দহন পর্ব-৩০

0
513

দহন _ ৩০

নীলা ভাবতেও পারে নাই। তার জীবনে একদিনে এতো সুখ আসবে। বিছানা থেকে উঠে শুধু গতকালের দিনটার কথা ভাবছে। এরপরে রাতের ঘটনায় নীলা সত্যিই বেশ অবাক। চুলগুলো ঠিক করে নীলা ওয়াশরুমে যায়। ওয়াশরুমে যেয়ে আকাশের আনা কাঠিটি সঙ্গে করে নিয়ে, পরীক্ষা করতে যায় । পরীক্ষা ফলাফল পজেটিভ। নীলা প্রেগনেন্ট হওয়ার আনন্দে কাঠিটি নিয়ে আকাশকে ডাক দেয়।

” আকাশ এই আকাশ উঠেন। আকাশের শরীর থেকে ব্ল্যানকেট সরিয়ে দেয়। আকাশ হাই তুলে বিছানা থেকে উঠে বলে কি হয়েছে নীলা আমাকে এইভাবে তুললে কেনো? কাল ঘুমাইতে ঘুমাইতে ৩.০০ টা পার হয়েছিলো। আজকে আমি সারাদিন ঘুমাবো। ”

নীলা আকাশের হাতে প্রেগনেন্সি পরীক্ষার কাঠিটি দিয়ে বলে দেখেন আপনি কি করেছেন ?

আকাশ কাঠির রেজাল্ট পজেটিভ দেখে আনন্দে আত্যহরা হয়ে যায়। নীলাকে জড়িয়ে ধরে বলে জানোনা তুমি আমাকে কতো বড় উপহার দিচ্ছো। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে তোমার বাচ্চার বাবা হবো।

নীলা ভ্রু কুচকে বলে, এই লোক আপনি পাগল হয়েছেন? আমার বাচ্চা মানে, যে পৃথিবীতে আসছে সে আমাদের বাচ্চা বুঝলেন।

আকাশ মুচকি হাসি দিয়ে বলে, এই সময় ঝগড়া করা ঠিক নয় প্রেয়সী। এই সময় থাকতে হবে কুল। তবেই না আমাদের বাচ্চা থাকবে বি কেয়ারফুল।

সবসময় উল্টো পাল্টা কথা তো আপনি জুড়ে দেন। এরজন্য লাগতেই হয়।

” এই নীলা আমার খুব লজ্জা লাগছে। ”

” কেনো? ”

বাড়ির সবাই যখন জানবে তুমি প্রেগনেন্ট। তখন বাড়ির লোকের কাছে আমার ইমেজ নষ্ট হয়ে যাবে। আমার মান সম্মানের ১২ টা বাজবে। বাইরের লোক বলবে আকাশ ভার্জিন নয়।

” এই লোক আমাকে ক্ষেপাবেন না। এসব করার সময় আপনার মনে ছিলো না? আর বিয়ের পর কিসের ভার্জিনিটি। আপনার মাথায় কে ঢুকাইছে ছেলেরা ভার্জিন হয়। ক্ষিপ্ত গলায় কথাটি আকাশকে বলে। ”

” আকাশ ফিক করে শয়তানি হাসি দেয়। জানো নীলা আমার না খুব শরম করছে। নিচে কিভাবে যাবো। নিচে আমার শশুড় / শাশুড়ী, আম্মাকে মুখ দেখাবো কি করে? এই সব কিছু হয়েছে তোমার জন্য। ”

” নীলা এবার কাঠ কাঠ গলায় কথা শুনায় আকাশকে। লুতুপুতু করার জন্য আমি কাছে টানেনি। উল্টো আপনি আমার সাথে জোড় করেছেন? এতই যদি নাক কাটার মতো শরম লাগে গলায় দড়ি দেন। ব্যাস সমস্যা ক্লিয়ার। ”

” বাচ্চার মা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাচ্চার বাবাকে ভূলে গেলা কি করে? এই কথাটি সবসময় মনে রাখবা। এই বাচ্চার জন্য আমাকে কত কষ্ট করতে হয়েছে। আর তুমিতো বিনাকষ্টে মা হওয়ার আনন্দ পাচ্ছো। সেই তুমি এখন বাচ্চার বাবাকে গলায় দড়ি দিতে বলছো? তোমার স্পর্ধা দেখে সত্যিই আমি শঙ্কিত। ”

” নীলা চোখ লাল করে ফেলে আকাশের কথা শুনে। সকাল সকাল আপনার ঢং দেখতে কেউ চাইছে? দিনদিন যে আপনি বাচ্চা হতে চাচ্ছেন। এইগুলা ভীমরতি নাতো কি? পরিবর্তন করুন নিজেকে। এই বয়সে আপনার এই সঙ্গে এই আচরণ যায়না। ”

” আকাশ নীলার পেটে ডান হাত দিয়ে বলে। জানিনা তুমি প্রিন্সেস নাকি প্রিন্স। তবে যেই হও তোমার কাছে অভিযোগ দিলাম তোমার আম্মুকে ভদ্র হতে বলো। দিনদিন আমার মুখের সাথে বড্ড লেগে থাকা স্বভাব হয়েছে। ”

” জানিনা এই লোকটার কি হয়েছে? এনার কথা আর ০৫ মিনিট দাড়িয়ে শুনলে আমি পাগল হয়ে যাবো। ”

এই নীলা কোথায় যাচ্ছো? আমার শরম করছে। একটি ছেলের মান সম্মানের দিকে হাত দিয়ে এভাবে পালাচ্ছো।

নীলা তার মুখটা রাশভারি করে বলে, আপনি পাগল হয়েছেন। আপনাকে পাবনা পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।

ওসব পাবনা টাবনা আমার জন্য নয় প্রেয়সী। দ্রুত কফি নিয়ে আসো। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে দিছো।

নীলা আকাশের জন্য কফি বানিয়ে আনে। এরপরে আকাশের ডানহাতে কফির মগটি দেয়। আকাশ কফির মগে চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। তা দেখে নীলা জিজ্ঞেস করে কেমন হয়েছে কফি। আকাশ মুচকি হেসে বলে অনেক সুন্দর হয়েছে প্রেয়সী। জীবনেও প্রথম এতো সুন্দর কফিতে চুমুক দিলাম। তোমাকে বিয়ে না করলে এই কফি খাওয়ার স্বাদ কিভাবে পেতাম। ধন্যবাদ প্রেয়সী। নীলা আড়চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে দেখি আমি এক চুমুক দিই। সত্যি কি ভালো বানিয়েছে। আকাশ মুচকি হেসে বলে এতো সুন্দর কফিতে বউয়ের চুমুক দিয়ে কফি কমাতে চাইনা। কারণ এই কফিটা এতো সুন্দর যত্ন করে শুধু বউ আমার জন্য বানিয়েছে। নীলা বুঝতে পারে কফিতে কোনো গন্ডগোল রয়েছে, নাহলে আকাশ এতো সুন্দর প্রসংশা সহজে করেনা। আকাশ দ্বিতীয়বার চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। তা দেখে নীলা জিজ্ঞেস করে চোখমুখ এরকম করছেন কেনো? আকাশের হাত থেকে কফি মগটি কেড়ে নিয়ে নীলা এক চুমুক দেয়। সাথে সাথে নীলা বমি করে ফেলে। দৌড়ে বেসিনে যায়। আকাশ এসে বলে অসুস্থ সময়ে এতো ভালো কফি তোমার পেট সহ্য করবেনা। এরপরেও চুমুক দিলা। নীলা শাড়ির আচল দিয়ে মুখে মুছে কফি মগটি আকাশের হাত থেকে কেড়ে নেয়। এরপরে সম্পূর্ণ কফি বেসিন উপর করে ঢেলে দেয়। আকাশ বলে এই প্রেয়সী এতো সুন্দর কফি কেউ এভাবে ফেলে দেয়। নীলা ভ্রু কুচকে বলে আমাকে ইমপ্রেস করার জন্য এতো বাজে কফিতে আপনাকে চুমুক দিতে হবে না। আমি ভালো করে কফি বানিয়ে আসছি এরপরে খেয়ে নিয়েন। আকাশ মুচকি হাসি দিয়ে বলে বউয়ের হাতের তৈরি সব জিনিসই আমার কাছে অমৃত। হইছে আপনাকে আর এতো কাহিনী করতে হবেনা। ফ্রেশ হয়ে নেন। আমি কফি বানিয়ে আসছি।?

আকাশ মুচকি হেসে নিচে নেমে আসে। নিচে এসে দেখতে পায় তার শশুড় / শাশুড়ী / আম্মা কোনো একটা বিষয় নিয়ে ডিসকাশন করতেছিলো। সাফা সোফায় পুতুল নিয়ে খেলতেছে। আকাশকে দেখে নীলার মা দৌড়ে এসে মিষ্টির বাটি নিয়ে। আকাশকে বলে বাবা মিষ্টিমুখ করো। আকাশ খানিকটা লজ্জায় পড়ে যায়। এরপরে জিজ্ঞেস করে কিসের জন্য মিষ্টিমুখ করবো মা। আশফাকুল খান এই কথা শুনে ফিক করে হেসে দেয়। দেখছিস রেহেনা তোর ছেলে একদম আমার মতো হয়েছে? সব বিষয়ে খালি লজ্জা পায়। আকাশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। রেহেনা শিকদার বলে উঠে অভিনন্দন আকাশ। খুব দ্রুত আমাদের বংশের প্রজন্ম কে পৃথিবীতে নিয়ে আসার জন্য। আকাশ এই কথা শুনে লজ্জায় মুখ চোখ লাল করে ফেলে। আশফাকুল খান এসে জোড় করে আকাশের মুখে মিষ্টি দেয়। এরপরে তিনজনে খপাখপ মিষ্টিমুখ করে। আকাশ মনে মনে বলে কি দেখে যে, নিচে নামতে আসলাম।

নীলা নিচে এসে বলে তোমাদের সুখবরের সময় এসে আরো একটি সুখবর দিতে চাই মা। আমার শশুড় আমজাদ শিকদারকে জেল থেকে ছাড়ানোর সব ব্যবস্থা করছি। ওনি আজকে ছাড়া পাবে। এই কথা শুনে আশফাকুল খান ও দিলারা খানের খুশি যেনো আরো একধাপ তরতরিয়ে বাড়লো। বাট এই খবর শোনার সাথে সাথে রেহেনা শিকদার মুখ কালো করে ফেলে। নীলাকে বলে আমাকে না জানিয়ে তাকে ছাড়ানো তোমার ঠিক হয়নাই। আমি নতুন করে আর কোনো বিপদ চাইনা। আমি চাইনা কোনো খুনীর ছায়া আমাদের পরিবারে আরো পড়ুক। তুমি তাকে এই বাড়িতে আনতে পারবা না।

” মা ওনার অতীত নিয়ে আমরা তাকে এতো শাস্তি দিতে পারিনা। ওনি আমাদের খুব ভালোবাসে। প্রতিটা বিপদের সময় জেইল থেকে ওনি আমাদের সাহায্য করেছে। ওনি আমাদের প্রচন্ড ভালোবাসে মা।তোমাকেও প্রচুর ভালোবাসে। ওনি যা কিছু করেছিলো একপ্রকার লোভের মোহ থেকে। তাই বলে আমরা তাকে অন্ধকার জীবনে ঢেলতে পারিনা। জেল থেকে বারবার প্রতিটা ধাপে ওনি আমাদের সঙ্গী ছিলো। আমি চাইনা আমার পরিবারের লোকগুলো আরো কষ্ট পাক। তুমিতো প্রতিরাতে বাবার জন্য কান্না করো। সেদিন রাতে তোমার রুম পাস করার সময় আমি দেখেছিলাম। তুমি তার ছবি নিয়ে কান্না করছো। ”

” আমি এরকম কিছুই করিনাই নীলা আমি কেনো একটা খুনীর জন্য কান্না করবো। আশফাকুল এসে রেহেনাকে জড়িয়ে ধরে। বোন অভিমান গুলো ক্ষোভ হিসাবে প্রকাশ করিস না। তাহলে বিশাল বড় ফাটলের সৃষ্টি হয় সম্পর্কে। মানুষকে অতীত ভূলে সামনের দিকে এগোতে হয়। একসময় তুইতো আমাকে অনেক দোষারোপ করতিস? আমি কি দিনগুলি ভূলি নাই। অনায়াসে ভূলে গেছি, কারণ তা নাহলে সম্পর্ক গুলো আর সম্পর্কের মধ্যে থাকেনা। ”

” রেহেনা নীলাকে বলে তোমার শশুড় আব্বাকে বলে দিয়ো ও যেনো আমার সঙ্গে কথা না বলে। রেহেনা এই কথা শেষ করে হনহন করে নিজের রুমে চলে যায়। ”

সবাই মুখে একটা করে মুচকি হাসি দেয় রেহেনার কথা শুনে। নীলা আকাশকে বলে যাও বাবাকে নিয়ে আসো। বাবা আমাদের বাড়িতে আসলে এখন সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা আগের মতো হ্যাপি ফ্যামিলি হবো। আমাদের সন্তানকে দাদার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করতে পারিনা।

এরপরে সবাই সকালের খাওয়া দাওয়া শেষ করে যার যার মতো নিজ কর্মে নিয়োজিত হয়। আকাশের কাজ শুধু বউকে কোর্টে দিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা। সারাক্ষণ বডিগার্ডের মতো পিছনে পড়ে থাকতো।

” আকাশ এভাবে আর কত? এইবার আমাদের শিকদার কোম্পানিকে নতুন করে দাড় করাও। আমি আমাদের সন্তানকে পেটে করে নিয়ে চাকরি করতে চাইনা আর। ”

” মহারানী, কোম্পানি টা বাবার ছিলো। বাবা না থাকলে কিভাবে শুরু করবো নতুন করে। আজকে বাবাকে আগে নিয়ে যাই তারপরে সকল ব্যবস্থা করবো। তোমাকে কে বলছে চাকরি করতে, এই দেখো রেজিকনেশন লেটার সঙ্গে করে নিয়ে আসছি। এই ভাঙ্গা শরীরে অন্য চাপ নেওয়ার দরকার নাই। ”

” পাগল একটা, কয়েকমাস গেলে অফিস থেকে আমাকে ছুটি দেওয়া হবে। তুমি কোনো চিন্তা করিয়ো না। চাকরি ছাড়লে মানুষজনকে ন্যায় পাইয়ে দিবো কিভাবে? ”

” মানুষজনের কথা বাদ দাও। আমার সন্তানের কথা ভাবো। এই অসুস্থ শরীরে আমার সন্তানের আম্মাকে চাপ নিতে দিবো না।”

আকাশ গাড়ি থামিয়ে নীলাকে বের করলো। নীলার থুতনীতে ডানহাতের বৃদ্ধা অঙ্গুলি রেখে বামহাত দিয়ে কোমড় জড়িয়ে ধরলো। খুব ভালোবাসি তোমাকে নীলা। আমার সন্তানের খেয়াল রাখিয়ো। রেজিকনেশন টা নিয়ে নাও। তোমাকে জোড় করবো না। তোমার যদি মনে হয় আমার কথা শোনা উচিত। তবে তাই করো। কখনো জোড় করবো না।এরপরে নীলার গালে আলতো করে চুমু দেয়।

ছি! আকাশ কি করছেন সবাই দেখছে। আমাকে ছাড়ুন আমি অফিসে যাই। বাকি কথা পরে হবে। নিজের খেয়াল রাখিয়েন। বাবাকে নিয়ে বাড়িতে রেখে আমাকে নিতে আসবেন। তা নাহলে আমি কিন্তু রাগ করবো।

” ঠিক আছে প্রেয়সী। বলেই চার পাঁচটা চুমু দিয়ে নীলার মুখ ভরিয়ে ফেলে। ”

পথের সবাই এই দৃশ্য দেখে হাসিতে হো হো করছিলো।

#চলবে,,,,
®️ রিয়া জান্নাত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে