প্রিয় রাগান্বিতা পর্ব-০৩

0
588

#প্রিয়_রাগান্বিতা🩷
#লেখিকা:#তানজিল_মীম🩷
পর্ব-০৩
______________
দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রাগান্বিতা। চোখে মুখে অশেষ চিন্তার ছাপ। উঠানে কান্নার রোল পড়েছে কারণ মুরতাসিনের বাবা মা এসেছেন। ছেলের এমন অকাল মৃত্যুটা তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। রাগান্বিতার বাবা যেন ওনাদের কষ্টটা বুঝলেন মেয়ে মরা শোক এখনো তো যায় নি তার। রাগান্বিতা আর দাঁড়ালো না চুপচাপ ঢুকে গেল বাড়ির ভিতরে। অন্যমনস্ক হয়ে হেঁটে গেল নিজের কক্ষে। কিছু ভালো লাগছে না চারপাশটা কেমন যেন রহস্য রহস্য ঠেকছে তার কাছে। মুরতাসিনকে এমন নয় রাগান্বিতা চেনে না। ঠিক দুদিন আগে তার কক্ষে ঢিল ছুড়ে ছিল এতে রাগান্বিতা প্রচুর রেগে যায় অনেক বকাঝকাও করে কিন্তু তাও ছেলেটা শোনে না প্রায়সই তাকে বিরক্ত করতো। কখনো হাত ধরার সাহস করে নি, কিন্তু কাল রাগান্বিতা বোনের কথা চিন্তা করতে করতেই বাহিরে বেরিয়েছিল তখন মুরতাসিন অনেক সাহস নিয়ে তার হাতটা ধরে, তাকে ভালোবাসি বলেছিল। রাগান্বিতা এতে খুবই ক্ষিপ্ত হয়ে যায় মুরতাসিনের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে উল্টো সে মুচড়ে ধরে মুরতাসিনের হাত সাথে হুমকি দেয় ফের যদি এমন কিছু বলে তাহলে সে তার বাবাকে বলে দিবে। মুরতাসিনের চোখে মুখে ভয় ছিল তখন সাথে হাতে ব্যাথা পাচ্ছে তারও আর্তনাদ ছিল। রাগান্বিতা মুরতাসিনের আর্তনাদ ভরা চোখ দেখে ছেড়ে দেয় তার মনে হয়েছিল মুরতাসিন আর তার সাথে এসব বিষয় নিয়ে কিছু বলবে না। কিন্তু আজ সকালে, পুকুর পাড়ে নাইতে নেমেছিল সে। রাগান্বিতাদের বাড়ির পুকুরপাড়ে গোসল করার জন্য ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা পুকুরপাড় আছে। মেয়েদের পাড়টায় চারপাশ কালো পলিথিন দিয়ে বেড়া দেয়া থাকে। রাগান্বিতা কেবলই পুকুরে নেমেছিল নাইবার জন্য তখনই কোথা থেকে যেন মুরতাসিন হাজির হয়। রাগান্বিতা প্রচন্ড ক্ষেপে যায় এতে। আটপাচ কিছু না ভেবেই নাওয়া ছেড়ে ছুট লাগায় মুরতাসিনের দিকে। কিন্তু মুরতাসিন তখন পালিয়ে বাঁচে। এসব কথা রাগান্বিতা ভেবেছিল তার বাবাকে বলবে কক্ষেও গিয়েছিল একবার কিন্তু বোনের শোকে বাবা খুব মর্মাহত ছিল বিধায় আর বলা হয় নি। কিন্তু রাগান্বিতা এটা ভেবে পাচ্ছে না মুরতাসিনকে কেউ কেন মারলো। তার জন্য নয়তো। কিন্তু তার জন্য কেউ কেন এভাবে একটা মানুষকে খুন করবে। রাগান্বিতা নিচে পড়ে থাকা সেই রক্তে ভেজা চিঠিটা আবার দেখলো। রক্তে পুরো জ্বলজ্বল করছে লেখাটা “সে নিষিদ্ধ ছিল”।

এই নিষিদ্ধ জিনিটা ঠিক কি? কোনো মানুষ নাকি অন্যকিছু। রাগান্বিতা কি ভেবে যেন সকালের সেই ডাকপিয়নের কাছ থেকে পাওয়া চিঠিটার হাতের লেখা আর এই রক্তে ভেজা চিঠিটার হাতের লেখাটা মিলালো। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুঝলো, এই দুটো চিঠির হাতের লেখা ভিন্ন। রাগান্বিতা বিষয়টা ধরতে পেরেই মনে মনে আওড়ালো,
“তাহলে কি এই দুই চিঠির মালিক দুটো ভিন্ন মানুষ!”
____

প্রকৃতি জুড়ে আজ রোদ উঠেছে। পাখিরা উড়ছে, বাতাসে শোকের ছায়া শেষে যেন হাল্কা হাল্কা আলো এসেছে। রাগান্বিতা বাড়ির উঠানে হাঁটছিল। সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে রাগান্বিতা স্কুলে যাচ্ছে না। রাগান্বিতা এবার মাধ্যমিক দিবে। বয়স তার ষোল হলেও মেয়েটা সাহসের দিক দিয়ে তার বাপ ভাইদের মতো। শুধু কুহু একটু ভীতু টাইপের ছিল। রাগান্বিতা তার শাড়ির আঁচলটা ধরে হাঁটছে আর নানা কিছু ভাবছে। হঠাৎই রাগান্বিতার কি যেন একটা মাথায় আসলো সে এগিয়ে যেতে লাগলো কালকের সেই জঙ্গলটার দিকে রাগান্বিতার বিশেষ ভুল না করলে তার মনে হচ্ছে কালকের সেই ছেলেটার সাথে তার আজও দেখা হবে। হলোও তাই রাগান্বিতা কালকের সেই আগের জায়গাটায় আসতেই নজরে আসলো তার কালকের সেই ছেলেটাকে। ছেলেটার নামটা যেন কি ছিল? কিছুক্ষণ ভাবতেই মনে পড়লো রাগান্বিতার। ছেলেটার নাম ইমতিয়াজ। ছেলেটা আজও দাঁড়িয়ে আছে কালকের সেই বড় গাছটার নিচে। ওই বড়গাছটার নামই ছিল বটগাছ। মানে মুরতাসিনের মৃত্যুর সেই স্থানটা। রাগান্বিতা আশেপাশে তাকালো না নিচে কোনো রক্তের দাগ টাগ দেখছে না। রাগান্বিতা যখন এসব ভাবতে ব্যস্ত ছিল ঠিক তখনই ইমতিয়াজ পিছনে ঘুরলো। সামনেই রাগান্বিতাকে দেখে বললো,
“আরে জমিদার কন্যা রাগান্বিতা যে আপনি এখানে?”

রাগান্বিতা জবাব দেয় না। শুধু তাকিয়ে থাকে ইমতিয়াজের মুখের দিকে। তার কি এই ছেলেটাকে সন্দেহ হচ্ছে। রাগান্বিতাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইমতিয়াজ আবার বলে,
“শুনলাম কাল রাতে নাকি আপনাদের গ্রামের কাকে যেন খুন করা হয়েছে কথাটা কি সত্যি?”

এবার রাগান্বিতা মুখ খুললো মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হুম। আর লাশটা কোথায় পাওয়া গেছিল জানেন?”

বেশ আগ্রহ নিয়ে বললো ইমতিয়াজ,
“কোথায়?”
“আপনি যে গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছেন ঠিক সেই গাছটার নিচে।”

সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠলো ইমতিয়াজ। দ্রুত গাছটার থেকে সরে এসে বুকে ফু দিলো। ইমতিয়াজের কান্ডে রাগান্বিতা না চাইতেও হেঁসে দিলো। রাগান্বিতার হাসি দেখে চোখ মুখ কুঁচকে বললো ইমতিয়াজ,
“আমি কিন্তু ভয় পাই নি পায়ে কি যেন একটা লাগলো তাই সরে এসেছি।”

রাগান্বিতা হাসতে হাসতে জবাব দিলো,
“হুম বুঝেছি।”
“কি বুঝেছেন দেখুন আপনি যা বুঝেছেন তা কিন্তু আমি বোঝাতে চাই নি।”

ইমতিয়াজের কান্ডে রাগান্বিতা আরো হাসলো। তার হাসি থামছে না। ইমতিয়াজকে আর একটু ভয় দেখাতে বললো রাগান্বিতা,
“আপনি জানেন আমাদের গ্রামে ভূত আছে।”

ইমতিয়াজ স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলো,
“তাই বুঝি।”
“হুম।”
“আপনার কি মনে হয় আমি ভূতে ভয় পাই?”
“পেতেও তো পারেন যেভাবে ভয়ের চোটে সরে আসলেন।”

ইমতিয়াজ মাথায় চুলকায়। বলে,
“আপনি আমায় চিনেন না তাই বলছেন যেদিন চিনে যাবেন সেদিন কিন্তু আপনি ভয় পাবেন।”

ইমতিয়াজের এবারের কথায় রাগান্বিতার হাসি থেমে গেল ছেলেটা কি বললো ঠিক বুঝলো না। রাগান্বিতা তার হাসি থামিয়ে প্রশ্ন করলো,
“মানে?”
“কাল আপনায় একটা কথা বলেছিলাম সব কথার মানে খুঁজতে নেই।”
“আপনি কি এখানে একা আছেন?”
“বলবো কেন!”

উত্তর খুঁজে পায় না রাগান্বিতা। সত্যি তো ছেলেটা তাকে সব প্রশ্নের এত উত্তর দিবে কেন? রাগান্বিতা আবার চুপ হয়ে যাওয়ায় ইমতিয়াজ বলে,
“আচ্ছা আমরাও তো কাল সন্ধ্যার দিকে এখানে ছিলাম খুনটা নাকি রাত আটটার দিকে হয়েছে তা আপনার বাবা মানে জমিদার সাহেবকে বলেছিলেন আপনি কাল এখানে এসেছিলেন আর আমায় দেখেছেন।”

রাগান্বিতা অনেকক্ষণ চুপ থেকে জবাব দেয়,
“না বলা হয় নি।”
“ওহ আচ্ছা। আমি ভেবেছিলাম বলেছিলেন হয়তো। তা ছেলেটাকে চিনতেন আপনি?”
“হ্যাঁ চিনতাম প্রায়সই দেখা হতো।”
“ভালো ছেলে ছিল বুঝি।”
“ভালো না ছাই এক নাম্বারের অভ..

বলতে গিয়েও থেমে গেল রাগান্বিতা। ইমতিয়াজের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনায় বলবো কেন?”

হেঁসে ফেলে ইমতিয়াজ। চোখের চশমাটা হাত দিয়ে নাড়িয়ে বলে,
“খুব সুন্দর।”

অবাক হয়ে বলে রাগান্বিতা,
“কি?”
“আপনায় বলবো কেন।”

হঠাৎই সাইকেলে বেল বাঝার আওয়াজ আসলো। ইমতিয়াজ বললো,
“কোনো ডাকপিয়ন এসেছে বুঝি?”

রাগান্বিতা বিড় বিড় করে বললো,
“আবার ডাকপিয়ন তার নামে আবার কোনো চিঠি আসলো না তো।”

রাগান্বিতা দাঁড়ালো না। কি ভেবে থড়থড় করে বললো,
“আমায় যেতে হবে।”

ইমতিয়াজও কোনো প্রশ্ন করলো না শুধু বললো,
“ঠিক আছে যান।”

রাগান্বিতা যেতেই ইমতিয়াজ তাকালো সামনের বটগাছটার দিকে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সেও চলে গেল তার গন্তব্যের স্থানে।
—–

রাগান্বিতা বাড়ি ঢুকতেই দেখলো সত্যি সত্যিই একজন ডাকপিয়ন তাদের বাড়ির উঠানে এসেছে। আশেপাশে কেউ নেই বিধায় লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। রাগান্বিতা পিছন থেকে হেঁটে যেতেই তাকে নজরে আসলো ডাকপিয়নের। খুব অস্থির কণ্ঠে চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
“আমনের নামে চিডি আইছে?”

রাগান্বিতা অবাক হলো সত্যি সত্যিই তার নামে আবার চিঠি এসেছে। রাগান্বিতা বেশি না ভেবে চিঠিটা হাতে নিলো ডাকপিয়নও তার একটা ছোট্ট সই নিয়ে সাইকেল নিয়ে চলে গেল। এমন সময় সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো রাগান্বিতার বাবা,
“কে আসছিল রাগান্বিতা?”

রাগান্বিতা খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে চিঠিটা শাড়ির আঁচলে লুকালো। বললো,
“ডাকপিয়ন আসছিল বাবা।”
“ হঠাৎ ডাকপিয়ন কেন আসলো?”

রাগান্বিতা হেঁটে এগিয়ে গেল তার বাবার দিকে।বললো,
“তেমন কিছু না বাবা একটা ঠিকানা জানতে চেয়েছিল।”
“ওহ আচ্ছা। বাহিরে বেশি বেরিও না রাগান্বিতা গ্রামের পরিস্থিতি জানোই তো।”
“বাবা মুরতাসিনের খুনটা কে করলো খুঁজে বের করবে না?”

ছোট করে জবাব দিলো রাগান্বিতার বাবা,
“দেখি। শোনো আমি একটু বাজারের দিকে যাবো বাড়ি ছেড়ে কোথায়ও যাবে না ঠিক আছে।”
“আচ্ছা বাবা।’

রাগান্বিতার বাবা চলে গেলেন। রাগান্বিতাও আর কিছু বললো না। তার কি বলা উচিত ছিল কালকের ওই ছেলেটা আর তার জঙ্গলে যাওয়ার বিষয়টার কথা। রাগান্বিতা তার হাতের চিঠিটা আবার দেখলো বাড়ির ভিতরে ঢুকতে ঢুকতেই চিঠিটা খুলো। চিঠিটা খুলতেই লেখা দেখলো। যেখানে লেখা ছিল,

“আমি প্রেমহীন নগরে লিখতে বসেছি
এক বিষাক্ত উপন্যাস
তুমি ছুঁয়ে দিলে একবার, দেখে নিও আমি পিছু ছাড়বো না আর”

#চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে