প্রনয়ের দহন পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
453

#প্রনয়ের_দহন
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_৩৭

গাড়ি এসে থামে একটা বাগান বাড়ির সামনে। তীর গাড়ির কাচ নামিয়ে বাড়িটা পর্যবেক্ষণ করছে। অন্য দিকে রিফাত আর ইশা চোখে চোখে এক জন আরেক জনকে কিছু একটা বলে ইশারা করছে। ইশা গলা পরিস্কার করে বলে।

–কি হলো তীর গাড়ি থেকে নাম তাড়াতাড়ি?

–এটা কোথায়?

–উফফ‌ এতো কথা না বলে তুই নাম তো। ইদানিং বেশি কথা বলচ্ছিস তুই।

–আরে নামছি রে বাবা এতো অস্থির হোচ্ছিস কেন?

তীর তো গাড়ি থেকে নেমে গেছে অবুঝ মেয়ের মতো কিন্তু অঘটন ঘটলো গাড়ির দরজা লাগনোর শব্দ শুনে। তীর তড়িৎ বেগে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে ইশা গাড়ির ভেতর থেকে মিটিমিটি হাসছে আর ভ্রু নাচাচ্ছে।

তীর ভ্রু-কুচকে গাড়ির দরজা খুলতে নিলেই ইশা সাথে সাথে দরজা লক করে দেয়। ইশাকে এমন করতে দেখে তীর রেগে গিয়ে বাজখই কন্ঠে বলে।

–এসবের মানে কি ইশু?

ইশা দু কাঁধ নাচিয়ে বলে।

–কোন সবের?

–কোন সবের মানে তুই কি বুঝতে পারচ্ছিস না আমি কোন সবের কথা বলছি। নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করচ্ছিস কোনটা?

–তীরু সোনা মাথা ঠান্ডা কর। এভাবে চিৎকার করিস না গলা ব্যাথা করবে। তুই বরং ভেতরে যা তোর সারপ্রাইজটা ভেতরে তোর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

তীর গাড়ির দরজা খুলার চেষ্টা করতে করতে বলে।

–দরজাটা খুল ইশু ভালো হচ্ছে না কিন্তু।

–ভালো না খা’রা’প সেটা পরে বুঝা যাবে।

–আরে আজব আমি এখানে একা একা করবোটা কি?

–তুই একা না আরো একজন আছে ভেতের।

তীর স’ন্দে’হে’র দৃষ্টিতে ইশার দিকে ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে বলে।

–কে আছে ভেতরে?

ইশা র’হ’স্য’ম’য় হাসি দিয়ে বলে।

–ভেতরে গেলেই দেখতে পাবি। আমরা বরং আসি আর তোকে অল দ্যা বেস্ট।

রিফাতও তীরের দিকে তাকিয়ে বলে।

–তীর অল দ্যা বেস্ট। সময়টা ভালো কাটুক তোমাদের।

তীর অবাক হয়ে দু জনের দিকে তাকিয়ে আছে। কিসের জন্য এরা তাকে অল দ্যা বেস্ট জানাচ্ছে? তীর কিছু বলতে নিবে তার আগেই রিফাত গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে যায়। তীর হাবলার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল গাড়ির পানে। তার সাথে এতক্ষণ যা যা ঘটলো সব যেন মাথার উপর দিয়ে গেলো। গাড়িটা আড়াল হতেই তীর বাড়ির দিক মুখ করে তাকায়। কিছুক্ষণ বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ভাবে ভেতরে যাবে নাকি যাবে না। কিছুক্ষণ ভাবার পর মনে হলো ও ফিরে যাবে বাড়িতে এখানে আর এক মুহূর্তও থাকবে না। কিন্তু যখনেই তীর চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে তখনেই মনে পড়ে তার কাছে তো টাকা নেই। ব্যাগটা তো গাড়িতে রয়ে গেছে তাহলে যাবে কি করে হাত পুরা ফাঁকা। আর এখানের রাস্তাঘাটও তেমন ভালো করে চিনে না। তীর ঢোক গিলে চারিপাশটায় নজর বুলায় কেমন জনমানব শূণ্য এক জায়গাতে রেখে চলে গেলো থাকে। রাগে মন চাইছে ইশার নাক ফাটিয়ে দিতে কোন দুঃখে যে ইশার ফাঁ’দে পা দিলো উফফ। তীরের আর কি করা এক প্রকার বাধ্য হয়ে গেইটের কাছে গেলো। আর এটাও এখন জানার কৌতুহল হচ্ছে কি এমন সারপ্রাইজ আছে বাড়ির ভেতরে। তীর গেইটের কাছে আসতেই দেখে নীল একটা কাগজ ঝুলছে আর তাতে বড়ো বড়ো করে তীর লেখা। এটার মানে এই চিরকুট’টা তার জন্যই রাখা। তীর চিরকুট’টা হাতে নিয়ে ভাঁজ খুলে চিরকুটে কি লেখা আছে তা পড়তে থাকে।

“ভয় পাস না। চুপচাপ ভেতরে আয় আর নাক বরাবর সোজা হাঁটতে থাক”।

তীরের ভ্রু-কুচকে আসে এটা ভেবে কে এই চিরকুট’টা লিখতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয়ে চিরকুটের লেখা গুলা প্রিন্ট করা তাই চাইলেও আর বুঝতে পারবে কে লিখেছে? তবে চিরকুট’টের লেখা ভাষা গুলা একটু সন্দেহের সৃষ্টি করছে মনের মাঝে। তীর মনে মনে বলে।

–তবে কি ওনি…. না না এসব কি ভাবছি আমি ওনি তো ওনার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে আমাকে সময় দেওয়ার ওনার সময় কোথায়?

তীর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে গেইট খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। যতো ভেতরে যাচ্ছে ততই তীর অবাক হচ্ছে। সারা বাড়িতে নানা রকমের নাম না জানা ফুলে সজ্জিত হয়ে আছে। যত দুরে চোখ যাচ্ছে শুধু নানা রকম বাহারির ফুলের সামারোহ। ফুলের উপরে বাহারি রংয়ের প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছে। এক বার এক ফুলে তো অন্য ফুলে উড়ে গিয়ে বসছে। এতো ফুল থাকার কারনেই বাড়িটার নাম হয়তো বাগান বাড়ি রাখা হয়েছে। রাস্তার দু ধারে টগর গাছ লাগানো তাতে সাদা ফুলে ভর্তি। টগর ফুল গুলা হাত দ্বারা ছুঁয়ে ধীর পায়ে হেঁটে চলছে তীর। এতো ফুল দেখে তীরের বিষন্ন মনটা প্রফুল্লে পরিণত হয়েছে যেন।

সোজা রাস্তা এসে শেষ হয়েছে। এবার কোন দিকে যাবে তীর ভেবে পাচ্ছে না কারণ ডানে বামে দুটো রাস্তা চলে গেছে। কোন রাস্তা ধরে গেলে ঠিক জায়াগাতে পৌঁছাবে বুঝতে পারছে না। তীর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবলো হয়তো এখানেও কোনো চিরকুট থাকতে পারে যেহতেু আগে একটা চিরকুট পেয়েছে। তীর টগর গাছ গুলার পাশে ভালো করে খুজতে লাগলো কোনো চিরকুট আছে কিনা। কিছুক্ষণ খুজাখুজির পর দেখলো ডান পাশের রাস্তায় পড়ে আছে নীল একটা চিরকুট। তীর চিরকুট’টা হাতে নিয়ে পড়তে থাকে।

“যাক তোর মাথায় তাহলে বুদ্ধি নামক একটা বস্তু আছে। ভেবেছিলাম তোর ঘটে(মাথা) কোনো বুদ্ধি নেই কিন্তু না আমি ভুল প্রমাণিত হলাম। যাই হোক যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছিস সেই রাস্তার নাক বরাবর হাটতে থাক তাহলেই পেয়ে যাবি তোর সারপ্রাইজ”।

চিরকুট’টা পড়ে রাগে তীরের নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। এত্ত বড় সাহস তাকে আকার ইঙ্গিতে বোকা বলল। চিরকুট লিখার মালিক হয়তো আগে থেকেই জানতো তীর এমন কিছু একটা করবে তাই এটা লিখে রেখেছে। তীরের মন চাইছে এই চিরকুট লিখার মালিককে পঁ’চা ডোবায় চুবিয়ে মা’র’তে। যত্তসব।

তীর হাঁটা ধরে কিছুটা সময় হাঁটার পর রাস্তার মোড় ঘুড়ে বাড়ির পেছেনের দিকে এসে সামনে তাকাতেই তীর চ’র’ম অবাক হয়। চারিপাশটায় অনেক সুন্দর ডেকোরেট করা আর তার মাঝ খানে খড়ের একটা ছাউনি। সেই ছাউনির চারিপাশটা খোলা। খোলা ছাউনির চারপাশটায় সাদা আর লাল পর্দা দিয়ে সুন্দর করে ডেকোরেট করা হয়েছে। বাতাসে পর্দা গুলা দুলছে। এসব দেখে তীরের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা ফুঁটে উঠে। এমন মনোরম দৃশ্য তো তীর সিনেমাতে দেখে কিন্তু বাস্তবে যে দেখবে কল্পনাও করতে পারে নি। ছাউনি দেওয়া ঘরটার মাঝ একটা টেবিলে রাখা তার উপরে কিছু একটা রাখা আছে।

তীর ধীর পায়ে হেঁটে যায় ছাউনির কাছটায়। ছাউনির নিচে আসতেই তীর যেন আরো অবাকের চূড়ায় পৌঁছে যায়। টেবিলের উপরে রাখা চকলেট ফ্লেভারের একটা কেক আর ইয়া বড় একটা লাল গোলাপের বুকে দেখে। কেকের উপরে “Happy Birthday Thir” লেখা দেখে বুঝতে পারে এটা তার বার্থডে উপলক্ষেই কিনা। তীর এসব দেখে খুশির জোয়ারে ভাসতে থাকে। ছাউনির চারপাশটায় ভালো করে ঘুড়ে আবারও টেবিলের কাছে এসে গোলাপ ফুলের বুকেটা হাতে নিয়ে ফুলের ঘ্রাণ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তীর চোখ বন্ধ করে ঘ্রাণ নিয়ে চোখ খুলতেই চোখের সামনে একটা অবয়ব ভেসে উঠে। সেটা আর কেউ নয় স্বয়ং ইশান ফরাজী দাঁড়িয়ে আছে। ইশানের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। ছাউনির খুটির সাথে হেলান দিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে। নজর তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা পরী নামক তীরের দিকে। তীরের এমন সিম্পল সাজ যেন ইশানের বুকের বা পাশে গিয়ে লেগেছে সোজা। চোখে কাঁজল, ঠোঁট হালকা লিপস্টিক, কোমড় পর্যন্ত চুল গুলা ছাড়া যেগুলা বাতাস নিজের আপন মনে খেলা করছে। ইশানের খুব হিংসা হচ্ছে এই বাতাসের উপরে। আজ পর্যন্ত ও এখনো এই‌ রেশমি চুলের ঘ্রাণ নিতে পারলো না আর এই বাতাস নামক শু’ত্রু প্রতিনিয়ত খেলা করছে এই‌ রেশিম চুলের সাথে।

তীরের মুখে এতক্ষণ হাসি লেগে থাকা‌ মুখটা ইশানকে দেখার সাথে সাথে চুপসে গেলো। মনে পড়ে গেলো ইশানের করা ইগনোরের কথা। কিশোরি ছোট হৃদয়ের মনটা আবারও অভিমানে ভরে গেলো ভালোবাসার মানুষটাকে চোখের সামনে দেখে। তীর গোলাপের বুকেটা টেবিলের উপরে রেখে দেয়। তীরের নাক ফুসছে। চোখ দুটো লাল হয়ে আসছে, নিজেকে সামলে রাখার যথেষ্ট প্রয়াস করছে কিন্তু না চাওয়া সত্ত্বেও দু’চোখ ভরে আসছে নোনা জলে।

তীরের চোখে পানি দেখার সাথে সাথে ইশান হন্ততন্ত হয়ে এগিয়ে হাত বাড়িয়ে তীরের চোখের জল মুজতে নিলে তীর দু কদম পিঁছিয়ে গিয়ে ভাঙ্গা গলায় বলে।

–ছুঁবেন না আপনি আমায়।

ইশানের হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠলো। মেয়েটা তার উপর ভীষণ রকমের অভিমানে করে ফেলেছে। এখন এই অভিমান কিভাবে কমাবে। এমনটা করা একদমেই উচিত হয় নি তার। ইশান আর কিছু না ভেবেই তীরের হাত চেপে ধরে নিজের বক্ষস্থলে এনে ফেললো। তীর ছটপট করছে ইশানের কাছ থেকে ছুটার জন্য কিন্তু ইশান জাপ্টে ধরলো তীরকে আর নরম কন্ঠে সুধালো।

–সরি জান। প্লিজ রাগ করিস না আর এমন করবো না তোর সাথে প্রমিজ। এবারের মতো প্লিজ ক্ষমা করে দে আমাকে।

তীর এবার জোরেই কান্না করে দেয়। দু গাল বেয়ে পড়ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অজস্র নোনা জল। তীরকে এমন করে কান্না করতে দেখে বলে।

–স্টপ তীর! এবার তো অন্তত কান্নাটা বন্ধ কর।

তীর নিজেকে ইশানের কাছ থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছেই না। যতো চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়ানোর ততোই ইশানের হাতের বন্ধন দৃঢ় হচ্ছে। এক পর্যায়ে তীর না পেরে ফুপাতে ফুপাতে বলে।

–ছাড়ুন আমাকে। আমাকে কোন সাহসে ছড়িয়ে ধরেছেন আপনি? কে হোন আপনি আমার? দুরে সরে যান আমার থেকে।

তীরের কথা শুনে ইশান মুচকি হেসে বলে।

–আমিই তোর সব বুঝলি। আর এতো ছটপট করচ্ছিস কেন একটু স্থির হয়ে থাকতে পারচ্ছিস না।

তীর নাক ফুসাচ্ছে রাগে, দুঃখে, কষ্টে। মন চাইছে ইশানকে এক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে কিন্তু এই হাতির মতো মানুষটাকে এক চুল পরিমাণও সরাতে পারছে না শত চেষ্টা করেও।

তীর শান্ত তো হলো কিন্তু নাক এখনও ফুসাচ্ছে। তীরকে শান্ত হতে দেখে ইশান মুচকি হেসে হাতের বন্ধন নরম করতেই তীর নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ইশানকে ধাক্কা দিয়ে দুরে সরিয়ে দেয়। ইশান দু কদম পিছিয়ে গিয়ে তীরের দিকে হতভম্ব হয়ে তাকায়। তীর যে ভীষণ ক্ষেপে আছে ইশানের উপরে সেটা আর বুঝতে বাকি নেই। এখন এই মেয়ের অভিমান মিশ্রিত রাগ কমাতে ইশানকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে।

#চলবে_____

#প্রনয়ের_দহন
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_৩৮

ইশা একটা ঝিলের ধারে বসে আছে। নজর তার ঝিলের ও পাড়ে এক ঝাক সাদা বুনো হাঁসের দিকে। বুনো হাঁসগুলা একবার পানিতে নামছে তো আবার উঠছে। ভালোই উপভোগ করছে এই মুহূর্তটা ইশা। এমন সময় রিফাত হাতে করে দুটো চকলেটের পেকেট নিয়ে এসে ইশার পাশে বসে। কিন্তু তাতেও ইশার কোনো হেলদোল নেই। রিফাত ইশার চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে নিজেও বুনো হাঁস গুলার দিকে তাকিয়ে বলে।

–আপসেট।

রিফাতের কন্ঠস্বর শুনে ইশা নিজের ভাবনার জগত থেকে ফিরে এসে‌ মাথা নাড়িয়ে না করে। রিফাত দু হাত দ্বারা মাথা ভর্তি চুল গুলা পিছনে টেলে দিয়ে বলে।

–তাহলে এমন চুপচাপ‌ হয়ে বসে আছো কেন?

ইশা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে।

–বোনেরা ভাইদের রিলেশনে সাহায্য করলেও ভাইয়েরা কেন বোনদের রিলেশনে সাহায্য করে না! উল্টে তারা আরো বোনের রিলেশনটা মেনে নেয়।

রিফাত ইশার কথাটা শুনে নিচের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে। কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে বলে।

–তুমি কি আমাদের রিলেশনটা নিয়ে টে’ন’শ’নে আছো।

–হুম।

রিফাত ইশার হাত দুটো নিজের হাত দ্বারা আবদ্ধ করে বলে।

–উপরওয়ালা যদি চায় আমরা এক হবো তাহলে নিশ্চয়ই এক হবো কিন্তু…

ইশা মুখটা কালো করে বলে।

–কিন্তু কি?

রিফাত মুচকি হাসি দিয়ে বলে।

–কিচ্ছু না।

ইশা ছোট বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে বলে।

–মেনে নিবে তো সকলে আমাদের এই সম্পর্কটা!

রিফাত তো নিজেই জানে ভবিষ্যতে তাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে। ইশান যদি ওদের এই সম্পর্কের কথাটা জানতে পারে তাহলে কিভাবে রিয়েক্ট করবে ভেবেই রিফাতের হৃদয়টা মুছরে উঠে। আর সবাই যদি প্রশ্ন করে বন্ধু হয়ে বন্ধুর ছোট বোনের সাথে কি করে এমন একটা সম্পর্কে জড়ালে তাহলে কি উত্তর দিবে রিফাত। তারও বা কি করার ছিলো ভালোবাসা তো আর বলে কয়ে আসে না। কিভাবে কি হয়ে গেলো নিজেই বুঝতে পারে নি। রিফাতকে চিন্তিত থাকতে দেখে ইশা বলে।

–কি হলো কথা বলছেন না কেন?

রিফাত মুচকি হেসে ইশার কপালে পড়ে থাকা চুলে গুলা সরিয়ে মাথাটা যত্ন সহকারে নিজের বা বুকে রেখে ইশার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে।

–ভবিষ্যতে যা হবে তা ভালোর জন্যই হবে। তাই এতো দুশ্চিন্তা করে এই‌ ছোট মাথায় এতো প্রেসার ক্রিয়েট না করলেও চলবে আপনার।

ইশা মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলে।

–জানি না আমার ভাগ্যে আপনি আছেন কি না। কিন্তু বিশ্বাস করুন আপনাকে ছাড়া আমি সত্যি থাকতে পারবো না। যতো কষ্ট হোক মা, বাবা আর ভাইয়াদের আমি ঠিকেই রাজি করবোই করাবো।

_______

তীর ইশানের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই ইশান তীরের ডান হাত চেপে ধরে গম্ভীর কন্ঠে বলে।

–এবার একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না তীর।

তীর কোনো কথা বলে এক ঝটকায় ইশানের কাছ থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে বলে।

–এখানে বাড়াবাড়ির কিচ্ছু হয় নি আমাকে বাড়ি যেতে হবে। আমার ভালো লাগছে না।

এই কথাটা বলেই তীর হাঁটা ধরে। এতক্ষণ ইশান নিজের ক্রো’ধ’টা সংযোত করে রাখতে পারলেও আর পারছে না তীরের এমন আচরণ করা দেখে। এক প্রকার রে’গে চিৎকার করে বলে।

–তীর! স্টপ রাইট নাও। এখানেই থেমে যা আর এক পাও এগোবি না। যদি এগোস তাহলে আমার থেকে খা’রা’প কেউ আর হবে না।

ইশানের কথা শুনে তীরের পা জোড়া থমকে যায়। ভ’য়ে গলা শুকিয়ে আসছে। হৃদস্পন্দনদের গতি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি লাফাছে। ইশান যে ভ’য়ং’ক’র ভাবে রে’গে গেছে সেটা বুঝতে আর বাকি নেই। এখন নিশ্চয়ই রাগে তীরকে মাথার উপরে তুলে একটা আ’ছা’র মারবে। তীরের ভাবনার মাঝেই ইশান হুট করে পেছন থেকে এসে নিজের কোমড় বাঁকিয়ে এক হাত তীরের পিঠে আরেক হাত গোড়ালির নিচে রেখে তীরকে পাঁজাকোলে তুলে নেয়। ইশানের এমন করাতে তীর হ’ত’ভ’ম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে ইশানের মুখ পানে। ইশান চুপচাপ তীরকে ছাউনের নিচে এনে ব্রেঞ্চে বসিয়ে দেয়। তীর উঠতে নিলে ইশান হুং’কা’র দিয়ে বলে উঠে।

–একদম না! একদম উঠার চেষ্টা করবি না। আগে আমার কথা শুনবি তারপর যা হওয়ার হবে… বুঝা গেছে আমার কথা।

ইশান শেষের কথাটা অনেকটা চিৎকার করে বলে যার কারণে তীর ভ’য়ে কেঁপে উঠে অশ্রুসিক্ত নয়নে ইশানের পানে তাকায়। ইশান তীরের দিক থেকে নজর ফিরিয়ে নিয়ে নিজের কোমড়ে দু হাত রেখে চারপাশটা নজর বুলিয়ে রা’গ’টা কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে। এতক্ষণ তীরকে ভালো করে বুঝিয়েছে এমনি কি সরিও বলেছে কিন্তু তীর যেন জোঁকের মতো লম্বাই হচ্ছে। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই ইশান তীরের সাথে এমন রূ’ঢ় আচরণ করছে। তীরের ফুফানোর আওয়াজ ইশানের কর্ণ গোচর হতেই তড়িৎ বেগে তীরের পাশে বসে তীরের মুখমন্ডল নিজের দু হাত দ্বারা অবদ্ধ করে নিজের বুড়ো‌‌ আঙুল দ্বারা চোখের পানি মুজিয়ে বলে।

–প্লিজ জান! এবার অন্তত চোখের পানি না ঝড়ানোর চেষ্টা কর। আমি তো তোর ক্ষমা চাইছি এরপর‌ থেকে তোকে আমি ইগনোর করবো না প্রমিজ।

তীর কান্না মিশ্রিত কন্ঠে মাথা তুলে বলে।

–সত্যি বলছেন তো আপনি।

ইশান মুচকি হেসে মাথা‌ নাঁড়িয়ে বলে।

–হুম! একে বারে তিন সত্যি আমি আমার তীরকে আর কখনোই‌ ক’ষ্ট দিবো না।

–মনে থাকে যেন কথাটা।

–থাকবে ম্যাডাম অক্ষরে অক্ষরে মনে থাকবে। এখন আর কোনো কান্নাকাটি নয়। দেখ কান্না করে চোখের কাজল ছঁড়িয়ে কেমন পেত্নী সেঁজে গেছিস।

তীর চোখের নিচে নিজের আঙুল দিয়ে ঘসতে ঘসতে বলে।

–বেশি ছঁড়িয়ে গেছে কাজল।

–আমি ঠিক করে দিছি দাঁড়া।

ইশান পকেট থেকে রুমাল বের করে তীরের চোখের আশেপাশে লেগে থাকা কাজলের দাগ মুজে দিয়ে বলে।

–এবার ঠিক আছে।

তীর ইশানের কথা শুনে মুচকি হাসি দেয়। তীরের ঠোঁটের কোণে হাসি দেখে ইশানের বুকের মাঝ থেকে যেন বড় একটা পাথরের বোঝা কমলো। ইশান তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে তীরের দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা কান্না করে চোখ দুটো ফুলিয়ে‌ ফেলেছে একেবারে। দেখতে খুব আদুরে লাগছে। ইচ্ছে করছে গভীর ভাবে ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু সেটা তো ইশান এখন করতে পারবে না তার জন্য তাকে আরো অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু কবে এই‌ অপেক্ষার প্রহর শেষ হবে ইশানের। নাকি এই অপেক্ষার প্রহর সারা জীবনেও শেষ হবে না।

ইশানের এমন গভীর ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তীর‌ লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে।‌ মনের মাঝে অজানা ভ’য় কাজ করছে। এখানে তো ওরা দু জন ছাড়া আর কেউ নেই। ইশান যদি আবেগের দ্বারা ভুলবশত কোনো কাজ করে বসে তাহলে। কিন্তু তীরের সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে ইশানের উপর‌ তাই ভ’য়’টা একটু হলেও কম লাগছে।

ইশানের হাত বাড়ানো দেখে তীর‌ ঝাপ্টে আঁখিদ্বয় বন্ধ করে নেয়। ইশান তীরের এমন করা দেখে হেসে তীরের কপালে পড়ে থাকা আগোছালো চুলগুলা সরিয়ে দিতে দিতে হবে।

–রাগ কমেছে। যদি রাগ কমে থাকে তাহলে কেকটা কাটি।

তীর ইশানের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। তীরের সায়পেয়ে ইশান তীরের হাত ধরে টেবিলের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বলে।

–মোমটা জ্বালিয়ে দেই দাঁড়া।

ইশান মোমটা জ্বালিয়ে দিয়ে বলে।

–এবার কেকটা কাট।

তীর হাতে ছু’রি’টা নিয়ে যেই মোমবাতিটা ফু দিয়ে নিভাতে যাবে ওমনি ইশান চিৎকার করে বলে।

–মোম নিভাবি না।

তীর ইশানের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে।

–কেন?

–তোর জীবনের আলো‌ সবসময় জ্বলে‌ থাকুক। কখন যেন না নিভে তাই মোম বাতিটা না নিভিয়েই কেকটা কাট।

তীর ইশানকে যতো দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে। এমন একটা সুন্দর পার্সোনালিটির মানুষ কি আদোই তার যোগ্য। তীরকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইশান দু ভ্রু নাচিয়ে বুঝায় কি হয়েছে? তীর‌ ইশানের ইশারা বুঝে মাথায় নাড়িয়ে না বুঝিয়ে কেক কাটায় মনযোগ দেয়। তীর কেক কাটার পরপরেই ইশান এক টুকরো‌ কেক নিয়ে তীরকে খাইয়ে দেয়। তীরও ইশানকে কেক খাইয়ে দেয়। কেক খাওয়ানোর সময় ইশানের ঠোঁটের সাইডে ক্রিম লেগে যায়। তা দেখে তীর ইশারা করে কিন্তু ইশান তীরের ইশারা না বুঝে বলে।

–কি হয়েছে?

–আপনার ঠোঁটের সাইডে ক্রিম লেগে আছে।

ইশান তীরের কথা শুনে টিস্যু পেপার নিয়ে ক্রিম মুজতে‌ নিলে কিছু একটা ভেবে থেমে যায়। ইশানকে থেমে যেতে থেকে তীর বলে।

–কি হলো থেমে গেলেন কেন?

ইশান হঠাৎ করেই‌‌ কোমড় বেঁকিয়ে তীরের মুখ বরাবর নিজের মুখটা এগিয়ে আনে।‌ আচমকা ইশানকে এমন করতে দেখে তীর ভ’য়ে দু কদম পিছিয়ে গিয়ে নিচু কন্ঠে বলে।

–কি হলো?

ইশান নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে।

–মুজে দে।

তীর ঢোক গিলে বলে।

–আমি।

–হুম।

–কিন্তু আমি কেন? এটা তো আপনেই….

–উমমম! কোনো কথা নয় আই এম ওয়েটিং।

বলেই আরেকটু এগিয়ে আনে মুখটা তীরের দিকে। তীর পড়লো এক ঝামেলাতে। ও কিভাবে ইশানের ঠোঁটে হাত রাখবে? মুজানোর সিনটা কল্পনা করতে সারা গায়ে কা’টা দিয়ে উঠে তীরের। কিন্তু ইশান যেহেতু এক বার অর্ডার দিয়ে দিয়েছে তার মানে কাজটা করতেই হবে। না হলে এখান থেকে এক পাও নড়তে পারবে না। তীর কা’পা’কা’পা হাতে টিস্যু পেপারটা হাত নিয়ে ধীরে ধীরে নিজের হাত ইশানের ঠোঁটের দিকে এগিয়ে নেয়। শ্বাস প্রশ্বাসের গতি ঘন হয়ে আসছে তীরের। মনে হচ্ছে এই‌ বুঝি ইশান শুনে নেবে ওর‌ নিঃশ্বাসের গতি। তীরের এমন বে’হা’ল অবস্থা দেখে ইশান মিটিমিটি হাসছে। এই একটা সামান্য কাজ করতে বলেছে তার জন্যই এই‌ মেয়ের ম’রো ম’রো অবস্থা। এর থেকে বেশি কিছু আবদার করলে তো অ’জ্ঞা’নে’ই হয় যাবে। তীর চোখ বন্ধ করে বড় একটা নিঃশ্বাস টেনে ইশানের ঠোঁটের সাইডে ক্রিমটা মুজিয়ে হাতটা নিয়ে আসতে নিলেই ইশান খপ করে হাত ধরে ফেলে। তীর অবাক চোখে ইশানের দিকে তাকায়। ইশান তীরকে আরো অবাক করার জন্য বাঁকা হেসে তীরকে হেচকা টান মেরে নিজের কাছে এনে বলে।

–চল ডান্স করি।

তীর এই কথা শুনে ইশানের দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলে।

–আপনি ডান্স করতে পারেন।

–কি মনে হয় তোর?

–না মানে আপনি…

–দাঁড়া একটা গান প্লে করি।

বলেই ইশান পকেট থেক ফোন বের করে একটা গান প্লে করে।

“ঠিক এমন এভাবে
তুই থেকে যা স্বভাবে
আমি বুঝেছি ক্ষতি নেই
আর তুই ছাড়া গতি নেই
ছুঁয়ে দে আঙুল
ফুঁটে যাবে ফুল, ভিজে যাবে গা
কথা দেয়া থাক
গেলে যাবি চোখের বাইরে না”

“ছুঁয়ে দে আঙুল
ফুঁটে যাবে ফুল, ভিজে যাবে গা
কথা দেয়া থাক
গেলে যাবি চোখের বাইরে না
তোরই মতো কোনও একটা কেউ
কথা দিয়ে যায়, ছায়া হয়ে যায়
তোরই মতো কোনও একটা ঢেউ
ভাসিয়ে আমায় দূরে নিয়ে যায়”

গানের তালে তালে ইশান আর তীর ডান্স করছে। ইশানের প্রত্যেকটা ছোঁয়া তীর গভীর ভাবে অনুভব করছে। এক জন আরেক জনের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন অন্য এক জগতে দু’জন হারিয়ে যাচ্ছে। ইশানের গরম নিঃশ্বাস গুলা আছরে পড়ছে তীরের মুখে। তাতে যেন তীরের ছোট হৃদয়টা ক্ষণে ক্ষণে কেঁ’পে উঠছে। ইশান তীরকে ঘুড়িয়ে নেয়। তীরের পিট গিয়ে টেকে ইশানের চাওড়া বুকে। ইশান সুযোগ পেয়ে তীরের চুলের ঘ্রাণ নিতে মেতে উঠে। এতো দিনের ইচ্ছেটা আজ পূরণ হলো যেন ইশানের।

#চলবে______

#প্রনয়ের_দহন
#Nusrat_Jahan_Bristy
#পর্ব_৩৯

রাত সাড়ে দশটা বাজে! তীর উপুর হয়ে শুয়ে আছে আর পা দুটো শূণ্যে তুলে সমানতালে নাচাচ্ছে মনের খুশিতে। চোখের সামনে বই খোলা কিন্তু বইয়ের দিকে তার কোনো মনযোগেই নেই।‌ মনযোগ বইয়ের মাঝে থাকবে কি করে তার মন তো পড়ে আছে ইশান নামক পুরুষ মানুষটার কাছে। আজকে দিনটা তীরের কাছে সারা জীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

তীর হাত বাড়িয়ে গলায় পরিহিত ধনুক আকৃতির লকেট’টা ছুঁয়ে দেয়। এই লকেট’টা আজ ইশান নিজের হাতে তীরের গলায় পরিয়ে দেয়। তীরের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি লেগে আছে। তীরের কিছু একটা মনে পড়তেই দু হাত দিয়ে লজ্জায় মুখ ডেকে চিৎ হয়ে বালিশে শুয়ে পড়ে বিড়বিড় করে বলে।

–আজ আর আমার পড়া হবে না। একি করে ফেলেন আমায় মিস্টার ইশান ফরাজী। আমি তো আপনাকে ছাড়া তো থাকতেই পারছি না। এবার কি হবে আমার সবাই তো‌ আামকে পা’গ’ল বলবে। আমাকে পা’গ’ল করার অপরাধে আপনাকে জে’লে দেওয়া দরকার।

বলেই তীর কোল বালিশ জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে নিয়ে আজকের মিষ্টি মুহূর্ত গুলা মনে করে।

_____

এগারোই এপ্রিল রাতটা পার হলেই ইশা আর তীরের এইচএসসি পরীক্ষা শুরু। তীর তো টে’ন’শ’নে ম’র’ম’র অবস্থা। পরীক্ষার কয়েকদিন আগেই থেকেই টে’ন’শ’নে ছিলো। কিন্তু যখন থেকে ইশানের মুখ থেকে শুনেছে “পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো না হলে খুব ভ’য়ংক’র শাস্তি দিবে তাকে” সেদিন থেকেই রাতে দিনে পড়ায় মনযোগ দিয়েছে। যে করেই হোক একটা ভালো রেজাল্ট করে ইশানকে দেখিয়েই দিতেই হবে। এমন পড়াই পড়ছে যে নিজের হাতে পর্যন্ত খেতে পারছে না। আয়েশা সুলতানা তীরকে রাতের খাবার খাইয়ে দিছে আর তীর পড়ছে। আয়েশা সুলতানা মেয়ের এমন পাগলামো দেখে বলে।

–তীর এমন করচ্ছিস কেন? গলায় তো খাবার আটকে যাবে মা।

তীর বি’র’ক্ত’ক’র ভাব নিয়ে বলে।

–উফফ মা! ডিস্টার্ব করো না তো আরো‌ দুইটা অধ্যায় বাকি আছে এগুলা রিভাইস দিলেই আমার পড়া শেষ।

অন্য দিকে ইশা সোফায় বসে পায়ের উপরে পা তুলে আপেল খাচ্ছে আর বইয়ের উপর চোখ বুলাচ্ছে। ওদিকে তীর টে’ন’শ’নে ম’রে যাচ্ছে আর এদিকে এই মেয়ের মনে পরীক্ষা নিয়ে কোনো প্রকার চিন্তাই নেই। পরীক্ষার কেন্দ্রে ইশান নিয়ে যাবে ওদের দু জনকে। ইশান ডিনার করার জন্য নিচে নেমে বোনকে এমন চিন্তাহীনভাবে বসে থাকতে দেখে বোনের মাথায় চটি মারতেই ইশা হু’কা’র দিয়ে বলে।

–ভাইয়া এভাবে মা’র’লে কেন?

–তোকে মা’রা’ই উচিত। তোর তো দেখে যায় কোনো চিন্তা নেই যে রাত পেরুলেই তোর বোর্ড পরীক্ষা। শুধু আছিস খাওয়ার চিন্তা নিয়ে।

–ভাইয়া শুনো এতো চিন্তা করে কোনো লাভ নেই। যাহ হওয়ার হবেই তাই এতো চিন্তা করে কোনো লাভ নেই শুধু চিল হবে।

–তোর যদি পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ তাহলে তোকে রিক্সাওয়ালার সাথে বিয়ে দিবো বলে দিলাম।

–উমমম। তোমার কথায়।

–আমার কথাই। তোকে রিক্সাওয়ালার সাথেই বিয়ে দিবো আমি।

ইশা এবার রা’গে চিৎকার করে বলে।

–মা দেখো ভাইয়া কি বলছে আমাকে!

নেহা বেগম মেয়ের চিৎকার শুনে রান্না ঘর থেকে দৌঁড়ে এসে বলে।

–কি হয়েছে? এভাবে চিৎকার করছিস কেন?

–মা তোমার ছোট ছেলে নাকি আমার বিয়ে রিক্সাওয়ালার সাথে দিবে আমার রেজাল্ট খারাপ হলে।

নেহা বেগম ইশানের দিকে‌ তাকিয়ে বলে।

–ইশান এটা কি ধরনের কথা। মেয়েটার সকালে পরীক্ষা আর তুমি কি বলছো এসব?

–তো কি বলবো তোমার মেয়েকে। পড়ালেখায় তো কোনো মনযোগ দেখতে পারচ্ছি না আমি।

ইশা ভাইয়ের উদ্দেশ্যে আবার বলল।

–তোমাকে কোন দুঃখে আমি আমার পড়ালেখার মনযোগ দেখাতে যাবো হুম।

–দেখলে‌ মা দেখলে কিভাবে পায়ের‌ উপর পা তুলে ঝ’গ’ড়া করছে আমার সাথে। আবার ওর নাকি বোর্ড পরীক্ষা।

–তুমি তো প্রথমে এসে ঝ’গ’ড়া শুরু করেছো‌ আমার সাথে ভাইয়া। আমি তো চুপচাপ বসেই পড়চ্ছিলাম।

দুরে দাঁড়িয়ে কেয়া ইশান আর ইশার ঝ’গ’ড়া দেখচ্ছে।‌ এই বাড়িতে যবে থেকে ও এসেছে তবে দেখে দেখে এসেছে ইশা আর ইশানের ঝ’গ’ড়া। ভালোই লাগে ওর ওদের দুষ্টু মিষ্টি ঝ’গ’ড়া গুলো দেখতে। নেহা বেগম এক পর্যায়ে চিৎকার করে বলে উঠে।

–উফফ! থামবি তোরা দু’জন।

তারপর ইশানের দিকে তাকিয়ে বলে।

–আর ইশান তুমি কি দিনদিন বাচ্চা হয়ে যাচ্ছো নাকি যে ছোট বোনের সাথে এভাবে ঝ’গ’ড়া করছো। কোথায় ওকে বুঝাবে যাতে ভালো করে পড়ে তা না করে উল্টো ওর সাথে তুমি আ’জে’বা’জে কথা বলছো।

ইশা মায়ের কথা শুনে ভাইয়ের দিকে তাকিয়র বলে।

–ঠিক হয়েছে।

ইশাকে কথা বলতে দেখে নেহা বেগম বলেন।

–কোনো কথা নয় চুপচাপ‌ পড়ো। আর ইশান খবার দিচ্ছি খেতে আসো।

নেহা বেগম চলে যান কথাটা বলে। ইশান একটা কথাও বলে না কারণ এখান হাওয়া গরম আছে আর মূলত দো’ষ’টা ওরেই তাই চুপ থাকাটাই ঠিক মনে করলো। আর তার উপরে ইশার কালকে পরীক্ষা। ইশান খাবার টেবিলে যাওয়ার আগে ইশাকে বলে।

–ভালো করে পড়। যা যা রিভাইস দেওয়া বাকি সেগুলা রিভাইস দে।

ইশা মুখ বেঁকিয়ে বলে।

–তোমাকে বলতে হবে না।

এমন সময় সোহেল ফরাজী বলতে বলতে আসেন।

–কি হয়েছে? এতো চিৎকার চেঁচামেচি কিসের?

ইশা বাবাকে দেখে বাবার কাছে গিয়ে আহ্লাদী কন্ঠে বলে।

–বাবা ভাইয়া নাকি আমাকে রিক্সাওয়াল সাথে বিয়ে দিবে আমার রেজাল্ট খারাপ হলে।

সোহেল ফরাজী মুচকি হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন।

–কে বলেছে আমি আমার রাজকন্যাকে রিক্সাওয়ালার কাছে বিয়ে দিবো। আমি আমার আদরের রাজকন্যাকে একজন রাজকুমারের কাছে বিয়ে দিবো যে রাজকুমার আমার মেয়েকে অনেক সুখে রাখবে আর যত্নে রাখবে।

ইশা বাবার কথায় মুচকি হাঁসে। সত্যিই তো তার জীবনে একটা রাজকুমার আছেই যে তাকে ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু সেই রাজকুমারটাকে কি সবাই মেনে নিবে। যদি না মেনে নেয় তাহলে কি হবে?

_____

তীর আর ইশা সবার কাছ থেকে দোয়া নিয়ে বের হয়ে পড়ে পরীক্ষার উদ্দেশ্যে। আজকে প্রথম পরীক্ষা তাই একটু আগেই বের হয়েছে। ইশানেই দু জনকে পরীক্ষার কেন্দ্রে নিয়ে যাবে বাকি সকলকে যেতে বললে না বলে দেয় কারণ এত গার্জিয়ান গিয়ে কোনো লাভ নেই। তাই বাড়িতেই বসেই‌ সন্তানদের জন্য দোয়া করবেন।

ইশান ড্রাইভ করছে আর লুকিং গ্লাসে তীরকে পর্যবেক্ষণ করছে। মেয়েটার সারা মুখে আতঙ্কের চাপ স্পষ্ট ফুটে উঠছে পরীক্ষার জন্য। ইশানের এখন মনে হচ্ছে তীরকে ভয় দেখিয়ে বড়সর একটা ভু’ল করে ফেলছে। নিজেকে‌ নিজে এখন চড়াতে ইচ্ছে করছে। তবে ইশা তীরের এমন টে’ন’শ’ন করা দেখে বার বার সান্ত্বনা দিছে।

গাড়ি এসে থামে নিজেদের গন্তব্যে। পরীক্ষার কেন্দ্রের সামনে ছাত্র-ছাত্রী তে ভর্তি সাথে তো গার্জিয়ান আছে। ইশা আর তীর গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। ইশানও ওদের দুজনের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে।

–এতো টে’ন’শ’ন করার কিচ্ছু হয় নি। তোদের দুজনের পরীক্ষাই ইনশাল্লাহ ভালো হবে। আর পরীক্ষার হলে মাথা ঠান্ডা রাখবি। প্রশ্ন হাতে পাওয়ার পর আগে প্রশ্ন গুলা ভালো করে পড়বি তার পর এন্সার করবি। যেই প্রশ্ন গুলা কমন পড়বে সেগুলা আগে এন্সার করবি। আর বিশেষ করে সময়ের দিকে খেয়াল রাখবি কেমন।

ইশা আর তীর মাথা নাড়ায়। ইশান তীরের দিকে তাকায় মেয়েটাকে টে’ন’শ’ন মুক্ত করতে হবে এখন। না হলে পরীক্ষাটা ভালো করে দিতে পারবে না। তাই তীরকে কোমল কন্ঠে ডাক দেয়।

–তীর!

তীর ইশানের দিকে চোখ তুলে তাকায়। ইশা ওদেরকে প্রাইভেসি দেওয়ার জন্য একটু দুরে সড়ে গিয়ে অন্যান্য ফ্রেন্ডদের পাশে গিয়ে দাঁড়া। ইশা চলে যেতেই ইশান তীরের দিকে দু কদম এগিয়ে এসে বলে।

–এতো প্রে’সা’র নেওয়ার কিচ্ছু হয় নি। ওই দিন আমি ওই কথাটা জাস্ট মজা করে বলেছি তাতে এতো টে’ন’শ’ন করার কিচ্ছু হয় নি। তুই যতটুকু পারিস ততোটুকু দিয়েই পরীক্ষা দিবি। তোর রেজাল্ট ভালো হোক বা খা’রা’প হোক তাতে আমার ভালোবাসা বিন্দু পরিমাণও কমবে না। তাই প্লিজ এই ছোট্ট মাথায় এতো প্রে’সা’র দিবি না।

তীর অবাক চোখে ইশানের দিকে তাকিয়ে আছে। এই‌ লোককে তীর জীবনেও বুঝতে পারবে না। কেমন যেন গোলক ধাঁধার মতো। তীরকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইশান বলে।

–কি হলো? আমি যা বললাম মনে থাকবে তো।

তীর মুচকি হেসে মাথা নাঁড়িয়ে সায় দেয়।

–ঠিক আছে তাহলে এবার ভেতরে যা। ভালো করে মন দিয়ে পরীক্ষা দিবি কেমন।

কিন্তু তীর টাই দাঁড়িয়ে আছে। তীরকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইশান ভ্রু-কুচকে বলে।

–কি হলো যা?

তীর নিচের ঠোঁট কামড়ে বলে।

–আপনি আগে গাড়িতে উঠুন।

–কেন?

–আপনি আগে উঠুন তারপর বলছি।

–তোরা দুজন পরীক্ষার কেন্দ্রে ডুকবি তারপর আমি গাড়িতে উঠবো।

–নাহ আপনি এখনি উঠবেন।

–তীর কি ছেলে মানুষি হচ্ছে এগুলা।

তীর মুখটা কালো করে বলে।

–প্লিজ। এমন করছেন কেন? তাড়াতাড়ি একটু গাড়িতে উঠুন না আমার হাত বেশি সময় নেই। আপনি যতো দেরি করবেন তত সময় ন’ষ্ট হবে আমার।

ইশান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে এক প্রকার বাধ্য হয়ে গাড়িতে উঠে বসে। অন্য দিকে তীর ইশাকে ইশারা করে একটু অপেক্ষা করতে বলে। ইশান গাড়িতে উঠেই বলে।

–হয়েছে! এবার যা।

তীর কিছু না বলে উল্টো নিজেই গাড়িতে উঠে বসে। ইশান তীরের এমন কাজ করাতে অবাক হয়ে বলে।

–তুই গাড়িতে উঠচ্ছিস কেন তীর? পরীক্ষা দেওয়ার কি কোনো‌ ইচ্ছে নেই।

তীর গাড়িতে উঠে আগে গাড়ির সব গ্লাস লাগিয়ে দেয়। তীরের এমন কাজ করাতে ইশান কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। ইশান কিছু একটা বলতে যাবে তার মাঝেই তীর ইশানকে অবাক করে জড়িয়ে ধরে। তীরকে এমন করাতে ইশান অবাকের চূড়ায় পৌঁছে যায়। এই প্রথম তীর নিজ থেকে ইশানকে জড়িয়ে ধরেছে তাও আবার এমন সময়। ইশান নিজেকে সামলিয়ে তীরের মাথায় হাত বুলিয়ে কোমল স্বরে বলে।

–কি হয়েছে জান? এভাবে হঠাৎ করে..

তীর আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ইশানকে। মনে হচ্ছে যেন নিজেকে ইশানের মাঝে ডুকিয়ে ফেলবে। তীরের এমন অদ্ভুত আচরণ করতে দেখে বিচলিত কন্ঠে বলে।

–কি হয়েছে জান? এমন করচ্ছিস কেন? কিছু কি হয়েছে?

ইশানের বিচলিত কন্ঠ শুনে তীর নিজের হোঁসে ফিরে এসে ইশানের কাছ থেকে তড়িৎ বেগে দুরে সরে যায়। লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতে পারছে না ইশানের দিকে। আবেগের বশে সাংঘাতিক একটা কাজ করে বসেছে সে। এবার ইশান কি ভাববে তাকে। ইশ! কি লজ্জার বিষয়। ইশান তীরের লজ্জা মাখা মুখটা দেখে ঠোঁট চেঁপে হেসে বলে।

–নিজের ইচ্ছেতে জড়িয়ে ধরলি আর এখন নিজেই লজ্জায় মরে যাচ্ছিস। তা মিস তীর আপনি হঠাৎ আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরলেন….

ইশানের কথার মাঝেই তীর বলে উঠে।

–আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আসি আমি।

কথাটা বলে তীর ঝড়ের বেগে গাড়ি থেকে বের হয়ে দৌঁড় মারে। তীরকে এভাবে দৌঁড় দিতে দেখে ইশান জোরেই বলে।

–আরে আস্তে যা পড়ে যাবি তো।

তীর দৌঁড়ে ইশার কাছে এসে বলে।

–ইশু চল দেরি হয়ে যাচ্ছে।

তীরের এমন করাতে ইশা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়। কিন্তু আপাতত কিছু বলে না। ইশা পিছন ফিরে ভাইয়ের দিকে তাকালেও তীর একবারও পিছন ফিরে তাকাই নি লজ্জায়।

#চলবে______

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে