তুমি অপরূপা পর্ব-১৭+১৮+১৯

0
563

#তুমি_অপরূপা (১৭)

ছাদের এক কোণে মন খারাপ করে বসে আছে রূপক। একটু একটু করে কখন যেনো ২ বছর কেটে গেলো। এক সময় যার সাথে আড্ডা না দিলে সময় কাটতো না আজ তার সাথে কথা নেই ২ বছর। যার সব বিপদ নিজের মাথায় তুলে নিতো নির্দ্বিধায়, তাকেই এখন সবচেয়ে বেশি অপছন্দ।
বুক ফুলিয়ে যাকে বলতো, “ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড নয় শুধু,ও আমার ভাই হয় ভাই।আমাদের দুই দেহ,এক প্রাণ। ”
কে জানতো,কোনো দিন সেই কঠিন বন্ধুত্বের সম্পর্কে ও ফাটল ধরবে?
দুই দেহ,এক প্রাণের যে আত্মার বন্ধন ছিলো তা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে,একে অপরের ছায়া ও মাড়াবে না কখনো!
কে ভেবেছে কোনো দিন এমন কিছু হবে!

রূপকের দুই চোখ জ্বালা করছে ভীষণ। রূপক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে কিছুতেই কাঁদবে না।সে তো ওর মতো নয় যে অল্পতেই ভেঙে পড়বে,ঝরঝর করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলবে।

মন খারাপের মাঝে ও হাসি পেলো রূপকের।আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, “এখনো ও কি অল্পতেই ভেঙে পড়িস ?এখন তো অবশ্য নতুন নতুন অনেক বন্ধু আছে।তাদের কাঁধে মাথা রাখিস নিশ্চয়। আমার কাঁধ না পেলেও অনায়াসেই চলে যায় তোর।শুধু আমার চলে না,আমি পারি নি কখনো কারো কাঁধে মাথা রাখতে অথবা কাউকে নিজের কাঁধে মাথা রাখতে দিতে।”

ছাদে কাপড় দিতে এসে অপরূপা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেলো। পুরুষ মানুষকে এভাবে কাঁদতে কখনো দেখে নি সে,অথচ রূপক কেমন নিঃশব্দে কান্না করে যাচ্ছে। কোনো শব্দ নেই অথচ দুই চোখে তার সমুদ্র হয়ে গেছে।

পরক্ষণেই রূপার মনে পড়লো এই লোকটা একটা যাচ্ছেতাই, ওর আরো কষ্ট পাওয়া উচিত। এক প্রকার জোর গলায় বললো রূপা,”মা’গো, পুরুষ মানুষ যে কাঁদতে কাঁদতে সমুদ্র বানিয়ে ফেলতে পারে তা আজ প্রথম দেখলাম।”

রূপকের খেয়াল হলো কাঁদবে না বলে ও সে কাঁদছে, এবং তা একটা মেয়ের সামনে। কি লজ্জাজনক ব্যাপার!

কিন্তু মেয়েটা কি বললো এটা!
সমুদ্র!

চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো রূপকের।এগিয়ে গিয়ে বললো, “পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট শব্দ সমুদ্র। আই হেইট ইট।”

রূপাকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে গটগট করে নেমে গেলো সিড়ি দিয়ে।

রূপা বিড়বিড় করে বললো, “প্রথমে তো মনে হয়েছিল আধা পাগল,এখন তো দেখছি পুরোই।”

নিচে এসে রুমে যেতেই মাহি আপার মুখোমুখি হলো রূপা। এই মেয়েটাকে রূপার তেমন একটা পছন্দ নয়।কেমন যেনো কর্তৃত্ব ফলাতে চায় সবার উপর।
এক জীবন দেখে এসেছে দাদী আর ফুফু মায়ের উপর কর্তৃত্ব দেখিয়ে মা’কে সবসময় দমিয়ে রেখেছে। সবসময় মা বাবার ভয়ে তাই তারাও মুখবন্ধ করে থেকেছে, কখনো প্রতিবাদ করতে পারে নি তবে এটুকু শিক্ষা নিয়েছে রূপা,অন্তত কখনো নিজের উপর কাউকে ছড়ি ঘোরাতে দিবে না,কাউকে ভয় পেয়ে চলবে না।নয়তো মায়ের মতো যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে।
আর ঢাকা শহরে এসে সেই প্রতিজ্ঞা আরো দৃঢ় হয়েছে।

মাহি রূপার হাত চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলো, “কই ছিলি এতোক্ষণ তুই?ছাদে ছিলি?”

রূপা ঝাটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে বললো, “হ্যাঁ ছাদে ছিলাম,কোনো অসুবিধা আছে আপনার তাতে?”

মাহি অবাক হলো রূপার এরকম কড়া জবাব শুনে।এই বাসার প্রত্যেকটা মেয়ে তাকে সমঝে চলে। আর এই গেঁয়ো মেয়ে কি-না তার সাথে গলা চড়িয়ে কথা বলছে!

কিছুটা অপমানিত বোধ করলো মাহি,সেটা রূপাকে বুঝতে না দিয়ে বললো, “রূপকের আশেপাশে যাতে তোকে আর না দেখি আমি,রূপকের আশেপাশে যাবার চেষ্টা করবি না।নাহলে দুই লাথি মেরে বাসা থেকে নামিয়ে দিবো।”

রূপা দমলো না,সাথেসাথে জবাব দিলো, “রূপা এখানে পড়ালেখা করার স্বপ্ন নিয়ে এসেছে, ছেলেদের সাথে লাইন মারার স্বপ্ন নিয়ে নয়।আর আমাকে শাসন করতে আসবেন না,তারচেয়ে আপনার রূপককে ভালো করে বুঝিয়ে দিন অপরূপার আশেপাশে যাতে না আসে।

আরেকটা কথা, এই বাসায় আমি আপনার কথা মতো উঠি নি,তাই নিজের ব্যবহার সংযত করে কথা বলবেন আমার সাথে। পরেরবার এরকম উল্টোপাল্টা শব্দ যাতে বের না হয় আপনার মুখ দিয়ে। ”

রূপা চলে যেতে নিতেই রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে মাহি বললো, “বের হলে কি করবি তুই?”

রূপা মুচকি হেসে বললো, “আপনার হিরোর তো নাক ফাটাবোই সেই সাথে আপনার ঠোঁটে সুপার গ্লু লাগিয়ে দিবো। ”

বাকি মেয়েরা সবাই হা হয়ে তাকিয়ে আছে রূপার মুখের দিকে। রূপা রুমে যেতেই রুমমেট নিপা রূপাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “উফ দোস্ত,তুই তো একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছিস আজকে।এই মাহি আপার ভীষণ অহংকার। নিজেদের বাড়ি থাকা সত্ত্বেও এখানে থাকছে তার হিরোর জন্য। কতো মেয়েকে যে নামিয়ে দিলো বাসা থেকে অযথা সন্দেহ করে। ”

রূপার নিজের ও কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে। এতোটা স্বাভাবিকভাবে জবাব দিতে পারবে তা তার ভাবনাতেও ছিলো না।

সন্ধ্যা বেলায় চা খেতে খেতে রত্না,পান্না গল্প করছিলো দাদাকে নিয়ে। পান্না হাসতে হাসতে বললো, “আপা জানিস তো,2c তে তো দাদাকে নিয়ে ঝগড়াঝাটি হয়ে গেছে এক দফা।আমার ফ্রেন্ড তমা আমাকে বললো। নতুন যেই মেয়েটা এসেছে, ওর সাথে মাহি আপার এক দফা হয়ে গেছে ঝগড়া। ”

পান্না হাসতে হাসতে বোনকে সব কিছু বললো। নিজের রুমে বসে রূপক সবটা শুনতে পেলো বোনদের কথা।

পরদিন সকালে রূপক রত্না পান্নাকে কলেজে দিয়ে আসার সময় আবারও দেখতে পেলো অপরূপা কলেজে যাচ্ছে। বোনদের দ্রুত নামিয়ে দিয়ে এসে রূপক রূপার পিছু নিলো।রূপার পিছু পিছু হাটতে হাটতে বললো, “এই যে মিস তেলতেলে বিনুনি, আপনি নাকি বলেছেন আমার নাক ফাটিয়ে দিবেন?মার্শাল আর্ট শিখেই বলেছেন না-কি না শিখে?
আপনার অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি আমি কিন্তু আরো ৭ বছর আগেই মার্শাল আর্ট শিখেছি। ”

রূপা বিরক্ত হলো রূপকের কথা শুনে।রূপকের কথা থেকে বাঁচতেই রিকশায় উঠে গেলো।

সমুদ্র দাঁড়িয়ে ছিলো একই সময়ে সেই জায়গায় যেখানে সেদিন সে কপালকুণ্ডলাকে দেখেছিলো।দাঁড়িয়ে থেকেই বুঝতে পারলো কপালকুণ্ডলা রূপকদের বাসায় থাকছে।মনটা খারাপ হয়ে গেলো মুহুর্তেই সমুদ্রের।
ঠিক করলো, দুপুরে সে দেখা করবে তার সাথে। কলেজের ড্রেস দেখেই বুঝেছে কপালকুণ্ডলা কোন কলেজে পড়ে।

দুপুরে কলেজ থেকে ফেরার সময় রূপার দেখা হয়ে গেলো গ্রামে দেখা হওয়া সেই ছেলেটার সাথে। দেখা হওয়া মাত্রই রূপা মনে মনে ভাবলো, পৃথিবীটা আসলেই গোল।নয়তো আবারও এই ছেলের সাথে দেখা হবে তা কে ভেবেছে!

সমুদ্র এগিয়ে গিয়ে রূপার পাশাপাশি হাটতে হাটতে বললো, “হাই!আমাকে চিনতে পেরেছেন?ওই যে আপনাদের গ্রামে দেখা হয়েছিলো। আপনি আমাকে সাহায্য করেছিলেন।”

রূপা বিরক্ত বোধ করলো। শহরের মানুষ এরকম গায়ে পড়ে কথা বলতে আসে কেনো!

সমুদ্র বুঝতে পারলো রূপা বিরক্ত হচ্ছে। ইতস্তত করে বললো, “আপনি মনে হয় বিরক্ত হচ্ছেন। আসলে আমি এরপরে ও কয়েকবার আপনাদের গ্রামে গিয়েছি আপনাকে খুঁজতে। কিন্তু পাই নি,আর যেহেতু আপনার নাম ও জানি না তাই খুঁজে বের করা সম্ভব হয় নি।
এজন্য আপনাকে হঠাৎ দেখতে পেয়ে ভীষণ এক্সাইটেড হয়ে পড়ি।”

রূপা শান্ত স্বরে বললো, “অতি উত্তেজনা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না।কিছু মনে না করলে আপনি এবার যেতে পারেন।”

রূপার এরকম রূঢ় ব্যবহার সমুদ্রের মন ছুঁয়ে গেলো । এমন কাউকেই তো সে খুঁজছে এতো দিন,যে বজ্রকঠিন মনের অধিকারী হবে। পরম তপস্যা করে যার মনে সমুদ্রের জন্য ভালোবাসা আনবে সমুদ্র। যে হবে ভীষণ রিজার্ভড।

রূপা খুব রাগ হলো সমুদ্রের এরকম পিছু পিছু আসা দেখে। বোনদেরকে নিয়ে যাওয়ার সময় রূপক খেয়াল করে সমুদ্র রূপার সাথে হেসে হেসে কথা বলার চেষ্টা করছে।সামনেই একটা দোকান দেখে রূপক বাইক ব্রেক করে দাঁড়ালো। তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে খেয়াল করলো, মেয়েটা সমুদ্রকে তেমন একটা পাত্তা দিচ্ছে না মনে হয়।

রূপকের ব্যাপারটা হজম হলো না। সমুদ্র এভাবে কোনো মেয়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করবে এটা রূপকের ভাবনার বাহিরে ছিলো।
রূপার বিরক্ত মুখ,কুঁচকানো ভ্রু সাক্ষ্য দিচ্ছে সমুদ্রের এই পাশাপাশি আসা সে পছন্দ করছে না।

অতি কষ্টে রূপকের হাসি পেলো। এই দিন ও তার দেখা লাগবে কখনো কি ভেবেছে!
যার সাথে এক সময় আত্মার বন্ধন ছিলো, সে ও কোনো মেয়ের কাছে এভাবে ধরাশায়ী হবে এটা ও সম্ভব!
অথচ দুই বন্ধুর পেছনে কতো মেয়েই তো ঘুরেছে,কখনো পাত্তা পায় নি।

রূপক ঠিক করলো ব্যাপারটা নজরে রাখতে হবে। যদি রূপক যা ভবছে তা হয়ে থাকে তবে কাবাবের হাড্ডি রূপক নিশ্চয় হবে।
মনের মধ্যে প্রতিশোধের এক অদম্য নেশা জেগে উঠলো রূপকের।
বোনদের রিকশায় তুলে দিয়ে রূপক বাইক রেখে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে সমুদ্রের পিছু নিলো।

প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে রূপা বললো, “আপনার ধন্যবাদ জানানো তো হয়েছে, এখনো পিছনে আসছেন কেনো?
আমি বিরক্ত হচ্ছি আপনার এরকম ব্যবহারে।”

বেশ উচ্চস্বরে কথাগুলো বললো রূপা,রূপক ও শুনতে পেলো।
মুচকি হেসে রূপক মনে মনে বললো, “বাহ,তেলতেলে বিনুনি তো একেবারে ধানিলঙ্কা। ”

সমুদ্র কিছু বলার আগেই রূপা লাফিয়ে একটা রিকশায় উঠে গেলো। রিকশায় বসে রূপা হিসেব কষতে লাগলো। সকালে যেতে ৩০ টাকা,এখন আবার ৩০ টাকা রিকশা ভাড়া একেবারে অযথাই খরচ করতে হচ্ছে। এই ছেলেগুলো এতো অভদ্র কেনো!
৬০ টাকা রূপার জন্য অনেক কিছু।

মাঝ রাস্তায় হা করে সমুদ্র তাকিয়ে রইলো রূপার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে।
এতোটাই নিমগ্ন হয়ে ছিলো যে কখন যে একটা কার তাকে ধাক্কা দিতে যাচ্ছিলো সেটাই তার খেয়ালে ছিলো না।
রূপক ঝাপিয়ে পড়ে সমুদ্রকে রক্ষা করলো দুর্ঘটনার হাত থেকে। সমুদ্রকে সরাতে গিয়ে নিজে রাস্তায় পড়ে গিয়ে হাটুর অনেকটা কে/টে যায় প্যান্ট ছিড়ে গিয়ে। কনুইয়ের চামড়া অনেকখানি উঠে গিয়ে রক্তক্ষরণ হতে লাগলো। ডান হাতের তালুর চামড়া রাস্তায় ঘষা লেগে উঠে গেছে অনেকখানি।

মুহূর্তেই অনেক মানুষ জমে গেলো সেখানে। সমুদ্র নিজেও বুঝতে পারলো না কে তাকে বাঁচিয়েছে।ভীড়ের ভেতর ঢুকে দেখতে গিয়ে দেখলো রূপক।

সমুদ্র এগিয়ে আসার আগেই রূপক উঠে দাঁড়ালো। তারপর একটা রিকশা থামিয়েয় উঠে চলে গেলো।

সমুদ্রের চোখ ভিজে গেলো হঠাৎ করেই। ভীষণ নরম মনের মানুষ হওয়ায় অল্পতেই সমুদ্রের মন খারাপ হয়ে যায়। এই যে কতগুলো দিন দুজন দু’জনকে এড়িয়ে চলছে,একে অন্যকে শত্রু ভাবছে,অথচ দুজনের মধ্যকার বন্ধুত্ব কি আদৌ নষ্ট হয়েছে!
যদি নষ্ট হতো তবে কেনো রূপক এভাবে তাকে রক্ষা করলো!
ঠিক ছোট বেলার মতো করে।
ছোট থেকেই রূপক ভীষণ ডানপিটে।মারপিট করার সময় সবার আগে তাকে দেখা যেতো যেমন, তেমন কারো বিপদেও তাকেই আগে পাওয়া যেতো।
স্বভাবে কিছুটা শান্ত, নির্ভেজাল সমুদ্রর সাথে মহল্লায় যার-ই একটু কথা কাটাকাটি হতো, রূপক আগে গিয়ে তার কলার চেপে ধরতো।
সমুদ্র যতটা মারামারি, ঝামেলা থেকে দূরে থাকতে চাইতো,রূপক ততটাই জড়িয়ে যেতো।
যখন বন্ধুত্ব ছিলো, কোথাও ঝামেলার কথা শুনলেই সমুদ্র রূপককে এটা সেটার বাহানায় সেই জায়গা থেকে অনেক দূরে নিয়ে যেতো।

সেই প্রাণের বন্ধুই কিভাবে জানের শত্রু হয়ে গেলো!

চলবে….!

#তুমি_অপরূপা (১৮)
রেশমা এক প্রকার জোর করেই বাসায় অবস্থান নিলো।জুয়েলের অকথ্য ভাষায় গালাগালি ও তাকে টলাতে পারলো না। রাগে জুয়েল যখন রেশমাকে মারতে গেলো, রানা গিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরলো। কাঁদোকাঁদো হয়ে বললো, “মা,আমি আর তুমি চলে যাবো এখান থেকে, বাবা তোমাকে বকা দেয় শুধু। ”

ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে জুয়েলের আর সাহস হলো না ছেলের সামনে রেশমাকে আর কিছু করতে বা গায়ে হাত তুলতে।এদিকে অন্তরার মুখে যেনো আষাঢ়ের মেঘ জমেছে। জুয়েল জানে এটা অন্তরার জন্য কেমন দুর্বিষহ একটা ব্যাপার। কিন্তু কি করবে সে!

ছেলের জন্য সবসময় সবকিছু মেনে নিয়েছে জুয়েল,যদি অন্তরা জীবনে না আসতো তাহলে হয়তো রেশমাকে আবারও মেনে নিতো শুধু ছেলেটার দিকে তাকিয়ে। এখন কোন দিকে যাবে জুয়েল ভেবে পেলো না!

দুপুরে রানাকে খেতে ডাকলে রানা এলো না।মায়ের সাথে খাবে বলে মায়ের গলা ধরে বসে রইলো। রেশমা মেইন দরজার পাশে এসে যে বসেছে আর উঠার নাম গন্ধ নেই।

সারাদিনের না খাওয়া রেশমার কথা ভেবে অন্তরার ভীষণ খারাপ লাগলো। যাই হোক,একজন মানুষ এভাবে বাসায় এসে না খেয়ে আছে তা অন্তরা মানতে পারলো না।
খাবারের প্লেট বেড়ে রানাকে ডেকে বললো, “রানা,প্লেট নিয়া তোমার মা’রে লইয়া ভাত খাও।”

রানা মায়ের হাতে খাওয়ার লোভে ছুটে এলো। তারপর প্লেট নিয়ে গেলো মায়ের কাছে। কোনো জড়তা না রেখে রেশমা খেয়ে নিলো।

জুয়েলের জন্য ভাত বেড়ে অন্তরা রুমে এনে দিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। জুয়েল অন্তরার হাত ধরে টেনে তুলে বললো, “আমাকে ভুল বুঝিও না অন্তু,আমি কি করবো এখন তুমি বলে দাও?আমার অবুঝ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে জোর করে ওকে বের করে দিতে ও পারছি না।তুমি যদি চাও তবে আমি রানাকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে দিই,তাহলে হয়তো ওর না চলে যাবে।”

এই কতো দিনে রানার জন্য অন্তরার মনে প্রচন্ড মায়া,ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে।রানা চলে যাবে এটা অন্তরা ভাবতেই পারছে না।আৎকে উঠে বললো, “না না,রানা কোথাও যাবে না।রানা আমার ও ছেলে,ওকে আমি যেতে দিবো না কিছুতেই। ”
জুয়েল স্বস্তি পেলো কিছুটা। রানার প্রতি যে অন্তরার বেশ ভালো রকমের টান আছে সেটা আগেই জুয়েল বুঝতে পেরেছে। সেই দুর্বলতাকেই কাজে লাগলো জুয়েল।

————–

আহত অবস্থায় রূপক বাসায় এলো। রত্না, পান্না সবেমাত্র ড্রেস চেঞ্জ করে ডাইনিং এ এসে বসেছে।এই অবস্থায় দাদাকে আসতে দেখে দুজনেই চমকে গেলো। সুস্থ একটা মানুষ এই অল্প সময়ের মধ্যে কিভাবে এরকম করলো!

দুই বোনকে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রূপক হেসে বললো, “হ্যালো হামটি,ডামটি!”

রত্না এগিয়ে গিয়ে দাদাকে ভেতরে আসতে সাহায্য করলো। পান্না জায়গায় জায়গায় এরকম কাঁটা ছেঁড়া দেখে শিউরে উঠলো।
ব্যতিব্যস্ত হয়ে দাদাকে জিজ্ঞেস করলো, “এরকম কিভাবে হলো দাদা?”

হেসে রূপক বললো, “রাস্তায় চল,একটা কারের সাথে ধাক্কা লাগিয়ে আবার দেখাবো তাইলে কিভাবে হলো। ”

রত্না কাঁদোকাঁদো হয়ে বললো, “এখনো তোমার এরকম ফাজলামো গেলো না দাদা।কিভাবে পারো এই মুহূর্তে ও এরকম চিল মুডে থাকতে, ব্যথা লাগছে না? ”

রূপক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “ব্যথা!
সে তো অনেক আগে থেকেই পাচ্ছি রে, কিন্তু কী করবো বল?”

পান্না বললো, “ব্যথার মলম লাগিয়ে দিই দাদা?”

রূপক হাসলো মিষ্টি করে। তারপর বললো, “বাহিরের ব্যথায় সবাই মলম লাগাতে চায়,মনের ব্যথার বেলায় কেনো কাউকে পাওয়া যায় না?
তাহলে তো একটা আঘাত পাওয়া মন নিয়ে বেঁচে থাকতে হতো না। ”

পান্না সুযোগ পেয়ে বললো, “একটা ভাবী নিয়ে আসো আমাদের জন্য। সে লাগিয়ে দিবে তোমার মনের ব্যথায় মলম।”

বোনের কথা শুনে রূপক হেসে বললো, “আগে তোদের বিদায় করবো। নয়তো কাল ননদী হয়ে আমার বউকে তোরা জ্বালিয়ে মারবি।”

ফাস্ট এইড এনে রত্না দাদার গায়ের কাটাছেঁড়ায় লাগিয়ে দিলো।রূপক রুমে বিশ্রাম নিচ্ছিলো তারপর শুয়ে।তন্দ্রা লেগে আসছিলো সেই সময় রত্না এসে ডেকে বললো, “দাদা,ছোট চাচা এসেছে। ”

রূপকের তন্দ্রা কেটে গেলো, এক রাশ বিরক্তি এসে ভর করলো রূপকের মনে।প্রতিবার চাচা আসে আর শুরু হয়ে যায় ঝামেলা। রূপক ভেবে পায় না মানুষ এরকম স্বার্থান্বেষী কিভাবে হয়?

নিজেকে নিজে বুঝালো মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে উত্তেজিত হওয়া যাবে না কিছুতেই।নিজেকে শান্ত করে রূপক বসার ঘরে গেলো। রূপকের চাচা সেলিম খান সোফায় বসে ঠান্ডা লেবুর শরবত পান করছেন।রূপক এসে চাচাকে সালাম দিলো।
।সেলিম খান গলা খাঁকারি দিয়ে বললো, “এই কী অবস্থা তোর?হাত পায়ের এই হাল কীভাবে?
গুন্ডামী এখনো ছাড়িস নি তুই?এতো অধঃপতন তোর!”

রূপক শান্ত স্বরে বললো, “আপনি তো এখানে থাকেন না যে আমার গুন্ডামী দেখতে হবে আপনার। এখন যদি বেশি অসুবিধা হয় তবে চোখ বন্ধ করে রাখেন চাচা।”

সেলিম খান মুখ গম্ভীর করে বললো, “আদব লেহাজ তো তোর মধ্যে কোনোদিনই ছিলো না। তাই তোর থেকে ভদ্র ব্যবহারের আশা ও করি না।যাক গে সেসব,এখন বল এভাবে আর কতো দিন? ”

রূপক না জানার ভান করে বললো, “কিভাবে চাচা?”

সেলিম খানের প্রচন্ড রাগ হলো এরকম হেঁয়ালিপূর্ণ কথা শুনে। এই ছেলেটা যে মহা ত্যাঁদড় তা তিনি জানেন।তাই ধৈর্য রেখে বললেন, “এরকম একটা জমি তো এভাবে ফেলে রাখা চলে না।ভাবনা চিন্তার ব্যাপার আছে। ডেভেলপাররা তো আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। ওই জমিতে কি না হবে বল?হাসপাতাল, শপিংমল, এপার্টমেন্ট সব হবে।এরকম সোনার খনি এভাবে ফেলে রাখার মতো বোকামি কোন পাগলে করে? ”

রূপক আগের মতো শান্তস্বরে বললো, “কোনো পাগলে করে না চাচা,সুস্থ মানুষ করে। আমি করি।”

তানিয়া অফিস থেকে ফিরে দেবরকে দেখে বুঝলেন ঘটনা কি।ছেলের দিকে না তাকিয়ে বললেন, “কি সিদ্ধান্ত নিলেন ছোট ভাই?”

বড় ভাইয়ের বউকে দেখে সেলিম খানের সাহস বাড়লো কিছুটা। মা ছেলের কোন্দলের কথা কারো অজানা নয়।সেলিম খান মন খারাপ করে বললেন, “সিদ্ধান্ত আর কি, রূপকেই তো রাজি হয় না।তা না হলে কোটি টাকার সম্পদ কেউ এভাবে ফেলে রাখে,বলেন ভাবী?”

তানিয়ার চোখ চকচক করে উঠলো। তিনি জানেন ছেলে রাজি হবে না,তবুও বললেন,”তাহলে তো ভালোই, আপনি না হয় আগামীকাল পার্টি নিয়ে আসবেন।কথা বলে ফাইনাল সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়া যাবে।এভাবে আর কতো অপেক্ষায় থাকবেন?”

রূপক উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “চাচা,ওই জমিটা আমার নামে দিয়ে গেছেন দাদা।ওটা ফুফুর ভাগের জমি।ওই জমিতে যা করার ফুফু করবে।কাউকে আমি ওই জমি থেকে এক কণা মাটি ও নিতে দিবো না।ওটা ফুফুর ওয়ারিশি সম্পদ।আর ওয়ারিশের সম্পদ না বুঝিয়ে দিলে আমার দাদাকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।তার ছেলেরা যে নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বুঝবে না তা আর দাদার অজানা ছিলো না ।”

তানিয়া ফোড়ন কেটে বললো, “আমি বুঝি না মানুষ এরকম সেন্সলেসের মতো কাজ করে কীভাবে!
এতো গুলো বছর কেটে গেলো, যে মেয়ে বাড়িতে ফেরে নি আর।বাবা মা কারো কথা যার মনে নেই,যে বেঁচে আছে কি-না তা নিয়েও সন্দেহ, তার জন্য এরকম একটা জায়গা এভাবে ফেলে রাখার কি মানে!”

রূপক মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “ফুফু বেঁচে যদি না থাকে তার ছেলে মেয়েরা আছে।কেউ না কেউ তো আছেই,এক দিন না একদিন পাবোই।সেদিন তাদের সম্পদ আমি তাদের বুঝিয়ে দিবো।কিন্তু তার আগে ওই জমি দিয়ে কারো স্বার্থ পূর্ণ করতে আমি দিবো না।আমি ভুলে যাবো কে আমার মা আর কে আমার চাচা।”

আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে রূপক নিজের ঘরে চলে গেলো। সেলিম খান ও বিরস মুখে বের হলেন বাসা থেকে।

পরদিন সকালে রূপক বাহিরে বের হয়ে বোনদের রিকশায় তুলে দিলো।তারপর এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখলো সমুদ্র বাসার উল্টো দিকে কিছুটা দূরের দোকানের সামনে বসে আছে।

রূপক ঘড়িতে টাইম দেখলো।এতক্ষণে তো মেয়েটার বের হয়ে যাবার কথা।
ভাবতে না ভাবতেই দেখলো চুলে দুই বিনুনি করে রূপা হন্তদন্ত হয়ে বের হচ্ছে। রূপক গেটের ভেতরে ঢুকে আড়ালে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলো। রূপা কিছুটা যেতেই সমুদ্র উঠে এসে রূপার পেছন পেছন হাটতে লাগলো।

রূপক এবার নিশ্চিন্ত হলো তার ভাবনা ভুল ছিলো না । হেসে বললো, “দেখা যাক সমুদ্র, তোমার লক্ষ্যে তুমি পৌঁছাতে পারো কি-না, নাকি তার আগেই তোমার লক্ষ্য অন্য কারো হয়ে যায়! ”

আজকেও সমুদ্র পিছু পিছু আসছে দেখে রূপা ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কী সমস্যা আপনার? আবার ও পিছু পিছু আসছেন কেনো?”

সমুদ্র থতমত খেয়ে বললো, “মানে,আপনার ওই ওড়নাটা আমার কাছে তো,ওটা কি ফেরত দিবো আপনাকে তা জিজ্ঞেস করতেই এলাম।”

রূপা বিরক্ত হয়ে বললো, “আমি গ্রামের মেয়ে হতে পারি,তবে এরকম খোঁড়া অযুহাত আমার গ্রামের ছেলেরা ও দিতো।তাদের চোখেই ফুটে উঠতো তাদের মনের ভাষা।”

সমুদ্র হেসে বললো, “না আমি তেমন না।তবে কেনো জানি আপনার সাথে বন্ধুত্ব করতে ইচ্ছে করছে। ”

রূপা দৃঢ় কণ্ঠে বললো, “আমি যদি আর কোনো দিন আপনাকে এভাবে আমার পিছু নিতে দেখি তবে আমি লোক জড়ো করে বলবো আপনি আমাকে টিজ করছেন।দয়া করে আর কখনো এরকম করতে আসবেন না আমার সাথে। ”

সমুদ্র হাহা করে হেসে বললো, “আপনি তো ভীষণ কঠোর মেয়ে।মেয়েরা না-কি নরম মনের হয়,আপনার মনটা এতো শক্ত কেনো?লোহার না-কি? ”

রূপা ক্রুদ্ধ স্বরে বললো, “ইস্পাত দিয়ে তৈরি। ”

সমুদ্র রূপার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো, “সেই ইস্পাতকে গলিয়ে ভালোবাসার সমুদ্রে রূপান্তর করার দায়িত্ব না হয় আমি নিলাম কপালকুণ্ডলা। ”

রূপা কিছু বলার আগেই সমুদ্র চলে গেলো উল্টো দিকে।
রূপা বিড়বিড় করে বললো, “আমি বাবাকে কথা দিয়েছি,বাবাকে দেওয়া কথা আমি রাখবো । ”

চলবে…..

#তুমি_অপরূপা (১৯)
অন্তরার সকাল হলো বুকে পাথর চাপা কষ্ট নিয়ে। রেশমাকে কিছুতেই তাড়িয়ে দেওয়া যায় নি তার এক কথা, হয় রানাকে দিতে হবে তা না হলে সে ও এখানেই থাকবে।
কিন্তু রানা চলে গেলে অন্তরা কিভাবে বাঁচবে!
জুয়েল অফিসে গেলে অন্তরার সময় কেটে যায় রানাকে নিয়ে। রানা যদিও তাকে মা বলে ডাকে না,তবুও অন্তরা বিশ্বাস করে একদিন রানা তাকে মা বলে ডাকবে।

এক দিন রানা আসায় অন্তরার ভীষণ রাগ হয়েছিলো অথচ এখন রানাকে ছাড়া একটা মুহূর্ত ও অন্তরা ভাবতে পারে না। কিছুতেই রানাকে যেতে দিতে পারবে না অন্তরা।রানা চলে গেলে জুয়েল ও ভেঙে পড়বে অন্তরা জানে।
কিন্তু এভাবে কিভাবে চলবে!
রেশমাকে যদি এখানে আবারও জায়গা দিতে হয়!

না,ভেবে পায় না অন্তরা।

দরজা খুলে বাহিরে এসে দেখে রেশমা রান্নাঘরের গতরাতের সব ধুয়েমুছে রেখেছে। ঝুড়িতে থাকা জুয়েলের ময়লা কাপড় ও রেশমা ধুয়ে রেখেছে।
অন্তরার ভীষণ কষ্ট হলো এসব দেখে। এটা তো তার সংসার। রেশমা এতে হস্তক্ষেপ করছে কেনো!

রেশমা নিজের প্ল্যানমতন আগাচ্ছে। অন্তরাকে দেখে মিষ্টি করে হেসে বললো, “আমার উপর রাগ করে থেকো না বোন।আমার মতো অসহায় আল্লাহর দুনিয়ায় আল্লাহ আর কাউকে না করুক।ভাইবো না,তোমার সংসার আমি কাইড়া নিমু না।তোমার স্বামী, সংসার তোমারই থাকবো।আমি শুধু আমার পোলাটারে লইয়া যাইতে চাই। এই পোলার লাইগা আমি সব ছাইড়া ফিরা আইছি।”

অন্তরার চোখ টলটলে হয়ে গেলো শুনে।রানাকে কিভাবে দিবে সে!
আস্তে করে বললো, “রানার বাবা যে বাঁচবে না রানাকে ছাড়া। ”

রেশমা হাউমাউ করে কেঁদে বললো, “আমি কি করমু বইন তুমি কও,তুমি আমার মায়ের পেটের বইন মানলাম,আমার আর কেউ নাই এই দুনিয়ায়। নিজের বাপ মা ও জায়গা দেয় না,যাওয়ার জায়গা নাই। এই পোলা ছাড়া এতো বড় দুনিয়ায় আমার কেউ নাই। তুমি রানার বাপেরে একটু বুঝাও। আমি তোমাগো কাম কইরা খামু,কামের বেটির মতো থাকমু। শুধু আমারে মাথা গোঁজার ঠাঁই দাও, এই খানেই ফ্লোরে থাকমু আমার পোলারে বুকে লইয়া। কোনো ঝামেলা করমু না।তুমি আমার ধর্মের বইন,তোমার দুই পায়ে ধরি আমি।”

অন্তরাকে হতভম্ব করে দিয়ে রেশমা সত্যি সত্যি ওর দুই পা চেপে ধরে কেঁদে উঠলো।
অন্তরা নিজেও বুঝতে পারলো না সে এখন কি করবে।
রেশমার কান্নায় অন্তরার ও কষ্ট হতে লাগলো। আবেগের বশে অন্তরা সবচেয়ে বড় ভুল করলো। দ্রবীভূত মনে জুয়েলকে বুঝিয়ে বলার সিদ্ধান্ত নিলো।

আজকের আকাশ স্বচ্ছ কাঁচের ন্যায়। একেবারে ঝকঝকে তকতকে একটা সকাল।রোদের ও তেমন একটা তেজ নেই।এই নরম আলোরএকটা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। নিজেকে কেমন স্বাধীন স্বাধীন আত্মবিশ্বাস এনে দেয়।মনে হয় যেনো মুক্ত পাখি,যেখানে ইচ্ছে উড়ে যেতে পারবে।
রূপার কেমন জানি আজকে খুব ঘুরাঘুরি করতে ইচ্ছে করছে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছে কি করা যায়।

কিছুতেই মন টানছে না আজ কলেজে যাবার জন্য।

রূপাকে বের হতে দেখে উপরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা পান্না ছুটে গেলো বোনের কাছে,উত্তেজিত হয়ে বললো, “ভাবী নেমেছে আপা,যাচ্ছে উনি।”

ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দুই বোন পড়িমরি করে ছুটে গেলো। এতো দিনে তাদের দাদা একটা মেয়েকে পছন্দ করেছে, তার সাথে বন্ধুত্ব করতে বলেছে বোনদেরকে।দুই বোনের কাছে দাদার আদেশ যে শিরোদার্য।
গতকাল রাতে রুপক বোনদের রুমে যায় এক বক্স চকলেট নিয়ে।

দুই বোন তখন পড়া শেষ করে সবেমাত্র উঠেছে। রূপক চকলেট নিয়ে বললো, “নে মিষ্টি মুখ কর।একটা সুখবর আছে। ”

দুই বোন লাফিয়ে বিছানায় উঠে দাদার দুই পাশে বসে বললো, “কি সুখবর দাদা,বল না।”

রূপক হেসে বললো, “তোদের জন্য তো ভাবী ঠিক করে ফেলেছি আমি। তোরা তোদের ভাবীর সাথে আগামীকাল থেকে একইসাথে কলেজে যাবি,আবার একই সাথে ফিরবি।”

রত্না,পান্না একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো দাদার কথা শুনে।
এতোটা ছাড় দিচ্ছে দাদা তাদের!

পান্না দাদার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, “মেয়েটা কে দাদা বল না?নাম কি?”

“অপরূপা, তার নাম অপরূপা। যেই মেয়েটি পাশের ফ্ল্যাটে নতুন এসেছে, মনে আছে তোদের?
সে-ই। দেখ,আমাদের নামের ও কতো মিল!
ও রূপা আর আমি রূপক!”

দুই বোনের আনন্দ আর ধরে না।ফাইনালি কেউ ওদের ভাবী হবে।দাদা কাউকে পছন্দ করেছে মানে সে ই হবে দাদার বউ।রগচটা, ঘাড়ত্যাড়া রূপককে সবাই জানে,সে যা চায় তা তারই হয়।

রত্না পান্না ছুটে গিয়ে রূপার দুই পাশে দাঁড়িয়ে বললো, “হ্যালো, আমি রত্না আর ও পান্না।”

রূপা এদের চেনে,সবসময় দেখে আসা যাওয়ার সময়। কখনো কথা হয় নি।
আজ ওরা আগ বাড়িয়ে কথা বলায় কিছুটা অবাক হলো । আস্তে করে বললো, “আমি অপরূপা। ”

পান্না বললো, “তোমার নামটা খুব সুন্দর। একেবারে তোমার মতো সুন্দর একটা নাম।”

রূপা বিব্রত বোধ করলো।

রত্না বললো, “তুমি আমাদের বন্ধু হবে?আমরা একই সাথে কলেজে আসা যাওয়া করবো তাহলে। যদিও আমি সেকেন্ড ইয়ারে আর পান্না ফার্স্ট ইয়ারে তোমার সাথে । ”

এদের এই আগ বাড়িয়ে বন্ধু হতে চাওয়া রূপার কেমন যেনো লাগলো। বিড়বিড় করে বললো, “না মানে,তোমরা তো প্রতিদিন তোমাদের ভাইয়ের সাথে যাও,আসো।উনি কিছু বলবে না?”

পান্না উত্তেজিত হয়ে বললো, “আরে,দাদাই তো আমাদের বলেছে তোমার সাথে….। ”

রত্নার চোখ রাঙ্গানির দিকে তাকিয়ে পান্না আর কথা শেষ করতে পারলো না। আমতাআমতা করে বললো, “মানে দাদা বলেছে আর কি আমাদের যদি কোনো মেয়ে বান্ধবী থাকতো, এক সাথে আসা যাওয়ার সুযোগ থাকতো তাহলে আর তার যাওয়া লাগতো না।”

শুনে রূপা আশ্বস্ত হলো। তারপর রত্না বললো, “চলো যাই কলেজে,সময় হয়ে যাচ্ছে ক্লাসের।”

কোথাও যাওয়ার প্ল্যান বাদ দিয়ে রূপা ওদের সাথে হাটতে লাগলো। কিছুটা যেতেই দেখলো সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছে হাতে একটা সাদা গোলাপ ফুল।
রূপা বিরক্ত হলো। তবে খুশি ও হলো এই ভেবে যে আজকে এই দুজন সাথে থাকলে সমুদ্র আর কিছু বলতে পারবে না।

হলো ও তাই।সমুদ্র যখন দেখলো রত্না আর পান্না রূপার সাথে যাচ্ছে, কিছুটা লজ্জা পেলো সে।রত্না পান্না দুজনেই তার কাছে ছোট বোনের মতো। তাদের সামনে একটা মেয়েকে ফুল দেওয়ার মতো সাহস তার নেই।

অগত্যা ফুল হাতে নিয়ে অসহায়ের মতো পেছন থেকে তাকিয়ে রইলো সমুদ্র।
সমুদ্রের থেকে কিছুটা দূরে ঠোঁটে বিজয়ীর হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে রূপক। সে তো এটাই চেয়েছিলো।

সমুদ্রের ভাঙা মন রূপকের উল্লাসিত হবার কারণ।

মনে মনে রূপক বললো, “কেমন লাগছে এবার সমুদ্র! প্রেম কি কঠিন জ্বালার জিনিস, কতো ছটফটিয়ে ম/রার জিনিস তোমাকে আমি বুঝাবো। খুচরো পয়সার মতো একটা একটা করে তোমাকে আমি বুঝাবো।
তারপর বুঝবে তুমি, যেই আঘাত আমাকে দিয়েছিলে সবটা হাড়ে হাড়ে টের পাবে।সামান্য কারণ নিয়ে বন্ধুত্ব ছিন্ন করেছিলে,আরো কষ্ট পাওয়া বাকি আছে। ”

চলবে……

রাজিয়া রহমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে