প্রণয়িনীর হৃদয়কোণে পর্ব-২৬+২৭+২৮

0
1569

#প্রণয়িনীর_হৃদয়কোণে
#আফসানা_মিমি
| ছাব্বিশ, সাতাশ, আটাশ তম পর্ব একসাথে |
❌ কোনভাবেই কপি করা যাবে না।❌

লিজাকে আজ দূর থেকে শিক্ষা দিয়েছি। আমাকে পঁচানো! আজ লিজার মুখ দেখার মতো ছিল। সে হয়তো বুঝে গেছে সাদা কইতর আমার আপন।

চাঁদনি রাত। শহরের মানুষেরা ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে। ফুটপাথের রাস্তা ধরে আমি আর আমার সাদা কইতর হাঁটছি। আমি হাঁটছি বললে ভুল হবে, আমি তো লাফাচ্ছি। পিছন থেকে সাদা কইতর বলছে, “আয়মান স্টপ! ব্যথা পাবে।”

আমি নাছোড় বান্দা। সাদা কইতরের কথা শুনছিই না।
এমন একটা রাত কীভাবে উপভোগ করা ছাড়া থাকবো? চাঁদনি রাতেই যে পাশে থাকা সঙ্গীর হাত ধরে পথের পথ চলতে হবে এমন কোন শর্ত নেই। চাঁদনি রাত মানে আমার কাছে অনেক কিছু। জীবনটাকে উপভোগ করা, লোকচক্ষুর আড়ালে নিজের বাচ্চামো প্রকাশ করা।

মেয়েদের ইচ্ছা তার জীবন সঙ্গী হবে এমন একজন যে তার সুখ দুঃখের সাথী হবে। আমিও চাইতাম আমার সাথী হবে এমন একজন যে নাকি আমার সব পাগলামো সহ্য করবে আর সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট কথা হচ্ছে আমার মাথায় কাকের বাসা গুছিয়ে দিবে।
পেয়েছিও, আমার সাদা কইতরকে।

শাড়ি পরিধান করে কোন মেয়ে এভাবে রাস্তায় হাঁটলে মানুষ পাগলী বলে উপাধি দিবে। আমাকে হয়তো অনেকে দিচ্ছে। এই রাস্তা দিয়ে যারা যাচ্ছে সকল পথচারীরা ফিরে আবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। তাতে আমার কি! আমি তো আয়মান তুবা। নিজের যা ইচ্ছা তাই করি। সাদা কইতর হঠাৎ আমার আঁচল টেনে ধরে। পিছনের দিকে তাকাতে বলে,

“আমার মনের সুপ্ত বাসনা, তোমাকে নিয়ে রাতের ল্যাম্পপোস্টের নিচে হাতের হাত ধরে হাঁটার আর তুমি কিনা ব্যাঙের মত লাফাচ্ছো?”

” ব্যাঙের মতো কোথায় লাফালাম। আমি তো আমার মত হাঁটছি। সাদা কইতর, তুমি কি জানো না তোমার আয়মান কেমন?”

” জানে দেখি তো চুপ করে আছি নয়তো এতক্ষণে কাঁধে তুলে বাড়ি নিয়ে বাসর করা শুরু করতাম।”

” ছিহ্ নির্লজ্জ সাদা কইতর।”

” আরে আয়মান তুবা লজ্জা পাচ্ছে! এ আমি কি দেখছি!”

সাদা কইতরের মাথা সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে। আমাকে কথা বলার সুযোগ দিল না সে। ঠিক এসে আমার হাতের মধ্যে নিজের হাত ঢুকিয়ে পথ চলতে শুরু করল। আমি আর কিছু বললাম না। আজকে তার চরণের সাথে চরণ মিলে সামনে হাঁটছি।

অনেক সময় অপরজনকে আনন্দ দিতে নিজেকে সবদিক থেকেই সংযত করে রাখা উচিত। এতে করে পাশের জন তৃপ্তি পেলেই নিজে তৃপ্তি পেয়ে যাবে।

সাদা কইতরের মনের খোঁজে বাসনা বেশিক্ষণ পূরণ করতে পারল না। তার আগেই আমি একটা কাজ করে বসলাম। এই রাতে, গভীর রাতে দেখতে পেলাম লুৎফা ভাইয়াকে আখের গাড়ি নিয়ে এদিকে আসছে। ব্যাপারটা সন্দেহজন। এত রাতে কোন হকারিরা চলাফেরা করবে না। আমাকে দেখে লুৎফা ভাইয়া আজ আর ভয়ে পালায়নি। বরং হাসিমুখে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসে। সাদা কইতরের দিকে তাকিয়ে বলে,

” কি মিয়া ভাই! এত রাতে কই যান।পাশে দেখছি পুরো এলাকার সবচেয়ে দুষ্টু মেয়েটাও আছে। তা সব ঠিকঠাক আছে নাকি?”

“অল গুড। তোমার বলো? এই সময় ঐদিক থেকে আসলে যে? আর যাচ্ছ কোথায়?তোমার বাড়ির পথ তো উত্তর দিকে।”

” এইতো একটু পশ্চিম পাড়ায় যাচ্ছি। ওয়াজ মাহফিল হবে তো! যদি সেখানে একটু একটু বিক্রি করতে পারি!”

” মিয়া ভালো হয়ে যাও। সৎ পথে কাজ কর। আমি জানি তুমি এখন কোথায় যাচ্ছ।”

দুই নাম্বারি কাজের গন্ধ পাচ্ছি। সাদা কইতর আর লুৎফা ভাইয়ার কথোপকথন শুনে কিছুটা বুঝতে পারলাম তারা কি নিয়ে আলোচনা করছে। আমার কোন ভয় নেই। কারণ পাশে সাদা কইতর আছে। আমাকে সব দিক থেকে হেফাজত করবে সে
কিন্তু আমারটা এখন আখের রস খেতে ইচ্ছে করছে। তাই দুজনের কথার মাঝেই বলে ফেললাম,

” এই লুৎফা ভাইয়া, আমাকে দুই গ্লাস আখের রস দাও তো!”
আমি কি ভুল কিছু বলেছি? আপনারাই বলুন! আমি তো জানি, বলিন। একদম বলিনি। তাহলে কেন লুৎফা ভাই আর সাদা কইতর আমার দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে? কথা বলেও যেন বিপদে পড়ে গিয়েছি। সাথে সাথে আমার হাত চলে গিয়েছে দাঁতের কাছে। কুটকুট করে নখ কামড়াচ্ছি আর টুকুর টুকুর চোখে সাদা কইতরকে দেখছি। সাদা কইতর তখনই দিল এক মহা ধমক,

” এক খচ্চর মেয়ে কতবার বলেছি দাঁত দিয়ে নখ কাটবে না! তুমি জানো না তোমার ওই নখে কত জীবাণু থাকে?”

অপমান সহ্য করা যায় কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত অপমান সহ্য করা যায়! আপনারাই বলুন। সাদা কইতরের একদম চোখের কাছে হাত লম্বা করে ধরে বললাম,

” এই যে, এই যে দেখো তো সাদা কইতর! আমার নখে কোন ময়লা আছে কি না। অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজেও আমার নখের ভিতর কোন ময়লা খুঁজে পাবে না। আসছে জীবাণু নিয়ে।”

লুৎফা ভাই যেন সিনেমার শুটিং দেখছে। আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। মেজাজ এই এমনিতে গরম হয়ে গেছে। ধমকে বললাম,

“এই লুৎফুর রহমান, বলেছিনা দুই গ্লাস আখের রস দিতে! এখনো বানাও নাই কেন? ”

লুৎফা ভাইয়া থতমত খেয়ে গেল। তাড়াতাড়ি আখের রস করে দুই গ্লাস আমার দিকে এগিয়ে এগিয়ে দিল। এক গ্লাস সাদা কইতরের হাতে ধরিয়ে আরেক গ্লাস আমি নিয়ে ঢকঢক করে গিলে ফেললাম।

” খাওয়া শেষ এবার ঘুম পাচ্ছে। চলো সাদা কইতর বাসায় যাব।”
” আরে আমার টাকা দেবে কে?”

