তুমি অপরূপা পর্ব-৪১+৪২

0
536

#তুমি_অপরূপা(৪১)

ফজরের আজান হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। রূপা নামাজ পড়ে বারান্দায় এসে বসেছে।অন্ধকার মিলিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে আলো ফুটছে।একটু একটু করে সময় যাচ্ছে আর একটু একটু করে সব আলোকিত হয়ে উঠছে।
সকালের এই ঠান্ডা, মধুর বাতাস রূপার দেহ প্রাণ জুড়িয়ে দিলেও রূপার বুকের ভেতর অস্থিরতা।
রাতে ঘুমানোর আগে সিরাজ হায়দার রূপাকে বলেছিলো দিনে তার সাথে কথা বলবেন কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে।
সেই থেকে রূপার মন অস্থির হয়ে আছে।

সমুদ্র বের হয়ে রূপাকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। এদিক ওদিক তাকিয়ে রূপার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “ভালো আছো অপরূপা?”

রূপা সমুদ্রের চোখের দিকে তাকালো। কি এক হাহাকার ওই দুই চোখে!
চোখ নামিয়ে নিলো রূপা।
সমুদ্র হেসে বললো, “রূপা,আমি জানি তুমি আমাকে পছন্দ কর না।আমি এটাও জানি,আমাকে পছন্দ করার সম্ভাবনা ০%
দুনিয়ার কেউ-ই এমন কাউকে ভালোবাসতে চায় না।আমি মনে হয় গুড ফর নাথিং।
আচ্ছা রূপা, ভালোবাসা কেনো ভুল মানুষের সাথে হয়ে যায় বল তো!”

রূপা কিছু না বলে উঠে চলে গেলো ঘরের ভেতরে।
সবাই একে একে উঠতে লাগলো ঘুম থেকে। দিনের আলো ফুটে গেলো পুরোপুরি।
সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো। সকালের নাশতা সেরে রূপক লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে বের হলো। রাস্তার ও পাশের ছোট্ট পুকুরে কয়েকটা ছোট ছেলে মিলে মাছ ধরছে।সেদিকে এগিয়ে গেলো রূপক।সারা শরীর ওদের কাঁদায় মাখামাখি। একটা চুনোপুঁটি ধরছে তো উৎসাহে চিৎকার করে উঠছে।
রূপক কখনো এই আনন্দ পায় নি,বিসমিল্লাহ বলে রূপক ও ওদের সাথে নেমে গেলো।
পায়ের নিচে নরম কাঁদামাটি,পা কাঁদায় ঢুকে গেছে অনেকখানি। কাঁদামিশ্রিত পানির কেমন একটা গন্ধ।রূপক চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে লাগলো।
আহা মাটির শরীর। এই নশ্বর দেহখানি ও তো এই মাটির গড়া।এই সোনার দেহ একদিন আবার এই মাটিতে মিশে যাবে।
অথচ কারো কোনো চিন্তা নেই।

মাটির দেহ নিয়ে এতো বড়াই!

সমুদ্র কিছুক্ষণ পাড়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর বললো, “নামতে ইচ্ছে করছে রে রূপক।”

রূপক বললো, “না না,নামিস না।অনেক কাঁদা।উঠতে পারবি না।তাছাড়া পানি সব কাঁদায় মাখামাখি, তুই সহ্য করতে পারবি না।”

সমুদ্র নামতে নামতে বললো, “আমি জানি রূপক,যতোই কাঁদা হোক আর যাই হোক। তুই থাকলে আমি সবকিছুতেই নিশ্চিন্ত। পরিস্থিতি যত জটিলই হোক,তুই আমাকে ঠিক মুক্ত করে ফেলবি।”

রূপক হেসে ফেললো। মনে মনে বললো, “তোর খুশীর জন্য আমি সব কিছুই করতে পারি বন্ধু।তোকে যে প্রাণের বন্ধু করেছিলাম আমি।প্রাণের দায় এড়াই কি করে! ”

সমুদ্র আর রূপক দু’জনেই কাঁদায় লুটোপুটি খাচ্ছে। এমন সময় রূপা ছুটে এলো সমুদ্রর ফোন নিয়ে।

অনেকক্ষণ ধরে ফোন বাজছে দেখে সালমা রূপাকে পাঠালো সমুদ্রের ফোন দিয়ে যেতে।
এসে দেখে দুই বন্ধু ভূত সেজে লুটোপুটি খাচ্ছে কাঁদায়।
রূপা হাসতে হাসতে মাটিতে বসে পড়লো।

তারপর সমুদ্রের পাশে দাঁড়িয়ে বললো, “আপনার কল এসেছে। ”

সমুদ্র কাঁদায় গড়াতে গড়াতে বললো, “আমার মা কল দিয়েছে? মা দিয়ে সেইভ করা নাম্বার থেকে কল আসলে কেটে ফোন অফ করে দাও।”

রূপা বললো, “না,আননোন নাম্বার। ”

সমুদ্র বললো, “রিসিভ করে লাউডস্পিকার দাও।”

রূপা তাই করলো। রিসিভ করতেই সমুদ্র সালাম দিলো।

অপর পাশে থেকে রেখার ক্রুদ্ধ স্বর ভেসে এলো।চিৎকার করে ছেলেকে বলছে,”এতো বড় স্পর্ধা তোমার? আমার কল রিসিভ কর না তুমি?
ওই সালমার বাড়িতে গিয়ে উঠেছ তুমি!
যে আমার শত্রু তার সাথে তোমার এতো মাখামাখি!
আমি তোমার পর হয়ে গেলাম?কি ভেবেছ,তুমি সালমার মেয়েকে বিয়ে করে আনবে?এতো সোজা!
সালমা কে যেমন আমি এই বাড়ির বউ হতে দিই নি,সালমার মেয়েকে ও দিব না।ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নাও এই কথাটা।”

ফোন রূপার হাতে থাকায় সমুদ্র কল কাটতে পারছে না,কিছু বলতে ও পারছে না।
রূপা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। রেখা অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে যাচ্ছে। সমুদ্র হাত পেতে ফোন নিতে চাইলে রূপা দিলো না।

রূপার কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে এসব শুনে।

অন্তরা এসেছিলো রূপার পেছন পেছন। হতভম্ব হয়ে অন্তরা ও শুনতে লাগলো সব কথা। রূপা কোনো জবাব দিতে পারলো না।কিন্তু অন্তরা চুপ থাকলো না।এগিয়ে এসে রূপার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বললো, “অনেক কথা বলছেন এতক্ষণ ধরে, সব শুনছি।আমার মায়েরে নিয়ে আর একটা খারাপ শব্দ উচ্চারণ করবেন তো আমি আপনার জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। যেই ঠোঁটে আমার মায়েরে নিয়ে নোংরা শব্দ উচ্চারিত হয় সেই ঠোঁট আমি ১০ নাম্বার সুঁই দিয়ে সেলাই করে দিব।আপনি দেখতে যতটা সুন্দর, আপনার অন্তর ততটা নোংরা। আপনার অন্তরের চাইতে সিটি কর্পোরেশনের নর্দমার পানি ও পরিস্কার আছে।নিজেরে মন পরিস্কার করেন,নয়তো ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ঘষে ঘষে আমি আপনার মন পরিস্কার করে দিমু খালা।”

রেখা হতভম্ব হয়ে গেলো এই ধরনের কথা শুনে। একটা মেয়ে তাকে এসব কথা বলতে পারলো তার ছেলের সামনে!
সমুদ্র একটা মেয়েকে দিয়ে এভাবে অপমান করালো তাকে!এতটা চেঞ্জ হয়ে গেছে তার ছেলে!

রেখা ভেবে পেলো না এটা কিভাবে সম্ভব। তার নিজেকে কেমন পাগলের মতো লাগছে।নিজের ছেলে তাকে এভাবে অপদস্ত করতে দিলো!

সমুদ্র লজ্জায় মাথা নত করে রাখলো। এই পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দিতে হয় সমুদ্রের জানা নেই।

অন্তরা আহত বাঘিনীর ন্যায় ফুঁসছে।সবাই জানে অন্তরা মুখরা,অন্তরা ঝগড়াটে,অন্তরা প্রতিবাদী।
শুধু একজনের কাছেই অন্তরা নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলো।নিজেকে বদলে নিয়েছিলো।
আর না।যে থাকার সে এই মুখরা,ঝগড়াটে অন্তরাকে মেনে নিয়েই থাকবে।

অন্তরা কিছু বলার আগে রূপক বললো, “সাবান,গামছা আর লুঙ্গি নিয়ে আয় তো অন্তরা।এক দৌড়ে যাবি।যেতে যেতে উল্টো কাউন্ট করতে থাকবি ১০০ থেকে।”

রূপকের কথার উপর কথা বলার সাহস পেলো না অন্তরা।কিছু মানুষ থাকে যারা তাদের ব্যক্তিত্ব দিয়েই অন্যকে নিজের কন্ট্রোলে নিয়ে আসতে পারে। রূপক তাদের একজন।

অন্তরা ছুটে গেলো যেই রাগ নিয়ে, ফিরে আসার পর সেই রাগ আর রইলো না।
তবুও কিছু বলতে চাইলো,রূপক সরাসরি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো অন্তরার দিকে।
অন্তরা জানে এই চোখের ভাষা। কি বলতে চাচ্ছে আর কি বুঝাতে চাচ্ছে রূপক তা বুঝে গেছে অন্তরা।

দু’জনে মিলে নদীতে গিয়ে গোসল করে এলো।এসে খেতে বসলো। খুদের ভাত আর কয়েক রকম ভর্তা করা হয়েছে।
সমুদ্র হামলে পড়লো ভর্তা ভাত দেখে।

আরাম করে খেলো সবাই মিলে। খাওয়া শেষে সমুদ্র আর রূপক দুজনেই ঘুরতে বের হলো। সালমা অন্তরা আর রূপাকে ডাকলেন।রূপার বুক কেঁপে উঠলো মায়ের ডাক শুনে।
বারান্দার মাঝখানে পাটি বিছিয়ে বসেছে সিরাজ হায়দার আর সালমা।
রূপার পেটের ভেতর মোচড়াচ্ছে।

সালমা রূপাকে পাশে বসিয়ে বললো, “রূপকরে তো জানস তুই রূপা,একই বাড়িতে থাকতি যখন তোর ভালো কইরাই চেনার কথা ওরে।রূপক আমার কতো আদরের তা আমি জানি শুধু।
মায়ের ভালোবাসা না পাওয়া ছেলেটার জন্য আমার অন্তর পোড়ে কেমন আমি জানি তা।
তোর বড় দুই বোনরে তো আমরা পছন্দ কইরা বিয় দিতে পারি নাই,ভাগ্যে আছিলো না।তোর বিয়া যদি আমরা রূপকের লগে দিতে চাই তোর কি আপত্তি আছে? ”

রূপা কি বলবে ভেবে পেলো না। এতো সহজে নিজের প্রিয় মানুষকে কাছে পেয়ে যাবে রূপা ভাবে নি।বুকের ভেতর কেমন হাতুড়ি পেটা করছে।
জীবন এতো আনন্দের লাগছে কেনো!

নদীর পাড়ে বিশাল আকারের একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ।সবুজ চিরল পাতার ফাঁক গলে আলো আসছে।
কেউ একজন এই জায়গাটা বাঁধাই করেছে। যে এই কাজটা করেছে সে যে বেশ সৌখিন সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই।
সমুদ্র আর রূপক দুজনেই বসলো ওখানে।
ঠান্ডা হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। সমুদ্র এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো, “এরকম জম্পেশ একটা খাওয়ার পর এই প্রাকৃতিক হাওয়ায় ঘুমাতে পারলে আরাম লাগতো বেশ।”

রূপক বললো, “ঘুমাবি,ঘুমা তাহলে। আমি বসে পাহারা দিই।”

সমুদ্র সাথে সাথে রূপকের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। রূপক মুচকি হাসলো। স্কুল,কলেজ এভাবেই পার করেছে সমুদ্র।সবকিছুতে রূপককে লাগতো তার।

রূপক বসে বসে সুর তুললো গানের,
“খাঁচার পাখি ছিলো সোনার খাঁচাটিতে
বনের পাখি ছিলো বনে
একদা কি করিয়া মিলন হলো দোঁহে
কি ছিল বিধাতার মনে”
বনের পাখি বলে, “খাঁচার পাখি ভাই
বনেতে যাই দোঁহে মিলে”
খাঁচার পাখি বলে, “বনের পাখি আয় খাঁচায় থাকি নিরিবিলে”………

সমুদ্র হেসে বললো, ” খাঁচার পাখি যদি খাঁচা ছেড়ে বের হয়ে আসে এবার তাহলে? ”

রূপক ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করলো, “মানে?”

সমুদ্র হেসে বললো, “কাল আমি আংকেলকে বলেছি তোর কথা। মোটামুটি পজিটিভ মনে হলো আমার। আমার মনে হয় দুই এক দিনের ভেতরেই খাঁচার পাখি তোর হয়ে যাবে।”

রূপক চমকে উঠে বললো, “মানে কি এসবের?কি বলছিস তুই?”

সমুদ্র উঠে বসে রূপকের হাত ধরে বললো, “আর কতো আমাকে ঋণী করবি তোর কাছে? ”

রূপক বুঝতে না পেরে বললো, “মানে কি?”

সমুদ্র পকেট থেকে ফোন বের করে বললো, “আমার ফোনে অনেকগুলো মেসেজ আছে। যেগুলো আমি ভাবতাম আমাকে মাহি পাঠাচ্ছে।
অথচ আমি বোকা বুঝতেই পারি নি সেটা তুই পাঠিয়েছিস।”

রূপক বিরক্ত হয়ে বললো, “আবোলতাবোল বলছিস কেনো!
আমি এসব করতে যাবো কোন দুঃখে?”

সমুদ্র সেই নাম্বারে কল দিলো। সাথে সাথে ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো। রূপক চমকে উঠলো। সিম কার্ডটা অফ করতে মনে ছিলো না।

সমুদ্র হাসতে লাগলো। রূপক বিব্রত হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। যতই যা হয়ে যাক,বন্ধুর দায়িত্ব পালন করতে রূপক কখনো ভুল করে নি।রূপার সব খবর তাই সমুদ্রকে নিজে দায়িত্বে জানিয়ে দিতো রূপক।যাতে করে সমুদ্র রূপার মনের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পায়।অথচ নিজেও রূপাকে মন দিয়ে ভালোবাসে।
মানুষের মন কতো বিচিত্র!

নয়তো কেউ কি এরকম কাজ করতে পারে?

সমুদ্র বললো, “পরশু যখন তুই আমাকে মেসেজ দিলি তোদের বাসায় যেতে,আমি মাহি মনে করে ওদের বাসায় গিয়ে হাজির হই।তারপর মাহিকে ডাকতেই মাহি বললো ও এসব ব্যাপারে কিছুই জানে না।আর ওর একটা সিম কার্ড। তখনই আমার মনে হলো তুই নয়তো।
তোদের বাসার দরজা খোলা ছিলো। ভেতরে ঢুকে সেই নাম্বারে কল দিতেই দেখি তুইকল কেটে দিয়েছিস।”

রূপক চুপ করে রইলো। তাড়াহুড়া করে সমুদ্রকে মেসেজ দিতে গিয়ে নিজের নাম্বার থেকে না দিয়ে ভুল করে ওই নাম্বার থেকে মেসেজ দিয়েছিলো।

সমুদ্র রূপকের হাত চেপে ধরে বললো, “অনেক ঋণী হয়েছি আমি তোর কাছে। এবার আমাকে কিছু করতে দে।তোদের বিয়ের সব দায়িত্ব কিন্তু আমার। ”

রূপক হাসলো। যে কঠিন লৌহ মানবীকে ভালোবেসেছে, সে কি এতো সহজে রাজি হবে?

চলবে…….

রাজিয়া রহমান

#তুমি_অপরূপা (৪২)
সময় গড়িয়ে যায় নিজের মতো করে। সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু বদলে যায়। আজকে অন্তরাদের বাড়িতে চাঁদের হাট বসেছে।
অনামিকা আর শাহেদ আজকে দেশে আসবে।সঙ্গে আসবে তাদের পুচকুটা।
সিরাজ হায়দার, সালমা,অন্তরা,অপরূপা সবাই অপেক্ষা করছে কখন আসবে ওরা।
ভিডিও কলে অনামিকার পুচকু অন্তরকে দেখে সবার যেনো আর তর সইছে না।

মশলার গন্ধে মৌ মৌ করছে চারদিকে। সালমা নানান রকম রান্না করছে।সিরাজ হায়দার অস্থির হয়ে পায়চারী করছেন।
অন্তরা গলদা চিংড়িতে হলুদ লবণ মাখছে। রূপা বেরেস্তা করছে অনেকগুলো পেঁয়াজের। পোলাও করবে সবার শেষে, পোলাওতে দিতে হবে বেরেস্তা।

সিরাজ হায়দার বের হয়ে এসে রূপাকে বললেন,”ও রূপা,দেখি সেজো জামাইকে একটা কল দিয়ে দেখ ওদের আর কতক্ষণ লাগবে আসতে?”

রূপার গাল লাল হয়ে গেলো জামাই শব্দটা শুনে।রূপকের সাথে ঘরোয়া আয়োজনের মাধ্যমে রূপার বিয়ে হয়েছে মাসখানেক আগে। এখনো রূপার কেমন লজ্জা করে রূপকের কথা শুনলে।
শাহেদদের নিয়ে রূপক আসবে ঢাকা থেকে। রূপা কল দিলো রূপককে,সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আর কতক্ষণ লাগবে আপনাদের আসতে?”

রূপক ফিসফিস করে বললো, “কেনো,মিস করছ নাকি আমাকে?”
রূপা লজ্জা পেলো শুনে।আশেপাশে মা আপা সবাই আছে।রূপা জবাব দিলো না।

রূপক আবারও ফিসফিস করে বললো, “আমার শ্বশুর এতো রসকসহীন ক্যান বউ?
এই যে আমারে আমার বউয়ের কাছে যাইতে দেয় না,তার মেয়ের ইন্টার ফাইনাল এক্সামের পর অনুষ্ঠান করার পর নাকি দু’জন এক সাথে থাকবো।আমি ও বলে দিলাম,আজকে এলে আমি ও আমার মেয়েকে ঢাকায় নিয়ে যাবো।
ব্যাটা বউ ছাড়া থাকলে বুঝবে আমার কষ্ট। ডিল হবে তার সাথে, তার মেয়ে আমার কাছে থাকবে তবেই আমার মেয়েকে তার কাছে দিবো।”

রূপা হাসতে হাসতে পিড়ি থেকে পড়ে গেলো মাটিতে। সালমা বিরক্ত হয়ে বললো, “এখন তোগো হাসনের সময়? অরা কখন আইসা পড়বো তাড়াতাড়ি হাত চালা।আমার দুইটা জামাই বিয়ার পর প্রথম বার শ্বশুর বাড়ি আইতাছে।”

অন্তরা মাথা নিচু করে চিংড়ি ভাজতে লাগলো। কেমন দম বন্ধ লাগে তার আজকাল। জীবনে এরকম একটা ভুল কেনো করলো!
আজ কি পেলো?
অথচ আজকে তো তার স্বামী ও থাকতো এই মিলন মেলায়। জুয়েলের সাথে শেষ বার দেখা হয়েছিলো অন্তরার কোর্টে।ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার দিন।
কেনো জানি ঘৃণায় অন্তরা লোকটার দিকে তাকাতে পারে নি।
বের হয়ে আসার সময় জুয়েল ফিসফিস করে বললো, “চামড়া সাদা মাইয়াগো অনেক সুবিধা। তোর মতো *** করে যদি জীবন চালাইতে কোনো অসুবিধা হয় না। এসব মাইয়াগো জামাই লাগে না।এজন্যই তো নাগর দিয়া আমারে মাইর খাওয়াইছস।আজকে নাগরেরা আসে নাই লগে?”

অন্তরার মনে হলো পুরো পৃথিবী ঘুরছে।এতো জঘন্য কথা মানুষ বলতে পারে!
এক ছুটে অন্তরা পালিয়ে এলো।

নিজের ভাবনায় মগ্ন থাকা অন্তরা খেয়াল করলো না বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিরাজ হায়দার ও মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন।
এই মেয়েটা তার বড় মেয়ে,বড় আদরের মেয়ে।বাবা হওয়ার প্রথম আনন্দ তো ওর জন্যই পেয়েছেন তিনি।

অথচ সেই মেয়েটাই আজ সবচেয়ে দুঃখী। ছোট দুই বোনের স্বামী আসবে অথচ বড় মেয়েটা একা।
একটা ভালো ছেলে কোথায় খুঁজে পাবেন তিনি?

কেউ জানে না,দিন রাত সিরাজ হায়দার শুধু অন্তরার কথা ভাবেন।মেয়েটার একটা গতি না হলে তিনি স্বস্তি পাবেন না।
কি করবেন মেয়েকে নিয়ে তিনি!

রান্না যখন শেষ পর্যায়ে প্রায় বাড়ির বাহিরে গাড়ি এসে থামলো। পড়িমরি করে সবাই ছুটে গেলো বাড়ির বাহিরে ।
সিরাজ হায়দারের বাড়িতে গাড়ি এসেছে দেখে আশেপাশের লোকজন ও আসতে লাগলো।

অন্তরকে কোলে নিয়ে রূপক বের হলো সবার আগে। সালমা হাত বাড়িয়ে নাতিকে কোলে নিলেন।নাতিকে কোলে নিতেই যেনো তার কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেলো। মনে হলো এতোদিন ধূ-ধূ মরুভূমিতে ছিপেন এখন এক পশলা বৃষ্টির সন্ধান পেয়েছেন।
এরপর অনামিকা আর শাহেদ নামলো গাড়ি থেকে। অনামিকা বাবা মা’কে জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগলো।
সবার চোখেই পানি এসে গেলো অনামিকার কান্না দেখে।

শাহেদ শ্বশুর শাশুড়ি কে সালাম করলো।

অন্তরা অন্তরকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো। বাবুর নাম অনামিকা অন্তর রেখেছে বড় বোনের নামের সাথে মিলিয়ে। অন্তরার মনে হলো অন্তর যেনো তারই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এতো মায়া লাগছে তার অন্তরের জন্য।
সালমা পোলাও বসিয়ে দিলো। সবাই মিলে কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে পোলাও হয়ে যাবে।

রান্না শেষ হতেই রূপা দ্রুত হাতে পাটি বিছিয়ে দিলো।সিরাজ হায়দার নাতিকে কোলে নিয়ে হাটছেন।অন্তর নানার গায়ের সাথে জড়িয়ে রইলো।
সিরাজ হায়দারের মনে হচ্ছে একখন্ড তুলো যেনো জড়িয়ে আছেন।কি নরম,কি আদুরে শরীর!
যেনো কত শত বছরের চেনা। যেনো আত্মার আত্মীয়।

বুক কেমন কেঁপে উঠলো। অন্তর কে ইচ্ছে করলো বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখতে।

রূপক বললো, “রূপা একটু এদিকে আসো তো,আমি হাত মুখ ধুতে যাবো।আমার জন্য একটু টিউবওয়েল চাপতে হবে।”

রূপা তৎক্ষনাৎ একটা পাতিল হাতে নিয়ে বললো, “আমার তো একটু কাজ আছে,আপনি অন্য কাউকে ডাকুন।”

রূপক ভ্রুকুটি করে তাকালো। শাহেদ হেসে বললো , “চলো আমি টিউবওয়েল চেপে দিব তোমাকে। ”

রূপক বজ্রাহতের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো
রূপা মুচকি হেসে চলে গেলো। রূপক শাহেদের পিছুপিছু কলঘরে গেলো।

শাহেদ কল চাপতে চাপতে বললো, “জ্বালা,জ্বালা!অন্তরে জ্বালা।কেমন পোড়া পোড়া গন্ধ আসছে না ভাইসাব?”

রূপক কপট রাগ দেখিয়ে বললো, “আপনি তো মিয়া বউরে বগলদাবা কইরা রাখছেন,তাই বউ থাকার পরেও ব্যাচেলর এর কষ্ট বুঝেন না।যা একটু বইরে কাছে পাওয়ার চেষ্টা করছি আপনি মাঝখানে ঢুকে গেলেন।”

শাহেদ হাসতে লাগলো রূপকের কথা শুনে। তারপর বললো, “অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়।”

রূপক বললো, “ভাইরে,আমার এখন মনের মধ্যে চৈত্রের খরা চলতেছে। এখন আমার মিষ্টি দরকার নাই, টক হইলেও চলে। ”

শাহেদ হাসতে লাগলো। হাতমুখ ধুয়ে দুজনে এসে বসলো। অনামিকা মা বোনদের সাথে বসবে বলে বসলো না।রূপক,শাহেদ,সিরাজ হায়দার বসলো।

সিরাজ হায়দারের ভীষণ আনন্দ লাগছে আজ।শুধু আফসোস একটাই আজ যদি বড় জামাই থাকতো তাহলে তার সব আশা পূর্ণ হতো।

পুরুষদের খাওয়ার পর মেয়েরা বসলো। অনামিকা এক লোকমা খেয়ে কেঁদে উঠলো। ভাতের প্লেটে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললো, “মা’গো তোমার হাতের রান্না এতো মিস করছি। নিজে যা রান্না করতাম সব কেমন ঘাস ঘাস লাগতো। ইচ্ছে হতো এক দৌড়ে তোমার কাছে চলে আসি।বেশি কিছু লাগবে না,তোমার হাতের রসুন দিয়ে ঝাল ঝাল শুঁটকি ভুনা দিয়ে এক থালা ভাত খাইতে পারি যদি তবে মনটা শান্ত হয়।এই দুনিয়ায় টাকা থাকলে সব পাওয়া যায় শুধু মায়ের ভালোবাসা পাই না গো মা।”

অনামিকার সাথে সাথে বাকিরা ও কেঁদে উঠলো।

খাওয়ার পর অন্তরা এঁটো বাসন সব নিয়ে বের হলো। বড় ঘরের সামনে আরেকটা ঘর তোলা হয়েছে রূপার বিয়ের আগে। তিন রুমের সেই ঘরের এক রুম রূপার। রূপক সেই রুমে গিয়ে শুয়ে চিৎকার করে বললো, “ফুফু একটা পান পাঠাও আমার জন্য। ”

সালমা পিরিচে করে একটা পান মিষ্টি জর্দা দিয়ে সাজিয়ে দিয়ে রূপাকে দিয়ে বললো,”যা রূপকের জন্য নিয়ে যা।যাওনের আগে গায়ের এই ছেড়া ফাঁটা জামা পালটে একটা সুন্দর শাড়ি পইরা যা।”
লজ্জায় রাঙা হয়ে রূপা বললো, “আমি যাবো না মা।অনিতারে দিয়ে পাঠাও।আমার কাজ আছে। ”

শাহেদ এসে বললো, “আমি যাচ্ছি আম্মা।”

রূপা স্বস্তি পেলো যেনো।রূপক রূপার জন্য অপেক্ষা করছে বসে বসে। শাহেদ অনামিকাকে ঈঙ্গিত দিয়ে চলে গেলো। দরজায় নক হতেই লাফিয়ে উঠে দরজা খুলতেই দেখে শাহেদ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রূপক
এর দিকে তাকিয়ে শাহেদ অট্টহাসি দিয়ে উঠলো।

তারপর বললো, “এতো তাড়া কিসের বৎস!রজনী এখনো অনেক দেরি।এখনই এতো উতলা হইও না।মেন্টাল প্রিপারেশন নাও আগে।নিজেকে প্রিপেয়ার কর,ম্যাচ এতো তাড়াতাড়ি শুরু করতে হবে না ।আশেপাশে লোকজন আড়ি পাতবে।”

রূপক হেসে বললো, “তোমার বেডরুমে আমি সিসি ক্যামেরা লাগাবো দেইখো।একবার শুধু আমার বউরে কাছে পাই,আগামী দুই দিন ঘরের দরজা বন্ধ থাকবে।”

শাহেদ হাসতে লাগলো শুনে।
একটু পর আবারও দরজায় নক হলো, রূপক দরজা খুলে চমকে উঠলো। লাল টকটকে একটা জামদানী শাড়ি পরে রূপা দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। দুই হাতে চুড়ি দুটো, মাথায় ঘোমটা।

শাহেদ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “আমার শালিকে রেখে গেলাম,সহিসালামতে রাইখো।”

এই বলে শাহেদ চোখ টিপ দিয়ে বের হয়ে গেলো। রূপার মনে হলো সে যেনো বরফের মতো জমে যাচ্ছে। শাহেদ বের হতেই রূপক রূপাকে এক টানে বুকে জড়িয়ে নিয়ে নাক ডুবিয়ে দিলো রূপার ঘন কালো চুলে।
বুকের ভেতর যে উথাল-পাতাল ঝড় ছিলো তা যেনো এক নিমিষেই থেমে গেলো।

চলবে…..
রাজিয়া রহমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে