তপ্ত সরোবরে পর্ব-২৭+২৮+২৯

0
427

#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

২৭(প্রথমাংশ)

শুক্রবার দিন। লাবন্যর শশুর-শাশুড়ি সকাল সকাল চলে গেছেন মেয়ের বাড়ি। আজ তাদের দাওয়াত সেখানে। লাবন্য-ইরফান যাবে দুপুরে। রান্না করার নেই আজ, তবে সকালটা তো চলতে হবে! লাবন্য গেছে রান্নাঘরে পরোটা বানাতে। ইরফান ঘুমাচ্ছে। এদিকে দুধওয়ালা এসে চেঁচাচ্ছে। লাবন্য তাড়াহুড়ো করে তাওয়াতে পরোটা রেখেই গেল দুধ আনতে। পাতিল নিতে ভুলে গেছে। আবার ফিরে এলো ডাইনিং রুমে। পাতিল নিয়ে গেল, দুধ মেপে দিলো দুধওয়ালা। ততক্ষণে পরোটা পুড়ে গেছে। লাবন্যর মেজাজ চড়ল। চট করে গ্যাসের চুলটা বন্ধ করে চিৎকার করতে ইচ্ছে করল। কিন্তু সে তো চাপা মেয়ে। চিৎকারটুকু ভেতরে চেপে গজরাতে গজরাতে কাজের নামে এদিক-ওদিক হাড়ি-পাতিল ছুড়তে শুরু করল। টেবিলের ওপর সবকিছু জোরে জোরে শব্দ করে রাখল। কাজ হলো না, ইরফান উঠল না।

লাবন্যর রাগ বাড়ছে। পুরো শরীর ঘামে ভেজা চুলোর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে। এরপর পরোটা পুড়ে গেছে। পরোটা ভালোভাবে সেঁকতে গিয়ে দুধ উতলে পড়েছে। রাগে মাথাটা টনটন করছে তার। সবটুকু চাপা রাগ গিয়ে পড়ল আরামে ঘুমিয়ে থাকা ইরফানের ওপর। ধুপধাপ পা ফেলে রুমে গিয়ে চট করে দিলো ফ্যানের সুইচটা অফ করে। এসে বসল ডাইনিংয়ের চেয়ারে। এবার শান্তি লাগছে অল্প একটু। ইরফান হাই তুলতে তুলতে উঠে এলো। জিজ্ঞেস করল,

-“লাবু! রান্না করেছ কিছু? খিদে পেয়েছে খুব।ʼʼ

কেমন লাগে তাহলে! আগুনে কেরোসিন ঢালছে এই লোক ইচ্ছে করে–তা লাবন্য খুব জানে। এই লোকের কী করা যায়? সে কথা বলল না। লাবন্য এটাও জানে সে যতক্ষণ কথা বলবে না ইরফান তাকে আরও ক্ষেপাবে। এই লোক চরম হাড়ে বজ্জাত। তবুও সে কথা বলবে না। ইরফান এসে বসল পাশের চেয়ারে। পরোটার প্লেট টেনে নিলো। সেখানে একটা পোড়া পরোটা। সেটা দু আঙুলে চুপে উচু করে তুলে ধরে বলল, “লাবু! ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে কখন? এই পরোটাটার ওপর বাজ পড়ল কখন? কী নিষ্ঠুরতার সাথে এটাকে পোড়ানো হয়েছে। দেখো, পড়েছে মেঘের বাজ, অথচ দেখে মনে হচ্ছে হিটলারের পারমাণবিক বোমা নিক্ষিপ্ত হয়েছে। বেচারা নিরীহ পরোটা..ʼʼ

লাবন্য শক্ত মুখে আড়চোখে তাকাল, তবুও কথা বলল না। ইরফান চট এক টুকরো পরোটা ছিঁড়ে মুখে দিলো। লাবন্য এবার কপাল-নাক কুঁচকে ফেলল–ব্রাশ না করে খাচ্ছে লোকটা! ছিহ! তবুও কিছু বলল না। ইরফান আরাম করে খেতে খেতে বেশ রিল্যাক্সলি বলল, “শুনেছি মেয়ে মানুষের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় তারা প্রেগন্যান্ট হলে। আমার লাবু যে কবে আমার উপর খিটখিট করবে, ঝারি মারবে…

এমন একটা কথার পেক্ষিতে কী করা যায়? না চাইতেও গোমরা মুখেই ঠোঁট চেপে অসহ্য ভঙ্গিতে হেসে ফেলল লাবন্য। খেয়াল করল ওর দিকে তাকিয়ে ইরফানও হাসছে নিজের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মুচকি মুচকি। লাবন্য কপট রাগে ইরফানের বাহুতে দু-তিনটা কিল-ঘুষি বসাল। ইরফান লাবন্যর হাতটা ধরে ফেলল। লাবন্য হাত ছড়ানোর চেষ্টা করতে করতে করল, “আপনার আক্কেল-জ্ঞান হবে কবে? ব্রাশ না করে খাচ্ছেন?ʼʼ

ইরফান কটাক্ষ করে বলে, “এজন্যই তো মেয়েদের ব্রেইনের ওজন কম! ডেন্সিস্টদের পরিমর্শ অনুযায়ী খাওয়ার পরেও ব্রাশ করা মাস্ট। তো আমি একই কাজ আগে পরে দুইবার কেন করব? একবারে খেয়ে করব, চুপচাপ বোসো, আগে খেতে দাও।ʼʼ

লাবন্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রয়। ইরফান আরেক টুকরো পরোটা মুখে দিতে যাবে হাত চেপে ধরল লাবন্য। চোখ গরম করে তাকিয়ে বলল, “ফেলুন, যান ব্রাশ করে আসুন। ব্রাশ না করে আমার বানানো পরোটা আপনি খেতে পারবেন না। ছিহ! আনহাইজেনিক!ʼʼ

ইরফান দু আঙুলের মাঝ থেকে পরোটা ছেড়ে দিলো, তা প্লেটে পড়ল। লাবন্যর দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল চোখে মুচকি হাসল। কী যে মারাত্মক ঠেকল সেই হাসি লাবন্যর কাছে। এ লোকটা এমন কেন? রাগ করে থাকা যায় না, তার সরল দুষ্টুমিতে না ভিজে উপায় থাকে না। ইরফান কপট মুখ গোজ করে বলল, “বউ পালতে কত কিছু করতে হয়, এতো কেবল ব্রাশ না করে পরোটা গেলা। তোমার বউ থাকলে বুঝতে, লাবু। বউ নেই, তাই সুখে আছো।ʼʼ

কৃত্রিম গোমরা মুখে বসে থাকে ওভাবেই ইরফান। লাবন্য কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে ফিক করে হেসে ফেলল। এই লোকের এসব কথাবার্তা! লাবন্য চাইলেও নিজের গম্ভীরত্বে টিকতে পারে না একটুও। হাসি থামিয়ে সামান্য হাসির রেখা ঠোঁটে এঁকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল ইরফানের দিকে। একটু শঙ্কিত সুরে প্রশ্ন করল, “আপনি কখনও বদলাবেন না তো? এই ভালো থাকা কতদিন সইবে আমার কপালে? শুনেছি হাসির পর কান্না আসে, আমি এই যে এভাবে আপনার সাথে হেসে এই হাসির শূন্যতায় কাদতে পারব না, ইরফান। সেই ক্ষমতা নেই, সাহস নেই আমার। আমি ধৈর্য্য ধরতে পারব না..ʼʼ

লাবন্যকে নীরব অস্থিরতা গ্রাস করে ধরেছে। ইরফান দ্রুত এগিয়ে এসে বসল। লাবন্যর ডানগালে হাত অপর হাত দ্বারা লাবন্যর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “তুমি আমার বউ, তার আগে তুমি আমার খুব প্রতীক্ষিত এক বন্ধু। তোমাকে প্রথম দেখে বন্ধুত্ব করতে ইচ্ছে হয়েছিল, কিন্তু তুমি সেরকম মেয়ে নও, তাই কী করলাম জানো, চিরতরে নিজের কাছে রাখার ব্যবস্থা করলাম। এই যা! স্বামী হিসেবে যদি কখনও মিসবিহেভ করেও ফেলি, আমার বন্ধু সত্ত্বাটার কাছে আপনি চিরকাল আহ্লাদি হয়ে থাকবেন, মেডাম!ʼʼ

একটু থামল ইরফান। লাবন্যর চোখে চোখ রেখে এতক্ষণ থুতনিতে আঙুল নাড়ছিল। এবার চট করে উঠে দাঁড়াল, লাবন্যর চেয়ারের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল, “আর আমার এসব ইমোশনাল আলাপ পছন্দ না। আপনি জানেন, আমি অলওয়েজ, চাঙ্গা থাকতে পছন্দ করি। এবার অল্প ভেজা চোখদুটো মুছে নিয়ে একটা ডিম ভেজে আনুন আপনার স্বামীর জন্য। সে ফ্রেস হয়ে এসেই কিন্তু খেতে বসবে। একটু স্বামীর খেদমত করো। আজকালকার মেয়েরা তো স্বামীর খেদমত কী জিনিস ভুলেই গেছে। আরে… আমার বউটাই আমাকে স্বামী মানতে চায় না, তোমায় আর কী বলব? বন্ধু বানিয়ে বসে আছে, আমি যে কীভাবে আছি আমি জানি। ভালো মানুষ বলে উল্টাপাল্টা কিছু করিনা সবসময়।ʼʼ

ইরফান চলে গেল বাথরুমের দিকে। লাবন্য মুচকি হেসে মাথা নুইয়ে নিলো কেবল। সে আজকাল ভাবে–আসলেই তার জীবনে এত চমৎকার একজন মানুষ পাওয়ার ছিল?

চলবে..

#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

২৭ (বর্ধিতাংশ).

সকাল সকাল উঠে দ্রুত গেছে দ্বিজা আগে গোসল সেরে নিতে। চিটচিটে একটা অস্বস্তি ভাব শুরু হয়েছিল শরীরে তিনদিন গোসল না করার ফলে। রাতে ঘুমটাও ঠিকঠাক হয়নি। সকাল সকাল গোসল করে বেরিয়ে চুলটা ঝারতে ঝারতে রুম পেরিয়ে বারান্দার দিকে এগোলো দ্বিজা। তোয়ালে দ্বারা দেয়া চুলের ঝাপটানির আওয়াজে ঘুম হালকা হলো ফারজাদের, এক পর্যায়ে ছুটে গেল ঘুম। ভেজা চুলে নীল রঙা এক সেলোয়ার-কামিজ পরা যুবতী চুল ঝারতে ঝারতে এগিয়ে যাচ্ছে বারান্দার দরজার দিকে। ফারজাদ ক্ষণকাল ধাতস্থ হতে পারল না। সেকেন্ড কয়েক কাটলে একটু সপ্রতিভ হয়ে উঠল। উঠে বসল। হাই তুলল একটা। ঘড়িতে নয়টা বাজতে যাচ্ছে। এখন মেয়েটা গোসল কেন করেছে–চট করে মাথায় এলো কথাটা। মাথাটা চেপে ধরে বসে রইল কিছুক্ষণ বিছানাতে ওভাবেই। পরনে তার শুধু থ্রি-কোয়ার্টার। বিছানা ছেড়ে উঠে হেঙ্গারের ওপর থেকে একটা গামছা নিয়ে গলায় ঝুলিয়ে সিগারেট আর দিয়াশলাই বাক্স হাতে নিলো। বাথরুমের দিকে অগ্রসর হতে গিয়ে আবার কী মনে করে যেন বারান্দায় উঁকি দিলো।

ফারজাদ নিজের ওপর বিরক্ত। এই মেয়েটা তাকে ডিস্ট্রাব করছে, যা সময়ের সাথে সাথে প্রকট হচ্ছে। নিজেকে কষে ধমক দিলো, তবে ফিরতে পারল না পেছনে। দ্বিজা তোয়ালেটা রেলিংয়ের ওপর বিছিয়ে দিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়াল এবার। বারান্দায় এলো ফারজাদ। একদম গা ঘেষে দাঁড়াল দ্বিজার। মেয়েটাকে পাক্কা বউ বউ লাগছে, তাতে সন্দেহ নেই। ফুলের ভেজা পাপড়ির মতো সিক্ত, স্নিগ্ধ একটা মাতাল করা সুরভী ছড়াচ্ছে যেন! উদাসী চোখে চেয়ে আছে প্রায় তেজহীন রোদে মুড়ানো আসমানের দিকে। আশ্চর্য! এই মেয়ের সমস্যা কী? কী চাইছে মেয়েটা! ফারজাদকে ভেঙেচুড়ে গুড়িয়ে দিতে কি তার এইসব আয়োজন! এই যে ফারজাদ নিজের সংযম হারাচ্ছে, এর দায়ের বোঝা এই মেয়ে বইতে পারবে তো? কী পরিকল্পনায় আছে মেয়েটা? ফারজাদকে নিয়ে খেলছে রীতিমত সে। ভ্রু কুঁচকে ভাবল ফারজাদ। তার এক মুহুর্তের জন্য ইচ্ছে করল দ্বিজাকে ধাক্কা মেরে এখান থেকে নিচে ফেলে দিতে। ফারজাদ এসে পাশে দাঁড়িয়েছে একবার তাকিয়ে দেখল পর্যন্ত না। তার অভিব্যাক্তিতে বিন্দু পরিমাণ পরিবর্তন লক্ষ করা গেল না। এসব নির্লিপ্ততা চলবে বলে মনে হয় ফারজাদের সামনে এই মেয়ের?

রেলিংয়ের ওপর মেলে রাখা দ্বিজার হাতের দিকে নজর গেল ফারজাদের। এখনও হাতটা অর্ধভেজা। ফারজাদের তুলনায় ছোট্ট হাতটা, ফারজাদের হাতের রঙ তার তুলনায় বেশ শ্যামবর্ণের চাপা রঙা লাগছে। এ ব্যাপারটাও পছন্দ হলো না ফারজাদের। তার মধ্যে ঘোর লেগে যাচ্ছে। পৌরুষ সত্ত্বা ভেতর থেকে কড়া নাড়ছে, আবার দমে যাচ্ছে ফারজাদের জীবন্মৃত সত্ত্বার জোরে। এক পর্যায়ে চট করে হাতটা ধরল ফারজাদ। দ্বিজা একটু চমকে তাকাল। ফারজাদ হাতটা আলগোছে ধরে এপিঠ ওপিঠ করে দেখতে দেখতে বলল, “চুড়ি কিনে দিতে হবে নাকি এখন আবার? আম্মাকে দেখেছি চুড়ি পরে থাকতে।ʼʼ

দ্বিজা একটু অবাক হলো, সাথে লজ্জাও পেল। চুপ রইল, মাথাটা অল্প নামিয়ে নিলো। ফারজাদ জিজ্ঞেস করল, -“রান্না করেছিস?ʼʼ

দ্বিজা মৃদু স্বরে ধীর কণ্ঠে বলল, “কী রান্না করব?ʼʼ

ফারজাদের মনে পড়ল কাল দ্বিজার জিদের কাছে তাকে হারতে হয়েছিল। শেষমেষ খাবার কিনে এনে বাড়িতে এনে খেয়ে ঘুমিয়েছে। ফারজাদ ডাকল, “আমার দিকে তাকা।ʼʼ

দ্বিজা কপালের চুল কানে গুজে সজল চোখে তাকাল ফারজাদের দিকে। ফারজাদ চোখে চোখ রাখল। সে বহুবার খেয়াল করেছে সে দ্বিজার চোখের দিকে পৃর্ণদৃষ্টি মেলে তাকালে মেয়েটা চোখ লুকোয়া না, বরং দিব্যি নিজের সরল চোখদুটোর ভরাট চাহনি মেলে তাকিয়ে থাকে, সে আগে কখনও কাউকে তার চোখে চোখ রেখে তাকাতে দেখেনি, আসলে ব্যাপারটা সে খেয়াল করেনি সেভাবে। প্রশ্ন করল, “ভালো আছিস আমার সঙ্গে?ʼʼ

দ্বিজা দৃঢ় দৃষ্টি মেলে চেয়ে থেকে জবাব দিলো মৃদু স্বরে, “খারাপ নেই তো।ʼʼ

ফারজাদ কেমন করে হাসল, “তুই একমাত্র মানুষ যে অন্তত আজ অবধি খোলামেলা অভিযোগ রাখে নি আমার ওপর। এটা আমার ঠিক হজম হয় না। করতো একটু অভিযোগ আজ! খুব শুনতে ইচ্ছে করছে তোর মুখে অভিযোগ।ʼʼ

দ্বিজার কণ্ঠস্বরটা মৃদু কাঁপল। সজল চোখে চেয়ে ধীর স্বরে বলল, “কীসের অভিযোগ করব?ʼʼ

-“তোর সাথে যা যা খারাপ হয়েছে আমার জন্য!ʼʼ

দ্বিজা ডানদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো, “কিচ্ছু খারাপ হয়নি।ʼʼ

ফারজাদ গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে মুখ ফিরিয়ে নিলি কেন?ʼʼ বলেই শ্লেষের সঙ্গে হাসল, “আফসোস হচ্ছে তো! কেন এলি আমার সাথে? বলেছিলাম ভালো থাকতে পারবি না। সেদিন আমি নাহয় রেগে গেছিলাম তাই…

দ্বিজা হঠাৎ-ই কেমন ক্রোধান্বিত হয়ে উঠল, “তাই কী? কী তাই? শুনত চেয়েছি আমি এসব? সেদিন কেন নিয়ে এসেছেন সেই ফিরিস্তি শুনতে চেয়েছি? আমি জানি না? আমি এটা জানি না যে আপনি আমায় ভালোবাসেন না? আমি জেনে শুনে আগুনের সাগরে ডুবেছি। ব্যাস, কথা শেষ!ʼʼ

দ্বিজা চলে যেতে নেয় সেখান থেকে। ফারজাদ বাহু চেপে ধরে নিজের সামনে এনে দাঁড় করালো। দ্বিজার মুখে চাপা ক্ষোভ। ফারজাদ ভারী কণ্ঠে বলল, “তুই ভালোবাসিস? কই আমি দেখছি না তো তোর ভালোবাসা? ভালোবাসা কাকে বলে বুঝিস?ʼʼ

ইচ্ছে করে ক্ষেপানোর চেষ্টা করল ফারজাদ। দ্বিজা মেনে নিলো, “একদম তাই! কীসের ভালোবাসা? কোনো ভালোবাসা নেই, আর না আছে অভিযোগ। কীসের অভিযোগ আপনার ওপর? কে আপনি? কার ওপর অভিযোগ করব আমি? আপনার সঙ্গে আমার আছেই কী, যে সেখানে অভিযোগ আসবে? অভিযোগ, অভিমানের সম্পর্ক না আমাদের..ʼʼ

ফাদজাদ নিজের ঠোঁটে আঙুল রাখল, “চুপ! চুপ কর। এত কথা বলছিস কেন? কানের ওপর একটা ঠাস করে লাগাব, কান গরম হয়ে যাবে। ওয়েট! তোকে বেশি প্রশ্রয় দিচ্ছি নাকি আজকাল? যা-তা ব্যবহার করে যাচ্ছিস!ʼʼ

ফারজাদ নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। ওকে দখল করে ফেলছে এই মেয়েটা! দ্বিজা ওর জীবনে আসার পর। থেকে ওর গুমটে চেনা জগতটা কেমন অচেনা হয়ে উঠেছে। সে একা ছিল, একা থাকাতে তার সবটুকু সুখ মিশে আছে। কিন্তু এখন একা থেকেও সেই একাকীত্বকে ঠিক উপভোগ করতে পারে না। সে-ও কি দ্বিজাকে… উহু! নাহ! দ্বিজা শুধু তার দায়িত্ব। কিন্তু দায়িত্বে এরকম টান থাকে? এটা কীসের টান? দৈহিক, নাকি মানসিক? কোন টান অনুভব করছে ফারজাদ!

দ্বিজা আর কথাই বলল না। তার মাঝে কেমন একটা চাপা ক্ষোভ কাজ করতে লাগল ফারজাদের ওপর। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল–তাকে নাকি প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। কীসের প্রশ্রয়! মানে কী বলছে ফারজার! ফারজাদকে বাইরে থেকে কখনও এমন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত লাগেনি। অথচ এই কয়েকদিনে খুব করে টের পেয়েছে দ্বিজা–ফারজাদ মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ নয়। একদম স্বাভাবিক নয় সে। এজন্য তার আচরণে এত অস্বাভাবিকতা, যা কারও সাথে মেলে না। আচ্ছা! অফিসিয়ালিই কি ফারজাদ মানসিভাবে অসুস্থ! হতেই পারে! তার আচরণ, কর্মকাণ্ড তো তা-ই বলে! কখন কী করে, কীসের মধ্যে কী করে, কখন কোন প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত তা যেন জানে জানেই না ফারজাদ! ফারজাদ সিগারেট জ্বালিয়ে তাতে একটা টান দিয়ে বারান্দার মেঝেতে বসে পড়ল। দ্বিজা তাকিয়ে দেখল। দেয়ালে হেলান দিয়ে এক পা ভাঁজ করে অপর পা টান করে বসেছে ফারজাদ। ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট রেখে অস্পষ্ট স্বরে বলল ফারজাদ, “বস পাশে।ʼʼ

দ্বিজা বসল। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বসে জিজ্ঞেস করল দ্বিজাকে, “কিছু বলবি?ʼʼ

-“আপনি কি পাগল?ʼʼ

ফারজাদ নিঃশব্দ হাসল, “তা একটু অবশ্যই!ʼʼ

-“কিন্তু পাগল তো টের পায় না সে পাগল।ʼʼ

-“কিন্তু আমার মতো পাগলেরা টের পায় তারা পাগল। ইভেন তারা নিজেরা যতটা বোঝে নিজেদের অসুস্থতা আর পাগলামি, লোকের চোখে অত ধরাই পড়ে না।ʼʼ

-“আপনি কেমন পাগল?ʼʼ

বেশ কিছুক্ষণ কোনো কথা বলল না ফারজাদ। বেশ কিছুক্ষণ পর বলল, “আমি রাজউক কলেজে পড়তাম জানিস তো!ʼʼ

-“হু।ʼʼ

-“তখন এক ঘৃণ রকমের বখাটে ছিলাম আমি।ʼʼ

এমনভবে কথাটা বলল ফারজাদ, যেন সে খুব প্রফুল্ল এই কথাটায়। কথাটা বলে তাকাল ফারজাদ দ্বিজার দিকে।

দ্বিজার একটু অবিশ্বাসের সুর, “বখাটে ছিলেন? আপনি?ʼʼ

ফারজাদ একটু বিরক্ত হলো, “হু, আমার কথাই তো বলছি।ʼʼ

দ্বিজা কৌতূহলি চোখে তাকিয়ে রইল। ফারজাদ আপন মনেই বলল, “একটা মেয়েকে খুব ইভটিজিং করেছিলাম।ʼʼ

দ্বিজার কপাল কুঁচকে গেল। কেমন অগোছালো কথাবার্তা! চোখ-মুখ জড়িয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সে। অস্পষ্ট স্বরে তোতাপাখির মতো করে বলল, “ইভটিজিং?ʼʼ

-“মেয়েটাকে মেলায় ঘুরতে নিয়ে গেছিলাম।ʼʼ

দ্বিজা হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে রইল ক্ষণকাল। এরপর নাক কুঁচকে দৃষ্টি বাঁকা করে বলল, “ইভটিজিং এরকমও হয়? মানে… ইভটিজিংয়ে মেয়েকে মেলায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হয়? আর ঘুরতে নিয়ে গেলে সেটাকে ইভটিজিং বলে?ʼʼ

ফারজাদ কেমন করে যেন হেসে ফেলল। মাথা দুলিয়ে বলল, “ইভটিজিং বলে। এরপর কী হলো জানিস? মেয়েটার বাপ ছিল এসপি ছিল। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ছেলেটাকে চেনো? মেয়েটা বলল, ‘উহু, আমাকে জোর করে ডেকে নিয়ে গেইটের বাইরে ডেকে নিয়ে গেছিল।ʼ ওহ তোকে বলতে ভুলে গেছি, মেলায় গিয়ে মেয়েটাকে বেশ কিছু উপহার কিনে দিয়েছিলাম। সেগুলো দেখিয়ে মেয়েটা বলল, ওগুলো আমি তাকে জোর করে গেইটের বাইরে ডেকে দিয়েছি।ʼʼ

দ্বিজার বোধহয় বুঝতে অসুবিধা হলো না–এটা ঠিক কী ধরণের ইভটিজিং। তার বুকের মধ্যে কোথাও জ্বলছে, তীক্ষ্ণ ধারাল এক খোঁচা অনুভূত হচ্ছে। এরকম অসহ্য অনুভূতি ফারজাদকে হারানোর ভয়েও ছিল না–এমনটা মনে হলো দ্বিজার। আশ্চর্য! এত কঠোর ব্যথারা কেন নাড়া দিচ্ছে বুকের ভেতরটায়! নিজেকে শক্ত করল, মুখে একটা বানোয়াট হাসি ঝুলিয়ে তাকাল ফারজাদের দিকে। সে খুব আগ্রহী ব্যাপারটা জানতে এমনভাবে বলল, “এরপর?ʼʼ

ফারজাদ জিজ্ঞেস করল, “খারাপ লাগছে?ʼʼ

-“উহু, ভালো লাগছে।ʼʼ

-“আচ্ছা, কোনো একদিন সময় করে তোকে মিথ্যা বলতে শেখাব, আর মিথ্যা হাসিকে কীভাবে একদম ন্যাচারাল করতে হয়, সে হাসিও শেখাব। এখন গল্পে ফিরি!ʼʼ

দ্বিজা কথা বলল না। ফারজাদ নিজ মনে বলে গেল, “জানিস, জেলার কৃতি শিক্ষার্থী ছিলাম আমি এককালে। এরপর…. প্রিন্সিপাল আর এসপি মহোদয় আব্বুকে ডেকে খুব গুণগান করেছিল আমার, আমায় অর্ধেক বহিষ্কারও করা হলো কলেজ থেকে। করি হতো না হয়ত, তবে করা হলো, কারণ–ইভটিজিংটা আমি করেছি স্বয়ং এসপির মেয়েকে।ʼʼ

কথাগুলো খুব অহংকারের সাথে বলছে ফারজাদ, সাথে লম্বা করে টান দিচ্ছে সিগারেটে। দেখতে একদম অপ্রকৃতস্থ, মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের মতো লাগছে ফারজাদকে। তার কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছে খুব আগ্রহ আর আনন্দ পাচ্ছে সে কথিগুলো বলতে। দ্বিজার ভেতরে অদ্ভুত কষ্টরা গুচ্ছ পাকাচ্ছে কেন জানি! ফারজাদ বলে চলল, দুটো সাবজেক্টে ফেইল করে ইন্টারমিডিয়েটে ডাব্বা মারলাম আমি… আমি, আমি ফেইল করলাম, আমি। এরপর যখন দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিতে গেলাম। প্রতিদিন স্যারেরা এসে জোরে জোরে বলত, “মান উন্নয়ন পরীক্ষার্থী আছো কারা, দাঁড়াও!ʼʼ

এ পর্যায়ে ফারজাদ হো হো হেসে ফেলল পাগলের, শত শত ছাত্রের ভিড়ে দাঁড়িয়ে বলতে হতো, “জি স্যার, আমি আছি, আমি। আমি কৃতি শিক্ষার্থী, আমি মান উন্নয়ন পরীক্ষার্থী।ʼʼ

নাক-মুখ ভরে ধোঁয়া টেনে নিলো ফারজাদ। ভ্রু নাচিয়ে ঘাঁড় দুলিয়ে বলল, “ইজটিজিং করার ফল। জোর করে মেয়েকে মেলায় ঘুরাবে? হ্যাঁ? উহু, আর না!ʼʼ

কিছুক্ষণ একদম চুপ করে রইল ফারজাদ। সামনের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ-ই গুরুগম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করে উঠল, “তুই কেন সেদিন তোর বাপের সামনে স্বীকার করলি ওভাবে?ʼʼ

বেজায় ভারী দুটো শ্বাস ফেলল ফারজাদ, “আমাকে উলোট-পালোট করে ছেড়েছিস, তুই। তোকে আমার সহ্য হয়না। তুই কেন সেদিন ওভাবে তোর সামনে আমায় বাঁচাতে দাঁড়িয়ে গেলি? আমি পারতাম না নিজেকে বাঁচাতে? আমাকে নড়বড়ে করে ফেলেছিস, তুই।ʼʼ

একদম দুর্বল, ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ফারজাদের, প্রাণের অভাব সেই স্বরে। দ্বিজার বুকে তুফান উঠেছে। তবে সে স্থবির হয়ে বসে আছে। নড়তে পারছে না একদম, পারছে না কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে। তবে এটুকু বুঝতে পারছে–ফারজাদ এর মানসিকতার ওপর ভারী একটা ছাপ ফেলেছে তার এই অন্ধকারচ্ছন্ন অতীত। যা তার স্বাভাবিকতা কেঁড়ে নিতে একটু হলেও দ্বায়ী। কিছু মানুষ থাকে যারা খুব অহংকারী হয়, নিজের সাফল্য নিয়ে খুব বেশিই কনসার্ন থাকে, বুক ফুলিয়ে চলা, বেপরোয়া স্বভাবে ঘেরা দুনিয়ার স্বাধীন মালিক হয়। ফারজাদ সেই একজন, অথচ তার থেকে তার অহমিকা কেঁড়ে নেয়া হয়েছে খুব বাজেভাবে, কিছু মানুষ অপমানের ঘানি টানতে পারে না।

আরও মিনিট বিশেকের মতো দুজনের মাঝে একদম নিরবতা বিরাজ করল। শুধু দুজনের বিক্ষিপ্ত শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ আসছে থেকে থেকে। নিচ থেকে গাড়ির হর্ন, চলমান ঢাকা নগরীর শান্তিনগর এলাকার ব্যস্ত সড়কে চলমান মানুষে দ্বারা সৃষ্ট আওয়াজ। বেলা দশটার মতো বাজছে। ফারজাদ আরও দুটো সিগারেট শেষ করল। সে খুব বেশি স্মোকিং করে না সবসময়। রেগলার স্মোকার নয় বলা চলে। তবে আজ বাঁধা মানছে না। বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটার পর ফারজাদ মুখ খুলল, “আমি তোকে ভালোবাসি কিনা জানা নেই। আসলে প্রেম ভালোবাসার সংজ্ঞাটাই জানা নেই আমার। তবে আজকাল তোর ওপর একটা আকর্ষন অনুভব করছি। হতে পারে সেটা শারীরিক অথবা…

কথা শেষ না করেই তাকাল দ্বিজার দিকে। দ্বিজা সজীব দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তারই দিকে। ফারজাদ ক্ষীণ মুচকি হাসল, ধীরে ধীরে হাসি বিস্তৃত হলো ঠোঁটের চারদিকে, এবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে গা দুলিয়ে নিঃশব্দে হেসে উঠল। দ্বিজার শুধু এটুকুই খেয়ালে এলো, দেখতে অমায়িক লাগছে এই লোকের এই পাগলাটে হাসি। কত দ্রুত রূপ বদলায় এই লোকের। ঈত রূপে রূপান্বিত এই মানুষটা। কোনো কিছুই যেন প্রভাবিত করতে পারে না একে। ফারজাদ হাসিমুখে যেন একটু বিমুগ্ধ নজরে চেয়ে বলল, “না খাইয়ে শুকিয়ে ফেলেছি একদম, তোকে। তবুও অটল তুই, না! অগ্নিপরীক্ষা দিচ্ছিস! ধরে নে, পাশ করেছিস। ভুল মানুষকে চাইলে, এর চেয়ে সুখ কোথা থেকৃ এনে দেব তোকে, বল?ʼʼ

এত সুন্দর লাগেনি কখনও ফারজাদের কথা। ভালো তো লেগেছে, তবে আজ কেন যেন হুট করে দ্বিজার ভেতরে সবটুকু আগুন নিভে একরত্তি ফোয়ারার জল জমে উঠল বুকের মাঝটায়। ফারজাদ হাসলে খুব সুন্দর দেখায়। দ্বিজাকে লোকে বহু বলেছে, দ্বিজার হাসি চমৎকার সুন্দর। দ্বিজার ধারণা–তারা নিশ্চয়ই এই পাগল, অস্বাভাবিক, অসহ্য মানুষটার হাসি দেখেনি। দেখবে কী করে! লোকটা হাসেই খুব কম। ফারজাদ জিজ্ঞেস করল, “খেদে পায় নি তোর?ʼʼ

কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ করে বলল, “সুন্দর লাগছে তোকে দেখতে।ʼʼ

দ্বিজার গালে হাত ছোঁয়ায় ফারজাদ। পরম আবেশে হাতটা দ্বিজার গাল পেরিয়ে চুল সরিয়ে গলায় নিয়ে এলো। ঠোঁট ছেঁড়ে একটু শীতল ভেজা চুমু দিলো দ্বিজার কপাল বরাবর। দ্বিজা সইবে কী করে তা। মেয়েটার চোখে জল জমে গেছে। চোখদুটো বুজে নিলো, বেরিয়ে এলো চেপে রাখা শ্বাসটুকু ভারী হয়ে। ফারজাদ চোখ মেলে তাকিয়ে মুখটা গোজ করল, “চুমু খেয়েছি বলে কাঁদতে হবে?ʼʼ

দ্বিজা জবাব দিলো না। ফারজাদকে জোরে একটা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে উঠে চলে গেল রুমে। ফারজাদের খোলা বুকে আঁচড় লাগল দ্বিজার নখের। শিউরে উঠল ফারজাদের পৌরুষ সত্ত্বা বোধহয়! এক অদম্য বিনাশকারী স্পৃহা জাগছে তার ভেতরে। তবে তা আপাতত দমন করা দরকার। মেয়েটার অভিমান জমবে স্বাভাবিক। তার যে অতীত সে শুনিয়েছে, তা যে বউ মেনে নেবে না, তা আর অজানা কী! এখন ভালোয় ভালোয় বাজার না করে আনলে ঘটে শনি আছে।

কী কী বাজার করা যায় এই ভাবতে ভাবতে বের হলো ফরজাদ ফ্লাট থেকে। গেইটের বাইরে এদিক-ওদিক তাকাল। এক লোক দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার অপর পাশে। তার ফ্লাটের দিকেই উঁকি-ঝুঁকি মারছে। এ ফ্লাটের কোনো সুন্দরীর সাথে লাইন চলছে নাকি? ইশ! ফারজাদ কেন এমন প্রেমিক হতে পারেনি। সে কোনোদিন কোনো সুন্দরী রমণীর বাড়ির সমনে গিয়ে চেয়ে থাকেনি, সুন্দরী একবার বেরোবে, একটা নজর দেখা দেবে। নিজের ভাবনাকে একটা গালি দিলো সে– এটা হলো চরম ছ্যাচড়ামি, সে তা করবে নাকি, আশ্চর্য!

বাজার পাওয়া পাওয়া। হুট করে তার মাথাটা সক্রিয় হলো। লোকটা প্রেমিকার জন্য অপেক্ষা করছে? তার নজর ছিল চার তলার ফ্লাটের দিকে। সেখানে কে আছে? এখন দ্বিজা এক আছে, ফারজাদ বেরিয়ে এসেছে। নিজেকে ফারজাদের এক কো পে দুই খণ্ড করতে ইচ্ছে করল। সে এতটা বোকা কী করে হতে পারে? তার হয়েছেটা কী? পরপর এত বড়ো বড়ো ভুল সে কী করে ফেলছে! তাকে কি পাগলা, স্টুপিড জিনে ধরেছে? এখন ফিরে গিয়ে কি খুব লাভ হবে? সে তো বহুদূর এগিয়ে এসেছে!

চলবে..

#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

২৮.

ফারজাদ ফ্লাটে ফিরল, তবে নিচে আর সেই লোকটা নেই। দৌঁড়ে ওপরে উঠল। ফ্লাটের দরজা সে বের হবার পর দ্বিজা আঁটকে দিয়েছিল, অথচ এখন খোলা। ফারজাদ নিজের কোমড়ের পিস্তলটাকে এই মুহুর্তে খুব মিস করল। তার উত্তেজনা মাত্রা ছড়িয়েছে। ফ্লাটের দরজা খোলা কেন? আস্তে কোরে ফ্লাটে ঢুকল। দ্বিজার কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। সে কেন জানি বুকের ভেতরে তরল কোনো ক্ষরণ টের পাচ্ছে। তছনছ হয়ে যাচ্ছে বোধহয় সব। শুধু মস্তিষ্কে একটা কথাই আসছে–দ্বিজার শরীরে কেউ হাত লাগালে তাকে ফারজাদ মাং স চুরার মতো চুরে ফেলবে। ফারজাদ তো আধুনিক ছেলে, তার তো ঢাকার পরিবেশে মানিয়ে নেয়া আছে, সে খুব পরিচিত আধুনিকতার সাথে। এখানকার মেয়েদের অবাধ চলিফেরা দেখে অভ্যস্ত সে।আর এত তাড়াতাড়ি দ্বিজার সাথে খুব খারাপ কিছু হবে না। তবুও শুধু স্পর্শের ভাবনাটুকুও সহ্য কেন করতে পারছে না সে? দৌঁড়ে গেল সেই রুমটার কাছে, যেখানে আলামিন বন্দি ছিল। ওখান থেকে আওয়াজ আসছিল।

দ্বিজা দাঁড়িয়ে আছে, সেই রুমের শেষ প্রান্তে একটা পুরুষ তদন্ত করার মতো করে কিছু দেখছে পিছু ঘুরে। ফারজাদ প্রলম্বিত এক শ্বাস টেনে একটানে দ্বিজাকে নিজের দিকে ঘুরাল। তার চোখে-মুখে ফুটে আছে নিদারুন উৎকণ্ঠা সাথে হিংস্রতা ঠিকরে বেরোচ্ছে যেন। দ্বিজা ঘাবড়াল, ভয় পেল। ফারজাদ হিংস্র হাত তুলল দ্বিজার গালে থাপ্পড় বসাতে। নামিয়ে নিলো হাতটা। হুট করে দ্বিজাকে জড়িয়ে আগলে নিলো নিজের বুকের সাথে। জোরে জোরে শ্বাস ফেলল কয়েকটা। ঘটনার আকস্মিকতায় দ্বিজা হতবাক। সে বুঝতে পারছে না ফারজাদ এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন! সে সময় ঘুরে দাঁড়াল লোকটা। দ্রুত সোজা হয়ে দাড়িয়ে সালাম ঠুকলো ফারজাদকে। ফারজাদ এবার ছেড়ে দাঁড়াল দ্বিজাকে। একটু শান্ত করল নিজেকে। আগন্তককে জিজ্ঞেস করল, “সামাদ!ʼʼ

-“জি স্যার!ʼʼ

-“কখন এসেছেন?ʼʼ

-“মিনিট কয়েক হবে, স্যার!ʼʼ

-“বাইরে অপেক্ষা করতে পারতেন আমার। ভেতরে ঢোকার কী এমন বিশেষ প্রয়োজন ছিল?ʼʼ

একদম ছোটোলোকি একটা কথা অকপটে বলে দিলো ফারজাদ মুখের ওপর। সামাদ শুনেছিল, ফারজাদ ক্যাটক্যাটে লোক, আজ সামনে থেকে প্রথম দেখায় দেখে এক মুহুর্তে ধারণা হয়ে গেছে–এর সহকারী হিসেবে কাজ করতে তার কী কী সহ্য করতে হবে। মিনমিন করে বলল, “আপনি নেই, তা আমি জানতাম না, স্যার। ম্যাম দরজা খুলে দিলেন, তাই ভেতরে..ʼʼ

কথা শেষ করতে দিলো না ফারজাদ। দ্বিজাকে কড়া সুরে বলে উঠল, “রুমে যা।ʼʼ

মাথার ওড়না পড়ে গেছে খেয়াল করেনি দ্বিজা। তা দেখে রাগ হলো ফারজাদের। ইচ্ছে করল একটা থাপ্পড় মারতে। সামাদকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি যখন ফ্লাটএ এলেন, নিচে রাস্তার ওপারে কাউকে এ ফ্লাটে নজরদারী করতে দেখেছেন?ʼʼ

সামাদ ঠোঁট গুজে আস্তে করে বলল, “খেয়াল করিনি, স্যার!ʼʼ

-“আচ্ছা, পরে আলাপ করছি আপনার সঙ্গে। এখন বাজার করে এনে দিন। দুপুরে এখানেই খাবেন।ʼʼ

টাকা ধরিয়ে দিলো ফারজাদ সামাদের হাতে। সামাদ ঠিক সামলে নিতে পারছে না ব্যাপারটা। কী থেকে কী করছে ফারজাদ! চরম অদ্ভুত লোক ফারজাদ, এ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সে পরিস্থিতির চিন্তা আপাতত বাদ দিয়ে চলে গেল বাজার করতে। পদের হিসেবে সিনিয়র বলে কথা! আর যে লোক হিসেবে প্রথমেই পরিচিত হয়েছে ফরজাদের সঙ্গে! ফারজাদের অবশ্য সামাদকে খুব একটা খারাপ লাগেনি। তার মানুষ চিনতে খুব সময় লাগে না। সামাদের চোখে একটা সচ্ছতা টের পেয়েছে সে।

রুমে গিয়ে দেখল দ্বিজা ফারজাদের কিছু কাপড় ভাজ করছে। চুলগুলো এখনও ভেজা, ছেড়ে দিয়ে রেখেছে পিঠ এলিয়ে।

“সামাদ আসার আগে আর কেউ এসেছিল?ʼʼ

-“আপনি যাবার পরপরই ওই লোক এসেছে। এর মাঝে আর কে আসবে?ʼʼ

ফারজাদ কথা বলল না। তার মানে, খুব বেশি সময় লোকটা ফ্লাটের সামনে ছিল না, যেহেতু সামাদও দেখেনি। তবে লোকটা যে তাকেই ফলো করছে এটা নিশ্চিত ফারজাদ। ফারজাদ বিশেষ একশন নেয়নি এখনও, তবুও নজরে পড়ে গেছে তাদের। তার আসলেই আর ইচ্ছে নেই এই প্রজেক্টে কাজ বাড়ানোর। কিন্তু ডিউটি ইজ ডিউটি। দ্বিজাকে জিজ্ঞেস করল, “তুই দরজা খুলেছিস কেন? তোকে নিষেধ করে গেলাম না আমি ছাড়া দরজা খুলতে?ʼʼ

-“আপনারই সহকারী পরিচয় দিলো যে!ʼʼ

-“এই জন্যই বলে, মহিলা মানুষের নেই বারো হাতের কাপড়ের কাছা!ʼʼ

দ্বিজা ভ্রু কুঁচকে তাকাল, “মানে?ʼʼ

নাক শিউরে তাকাল ফারজাদ, কিছু বলল না। রাগটুকু গিলছে যেন সে। ভাবলেই মাথা গরম হচ্ছে, আজ খুব খারাপ কিছু হতে পারতো। একটুর থেকে একটু মিসটেক হলেই ঘটনার চাল পাল্টে যেত। মেয়ে মানুষ এত বোকা হবে কেন? এরা এতো হাবাগোবা কেন হবে? সহকারী পরিচয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকিয়েছে। ফারজাদের ইচ্ছে করছে দ্বিজাকে কান বরাবর একটা সজোরে চর মারতে। কান ফাটিয়ে র ক্তা ক্ত করতে পারলে হয়ত গায়ের আগুনের তাপ কমতো একটু হলেও। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল। এসব অবলা পাগলি-ছাগলির ওপর তেজ দেখানোটা মোটেই বাহাদুরী নয়। এতে কাপুরুষতা প্রকাশ পায়–এত রাগের মাঝেও এইটুকু হিতাহিত জ্ঞান আছে ফারজাদের। বেশ কিছুক্ষণ পর একটু ঠাণ্ডা হয়ে জিজ্ঞেস করল,

-“রান্না করতে পারিস?ʼʼ

দ্বিজা তাকাল, “শুকনো খাবার পারি। মানে–ভাত, ভাজি, ডিমভাজি, ভর্তা।ʼʼ

-“বাহ, খুউউউব পারিস। আর কী লাগে? এসবই তো শুধু। তেল আর তেল! তেলে ডুবে মরে যাব। মরেও শান্তি।ʼʼ

ফারজাদের কণ্ঠে এখনও রাগ। দ্বিজা কপাল জড়িয়ে রইল কেবল, তাকাল না। বেশ কিছুক্ষণ পর আস্তে কোরে বলল, “আমার জন্য আপনার ডিউটিতে ডিসটার্বেন্স হচ্ছে। আমি নাহয় কুমিল্লা চলে যাই, আব্বুকে মানিয়ে…

ফারজাদ বোধহয় বারুদের মতো ধপ করে জ্বলে উঠল, “এতক্ষণে যা করিনি, এবার তা করে ফেলি এরকম কোনো কিছু করিস না। আর একবার এরকম কথা উচ্চারণ করলে তোর আমি…ʼʼ

উঠে দাঁড়াল ফারজাদ, এগিয়ে গেল দ্বিজার দিকে। বাহু ধরে টেনে তুলে পেছাতে পেছাতে নিয়ে গিয়ে দেয়ালে ঠেকাল দ্বিজাকে। দাঁতের মাড়ি চেপে বলল, “তুই কী বলতে চাইছিস? কী প্রমাণ করতে চাইছিস তুই? যে আমি তোর দেখভাল করতে অক্ষম? যে দায়িত্ব আমি তুলে নিয়েছি আমার কাধে তা তোর বাপ আর মামা ছাড়া পালন করতে অক্ষম এই আমি? এই, কথা বল। কথা বল…!ʼʼ

শিউরে উঠল দ্বিজা ফারজাদের হুংকারে। চোখ খিঁচে বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল ওভাবেই। ফারজাদ আবার বলল, “তোরা কী মনে করিস আমায়? এএএ, আমি কি এতই অপদার্থ রে! কিছুই হয়না আসলে আমার দ্বারা! যা হারিয়েছি জীবনে, তার বদলে কিছু তো করতে পেরেছি! অন্তত এটুকু সাহস, যোগ্যতা আর সামর্থ্য তো অর্জন করেছি যে তোর মতো পুচকে বউ পালতে পারব আমি, তোর ভরণ-পোষন দিতে পারব। নাকি তাও পারিনা? তোর বাপ তোকে আমার হাতে দেবে না। আনিনি আমি তোকে? তোর আমার জিদ সম্পর্কে ধারণা নেই। তোর বাপ দেবে না, আমার বাপ ঘরে তুলবে না। আমি ছাড়া আর কার হাত লেগেছে তোর গায়ে? আমার বাপ আমার কথা মানবে না। আমি গেছি তার বাড়িতে? সে ঘরে তোলে নি, তুই রাস্তায় আছিস? প্রতিদিন শ বার কল করছে। আমি কি শালা মানুষের পরোয়া করি নাকি হে?ʼʼ

থামল এক মুহুর্তের জন্য আবার গর্জে উঠল, “সাতটা বছর, সাত বছর নিজের খরচে চলছি। যেদিন থেকে ইন্টার পরীক্ষায় ফেইল করেছি, বাপ আমায় লজ্জা দেয়া কথা শুনিয়েছিল। তারপর তার আর একটা পয়সা আমার গায়ে লাগাতে দিই নি। আজ অবধি নিজে চলছি, তাতে আমার কমতি দেখেছিস কোনোদিন? আমাকে খারাপ পোশাকে দেখেছিস? খারাপ থাকতে দেখেছিস? কুমিল্লাতে পার্ট টাইম জব করেছি, পড়ালেখা করেছি। এরপর এসেছি ঢাকা, তারপর আমি লালে লাল। কোনোদিন আর আজাদ খানের একটা পয়সা বা তার সাহায্যের প্রয়োজন হয়নি। যখন উপার্জন শুরু করিনি ঠিকমতো, তখন না খেয়ে শুয়ে থেকেছি, আমায় টেনে খাওয়াতে পারেনি কেউ, পুরোনো গেঞ্জি পরে বাইরে যাব না জন্য বাইরেই যাইনি, বই কেনার টাকা যতদিন নিজে কামাতে না পেরেছি ভার্সিটিতে যাইনি, পড়া শুরু করিনি। ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরলে ততটুকু খরচা হাতে নিয়ে ঢুকতাম যা আমি খেয়ে শেষ করতে পারব না। আমায় বাড়ির লোক এমনিই পীর ভোজে? এত আহ্লাদ তাদের আমায় নিয়ে! হাহ! কেন ভোজে পীর আমায়? কারণ, আমি তাদের ফারজাদ মারায় না।ʼʼ

দুটো শ্বাস নিলো ফারজাদ, তাকে দেখতে একদম ক্ষ্যাপা অমানুষের মতো লাগছে। আলোক রশ্মির ন্যায় ঠিকরে বেরোচ্ছে যেন তার ভেতরে বহুদিন ধরে চাপা পড়ে বিলীন হয়ে থাকা ক্ষোভগুলো। যা কেউ জানে না, যা সম্বন্ধে বেখবর আশপাশটা। ফারজাদ একই সুরে বলতে থাকল,

-“আমার বাপ আমায় বলেছিল, ‘তুই আমার ছেলেই না। তোকে আমি জন্ম দিইনি, নয়ত তুই এরকম কাজ করতে পারতি না।ʼ তাহলে কার ছেলে আমি? আমার বাপ কে? পরিচয় নেই আমার, নিশ্চয়ই! ওকে, ফাইন! তারপর থেকে পরিচয়হীন, মনুষত্বহীন জীবন যাপন করছি। কেউ বদলাতে পেরেছে আমায়? সেদিন বাপ হয়ে আমায় অস্বীকার করার ছিল না তার, ধিক্কার দেয়ার ছিল না। ইভার বাপের মতোন সেদিন বাড়িভর্তি লোকের সামনে সে-ও থাপ্পড় মেরেছিল আমায়। ভুলে গেছি সব, তবে ভুলিনি কিছুই।ʼʼ

ফারজাদ থামছে, সংক্ষপ্ত শ্বাস নিচ্ছে, আবার যেন তুফান হয়ে বেরিয়ে আসছে পরিবার এবং জীবনের প্রতি চেপে রাখা আক্রোশগুলো, “এরপর কে থামিয়েছে আমায়?কোনোদিন কারও খরচা বা সাহায্য লাগবে না আমার। কী করেছিলাম আমি? খুব বড়ো এক পাপ। সেই পাপের পেছনে কে ছিল? তোর মতো একটা মেয়ে। তথাকথিত মিষ্টি মেয়ে! এরপর তোরা এসেছিস প্রেম দেখাতে? আমি তছনছ হয়ে যাওয়া এক ধ্বংসপ্রাপ্ত ছাইয়ের স্তূপ। সেখানে কেউ আদিক্ষেতা দেখাতে আসবে না, একদম না, তাতে আমার আগুন বাড়ে, সহ্য হয়না আমার। যখন আমার সঙ্গ প্রয়োজন ছিল, তখন লোকে শুধু আমার সো কলড ভুল আর ব্যর্থতা দেখেছে। এরপর যখন আমি অস্বাভাবিক ভাবে নিজস্ব জীবন যাপন শুরু করেছি তখন সকলের মধ্যমণি হয়ে উঠেছি! এরপরও সব ঝেরে ফেলে আমি যদি তোকে নিজের করতে পারি, আমার শেষ নিঃশ্বাসটুকু দিয়ে তোকে নিরাপত্তা দেয়ার ব্যাপারে যেন কোনো সন্দেহ না থাকে কারও। আমার অহংকার আমার ব্যাক্তিত্ব! আমার ব্যাক্তিত্ব সে যাই-ই হোক! তাতে কেউ আঙুল উঠাবে না। এই অহংকারটুকু সিনার উপরে সেঁটে, ঠোঁটের কোণায় রেখে একদিন আস্তে করে শুয়ে পড়ব শেষ ঘুমে। আমার ব্যাক্তিত্বে আঘাত করার অধিকার কাউকে দিয়ে রাখিনি। তুই দিতে চাইলে, জেনে রাখ, আমি মানুষ ভালো না।ʼʼ

ছেড়ে দিলো ফারজাদ দ্বিজাকে। ওভাবেই দাঁড়িয়ে শাসানোর মতো করে বলল, “আর কোনোদিন যেন ওই দুই বাড়ি যাওয়ার নাম মুখে না শুনি, তোর। আমি বলব, তুই বলতে পারবি না। তাতে আমার মনে হবে আমি নিজের কর্তব্য পালনে ব্যর্থ! তোর দায়িত্ব আমার। তা পালন করার সবটুকু ঘানি আমি টানব, তুই শুধু থেকে যা। কোনো কথা হবে না। তোর বাপ আসবে আমার কাছে, আমার বাপ আসবে, মা আসবে। পুরো গোষ্ঠী আসবে। তুই দেখ, চোখ খোলা রাখ। কলের ওপর কল আসছে। এবার মানুষ আসা শুরু করবে। ফারজাদ, সে সতন্ত্র! তার কোনো পিছুটান নেই। তার সত্ত্বায় কোনো কালো দাগ থাকবে না। বুক উঁচু কোরে যতদিন বাঁচা যায়, ঠিক ততক্ষণ বাঁচব, বেশি না।ʼʼ

ফারজাদ হনহন করে বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে। দ্বিজার থমকানো ভাব কাটল কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে। জিদ আর অহংকারে তৈরী ফারজাদকে পুরোটা বুঝে ওঠা যায় না যেন! কেমন এক অস্বাভাবিক ব্যাক্তিত্ব! দ্বিজা কিছুক্ষণ উদ্ভ্রান্তের মতো বসে রইল বিছানার এক কোণে। ভবিষ্যত বলতে যদি পরের মুহুর্ত হয়, তবে সেই মুহুর্তটাও অনিশ্চিত ভালো-খারাপের বার্তা বয়ে নিয়ে আসছে। কীভাবে এগোবে আগামীতে এই দিন! কী থেকে কী হয়ে গেল!


রান্না ফারজাদ করল। টুকটাক সাহায্য করল দ্বিজা। তাদের দুজনের মাঝে আর কোনো কথা হয়নি। সামাদ সেই ঘরেই বসে আছে, পরখ করে দেখছে রুমটা। টুকটাক দুপুরের খাবার তৈরী করে খেতে বসল ফারজাদ আর সামাদ। একটু-আধটু আলোচনাও চলল তাদের মাঝে। আজ যে লোকটাকে দেখেছে ফ্লাটের বাইরে, তার উদ্দেশ্য আসলে কী ছিল তা নিশ্চিত নয় ফারজাদ। কিন্তু আতঙ্কের বিষয়টা হলো দ্বিজা! সে পুরোদমে ডিউটিতে মনোনিবেশ করলে দ্বিজা ফ্লাটে একা থাকবে। যে বোকারাণী বউ তার! আর তাছাড়াও দরজা কখনও আতঙ্কবাদীদের প্রতিবন্ধক হতে পারে না। ফারজাদের মুখে চিন্তার ছাপ! দ্বিজাকে কোচিংয়ে ভর্তি করানোটাও অনিবার্য হয়ে পড়েছে।

সামাদ দুপুরের খাবার খেয়ে বেরিয়ে গেল। একটা ছোট্ট টিম দরকার তাদের এই প্রজেক্টে। যেটার কার্যক্রম হবে আলামিনকে খুঁজে বের করা। সামাদ চলে গেলে ফারজাদ রুমে এলো। দ্বিজা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ফারজাদ বেশ কয়েকবার ডাকল, জবাব দিলো না সে। একে বলে মেয়ে মানুষ! কী থেকে এরা জমে বরফ হয়ে যায় বোঝার উপায় নেই! ধমকে উঠল, “ডাকছি না তোকে? এদিকে আয়!ʼʼ

দ্বিজার নিরস মুখে এলো। ফারজাদ আদেশ করল,

-“খাবার আন। আর সিনেমাটিক ডায়লোগ দিস না আবার যে–আমার খিদে নেই। খাবার আন, যা।ʼʼ

-“পরে খাচ্ছি। বলেন আপনে।ʼʼ

ফারজাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলল, “আপনে না, ‘আপনিʼ।ʼʼ

খাবারসহ প্লেট হাতে রুমে এলো। দ্বিজার চমক ফুরোচ্ছে না যেন। এখন কি আবার নিজ হাতে খাইয়ে দেবে? অসম্ভব! এটা ফারজাদ! অসম্ভব সম্ভব হলো। ফারজাদ মনোযোগ সহকারে দ্বিজার মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে বলল, “বাড়ির কথা মনে পড়ছে?ʼʼ

কথাটা শুনতে দারুন শান্ত লাগল। দ্বিজা দুপাশে ঘাঁড় নাড়ল। আবার জিজ্ঞেস করল, “রেজাল্ট কেমন হবে আশা করছিস?ʼʼ

-“জানি না।ʼʼ

-“পরীক্ষার সময় প্রেমে পড়লে সেই পরীক্ষার রেজাল্ট না জানাই ভালো অবশ্য!ʼʼ

দ্বিজা লজ্জা পেয়ে গেল। তাদের সম্পর্কটা অদ্ভুত হয়ে উঠেছে। দ্বিজা ধীরে ধীরে জানছে মানুষটাকে, সেই সুবাদে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম ধারণা আর অনুভূতিরা নাড়া দিয়ে উঠছে ভেতরে।

বিকেলে দ্বিজাকে নিয়ে বের হলো ফারজাদ কোচিং সেন্টারের উদ্দেশ্যে। সামাদ ফারজাদের স্যালারিটাও হাতে তুলে দিয়ে গেছে। প্রথম অফিসিয়াল প্রোফেশন হতে আসা উপার্জন ফারজাদের। তার প্রথমটা সে খরচা করতে যাচ্ছে দ্বিজার উদ্দেশ্যে। বাড়ির কথা মনে পড়ল, আবার চেপে গেল ফারজাদের গভীরে। ভর্তির ফরম উঠিয়ে নিয়ে ফারজাদ মালিবাগ মোড়ের বাসস্টপ থেকে দ্বিজাকে নিয়ে একটা বাসে উঠে পড়ল। বিকেল ছয়টার মতো বাজছে। দ্বিজা কৌতূহল নিয়ে চলছে ফারজাদের সাথে। এ লোকের গন্তব্য কোথায়, কী চলছে ভেতরে?

বিজয় সরণী তেঁজগাও রোডে একবার কিছুক্ষণ জ্যামে বসে থাকতে হলো তাদের। দ্বিজা জিজ্ঞেস করল না তারা কোথায় যাচ্ছে! প্রায় দেড় ঘন্টা পর মনে হলো ফারজাদ পৌঁছেছে তার গন্তব্যে। ততক্ষণে সন্ধ্যার আকাশে কালো চাদর পড়েছে। এখন কোথায় যাচ্ছে ফারজাদ!

তারা এসে পৌঁছাল পুকুর বা গাঙ ধরণের এক জলাশয়ের পাড়ে। সন্ধ্যার আকাশের নিচে এই মরা নদীটার সৌন্দর্যও দারুন ফুটে উঠেছে। দ্বিজা প্রশ্ন করে উঠল, “এটা কোথায় এসেছি আমরা?ʼʼ

-“বালু নদী।ʼʼ

দ্বিজার কণ্ঠে বিস্ময়, “এটা নদী? দেখতে তো তেমন লাগছে না?ʼʼ

-“দেখতে কেমন লাগলে সেটা নদী হয়? পানি খুউব বেশি না তাই তো?ʼʼ

-“হু।ʼʼ

-“বলতে পারিস শাখা নদী। শীতলক্ষ্যার শাখা নদী। জানিস, শীতলক্ষ্যা নামটা খুব ভালো লাগে আমার। শুনতে সুন্দর লাগে নামটা, সাথে এর পানির সাথেও বহুত পুরোনো সম্পর্ক আমার। বারবার সময় হলেই ছুটে এসেছি এখানে বহুবার। চল সামনে এগোই।ʼʼ

আবাদী জমির মতো লাগছে আশপাশটা। অনেক শুকনো জায়গা পড়ে আছে আশেপাশে। মনে হচ্ছে খণ্ডকিত ভূখণ্ডের দেশ। সবুজ ঘাসে ছেয়ে আছে আশপাশের চড়গুলো। দ্বিজা লাফিয়ে উঠল, “ওই দেখুন জাহাজ!ʼʼ

ফারজাদ হাসল মৃদু, “ছোটো স্টিমার ওগুলো, জাহাজ না।মালামাল পার করে, বলা চলে।ʼʼ

দ্বিজা মুখ গোজ করল, “দেখতে তো জাহাজের মতো লাগছে।ʼʼ

একদম বাচ্চাদের মতো অভিমানী সুর। ফারজাদ দ্বিজার দিকে বিমুগ্ধ নয়নে চেয়ে চমৎকার নিঃশব্দ হাসল। তা আধারে দৃষ্টিগোচর হলো না দ্বিজার। সে আধারের সমীরে ফুরফুরে এক মনস্তাত্বিক সৌন্দর্য খুঁজে ফিরছে। এত ভালো লাগছে কেন তার? এমন সুখ সুখ অনুভূত হয়নি কখনও। উত্তেজনায় কখন যেন বাহু চেপে ধরল ফারজাদ। ফারজাদ আজ আর সরাল না তার হাতটা। আরও সুবিধা করে দিলো তাকে আঁকড়ে ধরার। নৌকা থেমে আছে পাড়ে। দ্বিজার একটু কষ্ট লাগল–দিনের আলোয় এলে নির্ঘাত ওই নৌকাতে চড়তে পারতো সে! ফারজাদ জীবনেও ভালো হবে না। পাড়ের মাটিতে কচুরিপানা জন্মেছে, তা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

ফারজাদ দ্বিজাকে নিয়ে উপস্থিত হলো বাশ-খুঁটি দিয়ে বানানো সেতুর কাছে। ফারজাদকে ছেড়ে দৌঁড়ে গেল দ্বিজা সেই বাঁশের সাঁকোর ওপর। ফারজাদ সাবধান করল,

-“আস্তে যা। পড়ে যাবি, আমি কিন্তু নায়কদের মতো ধরতে আসব না।ʼʼ

দ্বিজা ভেঙচি কাটল, “প্রয়োজন পড়বে না। আমি পড়বই

সাপের মতোন আঁকাবাঁকা নদীর গড়ন। তা অনুসরণ করে বিশ কিছুদূর হাঁটল দুজন। একস্থানে দাঁড়াল ফারজাদ। দ্বিজার খুব কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল। আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, “ভালো লাগছে?ʼʼ

অস্পষ্টু উচ্চারণকরল দ্বিজা, “হু।ʼʼ

-“তাহলে চল এবার। যাই, রাত হয়ে যাচ্ছে।ʼʼ

দ্বিজা চট করে বসে পড়ল বালুর ওপর। ওর দেখাদেখি বসে পড়ল ফারজাদও। এই সময়টুকু দ্বিজা পার করতে চায় না। আটকে রাখতে চাইছে, তবে সময় খুব অবাধ্য। কথাই শোনে না। চারপাশে ঝিঝি পোকার ডাক। পানির মৃদু কলকল রব। পাশে বসে আছে তার এক জীবনের সধনার পুরুষটি। দ্বিজার মনে নাচ উঠেছে। সে কোনোদিন প্রেম করল না কারও সাথে, বয়ফ্রেণ্ডের হাত ধরে আসেনি কোথাও ঘুরতে। এসেছে স্বামীর সঙ্গে, স্বামীর হাত ধরে। আস্তে করে মাথাটা এলিয়ে দিলো ফারজাদের কাধের ওপর। জড়িয়ে ধরল ফাদজাদের বাম বাহুখানা। পরম আবেশে চোখদুটো বুজল। বুক ফুলিয়ে শ্বাস টেনে নিলো। কেপে উঠল গলাটা। ফারজাদ ডান হাতের তালু রাখল দ্বিজার গালে। জিজ্ঞেস করল, “এই পাগলি, কাঁদছিস কেন? এখানে নিয়ে এলাম কি কাঁদার জন্য?ʼʼ

বাধ ভাঙল বোধহয় দ্বিজার, “কেন নিয়ে এসেছো তাহলে?ʼʼ

উত্তর দিলো না ফারজাদ। দেবে না সে। দ্বিজাও শুনতে চায় না কিছু, আর না চায় আর কিছু বলতে। বুকে ঝড় উঠেছে, লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে ভেতরটা। জীবনের গোটা গড়মিলে হিসেবে মাঝেমধ্যে একটু মিল যা দেখা দেয় তা এরকম ক্ষণিকের মুহুর্তগুলো। তাছাড়া বাকিটা তো ভীষণ এলোমেলো, ব্যথাদায়ক! এটুটু শুষে উপভোগ করা যাক, আর যদি না-ই মেলে পরবর্তিতে…!

চলবে..

#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

২৯.

দিনের পর দিনগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে। ফারজাদকে নেমে পড়তে হয়েছে কাজে। দুপুরের খা খা রোদে সামাদের ঘাম ঝরা হাল। মোহাম্মদপুর বস্তির সামনে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে সে ফারজাদের অপেক্ষা করছে। বস্তিবাসীদের সবার কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, আলামিনের ব্যাপারে। তাদের সবার বয়ান–এই লোক এই বস্তিতে থাকে না, তারা জানে না এর ব্যাপারে। এরপর ফারজাদ ওকে দাঁড় করিয়ে রেখে কোথাও গেছে। কল করল বেশ কয়েকবার। এক সময় ফারজাদ এসে দাঁড়াল পাশে, তার পকেটে এখনও সামাদের কল বাজছে। এটা তার পুরোনো বদভ্যাস, কল আসা ব্যাপারটা নিয়ে কোনোকালেই সে বিশেষ প্রতিক্রিয়াশীল না। সামাদ একটা হতাশ শ্বাস ফেলল। সিনিয়র যদি এমন হয়, জীবনটা এমনিতেই ত্যানা-ত্যানা। ফারজাদের হাতে কাগজে মোড়কের প্যাকেটে কিছু একটা। জিজ্ঞেস করল,

-“ফিরে যাবেন না, স্যার?ʼʼ

-“এক গ্লাস শরবত খেয়ে যাব।ʼʼ

সামাদ অবাক, “স্যার! বস্তিবাসীরা নিজেরাই খেতে পায় না ঠিকমতো। আপনাকে আর কী শরবত করে খাওয়াবে?ʼʼ

ফারজাদ রোদের তেজে মুখ-চোখ কুঁচকে তাকাল একবার। সানগ্লাসটা চোখে এঁটে রাস্তার ওপারে হাঁটা ধরল। সামাদ বেকুব বনে পেছনে হাঁটল। মোহাম্মদপুর বস্তির আশপাশ ঘেষে বড়ো বড়ো বিল্ডিং দাঁড়িয়ে আছে। বস্তি থেকে একটু দূরে এগিয়ে গেল ফারজাদ। রাস্তার পাশে একটি ভ্যানে কিশোর একটা ছেলে শরবত বিক্রি করছে। সামাদ নিজের বোকামিতে জিব কামড়ে ধরল। ছেলেটা শরবত বানাচ্ছে, ফারজাদ একশো টাকার একটা নোট বের করে ভ্যানের ওপর রাখল। এদিকে-ওদিক তাকাল। একটা লোক ছয়তলা এপার্টমেন্টের গেইট দিয়ে বেরিয়ে রাস্তার পাশ ধরে হাঁটছে। মুহুর্ত খানেক লাগল ফারজাদের চিনতে–এটা সেই লোকটা, যে সেদিন রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে তার ফ্লাটে নজরদারী করছিল। জোরে পা চালিয়ে সেদিকে এগোতেই লোকটার নজর পড়ল ফারজাদের দিকে। বিনা নোটিশে দৌঁড়াতে শুরু করল সে।

এই হলো সাসপেক্টদের চরম এক বোকামি। ফারজাদ বোঝে না–এরা নিজেদের সন্দেহমুক্ত রাখতে পারে না কেন? দৌড়ানোর কি বিশেষ দরকার ছিল? তাতে ফারজাদের সন্দেহ এত গাঢ় হতো না। বেশ কিছুদূর দৌঁড়ে, ঘাম ঝরিয়ে ধরা গেল লোকটাকে। সামাদ পিছু পিছু এসে দাঁড়াল। এখানে আর কোনো জিজ্ঞাসাবাদ নয়। আর এখন এ অবস্থায় আশপাশের ফ্লাটে এভাবে দুজন অভিযান চালানো মূর্খতা হবে। এখন আপাতত একে নিয়ে মালিবাগ যাওয়া যাক।

মালিবাগের রাজারবাগ এরিয়ার একাংশ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে স্পেশাল ব্রাঞ্চের সদর দফতরের দশতলা বিল্ডিংখানা। লোকটার নাম মাসুদ। এড-এসপি রুহুল আমিন সাহেবের হাতে মাসুদকে তুলে দিয়ে ফারজাদ বলল, “এবার নিশ্চয়ই এর খেয়াল আপানারা ভালোই রাখবেন। নোট যেন কাজ না করতে পারে এখানে আবার, তাহলে বদনামী হয়ে যাবে।ʼʼ

এড এসপি সাহেব রুষ্ঠ চোখে তাকালেন। ফারজাদ তা অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে এলো বিল্ডিং থেকে। খাড়া দুপুরের সময়। এখন ফ্লাটে গিয়ে ঠাণ্ডা পানিতে লম্বা সময়ের একটা গোসল নিতে হবে। পেটটাও খাবার চাইছে। ওখান থেকে বেরিয়ে মালিবাগের শামসুল আলম সড়কের একপাশ ঘেঁষে হাঁটছে ফারজাদ। সকাল থেকে বহু কল এসে জমে আছে ফোনে। মোহাম্মদপুর থেকে মালিবাগ আসার সময়ও গাড়িতেও কয়েকবার কল এসেছিল। পকেট থেকে ফোনটা বের করল। স্ক্রিন অন করে দেখল–’ফুপাʼ লিখে সেইভ করা নম্বর থেকে বেশ কয়েকবার কল এসেছে। মাড়ি শক্ত হয়ে এলো ফারজাদের। শক্ত হাতে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। কপালের দুপাশে টান ধরেছে, রোদে তার প্রচুর সমস্যা। এখন সাদা পাওয়ার চশমাটা খুব দরকার, চোখ লাল হয়ে গেছে নিশ্চিত!

হেঁটে আউটার সার্কুলার রোড পেরিয়ে শান্তিনগর চৌরাস্তার মোড়ে পৌঁছাল ফারজাদ। একটি পৌঢ়া মহিলা হাতে বিভিন্ন ধরণের ফুলের মালা নিয়ে ঘুরছে। মনটা একটু সপ্রতিভ হলো ফারজাদের, কী মনে করে যেন এগিয়ে গেল সেদিকে। জিজ্ঞেস করল, “দাম কত খালা, এগুলোর?ʼʼ

-“পঞ্চাশ টাহা করে দিও।ʼʼ

সাইজে বড়ো ফুলের গোছাগুলো, দ্বিজার হাত তো চিকন। জিজ্ঞেস করল, “কোথায় ব্যবহার করা যাবে এগুলো?ʼʼ

মহিলা বুঝল না কথাটা। ফারজাদ বুঝিয়ে বলল, “মানে কোথায় পরতে পারবে এগুলো?ʼʼ

মহিলা হাসল, “বউমারে দিও, সে নিজেই বুঝবো কোনহানে পিন্দা লাগে।ʼʼ

ফারজাদ কপাল উঁচিয়ে অস্পষ্ট ভঙ্গিতে আটকে যাওয়া হাসি হাসল একটু। বিল্ডিংয়ের আড়ালে ছায়ায় দাঁড়িয়েছে তারা। ফারজাদ সানগ্লাসটা খুলে শার্টের কলারে ঝুলিয়ে বলল, “দুটো দিন তাহলে।ʼʼ

মানিব্যাগে টাকার মধ্যে দুইশো টাকার একটা চকচকে নোট আছে তার কাছে। যেটা সে বহুদিন ধরে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। তার এত ম্যাচিউরিটির ভিড়ে এই একটা বাচ্চামি। তবে আজ কোন খুশিতে যেন মহিলাকে নোটটা ধরিয়ে দিয়ে ফুলের ছড়া দুটো কাগজের মোড়কওয়ালা হাতের ব্যাগটিতে ভরে নিয়ে হনহন করে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। মহিলা কিছু বলার সুযোগ পেল না। শুধু কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি মেলে চেয় রইল পেছন থেকে।

বেশ কিছুক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে ফ্লাটের দরজার বাইরে। সকালে বের হবার আগে ভালো করে সাবধান করে গেছে দ্বিজাকে। তার মানে কি এই–ফারজাদ আসলেও দরজা খোলা যাবে না? কণ্ঠস্বর চিনতে পারছে না নাকি এই মেয়ে? এই যে গলা ফাটিয়ে নাম ধরে ডাকছে, আর ধাক্কাচ্ছে! নাকি গোসলে ঢুকেছে? কিছু সময় পর এসে নিরস মুখে দরজা খুলে দিলো দ্বিজা। ফারজাদের চোখে মুখে কেমন এক চমক! চঞ্চল চোখে তাকাল দ্বিজার দিকে। দ্বিজার চোখ ফুলে আছে, টসটসে জলের ছাপ লেপ্টে আছে পুরো মুখজুড়ে, চেহারা জুড়ে অদ্ভুত আহ্লাদি মলিনতা ছেয়ে আছে। বুঝল না প্রথমে কিছুই, ভেতরে এক অস্থির উত্তেজনা বয়ে গেল ফারজাদের, অস্থির করে তুলল অজানা শঙ্কা তাকে। দ্রুত ভেতরে ঢুকে হাতের ব্যাগটা একপাশে রেখে একদম কাছে এগিয়ে এলো দ্বিজার। ব্যাতিব্যস্ত স্বরে শুধাল, “কী হয়েছে তোর? এই, কথা বলছিস না কেন? কেউ এসেছিল? কিছু হয়েছে, কেউ কিছু বলেছে? দরজায় এসেছিল কেউ?..ʼʼ

কথা ফুরালো না ফারজাদের। থেমে গেল হঠাৎ-ই। খোলা দরজার ফাঁক গলিয়ে নজরে এলো তার–শোবার ঘরে বিছানার ওপর বসে আছেন এক পুরুষ–হাবিব সাহেব! ফারজাদ থমকাল একটু, একটা ঝটকা খেল ভেতরে। অসহায়ের মতো ঢোক গিলে দ্বিজার দিকে তাকাল। মাথা নুইয়ে বিপন্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। বাপকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছে নাকি? চেহারা তো সে কথাই বলছে। দ্বিজা আস্তে করে বলল, “সেই কখন থেকে কল করছে আব্বু, ধরছিলেন না কেন? কোথায় ছিলেন?ʼʼ

ফারজাদ নিরুত্তর। কেবল চেয়ে রইল ক্ষণকাল তার আজব দৃষ্টি মেলে। চোখটা আস্তে করে নামিয়ে নিলো। ভীষণ শান্ত আর চাপা মানুষ সে। একসময় ধীর পায়ে দ্বিজাকে পাশ কাটিয়ে ফ্লাটের কমন বাথরুমের দিকে চলে গেল, যেটা ডাইনিং স্পেসের একপাশে অবস্থিত। দরজা লাগিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চোখদুটো বুজে, মাথাটা আওলে দিলো শক্ত টাইলসের দেয়ালে। কয়েকটা বুক হালকা করা শ্বাস নিলো। উহু, হচ্ছে না বোধহয়! চোখের স্মৃতিতে নাচছে–দ্বিজার জল শুকানো মুখটা, হাবিব সাহেবের বসে থাকার দৃশ্যটা। এরপরই ভেসে উঠল পুরোনো স্মৃতিতে, যখন সেদিন হাবিব সাহেব কষে এক থাপ্পড় লাগালেন ফারজাদের গালে। ফারজাদ নির্বিকার, নিথর, শান্ত চোখে চেয়ে ছিল কেবল। এরকম থাপ্পড় সে বহু খেয়েছে জীবনে। থাপ্পড় খেয়ে খেয়েই তো এই অবধি! এরপর হাবিব সাহেব দ্বিজাকে মারতে গেলেন, ফারজাদ গিয়ে সামনে দাঁড়াল, দ্বিজার হাতটা চেপে ধরে বেরিয়ে এলো দ্বিজাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে। এরপর তার মস্তিষ্কে এক তিক্ত স্মৃতিচারণ ঘটল–সেদিন দ্বিজা যখন বাবার সামনে দাঁড়িয়ে ফারজাদকে ডিফেন্স করছিল, জোর কণ্ঠে বলেছিল ‘ভালোবাসি আমি ফারজাদকে।’

ওখানেই তো ধ্বংস ফারজাদের! তড়াক করে চোখের পাতা খুলল ফারজাদ। আয়নাতে নিজের বিধ্বস্ত চেহারাখানির দিকে চেয়ে রইল। তুমি বোকা ফারজাদ! মূর্খ তুমি! এই যে লোকে তোমায় কঠিন বলে, কঠোর বলে, অমানুষ বলে! তারা নাহয় তোমায় চেনে না, তুমি তো চেনো নিজেকে! তোমার মতো অল্পতে বিগলিত, পূর্ব-অভিজ্ঞতা ভুলে সিদ্ধান্ত নেয়া, খুব অল্পতে আগলে নেয়া মানুষটাকে কী করে লোকে সচেতন বলে! বরাবর তোমাকে ঘাত সয়ে যেতে হবে! কারণ তুমি শুধরাও নি, শুধরাবে না। তাহলে তুমি কেন নিজেকে সচেতন বলো, তুমি কেন নিজেকে অভঙ্গুর বলে অহংবোধ করো! নির্বোধ পুরুষ! নারী ধোঁকা! আচ্ছা! আসলেই কি তাই? মেয়ে কি তবে শুধুই ক্ষণিকের সৌন্দর্য ও মায়ায় ডুবিয়ে মারার ষড়যন্ত্র মাত্র! কেউ ব্যাতিক্রম নয়, সবই মিথ্যাচার মাত্র! সবই লোক দেখানো! আবার ভুল করেছো তুমি ফারজাদ! আবার ফেঁসে গেছ ভুলের মাঝে! ধিক্কার তোমাকে!

নিজেকে উপহাস করল ফারজাদ। তার চোখের সূক্ষ্ম শিরায় র ক্ত জমেছে, জল ছলছল করছে নাকি মণিতে? অস্বীকার করল ফারজাদ, ওটা জল না। ধোঁয়া লেগেছে চোখে। কিন্তু ধোঁয়া তো নেই আশপাশে! নিজের ভেতরের প্রশ্নে ক্ষেপে উঠল ফারজাদ। ধমক দিলো, ধোঁয়া নেই? ভেতর থেকে আবার বলে ওঠে, আচ্ছা! কীসের ধোঁয়ার কথা বলছো? কিছু পুড়ছে নাকি তোমার?

আয়নায় নিজের সরূপের দিকে তাকিয়ে থেকে চট করে হেসে ফেলল ফারজাদ। কী আজব দেখালো সেই হাসি! ওভাবেই আয়নার দিকে চেয়ে থেকে বাম হাতে ঝরনা চালু করল। ডানহাতে শার্টের বোতামগুলো খুলল এক এক করে। ঘর্মাক্ত শার্টটা ছুঁড়ে মারল বাথরুমের সাদা টাইলসে। নজর তখনও আয়নায় নিজের চোখজোড়া বরাবর তার। দেয়ালের দিকে ঝুঁকে হাতের তালু দেয়ালে ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ওভাবেই ভিজল অনেকক্ষণ। আধাঘন্টা বা তারও বেশি সময় পর দ্বিজাকে ডাকল, তোয়ালে আর প্যান্টটা দিয়ে যেতে। খুব স্বাভাবিক স্বর তার।

এরপরও আরও দশ মিনিটের মতো লাগল তার বের হতে। গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে রুমে ঢুকল হাসি হাসি মুখে। জিজ্ঞেস করল, “কী অবস্থা, ফুপা? কেমন আছেন?ʼʼ

হাবিব সাহেব লজ্জা পাচ্ছেন। এই ছেলেটাকে সেদিন কত অপমান আর তামাশা করে ছেড়েছেন তিনি। আসলে বদমেজাজী মানুষদের এই একটা সমস্যা! তারা মেজাজ উঠে গেলে যা করেন, পরে তার জন্য তারাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট পান। বললেন, “আছি ভালোই। তোমার তো খোঁজ নাই। তোমার ফুপু তো পেরেশান মেয়ের জন্য।ʼʼ

হেঁটে গিয়ে ওনার পাশে বসতে বসতে বলল ফারজাদ, “ফুপুকে আনলেন না কেন?ʼʼ

একটু দ্বিধাগ্রস্থ কণ্ঠে বললেন, “তোমাদের নিয়ে যাইতে বলছে তোমার ফুপু।ʼʼ

ফারজাদ হাসল একটু, অদ্ভুত হাসি। হাসিটা বজায় রেখে বলল, “সে নাহয় যাবে দ্বিজা..

-“ক্যান! তুমি যাবা না? তোমার আব্বারে কল দিছিলাম। ভাইজান বললেন, তোমারে নিয়ে যাইতে। তোমার আম্মা তো তোমার শোকে পাগল হয়ে যাচ্ছে!ʼʼ

আঁটকে যাওয়া কণ্ঠে বললেন কথাগুলো হাবিব সাহেব। খুব জড়তা কাজ করছে এসব কথা বলতে তার। তিনি যে কতটা অনুতপ্ত তা এই ছেলেটার কাছে প্রকাশ করতে খুব লজ্জা লাগছে। সেদিনের ঘটনার পরও ফারজাদের এতো স্বাভাবিক আর আন্তরিকতা তাকে আরও লজ্জায় ফেলছে। ফারজাদ সব কথা অগ্রাহ্য করে বেশ স্বাভাবিক স্বরে বলল, “আমি? আমার যে কাজের চাপ চলছে! বোঝেনই তো এই চাকরির ব্যাপার। দ্বিজা তো যাচ্ছেই! দ্বিজা! রান্না করেছিস?ʼʼ

দ্বিজার বুক থেকে যেন পাথর নেমে গেল। সে ভয়ে ছিল, না জানি কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে ফারজাদ এ অবস্থায়! অথচ মানুষটা কত সাবলীল, স্বাভাবিক। আস্তে করে মাথা নাড়ল, “না, রান্না করিনি।ʼʼ

-“ফ্রিজে মাংস আছে না? ওটা ভিজিয়ে রাখ, আমি আসছি।ʼʼ

দ্বিজা চলে গেল। তার এখন ভালো লাগছে। মনটা হালকা লাগছে। ফারজাদ রান্না করল, দ্বিজা হাতে হাতে সাহায্য করল তাকে। অবশ্য রান্নার মাঝে বিশেষ কথা হয়নি দুজনের! তবে দ্বিজার খুব বলতে ইচ্ছে করল, আপনাকে যতটা শিমুর, আর অমানুষের মতো ভেবেছিলাম, আপনি একদম তেমন না।
ফারজাদের কী বলবে? সে নিজে এত কিছুর পর, এতদিন পরে আব্বুকে নিজের নতুন ঠিকানার দরজায় আকস্মিক দেখে কেমন বুক আওলে গেছিল। বাবা যখন মেয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করে, ক্ষমা চায়, আগলে নেয় বুকে, মেয়ের সাধ্যি কোথায়, সে কঠোর হয়! তার ওপর দ্বিজার একটুও মন বসে না আজকাল এই চার দেয়ালের বদ্ধ ফ্লাটে। ফারজাদ যখন আটকে-উটকে রেখে বের হয়ে যায়, বদ্ধ ফ্লাটে তার দম আটকে আসে, কান্না পায়। ছুটে কুমিল্লা চলে যেতে ইচ্ছে করে। আম্মুর কথা মনে পড়ে, ছোটো ভাইটার কথা মনে পড়ে। আর, ওই মেজাজী আব্বুটার রাগান্বিত মুখটার কথাও তো পড়ে।

বাপ তো! বাপেরা বোধহয় এমনই হয়। বাড়ির লক্ষী যখন ঘর ছাড়ে, এই মানুষগুলো খুব নিঃস্ব হয়ে পড়ে, বেসামাল হয়ে ওঠে এদের হাহাকার। সব ভুলে মেনে নেয় আরেকবার সবটা। হাবিব সাহেব সেই রাত থেকে পুড়ছেন, কিন্তু নিজের কড়া স্বভাবের দরুন তা প্রকাশ করতে পারেননি। সেই মুহুর্ত থেকে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে তার বুকের মাংস। শেষ অবধি আর পারলেন না বজায় রাখতে। আর মাসখানেকও নেই তিনি দেশে আছেন। অতৃপ্ত হয়ে দেশের মাটি ছাড়ার সাহস হয়নি তার। মেয়েকে দূরে রেখে আরও দূরে চলে যাবার সাধ্য হয়নি তার। ছুটে এসেছেন মেয়ের কাছে। তিনি বহুদিন পর উপলব্ধি করেছেন, তার ভেতরেও একটা নরম মন আছে, বহুদিন পর আবার মনে পড়েছে তার–তিনি দেশ ছেড়ে প্রাবাসে আছেন তো সন্তানদের জন্যই! তাহলে সন্তানদের ওপর তার এই রূপ কেন? ফারজাদের বলে আসা কথাগুলো তাকে প্রতিক্ষণে খাবলে খেয়েছে! বাবা নয় সে! এমনই বলেছিল ফারজাদ।

খেতে বসে, দ্বিজাকে হাবিব সাহেব গালে তুলে খাইয়ে দিলেন। দ্বিজার বুকটা আবারও ভিজে ওঠে। কুমিল্লার উদ্দেশ্যে বের হতে হতে তাদের সন্ধ্যা লাগল। দ্বিজা নেচেকুদে তৈরী হচ্ছে আব্বুর সাথে বাড়ি যাবার জন্য। ফারজাদ হাসল–অদ্ভুত এই মেয়েজাত! একসময় এভাবেই নেচেছিল তার এই শ্মশান কুঠিরে যেচে আসার জন্য!

ফ্লাট থেকে বের হবার সময় একবার ফিরে তাকাল দ্বিজা পিছনের দিকে। তার এমন লাগছে কেন! যেন ছেড়ে যাচ্ছে এই ফ্লাটটা! আবার তো আসবে কদিন পর! মানুষ এমনই, যেকোনো জিনিসের মায়ায় জড়িয়ে যায়। এই ইট-পাথরের কাঠামোতে দাঁড়িয়ে থাকা বিল্ডিংয়ের এক ফ্লাটও কেমন মায়ায় বাঁধছে!

মালিবাগ বাসস্ট্যান্ড অবধি যাবার সময় দ্বিজা আর আব্বুর হাত ধরল না। ফাদজাদের হাতখানা চেপে ধরে পৌঁছাল সেখানে। আটটার বাস তাদের।

বাসে ওঠার সময় বাসের দরজায় ব্যাগটা তুলে দিলো ফারজাদ। দ্বিজা দৌঁড়ে উঠে গিয়ে বসল জানালার পাশে। তখন হুট করে ফারজাদের কথা মনে পড়ল আবার। মনটা কেমন হু হু করে উঠল। ফারজাদকে একবার বলল না তো সে চলে যাচ্ছে! লাফাতে লাফাতে উঠে এলো বাসে। বাস ছেড়ে দিয়েছে। ধীর গতিতে এগোতে শুরু করেছে। দ্রত ফারজাদকে দেখার জন্য যখন জানালা দিয়ে মুখ বাড়াল, ফারজাদ ঘুরে হাঁটা শুরু করেছে। পেছন থেকেও দ্বিজা বুঝতে পারে, ফারজাদের ঠোঁটের ভাজে সিগারেট, হাতে লাইটার। হাত উচিয়ে ধরে সিগারেটে আগুন লাগাচ্ছে। একফালি ধোঁয়া উড়ে গেল সামনের দিকে, ফাদজাদ এগিয়ে যাচ্ছে বাস ছেড়ে ক্রমশ সামনের দিকে।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে