তুমি এলে তাই পর্ব-৩২

0
2470

#তুমি এলে তাই ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৩২
.
গুঞ্জন খাটে বসে পা দোলাচ্ছে আর ভাবছে যে পরবর্তীতে কী করা যায়। মেঘলা ওর পাশে বসে আগামী প্রজেক্টের ডিটেইলস গুলো ঠিক করছে ল্যাপটপে। নিজের কাজটা শেষ করে ল্যাপটপ অফ করে গুঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” কীরে তখন থেকে কী ভাবছিস?”

গুঞ্জন ভাবতে ভাবতেই বলল,

— ” কালক‍ে তোমাদের অফিসে ইম্পর্টেন্ট কোনো কাজ আছে?”

মেঘলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

— ” নাহ নেই। কেনো?”

গুঞ্জন দাঁত করমর করে বলল,

— ” ভাবছি যে ঐ চৌধুরীকে কীকরে শায়েস্তা করতে পারি। বেশি বেড়েছে!”

মেঘলা অবাক হয়ে বলল,

— ” বেশি বেড়েছে মানে?”

গুঞ্জন মুখ ফুলিয়ে রেখে বলল,

— ” দেখো বলছে ভালোবাসে অথচ বিয়ে করবে না। কেনো? আমি ওরকম কান্ড ঘটিয়েছি তাই। আরে কতোবার সরি বলেছি? আমি কী পাগল দ্বিতীয়বার এই ভুল করবো?”

মেঘলা ঘুরে খাটে হেলান দিয়ে বসে বলল,

— ” হুমম। আর কী করেছে?”

গুঞ্জন ও ঘুরে মেঘলার পাশে গিয়ে শুয়ে বলল,

— ” সরি এক্সেপ্ট করলো কিন্তু আমাকে না। কেকটা কেটে আমাকে খাইয়ে পর্যন্ত দিলো, পাস্তা খাইয়ে দিলো। কিন্তু কী বলল? এগুলো নাকি ফর্মালিটিস। তুমিই বলো এটা কোন ধরণের ফর্মালিটিস? ইনফ্যাক্ট আসার সময় আমার কপালে কিস করে হা…”

এটুকু বলে গুঞ্জনের গলা আটকে গেলো। মেঘলা ভ্রু কুচকে বলল,

— ” কীরে? থামলি কেনো?”

গুঞ্জন চোখের ইশারায় দরজার দিকে দেখাতেই মেঘলা ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দরজায় তাকাতেই দেখে আবির দাঁড়িয়ে আছে। মেঘলা আর গুঞ্জন দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে একটা মেকি হাসি দিয়ে আবিরের দিকে তাকালো। আবির ও উত্তরে একটা মেকি হাসি দিয়ে এগিয়ে এসে হাত ভাজ করে ভ্রু নাচিয়ে বলল,

— ” কী বিষয়ে কথা হচ্ছিলো?”

মেঘলা জোরপূর্বক একটু হেসে বলল,

— ” কথা? কী আর কথা হবে? ঐ তো স্পন্দন গুঞ্জনকে কিস…”

গুঞ্জন থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে বলল,

— ” কিসমিস। হ্যাঁ কিসমিস দেওয়া পায়েস খাওয়াবে বলেছে।”

মেঘলা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলল,

— ” হ্যাঁ?”

গুঞ্জন চোখ রাঙাতেই ব্যপারটা বুঝতে পেরে ইতস্তত করে বলল,

— ” হ্যাঁ। হ্যাঁ, ওই বলল পায়েস দেওয়া কিসমিস ওটাই।”

গুঞ্জন একটা চিমটি কেটে মুখে হাসি রেখেই দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

— ” পায়েস দেওয়া কিসমিস না। কিসমিস দেওয়া পায়েস।”

তারপরে আবিরের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টাটা জারি রেখে বলল,

— ” আসলে টাং অফ স্লিপ, ধ্যাত্তেরি! মানে স্লিপ অফ টাং হয়ে গেছে।”

আবির ভ্রু কুচকে দুই বোনের উদ্ভট সব কথা বার্তা শুনছিলো। এবার একটু গলা ঝেড়ে বলল,

— ” স্পন্দন তোকে পায়েস দেওয়া কিসমিস মানে কিসমিস দেওয়া পায়েস কেনো খাওয়াবে?”

গুঞ্জন এবার পরলো মহা জ্বালায়। কারণ এবার কী বলবে? ইতস্তত করে বলল,

— ” আসলে.. অবব..”

এটুকু বলে গুঞ্জন মেঘলার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলল,

— ” কেনো জেনো খাওয়াবে?”

মেঘলা সাথে সাথেই বলল,

— ” হ্যাঁ ওইযে…”

এটুকু বলে নিজের বেকুব হয়ে গেলো কিছুই তো জানেনা বলবে তাই গুঞ্জনের দিকে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,

— ” কেনো জেনো?”

আবির এবার হালকা শব্দ করে হেসে দিলো। ওদের কথায় না হাসার কোনো উপায়ই আছে? গুঞ্জন আর মেঘলা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। আবির হাসি থামিয়ে ওদের সামনে বসে বলল,

— ” দেখ। আমি তোদের বড় ভাই। তাই আমার কাছে সব রকমের কথা বলাটা শোভনীয় নয় আমি সেটা জানি। কিন্তু আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ আমি জানি আমার বোনেরা ভুল কিছু করবেনা।”

এটুকু বলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

— ” এবার চলুন? ডিনার করতে হবে তো? পরে না হয় এসব আলাপ হবে।”

ওরা মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালো। পরে তিনজনই গেলো ডিনার করতে।

______________________

স্পন্দন নিজের কেবিনে বসে কাজ করছে হঠাৎ করেই কোথা থেকে গুঞ্জন এসে কেবিনে হাজির হলো। বরাবরের মতোই উইথআউট কোনো পারমিশন ঢুকে পরল। স্পন্দনও কিছু বলল না জানে একে বলে কোনো লাভ হবে না। একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে দিলো। গুঞ্জন আজ আর লং ড্রেস পরে নি। সেই আগের ফর্মে ব্যাক করেছে। লং শার্ট আর জিন্স। স্পন্দন কাজ করতে করতে বিড়বিড় করে বলল,

— ” এইতো ঝাঁসির রাণী আবার নিজের ফর্মে ব্যাক করেছে।”

গুঞ্জন হেলদুলে আসতে আসতে বলল,

— ” হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ভালো আছি। সকালে ব্রেকফাস্ট করেই বেড়িয়েছি না খেয়ে বেড় হই নি। আপনি?”

স্পন্দন ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,

— ” কী সব আবল তাবল বোকছো? ”

গুঞ্জন অবাক হওয়ার ভান করে বলল,

— ” কী আবার? তুমিতো জিজ্ঞেস করলেন কেমন আছি? খেয়ে এসছি কী না? তারই তো উত্তর দিলাম। স্পন্দন দাঁত করমর করে বলল,

— ” হোয়াট দা হেল। আমি এমন কোনো কিছু জিজ্ঞেস করিনি।”

গুঞ্জন একটু ভাবার ভান করে তারপর স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” করো নি না? ওওও তাহলে আমিই ভুল শুনেছি আসলে তুমি বিড়বিড় করে বলছিলে তো। কোনো ব্যাপার না এগুলোই তো জিজ্ঞেস করতে তাই আগেই বলে দিলাম। হাউ ট্যালেন্টেড আই এম?”

স্পন্দন একটা হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে কাজে মন দিলো। গুঞ্জন একটু বিরক্ত হলো তাই উঠে গিয়ে স্পন্দনের ল্যাপটপটা বন্ধ করে দিলো। স্পন্দন বিরক্ত হয়ে বলল,

— ” এটা কী হলো?”

গুঞ্জন এবার সোজা স্পন্দনের কোলে বসে পরলো। স্পন্দনতো আহম্মকের মতো তাকিয়ে রইলো গুঞ্জনের দিকে। গুঞ্জন স্পন্দনের চুল নাড়তে নাড়তে বলল,

— ” চুলে কী দাও বলোতো? এতো সিল্কি, সোজা সোজা, স্মুথ।”

স্পন্দন চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে গুঞ্জনের দিকে। স্পন্দনের দিকে তাকাতেই গুঞ্জন একটু হকচকিয়ে গিয়ে বলল,

— ” না মানে আমিও দিতাম আরকি। দেখোনা আমার চুল স্মুথ হলেও কেমন একটু একটু কার্লি তাইনা? সেইজন্যে।”

স্পন্দন বিরক্ত হয়ে বলল,

— ” আমার কোল থেকে উঠবে?”

গুঞ্জন ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে স্পন্দনের নাড়তে নাড়তে বলল,

— ” তোমার কথায় বসেছি নাকি যে তোমার কথায় উঠবো?”

স্পন্দন চোখ বন্ধ একটা শ্বাস নিয়ে বলল,

— ” কোলটা আমার নিজের।”

গুঞ্জন চিন্তা করার ভান করে বলল,

— ” কই নাম লেখা নেই তো?”

স্পন্দন এবার গুঞ্জনকে কোলা করে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো তারপর কোলে করেই দরজার বাইরে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দরজা বাইরে থেকে লক করে দিয়ে বলল,

— ” এখানে থেকে আর লাভ নেই। আমি এখন বাইরে যাচ্ছি লাঞ্চ টাইমের অনেক পরে আসবো। সো বাড়ি চলে যাও।”

গুঞ্জন বিরক্ত হয়ে বলল,

— ” কেনো যাবে?”

স্পন্দন একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,

— ” তোমার জানা দরকার নেই। বাই।”

গুঞ্জন মুখ ফুলিয়ে বলল,

— ” হুহ।”

বলে মেঘলার কেবিনের দিকে হনহনিয়ে চলে গেলো। স্পন্দন ও ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা শ্বাস ফেলে নিজের কাজে গেলো।

_____________________

স্পন্দনের কেবিনে গুঞ্জন, রেহান,মেঘলা, সারা চারজনে কোকাকোলা আর চিপস খেতে খেতে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। স্পন্দন বলেছিল লাঞ্চ টাইমের অনেক পরে আসবে তাই কারো কোনো চাপ নেই। সারাকেও তাই কল করে ডেকে নিয়েছে। সবাই আরাম করে অাড্ডা দিচ্ছি। গুঞ্জন নিজের করা কাহিনী গুলো বলছে আর ওরা সবাই হাসছে আর এনজয় করছে ঘটনাগুলো। ওরা ওদের কথায় এতোই মসগুল যে আশেপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে কোনো খেয়াল নেই। গুঞ্জন চিপস চিবোতে চিবোতে বলল,

— ” কালকের প্লানটা জোস ছিলো।”

রেহান একটু চিন্তিত মুখ করে বলল,

— ” বাই দা ওয়ে গুটি তুই কী এমন বলেছিস বলতো ক্লাইন্টদের যে ওরা এক ঘন্টা লেইট করে আসতে রাজি হয়ে গেলো?”

গুঞ্জন কলার সেট করে হেসে বলল,

— ” এটাই তো আমার স্পেশালিটি।”

মেঘলা বিরক্ত হয়ে বলল,

— ” ‘এটাই তো আমার স্পেশালিটি।’ ঢং না করে বলবি?”

সারাও এক্সাইটেড হয়ে বলল,

— ” হ্যাঁ হ্যাঁ বলোনা?”

গুঞ্জন একটা টেডি স্মাইল দিয়ে বলল,

— ” বেশি কিছু না। জাস্ট ফোন করে ওনাদের বলেছি যে আমি স্পন্দন চৌধুরীর ওয়াইফ। আমার হাজবেন্ট সারাদিন কাজ নিয়ে বিজি থাকে আমাকে একটুও সময় দেয় না। এই নিয়ে আমাদের ঝগড়া হয়েছে। তাই আমি ওনার মান ভাঙাতে একটা সারপ্রাইজ এরেঞ্জ করতে চাই। কিন্তু উনি আমার ওপর রেগে আছেন তাই কোথাও যাবেই না আমার সাথে। তাই আপনারা যদি আগে একটু না জানিয়ে লাস্ট মুমেন্টে এক ঘন্টা লেট করে মিটিং জয়েন করেন তাহলে একটু সুবিধা হয়। ব্যাস ওনাদের কাজ ছিলোনা তাই মেনে নিলো। যতোই হোক স্পন্দন চৌধুরীর বউ তো।”

সবাই জোরে জোরে হেসে দিলো। কিন্তু হাসতে হাসতে হঠাৎই সবার হাসি অফ হয়ে গেলো শুধু গুঞ্জন বাদে গুঞ্জন এখনো হাসছে। সবার হাসি থামাতে দেখে গুঞ্জন ভ্রু হাসতে হাসতে বলল,

— ” তোমাদের কী হলো?”

সবাই দরজার দিকে তাকিয়ে একসাথে বলে উঠল,

— ” গেয়ে কাম সে।”

গুঞ্জন ভ্রু কুচকে পেছনে তাকাতেই চমকে গিয়ে চেয়ার থেকে পড়তে নিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। স্পন্দন হাত ভাজ করে চোখ ছোট ছোট করে দরজার সাথে হেলাম দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্পন্দন এসে বলল,

— ” বাহ বাহ। এখানে তো সেলিব্রেশন হচ্ছে।”

রেহান উঠে দাঁড়িয়ে তোতলানো গলায় বলল,

— ” ত্ তুই কখন এলি? তোরনা আরো পরে আসার কথা?”

স্পন্দন চারপাশে দেখতে দেখতে বলল,

— ” আর তাই তোরা পার্টি করছিলি?”

সারা একটু জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলল,

— ” ইয়ে হয়েছে কী ভাইয়া.. কী জেনো হয়েছে?”

স্পন্দন সারার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গুঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” সবাই বাইরে যাও।”

সবাই হাদার মতো দাঁড়িয়ে আছে। সেটা দেখে স্পন্দন ভ্রু কুচকে বলল,

— ” আমি কী চাইনিজ এ বলেছি?”

সবাই থতমত খেয়ে হুড়মুড় করে বেড়িয়ে গেলো। গুঞ্জনও কেটে পরতে নিলে স্পন্দন হাত ধরে বলল,

— ” আরে ম্যাডাম আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আপনি চলে গেলে হবে?”

এটুকু বলে স্পন্দন গিয়ে দরজাটা লক করে দিলো। গুঞ্জন তো একটু একটু ভয় পাচ্ছে। কী করবে ওর সাথে অাল্লাহ জানে। স্পন্দন এগোচ্ছে আর গুঞ্জন পেছাচ্ছে। স্পন্দন এগোতে এগোতে বলল,

— ” তুমি কাল আমার ক্লাইন্টদের কল করে ওসব বলেছো। আর সেইজন্যেই ওনারা ওভাবে মিটমিটিয়ে হাসছিলো। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পায়নি। তুমি করেছো এসব?”

গুঞ্জন পেছাতে পেছাতে তুতলিয়ে বলল,

— ” হ্যাঁ তো?”

বলে দেয়ালে লেগে গেলো। স্পন্দন এবার একটা ডেভিল স্মাইল দিয়ে দেয়ালে হাত রেখে ঝুকে বলল,

— ” নাথিং। বাট যেহেতু তুমি আমার বউ। তো বর বউ বন্ধ কোনো রুমে থাকলে কী করে সেটা নিশ্চয়ই জানো। ”

এটুকু বলে মুখটা একটু এগোতেই গুঞ্জন বলল,

— ” জানিতো! কাছাকাছি আছে। এরচেয়েও বেশি কাছে। আসুন?”

স্পন্দন এবার একটু হকচকিয়ে গেলো। গুঞ্জন নিজেই একটু এগিয়ে এসে বলল,

— ” ঠিক এভাবে।”

স্পন্দন একটু পিছিয়ে গেলো। গুঞ্জন এগোতে এগোতে বলল,

— ” কী হলো পিছিয়ে যাচ্ছেন কেনো? আসুন?”

গুঞ্জন এগোচ্ছে আর স্পন্দন পেছাচ্ছে। স্পন্দন ওর চেয়ারে আটকে চেয়ালে বসে পরলো। গুঞ্জন চেয়ারের দুপাশে হাত রেখে মুচকি হেসে স্পন্দনের দিকে ঝুকতে শুরু করলো স্পন্দন মাথা পেছাতে পেছাতে চেয়ারে সাথে লাগিয়ে ফেলেছে আর জায়গা নেই। ও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে গুঞ্জনের দিকে। ও তো গুঞ্জনকে অস্বস্তিতে ফেলতে চেয়েছিলো কিন্তু গুঞ্জন যে কেসটা ঘুরিয়ে দেবে সেটা কে জানতো?

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে