প্রণয়ে প্রলয়ের সুর পর্ব-০৭

0
490

#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
.
পর্ব_৭
.
তরু আর নির্জন দরজার দিকে তাকায়।
‘তোমরা খেলো, কে এসেছে আমি দেখছি’
বলে কেয়া বিছানা থেকে নামে। ওর চুলগুলো এলোমেলো। বুকে ওড়না নেই। কামিজের পেছনের অংশ উঠে আছে৷ ইশহাক সাহেব এখনই অফিস থেকে আসার কথা নয়। সে আশা করেছিল হুস্না হবে। কিন্তু দরজা খুলে বিস্মিত হয়ে গেল। মূর্তির মতো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল দরজার সামনে। তন্ময় প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে। তার পেছনে হাসি হাসি মুখে ইশহাক সাহেব।
কেয়া অপ্রস্তুত হয়ে বললো, ‘আরে তন্ময় তুমি। অনেকদিন পরে এলে।’

ইশহাক সাহেব এগিয়ে এসে বললেন, ‘কেমন সারপ্রাইজ দিলাম দেখলে তো? মন ভালো হয়ে গেছে তাই না? ক্লাসমেট বা ছোটবেলার বন্ধুদের হঠাৎ দেখলে কেমন লাগে আমি জানি।’

কেয়া অপ্রস্তুত চেহারায় হেসে বললো, ‘আসো ভেতরে আসো তন্ময়।’

– ‘প্রথমেই বলে নিই এভাবে ডায়রেক্ট চলে আসা আমার উচিত হয়নি। তবুও তোমাকে চমকে দিতে সোজা এসে নক করলাম। আমি সিটিং রুমে যাচ্ছি, দুলাভাই ফ্রেশ হয়ে আসুন।’

ইশহাক সাহেব ওর হাত ধরে বললেন, ‘আরে আসুন তন্ময় সাহেব, আপনি কি দুরের কেউ। খানপুরের ছেলে। আমাদের এলাকারই তো।’

সে রুমে ঢুকে বললো, ‘আপনি আমাকে “সাহেব” জুড়ে না ডাকলে খুশি হব। আগেও বলেছি, শুধু তন্ময় ডাকবেন আর “তুমি” করে বলবেন।’

ইশহাক সাহেব স্বভাবসুলভ হেসে বললেন, ‘অনেকদিন পর পর দেখা হয় তো, তারপর অফিসে এভাবে কথা বলে অভ্যস্ত। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি করেই বলবো।’

সে কথায় মনযোগ নেই তন্ময়ের। চোখাচোখি হয়ে গেল তরুর সঙ্গে। মুচকি হেসে তন্ময়ই আগে বললো, ‘আরে তরু না? চেনাই যাচ্ছে না। বড়ো হয়ে গেছো।’

তরু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘তন্ময় ভাই আপনি এখানে..মানে স্যরি বলতে চাইছি মানে কীভাবে চিনলেন..কীভাবে কী কিছুই বুঝতে পারছি না।’

ইশহাক সাহেব হেসে উঠলেন। কেয়া বিছানা থেকে ওড়না নিয়ে তরুকে বললো, ‘এত অবাক হওয়ার কিছু নেই, তোকে সব বলবো।’

তন্ময় সোফায় বসে নির্জনের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কি অবস্থা নির্জন, আপনার গান-টান কেমন চলছে।’

– ‘ভালোই মামা, আপনার কি অবস্থা?’

– ‘এই চলছে আরকি।’

ইশহাক সাহেব নির্জনকে বললেন, ‘তন্ময় সাহেবকে নিয়ে এসেছি অন্য কারণে। তোমার সঙ্গে আলাপ আছে।’

‘তাই না-কি, আচ্ছা আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি তাহলে। বাইরে থেকে এসেই খেলতে বসে গিয়েছিলাম।’ কথাটি বলে সে চলে গেল। তরুরও মোবাইল বেজে উঠলো তখনই। এক বান্ধবীর কল। সেও উঠে ‘আসছি’ বলে চলে গেল।

ইশহাক সাহেব কাপড় পালটে বাথরুমে যাওয়ার আগে বললেন, ‘কেয়া হুস্নাকে গিয়ে বলো নাশতা-টাশতা কিছু দিতে।’

‘আচ্ছা বলছি’ বলে সে বিছানা টেনে খানিক ঠিক করলো। ইশহাক সাহেব বাথরুমে গেলেন। তন্ময় চারদিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে চুপিচুপি এগিয়ে গেল কেয়ার দিকে। কেয়া দেখতে পেয়ে হাত দিয়ে ইশারা করছে কাছে না আসতে। তার ভয়ে বুক কাঁপছে। কিন্তু তন্ময়ের যেন কোনো ভয় নেই। সে হাসছে। একেবারে কাছাকাছি এসে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারায় চুপ থাকতে বললো। তারপর কেয়াকে টেনে কাছে এনে কপালে চুমু খেয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কেয়া ফিসফিস করে বলছে, ‘বাড়াবাড়ি করছো, প্লিজ ছাড়ো, এত সাহস ভালো না…।’

তন্ময় ওর ঠোঁটে চুমু খেয়ে কথা বন্ধ করে দিল। ধাক্কা দিয়ে ছাড়িয়ে দিল কেয়া। হাতজোড় করে বললো, ‘প্লিজ, ওইখানে গিয়ে বসো।’

তন্ময় ধীরে ধীরে পিছু হটে এসে সোফায় বসে পড়লো। কেয়ার বুক ধুকপুক করছে। শ্বাস ঘন হয়ে এসেছে। সে দ্রুত পায়ে বের হয়ে গেল রুম থেকে। ইশহাক সাহেব বের হয়ে তোয়ালে নিয়ে মুখ হাত মুছতে মুছতে তন্ময়কে বললেন, ‘শীলাকে চিনেন?’

– ‘কোন শীলা?’

– ‘আপনাদের ক্লাসমেট যে, বিয়ে হয়েছে, উত্তরায় থাকে।’

– ‘ও হ্যাঁ চিনেছি।’

– ‘ও এসেছিল একদিন আমাদের বাসায়। আমি দাওয়াত দিয়ে ওর স্বামী সহ এনেছিলাম।’

– ‘তাই না-কি?’

– ‘হ্যাঁ, কিন্তু এরপর আরও অনেকদিন বলেছি আসতে, কিন্তু আসে না। মেয়ে মানুষ তো সাংসারিকন নানান ঝামেলা থাকে। আর এদিকে কেয়া বাসায় একা, ওর বন্ধু-বান্ধবী এলে ভালো লাগবে এটা ভেবেই চাই ঢাকায় যারা আছে আসুক। তাছাড়া গ্রামে বড়ো হওয়া মানুষের জন্য তো শহর এক ধরনের কারাগার।’

– ‘একদম ঠিক বলেছেন।’

কেয়ার সিটিংরুমে এসে কপালে হাত দিয়ে বসে হুস্নাকে ডাক দিল। হুস্ন কাছে এসে বললো, ‘কি ম্যাডাম?’

– ‘ফল-টল কি আছে আমার রুমে দে তো। আর চা বসা।’

– ‘আইচ্ছা।’

– ‘না চা পড়ে বসা। ড্রিংকস দে ফলের সঙ্গে।’

‘আইচ্ছা’ বলে হুস্না চলে গেল। কেয়ার মোবাইলে নোটিফিকেশন টিউন বাজতেই হাতে নিল সে। মেসেঞ্জারে তন্ময়ের মেসেজ। মনে পড়লো হোয়াটসঅ্যাপে ব্লক করে ফোন অফ করে দিয়েছিল। মেসেঞ্জারে দেয়নি। মেসেজে ক্লিক করে, ‘দেখলে তো এই তন্ময় তার কেয়াজানকে একটিবার দেখার জন্য কি করতে পারে? বলেছিলাম বিকেলে ছাদে আসো, দূর থেকে শুধু দেখবো। তুমি আসবে না, ফোন অফ করে ফেললে, হোয়াটসঅ্যাপে ব্লক দিলে, আমি বুঝতে পারলাম মেসেঞ্জারে এখন মেসেজ দিলেই ব্লক খাব। তাই বিকল্প পথে হেঁটে আমার জান পাখিটার একদম বেডরুমে পৌঁছে গেলাম এখন।’

– ‘তুমি একটা পাগল, ক্ষ্যাপাটে, বেপরোয়া।’

তন্ময় রিপ্লাই দিল, ‘একটা শব্দ বাদ পড়েছে। আমি পাগল, ক্ষ্যাপাটে, বেপরোয়া প্রেমিক। তোমার প্রেমিক।’

কেয়া মুচকি হাসলো। এই ছেলেটাকে সে কীভাবে উপেক্ষা করবে, কীভাবে? পুনরায় মেসেজ টিউন, ‘কেয়া রুমে আসো, তোমার বর বড্ড বকবক করছে। আর শোনো, স্যরি।’

– ‘স্যরি কেন?’

– ‘এই যে জড়িয়ে ধরেছি, চুমু খেয়েছি। এটা তোমার উপর একপ্রকার টর্চার হয়ে গেল। ভয় পাচ্ছিলে জানি।’

– ‘কিন্তু হিরোগিরি দেখিয়ে তো ঠিকই কাজটা করলে।’

– ‘ম্যাডাম রুমে আসবে না-কি তোমার বরকে দিয়ে ডাকিয়ে আনবো?’

কেয়া মুচকি হেসে উঠে রুমে এলো। ইশহাক সাহেব বিছানায় বসে গ্রামের গল্প করছেন। তন্ময় সোফায় বসে আছে। কেয়া ঢুকতেই ইশহাক সাহেব তাকালেন। ওড়না মাথায় দিয়েছে। লাজুক চেহারা। লাজুক চেহারার কারণ তিনি জানেন। একটা সময় প্রচুর গল্প-উপন্যাস পড়েছেন। তাই মানুষের কতকিছু বুঝেন। ক্লাসমেট বা স্যার বাসায় এলে কমবয়সি মেয়েরা খুবই লজ্জা পায়। সেই লজ্জামাখা চেহারায় কেয়াবিবিকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। দিনকে দিন আরও যেন তরুণী হয়ে যাচ্ছে। তিনি চান ওর বন্ধু-বান্ধবী সবার সঙ্গে হাসি-খুশিভাবে কেয়াকে বুঝাতে আমি তোমাদের মতোই। আলাদা কিছু না৷ বয়স কেবল একটা সংখ্যা। আড্ডা জমানোর জন্য কেয়াকে বললেন, ‘বাড়িতে কিন্তু নতুন একটা বিরাট ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।’
এমনভাবে বলার চেষ্টা করলেন। যেন কেয়া আগ্রহ নিয়ে বলে, ‘কি সেটা।’

কেয়া উনার ঠিক পেছনে গিয়ে বসে সত্যিই বললো, ‘তাই না-কি? কি ঘটতে যাচ্ছে।’

– ‘তন্ময় সাহেব বলে দেবো না-কি? একটু টেনশনে থাকুক, কি বলেন?’

– ‘হ্যাঁ, দেখুন আগে বুঝতে পারে কি-না।’

ইশহাক সাহেব একটু ঘুরে বসে কেয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বলো তো কি হতে পারে?’

কেয়া বিরক্ত হলো। সে ঠিক পেছনে এসে বসেছিল তন্ময়কে নিরাপদে দেখবে বলে। কিন্তু ইশহাক সাহেব ঘুরে বসেছেন এখন। সে নির্লিপ্ত চেহারায় বললো, ‘আমি কীভাবে বলবো।’

তন্ময় মুচকি হেসে বললো, ‘দুলাভাইকে শাহরুখ খান বানানোর প্ল্যান চলছে কেয়া।’

ইশহাক সাহেব ‘হা-হা’ করে হেসে উঠলেন। যেন খুবই মজার আড্ডা হচ্ছে। মজার কথাবার্তা চলছে। কেয়া তুমি আনন্দে মেতে উঠো, হাসো।
কিন্তু কেয়া ভ্রু-কুঁচকে বললো, ‘কি সেটা?’

হুস্না তখন নাশতার ট্রে নিয়ে ঢুকে টি-টেবিলে রাখে। ইশহাক সাহেব রহস্য করার জন্য বললেন, ‘কি সেটা এখন বলা যাবে না। হুস্না যাও তো, নির্জনকে নিয়ে আসো।’

‘জি আচ্ছা’ বলে সে বের হয়ে তরুর রুমের সামনে দিয়ে গিয়ে নির্জনের দরজায় নক করে। তরু পর্দার ফাঁক দিয়ে খেয়াল করছিল। কিছু একটা বলে হুস্না পুনরায় চলে গেল। খানিক পর নির্জনকে বের হতে দেখে তরুর মাথায় দুষ্টুমি চেপে বসলো। ও কাছাকাছি আসতেই সে ফোন কানে লাগিয়ে পর্দার আড়াল থেকে কথা বলতে শুরু করলো, ‘আরে না এখানে এসে বোর হচ্ছি…না সমবয়সি কেউ নাই.. না বোনও নেই, হ্যাঁ ফুফাতো ভাই আছে কিন্তু সেও অনেক বয়স্ক মানুষ.. না বয়স জানি না কিন্তু কিছু ছেলে থাকে না ত্রিশে পঞ্চাশ বছরের বুড়ো লাগে। ও এইরকম আরকি। হ্যাঁ, না ওই কেয়া ফুপুই ভরসা…।’

তরু কথা বলার ফাঁকে লক্ষ্য করলো তার দরজার সামনে এসে নির্জনের হাঁটার শব্দ থেমে গেছে। ‘আচ্ছা রাখছি এখন’ বলে তরু পর্দা সরিয়ে থমকে যাওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়ায়। নির্জন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো। যেন চোখ দিয়ে ভস্ম করে ফেলবে। তরু ইতস্তত করে বললো, ‘ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, আপনি এভাবে আড়ি পেতে দাঁড়িয়ে আছেন কেন নির্জন সাহেব। আমার বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলছিলাম।’

– ‘আমি কারও দরজায় আড়ি পাতি না।’

– ‘সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। সামান্য খেলা নিয়ে আমাকে বলে ফেললেন প্রফেশনাল চু*ন্নি। অথচ একটা মেয়ের দরজায় আড়ি পেতে আছেন, সিরিয়াস অপরাধ, তবুও…।’

‘চুপ, আর একটা কথাও বলবেন না’ বলে নির্জন কয়েক কদম এগিয়ে আসতেই তরু আধো ভয় আধো ভালো লাগায় পিছু হটে একেবারে দেয়ালে গিয়ে আশ্রয় নিল। নির্জন দাঁত কটমট করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে কিছু না বলে করিডর কাঁপিয়ে হেঁটে চলে গেল।
____চলবে____
লেখা: জবরুল ইসলাম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে