#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-০৫
______________
থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে পুরো জমিদার বাড়ি জুড়ে। বাড়ির উঠানেই চেয়ার পেতে বসে আছে রাগান্বিতার বাবা মোতালেব তালুকদার। তার পাশেই ছাতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাশেম ব্যাপারী। কাশেম হলো মোতালেবের এসিস্ট্যান্ট সবসময় মোতালেব তালুকদারের সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। কিছু জরুরি কাজের জন্য গত দু’দিনের ছুটি নিয়ে নিজের গ্রামে গিয়েছিল কাশেম আজই এসেছে। রাগান্বিতা দাঁড়িয়ে আছে তাদের বাড়ির সদর দরজার সামনে। ইমতিয়াজ আসবে এখন? তার বাবা খবর পাঠিয়েছে ইমতিয়াজকে এখানে আসার জন্য বলা হয়েছে। রাগান্বিতা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎই জমিদার বাড়ির পরিবেশটা কেমন যেন করে উঠলো। গাছের পাতা নড়লো, ধূলো উড়লো হাল্কা। বাড়ির একদম সামনে থাকা কালো গেটটা খুলে বাড়ির ভিতর পা রাখলো ইমতিয়াজ। চোখের চশমাটা ঠিক করলো একবার। বাড়ির সামনেই বড় বড় অক্ষরের লেখা ছিল ‘তালুকদার ভিলা’। ইমতিয়াজ মনে মনে পড়েও ছিল একবার। ইমতিয়াজ ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলে রাগান্বিতাদের বাড়ির ভিতরে। বেশি দূর হাঁটা লাগলো না, তার আগেই চোখ পড়লো বাড়ির উঠানে বসে থাকা রাগান্বিতার বাবার দিকে। ইমতিয়াজ রাগান্বিতার বাবার সামনে গিয়েই হাত উঠিয়ে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম জমিদার সাহেব।”
রাগান্বিতার বাবাও এক গম্ভীর আওয়াজে জবাব দিলেন,
“ওলাইকুম আসসালাম। তুমিই ইমতিয়াজ?”
সরল কণ্ঠে বললো ইমতিয়াজ,
“জি আমি ইমতিয়াজ, ইমতিয়াজ সিকদার।”
“আগে তো এই গ্রামে তোমায় কখনো দেখি নি।”
“আসলে আমি শহরে থাকি আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার বাবা মা আমায় নিয়ে শহরে গিয়েছিলেন। আমি শহরেই থাকি কিছুদিনের জন্য গ্রামের বাড়ি ঘুরতে এসেছি।”
“একা?”
“জি।”
“কোথায় উঠেছো?”
“ওই সামনেই জায়গাটার নামটা ঠিক জানা হয় নি।”
“তোমার বাবার নাম?”
“নাম বললে হয়তো আপনি চিনবেন না আপনার দাদা বা বাবা হয়তো চিনতেন। আমার বাবার নাম মোশারফ সিকদার।”
মোতালেব তালুকদার সত্যি চিনলেন না কিন্তু অবাক হলেন ইমতিয়াজের বলা তার দাদা আর বাবার চিনতে পারার কথাটা শুনে। খানিকটা অবাক হয়ে বললো রাগান্বিতার বাবা,
“আমার বাপ-দাদা তোমার বাবাকে চিনে এটা তুমি জানলে কি করে?”
“বাবা বলেছে আপনার দাদার নাম মেহেরআলী তালুকদার তো আর আপনার বাবার নাম সোবহান তালুকদার তাই না।”
মোতালেব যেন না চাইতেই হতভম্ব হয়ে গেলেন ইমতিয়াজের কথা শুনে। তার দাদার নাম তো তারই ঠিকভাবে মনে নেই অথচ এই ছেলে তার দাদার নাম গড়গড় করে বলে দিল। মোতালেব তালুকদার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন ইমতিয়াজের দিকে। বললেন,
“তুমি কে বলো তো?”
খানিকটা হাসলো ইমতিয়াজ ফের জবাব দিলো,
“এই মাত্রই তো বললাম আমি ইমতিয়াজ, ইমতিয়াজ সিকদার।”
খানিকটা তাজ্জব বনে গেলেন মোতালেব তালুকদার। তবে নিজেকে সামলালেন গম্ভীর আওয়াজে বললেন,
“পরশু তুমি সন্ধ্যার দিকে সামনের ওই জঙ্গলটায় গেছিলে?”
“জি জমিদার সাহেব। বাঁশি বাজাচ্ছিলাম।”
“সন্ধ্যার সময় কে বাঁশি বাজায়?”
“এই কথাটা রাগান্বিতা মানে আপনার মেয়েও বলেছিল। আমিই বাজাই।”
“নিজেকে কি খুব চালাক ভাবছো?”
“একদমই না। ওইদিন মনটা খুব চাইছিল বাঁশি বাজাতে তাই বাজিয়েছিলাম।”
“মন চাইলেই অসময়ে জঙ্গলে গিয়ে বাঁশি বাজাবে। যদি তোমার মন মানুষ খুন করতে চায় তখন?”
ঝটপট জবাব ইমতিয়াজের,
“করে দিবো।”
সঙ্গে সঙ্গে মোতালেব, কাশেম আর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাগান্বিতা পুরো তাজ্জব বনে গেল। রাগান্বিতা তো বলেই ফেললো,
“ছেলেটা কি পাগল!”
রাগান্বিতার বাবা খুব অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো ইমতিয়াজের মুখের দিকে। বললো,
“কি বললে তুমি?”
“না মানে আজ পর্যন্ত এই জিনিসটা কখনো করতে ইচ্ছে হয় নি। ইচ্ছে হলে হয়তো করে দিতাম তাই বললাম। আমায় আবার খুনি ভাববেন না কিন্তু জমিদার সাহেব।”
রাগান্বিতার বাবা কি বলবেন বুঝতে পারছে না। ছেলেটা তার সামনে খুন করার বিষয়টা নিয়ে এত ইজিলি কথা কি করে বলতে পারছে। ছেলেটা কি সহজ সরল বোকা টাইপের। রাগান্বিতার বাবা ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোমার মন চাইলে তুমি সত্যি মানুষ খুন করতে পারবে?”
“আসলে হয়েছে কি জমিদার সাহেব খুন বিষয়টা আমি কখনো সেইভাবে বড় করে দেখিনি তাই কথাটা বলে ফেললাম। তবে মানুষ খুন করা এত সহজ নাকি।”
লাস্ট কথাটা রাগান্বিতার দিকে তাকিয়ে বললো ইমতিয়াজ। মেয়েটা শাড়ির আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। মনে হচ্ছে তারই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। ইমতিয়াজ দৃষ্টি সরালো। বললো,
“আরো কি কিছু জানার আছে জমিদার সাহেব?”
“তুমি কি করো?”
“পড়াশুনা তবে আমার নিজস্ব একটা ব্যবসা আছে পড়াশোনার পাশাপাশি আমি সেই ব্যবসাটাও করি।”
“কিসের ব্যবসা?”
“তাঁতের।”
“আচ্ছা পরশু রাতে যে একটা ছেলের খুন হয়েছিল এ সম্পর্কে তুমি কিছু জানো?”
“জানি বলতে শুনেছি আমি তো আর ছেলেটাকে চিনি না কখনো দেখিই নি। তবে শুনেছি খুন হয়েছিল নাকি।”
আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না মোতালেব তালুকদার। শুধু বললেন,
“ঠিক আছে তুমি এবার যেতে পারো,আবার ডাকলে এসো।”
“ঠিক আছে জমিদার সাহেব আসসালামু আলাইকুম।”
“হুম ওলাইকুম আসসালাম।”
ইমতিয়াজ আর দাঁড়ালো না দু’পলক রাগান্বিতাকে দেখেই বেরিয়ে গেল। রাগান্বিতাও দেখলো তা। ইমতিয়াজ যেতে সেও চলে গেল বাড়ির ভিতরে। অন্যদিকে রাগান্বিতার বাবা তাকিয়ে রইলো ইমতিয়াজের যাওয়ার পানে। ছেলেটার কথাবার্তা ঠিক কেমন যেন ঠেটকো তার তবে কারো কাছে তা প্রকাশ করলেন না। হঠাৎ যেন কি একটা মনে পড়লো রাগান্বিতার বাবা হাল্কা উচ্চ স্বরে বলে উঠলেন,
“ইমতিয়াজ দাঁড়াও।”
ইমতিয়াজ দাঁড়িয়ে পড়লো। কিছু একটা ভাবতে ভাবতে পিছন ঘুরলো। খানিকটা ভ্রু-কুচকে বললো,
“জি বলুন।”
কাশেমকে ডাকলো মোতালেব তালুকদার। বললো,
“পোলাডারে ভিতরে নিয়া যা কাশেম সঙ্গে রাগান্বিতাকে বলবি কিছু মিষ্টি আর পানি দিতে তুই তো জানিস আমাদের পরিবারে একটা নিয়ম আছে মেহমানদের খালি মুখে বিদায় দিতে নেই।”
ইমতিয়াজ শুধু শুনে গেল জবাবে কিছু বলবে কিন্তু রাগান্বিতার বাবা বলতে দিলেন না। কাশেম ইমতিয়াজকে ভিতরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলো ইমতিয়াজও আর বারণ করতে না পেরে চললো কাশেমের পিছু পিছু। তবে যাওয়ার আগে রাগান্বিতার বাবার দিকে তাকালো খুব তার মনে হলো,
“জমিদার সাহেব বোধহয় খুব ভালো মানুষ।”
—–
ডাইনিং টেবিলের পাশেই ছিল একটা জানালা। জানালার পাশে বিশাল একটা গাছ। গাছটার উচ্চতা হয়তো দোতলার ছুঁই ছুঁই। ইমতিয়াজ চেয়ারে বসে আছে তার সামনেই বাটিতে করে মিষ্টি আর পানি রাখা রাগান্বিতা মাত্রই তার সামনে এসব রেখে গেছে। ইমতিয়াজের মোটেও এসব খাওয়ার ইচ্ছে নেই। কাশেম বসে আছে ইমতিয়াজের সামনে। ইমতিয়াজ খাচ্ছে না বলে বললো,
“কি হইলো আমনে দেহি খাইতাছেন না কিছু?”
“আমার আসলে মিষ্টিটা ওতোটা পছন্দ না। মিষ্টি পছন্দ না বলেই আমি রোজ নিমগাছের ডাল দিয়ে দাঁত মাজি।”
কাশেম যেন অবাক হলো ইমতিয়াজের কথা শুনে। বললো,
“আমনে হাছা কন?”
“হুম। কতক্ষণ আগেও মেজে আসলাম তেমারর বিশ্বাস না হলে মোকলেসকে জিজ্ঞেস করতে পারো।”
“তাইলে আমনে এহন মিষ্টি খাইবেন না?”
“তুমি খেয়ে ফেলো।”
এই বলে সামনের গ্লাসটার পানি থেকে কিছুটা পানি খেল ইমতিয়াজ। তারপর বললো,
“তারপর জমিদার সাহেব কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে আমি খেয়েছি।”
“মিছা কতা কমু।”
“মিথ্যা কথা কই আমি তো খেলাম।”
“কই খাইলেন?”
“এই যে পানি খেলাম এবার তুমি ঝটপট মিষ্টিগুলো খেয়ে ফেলো তো।”
কাশেমের মিষ্টি খুব পছন্দ তাই আর লোভ সামলাতে না পেরে সব মিষ্টি ধপাধপ খেয়ে ফেললো। ইমতিয়াজ মিষ্টি হাসলো এতে। হঠাৎ কাশেমের ডাক পড়লো রাগান্বিতার বাবা তাকে ডাকছেন। কাশেমও দ্রুত পানি খেয়ে ছুট লাগালো বাহিরে। ইমতিয়াজ বসে রইলো অল্প কিছুক্ষণ জানালার বাহিরটা আর বাড়ির ভিতরের আশপাশটায়ও একটু চোখ বুলালো অতঃপর উঠে দাঁড়ালো ইমতিয়াজ এবার তাকে যেতে হবে। ইমতিয়াজ তার গায়ের শার্টটা ঠিক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে বসলো। কোনোদিক আর তাকিয়েই চলে যেতে লাগলো সে। সদর দরজা পর্যন্ত যেতেই রাগান্বিতার কণ্ঠ শোনা গেল। সে বললো,
“আপনি মিষ্টিগুলো খেলেন না কেন?”
ইমতিয়াজ দাঁড়িয়ে পড়লো। রাগান্বিতার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“তার কাজলকালো আঁখিতে আমি খুব মায়া দেখেছি,
মিষ্টি তো পছন্দ নয় তাই আমি তিতাতেই সন্তুষ্টতা উপভোগ করেছি।”
ইমতিয়াজ দাঁড়ালো না। রাগান্বিতা ইমতিয়াজের কথাটার অর্থ না বুঝতে পেরে বললো,
“মানে?”
ইমতিয়াজ কি আর এর মানে বলবে, বলবে না তো তাই যেতে যেতেই বলে গেল,
“সবকিছুর মানে যে খুঁজতে নেই কুমারী রাগান্বিতা।”
চলবে…..