টাকা তো আনিনি। সাদা কইতর দেবে সেটাও মানতে পারছি না। কি করি! এদিকে রাত অনেক বাড়ছে। এখনই বাড়ি ফিরতে হবে নয়তো কালকে মজা করতে পারব না। মাথা কেমন হালকা হালকা ঝিমঝিম করছে মনে হচ্ছে এখন নিচে পড়ে যাব।

কথাবার্তা ছাড়াই সাদা কইতরের হাত ধরে দিলাম এক দৌঁড়। সাদা কইতর কিছু বুঝতে পারেনি আমার তালে তাল মিলিয়ে দৌঁড়াচ্ছে পেছন থেকে লুৎফা ভাইয়া বলছে,

“ওই মাইয়া টাকা দিয়া যাও। টাকা না দিলে কিন্তু তোমার বাপের কাছে বিচার দিমু।”

সাদা কইতরের ব্যাপারটা বুঝতে অনেক সময় লেগেছে। আমার পাগলামির সাথে তাল মিলিয়ে সেও হেসে দেয় এবং পিছনে ফিরে বলে,

“আগামীকাল টাকা দিয়ে দিব। এখন যে কাজে যাচ্ছিস সে কাজ বাদ দিয়ে বাসায় যা।”

দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বাসার সামনে এসে থামলাম। সাদা কইতর হাঁটুতে ভর করে হাপাচ্ছে আর আমি বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ত্যাগ করছি আর ছাড়ছি।
” তুমি এত দুষ্টু কেন আয়মান! এভাবে কাউকে বোকা বানায়? কবে যেন তুমি আমাকে বোকা বানিয়ে একা ফেলে চলে যাও!”

” পৃথিবীর সবাইকে ধোঁকা দিতে পারব কিন্তু সাদা কইতরকে না। আমার মাথা কেমন ঘুরাচ্ছে সাদা কইতর। আমি বাসায় যাচ্ছি তুমিও বাসায় চলে যাও।”

আমার কথায় সাদা কইতর বিড়বিড় করে কিছু বলে। অস্পষ্ট স্বরে নয় তাই শুনে ফেলেছি,

” ওই শালাটা মানুষ হবে না। নিশ্চয়ই তোমার গ্লাসে কিছু একটা মিশিয়েছে। তাড়াতাড়ি বাসায় যাও। আশে পাশে না থেমে নিজের ঘরে দরজা আটকে ঘুমিয়ে পড়বে।”

সাদা কইতরের দিকে ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে আছি। কি বলছে মাথায় ঢুকছে না। আমার এখন খুব ঘুমের প্রয়োজন। হাতের ইশারায় টাটা বাই বাই বলে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলাম।

বাড়িতে অনেক মানুষ আমার কাছে মনে হচ্ছে সবাই ডাবল ডাবল। চোখ খিচে বন্ধ করে আবারো খুলে তাকালাম। না সবাইকে ডাবল মনে হয়। পৃথিবীর সমস্ত জমজ ভাই বোন চলে এসেছে আর সবাই আমাদের বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছে।
কোথায় থেকে আবুলের ভাই হাবলু আমার কাছে এসে উপস্থিত হয়ে হাতে একটা বক্স ধরিয়ে দেয়,

” আফা আমনের জন্য একটা গিফট আনছি।”

” টাকা কোথায় পেলে রে হাবলু? চুরি করেছিস নাকি কারো পকেট মেরেছিস।”

“আফা কি কন। সন্ধ্যায় আপনার আব্বা আমারে ৫০০ টাকা দিছিল সেখান থেকে আপনার জন্য উপহার আনলাম।”

ঘুমের ঘোরে উল্টাপাল্টা কি বকছি নিজেও জানিনা। হাবলুর সাহায্যে ঘরে এসে সাদা কইতরের কথা মতো দরজা আটকে ঘুমিয়ে পড়েলাম।

আমার আরামের ঘুম হারাম করা সকলের কাজ। সকাল সকাল কে যেন দরজায় ইচ্ছামত করাঘাত করছে। চোখ খুলে তাকালাম, দেয়াল ঘড়িতে নজর দিতেই দেখতে পেলাম দুপুর বারোটা বাজে। হে আল্লাহ, আমি এতক্ষণ সময় ঘুমিয়েছি! এজন্যই তো আমার দরজায় এতো আঘাত। শাড়ি না পাল্টিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ফলস্বরূপ আমাকে দেখতে পাগলি লাগছে। আসছি বলে, ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। ভাইয়ার বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হবে সন্ধ্যায়। এতক্ষণ সময় আমি অনেক কাজ করতে পারব। এই যেমন: সাদা কইতরের বাসায় গিয়ে একটু জ্বালাতন করে আসতে পারবো। নেংটি কইতরকে মিথ্যা বলে পুরো এলাকায় ঘুরিয়ে আনতে পারব।
ঘর থেকে বের হতেই এলাহীকাণ্ড দেখতে পেলাম। নেংটি কইতর ভূত সেজে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মানে ওর সাড়া মুখে কে যেন কালো কালি দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছে ঠোঁটে লাল লিপস্টিক দিয়েছে আর পরিধানে কালো কাপড় পরিয়ে দিয়েছে। দেখতে অনেকটা কালো ভূত মনে হচ্ছে। নেংটি কইতরের চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে একটু না একটু বেশিই বিরক্ত। আমাকে একটু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে খাটের উপর গিয়ে বসে অভিমান করে বলল,

” ভাইয়াকে তোমার রোগে ধরেছে। সকাল সকাল আমাকে ভূত সাজিয়েছে। এই অবস্থায় এই বাসায় নিয়ে এসেছে। তুমি জানো! বাসার সবাই আমাকে দেখে কীভাবে হাসছিল? আমার মান সম্মান আর কিছুই রইল না।”

” ওরে আমার মান সম্মান রে! এই তোর বয়স কত রে! তুই সম্মানের কি বুঝিস? তোকে তো অনেক কিউট দেখাচ্ছে। আস্ত একটা পান্ডা দেখাচ্ছে। নাদুসনুদুস একটা ছোট্ট পান্ডা।”

” হয়েছে হয়েছে এখন আমাকে এগুলো পরিষ্কার করে দাও। আমি এ অবস্থায় বাইরে যাব না। আমার সে এসেছে নিচে, খেলতে যাব।”

আধুনিক যুগের বাচ্চারা এতোটাই আপডেট যে এদের কথাবার্তা শুনলে বড়োরাই লজ্জায় পড়ে যায়।

সন্ধ্যা হতেই কনে বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নেই। আজ লাল রংয়ের থ্রি পিস পরেছি। ভাইয়া তৈরি হয়েছে। হাবলুকে আজ চেনা যাচ্ছে না। নথুন পাঞ্জাবীতে দারুণ লাগছে। মুখে থার অমায়িক হাসি যেন অনেক বছর পর প্রাণ খুলে হাসছে।
হাবলুর সাথে কথা বলে আগাচ্ছিলাম সাদা কইতরকে দেখে থেমে যাই। আবরারের ডাব্বার সাথে কথা দাঁড়িয়ে কথা বলছে। কালো রংয়ের পাঞ্জাবী পরেছে সাদা কইতর। আমাকে দেখে বুকে হাত,রেখে আবরারের ডাব্বার উদ্দেশ্যে বলে,
” আজ একটা অঘটন ঘটিয়েই ছাড়বো দোস্ত। তুই শুধু পাশে থাকিশ তাতেই চলবে।”

“আবরারের ডাব্বা বত্রিশ দাঁত বের করে হেসে বলে,
অবশ্যই আছি। তবে তোর কোন ছোট শালিকা থাকলে ভাল হতো রে!”

শালি না তোর কপালে কালি জুটবে রে আবরারের ডাব্বা। বাবাকে দেখে সাদা কইতর এগিয়ে এসে বলে,
” আয়মান আভাদের গাড়িতে উঠুক। রাতে কাকে যেন বলতে শুনেছিলাম, আয়মানের নাকি মাথা ঘুরাচ্ছে! মায়ের সাথে থাকলে ভাল লাগবে।”

সুন্দরী আন্টি যাচ্ছে নাকি? মাথা তো ঠিকই আছে তবে সাদা কইতর মিথ্যা বলল কেন? মুখ খুলে কিছু বলবো তার আগেই বাবার সামনে সাদা কইতর আমার হাত ধরে টেনে বাহিরে নিয়ে যায়। একেবারে গাড়িতে উঠিয়ে নিজেও পাশে বসে গাড়ির দরজা লক করে দেয়।
” কি হলো?”
” কি হবে? আমি কিছু করেছি?”
” নিপা ভাবিকে আনতে যাবো না?”
” যাবো তো! একসাথে নয়, আলাদা।”
” সাদা কইতর, তোমার মাথায় কি সমস্যা হয়েছে? আমাকে লুকিয়ে বিয়ে করার পর বলেছিলে, আভার স্বাধীনতায় কোন হস্তক্ষেপ করবে না। এখন তো দেখছি আমাকে ছাড়াই তোমার দিন রাত কাটে না।”

আমার কথায় সাদা কইতর মাথা চুলকায়। জানালার দিকে তাকিয়ে বলে,
” তোমার ঐ চোখের মায়াতে, পুড়ছি দিন রাত।
তোমার এলোমেলো কেশব গুছিয়ে দিতে, সময় চাই জান।”
————————-

বিয়ে শেষ। কনে বিদায়ের সময়। লিজা পিজ্জাও এসেছে। আমন্ত্রণ তো আমিই করেছিলাম, এখন পস্তাচ্ছি। মেয়েটা রাগি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। কারণও আছে, সাদা কইতর যে আমার চারপাশে ঘুরঘুর করছে। খাবারের পর্ব সমাপ্তি করে এক পাশে চেয়ার পেতে বসেছি। লিজাও সেই সময় পাশে বসে। সকলের অগোচরে আমার মাথার চুলের মুঠি ধরে ফেলে। আকস্মাত আক্রমণে নিজেকে সামলাতে পারিনি ব্যথার তাড়নায় ছটফট করছি। লিজা পিজ্জা আমার মুখের কাছে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

” তোকে সাবধান করে দিচ্ছি তুবা। আমার রাদের আশেপাশে আসবি না। রাদকে আমি অনেক ভালোবাসি।”

কত বড় সাহস মেয়েটার। আমার ভাইয়ের বিয়েতে এসে আমাকেই টর্চার করছে! একবার হাত ছাড়া পাই তোকে যদি আমি উত্তম মাধ্যম না দিয়েছি তো আমার নাম আয়মান তুবা না।

লিজা পিজ্জা আমাকে চুপ থাকতে দেখে আবার বলে ওঠে,
” রাদ তোর মাঝে কি এমন দেখেছে যে সারাদিন তোর পিছে ঘুর ঘুর করে! নিশ্চয়ই তুই তোর বাঁদরামি দিয়ে রাদের মাথা খেয়েছিস! এজন্যই তো রাদ তোর দিকে হয়ে গেছে। ব্যাপার না! তুই ঠিক থাকলেই সব ঠিক। আজ সাবধান করে দিচ্ছি আমার রাদের মাঝখানে আসলে তোকে আমি জ্যান্ত পুঁতে দিব।”

আর সহ্য হচ্ছে না। শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে লিজার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। অবশ্য তার জন্য মাথার কিছু চুলও বিসর্জন দিতে হয়েছে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সময় অপচয় করিনি। লিজা পিজ্জার মেকআপের স্তুবে ঢাকা গালে সজোরে থাপ্পড় দিলাম। ঐ যে স্টার জলসায় এক থাপ্পড়ে আকাশে বাতাসে সব জায়গায় প্রতিধ্বনি বাজে ঠিক তেমনই আমার থাপ্পড়ের আওয়াজে আশেপাশের মানুষের কানে চলে গিয়েছে। প্রমাণস্বরূপ সাদা কইতর। এতক্ষণ হিরোর আসার খবর ছিল না। থাপ্পড়ের আওয়াজ শুনেই এসেছে। ইতিমধ্যে আমি লিজার মাথার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকিয়ে বলছি,
” শয়তান মাইয়া। আমার জামাইয়ের দিকে নজর দিতে লজ্জা করে না? ঐ খচ্চর মাইয়া তুই বুঝিস না! একজন স্বামীই তার বউয়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করবে! তোর মতো লুচু নাকি সবাই হু! আজ একটা থাপ্পড় দিয়েছি। আমার জামাইকে নিয়ে উলটা পালটা বললে জে’লে ঢুকিয়ে দিব বলে দিলাম।”

এতোটুকু করেও ক্ষান্ত হলাম না। লিজাকে ছেড়ে দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা কইতরের কাছে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। লিজাকে দেখিয়ে সাদা কইতরে গালে চুমু দিয়ে বললাম,

“ছক্কা মেরে দিয়েছি সোয়ামি, এবার চলো বাসর করতে যাই তুমি আমি।”

সাদা কইতরের দিকে তাকিয়ে দেখি সে অবাক নয়নে আমাকে দেখছে। আশেপাশে ভালোভাবে নজর ঘুরিয়ে আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে,

” কখন যেন তুমি আমার হার্ট অ্যাটাকের কারণ হয়ে যাও। এভাবে কেউ দিন দুপুরে চুমু খেলে তো নিষিদ্ধ কিছু করতে ইচ্ছে করবে।”

” ফালতু কথা বাদ দাও তো সাদা কইতর! ওই লিজা পিজ্জাকে একটা থাপ্পড় মেরে আসো। না হলে আমার শান্তি লাগবে না।”

“তুমি তো মারলে এখন আমারও মরতে হবে?”

“অবশ্যই! বউকে যদি কেউ আঘাত করে স্বামীর সেখানে দায়িত্ব নায়ক সেজে প্রতিবাদ করা। যেহেতু আমি ব্যথা পেয়েছি এবার তুমি ডাবল ব্যথা এই মেয়েকে দিবে।”

” বউ আদেশ করেছে পালন না করলে তো আবার ঘরে জায়গা পাব না। কোথায় সেই মেয়ে যে আমার বউকে আঘাত করেছে!”

সামনে তাকিয়ে দেখি লিজা লিজার জায়গায় নেই। সে পালিয়েছে। হয়তো সাদা কইতরের হাতে মাইর খাওয়ার ভয়ে পালিয়েছে।

সাদা কইতর আমাকে একপাশে জড়িয়ে ধরে আমার নাকে টান দিয়ে আহ্লাদের সুরে বলে

” ও আমার মিষ্টি বউ! এত দুষ্টুমি করলে বউকে বাপের বাড়ি ফেলে রাখতে ইচ্ছে করবে না।”
” বাপের বাড়িই তো শান্তি। তুমি জানো না?”

সাদা কইতর আর কিছু বলল না। আমাকে নিয়ে গাড়ি করে সোজা বাসায় নিয়ে আসলো।
——————–

সাদা কইতর আজ আমার পাশ থেকে নড়ছেই না।
কিছুক্ষণ পরপর এটা সেটার অজুহাতে আমার কাছে আসছে। এই যে এখনো বান্দা চলে এসেছে ছোট্ট একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে। রান্নাঘর এসেছিলাম নিপা ভাবির জন্য লেবুর শরবত নিতে। সেখানেই চলে আসে। আমার হাতে প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলে,
” এটাতে ফোন আছে। আমি বাসায় যাচ্ছি। কল দিলে ধরবে। আমি জানি এখন তুমি বলবে যে, তোমার ফোন চালাতে ইচ্ছে হয় না ব্লা ব্লা। শুনে রাখো মেয়ে, আমার বউয়ের সাথে প্রেমালাপ করতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে তার ঘন নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনতে। মাতাল হতে তার দুষ্টুমিতে।”

সাদা কইতরের কথায় হেসে উত্তর দেই,

“আমি কি আর এখন আগের মত দুষ্টুমি করি? আমি অবশ্যই ফোন দেব। যখনই তোমার কথা মনে পড়বে তখনই তোমাকে স্মরণ করব। বলে দিলাম ঠিক তখনই আমার কাছে আসতে হবে।”

আবেদনময়ী কথা বলা সদা কইতরের কাছ থেকেই শিখেছি। আমার কথায় সাদা কইতরের মাথা আরো গরম হয়ে যায়। আমার কপালের ছোট্ট করে চুমু এঁকে য়কে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে যায়। আমি জানি রান্নাঘর থেকে বের হয়ে সে আর দাঁড়াবে না বরং বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে।

গভীর রাত। বাড়ির আত্মীয়-স্বজনরা সেই কখন বিদায় নিয়েছে। ভাইয়া ভাবি কেউ ঘরে ঢুকিয়ে রেখে এসেছি। অবশ্য ভাইয়ার কাছ থেকে মোটা অংকের টাকাও আদায় করে নিয়েছি। হাবলুর আজকে কোন দেখা মিলছে না সে ঘরে কোন কোনায় গিয়ে পড়ে আছে কে জানে! আজ হাবলুর কথা খোঁজ করতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে সাদা কইতরকে জ্বালাতন করি। তাইতো দরজা জানালা আটকে সাদা কইতরের দেওয়া মুঠোফোন বের করে কল লাগালাম। এখন সময় রাত ৩:০০ টা বাজে ১০ মিনিট। সাদা কইতর নিশ্চয়ই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।

এখন সাদা কইতরকে জ্বালাতন করলে সেই মজা হবে।পরপর ৩ থেকে ৪ বার কল দিয়ে যাচ্ছি। এখনো কল উঠানোর নাম নেই মানুষটার। অথচ সে আমাকে বলে গিয়েছে যখন ইচ্ছা তখনই তাকে কল দিতে। পঞ্চম বারের মতো কল লাগাতেই সাদা কইতর কল রিসিভ করে। ফোন কানে নিয়ে ঘুমু ঘুমু কণ্ঠস্বর বলে,

” ও আমার রাত জাগা পাখি! এত রাতে কি হয়েছে শুনি?”

” সাদা কইতরকে অনেক কাছে পেতে ইচ্ছে করছে। বসে গল্প করতে ইচ্ছে করছে। সাদা কইতরের হাতে হাত রেখে হাঁটতে ইচ্ছে করছে। বুকে মাথা রেখে ঘুমোতে ইচ্ছে করছে। এখন এত ইচ্ছে কীভাবে আমি একা পূরণ করি!”

” আচ্ছা তাই এমন বাজে ইচ্ছে হলে তো দূরে থাকা সম্ভবই না। আমি কি আসবো? এবার আসলে কিন্তু সদর দরজা দিয়ে ঢুকবো, লুকিয়ে আসবো না।”

“সাহস আছে কি?”

“তুমি কি আমাকে পরীক্ষা করছো?”

” পরীক্ষা না অনুভব করতে চাচ্ছি। তা স্বামীর কি ঘুম শেষ?”

” এত জ্বালাচ্ছে কেন আয়মান? যাও ঘুমাতে যাও।”

” তার মানে সাদা কইতর আসবে না। আমার সাথে কথা বলবে না। তাই না! ঠিক আছে। আসতে হবে না। আমার মনের ইচ্ছা মনে রেখে আমি ঘুমিয়ে যাই। এরপর যদি মারা যাই তখন কিন্তু আফসোস করবে। আমাকে খুঁজেও পাবে না।”

আয়মান তুবা অশান্তিতে থাকবে আর সবাইকে শান্তিতে ঘুমাতে দিবে সেটা কখনোই সম্ভব না। সাদাকইতকে জ্বালাতন করতে বেশ লেগেছে। এখন আমি ঘুম দেব, শান্তির ঘুম। সাদা কইতর সারারাত নির্ঘুম কাটাবে এরপর সকাল হলে আমাদের বাড়িতে আসবে এবং নির্ঘাত আমাকে শাস্তি দিতে আসবে।

প্রতিদিনের মতো সকাল সকাল আমার ঘুম ভাঙ্গে দরজার কড়াঘাতের আওয়াজে। আড়মোড়ে অপরপাশ ফিরতেই কারো উন্মুক্ত বক্ষবন্ধনী নজরে আসে। সাথে সাথে আমার ঘুম সব উবে যায়। চোখ বড়ো করে তাকাই মানুষটার পানে। এ তো সাদা কইতর! আমার ঘরে চলে এসেছে? আমার বিছানায় শুয়ে আছে! বাবা ভাইয়া জানলে তো কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। সাদা কইতর আরামে ঘুমাচ্ছে। দুই একবার আস্তে করে ডাক দিলাম তাকে। উঠার কোন খবর নেই। এবার রাগ হচ্ছে। সাদা কইতরের বুকে জোরে কামড় বসিয়ে দিয়ে দিলাম। এবার মহাশয়ের ঘুম ভেঙেছে। আমার মাথায় হাত দিয়ে সরিয়ে বলে,
” রাতে বিশ্বযুদ্ধ করে তোমাকে কাছে নিয়ে এসেছি। এবার ঘুমাতে দাও।”

নিয়ে এসেছে মানে? বিছানা দেকে উঠে পুরো ঘরে নজর ঘুরালাম। আরে! এটা তো সাদা কইতরের ঘর। আমি এখানে এলাম কীভাবে? আর কখন নিয়ে আসলো সে? দরজার কড়াঘাতে লাফিয়ে উঠলাম। ক্ষানিক ভয় পেয়েছিও। দরজার অপরপাশ থেকে পেট মোটা আনারস আঙ্কেল এবং সুন্দরী আন্টির কথা শুনছি,
” রাদ? সত্যিই কি তুই তুবাকে বিয়ে করেছিস? মান সম্মান তো ডুবাবি না? তুবার পরিবার কি বলেছে?”

সুন্দরী আন্টির কথা শুনে সাদা কইতরের দিকে রাগি চোখে তাকালাম। সাদা কইতর চোখ বন্ধ করে রেখেছে। ঘুম ঘুম সুরে উত্তর দেয় সে,
” ঘুম ভাঙেনি মা! এত অধৈর্য হয়ো না। তোমার ছেলে হারাম কিছু করেনি।”

” কত বড়ো বেয়াদব ছেলে দেখেছো? এত রাতে পাগলামি করেও শান্তি মিলেনি।”

সাদা কইতর এবার বিছানা থেকে উঠে বসলো। নিজের ঘারে কিছুক্ষণ মালিশ করে দরজা খুলতে চলে গেল।
এদিকে আমি যেন স্বপ্নের দুনিয়াতে অবস্থান করছি। কি হচ্ছে মাথায় ঢুকছে না। দরজা খুলতেই সুন্দরীআন্টি এবং পেট মোটা আনারস আঙ্কেলকে দেখতে পেলাম। সাদা কইতর দুজনকে সাইড কেটে বের হয়ে বলে,
” নতুন বউকে বরন করার কথা বলবো না। বলবো, নিজেদের সাথে মিশিয়ে নিতে শিখো। বউ নয়, মা ডাকো। তোমার ছেলে বড্ড ভালোবাসে তাকে।”

পেট মোটা আনারস আঙ্কেলের প্রেশার মনে হয় বেড়ে গিয়েছে। মাথায় হাত চেপে ছেলের পিছু পিছু চলে যায় সে। সুন্দরী আন্টি আমার কাছে এসে বলে,
” আমার মা আমার কাছে এত তাড়াতাড়ি চলে আসবে জানতামই না। আমি খুব খুশি তুবা মা! আমাকে মা ডাকবি তো!”

আসছেন আমার ইমোশনাল শাশুড়ি মা। কই এমন পুত্রবধূ পেয়ে অত্যাচার করবে তা না করে আহ্লাদ করছে। সুন্দরী আন্টিকে মা ডাকবো নাকি আন্টি তা জানি না। আমি ভাবছি, সাদা কইতরকে বর্তমানে কি বলে ডাকবো। আর কি বিচার করব। আমাকে এভাবে না জানিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে বলে কী শাস্তি দিব।
আমার ভাবনার মাঝেই সাদা কইতর ঘরে প্রবেশ করে। সুন্দরী আন্টিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,
” তোমার মেয়েটা খুব সুন্দর তাই না! ঠিক তার বরের মতো!”
” ওরে পাজি ছেলে। একে তো মেয়েটাকে হুট করে এভাবে নিয়ে আসলি। এখন আবার পাম দেওয়া হচ্ছে!”

সুন্দরী আন্টি চলে গেল। আমি ভ্রু যুগল কুঁচকে তাকে দেখছি। নেংটি কইতর কোথায় থেকে এসে জড়িয়ে ধরে বলল,
” তুমি নাকি আমার ভাবি? মা বলেছে তোমাকে নিচে নিয়ে যেতে।”
নেংটি কইতর জোর করে আমাকে নিচে নিয়ে যাচ্ছে। আমার নজর তখনও সাদা কইতরের দিকে। সাদা কইতর আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলে,

” এভাবে তাকিও না সুন্দরী, তোমার চাহনিতে কখন যেন হার্টের অসুখে ম’রি।”

চলবে…………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে