প্রাপ্তির শহরে পর্ব-০২ সিজন ০২

0
1009

#প্রাপ্তির শহরে সিজন ০২
#পর্ব-০২
#তাহরীমা

তাহুকে বিদায় দিয়ে এসে রিপা মায়ের রুমে যায়।আর মা কে বলে–“আম্মু আপুকে বিয়ে দিয়ে দেয়া কি খুব জরুরী ছিলো।আপুর ত পড়ালেখা করার ইচ্ছে ছিলো।”

তাহুর চাচি নিঃশব্দে কাঁদলেন।মেয়েটা চলে যাওয়াতে ঘর কেমন ফাঁকাফাঁকা লাগছে।
তিনি কান্না মুছে বলেন–“বাবা মার পরে মেয়েদের একমাত্র ঠিকানা হয় স্বামীর ঘর।তোর আব্বু চলে গেছে।আমি ও কখন চলে যাই ঠিক নেই।ওর যে একটা আশ্রয়স্থল এর প্রয়োজন ছিলো।”

রিপা বিচলিত হয়ে বলে,
–“কিন্তু আপুর যে স্বপ্ন?”
–“তুই কি জানিস তাহুকে আমি টাকা দিয়েই বিয়ে দিয়েছি।আমার বিয়ের গহনা বিক্রি করেই টাকা জোগাড় করেছি?”

রিপা অবাক হয়ে বলে–“কিন্তু কেন?”
–“কেন জানিনা।তবে আমার মনে হলো টাকা দিয়ে হলেও ওকে বিয়ে দিয়ে দেয়া দরকার।মেয়ে বড় হলে বিয়ে দিতেই হবে,সমাজের মানুষের জন্য হলেও মেয়েকে ঘরে রাখা যায় না।আমার হায়াতের ঠিক নেই,তুই ও বড় হয়ে যাচ্ছিস।তাছাড়া আমি যে ওর স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব নিতে পারব না।তাই ওর ভবিষ্যৎ ভেবেই বিয়ে দিয়েছি।অন্তত আমি মরে গেলেও ও একজন ভরসার মানুষ পাবে।”

–“হুম।কিন্তু ওরা টাকা নিয়ে ছেলেকে বিয়ে করায় ওরা কি ভাল হবে?আপু যদি কষ্টে থাকে?”

–“বিয়ের আগে আমি খুজ নিয়েছিলাম।ছেলের বংশ ভালো।ছেলে ভালো,ছেলের বাবা ভালো।সবাই সেটায় বলেছে।তারপর ও যদি তাহু কষ্টে থাকে ধরে নিবো ভাগ্যে যায় আছে তাই হয়েছে।মানুষ তো আর চেনা যায় না।আমি তো যতেষ্ট খুজ নিয়েছি।”

রিপা তখন মা কে জড়িয়ে ধরে–“আপুর জন্য খুব কষ্ট লাগছে।নিজেকে একা একা লাগছে।”

তাহুর চাচি বলে–“আদ্রকে বলেছি মেয়েটাকে পড়াতে।কি জানি শুনে কিনা?এমনি তে তো ছেলেটাকে ভালই লাগলো।তাহুকে এসব আমি কিছুই জানায়নি,জানি মেয়েটা এসব জানলে কখনো ই মেনে নিতো না।সারাজীবন মেয়েটা আমার সাথে ঠু শব্দ করে কথা বলেনি।আল্লাহর কাছে দোয়া করি সে যেন সুখী হয়।”

অথচ তাহুর চাচি জানেনা।যারা ছেলের শশুড় বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে মেয়ে নিয়ে যায় আর যাইহোক তারা ভাল হতে পারে না।

রিপা চুপ করে থাকে।
________

তাহু রাতের খাবার খেয়ে নেয়।আদ্রর মা তাহুকে সব বুঝিয়ে দিয়ে ঘুমাতে চলে যাবেন।মেয়েটা ভালো ই।একটা ভালো মেয়ে পেলো টাকা ও পেলো কি সৌভাগ্য।টাকা নেয়ার কথাটা শুধুমাত্র আদ্রর মা জানে।আর জানে আদ্র।আদ্র মাকে অনেক নিষেধ করেছিলো কিন্তু ওর মা শুনেনি।

আদ্রর মা টাকা নিয়েছে এটা আর কাউকে বলার প্রয়োজন ও মনে করেনি।অতি চালাক মহিলা যাকে বলে।
.
আদ্রর মা কিছুক্ষণ তাহুর দিকে তাকিয়েই চলে যান।

তাহু সব গুছিয়ে রাখে।বিয়ের প্রথম রাতে ও তার কাজ থামেনি।সব গুছিয়ে রাখতে রাখতে অনেক রাত হয়ে যায়।
কি অদ্ভুত তার ভাগ্যেটা।
.
আদ্রর রুমে গিয়ে দেখে আদ্র বিছানায় শুয়ে আছে।তাহু আদ্রর সামনে দাঁড়ায়।কিছুক্ষণ আদ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।মানুষ টা কত সুন্দর।আর সে মানুষটার সম্পূর্ণ বিপরীত।

আজকে তাদের বিয়ের প্রথম রাত।অথচ তার জন্য একটু অপেক্ষা করলো না ঘুমিয়ে গেলো?এতই অবহেলা?একটা কথা ও বলল না।কেন?কালো বলে?

কিন্তু সে তো আদ্রকে ভালবেসে ফেলেছে।নিজের স্বামীকে ভালবাসবে এটাই তো স্বাভাবিক।

তাহু কিছুক্ষণ আদ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে তারপর পাশে বসে।আবার কি মনে করে সোফায় গিয়ে বসে।আদ্রর টেবিলে খাতা কলম আছে তাহু সেখান থেকে একটা খাতা আর কলম হাতে নেয়।

একটা পাতায় লিখে–“আজ থেকে আমার জীবনে ভালবাসার আরেকটা মানুষ যোগ হলো নাম মেঘাদ্র।
.
.
আরেকটা পাতা উল্টিয়ে লিখলো–“শুনোন মি: মেঘ আপনি কখনো কারোর রূপের মায়ায় পড়বেন না।আপনি মায়ায় পড়বেন ব্যক্তিত্বের।রূপ একদিন চলে যাবে কিন্তু ব্যক্তিত্ব আজিবন থেকে যাবে।তবে আপনি যদি একবার মায়ায় পড়ে যান তাহলে একদম ফেঁসে যাবেন।”

আনমনে তাহু হাসে।এ কথাগুলো কখনো মুখে আদ্রকে বলতে পারবে না।মানুষটার সাথে তেমন কথা ও হলো না।

মন খারাপ করে তাহু আরেকটা পাতা উল্টিয়ে লিখলো–”

“প্রিয় মেঘাদ্র!

আমার ভালবাসা।শুনে রাখুন ভালবাসা শব্দটার মূল্য অনেক বেশি।এই শব্দ ঘীরে মানুষ হাসে,কাদে।আবার সুখী ও হয়,আবার দুঃখের সাগরে ভাসে।এই শব্দটার মূল্য যে দিয়েছে সে সুখী হয়েছে।আর যে অমূল্য রেখেছে সে হেলায় হারিয়েছে।আপনার অগোছালো জিবন গুছিয়ে রাখবে এই ভালবাসায়।আবার এই ভালবাসায় আপনাকে অগোছালো করে পাথর বানিয়ে দিবে ভাবতেই পারবেন না।তাই ভালবাসার মর্ম বুঝে আগলে রাখতে শিখুন।হেলায় হারালে চিল্লিয়ে বলবেন না ‘তোমাকে প্রয়োজন’।তখন যে বড্ড দেরী হয়ে যাবে।বউ চলে যাবে বহুদূরে,ফিরিয়ে আনা অসম্ভব।কঠিন হয়ে যাবে তাকে খুঁজে পাওয়া।

ইতি
আপনার বউ

আজ অনেক লিখে ফেলেছে।খাতার পৃষ্ঠাগুলো আস্তে করে ছিঁড়ে রিয়াদের বালিশের নিচে আস্তে করে রাখলো।যদি তার মনের কথা এভাবে জানতে পারে তো।আচ্ছা মানুষ টা কেমন রাগী নাকি শান্ত।কিছুই তো জানা হলো না।
.
.
তাহুর কিছুতেই ঘুম আসছে না।রিয়াদ রিপা আর মেজাম্মুর কথা ই মনে পড়ছে।
______________

সোফায় বসে থাকতে থাকতে ভোরের দিকে তাহুর চোখ লেগে এসেছিলো।আযানের শব্দ শুনে তাহুর ঘুম ভেঙ্গে যায়।

তাহু উঠে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নেয়।মোনাজাতে আল্লাহকে শুকরিয়া জানায় তার জীবনে আরো একটা দিন দেখার সৌভাগ্য দিয়েছেন বলে।

নামাজ পড়ে দেখে আদ্র এখনো ঘুম।মানুষ টা নামাজ পড়েনা নাকি?উনাকে কি ডাকবে নাকি ডাকবে না?নাম ধরে বলবে নাকি কি বলবে,কিছুই মাথায় আসছে না।

সাতপাঁচ ভেবে এমনি ই ডেকে ফেললো।
–“শুনেন উঠুন নামাজ পড়বেন।”

ব্যাস তাহুর এক ডাকে আদ্র চট করে উঠে বসে।কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ফ্রেশ হতে চলে যায়।ঘরে ই নামাজ পড়ে নেয়।
.
তাহু ততক্ষনে রুম থেকে বের হয়ে গেছে।আদ্র মোবাইল খুঁজতে গিয়ে বালিশের নিচে তাহুর লিখা কাগজ গুলা পায়।আর পড়ে দেখে।পড়াগুলো পড়ে আদ্র হাসে।

তাহুর মুখটা ভেসে উঠে মেয়েটা রূপবতী না হলেও মায়াবতী নামটা ঠিকই দেয়া যায়।প্রথমে ভেবেছিলো তাহুকে সে মেনেয় নিবেনা কিন্তু তাহুর চাচির কথা শুনে তাহুর জন্য মন টা কেমন করে উঠলো।তাহুর জীবনের কাহিনী শুনেই মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছে।আর ফেঁসে গেছে মারাত্মকভাবে যা তাহু জানেই না।


আদ্রর মনে পড়ে গেলো কাল রাতের কথা।তাহু আসার জন্য আদ্র অপেক্ষা করছিলো।আদ্রর ঘুম খুব প্রিয়।আদ্র বিছানায় হেলান দিয়ে বসেছিলো।তাহু আসার অপেক্ষা করতে করতে তাহুকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ লেগে এসেছিলো।বিয়ের ঝামেলা সে দুইদিন চোখের পাতা এক করতে পারেনি।
ভেবেছিল তাহু আসলেই সারপ্রাইজ দিবে এজন্য তাহুর সাথে সে বিয়ের পর থেকে কথা বলেনি।কিন্তু সে কখন ঘুমিয়ে গেলো আর তাহু এসে তাকে ডাকলো ই না।ইশ এমন একটা রাত এভাবে মিস হয়ে গেলো আদ্রর মন খারাপ হলো।কিন্তু পরক্ষণে হেসে উঠলো আজকের পর থেকে তাহুর জীবনে যতদিন আদ্র আছে সব দিন রাত সুন্দরময় হবে।

_____________

তাহু আদ্রকে ডেকে রুম থেকে বের হয়ে চা বানাতে যায়।যেহেতু কালকেই শাশুড়ি কাজ সব বুঝিয়ে দিয়েছিলো যেন সে এ বাড়ির বউ নয় কাজের মেয়ে।বউ হিসেবে সে ভালবেসে কাজগুলো করবে কিন্তু তাই বলে বউ হিসেবে প্রাপ্য সম্মান টা তারা দিবে না?

তাহু চা বানিয়ে সবাইকে ডাকতে যায়।ননদ ঘুম তাই তাকে ডাকে না।ননদের জামাই উঠেছে উনাকে খেতে দেয়।ননদের জামাই ও শান্ত মনের মানুষ মনে হলো তাহুর সাথে বিনয়ী হয়ে কথা বলে।কিন্তু তিনি কেন আয় করেন না তাহুর বুঝা আসলো না।তিনি চা পান করেই চলে যান।
তাহুর শশুড় আসলে সালাম দিয়ে চা এগিয়ে দেয়।তাহুর শশুড় বলে–“অনেকদিন পর এরকম সকাল সকাল চা পাচ্ছি।”

তাহু অবাক হয়।ঘরে এত মানুষ থাকতে সকালে উনাকে কেউ চা বানিয়ে দিত না?”

তাহুকে অবাক হতে দেখে তিনি বলেন–“সবাই উঠে আট টার পর,আলো তাড়াহুড়া করে উঠে গার্মেন্টস এ চলে যায়।আর তোর শাশুড়ি উঠে চা বানাতে বানাতে নয়টা।বাকিরা তো ঘুমেই থাকে।”

তাহু চুপ করে থাকে।তবে ভালো লাগছে শশুড় কে খুশি দেখে।কিছুক্ষণ পর শাশুড়ি আর আদ্র আসে।দুজন কেই চা দিয়ে তাহু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

আদ্র ই প্রথম বলে–“তাহু তুমি ও বসে পড়ো!”

‘তাহু’ প্রিয় মানুষের মুখে নিজের নাম শুনলে কেমন যেন লাগে।কেমন লাগে?তাহু প্রকাশ করতে পারেনা।এই প্রথম আদ্র তাকে নাম ধরে ডাকলো।

আদ্রর মা অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে।আর ভাবছে হলো টা কি?একদিনেই তাহু ছেলেটাকে পরিবর্তন করে দিলো নাকি।

তাহুকে আদ্র আবারো বললে সে চুপচাপ বসে খেয়ে নেয়।

আদ্র মুচকি হাসে।তারপর তার মা উদ্দেশ্য বলে–“আমি একটা সীদ্ধান্ত নিয়েছে আম্মু।তাহু এখান থেকেই পড়ালেখা করবে।কালকেই আমি কলেজে ভর্তি করাবো।”

আদ্রর মা হঠাৎ ই রেগে যান।
–“বিয়ের পর কিসের পড়ালেখা?বাইরে গেলে মেয়েরা খারাপ হয়ে যায়।ঘরের বউ ঘরে ই মানায়।”
আদ্র কিছুক্ষণ ভেবে বলে–“যে খারাপ হওয়ার তাকে তুমি সামলে রাখলেও সে খারাপ হবে।আমি ঠিক থাকলে জগৎ ঠিক।”

তাহু খুশিতে চোখের জল ফেলে।হাসা অবস্থায় কেঁদে ফেলে।আল্লাহর কাছে পাওয়া না পাওয়া সবকিছুর জন্য শুকরিয়া..

আদ্র তার মা কে আবারো বলে–“আমি তাহুর চাচিকে কথা দিয়েছি।ওকে আমি পড়াবো।আর তুমি জানো তোমার ছেলে কেমন?আর যাইহোক আদ্র কাউকে কথা দিয়ে কথার অমান্য করে না।আশা করছি তুমি ওর শাশুড়ি নয় মা হিসেবে ওকে ভালবাসবে।”

আদ্রর বাবা মুচকি হাসে।

আদ্র উঠে চলে যায়।তাহু ও রান্নাঘরের দিকে চুপচাপ যায়।আদ্রর বাবাকে হাসতে দেখে আদ্রর মা রেগে বলে,
–“তুমি হাসো?দেখলে ছেলে আমার, বউয়ের কথায় উঠছে বসছে?”

আদ্রর বাবা হেসে বলে,
–“আমি যদি আমার বউয়ের কথায় চলতে পারি,না হয় আমার ছেলেও বউয়ের কথায় চলছে?ভালো না?”

আদ্রর বাবা ও উঠে চলে যান

চলবে……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে