তুমি রঙিন প্রজাপতি পর্ব-২১+২২

0
602

#তুমি_রঙিন_প্রজাপতি

#writer_sumaiya_afrin_oishi

#পর্বঃ২১

ফাহাদে’র ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। শুভ্র মনযোগ দিয়ে শুনলো ফাহাদে’র বলা কথা গুলো। ফাহাদে’র কথা শুনে তার আন্দাজ করা শেষ, বন্ধুর মেয়েটাকে ভালো লাগে। হয়তো এই ভালোলাগা প্রণয়ের সূচনা অবধি নিয়ে গিয়েছে।
মিনিট সময় চুপ থেকে কিছু একটা ভেবে নিলো শুভ্র। ভিজ্ঞদের মতো গলা খাঁকারি দিয়ে হাত রাখলো ফাহাদে’র কাঁধে। কণ্ঠে গম্ভীরতা টেনে বললো,

“অনেক তো হলো ফাহাদ। এবার সব ঠিকঠাক করে নে ভাই।
হা’রি’য়ে যাবার পর মানুষকে খুঁজতে নেই, থাকতে মানুষকে মূল্যায়ন করতে হয়। নিজের করে রেখে দিতে হয়, নয়তো চিরদিনের জন্য হারাতে হয়।
কেউ একবার অ’ব’হে’লা’য় হা’রি’য়ে গেলে অনেকটা তীব্র ক’ষ্ট আর য’ন্ত্র’ণা নিয়েই হারায়, ক’ষ্টগুলোকে ভালবাসতে শিখে যায়।আত্মসম্মান কে পুঁজি করে বাঁচতে শিখে যায়। তাই হা’রি’য়ে যাওয়া মানুষেকে হা’রি’য়ে ফেলার আগেই আকড়ে ধরে রাখতে শিখতে হয়।হয়তো চিরদিনের জন্য হা’রি’য়ে ফেলতে হয়।”,

থামলো শুভ্র। ফাহাদ চুপ করেই আছে। শুভ্র আবারো বললো,

“প্রথমবার মানুষের জন্য মানুষের মনে যে ভালবাসার অনুভূতি জন্মায়,অ’য’ত্ন, অ’ব’হে’লা’র পর সেরকম অনুভূতি দ্বিতীয়বারে ততটা জন্মায় না। ভালবাসায় অ’য’ত্ন, অ’ব’হে’লা ভর করলে ভালবাসা দিন দিন রুপ নেয় বি’ষা’দ মাখা স্মৃতিতে।
আর ভালবাসার মানুষগুলো জীবন থেকে এমনি এমনি হা’রা’য় না, তাদেরকে হা’রি’য়ে যেতে বা’ধ্য করা হয়, অনেকটা অযত্ন, অ’ব’হে’লা’য়।
তাই কেউ জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়ার আগে তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে হয়, গুরুত্ব দিতে হয়। ভালবাসায় গুরুত্ব থাকলে ভালবাসা হারায় না।”
.
.
প্রিয় মানুষটা চলে গিয়েছে ঢাকায় কিন্তু এই নিষিরাত জানে তার কতোখানি ফেলে গিয়েছে সপ্তদশী কন্যার মনে। এই ক’দিনে এক আকাশ সমান মায়া বাড়িয়ে চলে গেলো তাকে একা রেখে।
চাঁদনী রুমে বসে অনবরত পায়চারী করছে। সবার সাথে থেকে মাএ রুমে এসেছে কিন্তু, মন টিকছে না।
এই রুমটা এখন ফাঁকা, কোথাও কেউ নেই। সে চাইলেও এতদিনের মতো প্রিয় মুখটা হুটহাট দেখতে পারবে না। নিজের তৃষ্ণা জুড়িয়ে দু’চোখ ভরে মায়াবী মুখটায় মুগ্ধতা খুঁজে নিতে পারছে না চাঁদনী।
এই কয়দিনে লোকটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে।
হুটকরে চাঁদনী পায়চারী করা বন্ধ করে, টেবিলে পড়ে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে বসলো খাটের উপরে।
ওয়ালপেপারে’র স্কিনে জ্বলজ্বল করছে সেই প্রিয় মুখটা। চাঁদনী নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে দেখছে এলোমেলো পুরুষটি কে।
কিছুক্ষণ পরে মলিন কন্ঠে ছবির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

“গত কয়েকদিন তোমার সাথে আমার যোগাযোগ নেই, তোমায় ভীষণ মিস করছি ।
তোমার কথা ভাবছি আর মন খারাপ করছি।
তুমি কেমন আছো?
কেমন আছো সেটা ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে
কিন্তু তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না।
আমার মন খারাপ হচ্ছে
মন খারাপে ছুঁয়ে যাচ্ছে আকাশ।
মাঝে মাঝেই তোমার বিরহে বৃষ্টি ঝরছে
আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারছি না
চোখের জল ঢেউ হয়ে ভাঙছে দুচোখের কার্নিশে।
আমার মন আরো ভীষণ খারাপ হচ্ছে ,
নীল থেকে কালো মেঘের মত।
পরক্ষণেই আমার মনে হচ্ছে, তুমি তো হারিয়ে যাওনি।
তুমিতো আমায় ছেড়ে যাওনি,তুমি তো ফিরে আসবে।
এটুকু স্বান্তনা নিয়েই সামলে নিচ্ছি নিজেকে।
কিন্তু এই যে আমার বারংবার মন খারাপ হচ্ছে,
তুমি কেমন আছো জানতে ইচ্ছে করছে,
এই যে তোমার জন্য আমার খুব চিন্তা হচ্ছে,
তুমি কি বুঝতে পারো? বলো… বুঝতে পারো?
বুঝতে যদি পারো তবে একটু খবর পাঠিও
মেঘের ভেলায় কিংবা পাখির পালকে,
শুধু ভালো আছি বলেই একটা চিরকুট লিখে দিও
ব্যস, এতটুকুতেই মন করে নেব শান্ত।”

তান্মধ্যে ফারিহা’র আগমণ ঘটে রুমে। সে এসেছে ভাবীর সঙ্গ দিতে। চাঁদনী নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক কথা-বার্তা বলতে চেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু তার কণ্ঠ কাঁপছে। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে কিন্তু বারংবার ব্যর্থ হয়। তার কণ্ঠ বলে দিচ্ছে তার ভীষণ মন খারাপ।
ফারিহার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ধরে নিয়েছে, মেয়েটা ভালো নেই! কিন্তু প্রশ্ন করলো না সে।
আজ নিজের রুমে গেলো না ফারিহা। চাঁদনী’র দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,

“আমি আজ তোমার রুমে থাকি ভাবী। আমার একটু জায়গা হবে তোমার বিছনায়?”

একটা মানুষ যেচে এসে বললে তাকে তো আর মুখের উপর “না করা” শোভনীয় আচারণ নয়। চাঁদনী আমতা আমতা করে বললো,

“এভাবে বলছো ক্যান আপা? তোমার ইচ্ছে হলে থাকবে আমার সাথে। এভাবে অনুমতির নেওয়ার কি আছে?”

ফারিহা এ বিষয়ে আর কথা বাড়ালো না বরং বিপরীতে মুচকি হাসলো। প্রসংগ পাল্টিয়ে অন্য বিষয় কথা তুললো।
চাঁদনী’কে একে একে বলছে নিজের লাভ স্টোরি। কি ভাবে আয়ানের সাথে তার পরিচয় হলো।
চাঁদনী ও ভীষণ মনযোগী হয়ে শুনতে লাগলো।

সুয়ে সুয়ে প্রায় ঘন্টা খানিক সময় গল্প করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে গেলো ফারিহা।
কিন্তু চাঁদনী এখনো জেগে আছে। তার চোখে ঘুম আসছে না।
এপাশ-ওপাশ করতে করতে হঠাৎ ফোনের এলার্ম বেজে উঠলো। এলার্মের ঘন্টা জানান দিচ্ছে এখন রাত তিনটা। তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার জন্য দিয়ে রাখছিলো সে।
দ্রুত ফোনটা হাতে নিয়ে বন্ধ করে দিলো। ফারিহা গভীর ঘুমে আছন্ন। চাঁদনী তবুও খুব সতর্কতা অবলম্বন করে উঠে দাঁড়ালো। যাতে ফারিহা ঘুম নষ্ট না হয়, নিঃশব্দে পা টিপে টিপে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

গভীর একটি রজনী। উওম রুপে ওজু করে নতুন একটি পোশাক পরে নিলো চাঁদনী। গায়ে একটু সুগন্ধি মেখে নিলো। এই সাজ এক মাএ সৃষ্টিকর্তার জন্য। নিজেকে পরিপাটি করে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলো।
গভীর ধ্যানে একান্তই আল্লার ইবাদতে মশগুল হলো তার এক বান্দা। সেরা এই দৃশ্যটা শুধু মাএ চার-দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ।
নামাজ শেষ করে মোনাজাতে দুই ফোঁটা চোখের জল ফেলে নিলো। দুই হাত উঁচু করে সৃষ্টিকর্তা’র নিকট প্রার্থনা করলো,

“হে আমার রব!
হয়তো আমার বাক্যগুলো এলোমেলো। হয়তো নিজের চাওয়াটুকু বোঝাবার মতো যথার্থ শব্দ খুঁজে পেতে আমি ব্যর্থ। হতে পারে আমার চিন্তাগুলোও বিচ্ছিন্ন।
কিন্তু মালিক, আপনি তো অন্তরের ভাষাও বুঝেন। মুখ যা উচ্চারণ করতে ব্যর্থ হয়, হৃদয় যা সাজিয়ে নিতে হিমশিম খায়— এসবের কোনোকিছুই আপনার অজানা নেই।
আমি শব্দের অভাবে, বাক্য-বিন্যাসের অপটুতায়, চিন্তার অসামঞ্জস্যতায় যা বলতে পারছি না তা আপনি ইতোমধ্যেই জানেন। সুতরাং— আমার ব্যর্থতাকে আপনার দয়া দ্বারা পরিবেষ্টন করে, আমার অন্তরের চাওয়াটুকু পূরণ করে দিন।”
.
খুব ভোরে মোবাইলের কর্কশ রিংটোনে ঘুম ছুটে গেলো চাঁদনী’র।
রাতে একেবারে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়েছে কিছুক্ষণ হলো। এতো সকালে কে বিরক্ত করছে?
বিরক্ত চাহনিতে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো অপরিচিত নাম্বার। পাঁচ -ছয়বার কল দিয়েছে। কিন্তু কে হতে পারে ভাবতে, ভাবতে কলটাই কে’টে গিয়েছে। এরিমধ্যে টেক্সট আসলো একই নাম্বার থেকে,
” তোমার সাথে জরুরী কথা আছে ফোনটা রিসিভড করো। ঘুমিয়ে থাকলে উঠো, কল ধরো প্লিজ! খুব দরকার।”

চাঁদনী বিস্মিত চোখে তাকিয়ে কয়েক বার পড়লো লেখাটা। মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে,

“কে এই লোক? তাকে তো আপা ছাড়া কেউ কল দেয় না। আর এটা আপাও নয়। এতো ভোরে তাও ঘটা করে তাকে ফোন রিসিভ করতে বলছে কেনো? কোনো ভাবে ফাহাদ নয়তো?”

মেয়েটার ভাবনার মাঝে আবারো কল আসলো। এবার আর দেরী করলো না চাঁদনী। দূরুদূরু বুকে ফোনটা রিসিভড করা মাএই সাথে সাথে ওপাশ থেকে পুরুষালী গম্ভীর এক কণ্ঠ ভেসে আসলো,

“আচ্ছা শুনোনা, আমার তোমাকে প্রচুউর ভাল্লাগে। জরুরী কথা বলা শেষ। ভালো থেকো। আল্লাহ হাফেজ!”

বলেই লাইনটা কে’টে দিলো পুরুষটি। চাঁদনী চমকালো দারুণ ভাবে। তার মুখটা হা হয়ে গেলো। বড়বড় চোখ করে মোবাইলটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে আছে। এই গম্ভীর কণ্ঠ তার খুব পরিচিত। এটা আর কেউ নয়, তার ফাহাদ। তবে কি সেই কল দিয়েছে? হ্যাঁ দিয়েছে, মাএই তো দিলো। কথা বললো। তাও যেনতেন কথা নয়, তাকে নাকি প্রচুর ভাল্লাগে!
চাঁদনী আনমনে একটু শব্দ করেই হেসে উঠলো। এই মুহুর্তে তার সমস্ত ভাবনা জুড়ে শুধু প্রিয় মানুষটার বিচরণ।
আজকের সকালটা এতো মধুর! এতো ভালো লাগার হয়ে উঠলো শুধুমাত্র প্রিয় পুরুষের মধুর কণ্ঠে।
_____________________________
ফাহাদ বাড়ি থেকে এসেছে আজ দু’টো মাস। এরিমধ্যে মাঝে মাঝে চাঁদনী’র সাথে কয়েক মিনিট কথা বলতো। খোঁজ নিতো মেয়েটার। বাবা ছাড়া বাড়ির লোকদের সাথেও কথা বলতো নিয়ম করে।
এভাবে দিন ভালোই যাচ্ছিলো। হঠাৎ করেই কয়েক সপ্তাহ হলো শেষ অবলম্বন চাকরিটা চলে গিয়েছে তার। কম্পানীটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পুরুষের মনোবল পকেটের অবস্থার উপর নির্ভরশীল। তার খুব একটা সঞ্চয় ও নেই।

এমন এক পরিস্থিতিতে হ’তা’শ হলো ফাহাদ । ভিতরে ভিতরে ভে’ঙে পড়েছে ভীষণ।
কয়েক সপ্তাহ ঘুরেও কোনো নতুন চাকরি পেলো না। এই শহরে আজকাল একটা চাকরী পাওয়া বড্ড কঠিন হয়ে গিয়েছে।
চারপাশে সেই আগের মতো শূন্যতা দেখছে। মাস শেষের দিকে অথচ পকেট শূন্য।
কত দায়িত্ব তার। বোনের হাসবেন্ড দেশে এসেছে দিন পনেরো হলো। বোনকে শ্বশুর বাড়ি পাঠাতে হবে। শুধু বিয়েটা হয়েছে এখনো সব অনুষ্ঠান বাকি।
বড় ভাই হিসেবে কতবড় এক দায়িত্ব তার কাঁধে অথচ সে পুনরায় আবারো বেকার হয়ে বসে আছে।
তার এই ভাগ্য নিয়ে চরম হ’তা’শ সে। কি একটা ভাগ্য ভালো কিছু যেন সহ্য হয় না তার।
পুরুষের কাছে পৃথিবীর সব থেকে ভারী জিনিস হচ্ছে শূন্য পকট।
যা শূন্য থাকা স্বত্বেও সত্যেও বয়ে বেড়ানো কঠিনতম এক কাজ।
তবুও ফাহাদ চেষ্টা করেতেই আছে। খুব ভোরে উঠে ধারে ধারে ঘুরে কয়েক জায়গায় পুনরায় চাকরির আবেদন করে এসেছে।
কিন্তু একটাও ভালো খবর আসছে না। নানাদিক টেনশনে আগের মতো আবারও সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ তার।

আজ শুক্রবার! রুমের বারান্দায় বসে এতক্ষণ কয়েকট সিগারেট শেষ করেছে ফাহাদ। জ্বলন্ত আধখাওয়া সিগারেটা হাত দিয়ে ফেলে দিলো দূরে। কিছুই ভাল্লাগছে না তার।
এরিমধ্যে শুভ্র, ফাহাদ’কে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসেছে। ফাহাদে’র বাবা কল দিয়েছে। ছেলের খবর শুভ্রর থেকে প্রতিনিয়ত নেয় সে। বাবা জেনে গিয়েছে, তার ছেলেটার চাকরি নেই।
এই মুহূর্তে সমস্ত মান-অভিমান চুকিয়ে শুভ্র’কে ফোন দিতে বললো ফাহাদে’র নিকট।
শুভ্র ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

“নে কথা বলল আঙ্কেলের সাথে।”

ফাহাদ ডান হাত দিয়ে মাথা চুলকাচ্ছে। এতদিনে বাবার সাথে কথা না বলতে বলতে অজানা এক দূরত্ব তৈরী হয়েছে বাবা-ছেলের মাঝে।
কি বলবে, সে বাবা’কে? তার চাকরি নেই।
বোনের বিয়ের আয়োজন চলছে, এই মুহূর্তে বাবার পাশে থাকা উচিত তার। অথচ কতটা হ’ত’ভা’গা সে!
বাবা বুঝলো বোধহয় ছেলের মনের অবস্থা। কোমল কণ্ঠে ডাক দিলো,

“ফাহাদ…? ”

লাউডস্পিকার দেওয়া যার ফলে শুনলো ফাহাদ। কত মাস পরে বাবা’র কণ্ঠে নিজের ডাক নাম শুনে আর অভিমান ধরে রাখতে পারেনি ছেলেটা।
ফোনটা হাতে নিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললো,

“বলো বাবা!”

আফজাল হোসেন বুক ভরে শ্বাস ছাড়লো। অনেক দিন পরে একটা চাপা কষ্ট যেন দূর হলো এক নিমিষে। উনি কণ্ঠ আগের মতো কোমলতা বিরাজমান করে ছেলেকে আশ্বাস দিয়ে বললো,

“শুনলাম কম্পানী বন্ধ হয়ে গিয়েছে তোর।
শোন বাবা? তুই এসব নিয়ে চিন্তা করিস না। আমিতো আছি। কোনো সমস্যা হবে না আমাদের।
তুই বাড়ি চলে আয় আপাতত।
ফারিহা’কে তুলে নিতে চাচ্ছে তারা। বাড়িতে অনেক কাজ আমি এসব একা সামলাতে পারছি না।”

ফাহাদ তপ্ত শ্বাস ছাড়লো। বড় ছেলে হিসেবে বাবা’র কোনো কাজে পাশে দাঁড়াতে পারলো না সে। অথচ এত দায়িত্ব কাঁধে বাবা”র।
সব সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষটা। তবুও কি সুন্দর ভাবে সবকিছু এড়িয়ে গিয়ে সন্তান’কে ভরসা দেয়, “আমি তো আছি!”
এমন ভরসার স্থানটার নামই বোধহয় বাবা!
ফাহাদে’র এক্ষণের চাপা কষ্টটা দূর হলো। বাবা আরো অনেক বুঝিয়েছে ছেলেকে, সে যেন কোনো চিন্তা না করে।
শুভ্রও আশ্বাস দিয়েছে, সে সবসময় সাথে আছে তার। একটা না একটা ব্যবস্হা হয়েই যাবে।
ফাহাদ আর সময় নষ্ট করলো না। আপাতত চলার জন্য নতুন একটা টিউশনি নিয়েছে। শুক্রবার সকাল থেকেই যেতে বলছে তারা।
হালকা নাস্তা খেয়েই চলে গেলো নিজের গন্তব্যে।
.
.
দেখতে দেখতে বিয়ের অনুষ্ঠানের তারিখ চলে এসেছে। সুখ নীড়ের চারপাশে আজ নানান রঙিন আলো জ্বলছে। বাবা মেয়ের বিয়েতে বিরাট আয়োজন করছে, নিজের সাধ্য অনুযায়ী। চারপাশে অতিথির আনাগোনা। আজ ফারিহার হলুদ সন্ধ্যা। এতো এতো মানুষ অথচ বাড়ির বড় ছেলেটা বোনের বিয়েতে নেই। সবাই তার সাথে পাল্লা দিয়ে অভিমান করে বসে আছে।
কিন্তু কেউ জানে না তার পরিস্থিতি। বাবা ছাড়া সবার অজানা।
কাজের চাপে ফাহাদ’কে সবাই বেমালুম ভুলে বসে আছে এখন।
আজ সারাদিন ভীষণ ব্যস্ততায় সময় কেটেছে সবার। চাঁদনী’র উপরে একটু বেশীই কাজের চাপ। বাড়ির বড় বউ হিসেবে সেও নিজের দায়িত্ব পালন করছে সঠিক ভাবে। আজকের মতো কাজ শেষ করে, চাঁদনী স্ববে মাএ গোসল করে এসেছে নিজের রুমে।
এরিমধ্য মাগরিবের আযান দিয়ে দিয়েছে। সাথে সাথে নামজটা আদায় করে নিলো চাঁদনী।
শরীর চলছে না তার, তার উপর মনটা বিষিয়ে আছে। নামাজ শেষে রুমেই সুয়ে আছে। সুয়েও ভালো লাগছে না। পরক্ষণেই উঠে দাঁড়ালো সে, রুম অন্ধকার করে জানালার কার্ণিশে দাঁড়িয়ে বাহিরে মুখ ডু’বা”লো।
চোখে তার অশ্রু। বাহিরে কত আয়োজন, কত মানুষ আনন্দে মেতেছে। একটু পরেই বর-পক্ষ থেকে লোক আসবে কণেকে হলুদ লাগাতে। সবার মাঝে হৈচৈ।
কিন্তু চাঁদনী নির্জীব। এতো রঙিনতার মাঝে থেকেও তার মাঝে কোনো রঙ নেই। সব পানশে লাগছে।
আজ প্রায় একটা মাস হলো ফাহাদ তার একটি খোঁজ নিলো না। মনে হচ্ছে কত যুগ ধরে কথা শুনে না প্রিয় কণ্ঠের। একটা মাস বা কম কিসে?
নাম্বারটা ও বন্ধ বলছে। এই যে মেয়েটা চিন্তায় দ’ম বন্ধ হয়ে আসছে। মানুষটা কেনো বুঝে না তাকে।
ভাবতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো চাঁদনী।
এরিমধ্য রুমে হঠাৎ লাইট জ্বলে উঠলো। পিছন থেকে একটা কোমল কণ্ঠে বলে উঠলো,

“দেখো, নিজেকে ভালোটা নিজেরই রাখতে হয়। এই যে এতো আয়োজন, এতো হৈচৈ তারপরও তুমি ঘা’পটি মে’রে বসে আছো। কেনো বলতো? কেনোই বা নিজের হাতটাকে লাল টুকটুকে করার বদলে জানালায় মাথা এলিয়ে বিষাদ উড়াচ্ছো? কেনোই বা ভালো না লাগার বাহানায় অন্ধকার রুম করে নেতিয়ে আছো?
একটু নড়েচড়ে বসো না। অন্ধকারকে মুক্তি দাও। এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে নাও। হাতটাকে লাল টুকটুকে করার জন্য বসে পরো। একটু নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েই দেখো না। ম’ন্দ লাগবে না।
জানো তো, পরের মুহুর্তে কি হবে আমরা জানি না। বেঁচে থাকার প্রশ্নটা সম্পূর্ণ অ’নিশ্চিত। তাই এই সামান্য জীবনে এতো বিষাদ উড়িয়ে কি হবে বলো তো! মন খা’রা’প ছাড়া আর কিছুই না।
একটু চেষ্টা করেই দেখো না। সবার হৈ-হুল্লোড়ে নিজেকেও একটু শামিল করো। ভালো লাগলে তো কথাই নেই। আর যদি না লাগে তাতেও সমস্যা নেই। আবার সেই অন্ধকারে ঠাঁই নিয়ে না হয় কেঁ’দে নিবে। তবুও চেষ্টাটা তো করাই যায় বলো!”

চলবে….

#তুমি_রঙিন_প্রজাপতি

#writer_sumaiya_afrin_oishi

#পর্বঃ২২

চাঁদনী দ্রুত চোখের জল লুকিয়ে পিছনে ঘুরে তাকালো। বাবা হাসিহাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে একটা শপিং ব্যাগ ও রয়েছে। চাঁদনী জোড় করে মৃদু হাসলো। হেসেই নম্র কণ্ঠে বললো,

“আব্বা আপনি? বসুন।”

“বসবো না। আমি তোমার সাথে রেগে আছি চাঁদনী।” খানিকটা গম্ভীর কণ্ঠে বললো আফজাল হোসেন।
বাবার এমন কথায় চাঁদনী’র হাসি মুখটা চুপসে যায়। কাচুমাচু করে ভিত কণ্ঠে বললো,

“কেনো আব্বা?কোথাও কোন ভুল করেছি আমি?”

“অবশ্যই ভুল করেছো।”

“কি করেছি?”

“এই যে বাহিরে মেয়েরা কত আনন্দ করছে। আর আমার এক মেয়ে গোমড়া মুখে রুমে বসে আছো। এটাই তো মারাত্মক ভুল চাঁদনী।”

চাঁদনী কিছু বললো না মাথা নিচু করে নিলো। বাবা খানিকটা এগিয়ে এসে চাঁদনী’র মাথায় স্নেহেতুময় হাত বুলিয়ে বললো,

“মন খারাপ করো না মা। আমাদের যার যা ভাগ্যে রয়েছে তা হবেই। তুমি এভাবে থাকলে আমার কষ্ট হয়। নিজেকে অপরাধী মনে হয়।”

“আরে এসব কি বলছেন আব্বা? আমি একদম ঠিক আছি। ” চট করে মাথা তুলে বললো চাঁদনী।

বাবা মৃদু হাসলো। হাতে থাকা শপিং ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

“এখানে তোমার প্রয়োজনীয় সব কিছু রয়েছে। রেডি হয়ে তাড়াতাড়ি বাহিরে এসো মা। ফারিহা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

বলেই আর এক মুহূর্তেও দাঁড়ালো না বাবা, দ্রুত পায়ে চলে গেলো৷ চাঁদনী বাবার যাওয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে হাতে থাকা ব্যাগের দিকে তাকিয়ে রইলো। এখানে গায়ে হলুদের শাড়ী, চুড়ি, গহনা ইত্যাদি রয়েছে। এসব পড়তে ইচ্ছে করছে না তার এগুলো মিনিট দশেক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কিন্তু বাবা দিয়ে গেছে তার বিরুদ্ধে গিয়ে কি করে রাখে দিবে এগুলো? তান্মধ্যে মিম আসলো রুমে, চাঁদনী’কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হলো। মেয়েটা একটু খিটখিটে স্বভাবের। চাঁদনী’র কাছে এসে কোমড়ে হাত দিয়ে একরাশ বিরক্ত নিয়ে বললো,

“এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেনো তুমি?দাদি তোমাকে ডাকতেছে। দ্রুত তৈরী হয়ে এসো।”

মিম চলে যেতে নিলো, চাঁদনী মায়াবী কণ্ঠে পিছন থেকে ডাক দিলো,

“আপু?”

মিম দাঁড়িয়ে গেলো। তার ভিতরে ভিতরে ভিষণ মায়া হলো। কিন্তু কণ্ঠ এখনোও কঠোর একটা ভাব, গমগমে আওয়াজে বললো,

“হ্যাঁ বলো? কি হয়েছে? ”

“আমায় একটু শাড়ী’টা পড়িয়ে দিবে? এগুলো কোথায় কি ভাবে পড়তে হয় আমি ঠিক জানি না।”

মিম কিছু না বলে এগিয়ে আসলো। মনে হচ্ছে খুব যত্ন করে শাড়ী’টা পড়িয়ে গহনা পড়িয়ে দিলো, অল্প সময়ের মধ্যে সুন্দর করে রেডি করে দিলো চাঁদনী’কে। কিন্তু দু’জনই চুপচাপ। মিম সব শেষ করে চাঁদনী’র দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠলো,

“তোমার কি খারাপ লাগছে? আই মিন, কোনো কারণে মন খারাপ?”

“নাহ।” ছোট্ট করে বললো চাঁদনী।

মিম তাকালো চাঁদনী’র দিকে, মেয়েটার মুখটা মলিন হয়ে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে কালো আঁধার ধে’য়ে এসেছে মেয়েটার আঙিনায়, সেই আঁধারের তোড়জোড়ে মায়াবী মুখটায় বিষন্নতার ছাপ। অথচ মুখে কৃত্রিম হাসি লেপ্টে আছে। মিম খানিকটা হাসেই বললো,

“তুমি তো ঠিক ভাবে মিথ্যে ও বলতে জানো না। তোমার চোখ বলে দিচ্ছে তোমার মন খারাপ। ”

চাঁদনী সাথেসাথে মাথা নিচু করে ফেললো, কিছু বললো না। মিম তা দেখে চাঁদনী’র এক হাত ধরে বললো,

“আচ্ছা থাক এসব। চলো যাওয়া যাক।”

অনুষ্ঠানে’র সকল নিয়ম চলছে। সাথে ইয়াং ছেলে-মেয়েরা নাচছে কেউ বা গাইছে। চারপাশে আনন্দের ছড়াছড়ি। একটু পরপর এক ঝাঁক কিশোরী মেয়েদের ঝংকার তোলা হাসির শব্দ ভেসে আসছে। কিন্তু হাসি নেই চাঁদনী’র মুখে। ফারিহা’র পাশে স্টাইজে মুখ কালো করে বসে আছে সে। একটু পরপর গেইটের দিকে তাকাচ্ছে মনে হচ্ছে কেউ আসবে, সে অপেক্ষা করছে পরিচিত একটি মুখের জন্য। কিন্তু সে জানে কেউ আসবে না তবুও তাকাচ্ছে। ফারিহা বারকয়েক লক্ষ করে মৃদু স্বরে বললো,

“ওদিকে কি দেখছো ভাবি?”

চাঁদনী চমকালো। ধরা খেয়ে আমতা আমতা করে বললো,

“কিছু না আপু এমনিতেই। ”

“কিছু না , বললেই হলো নাকি? সত্যি বলোতো, তুমি অপেক্ষা করছো কারো জন্য? কেউ আসবে তোমার। ”

চাঁদনী নিশ্চুপ। ফারিহা আবারো তাড়া দিয়ে বললো,

“কি হলো বলো? কি হয়েছে তোমার ভাবী? এতো আনন্দ চারপাশে অথচ তুমি নিশ্চুপ। তোমার মুখটা এতো শুকনো লাগছে কেনো?”

চাঁদনী আবারো একবার গেইটের দিকে তাকিয়ে ফারিহার দিকে তাকালো। মিনিট খানিক সময় চুপ থেকে হতাশ হয়ে বললো,

“জানিনা ঠিক কিসের অপেক্ষাতে প্রহর গুনছি আমি। সবকিছুর মাঝেও কেনো তীব্র শূন্যতা বিরাজ করে আমার ভেতরে। সব থেকেও কেনো মনে হতে থাকে নিজের বলতে কিছু নেই। বুঝতেছি না ভীড়ের মাঝেও ইদানীং কেনো এতো বেশি একা মনে হয় নিজেকে। কোথায় আছি, কোথায় যাওয়া উচিৎ কিছুই মাথায় কাজ করে না আমার। কোনটা সুখ কিংবা কোনটাই
বা মরীচিকা সবটাই ধোঁ’য়া’শা লাগে নিজের কাছে। জানিনা আমার ঠিক কি করা দরকার আর আমি কি সবই বা নিজের সাথে করে বেড়াচ্ছি আজকাল।

আমি শুধু এতটুকুই জানি, আমি নিজের মাঝ থেকে নিজেকে হারিয়ে ফেলছি ভীষণ বা’জে ভাবে। বহু চেষ্টা করেও আমার আমিটাকে খুঁজে পাচ্ছি না কোত্থাও।যেখানে তাকাই সবটা জুড়ে কেবলই অন্ধকার দেখি।
কেউ পারলে আমার আমিটাকে একটু খুঁজে দাওনা!”

কন্ঠ কাঁপছে চাঁদনী’র এইতো মনে হচ্ছে আঁটকে রাখা চোখের অশ্রুটুকু বেরিয়ে আসবে। ফারিহা’র মায়া হলো।এতটুকু মেয়েটার এতো কষ্ট! যদি সম্ভব হতো সবটুকু সে দূর করে দিতো। কিন্তু কি করবে সে? তবুও শান্ত কণ্ঠে বললো,

“হেরে গিয়ে হাল ছেড়ে দেয়ার আগে আরো একবার চেষ্টা করে দেখো, হয়তো একটু সামনেই সফলতা হাতছানি দিচ্ছে!”

চাঁদনী নিশ্চুপ বসে রইলো। দাদি এদের পাশেই বসা ছিলো। এতক্ষণ বিচক্ষণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেছে মেয়েটাকে। চাঁদনী’র কাঁধে ন’ড়’ব’ড়ে হাতটা দিয়ে কোমল কণ্ঠে বললো,

“নিজের সুখকে অন্যের কাছে আমানত দিতে নাই।
এ যুগে ঋতু পরিবর্তন হওয়ার আগে,মানুষের মন পরিবর্তন হয়..!”

থামলো বৃদ্ধা মহিলা। এইটুকুতেই হাঁপিয়ে গিয়েছে। লম্বা লম্বা শ্বাস টেনে আবারো বললো

শোন? অনেক তো হইলো। এখন নিজেরে লইয়া ভাবো।
জানো?কখনো কখনো নিয়ম কইরা,
নিজেরে সময় দিতে হয়,
নিজেরে লইয়া ভাবতে হয়।
মাঝে মাঝে নিজেকে খুব কইরা ভালোবাসতে হয়,
যত যাই হোক নিজেকে ভুলে যেতে নাই।
অনেক সময়,সময় থমকে যায়।
মনে হয় গোটা পৃথিবী’টাই থমকে গেছে তখন!
তখন নিজের দিকে তাকাইতে হয় একটুখানি।
ঘুরে ফিরে ভাবতে হয়,আমি নিজেকে ভালোবাসি প্রচন্ড,আমায় এগিয়ে যেতে হবে,হবেই।
পৃথিবী কখনো ভাবনার বাহিরে না,ঠিক ভাবনার মাঝে বিরাজমান।”
.
.
রাত অনেকটা গভীর হয়ে গিয়েছে। পাশে’র বাগান থেকে খেঁকশিয়াল ডাকছে। আজকের মতো অনুষ্ঠান শেষ করে সুখ নীড়ে’র সবাই একটু তাড়াতাড়িই সুয়েছে। সারাদিনে কাজ করার ফলে সবাই একটু ক্লান্ত। ইতোমধ্যে সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে।
মধ্যেরাতে কাউকে কিছু না বলেই চুপচাপ বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো আফজাল হোসেন। গাড়ি নিয়ে বাস স্টার্ন অপেক্ষা করছে পরিচিত একটি মুখের জন্য। বারবার হাত ঘড়িতে সময় দেখছে। মিনিট পাঁচেক অতিবাহিত হতেই বাস এসে থেমেছে। অনেকটা রাত যার ফলে রোড জনমানবশূন্য। বাস থেকে একে একে সবাই নেমেছে। সবার শেষে দেখা গেলো খুব পরিচিত সেই মুখটা। আগোছলো মানুষটার চুল গুলো এলোমেলো কাঁধে কালো রঙের ব্যাগ ঝুলছে, সাথে দু’হাতে দু’টো ব্যাগ।
বাবা হাসিমুখে এগিয়ে গেলো সেদিকে। ঠোঁটের কোণে হাসি টেনেই বললো,

“ফাহাদ? এসেছিস বাবা। ব্যাগ গুলো আমার কাছে দে।”

আকস্মিক অনাকাঙ্ক্ষিত জায়গায় বাবা’র কণ্ঠ কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই চমকালো ফাহাদ। এতোদিনের কয়েকটা টিউশনি’র আরো কিছু ঝামেলার জন্য আঁটকে ছিলো সে। বাবা’কে জানিয়েছিলো আরো দিন পনেরো আগে, “আজ নাইটে আসবে সে।”
বাবা চাপ দেয়নি ছেলে’কে। বিনাবাক্যে মেনে নিয়েছে ছেলের সিদ্ধান্ত। ফাহাদ ও ওখানে বসে ফোনে বাবা’র সাথে যোগাযোগ রেখেছে, বিয়ে’র বাজেট অনুযায়ী বাপ-ছেলে যুক্তি পরমর্শ করেছে। বাবা ও ছেলের কথা অনুযায়ী সমস্ত আয়োজন করেছে যা সবার অজানা। তবে এতো রাতে এখানে বাবা’কে মোটেও আশা করেনি সে। বিস্মিত কণ্ঠে আপনা-আপনি বেরিয়ে আসলো,

“আব্বু তুমি এখানে?”

বাবা বিপরীতে হাসলো। ফাহাদ আবারো বললো,

“এতো রাতে আসলে কেনো?”

“এতো রাতে গাড়ি পেতে সমস্যা হতো তোর। তাই গাড়ি নিয়ে এসেছি।”

ফাহাদ আর কিছু বললো না। এতো ঝামেলার মধ্যে থেকেও লোকটা তার জন্য মধ্যরাতে দাঁড়িয়ে আছে এখানে। ভাবতেই এতক্ষণের সমস্ত ক্লান্ত দূর হয়ে গিয়েছে ফাহাদে’র। ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসি তার। মন চাচ্ছে বাবা’কে একটু সময় জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে কিন্তু জড়তার জন্য পারছে না।
মানুষটার প্রতি অটোমেটিক ভালোবাসাটা আরো একটু বৃদ্ধি পেলো।
আফজাল হোসেন ছেলের হাত থেকে ব্যাগ দু’টো নিয়ে নিলো জোড় করে। অতঃপর গাড়িতে বসলো, গাড়ি স্টার্ট দিলো ড্রাইভার। বাপ ছেলে গাড়িতে পাশাপাশি বসে টুকটাক কথা বলছে। বাসা থেকে বাস স্টার্নের দূরত্ব খুব বেশী না।
কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ির সামনে এসেছে। বাবা ড্রাইভার’কে বিদায় দিলো। ফাহাদ একটু সামনেই হেঁটে এসেছে। পিছন থেকে বাবা স্বাভাবিক কণ্ঠে ডাকলো,

“ফাহাদ?”

ফাহাদ দাঁড়িয়ে গেলো। পিছনে ঘুরে তাকিয়ে বললো,

“বলো আব্বু?”

“চল বাহিরের বেঞ্চিতে বসি একটু বাপ-ছেলে।”

ফাহাদ বিনাবাক্যে বাগানে বেঞ্চিতে গিয়ে আয়েস করে বসলো। বাহিরে হালকা জোছনায় চারপাশ স্পষ্ট, সাথে জোনাকি পোকা মিটমাট আলো ছড়াচ্ছে, মৃদু মৃদু ঠান্ডা বাতাস বইছে।
কিছুক্ষণ পরে বাবা ও পাশে বসলো। এতোদিনে জমানো কথা গুলো বলে মনটা যেন হালকা করছে। ফাহাদ ও মনযোগ দিয়ে শুনছে। দু’জনার মধ্যে হঠাৎ নিরবতা। নিরবতা ভেঙে আবারো আফজাল হোসেন আদুরে স্বরে ডাকলো,

“ফাহাদ?”

“হুম।”

“তুমি তো আর এখন ছোট নয় তাই না? ভালো-মন্দ বুঝার জন্য যথেষ্ট বয়স হয়েছে তোমার।”

“আব্বু হঠাৎ এসব বলছো যে? কারণ কি?”

“কারণ অবশ্য তেমন নয়’ বললাম আর কি।”

ফাহাদ বাগানের দিকে তাকিয়ে ছিলো এতক্ষণ। বাবা’র এতো ঠান্ডা মেজাজের আদুরে কথা শুনে ত’ড়া’ক করে মনোযোগ দিয়ে তাকালো বাবা’র মুখের দিকে। আফজাল হোসেন হাসলো। জোছনার আলোয় বাবা’র হাসিটা ভীষণ মনোমুগ্ধকর লাগছে। কতদিন পরে এই হাসিটা দেখলো। এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলো ফাহাদ। এরিমধ্যে বাবা আবারো বললো,

“একটা কথা বলি ফাহাদ?”

“একটা নয় তোমার হাজারটা কথা শুনবো আব্বু। বলো কি বলবে?”

“শোনো? জীবন চলমান। আজ অবধি কারো জন্য এই জীবন থেমে থাকিনি। এক জীবনে অনেক পাওয়া না পাওয়ার গল্প থাকবে। আজ যা হারিয়েছো কাল তা পাবে। তবে বিশ্বাস রাখতে নিজের প্রতি। জীবনে দেরী বলে কিছু নেই, নেই কোনো শেষ কথা।যে কোনো সময় আবার একটি ফ্রেশ শুরুর সিদ্ধান্ত নিতে পারবে তুমি, কোনো বাঁধা নেই।
যতক্ষণ তোমার মাঝে ইচ্ছা আছে ততক্ষণ কোনো দেরী হয়নি তোমার জীবনে। তুমি আবার জেগে উঠতে পারবে, নিজেকে প্রকাশ করতে পারবে, কিন্তু সব কিছুর মাঝে ইচ্ছা শক্তিটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ইচ্ছা আমাদের নিয়ে যেতে পারে অনেক দূর, বয়স কত হলো, কতবার ভুল করেছি জীবনে এগুলো কোনো বিষয়ই নয়।”

থামলো বাবা। ফাহাদ এতক্ষণে বুঝেছে বাবা’র এসব কথার পিছনে নিশ্চয়ই বড়সড় কারণ রয়েছে। সবটা শোনার জন্য তাকিয়ে রইলো বাবা’র মুখের দিকে। এরিমধ্য বাবা আবারো বললো,

“ঠকে যাওয়া মানেই হেরে যাওয়া নয়।
জীবনে সত্যিকারের ভালোবাসা খুব মুসকিলে পাওয়া যায়। আর সেই ভালোবাসা হারিয়ে যাবার পর জীবনে সেকেন্ড চান্স পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। তাই বলবো যদি কারোর জীবনে দ্বিতীয়বার সেই সুযোগ আসে তাহলে সেই সুযোগ মিস্ করতে নেই।
কে বলে আমাদের ভবিষ্যৎ নেই? ভবিষ্যৎ তো নিজের হাতেই।

আচ্ছা? ঠকে যাওয়া মানেই কি হেরে যাওয়া? কিছু কিছু সময় ইচ্ছে করেই ঠকতে হয়। নিজের কাছে, সময়ের কাছে ভাগ্যবিধাতার কাছে— আমরা হরহা’মে’শা’ই ঠকে যাই। ভাগ্যকে, নিজেকে নয়তো চারপাশের মানুষদেরকে দোষারোপ করি। বিশ্বাস রাখুন নিজের প্রতি। নিজেকে সুযোগ দিন, কেউ জীবনে আসতে চাইলে গ্রহণ করুন, নিজের বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়েই গ্রহণ করো।
একজনের কাছে ঠকে সবাইকেই অবিশ্বাস করা ঠিক নয়, এমনও তো হতে পারে আজ যাদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন হয়তো তাদের মধ্যেই জীবনের সেই সঠিক মানুষটিও ছিলো। ঠকতে ঠকতেই একদিন জিতে যাবে, বিশ্বাস করো নিজেকে একবার নয় বারবার।
তুমি তোমার সময় নেও। কিন্তু অতিরিক্ত সময় নেওয়া যাবে না, তবে মনে রাখবে অনেক কম সময় ও নেওয়া ঠিক হবে না, আর ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকো!”

কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো আফজাল হোসেন। ফাহাদ এখনো নত মুখে বসে আছে। বাবা কিসের ইঙ্গিত দিয়েছে তা আর বুঝতে বাকি রইলো না। কিন্তু সে উত্তর দিতে পারছে না এই মুহূর্তে। আফজাল হোসেন পুনরায় তাড়া দিয়ে বললো,

“এবার চলো ভিতরে। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে।”

ছেলের উওরের আশায় দাঁড়ালো না তিনি নিজে আগেই হাঁটা দিলো।
.
.
বিছনায় সুয়ে কাতরেচ্ছে চাঁদনী। জ্বরে শরীর পু’ড়ে যাচ্ছে তার। সন্ধ্যায় গোসল করার ফল স্বরুপই বোধহয় এই জ্বর। জ্বরে শরীর কাঁপছে এখন। অনুষ্ঠান চলাকালীন থেকেই শরীর মেজমেজ করছিলো তার। যার জন্য পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই রুমে এসে দরজা বন্ধ করে সুয়েছে সে। খাবারটা ও খায়নি রাতে। যদিও একবার মিম ডেকেছিলো। সে না করে দিয়েছে, কেউ আর জোড় করেনি।
কিন্তু রাত বাড়ার সাথে সাথে জ্বরটাও তড়তড় করে বাড়ছে। চোখে ঘুমের ছিটেফোঁটা ও নেই। তবুও কাঁথা মুড়ি দিয়ে চোখ দু’টো বন্ধ করে আছে।
এরিমধ্য হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ানোর শব্দ চোখ খুলে তাকালো। কপালে চিন্তার ভাঁজ। এতো রাতে আবার কে? এখন তো সবার ঘুমোনোর কথা। আবারও কিছু একটা ভেবে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো চাঁদনী। বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“কে?”

চলবে…..

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে