দহন পর্ব-১৫

0
549

#দহন
#রিয়া_জান্নাত
#পর্ব_১৫

আমজাদ শিকদার কে জেইলে ঢোকানোর আজ ৪২ দিন হলো। রেহেনা তার একমাত্র ছেলের ধুমধাম করে বিয়ে দিচ্ছে আজকের দিনে। বিয়েটা হচ্ছে খান বাড়িতে। খান বাড়িতে ভরপুর আত্নীয়। নীলার আম্মার বংশের সব আত্নীয় কবজি ডুবিয়ে বিয়ে খেতে এসেছে। চারদিকের ডেকোরেশন অনেক সুন্দর করে পরিপাটি করে সাজিয়েছে। আশফাকুল খান ডেকোরেশনের লোকদের গতকাল থেকে ব্যস্ত রেখেছে। একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। গ্রাম প্রতেবেশীদের সবাইকে দাওয়াত দিছে। গ্রামের প্রতিবেশীরা সবাই দুপুরবেলা খেয়ে গেছে। ছেলে মেয়ের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের অংশীদার হয়েছিলো। চারদিকে বাজি ফাটাচ্ছে। নীলার কাজিনরা ছাঁদে ঘুড়ি উড়াতে ব্যস্ত রাতের বেলা। অনেকে ফটো তুলতে ব্যস্ত। বিয়ে যেখানে পড়ানো হবে স্টেজ টা লাল,নীল,সবুজ, হলুদ কাপড় দ্বারা মোড়ানো। ছোট ছোট ঝাড়বাতিতে মনে হচ্ছিলো আজকে মনে হয় কোনো রাজার সাথে রাণীর বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে। এমন সময় কাজী সাহেব বললো রাত ১১.০০ টা বাজতে চললো। ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে আসুন ইসলামি শরীয়ত মোতাবেক বিয়েটা সুসম্পূর্ণ করি।

আকাশকে তার বন্ধু সুজন নিয়ে আসলো বর স্টেজে। নীলাকে নিয়ে আসলো জাকিয়া সুলতানা। হ্যা আজকে নীলা ও আকাশের বিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

নীলা ব্রাউন কালারের লেহেঙ্গা মুখে সব ধরনের মেক-আপ শরীরে গা ভর্তি অলংহার পড়েছে। আকাশ শুভ্র শেরওয়ানি হোয়াইট কালারের পায়জামা, মাথায় টোপড় মুখে রুমাল, হাতে নীলার দেওয়া রিং। বামহাতে গ্লোডেন কালারের চেইনের ঘড়ি পড়ে স্টেজে বরবেশে বসে আছে।

নীলা আকাশের দিকে আড়চোখে তাকায়। আকাশকে একদম স্বপ্নের ক্রাস পাকিস্তানের ওয়াজ আলীর মতো লাগছিলো নীলার কাছে। নীলা যেনো আকাশের মাধ্যমে স্বপ্নকে ছুঁতে পারবে। আকাশ নীলার চাহনি দেখে চোখ টিপি মারে । নীলা মাথা নিচু করে ফেলে।

আকাশ মনে মনে বলে এই মেয়ের লজ্জা একদম নাই। চারদিকে কত লোক। স্টেজে মামা, মামি, আম্মা রয়েছে তবুও নিলজ্জের মতো আমাকে দেখছে।আমিতো আবার কম নির্লজ্জ না

কাজী সাহেব বলে ___

আমি এবার বিয়ে পড়াবো। বর ও বধূ তোমরা তৈরি থেকো। প্রথমে ছেলেকে কবুল/ আলহামদুলিল্লাহ বলতে হবে ।

আকাশ মাথা নেড়ে হ্যা সূচক সম্মতি জানায়।

” হাজিরান মজলিশে ৫,৭৫, ৫০১ টাকা দেন মোহর ধার্য্য করিয়া নগদ গহনা বাবদ ৪,৫০,৫০১ টাকা বুঝিয়া পাইয়া, অবশিষ্ট টাকা বাকি রাখিয়া ঢাকা জেলার সদর থানার মতিঝল নিবাসী আশফাকুল খানের একমাত্র মেয়ে মোছাঃ নীলা খানের সাথে আমি উকিল নিযুক্ত হইয়া তোমার সহিত বিবাহ দিলাম! বলুন আলহামদুলিল্লাহ, কবুল। ”

” কবুল ” কবুল ” কবুল ”

কাজি সাহেব এবার নীলাকে ইশারা করে। নীলা মাথা নেড়ে হ্যা সূচক সম্মতি জানায়।

” হাজিরান মজলিশে ৫,৭৫, ৫০১ টাকা দেন মোহর ধার্য্য করিয়া নগদ গহনা বাবদ ৪,৫০,৫০১ টাকা বুঝিয়া পাইয়া, অবশিষ্ট টাকা বাকি রাখিয়া ঢাকা জেলার সদর থানার মতিঝল নিবাসী আমজাদ শিকদারের একমাত্র ছেলে মোহাম্মদ আকাশ শিকদারের সাথে আমি উকিল নিযুক্ত হইয়া তোমার সহিত বিবাহ দিলাম! বলুন আলহামদুলিল্লাহ, কবুল। ”

” কবুল ” কবুল ” কবুল ”

ওইখানে থাকা সকল লোক একসঙ্গে বলে উঠলো আলহামদুলিল্লাহ। কাজী সাহেব বললো আজ থেকে ইসলামি শরীয়ত মোতাবেক আপনারা দুজন স্বামী স্ত্রী। আজ থেকে এক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হলেন আপনারা।

উকিল সাহেব বলে ইসলামের দিক থেকে তো হলো সরকারী নিয়মে বিয়েটা হোক এবার। উকিল সাহেব আইনি কাগজ পত্র আকাশ ও নীলাকে সাইন করার জন্য দিলো। আকাশ ও নীলা টপাটপ কাগজে সাইন করলো। উকিল সাহেব বললো আপনাদের রেজিস্ট্র ম্যারিজ হয়ে গেলো।

সবাই আরো একবার বললো আলহামদুলিল্লাহ। আকাশ এবার নীলাকে দেখলো। মনে মনে বললো আজ থেকে এই পাখির মালিক আমি হলাম। পাখিকে ধরেছি একবার জীবনেও ছাড়বো না। নীলা আকাশের দিকে তাকাতেই মাথা নিচু করে ফেললো। কারণ আকাশের চোখের দিকে তাকাতেই লজ্জায় পড়ে গেছে নীলা।

আশফাকুল খান এগিয়ে এসে নীলার হাত ধরলো। নীলা বাবার হাতের স্পর্শ পেয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। নীলা কান্না করতে লাগলো। নীলা নিজেও জানেও না ক্যান আজ তার চোখ দিয়ে পানি বেড়াচ্ছে। আশফাকুল খান শীতলভাবে নীলাকে বললো কাঁদছো কেনো তুমি? তোমারতো খুশি হওয়ার কথা নীলা। যেই মানুষটাকে তুমি ভালোবাসো, তাকে সাড়ে চার বছর সাধনার পর পাচ্ছো। এইটাতো তোমার সাধনা নীলা। আমি ওইসকল বাবা না তোমার অনুভূতি আমি বুঝি। তোমাকে তো বাইরে বিয়ে দেই নাই। কখনো চোখের আড়াল হবেনা তুমি। তুমি যেমন আমার মেয়ে, আকাশ আমার ছেলে। প্রতিদিন যাতায়াতের পথেই বার বার তোমার সাথে দেখা হবে। আশফাকুল খান মেয়েকে এক কাঁধের বুকে নিয়ে, ডানহাত দিয়ে আকাশের হাত ধরলো। এরপরে ডান কাঁধে আকাশকে জড়িয়ে ধরে বললো বাবা আমার জান্নাতুল ফেরদাউসকে তোমার হেফাজতে পাঠালাম। তুমি তাকে দেখে রাখিয়ো। তার সকল আবদার পূরণ করিয়ো। কখনো কোনো বিপদে পড়লে এই বাবার কাছে আসিয়ো। তোমাদের দুজনের জন্য সবসময় আমার মনের দরজা খোলা। কেউ নেই আমার তোমরা দুটি ছাড়া। একটা জান্নাতের বাগান ছিলো। সেই বাগানকে দেখার দায়িত্ব তোমাকে দিলাম। কথা দাও আমার জান্নাতকে কখনো কষ্ট দিবানা। ”

আকাশ এবার বলে ___

এই জান্নাত টা শুধু আপনার নয় বাবা। আজ থেকে এই জান্নাতের দায়িত্ব শিকদার পরিবারের কথা দিলাম নীল পাখি আমার কাছে জান্নাতের মতই থাকবে।

আশফাকুল খান এবার আর নিজের আবেগকে কন্ট্রোল রাখতে পারছিলো না। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। মেয়েকে চোখের পানি দেখাবে না বলে রেহেনাকে যেয়ে বলে আসি বোন। আমি আর থাকতে পারছিনা। দেখে রাখিস আমার জান্নাতকে। এই কথা বলে নিজের স্থান ত্যাগ করে আশফাকুল চলে যায় নিজের রুমে।

নীলা ও আকাশ শুধু আশফাকুলের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। এমন সময় দাদু এসে বলে। আমার টুনা টুনি দুইটা অবশেষে এক হলো। এই রেহেনা এখন থেকে প্রতিদিন বাজার করার পথে তোর বাসায় যাবো টুনা টুনির সংসার দেখতে।

” হ্যা বাবা যেয়ো। তোমাদের আবেগ দেখে মনে হচ্ছে নীলা আমার মেয়ে নয়। আমি ওকে দেখে রাখতে পারবো না। এতোটা খারাপ ভাবো কি করে আমাকে? আর শুনো যখন তখন আমার মেয়ের সংসারে যেয়ে ডিস্টার্ব করবা না। সবাই দোয়া করো ওদের একটা সংসার হোক আমাদের মতো। ”

” নীলার মা এসে বলে রেহেনা দেখে রাখিস বোন। ”

” তুইয়ো শুরু করলি ভাবি। ওরা নাহয় আবেগে ভাসছে তুই আমাকে ভরসা করিস না। শুন নীলা যতখানি তোর মেয়ে, ততখানি আমারো। ও আমার রক্ত। নিজের রক্তকে কখনো অবহেলা করবো ভাবলি কি করে? মুখটা পানসে না করে আমার ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দে। আমার ছেলেমেয়েকে দুটিকে দ্রুত বাড়ি নিয়ে যাই।”

” এবার নীলার মা আকাশের হাতে আর একমাত্র মেয়েকে তুলে দিলো। রেহেনা বললো বাবা আকাশ পাশেই আমাদের ফ্ল্যাট তুই নীলাকে হেটে না নিয়ে বরং কোলে করে নিয়ে আয়। ”

” মায়ের অনুমতি পেয়ে আকাশ নীলাকে কোলে তুলে নিলো। নীলা বলে কি করছেন আকাশ ছাড়ুন আমাকে। রেহেনা দ্রুত বাড়ি গেলো। নীলার কাজিনরা ওয়াও জোস চমৎকার বলে উৎসাহ দিলো। ফটোগ্রাফাররা ছবি তুলতে ব্যস্ত। নীলার সবার উৎসাহ শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। আকাশের বুকে মুখ লাগিয়ে দিলো। আকাশ কেপে উঠলো নীলার কোমলমতি ঠোঁটের স্পর্শে। ”

” নীলা মনে মনে বললো ওয়াও জামাইয়ের কোলে উঠে শশুড়বাড়ি যাওয়ার মজাই আলাদা। পৃথিবীর সব সুখের অভিজ্ঞতা যেনো নীলা এক মূহূর্তেই পেয়ে গেলো। ”

আকাশ নীলার বাড়ি থেকে বের হয়ে নিজের বাড়ির গেইট দিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকছে। নীলাকে বললো এতো খাও কেনো নীলা? ”

” এই প্রশ্ন শুনে নীলা আড়চোখে আকাশকে দেখে বললো এতো খাই মানে কি আকাশ? ”

” তোমার শরীরের কথা বলছি। ওয়েট অনেক বেড়ে গেছে তোমার? ৮০ পা পথ তোমাকেই কোলে নিয়ে হেঁটে আসতেই আমার যাতা অবস্থা। দেখো আমার মুখটা ঘেমে একাকার হয়ে গেছে? শেরেওয়ানির ভিতরের গেঞ্জি শরীরের সাথে বসে গেছে। ”

” ৪৮ কেজি ভর নিতেই এই অবস্থা আপনার । আমাকে বলতে পারতেন নীলা আমি তোমাকে বইতে পারছিনা। আমি নেমে গেতাম। তাই বলে আমাকে খাওয়ার খোটা দিবেন। নেমে দেন আমাকে আমি একাই চলে যাবো রুমে। পালোয়ানের মতো শরীর একটা জিম করে বডি বানাইছেন সাউথের সালমান খানের মতো, বউকে ৮০ পথ কোলে করেই আনতেই এই অবস্থা। এ আল্লাহ আমি কার সাথে বিয়ে করলাম। একবেলা তার এখনো খাই নাই। এতেই সে খাওয়ার খোটা দিচ্ছে। এ বিয়ে হওয়ার আগে আমার মরণ হলো না কেনো? ”

” চুপ করো খেয়ে দেয়ো শরীরকে আটার বস্তা বানাইছো। এই আটার বস্তার নাকি ৪৮ কেজি ওজন। মিনিমাম ৫৫ হবা। এই নিয়ে যদি আর একটি কথা বলছো সত্যি সত্যি তোমাকে কোল থেকে ফেলে দিবো! ”

” নীলা ফ্লোরের দিকে চায়। এরপরে আকাশের পিঠের খামছে ধরে, এই না না এমনটা করবেন না। এইখান থেকে আমাকে ফেলে দিলে কোমড়টা ভেঙ্গে যাবে। এরপরে কোমড়ভাঙ্গা বউ নিয়ে সারাজীবন বয়ে বেড়াবেন কি করে!”

” আর যদি একটি কথা বলো! সত্যি সত্যি তোমার কোমড় ভেঙ্গে বিছানায় ফেলে রাখবো। আর জামাইকে কাছে পাওয়ার আগেই এভাবে কেউ খামছে ধরে। আমার লাগছেনা, একটুপর কিন্তু এই খামচে ধরার প্রতিশোধ নিবো হারে হারে। ”

” নীলা আকাশের পিঠ ছেড়ে দেয়। আকাশের হুমকিতে ভয় পেয়ে যায়। ”

রেহেনা এসে বলে নীলাকে সোজা তোর রুমে নিয়ে যা আকাশ। আর হ্যা নীলাকে কোলে তুলেই নিবি যা।

আকাশ নীলাকে কোলে করে নিয়ে নিজের রুমের সোফায় ঠাস করে ফেলে দেয়।

” নীলাকে পড়ে যেতে জাকিয়া ও সাদিয়া খিকখিক করে হেসে দেয়। ”

কি ব্যাপার তোমরা এখানে,,,

” কি বলছেন দুলাভাই! একমাত্র বোনের বাসর রাত বলে কথা আমরা থাকবো না। এই বাসরের খাট নিজ হাতে সাজিয়েছি আমরা। ”

” তো বোনের সাথে কি তোমরাও বাসর করতে চাও? আমি রেডি আছি। আমি আবার দিলখোলা কেউ আমার জন্য হাঁটু পরিমান উপকার করলে, আমি তাদের জন্য বুক পরিমাণ উপকার করি।! ”

” ছি! দুলাভাই আপনাকে ভালো ভেবেছিলাম। আপনিয়ো এসব ছি! ছি!”

” আকাশ এবার মুখের দুষ্টমাখা হাসি প্রকাশ করে বলে। এই পৃথিবীতে কেউ ভালো নয় শালীরা। তোমরা আমার জন্য বাসরের খাট সাজাইছো আমি নাহয় প্রতিদান হিসাবে বাসরে কি কি হয়? আগে থেকে তোমাদের শিক্ষা দিলাম? ”

” ছি! নীলা তুই এই কাকে বিয়ে করলি! একদম নির্লজ্জ জামাই তোর। ”

” নির্লজ্জতামি তো করলাম না এতেই নির্লজ্জ বলছো। আচ্ছা টেষ্ট পরীক্ষা টা নাহয় এখনি হয়ে যাক। ”

” সাদিয়া আর জাকিয়া এই না না বলে চিৎকার করে রুম থেকে বের হয়ে যায়। ”

” এসব কি আকাশ! বিয়ের আগে তো এরকম নির্লজ্জতামি দেখি নাই আপনার। নাকি এর আগেও এসব করতেন অফিসের মেয়েদের সাথে। প্রশিক্ষণ দেখছি ভালোই নেওয়া। আমার বোনদের দিকে এসব কি চোখে তাকান? ”

” আরে পাগলী বউ টা আমার। রাগ করছো ক্যান? টেকনিক দিয়ে ওদের ঝেটিয়ে বের করলাম। ওরা যা আটা, এরকম না করলে সহজে কি আমাদের রুম থেকে যেতো? ”

চলবে,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে