বর্ষণের সেই রাতে- ২ পর্ব-২০+২১

0
1718

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

২০.

অনিমার সেই দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আদ্রিয়ান শক্ত করে ওকে নিজের দিকে টেনে নিল। এতো শক্ত করে ধরেছে যে হাতে ব্যাথা পাচ্ছে ও। আদ্রিয়ান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

” সমস্যা কী তোমার?”

অনিমা কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলল,

” আমার কোন সমস্যা নেই। আর সমস্যা কেন হতে যাবে?”

” তাহলে এসব কী হ্যাঁ?”

” কোনসব?”

আদ্রিয়ান চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস ফেলে অনিমার চোখে চোখ রেখে বলল,

” অনি প্লিজ আমায় রাগীও না। রেগে গেলে কিন্তু আমার মাথা ঠিক থাকেনা। আই ডোন্ট ওয়ান টু হার্ট ইউ। সো প্লিজ ডোন্ট মেক মি।”

অনিমা ভ্রু কুচকে বলল,

” বুঝতে পারছিনা কী করেছি আমি? আগে সেটা তো ক্লিয়ার করুন।”

” সত্যিই বুঝতে পারছ না? না কি বুঝতে চাইছ না? এরকম কেন করছ? তিনদিন যাবত কথা বলা তো দূর ঠিক করে তাকাচ্ছোনা আমার দিকে। তোমার মুখটা দেখতেও আমাকে একপ্রকার যুদ্ধ করতে হচ্ছে। বেড়োনোর আগে তোমাকে খুঁজে পাইনা, বাড়ি ফিরে দেখি দরজা লক করে রেখে দিয়েছ। বুঝতে পারোনা তোমার সাথে কথা বলতে না পারলে, তোমাকে দেখতে না পারলে আমার কষ্ট হয়? দম বন্ধ হয়ে আসে?মেরে ফেলতে চাও আমাকে? কী করেছি কী আমি? এমন ব্যবহার করছো কেন?”

অনিমা এতক্ষণ শান্ত চোখে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে ছিলো। আদ্রিয়ানের কথা শেষ হতেই ও ধীর গলায় বলল,

” আমি আপনার সাথে কথা না বললে, কাছে না আসলে, আপনার এতো খারাপ লাগার তো কিছু নেই। কী হই আমি আপনার? আমাদের মধ্যে না কোন আত্মীয়তা আছে আর না কোন সম্পর্ক। আমিতো শুধুমাত্র আপনার আশ্রিতা, তাইনা?”

কথাটা শুনে আদ্রিয়ান অনিমার হাত ছেড়ে দিয়ে অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল অনিমার দিকে। তারপর বলল,

” আশ্রিতা?”

অনিমা এবারও একই ভঙ্গিতে বলল,

” নই?”

” তোমার কী সেটাই মনে হয়?”

” অন্যকিছু মনে হওয়ার কারণ আছে কী?”

আদ্রিয়ান অনিমাকে কিছু বলবে তখনই ওর ফোন বেজে উঠল। আদ্রিয়ান পকেট থেকে ফোন বেড় করে অনিমার দিকে একপলক তাকিয়ে ফোন রিসিভ করে হনহনে পায়ে বাইরে চলে গেল। অনিমা গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে রুমে বসে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিল। কী পেয়েছে কী লোকটা? এতো আলগা পিরীত কীসের? নিশ্চয়ই ঐ স্মৃতি ফোন করেছে তাইতো চলে গেল। যাবেই যখন আসার কী দরকার ছিল? এভাবে ইচ্ছাকৃতভাবে ওকে দুর্বল না করে দিলে কী লোকটার হচ্ছেনা, না-কি? মানছে যে ওকে আশ্রয় দিয়েছে। তাই বলে এভাবে বারবার মনে আঘাত করবে? না চাইতেও কেঁদে দিল অনিমা। বিরক্তি নিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরল। এইটুকু বয়সে জীবনের এতো এতো জটিলতা ভালো লাগছেনা ওর।

___________

জানালা দিয়ে সূর্যের আলো মুখে পরার সাথেসাথেই ভ্রু কুচকে ফেলল রিক। অনেক রাত করে শুয়েছে তাই চোখে এখনও ঘুম আছে। সেইজন্য উল্টো ঘুরে শুয়ে পরল। স্নিগ্ধা কফি নিয়ে রুমে এসে দেখে রিক এখনও ঘুমোচ্ছে। ঘরির দিকে তাকিয়ে দেখে এগারোটা চুয়ান্ন বাজে। এতোক্ষণ অবধি একটা ইয়াং ছেলে কীকরে ঘুমায় সেটাই বুঝে উঠতে পারেনা স্নিগ্ধা। তারওপর ছেলেটা না-কি আবার একজন ডাক্তার! ভাবা যায়! ও কফির কাপটা টি-টেবিলে রেখে রিকের কাঁধে হাত রেখে বলল,

” রিকদা? ওঠো?”

রিক ঘুমে ঘোরে আড়মোরা ভেঙ্গে বলল,

” নীলপরী মাথায় হাত বুলিয়ে দাও তো একটু। ঘুম পাচ্ছে আরও।”

স্নিগ্ধা বোকার মত কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলল,

” খবিশ লোকটা ঘুমের ঘোরেও নীলপরীকেই দেখে। সারাদিন শুধু নীলপরী আর নীলপরী। যা খুশি করুক আমার কী? আমি এত বকবক কেন করছি? ডাকার কাজ ডেকে দেই।”

স্নিগ্ধা এবার জোরে জোরে ডাকতেই রিক বিরক্তি নিয়ে স্নেহার হাত ধরে টান দিয়ে বসিয়ে বলল,

” নীলপরী তুমি..”

এটুকু বলে চোখ খুলে তাকিয়ে স্নিগ্ধাকে দেখে নিজেকে সামলে নিয়ে কপাল কুচকে বলল,

” কী হয়েছে কী? এভাবে চেচাচ্ছিস কেন?”

স্নিগ্ধা মেকি হেসে বলল,

” নীলপরীর স্বপ্ন দেখা শেষ হলে এবার কফিটা নিয়ে আমাকে উদ্ধার করো।”

রিক চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে বলল,

” কেন? তোর জ্বলছে?”

স্নিগ্ধা একটা ভেংচি কেটে বলল,

” বয়ে গেছে আমার। যেই বানর মার্কা চেহারা। তারজন্য আমার জ্বলবে। আমার পেছনে না আরও হ্যান্ডসাম হ্যান্ডসাম ছেলেরা ঘোরে। বুঝলে?”

রিক হাতে ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে বলল,

” তাই?”

” জি হ্যাঁ। তাই আমি তোমার মত ক্যাবলাকান্ত লোকেদের পাত্তা দেইনা।”

” তুই জানিস? মেডিকেলের মেয়েরা ক্লাসে ক্লাস করত কম, আমাকে দেখতো বেশি।”

” জানিতো! ওরা দেখত আর এটাই ভাবতো যে মানুষের কলেজে বনমানুষ এলো কোথাথেকে?”

রিক চোখ ছোট ছোট করে বলল,

” তাই না?”

স্নিগ্ধা দাঁত বের করে হেসে বলল,

” তাই তো।”

” তোকে তো..”

বলে রিক উঠতে নিলেই স্নিগ্ধা এক দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। রিক স্নিগ্ধার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে দিল। অনিমা যাওয়ার পর এই প্রথম এভাবে হাসল ও।

____________

ভার্সিটির একটা ক্লাস শেষ হওয়ার পর লম্বা ঘন্টা দুয়েক এর একটা ব্রেক আছে। তাই অনিমা আর অরুমিতা ক্যান্টিনে গিয়ে বসেছে। স্টুডেন্টরা বিরতিতে এখানেই এসে বসে আড্ডা দেয়। তাই জায়গাটায় ভার্সিটির বেশ অনেক ছাত্র ছাত্রীরাই আছে। অনিমা এক‍দম চুপচাপ বসে আছে। কিছুই ভালো লাগছেনা ওর। মন ভালো না থাকলে কিছুই ভালোলাগবে না এটাই স্বাভাবিক। ক্যান্টিনেও শুধু একটু কফিই খেয়েছে কিন্তু আর কিছুই খায়নি। অরুমিতা গালে হাত দিয়ে দেখছে অনিমাকে। তীব্র আর স্নেহা আজ এখনও আসেনি। বলেছে আসতে ঘন্টাখানেক লেট হবে। ওরা নেক্সট ক্লাস জয়েন করবে এসে। অরুমিতা বলল,

” তোর কী হয়েছে বলতো? কিছুই তো খেলিনা?”

” খেলাম তো। খিদে ছিলোনা বেশি।”

” অনিমা আমার মনে হয় তুই বেশি ভাবছিস। আদ্রিয়ান ভাই কী নিজে একবারও বলেছে সে স্মৃতিকে ভালোবাসে?”

অনিমা অসহায় দৃষ্টিতে না বোধক মাথা নাড়ল। অরুমিতা ভ্রু নাচিয়ে বলল,

” তাহলে?”

” কিন্তু এটাতো বলেছে যে অন্যকাউকে ভালোবাসে।”

অরুমিতা এবার অবাক হয়ে বলল,

” সত্যিই উনি বলেছেন যে তোকে না অন্য কাউকে ভালোবাসেন?”

অনিমা মুখ ছোট করে বলল,

” বলেছে কাউকে একটা ভালোবাসে।”

” সেটাতো তুই হতে পারিস?”

” সেটা হলেতো সরাসরিই বলতো যে উনি আমাকে ভালোবাসেন।”

” এখানে ভালোবাসা বাসির কথা চলছে বুঝি? আমাদের সাথেও একটু বলো? আমরাও তো শুনি?”

হঠাৎ পেছন থেকে কারো গলার আওয়াজ পেয়ে পেছনে চমকে তাকাল অনিমা আর অরুমিতা। তাকিয়ে দেখে রবিন ওর গ্যাং নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনিমা আর অরুমিতা দুজনেই উঠে দাঁড়াল। অনিমা রবিনের দিকে বিরক্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

” অরু চল?”

বলে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই অনিমার ওড়নাটা হাত টেনে ধরল। অনিমা দ্রুত ওড়নাটা হাত দিয়ে ধরে রেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো রবিনের দিকে। ক্যান্টিনে বসা সবার দৃষ্টি এখন ওদের দিকে। অনিমা ভাবতেও পারেনি রবিন সবার সামনে এটা করবে। অনিমা ওড়না ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছেনা। ওর কেঁদে দেওয়ার মত অবস্থা হয়েছে। কেউ কিছু বলতেও পারছেনা কারণ রবিনকে ওরা সবাই মোটামুটি ভয় পায়। অরুমিতা বলল,

” ভাইয়া ওড়না ছাড়ুন ওর।”

রবিন বাঁকা হেসে ওড়না টেনে অনিমাকে নিজের দিকে টেনে নিল। অনিমা এবার রাগে কেঁদেই দিল। অরুমিতার ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ও বুঝে উঠতে পারছেনা কী করবে। অনিমা কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলল,

” ছাড়ুন আমাকে।”

রবিন একটু হাসল। সাথে ওর গ্যাং এর ছেলেরাও। ওড়নাটা হাত দিয়ে একটু পেঁচিয়ে নিয়ে বলল,

” সেদিনতো খুব তেজ দেখাচ্ছিলে? আজ কী হল? আর তোমার সেই বন্ধু কী জেন নাম? হ্যাঁ তীব্র কই? সেদিন তো খুব হিরো সাজছিল।”

অনিমা এবার রেগে থাপ্পড় মারতে গেলে রবিন হাত ধরে বলল,

” আ.. আ, একবার থাপ্পড় মেরেছিলে তাই আজ এখন এভাবে আছো। আবার একই ভুল করছ?”

অরুমিতা বলল,

” ভাইয়া এটা কিন্তু ঠিক করছেন না ছেড়ে দিন ওকে।”

রবিন ঘাড় বাঁকা করে অরুর দিকে তাকিয়ে বলল,

” তুমি কী চাইছ তোমাকে ধরি?”

অনিমা এবার একটু চেঁচিয়ে বলল,

” ছাড়ুন বলছি।”

অনিমার এমন উঁচু গলাতে রবিন আরও রেগে গেল। ওড়নাটা জোরে টান দিল। ওড়নাটা পিন দিয়ে লাগানো থাকায় কাধ থেকে শুরু করে হাতার অনেকটা জায়গা নিমেষেই ছিড়ে গেল। পিনের তীব্র খোঁচায় কাধের অনেকটা জায়গা কেটেও গেল। ব্যাথা পেয়ে মৃদু আর্তনাদ করে উঠল ও। হাত দিয়ে নিজেকে ঢাকতেও পারছেনা কারণ রবিন একহাত ধরে আছে। অনিমা যতই হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে রবিন আরও শক্ত করে ধরছে। এবার ও অনিমার হাত মোচড় দিয়ে ধরল। এতো জোরে ধরেছে যে অনিমার মনে হচ্ছে ওর হাত সত্যিই ভেঙ্গে যাবে। এতোগুলো মানুষের মধ্যে কেউ এগোচ্ছেনা বরং অনেকে মজা নিচ্ছে। অরুমিতা বুঝে গেছে ও কিছুই করতে পারবেনা। তাই একটু দূরে গিয়ে কাউকে একটা ফোন করল। রবিন রাগে গজগজ করে বলল,

” আমাকে এই হাত দিয়ে থাপ্পড় মেরেছিলি না। এবার দেখি কত তেজ আছে তোর দেখা! আমাকে অপমান করা না? এবার দেখ সবার সামনে অপমানিত হতে কেমন লাগে!”

অনিমা ব্যাথায় চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিঃশব্দে কাঁদছে। সকলের সামনে এভাবে হেনস্তা হতে হবে কল্পণাও করেনি ও। রবিন বলল,

” ক্যাম্পাস বলে এইটুকুতেই ছেড়ে দিলাম। বাইরে কোথাও পেলে বুঝিয়ে দিতাম আমি কী জিনিস।”

বলে ধাক্কা দিয়ে ওখানে ফেলে রেখে চলে গেল। অরুমিতা দৌড়ে এসে দ্রুত ওড়নাটা তুলে অনিমার গায়ে ভালোভাবে জড়িয়ে ঢেকে দিয়ে উঠিয়ে চেয়ারে বসালো। অনিমা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এরমধ্যেই ওখানে ডিপার্টমেন্টের একটা ম্যাম এলেন। আসলে অনিমারই দুজন ক্লাসমেট গিয়ে ডেকে এনেছেন। অবাক করা বিষয় হল উনি এসে অনিমাকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই সকলের সামনে অনিমাকে উল্টোপাল্টা কথা শোনাতে শুরু করলে, জঘন্যরকম কথাও শোনালেন, এমনকি চরিত্র নিয়েও কথা বললেন। অনিমা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিল ওনার দিকে। এখানে ওর দোষ কোথায়? বাকিরাও অবাক হয়েছে, কিছু না জেনেই হঠাৎ এই মহিলার এই অস্বাভাবিক আচরণে। কিন্তু ওখানে উপস্থিত কেউ কিছুই বলল না। এবারেও একইভাবে মজা দেখল। অরুমিতা কিছু বলতে গেছিল ম্যাম ধমকে থামিয়ে দিয়েছে। শেষে যাওয়ার আগে বলে গেলেন,

” এসব নষ্টামি করতে ভার্সিটিতে আসার দরকার নেই। এখানে ভদ্র মেয়েরা পড়াশোনা করতে আসে। তোমাদের মত মেয়েদের জন্যেই আজকাল ভার্সিটির বদনাম হয়। যত্তসব।”

অনিমা এতক্ষণ ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না আটে রাখলেও ম্যাম যাওয়ার পর জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। অরুমিতা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ম্যামের যাওয়ার দিকে। কী হল বুঝতেই পারল না ও। অনিমার কাধের সাইডটা ভীষণ জ্বালা করছে ওর, হাতেও ব্যাথা করছে। অরুমিতা দুবার চেষ্টা করেছে ওকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে এখান থেকে। কিন্তু অনিমা শক্ত হয়ে বসে কান্না করছে। আস্তে আস্তে সবাই আস্তে আস্তে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল। অনিমার কাঁদতে কাঁদতে হিঁচকি উঠে গেছে। অরুমিতাও কেঁদে দিয়েছে। এরমধ্যেই হন্তদন্ত হয়ে ক্যান্টিনে ঢুকল আদ্রিয়ান। আদ্রিয়ানকে দেখে ওখানের সবাই হা করে তাকিয়ে আছে। বিশ্বাস হচ্ছেনা কারও যে আদ্রিয়ান এসছে। আদ্রিয়ান চোখ অনিমার দিকে পরতেই ওর পায়ের গতি ধীর হয়ে গেল। অনিমাকে এভাবে দেখে চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেছে ওর। মুহূর্তেই মুখের রং বদলে গেল।ধীরপায়ে অনিমার সামনে দাঁড়াল। অনিমার চোখ আদ্রিয়ানের ওপর পরতে ও কোনরকমে উঠে দাঁড়িয়ে আদ্রিয়ানের মুখের দিকে তাকালো। আদ্রিয়ান ধীরে ওর গালে হাত রাখতেই ওর ঠোঁট আপনাআপনি ভেঙে এলো। দুবার ফোঁপানোর মত করে আওয়াজ করে আস্তে করে ঢলে পরল আদ্রিয়ানের বুকে।

#চলবে…

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

২১.

আদ্রিয়ান এর দৃষ্টি এতক্ষণ অনিমার কাধের ক্ষত আর ছেঁড়া পোশাকের অংশেই ছিল। অনিমা বুকের ওপর পরাতেই আদ্রিয়ানের হুশ এল। অনিমা এখনও কেঁপে কেঁপে উঠছে আর নিঃশব্দে কাঁদছে। অতিরিক্ত কান্না আর মেন্টাল প্রেশারে দুর্বল হয়ে পরেছে। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু নেই। আদ্রিয়ান একহাতে অনিমাকে জড়িয়ে নিয়ে ওপর হাতে অনিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

” স্টপ ক্রায়িং, কিচ্ছু হয়নি, আমি এসে গেছি তো। চুপ!”

অনিমা শক্ত করে আদ্রিয়ানের টিশার্ট খামচে ধরল। সবাই চরম অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অনিমা আদ্রিয়ানের দিকে। সবার মনে এখন একটাই প্রশ্ন। অনিমার সাথে আদ্রিয়ানের কী সম্পর্ক? এরমধ্যে ওখানে অভ্রও চলে এল, সাথে আদ্রিয়ানের দেহরক্ষীরাও। অনিমাকে এভাবে দেখে অভ্রও বেশ অবাক হল। সবাই শক থেকে বেড় হতেই ফোন বেড় করল ভিডিও করব বলে, অনেকে তো এই পরিস্থিতিতেও সেল্ফির জন্যে এগোচ্ছিল। তখনই আদ্রিয়ান একটু জোরে বলল,

” একজনের ফোনও যাতে ওপরে না ওঠে।”

সাথে সাথেই দেহরক্ষীরা সবাইকে আটকে নিল। এবং কাউকে ভিডিও করতে দেয়নি। দ্রুত ক্যান্টিন ফাঁকা করে দিল। অনিমার কোন রেসপন্স না পেয়ে আদ্রিয়ান বুঝতে পারল যে ও অজ্ঞান হয়ে গেছে। তাই ওকে দুহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরল আদ্রিয়ান। ফর্সা মুখ লালচে আভা ধারণ করেছে ওর। অভ্রও যে কিছু বলবে সেই সাহস পাচ্ছেনা। আদ্রিয়ান অরুমিতার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল,

” কী নাম ছেলেটার?”

অরুমিতা তোতলানো কন্ঠে বলল,

” র-রবিন। মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ার।”

আদ্রিয়ান ওর দুজন লোকের দিকে তাকাতেই ওনারা মাথা নেড়ে কোথাও একটা গেল। এরপর ও অনিমাকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,

” মিডিয়ার কোন লোক যাতে ক্যাম্পাসে ঢুকতে না পারে সেই ব্যবস্থা করো। একটা লোকও না। আর ডক্টর ডাকো ফাস্ট!”

অভ্র মাথা নাড়ল। আদ্রিয়ান অনিমাকে কোলে নিয়ে এগোতে নিলেই ডিন আর কিছু প্রফেসর এলো ওখানে। আসলে ওনারা আদ্রিয়ানের আসার খবর শুনেই এসেছেন। আদ্রিয়ান শক্ত চোখে ওনাদের দিকে তাকিয়ে বলল,

” এখন খোশ গল্প করতে পারব না। শী নিড রেস্ট। জায়গা এরেঞ্জ করুন, ফাস্ট !”

ওনাদের একজন বলল,

” শিওর আমি এরেঞ্জ করে দিচ্ছি। আপনি ওকে নিয়ে আসুন।”

ডিন আর ডিপার্টমেন্টের অনেকেই চেনে অনিমাকে। ভর্তির সময় আলাপ করিয়ে দিয়েছিল আদ্রিয়ান। আর যারা চেনেনা তাদের মনে এখন একটাই প্রশ্ন আদ্রিয়ানের সাথে কী সম্পর্ক এই মেয়ের? আদ্রিয়ান ভেতরে নিয়ে অনিমাকে শুইয়ে দিল। অরুমিতা এসে অনিমার মাথার কাছে বসল। অনিমার কাধ থেকে চুইয়ে রক্ত বেড় হচ্ছে। আদ্রিয়ানের দৃষ্টি ওখানেই আটকে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে রাগে ফেটে পরছে ও। কিন্তু ও এখনো একবারও জানতে চাইছেনা পুরো ঘটনাটা কারণ এখন ওর কাছে ফার্স্ট প্রায়োরিটি হচ্ছে অনি। তখন তীব্র আর স্নেহা প্রায় হাফাতে হাফাতে এলো ওখানে। তীব্র বলল,

” অরু অনি ঠিক আছে। আসার সময় শুনলা..”

এটুকু বলে দেখল অনিমাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। স্নেহা দ্রুত পদে এসে অনিমার মাথায় হাত রেখে বলল,

” কী হয়েছে ওর? এভাবে শুয়ে আছে কেন?”

অরুমিতা বলল,

” ডক্টর আসছে তোরা বস এখন।”

অাদ্রিয়ান চুপচাপ বসে আছে। আপাতত ওর কিছু বলার ইচ্ছে নেই। সারা ক্যাম্পাস জুড়ে কানাঘুষা হচ্ছে এই বিষয়টা নিয়ে, কয়েকজন প্রফেসরও এই বিষয়টা নিয়ে খুব চিন্তিত। ডক্টর এসে ফার্স্ট এইড করে দিয়ে, একটা ইনজেকশন দিল। আস্তে আস্তে ওর জ্ঞান ও ফিরে এলো। কিন্তু ও চুপচাপ শুয়ে আছে কিছু বলছেনা। ঔষধ লিখে দিয়ে বলল,

” আসলে ভয় আর মেন্টাল স্ট্রেসের কারণে অজ্ঞান হয়ে গেছিল। এখন উনি ঠিক আছেন। একটু খেয়াল রাখবেন।”

অভ্র গিয়ে ডক্টরকে একটু এগিয়ে দিয়ে এলো। ডিন এসে বলল,

” মিস্টার জুহায়ের আপনি ভাববেন না। আমরা দেখব ব্যাপারটা।”

আদ্রিয়ান সেই কথায় পাত্তা না দিয়ে অনিমার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে অরুমিতাকে বলল,

” কী হয়েছিল শুরু থেকে বলো।”

আদ্রিয়ান এর বলার ভঙ্গিটাই এমন ছিল যে অরুমিতা কিছু না ভেবে গড়গড় করে সব বলে দিল। ঐ ম্যামের কথাও বলল। সবটা শুনে আদ্রিয়ান শুধু ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। আর কেউ না জানলেও অভ্র জানে এই হাসিটার মানে। ডিন আবার বলল,

” দেখুন আমরা স্টেপ নেব। কিন্তু প্লিজ এ খবরটা যেন কলেজের বাইরে না যায় প্লিজ। আমাদের কলেজের রেপুটেশনের প্রশ্ন।”

আদ্রিয়ান একটু হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

” ম্যাডামকে ডাকুন! সবার সাথে আলাপ হল ওনার সাথেই হলোনা। ডাকুন, ডাকুন।”

ডিন দ্রুত সেই ম্যামকে ডেকে পাঠালো নিজের রুমে। আদ্রিয়ান অরুমিতা আর স্নেহাকে অনিমার খেয়াল রাখতে বলল। এরপর ডিনের সাথে ডিনের রুমে গেল। ওর সাথে অভ্র আর তীব্রও গেল। ডিনের রুমে কয়েকজন প্রফেসর আছেন। তীব্র আর অভ্র সাইডে দাঁড়িয়ে আছেন। আদ্রিয়ানের সামনের চেয়ারে ম্যাম বসে আছেন। ওনার মনে এখন ভয় ঢুকে গেছে। আগে যদি জানতো যে অনিমা আদ্রিয়ান আবরার জুহায়ের পরিচিত কেউ তাহলে রবিনের কথায় এসব করত না। আদ্রিয়ান নিজের নখ দেখতে দেখতে বলল,

” তো ম্যাম? আপনি যখন ক্যান্টিনে গেলেন? কী করছিল মেয়েটা?”

ম্যাম ভয়ে ভয়ে বললেন,

” বসে ছিল।”

” আর?”

” কাঁদছিল।”

” আর কিছু?”

” হ্যাঁ কাধ কেটেও গেছিল।”

আদ্রিয়ান এবার চোখ তুলে তাকিয়ে বলল,

” তো এগুলোর মধ্যে কী এমন বৈশিষ্ট্য ছিল যেটা দেখে একটা মেয়েকে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়া যায়?”

ম্যাডাম চুপ করে আছে। আদ্রিয়ান উত্তরের আশায় কিছক্ষণ তাকিয়ে রইল। কিন্তু কোন উত্তর না পেয়ে চেঁচিয়ে বলল,

” কী হল বলুন!”

উপস্থিত সবাই হালকা কেঁপে উঠল। আদ্রিয়ান এবার রাগী কন্ঠে বলল,

” জাস্ট বিকজ অফ ঐ ছেলেটা আপনার রিলেটিভ আপনি একটা মেয়ে হয়ে একটা মেয়েকে অপমান করতে দুবার ভাবলেন না? যেখানে আপনার গিয়ে ওকে সাহস দেওয়ার কথা, সামলানোর কথা সেখানে উল্টো ওকে এধরণের জঘন্য কথা বলতে বিবেকে বাঁধে নি। আবার আপনাকে সবাই ম্যাম বলে ডাকে? নিজেকে মহিলা বলে দাবী করেন আপনি?”

আদ্রিয়ানের কথাগুলো যেন রুমে কম্পিত হচ্ছে। কেউ কিছু বলতে পারছেনা। ঐ ম্যাম তোতলানো কন্ঠে বলল,

” আমি জানতাম না যে ও আপনার কেউ হয়?”

” ওও। জানতেন না? মানে একটা মেয়ে যদি কোন রেপুটেড, হাই ক্লাস ফ্যামিলি থেকে বিলং করে তাহলে ও নিরাপদ? কিন্তু সেই মেয়েটাই যদি মিডেলক্লাস হয় দেন ওর সাথে যা ইচ্ছে করা যায়? এটাই চিন্তা আপনার।”

ম্যাম আর কিছু বলতে পারলেন না। অযুহাত দেওয়ার মত কিছু আর অবশিষ্ট নেই। আদ্রিয়ান একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,

” আপনি একজন মেয়ে বলে এবং একজন প্রফেসর বলে আজ আমার হাত থেকে বেঁচে গেলেন। নইলে যার কারণে ঐ মেয়েটার চোখ দিয়ে জল বেড় হয় তাকে আমি ছেড়ে দেই না। কিন্তু, সরি টু সে ম্যাম আজকের পর আমি আপনাকে এই কলেজে আর দেখতে পারব না।”

ম্যাম অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,

” দেখুন আপনি শুধুই একজন রকস্টার। তাই এই ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করার অধিকার আপনার নেই।”

আদ্রিয়ান বাঁকা একটা হাসি দিয়ে বলল,

” সেটা কাল সকালে বুঝতে পারবেন।”

এরমধ্যেই সেই দুজন লোক এসে বলল,

” স্যার নিয়ে এসছি ওকে মাঠে আছে।”

আদ্রিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে বেড়িয়ে গেল। অভ্রর গেল পেছন পেছন। তীব্র একটু অবাক হয়েছে আজ। আদ্রিয়ানকে এভাবে কখনও দেখেনি। ডিনও কিছুই বললেন না। চেয়ারে বসে ঢকঢক করে গ্লাস ফাঁকা করে ফেললেন। কারণ আদ্রিয়ানকে উনি কিছুটা হলেও চেনেন। ক্যাম্পাসের বাইরে মিডিয়া চলে এসছে ওলরেডি কিন্তু কড়া পাহারার জন্যে ভেতরে আসতে পারছেনা। আদ্রিয়ান সোজা অনিমার কাছে গেল গিয়ে দেখে অনিমা চুপচাপ বসে আছে। আদ্রিয়ান ওর হাত ধরে দাঁড় করিয়ে বলল,

” চল।”

অনিমা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছেনা ওদের অনুসরণ করে বাকিরাও আসছে। আদ্রিয়ান অনিমাকে নিয়ে মাঠের মাঝে গেল। অনিমা তাকিয়ে দেখে রবিন আর ওর সেই গ্যাং এর লোকেরা দাঁড়িয়ে আছে। অনিমা একটু ভয় পেয়ে পেছাতে নিলেই আদ্রিয়ান হাত শক্ত করে ধরে টেনে রবিনের সামনে নিয়ে দাঁড় করালো।রবিন আদ্রিয়ানকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণ সবার মুখে শুনেছে ব্যাপারটা। কিন্তু এটা বুঝতে পারছেনা এতোবড় রকস্টারের সাথে অনিমার কী সম্পর্ক? আত্মীয় নয় তো? হলে বা কী? ওর বাবারও কী কম পাওয়ার না-কি? যা করেছে বেশ করেছে। তবুও নিজেকে সামলে রবিন বলল,

” আপনি আমাদের এখানে নিয়ে এলেন কেন?”

আদ্রিয়ান অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,

” থাপ্পড় মারো ওকে। এখন, আমার সামনে। যতগুলো ইচ্ছে। চাইলে তোমার জুতো খুলেও মারতে পারো। যেভাবে ইচ্ছে। জাস্ট গো ফর ইট!”

অনিমা অবাক হয়ে তাকাল আদ্রিয়ানের দিকে। রবিনও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আদ্রিয়ানের কোন ভাবান্তর নেই।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে