পরিণতি পর্ব -২
লেখক:জান্নাতুল ফেরদৌস মীম
সকালে ঘুম থেকে উঠেই মোহনা প্রতিদিনের মতো মেহজানকে তুলে, স্কুলের জন্য তৈরি করে নিয়ে বের হয়ে গেলো।
বীনা আহমেদ দরজা লাগিয়ে বাসার সব কিছু গুছিয়ে রাখলো। মোহনার চেঞ্জ করা কাপড় গুলো গুছিয়ে আলমারিতে রাখতে গিয়ে একটা শাড়ির দিকে তার চোখ আটকে গেলো।শাড়িটা মোহনার বিয়ের। লাল টকটকে একটা বেনারসি। মেয়েটা কত যত্ন করে শাড়িটা রেখে দিয়েছে।কাপড় গুলো রেখে বীনা আহমেদ জানালার পাশে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলো।আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে পুরোনো কথা গুলো ভাবতে থাকে।
মোহনা মা আর মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় এ বাসাটায় উঠেছে এক মাস হলো। দোতলা বাসাটার দুপাশে দুইটা ফ্লাটের মাঝে বাম পাশের ফ্লাটে তারা থাকে। খুব বড় কোন বাসা না। কম টাকার মাঝে এর থেকে ভালো বাসা পাওয়া যাবে না।দুইটা রুম, ড্রইং রুম, ডাইনিক একসাথে, রান্নাঘর,একটা টয়লেট।
রুম গুলো খুব একটা বড় না তবুও মানিয়ে নেয়া যায়।ডিসেম্বরের শেষের দিকে এ বাড়িতে উঠেছে তারা।মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করেছে। কষ্ট করে একটা চাকরী জোগাড় করেছে যদিও চাকরীটা পাওয়ার জন্য মোহনার মামা তাকে সাহায্য করেছে।
মোহনার ছোট বেলার স্মৃতি খুব একটা ভালো না বলা যায়।বাবার আদর তেমন পায়নি বললেই চলে।বীনা আহমেদ ছিলো মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে।তার বড় এক ভাই। বাবা মা মারা যাওয়ার পর ভায়ের কাছেই বড় হয়। তারপর বিয়ে হয় এক ব্যবসায়ীর কাছে। বিয়ের প্রথম কয়েক মাস খুব ভালোই যায় তাদের।
অনেক দিন পর বীনা আহমেদ টের পায় তার স্বামী মদ খায়। এতোদিন এটা সে বুঝতে পারে নি। তবে, যেদিন ধরা পরে তিনি বলেন, আজই প্রথম খেয়েছেন।বীনা আহমেদ সেদিন তার স্বামীকে ক্ষমা করে দেন। তিনিও প্রতিশ্রুতি দেন আর কোন দিন মদ খাবেন না।
একদিন বাহির থেকে আসার পর বোঝা যায় বীনা আহমেদ এর স্বামী মোনোয়ার আহমেদ কোন কারনে খুব আপসেট।বীনা আহমেদ কি হয়েছে জানতে চাইলে তিনি কিছুই না বলে বসে থাকেন।আরো কয়েকবার জিঙ্গেস করার ফলে তিনি বিরক্ত হয়ে স্ত্রী কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন তার পর রুম থেকে বের হয়ে চলে যায়। বীনা আহমেদ এ ঘটনায় খুব অবাক হয়েছিলেন।তবে স্বামীর এমন ব্যবহারেরর কথা কাওকে বলেন নি তিনি।বরং, এর পর থেকে তিনি আর তার স্বামীর ব্যাপারে তেমন ঘাটাঘাটি করেন নি।
তার পর থেকে অনেকদিন পর্যন্ত সব কিছু ভালোই যায়।বিয়ের একবছর পর বীনা আহমেদের কোল আলো করে জন্ম হয় এক কন্যা সন্তানের।মনোয়ার আহমেদই সেদিন মেয়ের নাম রাখেন, মোহসিনা মোহনা।
বীনা আহমেদ এর দিন গুলো খুব ভালোই যাচ্ছিলো।স্বামী সংসার নিয়ে তিনি খুব সুখে ছিলেন। মনোয়ার আহমেদ বাহির থেকে আসার সময়ই মেয়ের জন্য কিছুনা কিছু নিয়ে আসতেন। মেয়ের জন্য ভালোবাসার কোন কমতি ছিলো না ।
কিন্তু বিপত্তি টা ঘটলো তখনই।মোহনা যখন ক্লাস সেভেন এ পড়ে। বীনা আহমেদ সেদিন স্বামীকে আবার আপসেট থাকতে দেখে জিঙ্গেস করেন কি হয়েছে ? কিন্তু মোনোয়ার আহমেদ সেদিনও স্ত্রীকে কিছুই বলেন নি।এর তিন চার দিন পর বীনা আহমেদ তার স্বামীকে ফোনে কারোর সাথে কথা বলতে শুনেন। কথাগুলো শুনে বীনা আহমেদ সেদিন ফ্লোরে ধপ করে বসে পরেছিলো।
মোনোয়ার আহমেদ বলছিলো,
– হ্যা বাচ্চা টা আমার আমি স্বীকার করছি। তবে, এখন কিছু করার নেই। বাসায় এসব জানলে খুব খারাপ কিছু হয়ে যাবে।
–
– না বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলো তুমি।
–
– আরে বাবা বাচ্চা নষ্ট করতে বলেছি। তোমাকে মরে যেতে বলিনি।তোমাকে খুব তাড়াতাড়ি ঘরে তুলবো।
–
– হ্যা কথা দিচ্ছি।
কথা গুলো বলে মোনোয়ার আহমেদ পেছন ফিরতেই তার স্ত্রীকে এভাবে বসে থাকতে দেখতে পায়।তার আর বুঝাতে বাকি রইলো না যে স্ত্রী সব শুনে ফেলেছে।তবুও তিনি বীনা আহমেদের কাছে গিয়ে তার কাধে হাত রাখলেন।
বীনা আহমেদের চারপাশ ঘুরছিলো।চোখ দিয়ে অশ্রুধারা ছুটেছে।তিনি বুঝতে পারছিলেন না এখন তার কি করা উচিত।
মোনোয়ার আহমেদ কাধে হাত রেখে বললেন আমার কথাটা শুনো।
বীনা আহমেদ ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললেন,
– ফোনে যা বলতে শুনলাম তা কি সত্যি?
-শুনো আমি খুলে বলছি সবটা।
– আমাদের মেয়ের কছম। শুধু শুনতে চাই, সত্যি কি না?
– হ্যা সত্যি
বীনা আহমেদ এক ঝটকা দিয়ে স্বামীর হাতটা কাধ থেকে ফেলে দেন।
উঠে সোজা পাশের রুমে চলে যায়।মোহনা ঘুমোচ্ছিলো।তিনি মোহনাকে কোন রকমে তুলে বাসা থেকে বের হতে নেয়।
মনোয়ার আহমেদ স্ত্রীর হাত ধরে আটকিয়ে বলেন,
– যেখানে যাচ্ছো যাও।আমার মেয়ে কোথাও যাবে না। ওকে রেখে তুমি চলে যাও।
– বীনা আহমেদ এ কথা শুনে আরো অবাক হয়ে যায়।তিনি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে, মোহনাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
– তোমার বাবা আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করেছেন।বিয়ে করেছেন কিনা তা ও জানি না তবে তোমার বাবার বাচ্চা আরেকটা মেয়ের গর্ভে।আমি চলে যাচ্ছি তুমি কি এর পরও তোমার বাবার সাথে থাকবে?
মোহনা তখন খুব একটা ছোট না, সে বুঝে গেছে তার বাবা কত বড় জঘন্য একটা কাজ করেছেন।তবে এমন পরিস্থিতিতে কি বলতে হয় তা মোহনার মতো মেয়ের জানা ছিলো না।সে স্তব্ধ হয়ে শুধু দাড়িয়েছিলো।লক্ষ করছিলো তার মা এর চোখ দিয়ে অগনিত ভাবে পানি ঝড়ছে।মায়ের কান্না দেখে মোহনাও কাঁদতে থাকে।বীনা আহমেদ স্বামীকে বললেন,
-এমনটা কেনো করলে? আমার সাথে তুমি সুখি ছিলে না..?
মোনয়ার আহমেদ চুপ করে রইলেন। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে বীনা আহমেদ গলা উঁচু করে বললেন, এখন চুপ করে থাকলে তো হবে না। উত্তর দাও আমার কথার!
মনোয়ার আহমেদ বলতে শুরু করেন,
– আমার বিয়ের আগে একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিলো। বাবা মা মেনে না নেয়াতে জোড় করেই তোমার সাথে বিয়ে দিয়ে দেয় সেদিন।আমি চেয়েছিলাম তোমার সাথে মানিয়ে নিতে।সংসারটাতে মন বসাতে।তবে পারছিলাম না।তবুও চেষ্টা করে যাই। আমাদের মেয়ে হওয়ার পর আমি মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন একটা শান্তি পেতাম। পুরোনো সব কিছু ভুলতে থাকি। তবে কিছুদিন আগে আবার তার সাথে আমার দেখা হয়।সে বিয়ে করেনি।আমার অপেক্ষায় ছিলো।আমি তাকে ভালোবাসতাম, এখনো বাসি। তাই কিছু না ভেবেই বিয়ে করে ফেলি। তোমার কথা সবই ও জানে।তোমার সংসারে তাই বাধা হতে আসেনি।
কথা গুলো শুনে বীনা আহমেদের আর কিছু বুঝতে বাকি রইলেন না যে তার স্বামী ওই মেয়েটাকেই ভালোবাসে।শুধু তার সাথে থাকতে চায় মোহনার জন্য।তিনি কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না।তবে মোহনাকে ছাড়া তিনিও বাঁচবেন না।আর সৎ মায়ের ঘরে মেয়েকে রেখে গেলে কি অবস্থা হবে তা ভেবেই বীনা আহমেদের শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো।তিনি আর কিচ্ছু না ভেবে মোহনাকে নিয়ে বের হয়ে যেতে নেন।কিন্তি তখন মনোয়ার আহমেদ আবার স্ত্রীর হাত ধরে আটকালেন, মোহনা সেদিন মুখ খুলে বলে, ‘বাবা আমি মায়ের সাথেই চলে যাবো।’
কথাটা শুনা মাত্র মনোয়ার আহমেদ স্ত্রীর হাত ছেড়ে দেন।বের হওয়ার সময় বলেন, ‘এতো রাতে কোথায় যাবে ? সকালে যেও।’কিন্তু এর পর আর এক মুহুর্তও সে বাড়িতে থাকেনি বীনা আহমেদ, মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে যায় রাস্তায়।
এতো রাতে কোথায় যাবে ভেবে পাচ্ছিলেন না তিনি। ভাইয়ের বাসায় যেতে ইচ্ছে করছিলো না, পরের উপর বোঝা হওয়ার কোন ইচ্ছা তার নেই তবে কোন পথ না পেয়ে ভাইয়ের বাসায়ই চলে গেলেন।
চলবে….