তুমি অপরূপা পর্ব-১+২

0
921

রাজিয়া রহমান
#তুমি_অপরূপা(০১)

স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় অপরূপা জানতে পারলো বড় আপা অন্তরা নাকি কোনো ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে। ফুফাতো বোন মিতা হেসে বললো, “তোদের রক্তে মনে হয় এই নোংরা ব্যাপারটা আছেরে অপরূপা। দেখ না, তোর মা ও তো এভাবে পালিয়ে বিয়ে করেছে মামাকে। সেই মায়ের মেয়ে তোরা,তুই ও এরকমই করবি।”
রূপার ইচ্ছে হলো একবার বলে, “তাহলে তো তুই ও তোর বাবার মতো তিন বিয়ে করবি।” কিন্তু বললো না রূপা।কাউকে এভাবে অপমান করা রূপার ধাতে নেই।
খবরটা শুনেই রূপার চোখের সামনে ভেসে উঠলো মায়ের রক্তাক্ত দেহ।বাবা নিশ্চয় মা’কে ভীষণ মেরেছে এই খবর শোনার পর। রূপার বাবার ধারণা যেখানে যেই অঘটন ঘটে সব কিছুর জন্য রূপার মা সালমা দায়ী। আর বাবাকে ইন্ধন যোগাতে ফুফু আর দাদী তো আছেই।
রূপার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো,প্রচন্ড তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে এলো।ওড়না বড় করে মাথায় টেনে দিলো রূপা।তবুও পথে যেই রূপাকে চিনতে পারলো সেই বললো,”কিরে অপরূপা। তোর বড় বোইন কই?পোলাডা কে রে?”
রূপা জবাব না দিয়ে দ্রুত পা চালালো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
মিতা মজা পাচ্ছে ভীষণ। অপরূপা আর মিতা দুজনেই একই ক্লাসে পড়ে। মিতার বাবা মোজাম্মেল তৃতীয় বিয়ে করার পর মিতার মা বাবার বাড়ি চলে এসেছে মেয়েকে নিয়ে আরো দশ বছর আগে। সেই থেকে আর ওই বাড়ির সাথে তাদের বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই। গতবছর মিতার বাবা মারা যাওয়ার পর সম্পর্ক হওয়ার শেষ সূত্র ও ছিন্ন হয়ে গেলো।
বাড়ি এসে রূপা দেখলো মা রান্নাঘরের খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। ছোট বোন অনিতা মায়ের শাড়ির আঁচল ধরে কান্না করছে তাকে ৫ টাকা দেয়ার জন্য। রাস্তার মাথায় রূপা আইসক্রিমওয়ালাকে দেখে এসেছে। বুঝতে পেরেছে অনিতা আইসক্রিম খাওয়ার জন্য টাকা চাইছে মায়ের কাছে।
রূপা জানে তার মা কপর্দকহীন,একটা পয়সা ও তার কাছে নেই।
রূপার বাবা সিরাজ হায়দারের বাজারে একটা মুদি দোকান আছে। তার একার আয়ে ৯ সদস্যের বিশাল সংসার চলে। তিনবেলা ৯ জন খেতে গেলে হিসেব করলে ২৭ প্লেট দৈনিক খাবার লাগে তাদের।পরিবারের ব্যয় অনুরূপ আয় নেই তার।পুরুষ মানুষের হাতে টাকা পয়সা যতো কমতে থাকে তার মেজাজ তত বাড়তে থাকে।
রূপার বাবার অবস্থা ও তেমন। তার দোকানের পাশেই বড় একটা মুদি দোকান দিয়েছে গ্রামের সাদেক আলী। ৮ বছর সৌদি আরব থাকার পর দেশে এসে বাজারে বড় করে মুদি দোকান দেয়ার পর রূপার বাবার দোকানের বিক্রি-বাট্টা কমতে শুরু করে।
রূপারা ৪ বোন,তার সাথে মিতার পড়াশোনা, জামাকাপড়, খাওয়াদাওয়া সব কিছুর যোগান দিতে সিরাজ হায়দারের নাকানিচুবানি অবস্থা এখন।

রূপা ব্যাগ থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে অনিতার হাতে দিয়ে বললো, “যা,দুইটা আইসক্রিম আনবি।একটা তোর আর আরেকটা মেজো আপার জন্য।যা গরম পড়ছে,আপা ঘেমে গেছে হয়তো পড়ার টেবিলে।”

অনিতা টাকা নিয়ে ছুটতে ছুটতে গেলো। মিতা সালমা বেগমের হাত ধরে বললো, ” অন্তরা আপা না-কি পালাইয়া গেছে মামী?ঘটনা কি সত্যি না-কি? এজন্য আপনে এরকম তব্দা মাইরা রইছেন মামী?”

সুরাইয়া বেগম রূপার দাদীর নাম।বারান্দায় বসে বসে সুপারি কাটছেন।মিতার কথা শুনে বললেন,”ঠিকই আছে,আল্লাহর বিচার আল্লাহ করছে।মা’র যেমন লাজলজ্জা আছিলো না, আমার পোলার গলায় ঝুইলা পড়ছে মাইয়া ও হইছে তেমন। গাভী যেমন, বাছুর তো তেমনই হইবো।”

মিতা হাসতে হাসতে ঘরের দিকে চলে গেলো। সালমা বেগম সবার অলক্ষ্যে চোখ মুছলেন।
একটু পর অনিতা এলো আইসক্রিম নিয়ে,অনিতার হাতে আইসক্রিম দেখে সুরাইয়া বেগম ডাক দিলেন অনিতাকে।একটা আইসক্রিম অনিতার থেকে নিয়ে মিতাকে ডাক দিলেন।
ক্রুদ্ধ হয়ে অনিতা বললো, “এইটা কি হইলো দাদী,আপনে আমার থেকে নিছেন নিজে খাইবেন বলে। এখন মিতা আপারে দিলেন ক্যান?আমার আইসক্রিম দেন আমারে,আমি এটা অনামিকা আপার জন্য আনছি।”

সুরাইয়া বেগম খেঁকিয়ে উঠে বললেন,”মুখপোড়া মাইয়া,বান্দর কোনহানকার। আমার নাতনি স্কুল থাইকা কতো কষ্ট কইরা আইছে তা চোখে পড়ে না তোর?মা মাইয়া ৫ জন মিইল্লা আমার পোলারে ধ্বংস করার জন্য বইসা রইছে।আমার নাতনিরে পথের কাঁটা ভাবে। ভালোমন্দ কিছু খাইতে দেয় না।আল্লাহর বিচার আল্লাহ করে ঠিকমতো। ”

সালমা উঠে এসে অনিতার পিঠে ধুমধাম কয়েকটা কি/ল বসিয়ে দিলো।যার ফলে অনিতার আইসক্রিম মাটিতে পড়ে গেলো। মুহুর্তের মধ্যে অনিতা তারস্বরে চেঁচাতে লাগলো। মায়ের হাতে পি/টুনি খেয়ে অনিতার অভ্যাস আছে, অনিতা কান্না করছে তার আইসক্রিমের জন্য।কতো দিন পরে আজ আইসক্রিম খেতে পেলো তাও খাওয়া হলো না দাদীর জন্য।
১০ বছর বয়সী অনিতার কাছে এর চাইতে শোকের আর কিছু নেই।বাড়িতে যে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেলো সেসব নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই।

মিতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খেতে খেতে হাসতে লাগলো অনিতার দিকে তাকিয়ে। অনিতাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগলো, “আহ!কি যে স্বাদ। এতো ভালো লাগতাছে আইসক্রিমটা!”

এসব শুনে অনিতার বুক ফেটে কান্না এলো। মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদতে লাগলো অনিতা।

রূপা ঘরে ঢুকে অনামিকার পাশে গিয়ে বসলো। সামনে ইন্টার পরীক্ষা অনামিকার।অনামিকা পড়তে বসেছে। অপরূপা গিয়ে বোনের কাঁধে হাত রাখতেই অনামিকা নিঃশব্দে কেঁদে উঠলো। অপরূপা ও কাঁদতে লাগলো নিঃশব্দে। বাহিরের কেউ জানতে পারলো না ঘরের ভেতর দুই বোন অঝোরে কান্না করছে।

অপরূপার চোখ মুছে দিয়ে অনামিকা বললো, “আব্বা আজকে আম্মাকে আস্ত রাখবে না রূপা।আম্মার জন্য আমার ভীষণ ভয় হয়।”

অপরূপা ভয়ার্ত স্বরে বললো, “আপা কার সাথে গেছে রে আপা?আমরা একই সাথে, একই বিছানায় শুয়েও কিছুই টের পাই নি কেনো?”

অনামিকা দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে খুঁটতে বললো,”আমিও তো সেটাই ভাবছি রূপা।আর ছেলেটা কে তাও তো জানি না। ”

রূপা স্কুল ড্রেস চেঞ্জ করে সবে খাবারঘরে গিয়ে ভাত দুই লোকমা মুখে দিলো। সেসময় শুনতে পেলো বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে সিরাজ হায়দার হুংকার দিয়ে বলছেন,”অন্তরার মা!”

বাবার চিৎকার শুনে রূপার হাত থেকে ভাতের প্লেট পড়ে গেলো মাটিতে।কতোগুলো ভাত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো চারদিকে।
সালমা বেগম স্বামীর ডাক শুনে ছুটে এসে খাবার ঘরে লুকালেন।মেয়েকে খাবার ঘরে দেখে কিছুটা লজ্জা পেলেন সেই সাথে ভয়ে আপনাতেই তার চোখের জল চলে এলো। আজ তাকে কে রক্ষা করবে?

সুরাইয়া বেগম ছেলেকে দেখেই কেঁদে উঠে বললেন,”বাবারে,তুই আইছস?সব্বনাশ তো কইরা দিছে তোর মুখপুড়ি মাইয়া।সব তোর বউয়ের দোষ। মাইয়ারে সে চোখে চোখে রাখতে পারলো না। আর বুঝি মুখ দেখানো যাইবো না কাউরে।”

সিরাজ হায়দার আবারও হুংকার দিয়ে বললেন,”সালমা…..”

চলবে……..

#তুমি_অপরূপা (০২)
সিরাজ হায়দারের ডাক শুনে মিতার মা সুরভি বের হয়ে এলো ঘর থেকে।ভাইয়ের বউকে তাদের কারোরই বিশেষ পছন্দ নয়।এজন্য ভাই যখন ভাবীকে বকাঝকা বা মা/রধোর করে তখন একটা প্রশান্তি অনুভব করে সুরভি। দুই কলম লেখাপড়া করেছে বলে সবসময় অহংকার নিয়ে থাকে সালমা।আশেপাশের বাড়ির মহিলারা বাড়িতে আসলে সুরাইয়া বেগম আর তার মেয়ে সুরভি যখন কার কোথায় কি হলো,কে কি করলো সেসব আলোচনায় ব্যস্ত সালমা তখন অবসর থাকলে বসে বসে কাঁথা সেলাই করে। কতো দেমাগি হলে সবাই ডাকাডাকি করার পরেও গিয়ে বসে কথা বলে না!
উল্টো জ্ঞান দেয় এসব না-কি গীবত করা,নিজের পাপের পাল্লা ভারী করা। এসব শুনলে সুরভির মেজাজ ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তারা তো আর বানিয়ে মিথ্যা বলছে না।বরং কেউ কোনো দোষ করলে সেসব একজনকে অন্যজন জানাচ্ছে, আলোচনা করছে।এর জন্য কিসের গুনাহ?

প্রচন্ড গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। মাঠঘাট ফেটে চৌচির। বৃষ্টির জন্য আহাজারি চারদিকে।সুরাইয়া বেগম বারান্দায় শীতল পাটি বিছিয়ে বসেছেন সুপারি কাটতে।এই শীতল পাটি তার নিজের হাতে বানানো। পাটিবেত কেটে এই শীতল পাটি বানিয়ে বিক্রি করেন সুরাইয়া বেগম। মিতার জন্য টাকা জমাচ্ছেন।নগদ দেড় লক্ষ টাকা হয়েছে তার জমিয়ে জমিয়ে।সেই কথা ঘুণাক্ষরেও ছেলেকে জানান নি তিনি।তিনি আর তার মেয়ে ছাড়া কেউ জানে না।

সুরভি মায়ের পাশে বসতে বসতে বললো, “আজকে খুব শিক্ষা হইবো ভাবীর।”

সুরাইয়া বেগম মেয়েকে এক খিলি পান বানিয়ে দিয়ে বললেন,”ঠিকই আছে।বেহায়া মাইয়া মানুষ, নিজে যেমন মাইয়া ও বানাইছে তেমন। আজকে তো হেই শয়তানি মাইয়া ও নাই,ভাগছে নাগর লইয়া।আজকে কে বাঁচাইতে আইবো মা মা কইরা দেখমু।”

সিরাজ হায়দার বারান্দায় বসে ঘেমে জবজবে শরীর থেকে শার্টটা খুললেন।তারপর ঘরের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বললেন, “সালমা নাই নি ঘরে? জবাব দেও না ক্যান?বাইরে আসতে বলছি না আমি?”

রূপা খাবার প্লেট রেখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের ফর্সা মুখখানা ফ্যাকাশে লাগছে আজ ভীষণ। বড় আপা থাকলে তো আপা প্রতিবাদ করে, বাবার সামনে গিয়ে মা’কে আড়াল করতে যায়।আপা যতবার মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে বাবা ততবার হাতের লাঠি ফেলে দিয়েছে। কিন্তু আজ কি হবে?
শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছে সালমা বের হয়।সিরাজ হায়দার স্ত্রীকে দেখে বললেন, “কই ছিলা?এতো বার ডাকা লাগছে কেনো?”

সালমা জবাব দিতে পারলেন না।সিরাজ হায়দার বললেন,”একটা পাখা দিয়া যাও আর এক গ্লাস লেবুর শরবত বানাও আমার জন্য। আর শুনো,শরবতে চিনি দিও না।একটু নুন দিয়া বানাইলেই হইবো।সবকিছুর দাম যেভাবে বাড়তেছে।চিনির দাম কতো এখন জানো?শা**লা বাঁইচা থাকন এখন মস্ত বড় অন্যায়।”

সালমা দৌড়ে খাবার ঘরে ঢুকে গেলেন।বলা যায় এক প্রকার পালিয়ে বাঁচলেন তিনি।সুরাইয়া বেগম আর সুরভি কিছুটা মনোক্ষুণ্ণ হলেন।তারা ভেবেছিলেন কি আর হলো কি!
তবে কি সিরাজ হায়দার এখনো কিছু শুনেন নি?

ভাইকে উসকে দিতে সুরভি বললো, “ঘটনা শুনছেন ভাইজান?”

সিরাজ হায়দার পাখা ঘুরাতে ঘুরাতে বললেন,”কিসের ঘটনা? ”

সুরভি আমতাআমতা করে বললো, “আপনার বড় মাইয়া অন্তরা তো এক পোলার লগে ভাইগা গেছে শুনেন নাই?সারা গ্রামের মানুষ ছি ছি করতেছে।আর আপনি কিছু জানেন না?”

সুরাইয়া বেগম ফোড়ন কেটে বললো, “ও জানবো কেমনে?আমার পোলা কি ঘরে বইসা থাকে?খাটতে খাটতে আমার সোনার চান কেমন শুকাইয়া গেছে। যাগোরে ভালো রাখনের লাইগা কলুর বলদের মতন আমার পোলা কাম করে তারা তো সেই খাটনের দাম দেয় নাই।আমার পোলার মান সম্মান আর রাখলো না।কেমন মা হইলে মাইয়া নাগর লইয়া পালাইয়া যায় বুঝছ না তুই?মা’র লগে যোগসাজশ কইরাই মাইয়া এই কাম করছে।মা যেমনে আমার পোলার লগে পালাইয়া আইছে মাইয়ারেও তেমন বুদ্ধি দিছে পালানোর।ভালা কইরা একটা মা/ইর দিলেই দেখবি তোর বউ গড়গড় কইরা সব কথা কইবো। ”

সিরাজ হায়দার বাজারে থাকতেই খবর পেয়েছেন। এতো দিন যারা তার দোকানে মুখ ও দেয় নি আজ তারাও তার দোকানে একটা সিগারেট নেয়ার জন্য,একটা সাবান নেওয়ার জন্য এসে জিজ্ঞেস করে, “হায়দার ভাই,পোলাডা কেডা?
আগে কেউ টের পায় নাই মাইয়ার যে আরেক পোলার লগে চক্কর আছিলো?
মাইয়ার মা’র তো জানার কথা, মা-রা সবসময় বাড়িত থাকে। মাইয়াগো এজন্যই পড়ালেখা করান উচিত না এতো বেশি।”

এসব কথা সহ্য করতে না পেরেই সিরাজ হায়দার বাড়ি চলে এলেন।লজ্জার চাইতে বুকে কষ্ট জমাট বেঁধেছে বেশি তার।
মায়ের কথা শুনে সিরাজ হায়দারের মাথা গরম হয়ে উঠতে লাগলো। সালমা এনে শরবত দিলো।শরবত নিতে গিয়ে সিরাজ হায়দার বউয়ের দিকে এক মুহূর্ত তাকালেন।এক মুহূর্ত তাকিয়েই দেখলেন ভীত চোখে ফুটে উঠেছে কেমন আতংক।
সিরাজ হায়দার শরবত শেষ করে মা’কে বললেন,”সবই আমি শুনছি মা।তবে মা,সবসময় সবকিছুতে সালমাকে জড়াইও না।
আর তুমি তো এখন খুশি। খাওনের একটা মুখ কমছে।তোমার সোনার টুকরা ছেলের উপর থেকে একটু চাপ কমছে।নয়তো দেখো না,এই মেয়েকে বিয়ে দিতে গেলেও তো আমার কতোগুলো টাকা খরচ হতো। ”

সুরাইয়া বেগম বুঝতে পারলেন না ছেলে তাকে কটাক্ষ করে কথা বলছে না-কি।

সালমা যেনো হতবাক হয়ে গেলো স্বামীর কথা শুনে। তেমনই হতবাক হয়ে গেলো তার মেয়েরা।রূপা ভাতের থালা রেখে বের হয়ে এলো।গিয়ে অনামিকা আর অনিতার কাছে গেলো। সিরাজ হায়দার ঘরে যেতেই সালমা গেলো পিছন পিছন। সিরাজ হায়দার গিয়ে মেয়েদের পাশে বসলেন।অনিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন।তারপর হঠাৎ করেই কাঁদতে লাগলেন।
তার বুকের ভেতর কেমন তোলপাড় করছে তা কাকে বুঝাবেন তিনি!
বাড়ি ফিরে আর আদরের বড় মেয়ের মুখখানা দেখবে না,মেয়েরা ঘুমিয়ে গেলে আড়াল থেকে দেখতেন তিনি তা কেউ জানে না।মাঝেমাঝে হাতে টাকা এলে মেয়েদের অগোচরে মেয়েদের স্কুল ব্যাগে টাকা রেখে দিতেন।
আজ তার জোড়ের পাখি থেকে একটা পাখি উড়ে গেলো।
মেয়েদের সাথে কখনো নরম স্বরে কথা বলেন নি তিনি। অথবা মেয়েরা কখনো বাবার সাথে খুব কথা বলতো না।তবুও মেয়েদের প্রতি বাবা হিসেবে ভালোবাসা কম ছিলো না তার।অভাব অনটনে থেকেও কখনো মেয়েদের পড়ালেখা বন্ধ করতে চান নি তিনি।
কখনো ভাবেন নি এভাবে তার মেয়ে কারো হাত ধরে পালিয়ে যাবে।

চোখের পানি মুছে মেয়েদের উদ্দেশ্যে বললেন,”তোমরা বড় হইছো,নিজেগো ভালো মন্দ নিযেরা বুঝতে শিখছো বা বুঝতে শিখবা।তোমাগো বোইনের মতন যদি তোমাগো ও কাউরে কোনো দিন মনে ধরে, তবে এভাবে আমার বুক খালি কইরা চইলা যাইও না।আমারে একবার জানাইও।আমি মাইনা নিমু।তবুও আমারে কষ্ট দিয়া যাইও না।”

রাতে ঘুমাতে গিয়ে বহুদিন পর সিরাজ হায়দার বউকে নরম গলায় ডাকলেন।সালমা আবারও বিস্মিত হলো। সালমার এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,”এতো গুলো বছর তোমার বাবা মা,ভাইয়ের উপর আমার একটা রাগ আছিলো সালমা।তবে সেই রাগ একটু কমলো কবে জানো?যেদিন আমার অন্তরার জন্ম হয়।তারপর আরেকটু কমলো যেদিন আমার অন্তরা আমারে বাবা কইয়া ডাকছে।সেদিন এক মুহূর্তের লাইগা আমার ও মনে হইছে আমার কন্যার মুখে বাবা ডাক শুইনা আমার যেমন আনন্দ হইতাছে তোমার বাবা মায়ের ও তো এই অনুভূতি ছিলো যখন তুমি তাগোরে এইভাবে প্রথম বার বাবা মা বইলা ডাকছো।ছেলে সন্তানের চাইতে মেয়ে সন্তান আমার কাছে বেশি প্রিয় ছিলো। আল্লাহ আমার সেই ইচ্ছে জানে বইলাই আমারে চারটা মেয়ে দিছে। কিন্তু এই চারজনের মধ্যে আমার অন্তরা আছিলো আমার বেশি আদরের।ক্যান জানো?
কারণ আমার অন্তরা যে আমারে প্রথম বার বাবা কইয়া ডাকছে।আমার অন্তরা বাবা কইয়া ডাকছে বইলাই তো আমি জীবনে প্রথম বার জানতে পারছি বাবা হওনের মধ্যে কতো আনন্দ,সন্তানের মুখে বাবা ডাক শুনতে কতো মধুর লাগে।
আইজ যখন আমার মাইয়া আমারে ছাইড়া কারো কাছে চইলা গেলো তখন আমি পুরোপুরি বুঝতে পারছি তোমার বাপ মা,ভাইয়ের কষ্ট সালমা।তাগো উপরে আমার যেই অভিমান আছিলো আইজ তা একেবারে নাই।আইজ আমিও বুঝি তোমার বাপ মায়ের ও বুকের ভেতর এমন ভাংচুর হইছে তুমি আমার হাত ধইরা চইলা আসার পর।
এতো দিন ধইরা কোনো দিন তোমারে আমি কই নাই তোমার বাপ মা’র লগে যোগাযোগ করতে।তারা জানেও না তাদের মাইয়া আদৌও বাঁইচা আছে কি-না। তবে আইজ তোমার কাছে অনুরোধ তাগো লগে তুমি যোগাযোগ করো।সন্তান এভাবে চলে গেলে যে এতো কষ্ট হয় তা যদি আগে জানতাম সালমা তবে মাটি কামড়াইয়া তোমারে হারানোর কষ্ট সহ্য করতাম তাও তোমার বাপ মায়ের বুক থাইকে তোমারে নিয়া পালাইয়া আসতাম না।

আমি জানি অভাব অনটনে মাথা গরম হইলে মাঝেমাঝে তোমার গায়ে হাত তুলি।এতো দিন আমার অন্তরা আছিলো, তোমারে রক্ষা করতো। আজ থাইকা তোমারে রক্ষা করনের কেউ নাই।আমি কথা দিলাম সালমা আমি আর কোনো দিন তোমার গায়ে হাত তুলমু না।আইজ মনে হইতাছে আমি যেমন কারো মাইয়ার গায়ে যখন তখন হাত তুলতেছি শুধুমাত্র সে আমার স্ত্রী এই অধিকারে। আমার মাইয়া যখন আইজ অন্য কারো স্ত্রী হইবো তার স্বামীর ও সেই অধিকার হইবো।সালমা সেও কি এই অধিকারের জোরে আমার আদরের মাইয়ার গায়ে হাত তুলবো?
আমার চারটি মাইয়াই তো তোমার মতো ফর্সা হইছে,তোমারে মা/রলে যেমন তোমার গায়ে দাগ পইরা যায়।আমার মাইয়ার গায়েও তো এরকম দাগ পইরা যাইবো সালমা।
আমার একটুখানি মাইয়া কেমনে সহ্য করবো সেই সাথে যন্ত্রণা!
আমি আগে ক্যান বুঝি নাই সালমা?
আল্লাহ যদি আমার পাপের শাস্তি আমার মেয়েরে দিয়ে দেখায়।এইটা আমি কেমনে সহ্য করমু?”

সিরাজ হায়দার হাউমাউ করে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।নিরবে কাঁদছে সালমা ও।

সালমা নিজে ও মা হবার পর প্রথম বার অনুভব করতে পারলো বাবা মায়ের মূল্য। আর আজ অনুভব করতে পারলো বাবা মা’কে এভাবে ছেড়ে চলে গেলে বাবা মায়ের বুকের ভেতর কতটা রক্তক্ষরণ হয়।যেই রক্তক্ষরণ শরীরের না,বরং ভেতর থেকে একটা মানুষের মনকে ভেঙে চুরমার করে দেয়।আজ বুঝতে পারলো সেদিন বাবা মা’কে ছেড়ে চলে আসার পর বাবা মায়ের কাছে কেমন অসহায়ের মতো লেগেছে।

চলবে…….

রাজিয়া রহমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে