পিয়ানোর সুর
#৭মপর্ব
জোরে দরজা লাগানোর আওয়াজে বাবা রুমে এসে হাজির হলেন। আমার দিকে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। মাথানিচু করে অপরাধীর সুরে বললাম,
— কফির মগ ভেঙে ফেলেছি।
— চিন্তা কোরো না বুয়াকে দিয়ে ক্লিন করিয়ে নেবো। তোমার কী হলো এমন নাক গাল ফুলে পাকা ডালিম হয়ে আছে কেন? কে অপমান করলো আমার একটা মাত্র ডালিমকুমারকে!
— ও ড্যাড এসব যা তা নাম ধরে ডাকা বন্ধ করো। কোথায় পাও এত এত উদ্ভট নাম!
— বাংলার মায়েরা তাদের বাচ্চাদের আসল নাম ধরে ডাকে না। উদ্ভট নামে ডাকে। তোমার মা বিদেশী মা। এ কারণে তুমি উদ্ভট নামে অভ্যস্ত হওনি। যাক বাদ দাও, বলো এই অফ সিজনে আমার ডালিমকুমারের গাল ফুলে পাকা ডালিম হলো কেন?
— ড্যাড তুমি শুধরাবে না?
— না। পৃথিবীর সব পরিবর্তন হয়, বাবারা পরিবর্তন হয় না। হলে ছেলেরা বাবার মত হওয়ার স্বপ্ন দেখতো না। কী হয়েছে সৌরভ বলো?
— অভিমান হয়েছে ড্যাড।
— মিথি আজকে ইগ্নোর করলো তাই?
— হ্যাঁ।
— আরেএএ তোমার পায়ে কী হয়েছে? ভিজে লাল হয়ে আছে কেন অমন চাঁদের মত সুন্দর পা দুটো।
— ড্যাড চাঁদের মত পা হয় না চেহারা হয়।
— আমার ছেলের হয়। পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুরোটা চাঁদ তুমি, ফকফকা পূর্ণিমার চাঁদ। কথা না বাড়িয়ে বেডে বোসো আমায় দেখতে দাও কী হয়েছে।
— কিছু হয়নি। গরম কফি পড়ে লাল হয়ে গিয়েছে। ড্যাড মিথি চাঁদের মত। ওর গায়ের রঙ সিলভার গ্লিটারের মত চিকচিক করে।
— মিথিকে দেখে কফির মগ হাত থেকে ফস্কে গিয়েছিল?
— হ্যাঁ। আচ্ছা ড্যাড তুমি মিথিকে দেখে ঐ পচা পানিতে পড়ে যাওনি তো!
বাবা আমার কথায় জোরে হাসলেন। হাসতে হাসতে আমাকে ওয়াশরুমে নিয়ে নিজহাতে পা ধুয়ে দিলেন। বাঁধা দিইনি। দিলে শোনেন না। দুই বছরে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে বাবার এসব কাজে। আমার সব কাজ নিজে করেন।
সার্ভেন্ট সারা বাড়ীর কাজ করবে, বাবা শুধু আমার কাজ করবেন এটাই রুলস হয়ে গিয়েছে বিগত দুই বছরে। সোফায় বসিয়ে সেন্টার টেবিলের ওপরে আমার পা দুটো তুলে মুছে দিলেন। অয়েন্টমেন্ট এপ্লাই করতে এলে পা গুটিয়ে নিলাম। বাবা অবাক হলেন।
আনমনে বললাম,
— মিথিকে ডাকো। ওরজন্য পা পুড়েছে। ওই এসে মেডিসিন লাগাক। নইলে নয়।
— সৌরভ কথা শোনো বেটা..
— ড্যাড আমি কী বাঙালী ছেলেদের মত বখাটে আচরণ করছি?
— হুম।
— অবাধ্য হচ্ছি?
— হুম।
— মিথি আমাকে বখাটে বানিয়ে দিল ড্যাড। আই’ম ফিনিশড!
বাবা লম্বা শ্বাস ছেড়ে কিছুক্ষণ থম মেরে রইলেন। তারপর বললেন,
— মিথি আসবে না। ওর বড়মামী ওকে দিয়ে সাত সকাল সবজি কিনতে নীচে পাঠিয়েছিল। রাস্তার ভ্যান থেকে পচা পানিতে দাঁড়িয়ে সবজি কিনছিল অতটুকুন মেয়েটা। আমি মিথির আগেই সবজি কেনার জন্য ভ্যানের সামনে রিক্সায় বসে সবজি বাছাই করছিলাম। রজনীগন্ধা ফুলের মিষ্টি একটা ঘ্রাণ নাকে লাগলো। হাটু সমান পচা পানিতে রিক্সায় বসে সবজি কিনছি ওখানে রজনীগন্ধা কোত্থেকে আসবে বলো। ঐসময় মিথি এল।
মিথিকে দেখে সবজি ওয়ালা অবাক চোখে তাকালো। সবজিওয়ালার কী দোষ আমি নিজেই চোখ ফেরাতে পারিনি। অসহ্য সুন্দর একটা বার্বিডলের মত মেয়ে অনায়াসে পচা পানিতে পা ডুবিয়ে হেটে হেটে সবজি কিনতে ভ্যানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে অচেনা আমাকে সালাম দিল। সিক্সথ সেন্স বলল, ঐ মেয়েটা আমার ছেলের মিথি না হয়ে যা’ই না। ওকে আগে কখনো দেখিনি। নাম জিজ্ঞেস করতেই মিষ্টি হেসে বলে দিল “মিথি”। ব্যস আমিও নেমে পড়লাম।
— কোথায় নামলে ড্যাড (আমি টোটালি শকড)?
— কোথায় আবার ঐ নর্দমার পানিতে। ইউ নো সৌরভ, মিথি নামতেই পচা পানি টলটলে স্বচ্ছ, পরিষ্কার হয়ে গেল!
— ও ড্যাড নট এগেইন.. মিথির দিকে নজর দিও না।
হো হো করে অট্টহাসি হাসতে হাসতে বাবা বললেন,
— অয়েন্টমেন্ট লাগাতে দাও নজর দেবো না।
— মিথি লাগিয়ে দেবে।
বাবা বেশ মনমরা হলেন। বললেন,
— মিথি আসবে না সৌরভ। ওর সাথে অনেক কথা হয়েছে আমার। ফ্যামিলি খুব কড়া শাসনে রাখে ওকে। এ বাসায় আসার অনুমতি দেবে না।
সত্যিই এল না মিথি। বিকেলের দিকে গা কাঁপিয়ে জ্বর এল আমার। পায়ের জ্বলুনি কমে অসহ্য মাথাব্যথা বাড়লো। লাঞ্চ করার রুচি হয়নি। বিকেলে বাবা আমায় বেডরুমে দেখতে এসে জানলেন সব।
জ্বরের পারদ যত উপরে উঠছে ধীরে ধীরে আমি অনেকটা সেন্সলেস কন্ডিশনে.. ঘোরের মধ্যে প্রলাপ বকছি।
সারারাত বাবা পাশে ছিলেন। পরদিন সকাল হতে না হতে বাবার এক বন্ধু এলেন আমায় দেখতে। পেশায় ডাক্তার, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। এক পলক দেখে চোখ বন্ধ করে নিলাম। ভালো লাগছে না কাউকে দেখতে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেলে বাসা ভরে গেল আত্মীয়স্বজনে। ডেঙ্গুজ্বর, করোনা, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড ইত্যাদি রোগের নাম অনুমানে দিয়ে ভরে ফেললো। কথা বলার শক্তি নেই। বডি পেইনে অসাড় নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছি। রাতে ঠিক হলো হসপিটালে এডমিট করবে।
জ্বরের ঘোরে ফিসফিস করে বাবাকে বললাম,
— মিথিকে এনে দাও বাবা জ্বর সেরে যাবে।
সে রাতে সারাটা রাত বাবা আমায় বুকে জড়িয়ে রইলেন।
…
চলবে……