পরিণতি পর্ব-৩

0
1279

পরিণতি পর্ব-৩
লেখক:জান্নাতুল ফেরদৌস মীম

রাজিব আর তার স্ত্রী, দরজা খুলে এতো রাতে বোন আর ভাগ্নিকে দেখে ভয়ে আঁতকে উঠেন।চোখ মুখ শুকনো হয়ে আছে তাদের। অজানা এক ভয় রাজিবের মনের ভেতর লেগে গেলো। বাসায় ঢুকে ভাই ভাবিকে সবটা খুলে বললো বীনা।বলার সময় তার ভেতর টা কষ্টে শেষ হয়ে যাচ্ছিলো।

তারপর সেখানেই ভাইয়ের বাসায় মেয়েকে নিয়ে ছিলেন তিনি। তবে এক সময় তার নিজের কাছে সংকোচ লাগতে থাকে। তার ভাইয়ের মধ্যবিত্ত পরিবারে সে আর তার মেয়ে গিয়ে পরেছে! ভাই ভাবি ভালো বলে কিছু বলছে না। তবে, তার নিজের কাছেই ব্যাপার টা খারাপ লাগে।একসময় বীনা সবাইকে বুঝিয়ে অন্যত্র চলে যেতে চায়। তবে, ভাই ভাবিই সেটা করতে দেয়নি। তারপর থেকে মোহনা কে নিয়ে বীনা আহমেদ তার ভাইয়ের বাসাতেই থাকেন। একটা সেলাই মেশিন কিনে সেলাই করেন, হাতের কাজ করে কিছু টাকা উপার্জন করেন, যাতে ভাইয়ের সংসারে কিছু হলেও দিতে পারে।এভাবে হাজারো কষ্টের মধ্যে দিয়ে পার হওয়া জীবন তাদের। ভেবেছিলো মেয়েটা জীবনে অনেক বড় হবে। সুখি হবে।তবে কে জানতো মোহনার জীবনটা তার থেকেও খারাপ হয়ে যাবে।

আনমনে এসবই অনেকটা সময় ধরে ভাবছিলো বীনা আহমেদ।পুরোনো স্মৃতি গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতেই চোখজোড়া পানিতে ঝাপসা হয়ে উঠেছিলো তিনি চোখ থেকে চশমা টা খুলে, আঁচল দিয়ে চোখ টা মুছে, আবার চশমা টা পড়ে নিলেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন অনেকটা সময় চলে গেছে। রান্না করে মেহজান কে স্কুল থেকে আনতে যেতে হবে।

এভাবেই চলতে থাকে তাদের সংসার।দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে যায়। মোহনা মা ও মেয়েকে নিয়ে এখন অনেকটা সুখে আছে। অফিসে ভালো কাজের জন্য বস তাকে প্রোমোশন দিয়েছেন, নাচের জন্য আসা মেয়েগুলোর সংখ্যা বেড়েছে। তাদের নাচ শেখানোর জন্য এখন আলাদা একটা রুম ভাড়া নিয়েছে মোহনা। মেহজান আরো একটা বছরে একটু বড় হয়েছে। কেজি শ্রেণী থেকে যেদিন বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়, সেদিন বিকেলে বাসায় আসার পর দেখে, মেহজান আজ ঘুমোয় নি।কলিং বেল চাপার পর মা এসে দড়জা খুলে দিতেই মোহনা দেখে, মেহজান হাতে করে রেজাল্ট কার্ডটা নিয়ে দৌড়ে রুম থেকে তার দিকে আসছে।ঘাড়ের চুল গুলো নড়ছিল। মোহনার কাছে এসে বলে,

-আম্মু আমি ওয়ানে উঠে গেছি।ম্যাম বলেছে আমি নাকি অনেক ভালো রেজাল্ট করেছি।
মোহনা হেসে রেজাল্ট কার্ডটা দেখে, মেহনাজ সেকেন্ড হয়েছে।মেয়ের গালে একটা চুমু দেয় সে।

এভাবেই মা আর মেয়েকে নিয়ে বেশ সুখেই আছে মোহনা।দিন গুলো বেশ ভালোই যাচ্ছে।প্রতিদিন মেহনাজকে স্কুলে দিয়ে আসা, বিকেলে নাচের ক্লাস, সন্ধায় মেয়ের সাথে খুনশুটি, মেয়ের পাঁকা পাঁকা কাথা শুনে দিনগুলো পার হচ্ছে।

একদিন সন্ধায় মোহনা আর তার মা বসে চা খাচ্ছিল, পাশেই মেহজান খাটে বসে হোমওয়ার্ক গুলো করছিলো।মোহনা মেয়েকে দেখছে চোখের উপর পরা চুল গুলোকে বার বার ঠিক করছে।এক সময় বলেই উঠলো,

-উফ মা আর পারছি না এই চুল গুলোকে আমি কুচিকুচি করে কেটে ফেলবো বলেই মুখটা ফুলিয়ে দিলো।

মেয়ের এভাবে কথা শুনে মোহনা আর তার মা হেসে পড়ে যাচ্ছিলো, তখনি মেহজান এসে মোহনার কোলে উঠে বসে। মোহনার মুখ ধরে বলা শুরু করে হুহ এভাবে হাসবে না। চুল গুলো কেটে দিলে তোমাকে চকলেট দিবো ।
কি ভেবে যেনো আবার বলে,

– ওহ আম্মু, আজ না ক্লাসে এক টিচার আমাকে অনেক গুলো চকলেট দিয়েছে।আর বলেছে ভালো করে পড়াশুনা করতে।মায়ের সব কথা শুনে চলতে।

-কোন টিচার উনি? নাম জানো?
– উম রিয়ান টিচার।আমাকে টিচার এত্তো এত্তো আদর করে।জানো আম্মু টিচার কে একদম বাবার মতোই লাগে আমার কাছে।বাবার ওই ছবিটাই বাবাকে যেমন দেখা যায় ঠিক তেমন।
কথাটা শুনেই মোহনা গম্ভীর হয়ে যায়।

-তোমার টিচার আর কিছু বলেছে তোমাকে?
-হু টিচার তো রোজই কত কথা বলে
– কি বলে?
– আমি ঠিক করে পড়াশুনা করি কিনা? বাসায় সবার কথা শুনে চলি কিনা..?
-হুম আচ্ছা যাও। এখন বসে হোমওয়ার্ক গুলো শেষ করো।

তারপর মেহজান আবার লিখতে শুরু করে।
মোহনা একদম চুপ হয়ে বসে থাকে।বীনা আহমেদ বুঝতে পারে এখন তার মেয়ে কি ভাবছে।একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে তিনি উঠে চলে যায়।

পরের দিন মেহজান কে স্কুলে দিয়ে মোহনা অফিসে চলে যায়। স্কুল শেষে মেহজান অপেক্ষা করছিলো তার নানু আসার।তখন পেছন থেকে একজন ডাক দেয় মেহজান কে। মেহজান তাকিয়ে দেখে তার রিয়ান টিচার। মেহজান রিয়ানকে দেখেই খুশি হয়ে যায়।রিয়ান মেহজানের সামনে এসে জিঙ্গেস করে,

-নানুর জন্য অপেক্ষা করছো?
-হুহ, নানু আজ দেরি করে আসছে ! বাসায় গিয়ে আমি নানুকে ইচ্ছে মতো বঁকা দিবো।
রিয়ান হেসে দিয়ে বলে,

– উহু, নানুর হয়তো কোন কাজ পড়ে গেছে একটু পরেই চলে আসবে।চলো আমরা বসে গল্প করি..?

অনেকটা সময় পর মোহনা এলো। তাড়াহুরো করে স্কুল গেইটের ভিতর ঢুকে দেখে ওয়েটিং সিটের দুটো চেয়ারে বসে মেহজান আর একটি ছেলে।
লম্বা চওড়া গড়নের ফর্সা চেহারার একটি ছেলে, চোখে চশমা,পড়নে ফরমাল ড্রেস। বয়স কত হবে..?সাতাশ কি আঁঠাশ?
ছেলেটি মেহজানের সাথে হেসে হেসে কথা বলছিলো।মোহনা কাছে যেতেই মেহজান আম্মু বলে এসে মোহনাকে জড়িয়ে ধরলো।

-তুমি এসেছো আজ? নানু কোথায়..?
মোহনা মেয়ের কথার কোন উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো,

– অনেক্ষন ধরে অপেক্ষা করছিলে? খারাপ লেগেছে তোমার?
– না তো, টিচারের সাথে কথা বলছিলাম।
মোহনা বুঝতে পারলো পাশের ছেলেটিই মেহজানের টিচার। মোহনা ছেলেটির উদ্দেশ্যে বললো,

-আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম সালাম
-আমি ওর মা। আসলে প্রতিদিন ওর নানুই ওকে নিতে আসে। আজ তিনি একটু অসুস্থ হয়ে পড়ায়, আমাকে ফোন করে বলে।আমি অফিস থেকে আসতে অসতে একটু দেরি হয়ে যায়।সরি আপনাকে মনে হয় অনেক জ্বালিয়েছে ।

– না না। মেহজান খুব মিষ্টি একটি মেয়ে।
তারপর কি বলবে দুজনের কেউই খুজে পেলো না। মোহনা একটি ধন্যবাদ দিয়ে মেহজান কে নিয়ে চলে গেলো।

রিয়ান সেখানেই দাড়িয়েছিলো।রিয়ান এই স্কুলে জয়েন করেছে দুবছর হলো। পড়াশুনা শেষ করে বেকার বসে ছিলো তাই স্কুলটায় জয়েন করা।রিয়ানের পরিবারের অবস্থা যথেষ্ট ভালো।সে চাইলেই বাবার হেল্প নিয়ে কিছু একটা করতে পারে। তবে সেটা সে করবে না বলেই, নিজ চেষ্টায় এ স্কুলটাতে জয়েন করেছে।

একবছর ধরে রিয়ান লক্ষ করছে একটি মিষ্টি বাচ্চাকে প্রতিদিন সকালে একটি মেয়ে স্কুলে দিয়ে যায়। হালকা-পাতলা গড়নের শরীর।শ্যামবর্ণের সুন্দরীরা যেমন হয় ঠিক তেমন।ঠোঁটের নিচে একটা গাঢ় কালো তিল আছে। প্রথম দেখাতেই মেয়েটিকে রিয়ানের ভালো লেগেছিলো।বয়স হবে পঁচিশের মতো।যেহেতু বাচ্চাটি তাদের স্কুলেই পড়ে তাই খোঁজ নিয়ে জানতে পারে বাচ্চাটির নাম মেহজান আর মেয়েটি এই বাচ্চাটিরই মা।

রিয়ান সেদিন হতাশ হয়ে যায়।কলেজ জীবনে একটি মেয়েকে দেখে ভালো লেগেছিলো তবে কোনদিন বলতে পারে নি।তারপর আর কখনো কোন মেয়েকে নিয়ে সে ভাবে নি।সব সময় বন্ধুবান্ধব ঘুরাফেড়া নিয়েই বিজি ছিলো। আর এতোদিন পর যখন কোন মেয়েকে ভালো লাগলো তখন জানতে পারলো মেয়েটি তারই স্টুডেন্ট এর মা।

চলবে….

পর্ব -২ এর লিংক..https://www.facebook.com/groups/golpopoka/permalink/887323308365056/?app=fbl

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে