পিয়ানোর সুর
#৪র্থপর্ব
এরই মধ্যে টিনার সাথে পরিচয়। খুবই মিষ্টি চেহারার এক আইরিশ বংশোদ্ভূত মেয়ে টিনা। পা থেকে মাথা পর্যন্ত ওয়াইল্ড ক্যারেক্টর। দারুণ প্রাণবন্ত। হাইওয়েতে রোড এক্সিডেন্টে আমাদের পরিচয়ের সূত্র। এক মাতাল ড্রাইভার ওর প্রাইভেট কার ঠুকে দিয়েছিল। আমি যাচ্ছিলাম সে পথ দিয়ে। তখনো সাহায্য এসে পৌঁছেনি। গাড়ী থামিয়ে জানতে চাইলাম কোনো হেল্প লাগবে কিনা। মিষ্টি হেসে টিনা মাথা নেড়ে সায় জানিয়েছিল। বয়সের দিক দিয়ে টিনা আমার এক বছরের বড় ছিল। দেখতে একেবারে ইনোসেন্ট সুইট সিক্সটিনথ লাগছিল। বিপদে হাত বাড়ানো টিনাকে মুগ্ধ করেছিল। সেই থেকে শুরু দারুণ একটা এডভেঞ্চার লাইফ। মেয়েটি ভ্রমণ পিয়াসী। ছুটে বেড়াতে পছন্দ করতো। ওরসাথে জড়িয়ে আমিও যেন হয়ে উঠলাম ওরই মত একজন। বেশ কিছুদিন লাগামহীন জীবন যাপনে অভ্যস্ত হওয়ায় মায়ের নজর পড়লো। বাঁধা দিলেন, বোঝালেন। টিনাকে নিয়ে এসে মায়ের সঙ্গে মিট করিয়ে দিলাম। ততদিনে মা হয়ে উঠেছেন রক্ষণশীল এক ঘরোয়া নারী। মায়ের যে রূপটি দেখতে বাবা ভীষণ তৃষ্ণার্ত ছিলেন। দুর্ভাগা দুজনেই। কেউ কারো পছন্দমতো পরিবর্তন সময় থাকতে দেখতে পায়নি। টিনা এবং মা কেউ কাউকে পছন্দ করেনি। স্বল্প বসনা টিনাকে প্রথম দেখাতেই মা ভীষণ ম্রিয়মাণ হয়ে গেলেন। হলেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্বল্পভাষী। টিনা এই গোমড়ামুখো নারীকে ইন ল’স হিসেবে পছন্দ করলো না। সেদিনের পর দ্বিতীয় বার আমাদের বাসায় আসেনি টিনা। ওর বল্গাহীন প্রেম আর মায়ের বাঁধা দেয়া দুই দিকের এই টানা হেঁচড়ায় দ্রুত ঘর ছাড়লাম আমি। টিনা এবং আমার দুজনের জমানো টাকায় আর কিস্তিতে ছোট্ট একটা আড়াই রুমের এপার্টমেন্ট কিনলাম। পড়াশোনা লাটে তুলে জব নিলাম। মা বাঁধ সাধলেন। জব বাদ দিয়ে পড়তে বললেন। জবের সেলারি যা তা তিনিই দেবেন বললেন, রিকোয়েস্ট করলেন ভার্সিটির লাস্ট ইয়ারে এসে যেন স্টাডি না ছাড়ি। টিনার পছন্দ না হলেও আমি রাজি হয়ে গেলাম। টিনার আড়ালে মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ছিলাম। মা সুযোগ নিলেন। পড়ার পাশাপাশি আবারও অনলাইনে ধর্ম শিক্ষা আর বাংলা স্কুলে যাতায়াত বাড়লো। টিনা জানতো জবে থাকি ঐ সময়টা। তিক্ততা এড়াতে এইটুকু হাইড এন্ড সিক খেলতে হয়েছিল আমাকে। কী করবো, মাকে কষ্ট দিতে চাইনি।
একবার এক জন্মদিনে মাকে উইশ করতে গেলে মা জানালেন আমার বাবার পরিবার কতটা রক্ষণশীল। বাংলাদেশের কালচার সম্পর্কে জানাতে নিয়ে গেলেন বাঙালী পাড়ায় বাবার এক বাল্যবন্ধুর বাড়ী। মূলত তার মাধ্যমেই বাবার সাথে যোগাযোগ হলো।
টিনার সাথে বাউণ্ডুলে লাভ লাইফে সময় যেন হাওয়ায় উড়ছিল। মায়ের কথাও শুনছিলাম। বাংলা শিক্ষা দারুণ লাগছে। প্রতিদিন ক্লাস শেষে যুদ্ধ জয়ের অনুভূতি হত।
এরপর একদিন আশ্চর্য এক ঘটনা ঘটলো। মায়ের আরেক জন্মদিনের দিন বাবার সাথে প্রথম কথা হয় আমার। আমি তখন দুরন্ত যুবক। রক্ত গরম। ফোনে বাবার রাশভারী কন্ঠ শুনে ভয়ে কেঁপে উঠলাম। রক্তে হিম শীতল অনুভূত হল। দুরন্ত যুবক থেকে মুহূর্তেই বাধ্য অনুগত ভীরু বাচ্চা হয়ে গেলাম যেন বাবা যখন প্রথম বললেন,
— সৌরভ! ও মাইবয় আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ!
বাংলার শুদ্ধ উচ্চারণে আমি প্রথম যে শব্দটা গলায় কাঁপুনি তুলে বললাম, তা ছিল,
— বাবা!
ওয়ালাইকুমুস সালাম! তুমি কেমন আছো বাবা?
ফোনের অপরপ্রান্তে বাবা থমকে গেলেন। ফোঁপানোর ক্ষীণ আওয়াজ এল। এরপর তিনি লাইন কেটে দিলেন। আমি অস্থির হয়ে উঠলাম বাবাকে শুনতে। তিনি ফোনে এলেন না। মায়ের বুকে মুখগুঁজে হাউমাউ করে বাচ্চাদের মত কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
— ও মম আমি বাবাকে শুনবো মম বাবাকে বলো কথা বলতে মম প্লীজ বাবাকে বলো হার্ড বিহেইভ না করতে আই মিস মাই ড্যাড মম.. বাবাকে বলো আরেকটু কথা বলতে মম… প্লীজ!
মা আমাকে জড়িয়ে নীরবে কাঁদলেন শুধু। বাবার সাথে কথা বলিয়ে দিতে পারলেন না। আঙ্কেল খুব চেষ্টা করলেন কিন্তু বাবাকে ফোনে রিচ করতে পারলেন না। পরাজিত অথর্ব অনুভূতি নিয়ে মাকে ফেলে একছুটে বের হয়ে এসেছিলাম ঐদিন।
ভীষণ অভিমানে মায়ের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে পুরোপুরি ভাবে আমি যেন টিনার হয়ে গেলাম। যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেও মায়ের তরফ থেকে সপ্তাহ, মাসান্তে একাউন্টে টাকা জমা হতে লাগলো। বাধ্য হয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হলো এবং এক্সট্রা কারিকুলাম ক্লাসগুলোও। মা যেন কিছুতেই পিছু ছাড়বেন না। ওনাকে ঠিক তখন আর ব্রিটিশ নাগরিক মনে হলো না। এ যেন পুরোপুরি আধিভৌতিক এক বাংলাদেশী সঙ্কীর্ণমনা নারী। যাকে বাবা চেয়েছিল খুব। সে বাবার পছন্দের নারী হয়ে আমার জীবন অতিষ্ঠ করতে উঠেপড়ে লাগলেন খুব গোপনে, চাতুর্যের সাথে। টিনাকে বুঝতে দিইনি মায়ের এধরণের অত্যাচার। মা টিনাকে নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাচ্ছিলেন না। ওনার সব মনোযোগ আমাকে ঘিরে। হটাৎ একদিন ব্যাংক একাউন্টে মোটা অংকের টাকা জমা হওয়ার মেসেজ এল। টিনাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। পরে চেক করবো ভেবে নোটবুকে টুকে রেখেছি। পরের সপ্তাহে ব্যাংক স্টেটমেন্ট তুলতে গিয়ে জানতে পারলাম বাংলাদেশের একটি একাউন্ট থেকে এই এমাউন্ট ট্রান্সফার করা হয়েছে। প্রেরকের নাম – সাদমান আশরাফি মৃধা। আমার বাবার নাম প্রেরকের জায়গায় দেখে ছুটে গেলাম মায়ের কাছে। মা যেন জানতেন সবই। মিটিমিটি হাসলেন আমায় দেখে। কিছু বলার আগেই বললেন,
— এখন থেকে এই গরীব মায়ের অল্প টাকার মুখাপেক্ষী হতে হবে না তোমাকে। বাবার টাকায় মানুষ হবে তুমি। তোমার সব অভাব দূর হবে।
চোখের কোণ ভিজে উঠতেই তা আড়াল করতে তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম,
— ভালোবাসা ছাড়া আর কোনো অভাব নেই আমার।
— কেন টিনা ভালোবাসে না?
— তুমি ভালো করেই জানো কোন ভালোবাসার কথা বলছি।
— চিন্তা কোরো না আমার বাচ্চা। তোমার সেই অভাব শীঘ্রই দূর হবে। বাবার দেশে যাবে তুমি।
— প্রশ্নই ওঠে না। ঐ দেশে কখনো যাবো না আমি।
— তোমার বাবা অসুস্থ। তাকে দেখতে যাবে না!
যেভাবে দপ করে জ্বলে উঠেছিলাম তেমনি দপ করে নিভে গেলাম বাবা অসুস্থ শুনে। টিনার কাছে ফিরে এসে ওকে সব জানালাম। ও বিরক্ত হলো। সাফ না করে দিল মা, বাবার সাথে যোগাযোগ রাখতে। যে বাবা মা আমাকে এত অবহেলা দিয়েছে তাঁদের সাথে সম্পর্ক রাখায় টিনার ভীষণ আপত্তি। মতের মিল হওয়ায় সানন্দে মেনে নিয়েছি টিনার কথা।
মাঝে কেটে গেল চারটি বছর। লিভ ইন রিলেশনশিপে টিনা খুব সুখী। আমিও। একদিন বিয়ে করার ইচ্ছে জাগলো। টিনাকে বললাম। রাজি হলো না। বিয়ে করে বাচ্চাকাচ্চার মা হওয়ার কোনো খায়েশ নেই ক্লিয়ারলি বলে দিল। মানসিকভাবে মারাত্মক ভেঙে পড়লাম আমি। ডিপ্রেশনে চলে গেলাম। ড্রাগ নিচ্ছিলাম নইলে ঘুম হত না। মা কীভাবে যেন জেনে গেল তা। ডাকলেন। মনটা ভাঙাই ছিল। ততদিনে টিনার প্রতি অব্যক্ত ক্ষোভ জমে পাহাড়। রাতের কিছু সময় ফিজিক্যাল নিডস ছাড়া আমাদের মাঝে সব ধরণের মেন্টাল এটাচমেন্ট কমতে শুরু করেছিল বেশ আগে থেকে। মায়ের ডাকে সাড়া দিলাম তাঁর বায়ান্নতম জন্মদিনে। আমায় দেখে কোনো রকম ভণিতা ছাড়াই নিভে যাওয়া কন্ঠে মা সরাসরি বললেন,
— সালমান বাবার কাছে যাও। সাদমান অসুস্থ। মৃত্যু শয্যায়। তোমাকে শেষ বারের মত দেখতে চাইছেন।
পায়ের তলার মাটি সরে গেল আমার।
…
চলবে…….