বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে পর্ব-১৫+১৬

0
489

বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে [১৫]
প্রভা আফরিন

কারো চা পান করার অভ্যাসকে যদি বাজে নেশা বলা হয় তাহলে সেটা জামশেদের রয়েছে। পল্টন থানার উপ পরিদর্শক তিনি। এমনিতে সিগারেটের গন্ধটাও সহ্য করতে পারেন না। কিন্তু চা পান করেন নেশারুর মতো। এই সময় তিনি কোনো ধরনের বিরক্ত করা পছন্দ করেন না৷ জামশেদ সকালের শুরুটা করেন রং চা দিয়ে। এরপর দুধ চা, মালাই চা, মশলা চা, লেবু চা কোনোটা বাদ রাখেন না। এখন উনার সামনে আধখাওয়া দুধ চায়ের কাপ। অত্যন্ত মনোযোগের সাথে তাতে বিস্কুট চুবিয়ে মুখে পুড়ছেন তিনি। তুষার লোকটির সামনে বসে আছে অস্থির ভঙ্গিতে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মাথার ওপরের সরকারি ফ্যানটা সরকারি ভঙ্গিতেই ঘুরছে বলে ঘাম শুকানোর বদলে বাড়ছে। সকাল থেকে পেটে কিছু না পড়ায় তৃষ্ণায় তুষারের গলা শুকিয়ে গেছে। পিয়াসার খবর পেয়ে যতটা গুরুতর ভঙ্গিতে সে ছুটে এসেছে পুলিশের কাছে সেটা যেন ততটাই গুরুত্বহীন। জামশেদ তাকে দেখে একবার শুধু বলেছেন,
“আপনিই ভিক্টিমের এক্স হাজবেন্ড?”
“জি।”
“বসুন।”

এরপর আয়েশ করে ধীরগতিতে চায়ের কাপে বিস্কুট চুবিয়ে খেয়ে চলেছেন। সামনের মানুষটা যেন সম্পূর্ণ অদৃশ্য। কিংবা এসআই নিজেই অন্যজগতে চলে গেছেন।
ধৈর্যচ্যুতি ঘটায় তুষার একসময় ডেকে উঠল,
“অফিসার!”

সঙ্গে সঙ্গে জামশেদের চায়ে ডোবানো বিস্কুটের অর্ধেকটা ভেঙে চায়ের তরলে ডুব দিল। জামশেদ যে অতিশয় বিরক্তবোধ করলেন সেটা প্রকাশ করলেন ভুরু কুচকে,
“আই হেইট ডিস্টার্বেন্স।”
“সরি!” তুষার সঙ্গে সঙ্গে যোগ করে।

জামশেদ আরেকটা বিস্কুটের সাহায্যে ডুবে যাওয়া বিস্কুটের ভগ্নাংশ উদ্ধার করতে করতে বললেন,
“চায়ের সঙ্গে বিস্কুটের সম্পর্কটা হচ্ছে প্রেমিক-প্রেমিকার মতো। চায়ের ভেতর বিস্কুট যখন গাঢ় প্রেমে ডুব দেয়, তখন বহিরাগত কেউ উত্যক্ত করলে বিস্কুট প্রেমিকা লজ্জায় চায়ের কাপেই তলিয়ে যায়। ফলস্বরূপ চা-প্রেমির মন ভাঙে। বোঝা গেছে?”

তুষার অবাক চোখে চায়। সে এসেছে নিজের এক সময়ের ভালোবাসার মানুষটার খু’নের ব্যাপারে কথা বলতে আর দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন ব্যক্তি কিনা তাকে চায়ের সাথে বিস্কুটের প্রেমের সংজ্ঞা দিচ্ছে! তুষার বলল,
“স্যার, আমি পিয়াসার ব্যাপারে জানতে চাইছি।”
“পিয়াসার ব্যাপারে আমরাও জানতে চাইছি বলেই আপনি এখানে।”

গম্ভীর গলায় জবাব দিয়ে জামশেদ পুনরায় চায়ে বিস্কুট চুবিয়ে খাওয়ায় মন দিলেন। অন্যদিকে অস্থিরতার পাশাপাশি তুষারের মনে জমতে থাকে বিরক্তি। বারবার মনে পড়ে গতকালের ফোনকলের কথাগুলো। এতদিন পর পিয়াসা কী বলতে চেয়েছিল তাকে?

জামশেদের চা খাওয়ার পর্ব চুকেছে। ঢেকুর তুলে এবার মনোনিবেশ করলেন সম্মুখে বসা যুবকের পানে।
“আপনিই তাহলে মি. তুষার?”
“জি।” তুষার নড়েচড়ে বসে।
“কী করেন? পেশা?”
“একটি ম্যানুফেকচার কোম্পানিতে চাকরি করি।”
জামশেদ মাথা নাড়লেন। যেন নিজের খোঁজ করে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছেন। পুনরায় জবান খুললেন,
“ভিক্টিমের সঙ্গে ডিভোর্স হয়েছে কবে?”
“বছরখানিক আগে।”
জামশেদ পুনরায় প্রশ্ন করলেন,
“শুনেছি আপনি ডিভোর্স দিতে চাননি? কেন?”
“ভালোবাসার সংসার বাঁচাতে চেয়েছি। পিয়াসা চায়নি।”
“কেন?”
“আমাদের সামাজিক অবস্থান ভিন্ন। প্রেমে অন্ধ হয়ে বিয়ে করলেও ও আমার মধ্যবিত্ত জীবনের সাথে এডজাস্ট করতে পারেনি।”
“ডিভোর্সের পর আপনাদের যোগাযোগ কেমন ছিল?”
“অযথা যোগাযোগ রাখিনি।”
“কিন্তু ভিক্টিমের কললিস্ট বলছে মৃ’ত্যুর আগে শেষ কলটা আপনাকেই করে। যার সঙ্গে বিগত বছরে কোনো যোগাযোগই নেই সে হঠাৎ খু’ন হওয়ার দিনই আপনাকে ফোন করল! স্ট্রেঞ্জ না?”

জামশেদের দৃষ্টি তীক্ষ্ণভাবে তুষারকে অবলোকন করে। তুষার বিচলিত হয় না। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই জবাব দেয়,
“আমার কাছেও স্ট্রেজ মনে হচ্ছে অফিসার। ও ফোন করে আমার কাছে ক্ষমা চাইলো। আরো কিছু বলতে চেয়েছিল। বলতে পারেনি। তার আগেই ফোন কেটে যায়। আমি ডায়াল করলেও সুইচ অফ পাই।”
“ক্ষমা চাইল কেন? আপনার সাথে কোনো অন্যায় করেছিল?”
“আইনের দৃষ্টিতে একে বোধহয় অন্যায় বলে না। তবে পিয়াসা আমার মনের সঙ্গে কিছু অন্যায় করেছে। আমার ভালোবাসাকে অপমান করেছে, আমার পরিবারকে অবমাননা করেছে, ক্ষণজন্মা সন্তানের মুখটা আমাকে দেখতে দেয়নি, পিতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করেছে…”
তুষার একটু থেমে স্তিমিত সুরে বলল,
“মৃ’ত মানুষের সম্পর্কে অভিযোগ করতে ভালো লাগছে না অফিসার। নিশ্চিত হয়ে বলতে পারছি না কোন বিষয়ের জন্য ক্ষমা চাইল।”

জামশেদ রসিকতা করে বললেন,
“আমি তো ভাবলাম বিষয়টা একটা আনওয়ান্টেড থ্রিলার স্টোরি হবে। প্রাক্তন অনেকদিন পর ফোন কর‍ল, আপনিও সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। ভিক্টিমের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। পূর্ববর্তী ক্ষোভের জেরে একপর্যায়ে ভারী কিছু দিয়ে ভিক্টিমের মাথায় মে’রে দিলেন। অতিরিক্ত র’ক্তক্ষ’রণে ভিক্টিভ মা’রা গেল। হতে পারে না?”

“কাহিনি সুন্দর৷ তবে আমার ব্যাপারে আপনাদের একটু খোঁজখবর করতে হবে। আমি কখনো রেগে নিয়ন্ত্রণ হারাই না, চেঁচামেচি করি না। গায়ে হাত তোলা দূরের কথা।”

“সাউন্ডস জেন্টেলম্যান! তবে কি জানেন, মানুষের খালি চোখেই পর্দা লাগানো থাকে। আমরা হলাম স্পষ্ট চোখের অন্ধমানব। অন্ধত্ব দূর করতে হয় বিচক্ষণতা দিয়ে।”

তুষার মাথা নুইয়ে চুপ রইল কিছুক্ষণ। এরপর বলল,
“আমি কী জানতে পারি ও কীভাবে মা’রা গেল?”

জামশেদ স্বল্পবাক্যে জানালেন,
“প্রাথমিক ধারণা মাথার আঘা’তে ও অতিরিক্ত র’ক্তক্ষ’রণে মৃ’ত্যু হয়েছে। ম’য়’নাত’দন্ত ও ফরেনসিক রিপোর্ট এলে বাকিসব বোঝা যাবে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্যই আপনাকে ডাকা৷ এরপর হয়তো আমাদের আবারো দেখা হবে। তখন আবারো জমিয়ে চা খাওয়া হবে। কিন্তু এবারের মতো মাঝপথে ডিস্টার্ব করবেন না।”
________________

অনন্যার আর হোস্টেলে ফিরে যাওয়া হয়নি। টিউশনি, অফিস, ক্লাস সব বাদ গেল। বড়ো মামী বলেছিলেন পাত্রপক্ষ ডাকবেন অথচ সে পরিস্থিতিও রইলো না। পিয়াসার খবরটা শুনে তারা সকলেই স্তব্ধ। সন্দেহভাজনের মধ্যে তুষারের নাম ওঠায় মনে মনে শঙ্কিতও। ওদের অস্থির জীবন সবেই স্থির হয়েছিল। স্বস্তিটা ছোঁয়া বাকি। ঠিক তখনই আবারো অস্থিরতা তাদের গ্রাস করে নিল! তার কিছুটা প্রভাব মামাবাড়িতেও পড়েছে।

ছোটো মামী তেরছা সুরে বলে বসলেন,
“যত ঝামেলা সব ওদের পেছনেই লাগে! মাঝে বাড়ির পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। বাচ্চাগুলোর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। আবির, নিবিড়কে আগামীকালই ওদের নানাবাড়ি পাঠিয়ে দেব।”

ধারাও চাচির কথার পালটা প্রত্যুত্তর করে বসল,
“ওরা তো তোমার সাথে বেশিরভাগ সময় নানাবাড়িতেই থাকে। বরং এখানে মাঝে মাঝে বেড়াতে আসে। আবার চলে যাওয়ার জন্য আলাদা করে বাহানার প্রয়োজন আছে?”

“শ্বশুরবাড়ি তো পাওনি। তাই বোঝো না কেমন জ্বালা।”

চাচির খোঁ চা বুঝে ধারার সর্বাঙ্গ জ্ব লে ওঠে। ইকরামের সঙ্গে বিয়ের পর বাবার বাড়িতেই থাকছে ও। কিন্তু ওর যাবতীয় খরচ ইকরামই বহন করে। সংসারেও যথেষ্ট অবদান রাখে। ধারা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। দূর্যোগের গন্ধ পেয়ে অনন্যা আগেই তার হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে এলো। মেয়েটা আজই স্বামীর সঙ্গে বেড়িয়ে বাড়ি ফিরেছে।

অনন্যা বলল,
“বাইরের ঝামেলায় টিকতে পারছি না। বেফাঁস কথা বলে ঘরে ঝামেলা বাঁধাস না।”

ধারা বলল,
“ঠিকই তো বলেছি। চাচি শুধু এ বাড়িতে না থাকার বাহানা খোঁজে। ধর্মে কর্মে এলার্জি কিনা! দাদুর সামনে তো আর যেমন ইচ্ছা চলতে পারে না। চাচা বিদেশ টাকা পাঠানো না বন্ধ করে সেই ভয়েই আলাদা হতে পারছে না। চাচার ইনকামের দুই টাকাও তো খরচ করে না সংসারের জন্য। সব নিজের একাউন্টে ভরছে। আবার আমাকে খোঁটা দেয়!”
অনন্যা সাংসারিক সমীকরণে মন দিচ্ছে না। ও বলল,
“ইকরাম ভাই কোথায়?”
“দোকানে গেছে। ডাকব?”
“না থাক। ভাইয়া আসুক আগে।”

তুষারের সঙ্গে সঙ্গে ইকরামও ফিরল। আঁখি বেগম ছেলের জন্য কেঁদেকেটে অস্থির। তিনি তড়িঘড়ি করে জামাকাপড় গোছাতে গোছাতে ছেলে-মেয়েকে বললেন,
“চল আমরা শহর ছেড়ে দূরে চলে যাই। এই শহর অভিশপ্ত। তোর বাবাকে নিয়েছে, বোনকে বাঁচতে দেয়নি। আমাদেরও বাঁচতে দেবে না।”

তুষার মাকে থামিয়ে অবসন্ন স্বরে বলল,
“আমারো তাই মনে হচ্ছে। সব ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাই। আর কোনো দেনাপাওনা নেই এ শহরে। কিন্তু মা, এখন বাড়ি ছাড়া মানেই বিপদ। পিয়াসার বিষয়টার সুরাহা দেখতে চাই আমি। ও আমাকে কী বলতে চাইছিল সেটাও হয়তো বের হতে পারে।”

ইকরাম হঠাৎ বলে উঠল,
“শ্রাবণকে ডাকব একবার? যদি কোনো সাহায্য করতে পারে।”

অনন্যা নামটা শুনে অবাক হয়। বলে,
“শ্রাবণকে কেন?”

“তুমি জানো না? শ্রাবণ তো এই এড়িয়ারই এসপি নিযুক্ত হয়েছে। সুতরাং পিয়াসা ভাবীর কেসটাও ওর আওতাধীন থানাতেই আছে।”

চলবে…

বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে [১৬]
প্রভা আফরিন

সূর্য হলো আঁধার শোষণকারী। সূর্যের আগমনে পৃথিবী নিকষ আঁধারের কোল থেকে আলোতে উঠে আসে। সজাগ প্রাণেরা মেতে ওঠে দিনের উল্লাসে৷ ব্যস্ত হয় দৈনন্দিন কাজে। আবার সূর্যই আঁধার বর্ষণকারী। রাঙা গোধূলিতে আলোর পসরা গুটিয়ে ধীরে ধীরে লীন হয় তার উপস্থিতি। সঙ্গে লীন হয় প্রাণের ব্যস্ততা। প্রকৃতি নিমজ্জিত হয় নিকষ বিশ্রামের কোলে। রাত মানেই বিশ্রাম কথাটা আবার সবার জন্য খাটে না। নৈশচারীদের রাতেই জীবনাচরণ। রাতেই তাদের কর্মব্যস্ততা। সুঘ্রাণ ছড়ানো ফুলগুলোও ফোটে রাতে। কেননা দিন রূপ প্রদর্শন করলেও রাতে সেই রূপ প্রদর্শিত হয় না। তাই রাতের ফুল ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে সৌন্দর্য বিস্তার করে। সকাল হতেই মূর্ছা যায়। মূর্ছা যায় না কেবল মানুষ। তারা দিন-রাত উভয় সময়েই সদর্পে বিচরণ করতে পারে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার অসীম শক্তি সৃষ্টিকর্তা তাদের মধ্যে দিয়েছেন। তাইতো ফুলের বিছানা থেকে ছিঁটকে পড়ে কাটার ওপর হাঁটতে শিখে গেছে অনন্যারা৷ প্রথম প্রথম ক্ষ’তের যন্ত্রণা ভীষণ ভোগাতো। আর এখন বিষে বিষে বিষক্ষয় হয়ে গেছে তাদের ভাগ্য। দুঃখ শুষে তাদের মন হয়ে গেছে নীলকণ্ঠরূপ। তবুও মানুষ তো! সহ্য ক্ষমতা তৈরি হলেও যন্ত্রণার জ্বালা একই থাকে।

সময়টা এখন মধ্যরাত। অনন্যা ঘুমন্ত মায়ের পাশে চুপচাপ বসে আছে। আজ তার ক্লাস, অফিস, টিউশনি সব কামাই গেছে। আগামীকাল ছুটির দিন। পরশু ফিরলে একগাল বকা খেতে হবে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। শফিক ভাই কল করেছিল। অনন্যা রিসিভ করেনি। ম্যাসেজের রিপ্লাইও দেয়নি। বাস্তব জীবনের সমস্যা অন্যকে জানিয়ে সহানুভূতি নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা ওর কোনোকালেই ছিল না। তারচেয়ে ফিরে গিয়ে একটা বাহানা দাঁড় করিয়ে দেবে। অবশ্য বাহানা নয়, সত্যি কারণ তৈরিই আছে। মা এখন অসুস্থ। উনার পাশে তো থাকতেই হতো।

দিন দিন মায়ের মানসিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে। মাঝে যাও একটু সুস্থ ছিল আজ সারাদিনের ঘটনায় তা আবারো উত্তপ্ত হয়ে গেছে। সারাক্ষণ আতঙ্ক, আশঙ্কায় কুঁকড়ে উঠছেন। স্বামী, সন্তান, সম্মান, সংসার হারিয়ে মানুষটা এখন মাঝনদীতে ভাসমান মাঝিবিহীন নৌকার মতো হয়ে গেছে। অল্প স্রোতের ধাক্কাতেই তাল হারিয়ে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছেন। ঘুমের মাঝেও কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছেন! অনন্যার কান্না পায়। বুকের ভেতর জমাট বিষাদেরা হঠাৎ হঠাৎ খুঁ’চিয়ে ওঠে। ও একটু মুক্ত বাতাসের খোঁজে ঘর থেকে বের হয়। উদ্দেশ্য ছাদে একটু হাঁটাহাঁটি করা। কিন্তু ও খেয়াল করল দোতলার সদর দরজা খোলা। অবাক হয় অনন্যা৷ সিড়িতে সর্বদা লো ভোল্টের হলুদ বাতি জ্বলে। সেই আলোয় নিচে উঁকি দিয়ে দেখল নিচতলায় অন্দরে ঢোকার কলাপসিবল গেইট ভেতর থেকে তালাবদ্ধ। অনন্যা সিড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে। ধারণা ঠিক। কেউ ছাদে উঠেছে। এক পা এগিয়েই থেমে গেল ও। চাঁদের আলোয় নবদম্পতি একে অপরের সঙ্গে মিশে চন্দ্রবিলাস করছে। অনন্যা সংকোচে দৃষ্টি নত করে। ছোটো বোনের মিষ্টি মুহূর্তে তার উপস্থিতি উভয় পক্ষের জন্যই বিব্রতকর। অনন্যা যেভাবে এসেছিল সেভাবেই শব্দহীন পায়ে সরে যাওয়ার সময় শুনতে পায় ধারার উচ্ছল কণ্ঠ নিসৃত সুখের মূর্ছনা। মনে পড়ে এমনই এক দিনের কথা। সেদিনও এই যুগল ছাদে অবস্থান করছিল। তাদের চোখেমুখে ছিল প্রিয় মানুষটাকে হারিয়ে ফেলার ভয়। সময়ের পরিবর্তনে আজ তাদের মনে আর কোনো ভয় নেই, আছে অনাবিল সুখ। অনন্যা সেদিনই নিঃশব্দে চলে গেছিল। আজও গেল। শুধু সময়ের সাথে তার জীবনের দুঃখগুলো আর গেল না!
_________________

জেলার মেধাবী ও তরুণ এসপি শাহনেওয়াজ শিকদার। সৌম্যদর্শন এই তরুণ অল্প বয়সেই মেধা ও কঠোর অধ্যাবসায়ের জোরে নিজের ক্যারিয়ার পাকাপোক্ত করে নিয়েছে। রাশভারী চলন, বিচক্ষণতা, চেহারার গাম্ভীর্য সবই যেন তার ব্যক্তিত্বকে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এসআই জামশেদ মনে মনে এই তরুণকে খানিক ঈর্ষা করেন। বয়সে তার চেয়ে ছোটো অথচ পদমর্যাদায় অনেক উপরে। ডাকতে হয় স্যার বলে। খানিক দুঃখও হয়৷ পড়াশোনায় তিনি বিশেষ ভালো ছিলেন না। প্রমোশন পেয়ে এ পর্যায়ে আসতেই অনেক বছর লেগে গেছে। অন্যদিকে ক্যাডাররা একলাফে ওপরের পদে আসীন হয়। তবে শাহনেওয়াজকে জামশেদের পছন্দও। এই পেশায় সৎ থাকাটা নিজের চরিত্র ও লোভের জন্য অনেক বড়ো চ্যালেঞ্জের বিষয়। সেদিক থেকে এই তরুণ এসপি এখনো পর্যন্ত কাচের মতো স্বচ্ছ। এই প্রসঙ্গে একদিন শাহনেওয়াজই বলেছিল,
“কাগজ না হয়ে কাচ হোন। কারণ কাচের গায়ে দাগ লাগলে তা তুলে ফেলা যায়। কিন্তু সাদা কাগজে দাগ লাগলে তা তোলা দুষ্কর। আমাদের পেশায় বড্ডো দাগের ছড়াছড়ি।”

শাহনেওয়াজ শহরে ছিল না গত সপ্তাহে। আজ ফিরেই থানায় এসেছিল। হুট করে পিয়াসা মা’র্ডার কেসটা চোখে পড়ল। সাধারণভাবে চোখ বুলাতে গিয়েই পরিচয়টা চোখে বাজল। নিশ্চিত হলো জামশেদের মুখে প্রাক্তন স্বামী তুষারের নাম শুনে। এই কেইসটা জামশেদ দেখছে। শাহনেওয়াজ তাকে জিজ্ঞেস করল,
“অফিসার, অগ্রগতি কতদূর?”

“স্যার, লা’শ ময়নাতদন্তে গেছে। স্পট থেকে কিছু নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পাঠিয়েছি। রিপোর্ট চলে আসবে দ্রুত। এদিকেও জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।”

“প্রাথমিক ধারণা কী?”

“মাথার আঘা’তে মৃ’ত্যু। তবে শরীরে কিছু ক্ষ’তও আছে। মনে হয় মৃ’ত্যুর পূর্বে ধ’স্তাধ’স্তিতে লিপ্ত ছিল।”

শাহনেওয়াজের চওড়া কপালে একটা সুক্ষ্ম রেখা ফুটে ওঠে।
“শুধু খু’ন নাকি ধ’র্ষ’ণের পরে খু’ন?”

“তেমন কোনো আলামত মেলেনি যদিও। কিন্তু একেবারে হেলা করা যায় না।”

“আমাকে যাবতীয় আপডেট দেবেন।”

জামশেদ মনে মনে বিরক্ত। কেইসের তদন্তের ভার তার কাঁধে থাকলেও চাপ তিনি নেন না। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কনসার্ন থাকলে চাপ আপনা-আপনি চলে আসে। হুট করে নবীন এসপি এই কেইসের ব্যাপারে আগ্রহ কেন প্রকাশ করছে ভেবে পেল না। এদিকে জামশেদের গলা শুকিয়ে এসেছে। শাহনেওয়াজের চোখ এড়ায় না এসআইয়ের মুখভঙ্গি। অ্যাডামস্ অ্যাপেলের ক্রমাগত ওঠানামা লক্ষ্য করে স্মিত হেসে বলে,
“অফিসার, আপনার বোধহয় তেষ্টা পেয়েছে। আপনি তো আবার পানির বদলে চায়ে গলা ভেজান।”
জামশেদ কাচুমাচু ভঙ্গিতে হেসে ফেলল।

পিয়াসা মা’র্ডার কেইসের মোড় ঘুরে গেছে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পর। সাধারণ চোখে এটাকে মাথায় আঘা’তের ফলে মৃ’ত্যু মনে হলেও পরবর্তীতে বেরিয়ে এলো চাঞ্চল্যকর তথ্য৷ ভিক্টিমের দেহের বিভিন্ন স্থানের ক্ষ’ত দেখে পুলিশ আগেই নিশ্চিত হয়েছিল মৃ’ত্যুর পূর্বে ধ’স্তাধ’স্তি হয়েছে। সেই ভাবনাকে তরান্বিত করে বডিতে পাওয়া গেছে ধ’র্ষ’ণের আলামত। শুধু তাই নয়, ভিক্টিমের শরীরে স্কোপালামিন ড্রা’গের অস্তিত্ব মিলেছে। পুলিশের কাছে এখন অপরাধীকে শনাক্ত করার একমাত্র ক্লু হচ্ছে ভিক্টিমের বডি থেকে পাওয়া স্পার্মের ডিএনএ। তদন্ত ধীরে ধীরে বেগবান হচ্ছে।

শাহনেওয়াজ শিকদার ওরফে শ্রাবণ ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেয়েই প্রতিবেশী ইসহাক রহমানের বাড়িতে মুখদর্শন দিল। ইকরাম ওকে দেখেই বলল,
“তোমার খোঁজ করেছিলাম গতকাল। শুনলাম আউট অফ টাউন।”

“অফিশিয়াল কাজ ছিল।”

“ব্যস্ত মানুষ হয়ে গেছো তাহলে! বসো, আমি চা দিতে বলি।”

কিছুক্ষণ বাদেই বসার ঘরে পদার্পণ হলো অনন্যার। নিঃশব্দ চলনে এগিয়ে এলো দুটি নিটোল পা। মাথায় ওড়না প্যাঁচানো। হাতে চায়ের সরঞ্জামাদি সংবলিত পাত্র। শ্রাবণ চোখ তুলে চাইল। পাশাপাশি বাড়ি হলেও ব্যস্ত জীবনের তালগোলে বহুদিন বাদে মুখোমুখি দেখা হলো দুজনের। অনন্যা ক্ষীণ হেসে দৃষ্টি বিনিময় করে। সেন্টার টেবিলে চায়ের ট্রে নামিয়ে ভাইয়ের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়।
বসার ঘরে এখন বাড়ির পুরুষেরা উপস্থিত। শ্রাবণই কথা এগিয়ে নিল,
“নিশ্চয়ই জানেন আমি কেন এসেছি।”

“পিয়াসার খু’নের ব্যাপারটা কতদূর এগোলো। আমাদের ছেলের কোনো রিস্ক নেই তো?” বড়ো মামা বলে উঠলেন।

শ্রাবণ মাথা নেড়ে বলল,
“সেই রাতে শেষ কলটা তুষারের কাছে এসেছে। রহস্যময় কল। এটা নিয়ে ঘাটাঘাটি হবে। তদন্তের স্বার্থে যতটুকু দরকার। এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। বরং তুষার সাহায্য করলে বিষয়টা সহজ হয়ে যাবে।”

তুষার দৃঢ় স্বরে বলল,
“আমি যতটুকু পারব করব। আমিও জানতে চাই শেষ মুহূর্তে আমাকেই কেন কলটা করেছিল। কীই না বলতে চেয়েছিল। অপ’রাধীর কোনো সূত্র পাওয়া গেল?”

শ্রাবণ মাথা নাড়ে,
“ভিক্টিমের দেহে স্কোপালামিন পাওয়া গেছে।”

শ্রাবণ খেয়াল করল তুষার হঠাৎ চমকে উঠেছে। অনন্যা জিজ্ঞেস করল,
“স্কোপালামিন কী?”

“মা’দ’ক। ডেভিলস ব্রেথ নাম শুনেছো?”

পুনরায় চোখাচোখি দুজনের। অনন্যা মাথা নাড়ে। সে শুনেছে এই নাম। ঢাকা শহরে এই ত্রা’সের কথা প্রায় সকলেরই জানা। উপস্থিত সবাইকে পরিষ্কার ধারণা দিতে শ্রাবণ বলে চলেছে,
“স্কোপালামিন একটি ভয়ংকর ড্রা’গ। শরীরে প্রবেশ মাত্রই ব্যক্তি বাস্তব বোধ হারায়। নিশ্বাসের মাধ্যমে শ্বাসনালীতে প্রবেশ করা মাত্রই দেহ বশ করে ফেলে। তাই একে শয়তানের শ্বাসও বলে। তখন আক্রান্ত ব্যক্তিকে যা বলা হবে স্বেচ্ছায় তাই করবে। এই ড্রা’গের সাহায্যে মানুষের সর্বস্ব লুট করা বিভিন্ন চক্র শহরের অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়ায়। টার্গেট করা ব্যক্তির কাছে গিয়ে ঠিকানা বা কোনো লেখা পড়তে দেওয়ার ছুতোয় একটা কাগজ নাকের সামনে ধরে। এরপর ব্যক্তি নিজে থেকেই সর্বস্ব তুলে দেয় চক্রের হাতে। পিয়াসার দেহেও এই জিনিসের অস্তিত্ব মিলেছে। হয়তো কোনোভাবে ড্রাগটা ভিক্টিমের দেহে প্রবেশ করিয়ে ধ’র্ষ’ণ করা হয়। এরপর মা’র্ডার! সবটাই ধারণামাত্র।”

তুষার দুহাতে মুখ ঢেকে মাথা নুইয়ে ফেলে। ইকরাম সান্ত্বনার একটা হাত রাখে ওর পিঠে। কিছুটা সময় নিয়ে তুষার মাথা তুলে তাকায় শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ নিরব চোখে ওকেই পর্যবেক্ষণ করছিল। তুষার বলল,
“শুভ্রা! এই ড্রা’গ শুভ্রার দেহেও পাওয়া গেছিলো।”

মুহূর্তেই সকলের স্তব্ধ দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো তুষারের ওপর। বড়ো আপার নামটা শ্রবণেন্দ্রিয়তে ধাক্কা দিতেই অনন্যা দুই হাতে মুখ চেপে ধরেছে। দৃষ্টিতে বিস্ময়!

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে