তুমি রঙিন প্রজাপতি পর্ব-১৯+২০

0
624

#তুমি_রঙিন_প্রজাপতি

#writer_sumaiya_afrin_oishi

#পর্বঃ১৯

আরো কিছু সময় আড্ডা দিয়ে যে যার রুমে চলে গেলো সবাই। মানুষের সঙ্গ পেয়ে চাঁদনী’র এতক্ষণে মন খারাপ ভাবটা চলে গিয়েছে, ভীষণ ফুরফুরে মেজাজে রুমে আসলো। বিছানায় বসতেই চোখ গেলো বালিশের পাশে লাল শপিং ব্যাগটার দিকে। রুমে সে একাই তবুও চোরা দৃষ্টিতে আশপাশে একবার পর্যবেক্ষণ করে প্যাকেট গুলো খুলে ফেললো।
একটা আকাশী রঙের জর্জেট শাড়ী, দুই মুঠো রেশমি চুড়ি, একজোড়া নুপুর, আর একটা বেলি ফুলে’র মাসলা।
চাঁদনী বারংবার সেগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে, খুঁটিয়ে, খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো, প্রিয় মানুষের দেওয়া প্রথম উপহার গুলো। এইটুকুতেই ঠোঁটের কোণে অমায়িক হাসি যেন সরছেই না মেয়েটার। যখন ফাহাদ তার জন্য মনে করে, নিজ থেকে, কিছু একটা এনেছে বলেছিলো সেই থেকে তার হৃদয় জুড়ে আনন্দে’র শিহরণ বহিছে।
কিন্তু মানুষটার প্রতি অভিমান করে সেই আনন্দ আর প্রকাশ করেনি সে। কিন্তু এখন একাকী রুমে বসে নিজের খুশীটা আর দমিয়ে রাখতে পারলো না। তার মন চায় এগুলো এক্ষণই পড়েতে, কিন্তু তাতো আর করা যাবে না। পরক্ষণেই শাড়ীটা নিজের শরীরে’র সাথে জড়িয়ে উচ্ছাসিত কণ্ঠে বলে উঠলো,

“এগুলো আমার জীবনের সবচেয়ে বেস্ট গিফট হয়ে থাকবে ফাহাদ। আপনি কি ভেবেছেন? এগুলো পেয়ে আমি খুশী নই তাই-না? আপনি তো শুধু উপরের গম্ভীরতা দেখলেন, কিন্তু যদি একটিবার আমার ভিতরে’র আনন্দটা অনুভব করতে পারতেন, আমার ভালোবাসা’র গভীরতা বুঝতেন তাহলে বারংবার আমাকে উপেক্ষা করার মতো দুঃসাহস দেখাতেন না।”

ঠিক তক্ষণই একজোড়া চোখ দরজার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে নিলো।
হ্যাঁ ফাহাদ মিনিট পাঁচেক আগেই এসেছে বাসায়। রুমে’র দরজা অব্দি আসতেই মেয়েটার হাসি হাসি মুখটা দেখে ভিতরে ভিতরে স্বঃস্তি পেলো। কিন্তু রুমে গেলো না সে। এই অবস্থায় তাকে দেখলে নিশ্চয়ই ভীষণ লজ্জা পাবে মেয়েটা। তাই নিঃশব্দে মায়ের কাছে চলে গেলো।
শ্বাশুড়ি’র রুম থেকে হঠাৎ ফাহাদে’র কণ্ঠ কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই চমকে উঠলো চাঁদনী। দ্রুত জিনিসপত্র গুলো আগের মতো রেখে দিলো।
এরিমধ্য একে একে মাহিম, বাবা দোকান থেকে এসে গিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই মিলে এক সাথে ডিনার করে সুয়ে পড়লো।
.
.
ফাহাদ নিজের নিচে করা বিছনায় সুয়ে আশ-পাশ করছে, চোখ দু’টোতে ঘুম যেন ধরা দিচ্ছেই না। এই একাকী রাতের নিস্তব্ধতার কাছে খসে পড়ে সমস্ত কৃএিমতা। মস্তিষ্ক হিসাব মিলাতে ব্যস্ত হয়ে যায়, এই জীবনে”র চাওয়া পাওয়া গুলো নিয়ে। প্রাপ্তির খাতাটা শূন্য তার, না পাওয়ার খাতাই রয়ে গিয়েছে সব।
নিজের এই বিষিয়ে যাওয়া জীবনটা নিয়ে তো ভালোই ছিলো সে, হঠাৎ কোনো তার জীবনে অন্য কেউ আসলো।চট করে এক পলক তাকালো খাটের কর্ণারে সুয়ে থাকা চাঁদনী’র পানে। মেয়েটা এতক্ষণে ঘুমিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই, একদমই নেই। হুটকরে জীবনের মোড় কোন দিকে যাচ্ছে সেই ভাবনায় অস্হির ছেলেটা।
এ কেমন অ’স’হা’য়’ত্ব জীবন তার? না পারছে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে, আর না পারছে মেয়েটাকে সুখী করতে। নিজেকে পা’গ’ল পা’গ’ল লাগছে।
পৃথিবীতে সব চেয়ে অ’স’হা’য় সে তো এই মানুষ গুলো, যে নিজের রা’গ, অ’ভিমান, ক”ষ্ট কাউকে দেখাতে পারে না, একটু চি’ৎ’কা’র করে কাঁ’দতে পারে না! শুধু চো’খের জল লু”কিয়ে হাসে।
ফাহাদ ঠিক তেমন, নিজেকে কারো কাছে মেলে ধরতে পারে না। কষ্ট গুলো নিজের ভিতরে রেখে উপরে শক্তপোক্ত খোলসে মুড়িয়ে রাখে নিজেকে।
কিন্তু এই রাত বড়ই অদ্ভুত! সবসময় গম্ভীর শক্তপোক্ত মানুষটাকে ও ঘুমাতে দেয় না।
শত ভাবনা নিয়ে, ছটফট করতে করতে এক সময় চোখ বন্ধ করে নিলো ফাহাদ।

হঠাৎ মাঝ রাতে কারো কাতরানো’র শব্দে ঘুম ছুটে যায় চাঁদনী’র। চট করে উঠে বসলো সে। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে, কি হয়েছে?
আবার সেই শব্দ। শব্দের অনুসরণ করতেই চোখ গেলো ফাহাদে’র দিকে। তার কিছু হলো না তো আবার? ডিম লাইটের আলোতেও স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না লোকটা ঘুমাচ্ছে নাকি সজাগ।
চাঁদনী ব্যস্ত হয়ে এক-পা এক-পা করে এগিয়ে গেলো ফাহাদে’র নিকট। মৃদু ডাকলেও কিন্তু জবাব এলো না। কি জানি একা একা বিড়বিড় করছে ফাহাদ, কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারছে না চাঁদনী।
মিনিট খানিক সময় নিয়ে সাত-পাঁচ ভেবে কপালে হাত রাখলো চাঁদনী। পরক্ষণেই চমকালো মেয়েটা! মনে হচ্ছে তার হাত ঝলসে যাচ্ছে তাপে। শরীর কাঁপিয়ে ভীষণ জ্বর এসেছে ছেলেটার।
চিন্তিত হলো চাঁদনী, এই ঠান্ডা ফ্লোরে থাকলে তো আরো সমস্যা হবে। মিনিটের মধ্যে সমস্ত জড়তা ভুলে শরীরে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ডাকলো চাঁদনী,

“এই শুনছেন?”

এভাবে একবার , দুইবার, কিন্তু কোনো উওর আসছে না। এবার ঘাবড়ে গেলো চাঁদনী , এতো রাতে এই অবস্থায় কি করবে সে? উঠে লাইট জ্বালিয়ে নিলো। আরো কিছুক্ষণ সময় নিয়ে পরাপর বার কয়েক ডাকতেই নিভু নিভু চোখে তাকালো ফাহাদ।
চাঁদনী বিচলিত কণ্ঠে বললো,

“আপনি শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা? এ্যাই উঠুন একটু। আপনার শরীরের এতো জ্বর আসলো কখন?”

ফাহাদে এখনো জ্ঞান শূন্য নয়, দূর্বল চাহনিতে একবার চাঁদনী’কে দেখে নিয়ে, দূর্বল কণ্ঠে বললো,

“আমি ঠিক আছি। তুমি গিয়ে সুয়ে পড়। ঘুমাও।”

“এহ বললেই হলো ঠিক আছেন। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। উঠুন বলছি। কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে বললো চাঁদনী। ফাহাদ বোধহয় খানিকটা হাসলো। যা চোখ এড়ালো না চাঁদনী’র। চাঁদনী সহসায় ভড়কালো! জ্বরের ঘোরে মাথাটাও গেছে বোধহয়।
চাঁদনী সেসব পাওা না দিয়ে আবারও তাড়া দিলো,

“কি হলো? ”

“না কিছু না।”

“তাহলে উঠছেন না কেনো?”

“উঠে কই যাবো?”

“কই আবার বিছনায়। দেখুন বাচ্চামো করবেন না। আপনার শরীরে প্রচুর জ্বর এসেছে। ”

“না না থাক। এতটুকু জ্বরে কিচ্ছু হয় না আমার। আমি.. আমি ঠিক আছি।”

ফাহাদে’র কথা জড়িয়ে আসছে এবার। চাঁদনী কিচ্ছুটি না বলে, ফাহাদে’র এক হাত ধরে উঠানোর বৃথা চেষ্টা করছে। কিন্তু এতবড় মানুষকে কি আর তার মতো মেয়ে তুলতে পারে।
ফাহাদ কিচ্ছু বলছে না, নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলো তার ধরা হাতের দিকটায়।
এই ছোট ছোট স্পর্শ গুলো তার ভীষণ ভালো লাগছে।
একপ্রকার চাঁদনী’র জোড়াজুড়িতে উঠো দাঁড়ালো ফাহাদ। কিন্তু পারছে না মনে হচ্ছে এই বুঝি পড়ে যাবে। শরীর বড্ড দুর্বল, সারা শরীর ব্যথায় অচেতন হয়ে গিয়েছে। ফাহাদ অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো চাঁদনী’র দিকে। যার অর্থ আমায় উঠতে সাহায্য করো।
চাঁদনী বুঝলো এই চাহুনি, এগিয়ে এসে ফাহাদে’র হাত ধরলো। ফাহাদ চাঁদনী’র কাঁধে ভর দিয়ে টলতে টলতে বিছনায় কোনো মতো সুয়ে পড়লো।
বিছানায় সুতেই শরীর ছেড়ে দিয়েছে, ক্ষণে ক্ষণে শরীর কাঁপছে। চাঁদনী বিচলিত হয়ে আলমারি থেকে দুইটা মোটা কম্বল মুড়ি দিলো ফাহাদ’কে।
না এতেও মানছে না যেন। কি করবে চাঁদনী?
ঘড়ির কাটায় রাত দুইটা বাজে বিশ মিনিট। এতো রাতে নিশ্চয়ই সবাই ঘুমে। কাকে ডাকবে সে?
এদিকে ধীরে ধীরে ফাহাদে’র অবস্থা খারাপ হচ্ছে। চাঁদনী আর কাউকে না ডেকে একটা বোলে পানি আনলো। একটা কাপড় ভিজিয়ে ফাহাদে’র হাত-পা মুছে দিলো। এতে যদিও তার কেমন লজ্জা লাগছে। তবুও এই সময়ে কিছু করার নেই।
তারপর অসুস্থ স্বামী’র মাথার কিনারায় বসে কপালে জলপট্টি দিতে লাগলো।
মনে মনে সৃষ্টিকর্তা কে ডাকছে স্বামীর সুস্হ্যতার জন্য। মেয়েটার চোখ দু’টো ছলছল করছে। ফাহাদ এখনো জ্বরের ঘোরে অচেতন হয়ে পড়ে আছে।

এভাবে আরো ঘন্টা খানিক সময় পার হতেই আগের চেয়ে কিছুটা শরীর’রের তাপ কমেছে। চাঁদনী এখনো বসে বসে জলপট্টি দিচ্ছে।
ফাহাদে’র কিছুটা হুঁশ ফিরেছে সে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে মেয়ে’টার ফোলা ফোলা চোখের দিকে। তার মনে প্রশ্ন জাগলো, মেয়েটা কি কেঁদেছে তার জন্য?
কিন্তু বলতে পারলো না কিছু। ফাহাদে’কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অস্বস্তি হচ্ছে চাঁদনী’র। তারমধ্যেই ফাহাদ তার হাত থামিয়ে দিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললো,

“এখনো জেগে আছো? ঘুমাওনি কেনো?”

লোকটার এমন সময়ে এমন প্রশ্নে চাঁদনী’র মেজাজ বিগড়ে গেল। এমন অসুস্থ মানুষটাকে রেখে সে নাকি ঘুমাবে। আশ্চর্য! এমনিতেই টেনশনে মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে সেখানে ঘুম!
তবুও নিজেকে সামলে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,

“এখন কেমন লাগছে আপনার? কোথাও কষ্ট হচ্ছে?”

“একটু ভালো।”

“এবার একটু ঘুমানোর ট্রাই করুন।”

“মাথাটা ব্যথা করছে।”

চাঁদনী উঠে দাঁড়ালো। বোল ভর্তি পানি, ভেজা কাপড় গুলো ওয়াশরুমে রেখে পুনরায় বসলো ফাহাদে’র পাশে। উতাপ্ত কপালে নিজের ঠান্ডা হাতটা রেখে বললো,

“চোখ বন্ধ করে রাখুন। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ”

উষ্ণ শরীরে হঠাৎ ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে বেশ আরাম লাগছে ফাহাদে’র। এই স্পর্শ গুলো তার ভীষণ ভালো লাগছে তাই আর কিছু বললো না। এই সময়ে এমন একটা আদুরে, স্নেহময় হাতের দরকার, ভীষণ দরকার!
আরো একটু কোমল হাতের ছোঁয়া পাবার লোভে চাঁদনী’র কথা মতো চোখ দু’টো বন্ধ করে নিলো।
চাঁদনীও পরম যত্নে প্রিয় মানুষটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
হঠাৎ করে ফাহাদ চোখ বন্ধ অবস্থায়ই ডাকলো,

“চাঁদ? ”

চাঁদনী’র হাত থেমে গেলো। এই প্রথম মানুষটা তাকে ডাকলো, তাও আবার আদুরী কণ্ঠে, “চাঁদ” বলে।
সপ্তদশী মেয়েটার হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠলো আবেগে, ভালো লাগায় মাখোমাখো হয়ে যেন ছড়িয়ে পরছে শরীরের প্রতিটা শিরা-উপশিরায়।
অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্রিয় পুরুষটির মায়াবী মুখটার দিকে।
চাঁদনী’র কোনো রেসপন্স না পেয়ে চোখ খুলে তাকালো ফাহাদ। জড়ানো কণ্ঠে আবারো বললো ,

“কি হলো কথা বলছো না কেন চাঁদ ?”

“জ্বি বলুন। ” হকচকিয়ে বললো চাঁদনী।

“একটা কবিতা শুনবে? বলি?”

চাঁদনী যেন এবার হা’র্ট অ্যা’টা’ক করবে। এই ছেলে নিশ্চয়ই জ্বরের প্রলেপে আবল-তাবল বকছে। নিজেকে সামলে নিয়ে চাঁদনী মাথা নাড়ালো।
মানে শুনতে চা সে। ফাহাদ কিঞ্চিৎ হাসলো, চাঁদনী’র চোখ চোখ এখনো স্হির। অতঃপর এলোমেলো জড়ানো কণ্ঠে বলে উঠলো ,

“একটা নিজের মানুষ জীবনে আসুক। মানুষটা মনের কথা বোঝার পাশাপাশি চোখের ভাষাটাও না হয় মাঝেমধ্যে একটুখানি বুঝতে পারুক।

সেই মানুষটা আমার নিঃশ্বাস হয়ে বিশ্বাসে মিশে থাকুক। মানুষটার জীবনের গল্পের প্রতিটি অধ্যায়ে আমার স্মৃতিটাও না হয় একটুখানি আঁকা থাকুক।

বেলাশেষে যখন এই মানুষটার বুকে মাথা রাখবো, তখন আপনাআপনিই সারাদিনের সমস্ত দুঃখ আর আক্ষেপগুলো এক মুহূর্তেই ফুলের মতো সুন্দর হয়ে উঠবে।
এই নিজের মানুষটার হাত জাপ্টে ধরে হাজার আলোকবর্ষের অন্ধকার এক শুকতারার নিচে নিয়ে আসবো।
এই মানুষটাকে কখনও হারিয়ে যেতে দেবো না। তাকে একদম নিজের মানুষ হিসেবে রক্তে মিশিয়ে রাখবো।
এই নিজের মানুষটাকে সাথে নিয়ে নিজের জীবনের শেষ অবধি শেষ নিঃশ্বাস গুনবো।”

আস্তে আস্তে চোখ বুঝে নিলো ফাহাদ। ক্লান্ত হয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু পাশে থাকা কিশোরী মেয়েটা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে এখনো।
তার যেন গোড় কাটছে না। মাথাটা ভনভন করছে। হাজারটা প্রশ্ন চেপে ধরেছে তাকে। তবে এটা কিসের ইঙ্গিত দিয়েছে ফাহাদ?

#চলবে……

#তুমি_রঙিন_প্রজাপতি

#WriteঃSumaiya_Afrin_Oishi

#পর্বঃ২০ (প্রথম অংশ)

ঘুমন্ত স্বামী’র দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চাঁদনী। আজকের রাতটা তার জীবনের স্পেশাল একটা রাত হয়ে থাকবে তার স্মৃতির পাতায়।
আবেগি হয়ে জ্বরকে মনে মনে ধন্যবাদ দিচ্ছে চাঁদনী। এই জ্বরটার জন্যই আজ তার প্রিয় পুরুষের কাছাকাছি আসতে পেরেছে সে। তাকে প্রথমবারের মতো স্পর্শ করতে পেরেছে। এতটুকুই বা কম কিসের? এতেই সে খুশী, ভীষণ খুশী! এমন জ্বর নিত্য হলে মন্দ হয় না!
পরক্ষণেই মুখে হাত দিয়ে ফেললো চাঁদনী, ছিঁহ! আবেগের ব’শে এসব কি ভাবছে সে?
সে-তো চায় মানুষটা যেখানেই থাকুক, সবসময় ভালো থাকুক।
চাঁদনী একটু নড়েচড়ে বসলো, আবারো ফাহাদে’র মুখশ্রী’র দিকে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠলো,

“জা’নো প্রি’য় পুরুষ!
তুমি আকাশের নীল গু’লোর মতো’ই আমার বিশা’ল মনের পুরো’টা জু’ড়ে রয়ে’ছো!
তোমার কথা সারাক্ষণ ভাবতেই ভালো লাগে আমার, দু-চোখ ভরে সারাক্ষণ দেখতে ইচ্ছে করে তোমায়।
জা’নো আমার খুব করে ই’চ্ছে করে তোমায় জড়ি’য়ে ধরে হা’জার বছর বাঁচ’তে!”

অতঃপর কপালে হাত দিয়ে দেখলো, জ্বরটা কমেছে অনেকটাই। চাঁদনী স্বস্তি পেলো। আর বসে থাকলো না, আজ যখন জেগেই আছে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া যাক। সেই ভেবেই চলে গেলো ওয়াশরুমে ওজু করার জন্য। নামাজ শেষ করে মোনাজাতে অসুস্থ্য স্বামীর জন্য দোয়া চাইলো আল্লাহর কাছে।
নিজের সমস্ত ইচ্ছে অনিচ্ছা তুলে ধরলো রবের কাছে।
.
.
পরদিন সকালে বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙে ফাহাদে’র। ঘুম ভাঙতেই নিজেকে বিছনায় আবিষ্কার করলো। যা দেখে মিনিটের জন্য থমকে গেলো পুরুষটি। মস্তিষ্ক জাগ্রত হলো, এখানে কি করে আসলো সে?
পরক্ষণেই রাতের কথা চোখের সামনে স্পষ্ট হলো। বারংবার চোখের সামনে ভাসছে কৃষ্ণকলি মেয়েটার বিচলিত অবয়া। চাঁদনী’র যত্ন গুলোর জন্য মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নিলো ফাহাদ। নিঃসন্দেহে মেয়েটা ভীষণ যত্নশীল। মেয়েটার কথা ভাবতেই ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটলো গম্ভীর পুরুষটির।
পর-মুহুর্তেই নিজের বলা পা’গ’লা’মো কথা বার্তার জন্য লজ্জা পেলো ফাহাদ।
জ্বরের ঘোরে এসব কি বলছে সে? এসবের জন্য অস্বস্তি লাগছে এখন। কি করে এখন সে চাঁদনী’র মুখোমুখি হবে? নিজের সুপ্ত অনুভূতি গুলো’তো গোপনই শ্রেয় ছিলো তার জন্য ।
ফাহাদ বুঝেছে, খুব কাছ থেকে দেখেছে সপ্তদশী মেয়েটার চোখে তার জন্য গভীর টান, সীমাহীন ভালোবাসা। ওই সহজ, সরল মায়াবী মুখটায় কিঞ্চিৎ ছ’ল’না’ম’য়ী নয়। এমনটা হতেই পারে না তার গাঢ়ো বিশ্বাস।
তবুও কোথাও যেন একটা জড়তা, দ্বিধা রয়েই যায়। তীব্র ভালোবাসা দেখেও আগলে রাখতে পারছে না সেই ভালোবাসা। তারমধ্যেই মনে পড়ে অতীত। স্মৃতির পাতা জাগ্রত হয়ে, মস্তিষ্কে কিলবিল করছে প্রিয় নারীর ছ’ল’না।
একবার হেরে যাওয়া মানুষটা এত সহজে যে কাউকে বিশ্বাস করবতে পারছে না।
জীবন যে তাকে শিখিয়েছে,কারো প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীল হওয়ার আগে তাকে ভালো ভাবে যাচাই করে নিতে হয়। নয়তো একাকিত্ব ছাড়া নিজের বলতে আর কিচ্ছু থাকে না!
না আর ভাবতে পারছে না ফাহাদ। মাথাটা টনটন করছে, জ্বরটা কমলেও সাড়া শরীর ব্যাথা করছে।
বিছনা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো ফাহাদ। আপাতত ফ্রেশ হওয়া যাক।
.

মিনিট পাঁচেক পড়েই রান্না ঘর থেকে ছুটে এলো চাঁদনী। দুপুরের রান্না করছে সে। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে দেখে যায় মানুষটা উঠেছে কি-না।
দরজার কাছ থেকে রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো বিছানা খালি। তারমানে ফাহাদ উঠছে। ধীরপায়ে রুমে এসে বিছনা গুছিয়ে নিলো চাঁদনী।
এরিমধ্যে ফাহাদ ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। চাঁদনী সেদিকে তাকিয়ে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলো,

“এখন শরীর কেমন লাগছে আপনার?”

ফাহাদ একপলক তাকালো চাঁদনী’র দিকে, দৃষ্টি গাঢ়ো হওয়ার আগেই সরিয়ে নিলো সেই দৃষ্টি, অতঃপর গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

“ভালো।”

চাঁদনী অবাক হলো খানিকটা। এই মানুষটা’তো আস্ত একটা গিরগিটি, ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়। এইযে ঠিক আগের মতোই আবারো ও গম্ভীরতা বিরাজমান। অথচ রাতে কত কিছুই না বললো তাকে। নাকি সে-সব জ্বরের জন্য ভুলে গিয়েছে? জানা নেই চাঁদনী’র! এই মানুষটার মনে ঠিক চলছে টা কি বুঝে উঠতে পারছে না সে।
চাঁদনী এসব আর না ভেবে দ্রুত পায়ে চলে গেলো রুম থেকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে দু-হাতে করে, রান্না ঘর থেকে খাবার নিয়ে পুনরায় রুমে আসলো।
গরম ভাত, সাথে ঝাল ঝাল কয়েক পদের ভর্তা আর ডিম ভাজি’র প্লেট রাখলো খাটের এক সাইডে। জ্বরের মুখে ঝাল কিছুই খেতে ভালো লাগবে ভেবে খুব যত্ন করে ভর্তা গুলো বানিয়েছে চাঁদনী।

ফাহাদ আবারো সুয়ে পড়ছিলো, চাঁদনী’কে খাবার রুমে নিয়ে আসতে দেখে উঠে বসলো। ক্লান্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,

“রুমে নিয়ে আসলে কেনো? আমায় ডাকলেই তো পারতে।”

“এনেছি যখন খেয়ে নিন জলদি। খেয়ে ঔষধ খেতে হবে।”

“ঔষধ তো নেই বাসায়।”

“বাবা সকালে দিয়ে গেছে। আপনি তখন ঘুমে ছিলেন তাই কেউ ডাকেনি।”

ফাহাদ আর কিছু বললো না। চুপচাপ খাবার হাতে নিলো। অমনি রিনরিন কণ্ঠে চাঁদনী আবদার করলো,

“আপনি রাখুন। আমি খাইয়ে দেই না।”

“আমি পারবো। তুমি আমার জন্য অনেকটা করেছো।তার জন্য আমি ঋণী তোমার কাছে। প্লিজ আর করো না! আমারটা আমি বুঝে নিবো।”

ফাহাদে’র এহেন কথায় আশাহত হলো মেয়েটার কোমল মনটা। মলিন কন্ঠে আক্ষেপ করে বললো,

“এভাবে বলছেন কেনো ফাহাদ? আপনি এমন কেনো বলুন তো? রসকষহীন মানুষ! ”

“আমি এমনই।” চট করে বললো ফাহাদ।

চাঁদনী খানিকটা হাসলো। এই হাসির আড়ালে ছিলো এক আকাশ সমান দীর্ঘ শ্বাস। ঠোঁটের হাসিটা বজায় রেখেই মৃদু কণ্ঠে বললো,

“ভালোবাসি বলেই, বারবার ছুঁড়ে ফেলার অধিকার পেয়েছেন।
এই যে বারংবার অবহেলা করেন, অপেক্ষায় রাখেন।
আমার নামে ঘৃণার আধুলি জমান বুকের ভেতর।
ভালোবাসি বলেই, এসবের অধিকার পেয়েছেন।
জুড়ে আছি বলেই, বারবার ছুঁড়ে ফেলতে চাইছেন।
ভালোবাসি বলেই বারবার নত হই, তাই সচতা ভেবেছেন।
আমি যদি ভালো না বাসতাম তবে ঘৃণা কিংবা অবহেলার অধিকার পেতেন না।
আমি ভালো না বাসলে আপনার অবহেলার করার যোগ্যতাও থাকে না।

একদিন, হ্যাঁ একদিন আমিও পারবো..
“ভালোবাসি না” বলে দিয়ে সমস্ত অধিকার তুলে নিবো।”

কথা শেষ করে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলো চাঁদনী। অমনি পিছন থেকে ডাকলো ফাহাদ,

“শোনো?”

চাঁদনী থামলো, পিছনে তাকিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,

“বলুন?”

“খেয়েছো তুমি?”

“হুম। ” ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে চলে গেলো চাঁদনী

ফাহাদ খেতে পারলো না। গলা দিয়ে খাবার নামছেই না যেন। বারবার কানে বাজছে চাঁদনী’র বলে যাওয়া কথা গুলো। আচ্ছা সত্যিই কি সব অধিকার তুলে নিবে সে?
ফাহাদে’র বক্ষে হঠাৎ তী’ব্র আ’ন্দো’ল’ন শুরু হলো। না চাইতেও অজানা এক টানে বুকের বাঁ-পাশটায় চিনচিন ব্যথা করছে।
এরিমধ্য একে একে সবাই তার খবর নিতে রুমে আসলো। পরক্ষণেই ফাহাদ নিজেকে সামলে নিলো। ভাত খেলো না আর হাত ধুয়ে নিলো। যা দেখে ফারিহা ভাইকে জোড় করে দুই লোকমা ভাত খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিলো।
.
.
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলো। এরিমধ্য দু’জনার কেউ কারো সাথে প্রয়োজনীয় টুকটাক কথা ছাড়া কথা বলেনি। ঔষধ খাওয়ার ফলে ফাহাদে’র জ্বর ছেড়েছে। বিকেলে হাঁটাহাঁটি’র জন্য কিছুক্ষণ হলো বাহিরে বের হয়েছে ফাহাদ।
চাঁদনী নিজের রুমেই টুকটাক কাজ করছে। তারমধ্যই রুমে আসলো ফারিহা আজ সাথে মিম ও আসছে।
মিম’কে দেখে ভীষণ অবাক হলো চাঁদনী। এই মেয়ে এতদিনে তার কাছে একবারও আসেনি আজ হঠাৎ আসলো কারণ কি?
চাঁদনী কাজে’র হাত থামিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মিমের মুখে’র পানে। বুঝার চেষ্টা করছে আসল কারণ। কিন্তু ফলাফল শূন্য।
চাঁদনী’কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিম অস্বস্তিতে পড়লো, মিনমিন করে বললো,

“এভাবে কি দেখছো?”

চাঁদনী লজ্জা পেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো কিছু বললো না। মিম পুনরায় ফারিহা’কে উদ্দেশ্য করে বললো,

“আপু আমি চলে যাই। ভাল্লাগছে না।”

ফারিহা তার হাত ধরে জোড় করে খাটের উপরে বসিয়ে দিয়ে বললো,

“কই যাচ্ছিস? বোস এখানে।”

মিম চুপচাপ বসে রইলো। মূলত তাকে জোড় করেই এখানে এনেছে ফারিহা। বোনকে এতক্ষণ বুঝিয়েছে সে , সবাই মিলেমিশে থাকতে হবে।
চাঁদনী ও চুপচাপ বসলো তাদের পাশে। পরমুহূর্তেই ফারিহা এক গাল হেসে বললো,

” ভাবী?”

“বলো আপা।”

“ভাইয়া বললো তোমার জন্য নাকি একটা শাড়ী এনেছে সেদিন। চলো না আমরা তিনজন মিলে আজ শাড়ী পড়ে কোথাও ঘুরে আসি।”

চাঁদনী চটজলদি না করে দিলো। ওই শাড়ী সে জীবনেও পড়বে না। যে মানুষটা তাকে পছন্দেই করে না, তার শাড়ী চাঁদনী ক্যান পড়তে যাবে। মন চাইলেও কোনো ভাবেই মন’কে সায় দেওয়া যাবে না।
ফারিহা ও নাছোড় বান্দা। জোড় করে পড়িয়েই ছাড়লো।
তিনজনই একে একে শাড়ী পড়ে নিলো। ভাই তাদের দুই বোনের জন্য ও একই শাড়ী এনেছে।
মাহিম’কে দুই বোন, ভাবী আজ ক্যামেরা ম্যান বানিয়ে ফেলছে। বাধ্য হয়ে তাদের পিছনে পিছনে হাঁটতে হচ্ছে ছবি তোলা’র জন্য।
তিন মেয়ে এক সাথে সারা-বাড়ি ছুটছে, তাদের দুই হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি গুলো রিনঝিন শব্দ তুলে সাড়া বাড়ি মাতিয়ে দিচ্ছে।
তাদের সাথে দাদিও আছে। ফাতেমা খানম রুম থেকে বেরিয়ে দুই মেয়ে’কে দেখে খুশী হলেও চাঁদনী’কে সাথে দেখে বিরক্ত প্রকাশ করে চলে গেলো।
ফারিহা তা বুঝতে দিলো না কথা’র তালে ভুলিয়ে রাখলো।
সারা বিকেল আজ ঘুরেই কাটিয়েছে তারা। সন্ধ্যায় সবার জন্য চা করছিলো চাঁদনী। এখনো শাড়ী পড়েই আছে তিনজনই। চাঁদনী খুলতে চাইলেও ফারিহা, মিম দুই বোনই মানা করছে। তাই আর তাদের অবাধ্য হলো না চাঁদনী।
অল্প সময়ের মধ্যে মিমের সাথেও বেশ ভাব হয়েছে তার।
ফাতেমা খানম বসার ঘরে আছেন, তার সাথে যোগ দিয়েছে পাশের ঘরের দাদি।
চাঁদনী তাদের ও চা দিয়ে গেলো। চাঁদনী’কে এমন সেজেগুজে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো বৃদ্ধ মহিলা। চাঁদনী লক্ষ্য করলো দ্রুত সরে আসতে চাইলো। এই বুঝি কিছু বলবে সেই ভয়ে। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো কই?
এরিমধ্যেই মহিলা পান চিবাতে চিবাতে বললো,

চলবে…..

#তুমি_রঙিন_প্রজাপতি

#writeঃsumaiya_afrin_oishi

#পর্বঃ২০ ( শেষ অংশ)

“এতো সাইজা গুইজা থাইকা লাভ কি? কালা মানষেরে এতো সাজ সজ্জায় মানায় না, বুঝলা? হেইতো আমার নাতনী’ডা ফিরাও তাকায় না তুমার দিকে।”

চাঁদনী থমকালো, অপমানে থমথমে অবস্থা চোখে মুখে। কিন্তু মুখে কিচ্ছুটি বললো না। তার মুখে কোনো “রা” নেই।
কি বলবে সে? জীবনের একটা সময় এসে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় আমাদের। তখন আর কোনো প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করে না। কেননা, একটা সময় এসবে অভস্ত্য হয়ে যায় মানুষ গুলো।
চারপাশে প্রতিনিয়ত এসব হচ্ছে, এমনটা তো হওয়ারই ছিলো।
তখন আর এসব কথা গায়ে মাখে না তারা। তেমনই চাঁদনী’র ও কাউকে কিছু মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে করে না। মনের মাঝে কথা জমানো অথচ কথাগুলো শব্দের অভাবে বের হতে চাইছে না মুখ থেকে।

“মেয়েরা কি শুধু স্বামীর জন্য সাজে দাদি? এদের নিজের জন্য সাজা বাড়ন বুঝি? সে কালো তাই বলে তার জন্য সাজ-সজ্জা নি’ষি’দ্ধ, এমনতো কোনো বিধান নেই তাই না?
এই যে তোমার স্বামী নেই। তাও তো তুমি এই বয়সে এসেও রঙিন কাপড় পড়ে আছো।
এটা কার জন্য পড়েছো বলোতো দাদী?”

চাঁদনী আর দাঁড়ালো না, চলে যাবার জন্য পা-বাড়ালো। অমনি পিছন থেকে গমগমে আওয়াজে এহেন কথা শুনে পিছনে ঘুরে তালালো।
দরজার কাছে ফাহাদ, বুকে হাত বেঁধে দরজায় হেলাল দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবে মাত্র বাসায় এসেছিলো সে, আসতেই দাদীর এমন কথা শুনে চুপ থাকতে পারলো না।
বসার ঘরে’র প্রত্যেকটা মানুষের দৃষ্টি তার দিকে।
মুখের উপরে মোক্ষম জবাব শুনে মুখটা চুপসে যায় দাদির। তবে দমলো না সে।
একদল মানুষ আছে, কথার যুক্তিতে না পারলে অন্য ভাবে অ্যা’টা’ক করে। এদের মূল উদ্দেশ্য হলো, এদের জিততেই হবে!
পরক্ষণেই দাদী মুখ বাঁকিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলো,

“বাহ’রে বউ হুনলা তোমার পোলার কথা?
এই কয়দিনে’র মধ্যে কেমন বউ পাগলা হইয়া গেলো, দেখলা তুমি? কেমন বউয়ের হইয়া সাফাই গায়!
শা*লা বউ পা’গ’লা! ব্যা*ডা হইবার মুরাদ নাই তোর?”

ফাহাদ এতটুকুও রাগলো না বরং মুচকি হাসে বললো,

” সত্যি কথা বললে যদি লোকে বউ পা’গ’লা বলে তবে আমি এসব শুনতে রাজি আছি দাদী। তুমি না হয় আমায় এখন থেকে এমন নতুন নামেই ডাকিও।
এই যুগে এসে বউ পা’গ’লা হতে ও সাহস লাগে। যা সবাই পারে না।”

চাঁদনী বেশ লজ্জা পেলো ফাহাদে’র এমন কথায়। ফাহাদ তার হয়ে কথা বলছে দেখে, মনের বিষাদ ভাবটা সরে গিয়েছে। সে দ্রুত নিজের রুমে চলে গেলো। সবাইকে উপেক্ষা করে পিছনে পিছনে ফাহাদ ও চলে গেলো।
ফারিহা, মিম দুই বোনও বসার ঘরে এসেছিলো। ফাহাদে’র কথা শুনে মিটমিট হাসছে দুই বোন।
দাদী কারো কাছে পাওা না পেয়ে মুখ বাঁকিয়ে চলে যেতে নিলো, তাকে আর একটু জ্ব’লা’তে ফারিহা কানে’র কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

“জানো দাদী? ভাবী’র শাড়ী, চুড়ি এগুলোও কিন্তু ভাই এনে দিয়েছে।”

“সর ছুঁ’ড়ি (মেয়ে) আমারে যাইত দে। তোদের এসব রঙ-ঢঙ দেখলে পি’ওি জ্ব’লে আমার। বে’দ্দ’পের দল কো’ন’হা’ন’কার!”

“এ্যাহ বুড়ি! তাহলে পরে ঘরে সব বিষয়ে নাগ গলাতে আসো ক্যান?” মুখ ভেংচি দিয়ে বললো ফারিহা। ওখানে আর না দাঁড়িয়ে ঠা’স করে দরজা লাগিয়ে ভিতরে চলে আসলো। গ্রামের এমন কু’ট’না মহিলাদের বরাবরই অপছন্দ তার।
.
রুমে এসে চুপচাপ জানালার কার্ণিশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে চাঁদনী। পিছন থেকে ফাহাদ আড় চোখে কয়েক বার দেখে নিলো শাড়ী পরিহিত মেয়েটাকে। বলতেই হয়, শাড়ীতে সত্যিই মেয়েটাকে মা’রা’ত্ম’ক সুন্দর লাগে!
পরাপর বার কয়েক দেখে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো ফাহাদ। অতঃপর কণ্ঠে খানিক গম্ভীরতা টেনে বললো,

” এই মেয়ে? কেউ তোমায় ছোট করার চেষ্টা করছে দেখনো? তাদের কিছু না বলে, তুমি চুপ ছিলে কেনো?”

“চুপ না থাকলে কি আর আপনি আমার হয়ে কথা বলতেন? আমি তো এটাই চাই, যে কোনো পরিস্থিতিতে আপনি সব সময় আমার পাশে থাকুন।” ফাহাদে’র দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো চাঁদনী।

“দেখো মেয়ে, আমি সারাক্ষণ তোমার সঙ্গে থাকি না।
তুমি অন্যের উপর কেনো নির্ভরশীল হবে? প্রত্যেকটা মানুষের উচিত নিজের উপর নির্ভরশীল হওয়া।
যার যার আ’ত্ম’সম্মান তার তার। আর এটা ধরে রাখার দায়িত্বও একান্তই তার।
শোনো মেয়ে কৃষ্ণকলি? কোথাও নিজেকে ছোট হতে দেখলে প্রতিবাদ করবে, চুপ থাকবে না। আল্লাহ তোমাকে মানুষ হিসাবে দুনিয়াতে পাঠিয়েছে। সবাই তোমাকে পছন্দ করবে এমন না। আবার কারও পছন্দ না হলেই সে তোমাকে ছোট করবে, অসম্মান করবে ব্যাপারটা এরকমও না! যার যার পছন্দ রুচিবোধ আলাদা। তাই মানুষ হিসাবে সবার কাছে তোমার গ্রহনযোগ্যতা, মূল্যায়ন আলাদা হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক হলো যখন কেউ তোমাকে ছোট করে, তার পছন্দ না বলে খুঁজে খুঁজে তোমার খুঁত বের করে, কথা এবং ব্যবহারে সে তোমাকে কষ্ট দেয়। সেখানে প্রতিবাদ করবে। একজন মানুষ হিসাবে তোমাকে সম্মান দেওয়াটা কারও দয়া না, এটা তোমার অধিকার!”

চাঁদনী মুগ্ধ হয়ে শুনছে ফাহাদে’র কথা। বারংবার ফাহাদে’র বলা “কৃষ্ণকলি” নামটা কানে বাজছে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো প্রিয় পুরুষটির দিকে। কেন জানি এই মুখটার দিকে তাকালেই শান্তি খুঁজে পায় মেয়েটা।
কিন্তু তার আর শান্তি খুঁজা হলো না বেশিক্ষণ। ফাহাদ তার আগেই জায়গা ত্যাগ করে দাদীর রুমে চলে গেলো। ছেলেটা কেনো জানিয়ে পালিয়ে থাকতে চায় তার থেকে। বুঝলো চাঁদনী, আনমনে হাসলো। ফাহাদে’র যাওয়ার দিকে তাকিয়ে খানিকটা গলা উঁচু করে বললো,

“কতক্ষণ আর পালিয়ে বেড়াবেন আপনি? ভালোতো বাসেনই বলে দিলেই হয়।
আমি কিন্তু এসব বিষয়ে মাইন্ড করবো না একদমই।”

বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো চাঁদনী। ফাহাদ খুব গোপনে সেই হাসির এক ঝলক দেখে নিলো।
তার ওষ্ঠেও খুব সূক্ষ্ণ এক ঝলক হাসি। সেই হাসি বরাবরের মতোই রয়ে গিয়েছে আড়ালে।
এরিমধ্যই চাঁদনী’র মুঠোফোনটা বেজে উঠলো। স্কিনে জ্বলজ্বল করছে “জোছনা আপা” নামটা। তার আপা কল দিয়েছে। যা দেখে চাঁদনী’র হাসিটা দীর্ঘ হলো।
অনেকদিন পরে বোনের সাথে মন খুলে কথা বললো।
.
.
রাতে খেয়ে ফাহাদ আজ আগেই রুমে এসেছে। আজও নিজের জন্য ফ্লোরে বিছনা করছে।
চাঁদনী সবাইকে খাইয়ে, সব কিছু গুছিয়ে মাএ রুমে এসেছে। এসেই ফাহাদ’কে নিচে সুতে দেখে কিঞ্চিৎ রাগ হচ্ছে।
লোকটা এমন কেনো? কি জ্বরটাই না হলো, এখনো কমেনি। তার মধ্যে আবারও বিছনা রেখে নিচে সুইছে।
একে নিয়ে কই যাবে চাঁদনী? কেনো এতো লুকোচুরি লোকটার?
চাঁদনী কোমড় হাত দিয়ে, বিরক্ত কণ্ঠে বললো,

“আজও নিচে সুয়ে পড়লেন। এতো কেয়ারলেস কেনো আপনি বলুন তো? শরীরে এমনিতেই জ্বর আরো ঠান্ডা বাঁধাবেন।”

“আমি ঠিক আছি এখন। কিছু হবে না চিন্তা করো না এতো। তুমি ঘুমাও।”

“বললেই হলো, ঠিক আছেন। একদমই ঠিক নেই আপনি। উপরে সুয়ে পড়ুন প্লিজ! দরকার হলে আমি নিচে ঘুমাবো আজ।”

“না। না। তা কি করে হয়? তুমি বাচ্চা মানুষ, ঠান্ডা লেগে যাবে।”

কিছুসময় দুজনার মাঝে যুক্তি ত’র্কে’র পরে দু’জনই খাটের দুই কর্ণারে সুয়ে পড়লো।
রুমে ডিম লাইট জ্বলছে। হালকা আলোয় সবকিছু স্পষ্ট। ফাহাদ কপালে হাত রেখে সোজা হয়ে সুয়ে আছে। এক জোড়া চোখ সেদিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ হাত সরিয়ে নিলো ফাহাদ। দু’জনার দৃষ্টি বিনিময় হলো।
হঠাৎ করে ফাহাদ বলে উঠলো,

“কি দেখছো এভাবে?”

মোহনীয় কণ্ঠে চট করে উওর দিলো চাঁদনী,

“চোখের গভীরতা।”

“হারিয়ে যাবে তো।”

“ফিরতে চাই না।হারিয়ে গিয়েছি তো সেই কবেই।”

“যদি চোখের অতল গহীনে ডু’বে যাও তখন কি হবে?”

“উঠতে চাই না। ”

ফাহাদ লম্বা শ্বাস টানলো, মিনিট সময় চুপ থাকে আবারও বললো,

“যদি এই চোখের মায়ায় আটকে যাও?”

“আবদ্ধ হয়েই তো থাকতে চাই।”

“মায়ায় পড়ে যাবে তো।”

চাঁদনী দৃষ্টি নত করে, হতাশ কন্ঠে বললো,

পড়তে চেয়েছি তো বহুবার।

“তো হয়েছে কি?”

“সুযোগ দিয়েছেন কি?”

“চেষ্টাও তো করোনি।”

“কোন কমতিও রাখিনি।”

“সফলতো হলে না।”

ফাহাদের কথার উওরে চুপ করে রইলো চাঁদনী, এক পাশ থেকে অন্য পাশে ঘুরে সুয়ে পড়লো।
কিছু একটা ভেবে অভিমান ভরা কণ্ঠে বললো,

“হ্যাঁ এটাই তো আমার ব্যর্থতা!”

দু’জনার কেউ আর কথা বললো না। চুপচাপ দুই দিকে মুখ করে সুয়ে আছে।
একটা সময় চাঁদনী ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু ফাহাদে’র ঘুম হলো না। পাশের মানুষটা অভিমান করে আছে যেনেও এই অভিমান ভা’ঙা’তে পারছে না।
এই যে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছে না। সেই কষ্ট গুলো কুঁড়ে কুঁড়ে রাতের ঘুমটা হারিয়ে গেলো। কষ্ট গুলো বুকের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে, বুক চিরে বেড়িয়ে আসলো আরো একটি দীর্ঘ শ্বাসের গল্প।
রাত বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। ফাহাদ আশপাশ করছে।
অতঃপর রাত গভীর হলেই খসে পড়লো ভালো থাকার মুখোশটা। সবার সাথে সারাদিনের অভিনয় শে’ষে মুখোমুখি হতে হয় নিজেকে সত্যের সামনে।
রাত নামলেই বাড়তে থাকতে উৎকন্ঠা, গভীর হতে থাকে জমিয়ে রাখা আ’ঘাতের তী’ব্রতা। অ’বাধ্য হয়ে ওঠে মন, চোখগুলিও বাঁধা মানে না তখন।
অ’তঃপর নিজের কাছেই প’রাজয় মেনে নিতে হয়
চরম ভাবে। ঠুকরে কেঁ’দে উঠতে হয় একা ঘরের চারদেয়ালে। প্রতিফলিত হতে থাকে ভ’য়াবহ মনখারাপ সারা ঘর জুড়ে। অস্তিত্বরা জাপ্টে ধরে চারপাশ থেকে খুব করে। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়। তখন শুধু মনে হয় এ-রাত বুঝি আর শে’ষ হবার নয়। আহা কি নিদারুণ য’ন্ত্র’ণা!
এভাবেই কেটে গেলো রাতটা।
.
.
দেখতে দেখতে সময় চলে গেলো। ফাহাদে’র ছুটি শেষ। এই জ্বর নিয়েই, প্রিয়জন ছেড়ে আবারো চলে আসতে হলো ঢাকায়, নিজের কর্ম স্হানে।
পরে’র কাজ করলে এমনই হয়। শত অসুস্থতা নিয়েও কাজ করতে হয়। না হয় যে চাকরিটা ও চলে যাবে।
শুরু হলো ব্যস্ততার জীবন।
ফাহাদ আগের ন্যায় অফিস শেষ করে বাসায় এসেছে। মনটা কেনো জানি ছ’ট’ফ’ট করছে ভীষণ। সারাদিন ঠিক ভাবে কাজে মন দিতে পারেনি। না চাইতেও সারাক্ষণ চাঁদনী’র কথা মনে পরে যায়। আসার সময় দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ওই ছলছল চোখের, মায়াবী মুখটা ভেসে উঠে চোখের পাতায়।

শুভ্রও এসেছে রুমে কিছুক্ষণ হলো।
মনে হচ্ছে কতদিন হলো প্রিয় বন্ধু’র সাথে আড্ডা দেওয়া হয়নি। আজ জমিয়ে আড্ডা হবে। তাই আজ অফিস থেকে আগেই ফিরছে।
দু’জনার জন্য দুইটা কফি নিয়ে ফাহাদে’র কাছে চলে আসলো শুভ্র।
কিন্তু আনমনা হয়ে বসে আছে। মনে হচ্ছে রাজ্যের ভাবনায় মশগুল।
শুভ্র ফাহাদে’র কাছাকাছি বসে কনুই দিয়ে গুঁ’তো দিলো। ফাহাদ ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলো কিন্তু কিছু বললো না। শুভ্র এবার খোঁচা দিয়ে বললো,

“কিরে ভাবির কথা ভাবছিস নাকি?”

ফাহাদ মুচকি হাসলো। শুভ্র বিস্মিত হলো! সে ভেবেছে নিশ্চয়ই ফাহাদ আগের মতো রেগে যাবে। কিন্তু না, তাকে অবাক করে গম্ভীর ছেলেটা হাসছে। মনে মনে শান্তি পেলো শুভ্র। কিন্তু, বন্ধুর সাথে তো একটু মজা করাই যায়। হাসি-হাসি কণ্ঠে বললো,

“ফাহু চাচ্চু ডাক নিশ্চয়ই খুব শীগ্রই শুনতে যাচ্ছি আমি। মিষ্টি খাওয়া শা’লা।”

ফাহাদ চোখ গরম করে তাকালো। তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, এটা সেটা বলেই যাচ্ছে সে। আবারো সিরিয়াস ভঙ্গিতে হঠাৎ প্রশ্ন করলো শুভ্র,

“ভাবীর প্রেমে পড়লি নাকি ফাহাদ? তোর ভাব-ভঙ্গি তাই বলে দিচ্ছে? ”

“জানি না আমি। তবে তার কথা ভাবাচ্ছে আমাকে।” স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো ফরহাদ।

“আচ্ছা এটা বল। মেয়েটা তোকে ভালোবাসে?”

“সে আসে,মায়া করে ভালোবাসি আর ভালোবাসা দিয়ে, ছুঁয়ে যায় গভীর ভাবে হৃদয়।
আমারও মায়া হয়,
তবুও ভালোবাসি না বলে ফিরিয়ে দেই
রু’ক্ষ’ভা’ষী সাজি এক মুহূর্তেও হইনা সদয়।
সে আসে,
করুন কন্ঠে বলে আমি ভালোবাসায় ডুবন্ত
তুমিহীন তোমায় ছাড়া থাকা যায় না সুখে।
আমি আবেগী হয়ে উঠেও নিজেকে সামলে রাখি,
শুধু বলে দেই এই যে_
আমাকে পেয়েছে কোনো এক নাম না জানা অসুখে!
যে অসুখে ভুগছি আমি
লিখতে চেয়েছিলাম তাকে নিয়েই,
লিখতে লিখতে হঠাৎ খেয়াল করলাম
ভুল করে লিখে ফেলেছি কিছু কথা অজান্তেই তার নামে।
অতঃপর বেহায়া অনুভূতিগুলো
এসে ভালো করে বুঝিয়ে দিলো এই যে_
আমাকে পেয়েছে গভীর ভাবে সে নামক বি’ষা’ক্ত অসুখে!

#চলেবে…..

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ! ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে