তুমি আমার স্নিগ্ধ ফুল পর্ব-১৭+১৮

0
320

#তুমি_আমার_স্নিগ্ধ_ফুল
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর
#পর্বঃ১৭

ইয়ানা গুটিশুটি হয়ে বেডে বসে আছে এক রাশ অস্বস্তি নিয়ে। দু হাত কচলাতে লাগলো অসস্তিতে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে বারবার জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছে। তখন হুট তখন ইমা পারফিকে নিয়ে রুমে এসে দিয়ে গেলো। হঠাৎ করে পারফিকে এমন আশা করে নি। বুকের ভিতর ধুকপুক ধুকপুক করতে লাগলো সেই থেকে এখন পর্যন্ত ধুকপুকনি করেই চলেছে। একরাশ অস্বস্তি নিয়ে স্টাচু হয়ে বসে আছে। অস্বস্তি আরো কয়েক গুন বাড়িয়ে দিচ্ছে পারফির ধারালো চাওনি। কোনো কথা না বলে চুপচাপ ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

এদিকে পারফি শুক্ষ ভাবে ইয়ানাকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। ড্রেসিংটেবিলের সাথে হেলান দিয়ে ইয়ানার কার্যকলাপ দেখতে লাগলো। তখন রুমে প্রবেশ করে বিড়াল ছানার এই লুক দেখে থমকে গিয়েছিলো পারফি। মেরুন রঙের সিম্পল একটা শাড়ি পরিহিত সিম্পল সাজে ইয়ানাকে দেখে হার্টবিট মিস করে ফেললো। চোখ সরানো দায় হয়ে পড়েছিলো। আজ থেকে এই বিড়াল ছানা একান্ত ওর ভাবতেই একরাশ ভালোলাগায় ছেয়ে গেলো মন। তখন মাথায় দুষ্টবুদ্ধি চাপলো, ইয়ানাকে একটু লজ্জায় ফালানো ছিলো মেইন উদ্দেশ্য। কেনো যেনো বিড়াল ছানার লজ্জমাখা মুখশ্রী দেখার তীব্র ইচ্ছে জাগলো মনে তাই তখন থেকে কোনো কথা না বলে ইয়ানার দিকে তাকিয়ে রইলো এতে ইয়ানা লজ্জায় মাথা নুইয়ে এভাবে হাসফাস করে চলেছে। তা দেখে পারফি ঠোঁট কামড়ে হাসলো।
বিড়াল ছানাকে আর অস্বস্তিতে ফালাতে চাইলো না তাই গলা পরিস্কার করে কোমল স্বরে ডাকলো…. ইয়ানা।

ইয়ানা চমকে পারফির দিকে তাকালো। এই প্রথম পারফির মুখে নিজের নাম শুনলো। এই প্রথম নিজের নাম পারফির মুখে শুনে বুকের ভিতর ধক করে উঠলো। চমকে পারফির দিকে তাকিয়ে রইলো।

তা দেখে পারফি ফের ঠোঁট কামড়ে হেসে বললো কিছু কথা বলার ছিলো অনুমতি দিলে বলতে পারি।

ইয়ানা নিজেকে সামলে আস্তে করে বললো হ…হুম বলুন।

পারফি এবার কিছুটা সিরিয়াস হয়ে ইয়ানার উদ্দেশ্যে বললো এই বিয়েতে তুৃমি রাজি তো?

এ কথার উত্তরে ইয়ানা কি বলবে খুঁজে পেলো না। এর উত্তর যে ওর নিজেরও জানা নেই। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো আসলেই কি আমি এ বিয়েতে রাজি? কিন্তু কোনো উত্তর খুঁজে পেলো না নিজের ভিতর। কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে ইয়ানা মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলো।

পারফি কিছুক্ষণ ইয়ানার দিকে তাকিয়ে থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে বললো নীরবতা কি তাহলে সম্মতির লক্ষণ হিসেবে ধরে নিবো মিস বিড়াল ছানা?

ইয়ানা কি বলবে কি করবে কিছুই বুঝতে পারলো না। মনের ভিতর কেমন এক জড়তা কাজ করছে। মন কি চাচ্ছে তা ওর নিজেরও জানা নেই।

পারফি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো ওঁকে আমার উত্তর আমি পেয়ে গেছি চলো তাহলে এ বলে ইয়ানার হাত ধরে ওকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো।

ইয়ানা কেঁপে উঠলো পারফির স্পর্শে। এই প্রথম পারফির স্পর্শে অন্য কিছু অনুভব করলো। বুকের ভিতর ধুকপুকানি বেড়ে গেলো কয়েক গুণ। কাঁপা কাঁপা পায়ে পারফির সাথে হেঁটে চলেছে।

পারফি ড্রয়িংরুমের কাছে এসে ইয়ানার হাত ছেড়ে দিয়ে ঠোঁট কামড়ে হেসে চলে গেলো।

ইয়ানা ধীরপায়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতে ইমা এসে ইয়ানাকে ধরে নিয়ে পারফির পাশে বসিয়ে দিলো। বুকের ভিতর ধুকপুকনি বেড়েই চলেছে। এ কেমন অনুভূতির সাথে পরিচয় হচ্ছে ইয়ানার জানা নেই।

অবশেষে সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সুষ্ঠু ভাবে দুজের বিয়ে সম্পূর্ণ হয়ে গেলো। আবদ্ধ হয়ে গেলো দুজন এক পবিত্র বন্ধনে।

তৃপ্তির হাসি হাসলো পারফি। অবশেষে স্নিগ্ধ ফুলকে নিজের করে পেয়ে গেলো। এই নিস্পাপ মায়াবী মেয়েটাকে পারফি ভালোবাসে কিনা জানা নেই কিন্তু এই ফুলের আশপাশে থাকলে বুকের ভিতর এক শান্তি অনুভব করে। ইচ্ছে হয় স্নিগ্ধ ফুলকে সব সময় বুকের মাঝে আগলে রেখে সব কষ্ট দূর করে দিতে।
————————————-
অবশেষে বিদায়ের সময় হয়ে আসলো। ধীরে ধীরে বুক ভারী হয়ে উঠছে ইয়ানার। কষ্ট হচ্ছে, খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে ভিতরে ভিতরে।

ইয়ানা ধীর পায়ে হেঁটে ইতি বেগমের রুমে প্রবেশ করলো। দেখলো ইতি বেগম খাটের সাথে হেলান দিয়ে চোখের উপর হাত দিয়ে নীরবে বসে আছে।

ইয়ানা ধীরপায়ে বেডের কাছে এগিয়ে গিয়ে আস্তে করে ডাক দিলো… মা….

মা ডাকটা শুনে ইতি বেগমের বুকের ভিতর ধক করে উঠলো। চমকে তাকালো সামনে, সামনে তাকাতে শাড়ি পরিহিত ইয়ানার বিষাদী মুখটা ভেসে উঠলো। কিছু না বলে নিশ্চুপে তাকিয়ে রইলো ওই মায়াবী মুখশ্রীর দিকে।

ইয়ানা নিঃশব্দে ইতি বেগমের পাশে বসে ভেজা গলায় বললো চলে যাচ্ছি মা দূরে, এখন আর তোমার বিরক্ত হওয়ার কারণ মেয়েটা তোমার কাছে থাকবে না। তুমি খুশি তো মা? বলতে বলতে কন্ঠ কেঁপে উঠলো ইয়ানার।

চোখের পানি আটকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো কিন্তু ব্যর্থ হলো আটকাতে। কান্না ভেজা কন্ঠে ফের বললো তুমি ভালো থেকে মা,, পারলে তোমার এই মেয়েটাকে ক্ষমা করে দিয়ো। তোমাকে মুক্ত করে দিয়ে বহুদূরে চলে যাচ্ছি। সবশেষে বলবো তোমার এই মেয়েটা তোমাকে খুব ভালোবাসে মা বলতে বলতে উঠে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি গড়িয়ে পড়তে লগলো। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে, এই কষ্ট যে সহ্য করার মতো না।

ইয়ানার যাওয়ার পানে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে রইলো ইতি বেগম। চাইলেও পারলো না মেয়েকে আঁটকে একটাবার বুকে আগলে নিতে। অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে ভিতর টা। ইচ্ছে করছে ছুটে যেয়ে মেয়েটাকে একটা বার বুকে আগলে নিতে। কিন্তু কোন মুখে যাবে? এতো বছর যেই অন্যায় করে এসেছে তা যে ক্ষমার অযোগ্য। বুকের ভিতর যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলো ইতি বেগম।
কথায় আছে না হারিয়ে গেলে সেই জিনিস এর মূল্য মানুষ বুঝতে পারে। আজ তার সেই অবস্থা হলো। এতো বছর ইয়ানাকে দেওয়া অবহেলা আজ চোখের সামনে ভেসে আসছে। অপরাধবোধে কুঁকড়ে যাচ্ছে।

এদিকে ইয়ানা অঝোরে কান্না করেই যাচ্ছে ইমাকে আর ইসহাক আহমেদকে ধরে। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে এই দুইটা মানুষকে ছেড়ে যেতে। ইমাও কান্না করছে ইয়ানার সাথে, খুব আদরের বোনটাকে আজ অন্যের ঘরে চলে যেতে ভাবতেই কষ্ট লাগছে।

ইসহাক আহমেদের চোখেও পানি। এক মেয়ে অন্যের ঘরে চলে গেছে এক বছর হয়েছে এখন আরেকটা মেয়েকেও অন্যের ঘরে চলে যেতে হবে। কি করে থাকবে উনি এখন? মেয়েদের যে বড্ড বেশি ভালোবাসেন। ভিতরে ভিতরে দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে কিন্তু এখন ভেঙে পড়লে হবে না তাই নিজেকে শক্ত করে ইয়ানাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে বসালো। তারপর একে একে সবাই বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠতে লাগলো তখন পারফি ইসহাক আহমেদের কাছে এসে হাতে হাত রেখে বললো কষ্ট পাবেন না আঙ্কেল। আমি আমার সবটা দিয়ে ওকে আগলে রাখবো সবসময়। আপনি একজন বাবা নিজের মেয়েকে সবমসময় ভালোবেসে আগলে রেখেছেন। আপনার মতো পারবো কিনা জানিনা কিন্তু আমার দিক থেকে আমি সবসময় চেষ্টা করবো ওকে আগলে রাখার।

ইসহাক আহমেদ পারফিকে জড়িয়ে ধরে বললো ভরসা করি তোমাকে বাবা তাই তোমার হাতে আমার মেয়েটাকে নিঃসঙ্কোচে তুলে দিলাম। আমার মেয়েটা বড্ড সহজসরল, ওর দিকে খেয়াল রেখো বাবা।

পারফি অভয় দিয়ে বললো ইন শা আল্লাহ রাখবো আঙ্কেল। নিজের দিকে খেয়াল রাখবেন, যখন ইয়ানাকে দেখতে ইচ্ছে হবে আমাকে নিজের ছেলে ভেবে একটাবার ফোন করে বলবেন আমি ওকে নিয়ে আসবো।

ইসহাক আহমেদ সন্তুষ্ট হলো পারফির কথায়। মেয়েকে যে সঠিক কারো হাতে তুলে দিতে পেয়েছেন ভাবতেই বুকটা শান্তিতে ভরে উঠছে। তিনি একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে পারফির সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে সবাইকে বিদায় দিলো।

পারফি গাড়িতে উঠতে শাফিন গাড়ি স্টার্ট দিলো। শাফিনের পাশে পারফি বসা চুপচাপ। ইয়ানা এখনো কান্না করছে আর পাশে বসে প্রীতি ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। ইয়ানার চোখে পানি দেখে পারফির মনটাও ভারী হয়ে আছে। স্নিগ্ধ ফুলের কষ্টে যেনো নিজেও সমান পরিমাণ কষ্ট পাচ্ছে।

পারফিকে এমন চুপচাপ বসে থাকতে দেখে শাফিন বললো ধুর শালা বিয়ে করতে এসেছিস নাকি নীরবতা পালন করতে এসেছিস? তোরতো এখন খুশিতে নাচার কথা।

পারফি শাফিনের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো তোর এতো শখ জাগলে তুই নাচ।

নাচবো মানে আমার বিয়ের সময় পুরো এলাকা ঘুরে নাচবো আমি দেখে নিস। কবে যে একটা বউ পাবো আর কবে যে একটু এলাকে জুড়ে নাচবো।

পারফি খোঁচা মেরে বললো তোর মতো বাঁচালের কাছে মেয়ে দিবে কে? সারাজীবন বিয়ের স্বপ্ন এই দেখে যেতে পারবি মেয়ে আর পাবি না।

ইনসাল্ট করলি আপনাকে? তুই জানিস আমার জন্য কতো মেয়ে পাগল? এই শাফিন শিকদারের জন্য মেয়েরা লাইন লেগে থাকে আর তুই বলছিস আমি মেয়ে পাবো না। তোরে আমি অভিশাপ দিলাম জীবনেও বউ পাবি না।

পারফি শাফিনের মাথায় চাপর মেরে বললো তোর অভিশাপ তোর গায়েই লাগে নাকি তা দেখ। আমার বউ অলরেডি পিছে বসে আছে।

শাফিন দাঁত দিয়ে জিভ কেটে বললো ওহ তুই বউ পেয়েই গেছিস তাতো ভুলেই গেছি।
—————————
এলিজা জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি করছে আর কান্না করে যাচ্ছে। এনামুল খান মেয়েকে সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছে এলিজাকে।

এলিজা চিৎকার করে বললো এতো কিছু করার পর ও পারফি ওই মেয়েটাকে বিয়ে করেছে পাপা। এটা আমি মেনে নিতে পারছি না, আমার পারফিকে চাই এই চাই এ বলে আবার জিনিসপত্র ভাঙা শুরু করে দিলো।

এনামুল খান ও বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। সব কিছুতো ওনার প্লান মতোই হচ্ছিলো তাহলে শেষে এসে এভাবে প্লান এর মোর অন্যদিকে ঘুরে গেলো কোনো।
প্লান করে সেদিন রাতে পারফিদের উপরে এনামুল হক এই অ্যাটাক করিয়েছিলো। উদ্দেশ্য অন্য কিছু থাকলেও পারফি চালাকি করে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। তারপর অন্য প্লান করে মিডিয়াকে টাকা খাইয়ে উস্কে উনি এই দিয়েছিলো যাতে ওদের নাম এ মিথ্যে কথা ছড়ায়। ভেবেছিলো এতে তাদের মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে তাদের দুর্বল করে দিতে পারবে কিন্তু তার এই প্লান ও সাকসেস হলো না। ক্ষমতার জোর দিয়ে মিডিয়ার মুখ ও বন্ধ করে দিয়েছে। শেষে কিনা ওই মেয়েটাকেও বিয়ে করেছে এখন নিজের মেয়েকে কিভাবে সামলাবে তাই বুঝে উঠতে পারছে না।

এনামুল খান এলিজাকে থামানোর জন্য বললো শান্ত হও মামনী বিয়ে করেছে তাতে কি হয়েছে ওই মেয়েকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিলেই তো সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি শান্ত হও আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলবো৷

এনামুল খানের কথায় এলিজা কিছুটা শান্ত হলো। যেভাবেই হোক পারফিকে ওর চাই এই চাই এতে যদি ইয়ানাকে রাস্তা থেকে সরাতে হয় তাহলে তাই করবে।

#চলবে?

#তুমি_আমার_স্নিগ্ধ_ফুল
#নুসাইবা_ইসলাম_হুর
#পর্বঃ১৮

পারফির রুমে একরাশ অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে ইয়ানা। একটু আগেই প্রীতি এসে ইয়ানাকে পারফির রুমে দিয়ে গেলো।
ইয়ানার কেমন নার্ভাস লাগছে মাত্র কয় মাস এর পরিচয় পারফির সাথে। এই কয় মাসে পারফিকে যতোটা চিনেছে তাতে মনে হয়নি লোকটা খারাপ উল্টো সব সময় তার ব্যবহার এই বুঝিয়ে দিয়েছে সে কতোটা ভালো মনের একজন মানুষ তবুও ইয়ানা আজ খুব নার্ভাস। ভয় লাগছে যদি অধিকার চায় তখন কি করবে? সব কিছু স্বাভাবিক করার জন্য একটু সময় প্রয়োজন সেই সমটা কি দিবে না?

এসব ভাবনা চিন্তার মধ্যে চোখ জোড়া লেগে আসছে। কয়টা দিন থেকে শরীর এর উপর দিয়ে কতো ধকল যাচ্ছে। শরীর দুর্বলতার জন্য প্রচুর ঘুম পাচ্ছে ইয়ানা আর কিছু না ভেবে বেডে শরীর এলিয়ে দিলো। চোখে এসে রাজ্যের ঘুম হানা দিলো। কিছুক্ষণের মাঝে ঘুমের দেশে পারি জমালো।

সবাই অনেক টায়ার্ড রাত প্রায় ১ টার মতো বেজে গেছে তাই সবাই রেস্ট নিতে নিজেদের রুমে চলে গেলো। পারফি যেই রুমে ঢুকতে যাবে অমনি দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো প্রীতি আর শাফিন।

হাঠাৎ ওদের এমন দরজা আকরে দাঁড়াতে দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো কি চাই?

প্রীতি বললো টাকা চাই টাকা।

পারফির কুঁচকে যাওয়া ভ্রু আরো কুঁচকে বললো কিসের টাকা?

শাফিন বললো কিসের টাকা মানে? বউয়ের কাছে যেতে হলে টাকা দিয়ে তারপর যাওয়া লাগবে।

এবার পারফি বুঝলো এদের মতলব তাই ত্যাড়া ভাবে বললো আমার বউয়ের কাছে আমি যাবো তাতে তোদের টাকা দিতে যাবো কোন দুঃখে?

প্রীতি বললো ভাইয়া এটা কিন্তু ঠিক না, টাকা না দিলে আমরা ঢুকতে দিবো না ভিতরে।
প্রীতির সাথে সায় দিয়ে শাফিন ও বললো শালা বাসর ঘরে যাবি আর টাকা দিবি না তা হবে নাকি? তারাতাড়ি টাকা বের কর।

পরাফি ফের ভ্রু কুঁচকে বললো তোরা কি বাসর ঘর সাজিয়েছিস নাকি যে টাকা দিবো? আমার রুম আগে যেমন ছিলো তেমন এই আছে সো ভাগ এখন এখান থেকে। যদি রুম সাজিয়ে দিতি তাহলে ভেবে দেখতাম টাকার কথা।

শাফিন বাঁকা হেসে বললো তাহলে তুই যা এখান থেকে আমরা রুম সাজাবো তারপর ভিতরে যাবি। তারপর শাফিন পারফির কানে ফিসফিস করে বললো তাহলে কিন্তু আজ আর বাসর করা লাগবে না, রুম সাজাতে সাজাতে দেখবি ভোরের আলো ফুটে গেছে। এখন কি করবি নিজেই বল বলে ভ্রু নাচালো শাফিন।

পারফি এবার দাঁতে দাঁত চেপে প্রীতি আর শাফিনের দিকে তাকিয়ে বললো কতো লাগবে?

প্রীতি দুই হাত উপরে উঠেয়ে বললো পাক্কা দশ হাজার।

প্রীতির কথায় পারফি চোখ কপালে উঠিয়ে বললো মানুষ মাত্র তোরা দুইজন আর চাচ্ছিস দশজনের টাকা। সম্ভব না ডিমান্ড কমা তারাতাড়ি।

শাফিন বললো শালা তোর দিকে মায়া করে কম করে চেয়েছি আর তুই বলছিস বেশি। যা তোর আজ ভিতরে যাওয়াই লাগবে না তুই ছাঁদে যেয়ে ঘুমা।

পারফি বুঝলো যে এরা নাছোড়বান্দা এদের সাথে তর্ক করে লাভ নেই তাই হার মেনে দশ হাজার টাকা শাফিনের হাতে দিতে ওরা গেট খুললো।

পারফি যেতে প্রীতি শাফিনের উদ্দেশ্যে বললো ফিফটি ফিফটি এবার আমার ভাগেরটা আমাকে দিয়ে দেও তারাতাড়ি।

শাফিন ত্যাড়া ভাবে বললো যদি না দেই তোকে?

প্রীতি ক্ষেপে বললো দিবে না মানে? তারাতাড়ি দেও বলছি আর না হলে….

শাফিন প্রীতির মুখের কথা কেঁড়ে নিতে প্রীতির দিকে কিছুটা ঝুঁকে বললো আর নাহলে কি?

শাফিনকে এভাবে ঝুকতে দেখে প্রীতির হার্টবিট বেড়ে গেলো। গলা দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না কথা গুলো সব গলায় আঁটকে গেছে।

তা দেখে শাফিন ফের বললো কি হলো বলছিস না কেনো আর নাহলে কি করবি?

প্রীতি এবার আমতা আমতা করে বললো আ..আর নাহলে ক..কামড় দিবো।

প্রীতি কথায় যেনো শাফিন বেশ মজা পেলো। চমৎকার এক হাসি দিয়ে প্রীতি দিকে আরেকটু ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো তাই নাকি?

প্রীতি কি বলবে খুঁজে পেলো না। শাফিনের এমন ফিসফিসানিতে বুকের ভিতর হাতুড়ি পেটানো শুরু করে দিয়েছে। জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো।

প্রীতির অবস্থা দেখে শাফিন ঠোঁট টিপে হাসলো। তারপর কিছুটা দূরে সরে প্রীতি হাত ধরে ওর হাতের উপর সব টাকা দিয়ে বললো পুরোটাই তোর এবার খুশি?

শাফিন একটু দূরে সরাতে প্রীতি কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো তারপর শাফিনের দিকে তাকিয়ে বললো তুমি নিবে না?

শাফিন প্রীতির মাথা গাট্টা মেরে বললো আমারটা তোকে দিয়ে দিলাম। এবার যেয়ে ঘুমা রাত অনেক হয়েছে এ বলে শাফিন চলে গেলো।

প্রীতি শাফিনের যাওয়ার পানে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। কেনো যেনো শাফিনের এই ছোট ছোট ইচ্ছে পূরণ করা খুব খুব ভালো লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয় শাফিন ও ওকে খুব ভালোবাসে কিন্তু সেটা প্রকাশ করে না। শাফিনের এই ছোট ছোট কেয়ার, সারাদিন পিছনে পড়ে থাকা, ঝগড়া করা সবটাই প্রীতির খুব ভালোলাগে।
—————————————–
এদিকে পারফি রুমে ঢুকতে চোখে পড়লো ইয়ানা গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে তা দেখে নিঃশব্দে হাসলো পারফি। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো ইয়নার কাছে। তাকালো সেই মায়াবী মুখশ্রীর দিকে। কি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে স্নিগ্ধ ফুল। এদিকে তার এই মায়াবী মুখশ্রী যে অন্য কারো চোখের ঘুম কেঁড়ে নিয়েছে সেই খবর কি একটি বার নিয়েছে?
পারফি আরো কিছুক্ষণ ইয়ানার মায়াবী মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে রইলো। মন ভরে কাছ থেকে স্নিগ্ধ ফুলকে দেখলো। বুকের ভিতর এক অন্যরকম ভালোলাগা অনুভব করছে এটা ভেবে যে স্নিগ্ধ ফুল এখন থেকে ওর, শুধুই ওর।

পারফি এবার নিজের ভাবনা থেকে বের হয়ে ইয়ানার শরীরে ব্লাংকেট জড়িয়ে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে এসে রুমের লাইট বন্ধ করে দিয়ে ড্রিমলাইট জ্বালিয়ে দিয়ে সোফায় যেয়ে শুয়ে পড়লো। এখন বেডে শুলে ইয়ানা অস্বস্তিতে পড়ে যাবে সেটা খুব ভালো করেই জানে। মেয়েটাকে একটু সময় দেওয়া প্রয়োজন তাই পারফি সোফায় শুয়ে পড়লো। সোফায় শুতে একটু কষ্ট হলেও মানিয়ে নিলো।

সোফায় শুয়ে তাকালো ফের ইয়ানার স্নিগ্ধ মুখপানে। কম্বল জড়িয়ে মনে হচ্ছে এক আদুরে বিড়াল ছানা আরামসে ঘুমিয়ে আছে।

ইয়ানাকে দেখতে দেখতে একসময় পারফিও ঘুমিয়ে পড়লো।
——–
ফজরের আজানের শব্দে ঘুম ভাঙলো ইয়ানার। ঘুম ভাঙতে ড্রিমলাইটের হালকা আলোতে দেখতে পেলো এটা ওর রুম না। হঠাৎ এমন অচেনা রুমে আসলো কিভাবে ভাবতে লাফ দিয়ে উঠে বসলো। উঠে বসতে চারেদিকে ভয়ে ভয়ে চোখ বুলালো তখন চোখ পড়লো সোফায় শুয়ে থাকা পারফির দিকে। পারফিকে দেখে আস্তে আস্তে কাল রাতের সব কথা মনে পড়লো। সব কথা মনে পড়তে কিছুটা শান্ত হলো। কাল রাতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে টের এই পায় নি।

ইয়ানা ফের তাকালো পারফির দিকে। সোফায় টান হয়ে শুয়ে আছে, এতবড় শরীর নিয়ে সোফায় ঘুমাতে যে খুব কষ্ট হচ্ছে তা দেখেই বুঝা যাচ্ছে।

পারফিকে দেখে ইয়ানার খারাপ লাগলো খুব। ওনার রুমে উনি কষ্ট করে সোফায় ঘুমিয়ে আছে আর আমি আরামসে বেডে ঘুমিয়ে রাত পার করে দিলাম ভাবতেই খারাপ লাগছে। সাথে পারফির প্রতি রেসপেক্ট কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। অন্য পাঁচটা স্বামীন মতো স্বামীর অধিকার না চেয়ে নিজ থেকে ইজি হতে সময় দিয়ে দিলো। এমন কি নিজে কষ্ট করে সোফায় ম্যানেজ করে নিয়ে বেড আমাকে দিয়ে দিলো। তিনি চাইলেই পারতো নিজে বেডে ঘুমিয়ে পড়তে কিন্তু তা না করে আমার দিকটা আগে চিন্তা করেছে ভাবতেই একরাশ ভালোলাগা কাজ করলো পারফির প্রতি।

ইয়ানা বেড থেকে আস্তে ধীরে নেমে সোফার কাছে গেলো। এখন পারফিকে ডাক দিয়ে বেডে যেতে বলবে কিনা তা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্ব ভুগতে লাগলো। তাছাড়া নামাজ আদায় করার জন্য জায়নামাজের প্রয়োজন। রুমের চারপাশে চোখ বুলিয়ে কোনো জায়নামাজ চোখে পড়লো না। ভাবলে হয়তো আলমারিতে তোলা আছে কিন্তু অন্যের জিনিসে অনুমতি ছাড়া হাত দেওয়া সোভা পায় না তাই ইয়ানা বাধ্য হয়ে পারফিকে আস্তে করে ডাক দিলো… শুনছেন….

কিন্তু পারফির কোনো সাড়াশব্দ নেই তা দেখে ইয়ানা কাঁপা কাঁপা হাতে কিছুটা ঝুঁকে পারফিকে হালকা ধাক্কা দিয়ে ডাক দিলো।

ঘুমের মাঝে কারো ডাকার আওয়াজে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো পারফি। ইয়ানা যেহেতু পারফির দিকে কিছুটা ঝুকে ছিলো তাই পারফি এভাবে ধড়ফড়িয়ে উঠাতে দুজনে একে অপরের মাথার সাথে টাক খেলো।

মাথায় মৃদু ব্যথা অনুভব করতে আহ্ করে উঠলো ইয়ানা।

কি হয়েছে বুঝে উঠতে পারফি দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে ইয়নার কাছে যেয়ে বললো সরি সরি সরি আই একট্রেমলি সরি। আমি খেয়াল করি নি একদম। বেশি ব্যথা পেয়েছো? আম রিয়েলি সরি তখন হঠাৎ ওভাবে ঘুম ভেঙে যাওয়াতে খেয়াল করতে পারি নি কিছু।

পারফিকে এমন বিচলিত হতে দেখে ইয়ানা মৃদু হেসে বললো ইটস ওঁকে আমার তেমন লাগে নি সামান্য একটু লেগেছে এতে সমস্যা নেই।

পারফি ইয়ানার দিকে তাকিয়ে বললো সত্যি জোরে লাগেনিতো?

ইয়ানা হেসে দিয়ে বললো সত্যি লাগেনি।

পারফি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো এতে। তারপর ইয়ানার দিকে তাকিয়ে বললো ডাকছিলে কেনো? কোনো সমস্যা?

ইয়ানা আমতা আমতা করে বললো সমস্যা না আসলে একটা জায়নামাজ লাগতো নামাজ পড়ার জন্য।

ওহ্ একটু ওয়েট করো আমি এখনি দিচ্ছি এ বলে পারফি কাবার্ড থেকে একটা জায়নামাজ ইয়ানার হাতে দিয়ে বললো কোনো কিছু প্রয়োজন হলে কাবার্ড খুলে দেখো পেয়ে যাবে।

ইয়ানা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। তারপর ফ্রেশ হয়ে এসে নামাজে দাঁড়াতে যাবে তখন দেখলো পারফি সোফায় বসে আছে তা দেখে ইয়ানা আমতা আমতা করে বললো নামাজ পড়বেন?

ইয়ানার এই প্রশ্নে পারফি কি উত্তর দিবে খুঁজে পেলো না। সচারাচর সকালের নামাজটা আদায় করা হয় না।

পারফিকে কিছু বলতে না দেখে ইয়ানা হয়তো কিছুটা বুঝতে পেরেছে তাই একটু মুচকি হেসে বললো ফজরের নামাজ আদায় করলে মনের ভিতর এক শান্তি লাগা অনুভব করা যায় যেই শান্তি অন্য কিছুতে মিলে না। চাইলে নামাজটা আদায় করে নিতে পারেন।

পারফি বাধ্য ছেলের মতো সাথে সাথে উঠে ফ্রেশ হয়ে ওজু করে বের হলো। বের হয়ে দেখলো ইয়ানা নামাজে দাঁড়িয়ে গেছে তাই মাথার টুপিটা নিয়ে দরজা হালকা করে চাপ দিয়ে বেড়িয়ে গেলো নামাজের উদ্দেশ্যে মসজিদে।

বাসার নিচে নামতে দেখা হয়ে গেলো পাভেল চৌধুরী আর শরীফ শিকদারের সাথে। তারাও মসজিদে যেতে নিয়েছিলো তখন পারফিকে এতো সকাল সকাল দেখে দুজনে বেশ অবাক হলো।
পারফি কাছে আসার পর জানতে পারলো নামাজ পড়তে যাবে তা শুনে দুজনেই খুব খুশি হলো।

#চলবে?

ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
হ্যাপি রিডিং….🥰

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে