বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে পর্ব-০৪

0
478

#বৃষ্টি_হয়ে_অশ্রু_নামে
#প্রভা_আফরিন
[৪]

রান্নাঘরের মেঝেতে বাজারের ব্যাগ উপুর করেই মা গলা চড়িয়ে বললেন,
“এসব কী এনেছিস? সব পচা-গলা টমেটো!”

রোদ মাথায় ঘেমে-নেয়ে সবেই বাজার থেকে ফিরেছি। পানির গ্লাসটা মুখে তুলতেই মায়ের কথায় অবাক হলাম। দেখলাম আসলেই টমেটোগুলো প্রায় গলে যাওয়ার মতো অবস্থা। ভালো, টাটকা টমেটোগুলো দেখে কিনতে গিয়েছিলাম। সবজিওয়ালা মামা তো হুজুর ছিল। মাথায় টুপি, গালভর্তি দাড়ি। ভাবলাম সৎ লোক হবে। কিন্তু লোকটি আমাকে আরেকবার শিখিয়ে দিলো পোশাকি রূপে কারো ভেতরটা বিবেচনা করা ঠিক না। পবিত্র বা শালীন পোশাক শুধু সুন্দর ব্যক্তিত্ব প্রকাশে নয়, অনেক সময় কদর্যতা ঢাকার মাধ্যমও হয়। কিংবা সবজিওয়ালার বিবেচনায় ব্যবসায় আমার মতো বোকা ক্রেতাদের বিভ্রান্ত করার মাধ্যম হয়ে ওঠে। শুধু সুযোগটা পাওয়ার অপেক্ষা মাত্র। ভাবনার মাঝে মা আবার চেঁচিয়ে উঠল,
“এতগুলো শাক এনেছিস কেন? কে খাবে এত? কাঁচামরিচ কোথায়? মরিচ ছাড়া শাক ভাজি হবে?”

অলস ভঙ্গিতে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বললাম,
“কাল এনে দেব। আমাকে আরেকবার মনে করিয়ে দিয়ো।”

“তাহলে কালকেই খাবি। আজ খাওয়ার কী দরকার?”

মা বাজারগুলো মেঝেতে ফেলেই গটগট করে পা ফেলে ঘরে চলে গেল। যেন এক জেদি কিশোরী কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা না পাওয়ায় রেগে গেছে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ক্লান্ত দেহ নিয়ে নিজেই সবগুলো সবজি গুছিয়ে ফ্রিজে তুলে রাখলাম। প্রতিবার বাজার করতে গিয়েই কোনো না কোনো ভুল করে ফেলছি। কোনোদিন দাম না জানার অজ্ঞতায় দ্বিগুণ দামে সবজি কিনছি, লাউটা কচি না বুড়ো তা না বুঝেই কিনে আনছি, পরিমাণ না বোঝার গণ্ডগোল তো আছেই। এরকম নানান ভুল প্রতিনিয়ত হয়েই যাচ্ছে। টাকার মায়ায় নিজেই নিজেকে বোঝাচ্ছি প্রথম প্রথম এমন ভুল হয়েই থাকে। এই ভুল থেকে আমি শিক্ষা গ্রহণ করছি। অথচ শিক্ষার কোনো প্রসার বা ব্যবহার এখনো অবধি করতে পারিনি।

ভাইয়া চলে যাওয়ার পর আমাকে সংসারের হাল ধরার চেষ্টায় নামতে হয়েছে। প্রথম প্রথম ভাইয়া দু-তিন দিন অন্তর এসে আমাদের সাথে দেখা করে, বাজার-সদাই সব করে দিয়ে যেত। একসময় তা সপ্তাহ, এরপর মাসে গড়ালো। তারপর একদিন ফোন করে বলল বিকাশে টাকা দেবে আমি যেন বাজার করে নেই। কথাটা শুনে বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারিনি। দুরত্ব যে চলে আসবে তা মস্তিষ্ক আগে থেকেই ভেবে রেখেছিল বলে খারাপ লাগাটাও টের পাইনি। শুধু মায়ের ব্যথাতুর মুখটা না দেখার ভান করে থেকেছি।

ভাইয়া যে খুব ভালো আছে তাও নয়। অফিস করে বেচারা সময়ই পায় না। আবার ভাবীকে রেগুলার চেক-আপে নিয়ে দৌড়াতে হয়। ভাবীর পরিবার এ বিষয়ে খুবই স্ট্রিক্ট। বড়ো হাসপাতালে মেয়েকে না দেখালে উনাদের ভেতর খুঁতখুঁত করে। খরচের ঝামেলা তো আছেই। সব মিলিয়ে ভাইয়ার অবস্থা কল্পনা করতে পারি। তবে অভিযোগ নেই। আমিও চাই তাদের সংসারটা বাঁচুক। আশেপাশে ভালোবাসার জঘন্য উদাহরণ দেখে দেখে জগতে সুখী প্রেমের অভাববোধ করছি। ভাইয়ার মুমূর্ষু সংসারটা যদি ভালোবাসার জোরে বেঁচে যায় আমি বরং খুশিই হবো।

এদিকে ভাইয়া চলে যাওয়ার পর মায়ের রাগ, ক্ষো’ভ য’ন্ত্র’ণা ঝারার একমাত্র ব্যক্তিটি এখন আমি। মা এই ভালো থাকে তো খানিক বাদে আবারো এলোমেলো আচরণ করে। বাড়িতে একা রেখে কোথাও যাওয়ার সাহস পাই না। ডিপ্রেশনের কবলে পড়ে মানুষ পারে না এমন কোনো কাজ নেই। মাকে চোখের আড়াল করলেই কেমন অস্থিরতা কাজ করে। তাই এখন মায়ের ঘরেই ঘুমাই। আগে যেখানে ছুটির দিনে একটু বেশি ঘুমানোর পরিকল্পনা করতাম সেটাও এখন অতীত। রাতভর সোস্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়ানো মেয়েটা এখন ভাঙাচোরা সংসার জোড়া দিতে ব্যস্ত।

বলা হয় সময় মানুষের সবচেয়ে বড়ো শিক্ষক। এইটুকু সময়ে অনুধাবন করতে পারলাম দুঃসময় সবচেয়ে স্বচ্ছ ও রূঢ় শিক্ষক। যে আমাদের মানুষ চেনার শিক্ষা দেয়। দুঃসময়ের শ্রেণিকক্ষে মানুষের সকল পর্দা খসে পড়ে, আসল রূপ বেরিয়ে আসে। যেখানে অভিনয়ের জায়গা নেই। সুসময়ের শ্রেণিকক্ষ আসলে ভান ও মুখোশে ঠাসা।

দুঃসময়ের করাল গ্রাসে বিলীন হতে থাকা ব্যক্তিটি এক সময় তার সহনশীলতা ও ধৈর্য দ্বারা আবার সুসময় ফিরিয়ে আনতে পারে। সে সুসময়টা আসলে শিক্ষার ফল। আগের মতো ভানে ঠাসা নয়, সেই সময় কষ্টার্জিত। আমি এবং আমার এই ছোট্টো পরিবারটি এখন সেই ভানহীন, কষ্টার্জিত সুসময়ের অপেক্ষায় চাতকের মতো অপেক্ষায় আছি। এই অপেক্ষা কবে ফুরাবে কে জানে!

পরদিন সকালে রান্না-বান্না সেরে ভার্সিটি গেলাম। এত চাপের মাঝে পড়াশোনাটা হয়ে উঠছে না। ড্রপ দিতেও চাই না। তাই পরিচিতদের বাঁকা দৃষ্টি উপেক্ষা করার সহ্য ক্ষমতা যোগানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছি। ভার্সিটি এলে আমি মনে মনে একটাই বাক্য আওড়াতে থাকি। আদনানের সঙ্গে যেন দেখা না হয়। কিন্তু একই ডিপার্টমেন্ট, একই ইয়ার হওয়ায় এড়াতেও পারি না। দেখা হয়, কথা হয় না বা বলা যায় আমি সে সুযোগটা তৈরি করি না। ইচ্ছে যে হয় না তাও নয়। খুব ইচ্ছে করে ছুটে যাই। মনের সমস্ত জমানো কথা উগড়ে দেই। কিন্তু আদনানের নির্লিপ্ত দৃষ্টিজোড়ায় আমার দৃষ্টি মিলতেই টের পাই ভেতর থেকে কেউ আমায় তাচ্ছিল্য করছে। ধিক্কার দিয়ে বলছে, যে আমাকে চায় না তার কাছে এত বে’হা’য়াপনা কেন? পা থমকে যায় তখনই। আমি পথ বদলাই। অবচেতন মন তবুও আশা করে আদনান হয়তো পিছু ডাকবে। কী অদ্ভুত মন নিয়ে বেঁচে আছি!

করিডোর ধরে ক্লাসের দিকে এগোতেই ইতু ছুটে এলো। বলল,
“এসেছিস অবশেষে! তুই এমন লেট লতিফ কবে থেকে হলি?”
প্রত্যুত্তরে হাসার চেষ্টা করলাম। বোধহয় পারলাম না। ইতু আবার বলে উঠল,
“আদনান তোর খোঁজ করে গেল একটু আগে।”
চমকে উঠলাম। নিশ্চিত হতে উচ্চারণ করলাম,
“আদনান?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“তা তো কিছু বলেনি। দেখা করবি তুই?”
আমি আবেগের পায়ে শেকল পরিয়ে নিজেকে সামলে নিলাম। বললাম,
“প্রয়োজন ফুরিয়েছে। মায়া বাড়ানোর কী দরকার?”
“যদি সম্পর্কটা ঠিক করতে চায়।”
আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম। ইতু বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল,
“ওকে ভুল বুঝিস না অনন্যা। কতই বা বয়স তোদের? সবে সেকেন্ড ইয়ার। আদনানের কোনো সাপোর্ট নেই পরিবার ছাড়া। তাই হয়তো আকস্মিক ঘটনাগুলোয় ঘাবড়ে গেছিল। এখন ধীরে ধীরে রিয়েলাইজ করছে।”
“ও এসব বলেছে তোকে?”
“না, তবে অনুমান করলাম।”
“অনুমান ও বাস্তবে তফাত আছেরে। আমি এখন স্পষ্ট অনুমানেও বিশ্বাস করতে পারি না।”

এরপর ইতু বিশেষ কিছু বলল না। ক্লাসে আদনানের দেখা পেলাম না। একটু স্বস্তি পেলাম। নির্বিঘ্নে সবকটা ক্লাস শেষ করে বেরোতেই আদনান ঝড়ের বেগে সামনে এসে দাঁড়ালো। অনুরোধের সুরে বলল,
“একটাবার কথা বলবে, প্লিজ!”

অনেকদিন পর এতটা কাছাকাছি দাঁড়িয়েছি। সেই লম্বাটে দেহ, এলোমেলো চুল, চেনা পারফিউমের ঘ্রাণ। তবুও কত অচেনা লাগছে! হৃদয়ে কেমন ঝড়ো বাতাস বইছে। আদনান উত্তরের আশায় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার উষ্ণ কণ্ঠের বিপরীতে চেয়েও শক্ত গলায় মানা করতে পারলাম না। বললাম,
“বলো কী বলতে চাও?”
“এখানেই? কফি শপে গেলে…”
আদনান আমার হাত ধরতে চাইলো। এক পা পিছিয়ে প্রত্যাখ্যান করে বললাম,
“এখানেই বলো।”
“আমার স্কলারশিপের ব্যবস্থাটা হয়ে গেছে, অনন্যা। সব গোছানো শেষ। আমি ফরেন চলে যাচ্ছি এ মাসে।”
কথাটায় কেমন প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিৎ বুঝতে পারলাম না। এতদিন বাদে শুধু এই কথাটা বলতেই ডাকল? শুকনো গলায় বললাম,
“কংগ্রাচুলেশনস! আমার হাতে সময় কম। বাড়িতে অসুস্থ মা একা আছে। এখন যাই।”

আদনানকে কিছু বলতে না দিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলাম। চোখদুটো জ্বা’লা করছে খুব। এটুকু সাক্ষাৎ, কথা বলা আমায় অনেকগুলো রাত ঘুমাতে দেবে না, আদনান কী তা বোঝে? এলোমেলো পা ফেলে রিক্সার খোঁজ করছিলাম। ঠিক তখনই সাগর ভাইকে দেখলাম। সাগর ভাই একটা শপ থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে চলে গেল। সঙ্গে এক অপরিচিত রমনী। মুহূর্তেই সারা গায়ে কে যেন মরিচ বাটা ডলে দিয়েছে মনে হলো। এই সেই লোক, যার সঙ্গে আপার অন্তরঙ্গ ফটো ভাইরাল হয়েছে। ভাইরাল তো এমনি এমনি হয়নি। আমার বিশ্বাস এই লোকটাই সব কলকাঠি নেড়েছে। আপার মৃ-ত্যুর পর লোকটার বিরুদ্ধে ভাইয়া ও মামারা মামলা করেছিল। কিন্তু রাশেদ ভাইয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে জল ঘোলা করতে দেওয়া হয়নি। তারা আগেই তা থামিয়ে দিয়েছে। নয়তো রাশেদ ভাইয়ের বোনের সংসারটা টিকতো না। ক্ষমতাধরদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়ানোর সাহস না থাকায় আমার মামারাও আর এগোয়নি। এতকিছুর পরেও সাগর ভাই কী বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে! অথচ আমার আপার দেহটাও বুঝি মাটিতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। দোষ যদি হয়ই সেটা শুধু মেয়েরই কেন? পুরুষের বেলায় কেন আঙুলটা সরাসরি ওঠে না? আজও বিশ্বাস করতে পারি না, আমার আপা এতটা নিচ কাজ করেছে। একটা সুখের সংসার গড়ে তোলায় আমার আপা নিবেদিত প্রাণ ছিল। আমি নিজের চোখে দেখেছি। শুভ্রা আপা তার নামের মতোই শুভ্র ছিল। অথচ এক ঘটনায় সব এলোমেলো হয়ে গেল।

দুপুরের তাপ ঝরা আকাশ মাথায় বাড়ি পৌঁছে দেখলাম মা রান্নাঘরে। অবাক হয়ে বললাম,
“রান্না কেন করছো? আমিতো দুপুরেরসহ রেঁধেছিলাম।”
“তোর মেজো চাচি আসছে খানিক বাদে। সঙ্গে কয়েকজন মেহমান আসবে। তুই ঘরে যা। গোসল করে ভালো দেখে একটা শাড়ি পরে নে।”

আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মেজো চাচি কেন আসছে বুঝতে খুব একটা অসুবিধে হলো না।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে