তুমি অপরূপা পর্ব-২৬+২৭+২৮

0
529

#তুমি_অপরূপা(২৬)
“দেখতে তো ভদ্র মনে হয়, তাহলে এরকম ছ্যাবলামি করেন কেনো?
আপনার ব্যক্তিত্বের সাথে কি যায় এসব কাজ?
এতো পড়াশোনা করে কি লাভ হলো যদি নিজে এরকম সস্তা দরের মানুষ হয়ে থাকেন?”

এক দমে কথাগুলো বলে রূপা গটগট করে হাটা শুরু করে দিলো।সমুদ্র থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। কি বলছে এসব রূপা!রূপা কি তাকে কোনোদিন বুঝবে না!

রূপা আজ সব ক্লাস না করেই চলে এসেছে। তবুও কলেজ থেকে বের হয়ে দেখে সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছে বাহিরে।
এই ছেলেটা কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকে না-কি?
বিরক্তি এসে ভর করলো রূপার মনে। সে যেই লক্ষ নিয়ে এই শহরে এসেছে সেই লক্ষ্য থেকে কিছুতেই সরবে না।

বাসায় গিয়ে বাবাকে কল দিলো।বাবার সাথে কথা বলে বুঝতে পারলো সালমা আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েছে । রূপা ভেবে পায় না তার কি করা উচিত!
হুট করে সিদ্ধান্ত নিলো সে গ্রামে যাবে।মা’কে দেখতে যাবে।

যেই ভাবা সেই কাজ।দুপুরে খেয়ে রূপা অপেক্ষা করতে লাগলো রত্না পান্নার জন্য।
ক্লাস শেষ করে বাসায় এসেই দু’জনে ছুটে এলো রূপার কাছে।রূপার সাথে দুজনের ভীষণ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। রূপা যখন জানালো সে গ্রামে যাবে রত্না পান্না দুজনের মুখ শুকিয়ে গেলো।
পান্না কাঁদোকাঁদো হয়ে বললো, “কেনো যাবি বল?না গেলে হয় না?
দূর তুই গেলে আমাদের ভালো লাগবে না। ”

রূপা মলিন হেসে বললো, “আমি ও তোদের অনেক মিস করবো। অনেক দিন হলো এসেছি, বাড়ির জন্য মন কেমন করছে। মা’কে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।মা খুব অসুস্থ।”

রত্না বললো, “ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি আসিস।তোর অপেক্ষায় থাকবো আমরা। ”
রূপা মুচকি হাসলো। তারপর দুজনকেই জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।
ভ্যানিটি ব্যাগে দুই সেট জামা আর দুইটা বই নিয়ে রূপা বের হলো বাসা থেকে। রত্না এসে বলেছে রূপা তার গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে। এরপর থেকেই রূপকের মন খারাপ হয়ে আছে।না সে রূপার মুখোমুখি হয় না,রূপার বিরক্তির কারণ হতে চায় না।তবুও তো মন জানতো রূপা পাশের ফ্ল্যাটে আছে, ইচ্ছে করলেই তাকে দেখতে পারবে রূপক।
রূপা বের হওয়ার সময় ছাদে দাঁড়িয়ে এক নজর দেখতো রূপক। কিন্তু এখন কাকে দেখবে সে?
রত্না পান্নার সাথে যখন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতো রূপক তখন দূরে দাঁড়িয়ে রূপার পিঠময় ছড়িয়ে থাকা কোঁকড়ানো চুলের ঢেউ খেলানো দেখতো।

রূপকের একটা গোপন ইচ্ছে, কোনো একদিন নিজের হাতে এই তেলতেলে চুলগুলো সে ধরবে।নিজের হাতে এই চুলে গাঁদা ফুলের মালা জড়িয়ে দিবে।

কে জানে কখনো এই ইচ্ছে পূর্ণ হবে কি-না!

রূপা রুমের সবার থেকে বিদায় নিয়ে বের হলো। মাহি ভীষণ খুশি হলো। মনে মনে দোয়া করতে লাগলো রূপা যাতে আর না ফিরে আসে।এই কয়েকদিনে মাহি সবসময় মনে মনে দোয়া করতো রূপার যাতে সমুদ্রের সাথে প্রেম হয়ে যায়। তাহলে তার আর ভয় নেই রূপককে নিয়ে ।

সমুদ্রের ফোনে একটা টেক্সট এলো, ওপেন করে দেখলো লিখা,”রূপা তার গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে কয়েকদিনের জন্য। ”

বিছানায় শুয়েছিলো সমুদ্র, টেক্সট পেয়ে আর দাঁড়ালো না।সমুদ্র জানে কোন জায়গা থেকে গাড়িতে উঠতে হবে।তাই নিজের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ছুটে গেলো। এই ব্যাগটা সবসময় তার গুছানো থাকে।হুটহাট বেরিয়ে পরার স্বভাব তার এজন্য আগেই গুছিয়ে রাখে।

রূপার বুক কাঁপছে দুরুদুরু করে। এই প্রথম সাহস করে বের হচ্ছে একা একা বাড়ির উদ্দেশ্যে। ঠিকঠাক পৌঁছাতে পারবে তো? কাঁপতে কাঁপতে সিড়ি দিয়ে নামতে লাগলো রূপা।এক মনে আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছে যাগে সহি সালামতে বাড়ি গিয়ে পৌঁছাতে পারে।

রূপক গ্যারেজে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বাইকের চাবি। রূপা আড়চোখে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো।সেদিনের পর থেকে রূপক সাথে রূপার কথা হয় নি।রূপা রূপককের সামনে পড়তে চায় না।হয়তো রূপক ও রূপার মনোভাব বুঝতে পেরেছে তাই রূপাকে বিরক্ত করে না।
তবে রূপা অনুভব করে কেউ তাকে নিবিড়ভাবে দেখছে।

রূপা বের হয়ে রিকশায় উঠে। রূপক বাইক নিয়ে পিছন পিছন যায়। কিছুটা পথ যেতেই রূপক রূপার রিকশার পাশাপাশি বাইক এনে জিজ্ঞেস করে, “কবে আসবে তুমি? ”

রূপা বিরক্তিতে ভ্রুঁ কুঁচকায়।ম্লান হেসে রূপক পিছিয়ে যায়।রূপক বুঝতে পারে এই মেয়েটা গ্রামের মেয়ে হলেও এর মন ভীষণ শক্ত। অন্য কোনো মেয়ে হলে আরো আগেই পটে যেতো। অন্তত রূপকের প্রেমে না হলেও সমুদ্রের প্রেমে ঠিকই পড়ে যেতো।
হয় আবেগে পড়ে প্রেমে পড়ে যেতো নয়তো সবাই প্রেম করছে এই ভেবে নিজেও প্রেমে পড়ে যেতো।

কিন্তু তা হচ্ছে না রূপার সাথে। ওর ব্যক্তিত্ব খুবই স্ট্রং।এজন্যেই হয়তো সমুদ্র এভাবে হাবুডুবু খাচ্ছে।
রূপা রিকশা থেকে নেমে কোনোদিন ভ্রুক্ষেপ না করে রূপা কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যায়।এই বাসেই করে তো এসেছিলো। মুখে অতিরিক্ত গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলে রূপা এগিয়ে যায়।রূপকের বুক ছিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো। মনে মনে বললো, “একটা জীবন আমার ফুরিয়ে যাবে এক বুক আক্ষেপ নিয়ে। আহা ভালোবাসা! ”

রূপা টিকিট কেটে কাউন্টারে বসলো। ঝড়ের বেগে সমুদ্র এসে হাজির হলো। সেও একটা টিকিট কাটলো দিঘলির।

রূপা চমকে গেলো সমুদ্রকে দেখে।বিড়বিড় করে বললো, “ও আল্লাহ,আমাকে শক্তি দাও।নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকার মনোবল দাও।”

নির্দিষ্ট সময়ে বাস এলো। বাসে উঠতেই রূপার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। এতো মানুষ বাসে,তার সীট কোনটা?
কিভাবে খুঁজবে?
কার পাশে বসবে?
গাড়ির কন্ডাকটর এগিয়ে এলো। রূপা নিজের টিকিট দেখিয়ে বললো, “এই সীট টা কোনটা? ”

কন্ডাকটর এক নজর রূপার দিকে তাকাতেই রূপা মুহূর্তেই চোখে মুখে অতিরিক্ত গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুললো। সীট খুঁজে দিয়ে কন্ডাকটর চলে গেলো। রূপা খুশি হলো জানালার পাশে সীট পেয়ে।তার পাশের সীট এখনো ফাঁকা। রূপার বুক কাঁপতে লাগলো। রূপা সিনেমায় দেখেছে সবসময় নায়িকার পাশের সীটে ভুল করে হোক বা ইচ্ছে করে হোক নায়কেরই সীট পড়ে।
সমুদ্র সীট খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে এসে রূপার পাশে দাঁড়ালো । রূপার সারা শরীর ভয়ে ঠান্ডা হয়ে গেলো। রূপা বুঝতে পারলো এটাই সমুদ্রের সীট। চোখ বন্ধ করে মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো রূপা। একটু পরেই বুঝতে পারলো তার পাশে কেউ ধপ করে বসে পড়েছে।

রূপার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। কিছুতেই সে সমুদ্রের সংস্পর্শে থাকতে চায় না সেখানে পাশাপাশি বসে এতো দূর যাবে!

চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পেলো তার পাশের সীটে বছর ষাটের একজন ভদ্রমহিলা বসেছে। মুখে জর্দা দেওয়া পান। জর্দার কড়া ঘ্রাণ আসছে তার শরীর থেকে। হুট করেই রূপার এতো ভালো লাগলো। তীব্র জর্দার ঘ্রাণও রূপার কাছে ভীষণ সুঘ্রাণ মনে হলো। আল্লাহ তার ডাক শুনেছেন।পিছনে তাকিয়ে দেখলো সমুদ্র ঠিক তার পিছনের সীটে,জানালার পাশে।
পিছনে তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেলো। সমুদ্র হেসে বললো, “পিছনে ফিরে আমাকেই খুঁজছিলে তাই না?আমি তোমার কাছাকাছি আছি অপরূপা। ”

মাথা সামনের দিকে ঘুরিয়ে মনে মনে রূপা বললো, “আর পিছনে তাকাবো না।এই জন্মের মতো আর তাকাবো না।
শা//লা!”

পান খাওয়া ভদ্রমহিলা রূপার দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি কোনখানে নামবা বইন?”

“দিঘলি নামবো আমি।”

“আমি নামমু দিঘলির পরে।ঢাকা কি করো?”

“ঢাকায় থেকে পড়ি।”

“বাপ মা কউ থাকে?গেরামে?”

“জি।”

“বিয়া হইছে নি বইন তোমার? ”

রূপা এই প্রশ্নের জবাব দিলো না। সে বুঝে গেলো এর পরের কথাটা কি হতে পারে। ভদ্রতাসূচক হেসে চুপ করে রইলো।

ভদ্রমহিলা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বললো, “ও বুইঝছি বিয়া হয় নাই।আমার আবার একটা নাতি আছে বুঝলা বইন।দেখতে একটু কালা।তয় কালা হইলো গিয়া গলার মালা,সোন্দর হইলো ঝাড়ুর শলা।এইটা মুরব্বিগো কথা বুঝলা।তুমি আবার মন খারাপ কইরো না।তুমি ম্যালা সোন্দর। তোমারে আমার মনে ধরছে।আমার নাতি মেট্টিক পরীক্ষা দিছে। পাশ দিতে পারে নাই যদিও,তয় সে ভালো ছেলে।গেরামে দুইটা পুকুরে মাছ চাষ করে, গরু আছে ৪ টা,জায়গা জমি ও করছে।ঘর ও করছে।চার চালা টিনের ঘর।অনেক বড় কইরা ঘর করছে। এখন পাকা পায়খানা বসাইবো। দুইটা বোইনেরে বিয়া দিছে।
এখন তার বিয়ার পালা।”

সমুদ্র কান খাড়া করে শুনতে লাগলো দুজনের কথোপকথন। ভদ্রমহিলার কথা শুনে বললো, “বুড়িরে,তোর নাতির গুষ্ঠি কিলাই আমি।তুই শুধু একবার ঠিকানাটা বল।ওর মাছের পুকুরে গিয়ে আমি মাছ মা/রারা ঔষধ ঢাইলা আসমু।আমার সামনে বসে আমার কলিজা ছিনিয়ে নেওয়ার ধান্ধা! ”

রূপা কিছু না বলে মুচকি হাসলো। মাথা ধরে যাচ্ছে তার।তবে মায়া ও লাগছে।এই মানুষগুলো ভীষণ সহজ সরল। নয়তো চেনা নেই জানা নেই,একটা মেয়ের কাছে সব বলা শুরু করে দিয়েছে। শহরের মানুষের মধ্যে এই স্বভাব নেই।

ভদ্রমহিলা এবার প্রসঙ্গ থেকে সরে গিয়ে তার স্বামীর প্রসঙ্গে চলে গেলেন।রূপার হাত ধরে বলতে লাগলো, “বুইঝলা বইন,তোমার দাদা মানে আমাগো ঘরের উনি।আমার নাতি ওনার মতোই হইছে।তোমার দাদায় গো বইন,আমারে এতো আদর করতো। আমারে রাইখা মাঠে খেতের কামেও যাইতে চাইতো না।বারবার কইয়া যাইতো দুপুইরা আমি নিজের হাতে যেনো হের লাইগা ভাত লইয়া যাই।কাউরে দিয়া পাঠাইলে সে খাইবো না।এমন পাগল আছিলো তিনি।”

সমুদ্র পেছন থেকে বিড়বিড় করে বললো, “একেবারে আমার মতো ছিলো দাদী।দেখেন না,আমিও আমাগো ঘরের ওনারে ছাড়া কিছু বুঝি না।এরজন্য তো তার সাথে সাথে আমিও চলে আসছি।শুধু তারে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য দাদী।
দিন নাই,রাইত নাই,আমাগো ঘরের ওনারে এক নজর দেখার জন্য মহল্লার কুত্তাগুলার লগে ফুটপাতে বইসা থাকতে থাকতে এখন একদিন যাইতে দেরি হইলেই ওরা আমারে ঘেউঘেউ কইরা জিজ্ঞেস করে, এতো দেরি হইছে ক্যান!তবুও সে আমারে বুঝে না,অথচ এলাকার কুত্তাগুলা ও আমারে বুইঝা গেছে।”

নির্দিষ্ট গন্তব্য আসতেই রূপা নেমে গেলো বাস থেকে।রূপার পিছু পিছু সমুদ্র ও নেমে গেলো।রূপা রিকশা নিয়ে সোজা রিকশায় উঠে গেলো। সমুদ্র হা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো বোকার মতো। কেনো এসেছে সে এখানে?
কোনো দরকার ছিলো তার?
না তো,শুধু রূপাকে নিরাপত্তা দিতেই এসেছিলো।

মনে মনে হাসলো সমুদ্র নিজের বোকামির জন্য। অযথা একটা কাজ করে বসলো অথচ মনে ভীষণ প্রশান্তি লাগছে।সারাটা জীবন যদি এই মেয়েটাকে এভাবেই আগলে রাখার দায়িত্ব সমুদ্র পেতো!
ভাগ্য কি এতোটা সদয় হবে তার উপর!
কে জানে!

চলবে……

#তুমি_অপরূপা(২৭)

রূপা চলে গেছে অনেকক্ষণ হলো। সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছে সেখানেই, সেভাবেই।
একটা হাহাকার বুকের ভেতর। কার জন্য এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে সে?
সেই ময়না পাখি কি কখনো ধরা দিবে তার মন পিঞ্জিরায়?
এই যে বিনিদ্র রজনীরা সাক্ষী, সাক্ষী প্রিয় গীটার, সাক্ষী আকাশের তারারা,সমুদ্রের নিঃসঙ্গতার সাক্ষী এরা সবাই।এরা জানে সমুদ্র ভালো নেই।এরা শুনে একটা ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ের আর্তনাদ।
এরা দেখে একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছে সমুদ্র। এরা বুঝে বোবা হৃদয়ের নিঃশব্দ চিৎকার।
অথচ যার জন্য সোনার দেহ পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, যার জন্য বুকের বেদনার ঢেউ আছড়ে পড়ছে সেই তার খবর রাখে না।সে জানেই না ভেতরে ভেতরে একটা মানুষ ভীষণ ভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে।
আচ্ছা, তথাকথিত সেই ব্যক্তিত্ব যদি সমুদ্র ধরে রাখে তাহলে কি রূপা তার হবে?
নিজের একটা মানুষ থাকে মানুষের এজন্য, যাতে তার কাছে ভেঙেচুরে নিজেকে খুচরো পয়সার মতো জমা রাখতে পারে। তার কাছে আসলে যাতে ভান করতে না হয়।আমি যা,আমি মন থেকে যেমন ঠিক সেভাবেই নিজেকে প্রকাশ করা যায় যাতে।
যাতে তার সামনেও গাম্ভীর্যের অদৃশ্য মুখোশ পরে থাকতে না হয়।নিজের ব্যক্তিত্ব, ইগো,গাম্ভীর্য বজায় রেখে যদি কাউকে আপন করে নিতে হয় তবে সেখানে মনে হয় কিছুটা ফাঁক ফোকর রয়ে যায়।
সেখানে অন্তত নিজের ১০০ ভাগ প্রকাশ করা যায় না।আর যার কাছে নিজের শতভাগ প্রকাশ করা যায় না,নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া না যায় তবে যে যাই বলুক সমুদ্রের মনে হয় সেখানে “আমি সম্পূর্ণভাবে তোমার” এই কথাটা বুক ফুলিয়ে বলা যায় না। কেউ না জানুক,নিজে তো জানবে আমি পুরোপুরি তার হতে পারি নি।

সমুদ্র রূপাকে পুরোপুরি চায়,নিজেও পুরোপুরি তার হতে চায় যাতে কখনো অবচেতন মন ও বলতে না পারে কখনো সমুদ্র কিছু নিয়ে ভান করেছে। সে নিজের কাছে নিজে স্বচ্ছ থাকতে চায়।এতে তাকে সস্তা ভাবলে ভাবুক,সে বরং এই শব্দটাকে পজিটিভলি নিবে।
সস্তা বলুক,পাগল বলুক যা ইচ্ছে তাই বলুক।
আপন মনে হাসে সমুদ্র।
তারপর গলা ছেড়ে গান গায়,”লোকে পাগল বলুক,মাতাল বলুক আমি…..
তোমার পিছু ছাড়বো না….”

কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীন ঘুরাঘুরির পর সমুদ্র আবারও বাসের কাউন্টারে গেলো।ঢাকায় ফিরে যাবে এখন আবার। এখানে তো তার কোনো কাজ নেই,থাকবে কোথায়।
যাকে সঙ্গ দিতে এসেছিলো সে তো তার গন্তব্যে পৌঁছে গেছে এবার আর চিন্তা নেই।

পরবর্তী বাসে সমুদ্র আবারও ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

রূপার হাত পা কাঁপছে। এতো ভয় লাগছে কেনো?
বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নামতেই ভয়ের একটা শীতল স্পর্শ রূপাকে ছুঁয়ে গেলো।
সমুদ্রের সাথে এক বাসে আসার পরেও তো তার এতো ভয় লাগে নি।এখন কেনো এই অজানা ভয় তাকে চেপে ধরছে?
ভেতরে যতই যাচ্ছে ততই মন বলছে বাড়ি আসা উচিত হয় নি। চারদিকে এশার আজান হচ্ছে। রূপা অন্ধকারে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে।
দাদীর ঘর থেকে হাসাহাসির শব্দ ভেসে আসছে।
তাদের ঘরে হারিকেনের আলো জ্বলছে গুনগুন করে অনিতা পড়ছে মনে হয়। অল্প অল্প শোনা যাচ্ছে তা।

সিরাজ হায়দার আজ একটু সকাল সকাল দোকান বন্ধ করলো। মনটা অস্থির হয়ে আছে আজ।
অনুর সাথে কথা হয় নি তিন চারদিন হলো। যতোই মেয়ের উপর রাগ থাকুক এখন কেনো জানি মন পুড়ছে মেয়ের জন্য। মনে হচ্ছে মেয়েয়া যদি এই সময়টায় দেশে থাকতো, বাড়িতে থাকতো।
এই সময়টা একটা মেয়ের জন্য কেমন সেনসিটিভ সময় তা তিনি জানেন। কে জানে,ওখানে নিজের সব রান্নাবান্না, ঘরের কাজ করতে কতটা কষ্ট হয় মেয়ের!
খেতে পারে কি ঠিক করে?
আহা,বাড়িতে থাকলে তো তিনি নিজে খাইয়ে দিতেন।
মেয়েদের মা যেহেতু অসুস্থ সেহেতু তিনি নিজেই তো খাওয়াতেন মেয়েকে।
১০০ বার খাওয়াতেন।মেয়ের যা ইচ্ছে করে তাই এনে দিতেন মেয়েকে।

সিরাজ হায়দারের চোখে জল এলো।মেয়েটার এই অবস্থায় ওরা মেয়ের হায়ে হাত তুলেছে, সব কাজ করিয়েছে। আল্লাহ সহায় ছিলো বলে,নয়তো প্রথম তিন মাসে তো নানা রকম রিস্কের ব্যাপার থাকে অনেকের।
ভাবতেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো তার।

যেদিন অনামিকাকে নিয়ে এসেছিলেন বাড়িতে সেদিনের কথা মনে পড়ে গেলো।
দোকানে বসে ছিলেন তিনি।সেই মুহুর্তে কল এলো তার ফোনে।বিদেশের নাম্বার দেখে কিছুটা অবাক হলেন।তবুও রিসিভ করলেন।ভালোমন্দ কুশলাদির পর যখন শাহেদ নিজের পরিচয় দিলো ফোনটা রেখে দিতেই যাচ্ছিলেন তিনি কিন্তু রাখলেন না৷ শাহেদের কাতর স্বরের অনুরোধ শুনে।শাহেদ অনুনয় করে বললো, “আব্বা প্লিজ আমার কথা একটু শোনেন,আপনার মেয়েটা অসুস্থ আব্বা।আমাদের বাড়িতে ও ভালো নেই। সুযোগ পেলেই আমার মা ওর গায়ে হাত তোলে,আজকেও ওকে মেরেছে অকারণে। আমি ওকে ওখানে রাখতে চাচ্ছি না আব্বা।আমি জানি আপনি রাগ হচ্ছেন আমার এসব কথা শুনে।ভাবছেন আপনার মেয়েকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করার পরেও তাকে যথাযথ ভালোবাসা, মর্যাদার সাথে রাখতে পারি না।আমি ওকে এই দেশে নিয়ে আসার সকল ব্যবস্থা করতেছি আব্বা।ততদিন পর্যন্ত আপনি আপনার কাছে এনে রাখেন।আপনার মেয়েকে আমি সারাটা জীবন রানী করে রাখবো বলে কথা দিয়েছিলাম,আমি আমার কথা রাখতে চাই।আমাকে একটু সাহায্য করুন,আর অল্প কয়েকটা দিন। ”

শাহেদের কথার মধ্যে কিছু একটা ছিলো। যা জমে থাকা রাগের মধ্যে পানি ঢেলে দিয়েছে।
সেদিনই ছুটে গিয়ে মেয়েকে নিয়ে এসেছেন তিনি।

ভাবতে ভাবতে বাড়ি চলে এলেন।উঠোনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পেরে গলা খাকারি দিলেন তিনি।তারপর টর্চ লাইট জ্বালতেই চমকে উঠলেন।রূপা!
তার আদরের অপরূপা!

“আমার অপরূপা”বলেই সিরাজ হায়দার এগিয়ে এলেন।ছোট বাচ্চার মতো রূপাও এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। রূপা জানে না, কোন অজানা কারণে তার দুই চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো। কান্নাভেজা স্বরে সিরাজ হায়দার বললো, ” আইছস মা,ভালো করছস।কতো দিন তোরে দেখি না।আমার ঘর মাতিয়ে রাখতো যারা একসময় আইজ তারা কেউ নাই।এক সময় প্রতি দিন ঘুম ভাঙ্গলেই চিন্তা করতাম আজকে এতোগুলো মুখে খাবার জুটামু কিভাবে?
অথচ আইজ চিন্তা করি আবারও যদি আমার চারটা পরীরে একলগে পাইতাম তবে আর এক মুহূর্তের লাইগা ও দূরে যাইতে দিতাম না।না খাইয়া থাকতাম লাগলে।তবুও মাইয়াগোরে বুকের মইধ্যে রাখতাম।
মা রে,সন্তান বড় হইলে এমনে দূরে চইলা যাইতে হয় ক্যান?
ক্যান ওরা ছোট বেলার মতো কইরা বুকের ভেতর পাখির ছানার মতো ঘাপটি মাইরা থাকে না?
এতো বড় ক্যান হয় সন্তান?”

রূপা জানে না কি উত্তর দিবে।উত্তর কি আদৌও তার জানা আছে?
সিরাজ হায়দার মেয়েকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন।সালমা এক দৃষ্টিতে চালের দিকে তাকিয়ে আছে। রূপা পাশে দাঁড়িয়ে বললো, “মা…ও মা…..।”

সালমা চমকে উঠে বললো, “কে,কে?কে ডাকে?”

-“আমি ডাকছি মা।”

“কে,অনু? আমার অনু?না-কি আমার অন্তু?কে কথা কয় না ক্যান?কে ডাকে আমারে?
অনিতা কই আমার? ও মা অনিতা, কই গেছস?”

রূপার ভীষণ কষ্ট হয়।মা সবার কথা বললো অথচ তার কথা বললো না কেনো?
তার কথা কি মা’য়ের একটুও মনে নেই?
কোন অপরাধে মা তাকে এভাবে ভুলে গেলো?

“না মা,আমি তোমার রূপা,অপরূপা। ”

সালমার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। কোনো এক অজানা কারণে সালমা রূপাকে এখন সহ্য করতে পারছে না।সালমার চেহারায় হিংস্র ভাব ফুটতে লাগলো চিৎকার করে বললো, “ক্যান আইছস তুই?বাইর হইয়া যা।তুই কেউ না আমার। তোর লাইগা আমরা গেরামে থাকতে পারি না।নাগর লইয়া ভাইগা গেছস না তুই, আবারও ফিরা আইলি ক্যান?তোর নাগর কই এখন?তোর লাইগা এতো অসম্মান আমাগো। তোরে আমি শেষ কইরা দিমু।”

রূপা বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো মা’য়ের দিকে।সালমা ছুটে আসতে নিতেই সিরাজ হায়দার ধরে ফেললো তার হাত।তারপর কঠিন এক ধমক দিতেই থেমে গেলো সালমা।তার মুখ থামলো না।বিড়বিড় করে বললো, “না না,শেষ কইরা দিমু আমি তোরে।তুলনায় চইলা যা যেখান থাইকা আইছস।তোর মতো দুশ্চরিত্রা মাইয়া আমার লাগবো না। আমার মাইয়াগোরে বিয়া দিতে পারমু না তোর লাইগা।তোরে আইজ আমি শেষ কইরা দিমুই।”

সিরাজ হায়দার সালমাকে ছেড়ে মেয়েকে নিয়ে তাদের রুমে দিয়ে এসে বললেন,”তুই একটু জিরাইয়া ল মা।দরজা আটকাইয়া রাখ।”

রূপা ভেবে পেলো না কি করবে!
মা কেনো তাকে কিছুতেই বুঝতে পারে না। মা কি আর কখনোই তাকে ভালোবাসবে না?
কান্না আসে রূপার।বুকের ভেতর থেকে চেপে রাখা কান্নারা সবাই বের হয়ে আসতে চায়।

সিরাজ হায়দার রান্নাঘরে ছুটলেন।মেয়ে এসেছে কতো দিন পরে।দুটো ডিম ভাজবেন,একটা মাছ ভাজি করবেন।

রূপা বসে কান্না করছে। দরজায় টোকা দিতেই রূপা উঠলো দরজা খুলতে।পর মুহূর্তে দরজা না খুলে আগে টিনের ফোঁকর দিয়ে তাকাতেই দেখলো সালমা দাঁড়িয়ে আছে।
রূপা কিছু না ভেবেই দরজা খুলতেই সালমা ঝাঁপিয়ে পড়লো রূপার উপর। গলা টিপে ধরে বললো, “শেষ করে ফেলবো আমি তোরে।তোর লাইগা গেরামে মুখ দেখাইতে পারি না। তোর লাইগা সবাই আমাগো শরম দেয়।তুই ম/র।”

অনিতা দৌড়ে গিয়ে বাবাকে বললো, “আব্বা,মা আপার গলা টিইপ্যা ধরছে।”
সিরাজ হায়দার সব ফেলে ছুটে এলেন।এসে টেনে সালমাকে সরানোর চেষ্টা করলেন।সালমার গায়ে যেনো হাতির মতো শক্তি এসেছে। অনেক কষ্টে সালমাকে রূপার থেকে আলাদা করলেন।
রূপার নিশ্বাস নিতে পারছে না।হাঁফাতে লাগলো। সিরাজ হায়দার কি করবেন ভেবে পেলেন না।

সালমা সরে গিয়ে এক কোণে বসে কাঁদতে লাগলো অনু,অন্তু করে।
সেই রাতে কারো খাওয়া হলো না।কেউ ঘুমাতে পারলো না।সবাই জেগে রইলো নিজের জায়গায়।

পরের দিন সকালে রূপা ঘুম থেকে উঠে বাবার কাছে গিয়ে বললো, “আমি চলে যামু আব্বা।”

সিরাজ হায়দার জবাব দিতে পারলেন না।কেমন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।রূপা বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। বাবার বয়স এই এক রাতে অনেকখানি বেড়ে গেছে যেনো। কেমন বৃদ্ধ মনে হচ্ছে আজ বাবাকে।বাবা মা’কে বৃদ্ধ হতে দেখার মতো শোক মনে হয় আর কিছুতে নেই।

সিরাজ হায়দার রূপাকে নিয়ে বাস স্ট্যান্ডে এলেন । মেয়েকে বাসে তুলে দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।বাস ছেড়ে দিলো একটা সময় পর।তারপর আস্তে আস্তে দৃষ্টি সীমার বাহিরে চলে গেলো বাস।অপলক তাকিয়েই রইলেন সিরাজ হায়দার। বুকের ভেতর শূন্য হতে হতে এক সময় মনে হলো ভীষণ একা তিনি।
জীবন এরকম কেনো?
আর কি কখনো সব ঠিক হবে না?

চলবে……

রাজিয়া রহমান

#তুমি_অপরূপা (২৮)
বাসের ঝাঁকুনি, চারদিকের কোলাহল,মানুষের কথাবার্তা কোনো কিছুই রূপাকে স্পর্শ করতে পারছে না।সে নিজের ধ্যানে মগ্ন হয়ে আছে।বুকের ভেতর অজানা ব্যথারা আঘাত হানছে বারবার।
নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে রূপার।
কেনো এতো কষ্ট পাচ্ছে বুঝতে পারছে না।

ফোন বাজছে,বের করে দেখে রত্না কল দিচ্ছে।রূপা কল কেটে দিয়ে টেক্সট দিলো,”আমি বাসে,ঢাকায় আসতেছি।”

কোনো দোষ না করে দিনশেষে সে নিজেই অপরাধী হয়ে গেলো। যেই উৎসাহ, উত্তেজনা নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলো,ফিরে এসেছে ঠিক দ্বিগুণ কষ্ট নিয়ে।
রূপার দমবন্ধ হয়ে আসছে।এতো ব্যথা,এতো যন্ত্রণা, এতো আঘাত কিভাবে সইবে সে?

বাস কতক্ষণ ধরে চলছে,এখন কয়টা বাজে কিছু জানে না রূপা।ঢাকায় পৌঁছাতে আর কতক্ষণ লাগবে তাও জানে না।

বাসের কন্ডাকটর এসে বললো, “আপা,শাহবাগ তো আইসা গেছি,নামবেন না আপনে?”

রূপার হুঁশ এলো ততক্ষণে। সীট থেকে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি ও পাচ্ছে না সে।অনেক কষ্টে সামনের সীট ধরে উঠলো। উঠতেই মাথা কেমন চক্কর দিতে লাগলো। রূপার তখন মনে পড়লো গতকাল সকালের পর থেকে এখন পর্যন্ত না খেয়ে আছে সে।এজন্য শরীর দুর্বল হয়ে গেছে আরো বেশি।
অনেক কষ্ট হলো রূপার বাস থেকে নামতে।বাস থেকে নামতেই রূপার মাথা ঘুরতে লাগলো। পা ফেলার শক্তি নেই শরীরে।
সবকিছু যেনো গুলিয়ে গেছে। কোথায় বাসা,কোথায় রিকশা,কিভাবে যাবে সব মাথা থেকে বের হয়ে গেছে। মাথায় শুধু ঘুরছে মা আমায় ভালোবাসে না কেনো,কেনো আমাকে চিনতে পারে না!

শূন্য দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাতে তাকাতে দেখতে পেলো ফর্সা,গোলগাল ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে। ছেলেটা কে?
কেমন চেনা চেনা লাগছে!
রূপার মাথা কাজ করছে না। সারা পৃথিবী দুলছে যেনো!

সমুদ্র এগিয়ে এলো।রূপাকে তার স্বাভাবিক লাগছে না কিছুতেই।গতকাল যেই সুস্থ স্বাভাবিক মেয়েটাকে দেখে এসেছে আজকে তার এ কি হাল!
চোখ মুখ বসে গেছে।এক রাতেই যেনো অনেক শুকিয়ে গেছে। মাথার সব চুল এলোমেলো হয়ে আছে।কপালে এসে অবহেলিতের মতো লেপ্টে আছে তারা।

সমুদ্রের কোমল মন আরো দ্রবীভূত হলো।হঠাৎ করে মনে হলো, এই মেয়েটাকে ছাড়া তার কিছুতেই চলবে না।
না মানে না,কিছুতেই না।অসম্ভব!
এই মেয়েটাকে গুছিয়ে রাখতে হলে তাকে এই মেয়েটার হতে হবে।এই মেয়েটা বড্ড এলোমেলো। সমুদ্রের চোখের কোণে জল এলো। রূপক! ঠিক এরকম এলোমেলো তো রূপক ও থাকতো।

সাহস করে রূপার হাত ধরে বললো, “কি হয়েছে তোমার? এরকম উদভ্রান্তের মতো লাগছে কেনো?”

রূপা কি বলবে?রূপা কি বলবে তার মা তাকে ভালোবাসে না,একটুও ভালোবাসে না তার মা তাকে।
না এই কথা বলা যাবে না।
অনেক কষ্টে নিজেকে স্থির করে রূপা বললো, “আমার কিছু হয় নি, হাত ছাড়েন।”

সমুদ্র হাত ছেড়ে দিতেই রূপা সোজা হাটতে লাগলো। রিকশা খুঁজে নিয়ে রিকশায় উঠতে যেতেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো রূপার।রিকসাওয়ালা মামা শক্ত করে হাত ধরে ফেললো রূপার।

সমুদ্র দ্রুত এগিয়ে গিয়ে রিকশায় উঠে রূপার হাত ধরে রূপাকে রিকশায় তুললো। তারপর রূপার সাথে বসে যেতে লাগলো। রূপা বুঝতে পারছে কাজটা ঠিক হচ্ছে না। সমুদ্রের সাথে যাওয়া উচিৎ হচ্ছে না কিন্তু শরীর এতোটাই ভেঙ্গে পড়ছে যে রূপার পক্ষে কথা বলাও সম্ভব না।

রিকশা চলে গেলো রূপকের সামনে দিয়ে। এক বুক জ্বালা নিয়ে রূপক তাকিয়ে রইলো। আস্তে আস্তে রিকশা রূপকের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলো।
বাইকের সাথে হেলান দিয়ে, দুই হাত বুকে ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে রূপক সবটাই দেখলো। একবার ইচ্ছে করছিলো এগিয়ে যেতে রূপার কাছে।সমুদ্রের আগে সে-ই দেখেছে রূপাকে বাস থেকে এলোমেলোভাবে নামতে।
রূপক যেতো রূপার কাছে,তার আগেই দেখলো রূপা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। এরপর আর রূপার কাছে যাওয়ার মানে হয় না।
আচ্ছা রূপা কি কখনো জানবে রূপক যে সেই সাতসকালে এসে এখানে দাঁড়িয়েছে রূপার অপেক্ষায়। না রূপক জানতো না রূপা আজকেই আসবে।তবুও এসে দাঁড়িয়ে ছিলো। আজ না আসুক কাল আসবে,কাল না এলে পরশু,নয়তো দুই দিন বা তিন দিন পর অথবা এক সপ্তাহ পর ।রূপক প্রতিদিন এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে ভেবে ঠিক করেছিলো। রূপক দাঁড়িয়েই ছিলো তখনই রত্না কল দিয়ে বললো, “দাদা,রূপা আসতেছে ঢাকায়।”

মনে মনে হেসে রূপক, “রূপা,আজ থেকে যদি ১ মাস পরেও তুমি আসতে আমাকে এই জায়গায় ঠিক এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেতে।”

সমুদ্র বসে বসে দোয়া করতে লাগলো রিকশার যাতে চেইন পড়ে যায় অথবা সামনে রাস্তাটা আজ বন্ধ হয়ে যায়।
রাস্তায় আজ কেউ কাঁটাতার লাগিয়ে দিক।এই পথ কখনো শেষ না হোক,অনন্তকাল ধরে এই রিকশা চলুক।
কিন্তু তা আর হয় না।
রূপকদের বাসার সামনে এসে রিকশা দাঁড়ালো। রূপা রিকশা থেকে নেমে রিকশা ভাড়া দিতে গেলো। সমুদ্র রূপার হাত ধরে বললো, “আমি ভাড়া দিয়েছি।তুমি যাও।”

অন্য সময় হলে হয়তো সমুদ্রের ভাগ্য এতো প্রসন্ন হতো না। রূপার সাথে রিকশায় আসার ও স্বপ্ন পূর্ণ হতো না। কিন্তু আজ রূপা ঠিক নেই সমুদ্র বুঝতে পারলো।

কি এক ভালো লাগা,আবেশ সমুদ্রের মন প্রাণ জুড়ে আছে।রূপার সাথে এক রিকশায় করে এসেছে সে!
রূপার একটু কাছাকাছি সে আসতে পেরেছে!

ফোন বের করে অচেনা নাম্বারটিতে টেক্সট দিলো সমুদ্র।
“আপনি কে আমি জানি না,ধন্যবাদ আমার এতো বড় উপকার করার জন্য । আপনি না টেক্সট দিলে আমি সেদিন ও জানতে পারতাম না রূপা বাড়ি যাচ্ছে আর আজও জানতে পারতাম না রূপা আসছে।”

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়েছে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাহি রূপাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সমুদ্রের সাথে এক রিকশায় করে এসেছে দেখে মাহির কিছুটা ভালো ও লাগছে।এটাই তো চায় সে।রূপকের থেকে দূরে সরে যাক এই মেয়েটা।
রত্নার থেকে জানতে পেরেছে আজ রূপা আসবে,সেই থেকে মাহি অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখানে।

রূপা রুমে এসে কোনো দিকে না তাকিয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যে থরথর করে কাঁপতে লাগলো রূপা।

নিপা রপার কপালে হাত দিয়ে দেখে রূপার প্রচন্ড জ্বর। রত্না পান্নার কাছে গিয়ে কথাটা বলতেই দুজনে ছুটে এলো। রূপার কোনো হুঁশ নেই।দুই বোন দুই পাশ থেকে ধরে রূপাকে নিজেদের বাসায় নিয়ে গেলো। রূপক ততক্ষণে মোড়ের ফার্মাসি থেকে ডাক্তার ডাকতে ছুটে গেছে।
ডাক্তার এসে জ্বর মাপলো,প্রেশার চেক করে বললো, “ওনার মাথায় জলপট্টি দিন,হাতের তালু,পায়ের তালু মুছে দিন বারবার করে। আর ওনার শরীর দুর্বল, কিছু খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিন।”

রত্না বললো, “দাদা,ভাগ্যিস মা আজকে বাসায় নেই।নয়তো রূপাকে এখানে আনা যেতো না আর ওর সেবা ও কেউ করতো না।”

কঠোর স্বরে রূপক বললো, “মা থাকলেও আমি রূপাকে নিয়ে আসতাম তোদের রুমে ও অসুস্থ হলে।কারো পরোয়া করি না আমি।”

বালতিতে করে পানি এনে রূপক রূপার মাথায় ঢালতে লাগলো। ভেজা কাপড় রত্নার হাতে দিয়ে বললো, “তুই ওর হাত পা মুছে দে।”

পান্না বললো, “তুই দে দাদা।”

রূপক হাসলো। হেসে বললো, “সেই ভাগ্য আমার হবে কি কোনো দিন? রূপা যদি জানে আমি ওর অনুমতি ছাড়া ওকে ছুঁয়েছি ওর অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে, তবে আমাকে ও খুব খারাপ মনে করবে।এমনিতেই তো আমার রেকর্ড খুব একটা ভালো না এলাকায়। সবাই আমাকে গুন্ডা ভাবে।”

রূপক হাসতে লাগলো এই কথা বলে। রত্না ছলছল দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমরা কেউ ওকে বলবো না দাদা।তাহলে তো ও জানবে না।”

রূপক হেসে বললো, “তাহলে তো সেটা তোদের খাঁটি বন্ধুত্ব হলো না।বন্ধুত্ব সবকিছুর উর্ধ্বে। আমি তোর ভাই বলে নিজের বন্ধুর সাথে বেইমানি করবি?আমি নিজের কাছে নিজে আজীবন ছোট হয়ে থাকবো যদি ওর অনুমতি ছাড়া ওকে ছুঁই।তেমনই তোরা ও থাকবি।”

রত্না কেঁদে বললো, “দাদা,রূপা যদি তোর না হয়?এতো ভালোবাসা তোর,কিভাবে থাকবি?”

রূপক বললো, “না পেলে কি ভালোবাসা থাকে না? ভাগ্যে কি আছে সেটা কে জানে!
হতেও তো পারে রূপা আমারই হবে!”

চলবে……..

রাজিয়া রহমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে