তপ্ত সরোবরে পর্ব-২১+২২+২৩

0
437

#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মর্তুজা

২১.

ফজরের নামাজ আদায় করে একটু ঘুমিয়েছে দ্বিজা। বেশা নয়টার দিকে বালিশের পাশে থাকা ফোনটা ভাইব্রেট হচ্ছে, সাথে বিকট আওয়াজ। বিরক্ত হয়ে ফোন কানে তুলে নিলো দ্বিজা।

-“দিনকাল কেমন যাচ্ছে শালী সাহেবা!ʼʼ

দ্বিজা অস্পষ্ট উচ্চারণ করল, “ইরফান ভাইয়া!ʼʼ

-“হু, ইরফান ভাইয়া। এখনও ওঠো নি ঘুম থেকে? বেশি সুখে মানুষের ঘুম বাড়ে নাকি?ʼʼ

দ্বিজা উঠে বসল এবার, ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল–বেশি সুখ! ইরফান বলল, “বুঝলে শালী সাহেবা! কাহিনিতে টুইস্ট আসছে।ʼʼ

কথাটা বুঝতে পারল না দ্বিজা, “মানে? সাতসকালে কীসের টূইস্ট দিতে ঘুম ভাঙালেন ভাই আপনি? জীবনে এমনিতে কি প্যাচের অভাব পড়ল নাকি?ʼʼ–একটু তাচ্ছিল্য করে বলল কথাটা দ্বিজা।

-“গতকাল ফারজাদ ওয়াহিদকে তোমার মতামত জানার জন্য বলেছে।ʼʼ

দ্বিজা অবাক হলো, “ফারজাদ?ʼʼ

-“হুম, ফারজাদ। এটাও বলেছে তুমি তাকে ভালোবাসো। বিয়ে ভাঙার চেষ্টা বলেই মনে হচ্ছে।ʼʼ

-“আশ্চর্য! তা বলার তার এমন কীসের দরকার পড়ল? এরকম ইতর লোক আমি দুটো দেখিনি। চাচ্ছেটা কী সে?ʼʼ

-“উহহুহ! ওই ইতরকেই দিল দিয়ে বসে আছো। এটা ভুলে যাওয়া যাবে না।ʼʼ–হাসল ইরফান।

দ্বিজা যেন গম্ভীর গলায় বলার চেষ্টা করল, “সেসব পুরোনো কথা।ʼʼ

ইরফান হেসে ফেলল, “বাপরে! দু’দিনে কথা পুরোনো হয়ে যায় তোমার কাছে। তুমি তো খুব এডভান্স, দ্বিজা!ʼʼ

-“মজা নিচ্ছেন?ʼʼ

“নিচ্ছি অল্প একটু। শোনো, এখন কথা হচ্ছে, এতে যা বুঝলাম তা হলো– ফারজাদ বাবু বোধহয় সন্তষ্ট না তোমার বিয়েতে, বুঝলে!ʼʼ

দ্বিজা তাচ্ছিল্য হাসল, “ভাই আপনি খুব বোকা। অন্তত ওই মানুষটাকে জানার ক্ষেত্রে। এই তো দু’দিন আগেও বিয়ের শুভেচ্ছা জানিয়েছে আমায়। এখন আবার বলবেন, তাহলে কাল কেন ওয়াহিদকে এমন বলেছে? সে খুব ন্যায়পরায়ণ লোক তো! সেদিন জানতে পারল আমার মত ছিল না বিয়েতে। তাই একটু ইনসাফ দেখাতে গিয়েছিল। সে আবার কোনো মেয়ের সাথে অবিচার হতে দেখতে পারে না। এসব নিয়ে ভাববেন না। তাকে চেনায় এরকম ভুল আমিও করেছি আগে বহুবার।ʼʼ

আরও দু-চারটে কথা বলে ফোন রাখত দ্বিজা। ফারজাদ কী চাইছে? সে যা ভাবতে চাইছে তা ভাবতেই নিজের ভাবনার ওপর উপহাস করে হেসে উঠল। নিজেকে বিদ্রুপ করল–দ্বিজা তুই খুব কাল্পনিক। তবে কল্পনাও একটা সীমার মধ্যেই বদ্ধ রাখা দরকার। এসব বোকা ভাবনা ভাবার ফুরসত দিতে নেই মস্তিষ্ককে। আর যেখানে লোকটা ত্যাগের তালিকাভুক্ত হয়ে পড়েছে..


একদিন কেটে গেছে মাঝে। আজ মঙ্গলবার। আজাদ সাহেব খেতে বসেছেন। সকাল সাড়ে আটটার মতো বাজছে। আড়ৎয়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবেন তিনি। ফারজাদ নেমে এলো সিঁড়ি বেয়ে। পরনে তার থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, একটা টিশার্ট, এলোমেলো চুলে আলুথালু বেশ। চুলে হাত চালাতে চালাতে এসে বসল একটা চেয়ারে। উপস্থিত চারজোড়াজোড়া চোখে বিস্ময়। এসময় না ফারজাদের ঘুম ভাঙে আর ভাঙলেও তার খেতে দেরী হয়।

-“একটু কি মানুষ হইতেছিস দিন দিন!ʼʼ

আজাদ সাহেবের কথার এক অবাঞ্ছনীয় জবাব দিলো ফারজাদ, “না তো। তেমন কিছুই না। আম্মা, এককাপ কফি-টফি দেন।ʼʼ

ফিরোজাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আম্মার ঘর থেকে টোস্ট বিস্কুট এনে দে, যা।ʼʼ

আফছানা বেগম কফি নিয়ে এলেন। ফিরোজা টোস্ট এনে রাখল টেবিলের ওপর। ফারজাদ গোটা প্যাকেটটা নিয়ে বসল। একটা বিস্কুট কফিতে ভিজিয়ে ধরে বলল, “আম্মা! আমার এখন বিয়ে করে নেওয়া উচিত না?ʼʼ

অবাক হওয়ার সাথে সাথে সকলে লুকানো খুশি আর কপট রাগ নিয়ে তাকাল ফারজাদের দিকে। আজাদ সাহেব বললেন, “সেই সুমতি তোর হইলে তো!ʼʼ

-“ধরুন হয়েছে।ʼʼ

ফারহানা বেগম উত্তেজনা চেপে বললেন, “তাহলে মেয়ে দেখব, বাপ? এই জন্যই আসছিস এবার? বাদর, আগে বললেই তো আমি দু’দিন আগে থেকে দেখা শুরু করতাম আর..ʼʼ

-“রিল্যাক্স আম্মা! আপনাদের খাটুনি খাটতে হবে না। মেয়ে আছে, মেয়ে দেখার পরেই বিয়ের পোকা খোচাচ্ছে টুকটাক ভেতরে।ʼʼ


মাগরিবের নামাজ পড়ল দ্বিজা। অনেকক্ষণ বসে রইল জায়নামাজে। কী চলছে জীবনে তার? কোন দিক অভিমুখে বয়ে চলেছে জীবনতরী? কত জটিল হয়ে উঠছে পারিপার্শ্বিক অবস্থাটা। দ্বিজার আজকাল মনে হয়, সবচেয়ে অসহায় আর কঠিন মেনে নেওয়া হলো–নিজের ইচ্ছে ও পছন্দের বিরুদ্ধে কাউকে জীবন-সঙ্গী হিসেবে মেনে নেওয়াটা। যাকে কোনোদিন চাওয়া হয়নি, জীবনে কখনও স্বপ্ন দেখা হয়নি, যাকে ঘিরে মায়াময় শক্ত পিছুটান নেই, যার প্রতি মুগ্ধ হওয়া হয়নি, যাকে প্রার্থনায় চাওয়া হয়নি সেরকম এক অপরিচিতর নামে জীবনটা সঁপে দেওয়াটা এত নিষ্ঠুর অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে ভেতরে। মনে কেউ না থাকলে অবশ্যই কাউকে জায়গা দেওয়ার চেষ্টা করা যায়, জায়গা হয়েও যায়। অথচ অন্য কাউকে পুষে রেখে আরেকজনের নামের সাথে জুড়ে যাওয়ার মতো এই সংকটময় দিন কেন এলো তার জীবনে? এত কঠোরতার খেলায় মত্ত হয়েছে জীবন তার সাথে! দ্বিজা পারবে মেনে নিতে, তবে ভালো থাকতে পারার উপায় কী!

ফোনটা বেজে উঠল, দ্বিজা উঠল না। একাধারে বাজছে, দুবার, তিনবার। বিরক্ত হয়ে চোখ মুছে উঠে ফোনটা হাতে নিলো। ফারজাদের কল। দ্বিজা বিস্মিত হলো বটে, তার চেয়ে জোরালোভাবে বুকের ভেতরে সূঁচাল এক যন্ত্রণা নাড়াচাড়া দিয়ে উঠল। সামলালো নিজেকে। বহু দুর্বলতা দেখিয়েছে সে।

-“কল রিসিভ করছিস না কেন?ʼʼ

-“কৈফিয়ত চাচ্ছেন?ʼʼ

-“প্রশ্নই ওঠে না। আমি কেন তোর কাছে কৈফিয়ত চাইব? চারবার কল দিয়েছি। লাইন ব্যস্ত ছিল।ʼʼ

দ্বিজা হতাশ শ্বাস ফেলল। বলল, “কেন কল করেছেন?ʼʼ

-“তোর বাপ কোথায়?ʼʼ

-“বাজারে গেছে। কেন?ʼʼ

-“ফুপু?ʼʼ

দ্বিজার অস্থির লাগছে এই লোকের সঙ্গে কথা বলতে। কেমন যেন বুক ভার হয়ে উঠছে, সাথে অস্বস্তি ঘিরে ধরছে খুব। আস্তে করে বলল, “বাড়িতে।ʼʼ

মুহুর্তের মাঝে কল কেটে গেল। দ্বিজা কপাল কুঁচকে তাকাল ফোনের দিকে। আশ্চর্য লোকটা আম্মু-আব্বুর খোঁজ নিতে কল করেছিল কেবল? কেন? দ্বিজা ফোন রেখে বাথরুমে গেল ফ্রেস হতে। মুখে-চোখে পানি দিয়ে বেরিয়ে গামছা খুঁজল পেল না। রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং রুমে আসল। দরজায় করাঘাত পড়ছে। দাদি দরজা খুলে দিয়েছে, ফারজাদ ঢুকল ভেতরে। সেদিকে চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়াল দ্বিজা। বুকটা ধুক করে উঠল। এই লোক এখানে কেন এসেছে? আশ্চর্য! তাহলে কি বাড়ির আশেপাশেই ছিল? কিন্তু এসেছে-টা কেন? ফারজাদ এগিয়ে আসতে আসতে দ্বিজার শুকনো মুখটা দিকে তাকাল। দ্বিজাও তাকিয়ে রয়। মস্তিষ্ক চোখ সরাবার নির্দেশ দিলেও যেন চোখ আজও নিজেকে বড়ো নির্লজ্জ প্রমাণ করল। মানল না সেই নির্দেশ, তাকিয়ে রইল লম্বাটে মানুষটার দিকে চোখ উচিয়ে। দ্বিজার দিকে তাকিয়ে থেকেই গলা বাড়িয়ে ডাকল ফারজাদ,

-“ফুপু…!ʼʼ

দিলরুবা বেগম দৌঁড়ে এলেন রান্নাঘর থেকে। বিস্মিত ও আতঙ্কিত চোখের দৃষ্টি তার। ফারজাদ হাসল মৃদু, “ভয় পাচ্ছ নাকি, ফুপু?ʼʼ

দিলরুবা বেগম আস্তে করে ঘাঁড় নেড়ে ‘নাʼ বোঝালেন। যে যা-ই বলুক এই খিটখিটে ফারজাদকে তিনি খুব ভালোবাসেন। কেন বাসেন জানেন না। তবে কেন জানি মনে হয় এই ছেলেটাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না। একে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এটা গোপনে হলেও মানতে হবে। কেমন করে যেন তাকিয়ে রইলেন ফারজাদের দিকে। ফারজাদ হেলেদুলে এগিয়ে গেল একটু। ফুপুর চোখে চোখ রেখে বলল, “যদি অনুমতি দাও দ্বিজার সাথে একটু কথা বলব।ʼʼ

একটু থেমে একটা শ্বাস নিয়ে বলল, “ভয় পেও না। ফুপা আসলে হেন্ডেল করে নেব আমি। আর আসব না কখনও বোধহয়, হতে পারে শেষবার কথা বলব আজ। হয় শেষবার নয়ত শুরু।ʼʼ

ফারজাদের কণ্ঠে কিছু ছিল। যাতে অজান্তেই গা’টা শিউরে উঠল দ্বিজার। কী কথা বলবে মানুষটা? চোখটা ফিরিয়ে নিলো। বুকটা অপ্রত্যাশিত কোনো আতঙ্কে মুচড়ে মুচড়ে উঠছে খুব। পেটের ভেতরে পাক জড়িয়ে আসছে। খুব অস্বস্তি আর বুক ধড়ফড় করছে কেন জানি। ফারজাদ হেঁটে গিয়ে দ্বিজার ঘরের সাথে লাগোয়া ছোট বারান্দাটায় দাঁড়াল। দ্বিজা কী করবে ঠিক বুঝে আসছে না তার। এত বাজেভাবে বুক কাঁপছে কেন? কী মুশকিল! গা ঝিমঝিমে অনুভূতি হচ্ছে। শরীরটা কেমন অদ্ভুত শিহরণে উত্তেজিত হয়ে উঠছে। ফারজাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে না। দুটো গভীর শ্বাস ফেলল। নিজেকে ধাতস্থ করল। আম্মুর দিকে একবার তাকিয়ে ঘুরে হাঁটা লাগাল বারান্দার দিকে। হাহ! লোকটা বারবার আসছে বুকের জ্বালা বাড়াতে, বারবার এসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে দুর্বল, ক্ষীণ অনুভূতিতে ভেঙে পড়া দ্বিজার খুব কাছে।

-“শুধু আমি বলব। তুই শুনবি, কোনো উত্তর দিবি না। অল্প কিছুক্ষণ সময় দে শুধু।ʼʼ

দ্বিজার বুকের আলোড়ন টের পাচ্ছে না এই লোক। কেন জানি তাকাতে ইচ্ছে করল না ফারজাদের দিকে। চাপা এক ক্ষোভ ঘিরে ধরছে ক্রমশ!

-“বাসের দুটো টিকেট কেটেছি আগামীকাল সন্ধ্যার। এবার আর কেন জানি একা ঢাকা ফিরতে ইচ্ছে করছে না। কী মনে করে যেন দুটো টিকেট কেটে ফেললাম। শুধু শুধু একটা টিকেট গচ্চা যাবে। আমার তো সিট একটা হলেই চলে। বাড়িতে বললাম, বিয়ে করব ভাবছি। সায় দিলো। কিন্তু যখন তোর নাম বললাম–বলেছে হাবিবের মেয়েকে নিয়ে ওই বাড়িতে ঢুকার অধিকার রাখি না আমি। তোর বাপ ফোন করে আমার পরিবারের ভালো মতো খিস্তি ঝেরেছে। তোর বাপের ক্ষোভ আমার পরিবার নিয়ে, আমায় নিয়ে এত ফাটে কেন মাথায় ঢোকে না। বহুত কথা শুনিয়েছে তোর বাপ। আমার নাকি জন্মে দোষ ছিল, এজন্য আমি কুলাঙ্গার, আর অভিশপ্ত। ভালো, শুভ যেকোনো কাজে বাঁধা হয়ে দাঁড়াই। যেমন তোর বিয়েতে বাধা হয়েছিলাম।তোর শুভ বিয়েতে তোর মনের অবস্থার জন্য যে বাধা সৃষ্টি হয়েছিল, তার জিম্মাদার আমি। অবশ্য ভুল বলেনি তোর বাপ।ʼʼ

একনাগাড়ে বলে গেল কথাগুলো ফারজাদ। দ্বিজা যে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সেদিকে তার সমীহ নেই বিশেষ। এবার যেন দ্বিজার ভেতরের জলন্ত আগুনটুকু বেড়িয়ে এলো শব্দ হয়ে, “কী ভাবেন আপনারা আমাকে? ঘরের আসবাব? যেখানে যেভাবে রেখে দেবেন দাঁড়িয়ে থাকব চিরকাল। ইচ্ছেমতো জায়গা পরিবর্তন করবেন, রঙ লাগাবেন, ডিজাইন করবেন মনমতো? আমি জড়ো পদার্থ! আমি বাচ্চা ছেলের হাতের খেলনা? যখন তখন মা-বাপ, আপনি খেলছেন, মন ভরলে ছুঁড়ে ফেলছেন, আমি পড়ে থাকছি যেখানে সেখানে?ʼʼ

কান্নার তোড়ের সঙ্গে গর্জে উঠল দ্বিজা। কান্নাভেজা কণ্ঠস্বর ছাপিয়ে বেজে উঠল দ্বিজার ঝাঁজাল গলাটা। দিলরুবা বেগম ভেতরে দ্বিজার ঘরে এসে দাঁড়াল। ততক্ষণে দ্বিজাও চিৎকার করতে করতে এসে ঘরে দাঁড়িয়েছে। ফারজাদ শান্ত পায়ে হেঁটে এসে বসল দ্বিজার বিছানায়। দিলরুবা বেগম হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চোখে-মুখে নিদারুন হতাশা! কেমন বিবর্ণ মুখের ভাব। নেতিয়ে গেছে আজ এক মেয়ের মায়ের। ফারজাদ খুব বেশি সময় নিলো না, প্রশ্ন করল,

“আমি খুব খারাপ, তাই না ফুপু? হুহ.. আমি কখনও অস্বীকার করিনি এ-কথা। তবে আমি ঠিক কেমন ধরনের খারাপ, তা নিয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। প্রায়ই লোকে বলে–আমি মানুষ না। আমার শরীরে মানুষের চামড়া নেই। এটাও মানতে চাই আমি। কিন্তু যুক্তির কাছে হেরে যাই। সকলেই শুনেছে কথাটা–মানুষ মাত্রই স্বার্থপর। সেখানে আমি মাত্রার অতিরিক্ত স্বার্থপর। হিসেবে কিন্তু আমি অতি মানুষ। সে চামড়া এখন মানুষের না-ই থাক। সূত্রানুসারে, আমি কিন্তু সকলের চেয়ে বেশি মানুষ, কারণ আমি সকলের চেয়ে বহুত গুণে বেশি স্বার্থপর।ʼʼ

একটু থামল ফারজাদ। দ্বিজা অপলক তাকিয়ে আছে ফারজাদের দিকে। ওই অদ্ভুত ভাবাবেগে পূর্ণ মুখটায় কিছু খোঁজার বা বোঝার চেষ্টা করছে সে। ফারজাদ বলল,

“ফুপু, একটা আবদার রাখবে আমার? আবদারটাও করছি আমার স্বার্থের খাতিরেই। নয়ত তুমি জানো ফারজাদ আবদার করে না কখনও কারও কাছে। তার নিজের কাছেও কোনো আবদার নেই। কারণ, সে নিজের আবদার পূরণ করতে ব্যর্থ, অসফল, ধ্বংসপ্রাপ্ত ক্ষয়ে যাওয়া এক সত্তা।ʼʼ

থামল একটু, দুটো দম নিয়ে হুট করে বলল, “দ্বিজাকে দেবে ফুপু? ওকে আমি রেখে দেব আমার কাছে। খুব অভিযোগ জমেছে তোমার মেয়ের আমার প্রতি, সে তো সকলেরই আছে। তবে ওরটা আমায় খুব ডিস্ট্রাব করছে আজ ক’দিন। নিজের থেকে নিজে খুব ডিস্ট্র্যাক্ট হয়ে যাচ্ছি। ইটস রিয়েলি সো ইরিট্যাটিং। খুব জ্বালাচ্ছে আমায়। শান্তি দরকার একটু, জাস্ট আই নিড ব্যাডলি কাম-ডাউন! আমি জীবনে এরকমভাবে কখনও অস্থির হইনি। অথচ সব শান্তভাব কেটে গিয়ে কেমন একটা ছটফটে ভাব বিরাজ করছে আমার ভেতরে। পরে আবিষ্কার করলাম–তোমার মেয়ের নজর লেগেছে আমার ওপর। জিজ্ঞেস করো–পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে কতগুলো করে অভিশাপ দম করে আমার ওপর? ওর এসব জ্বালায় প্রতি মুহুর্তে খুব ডিসটার্বড আমি। এই জ্বালা থামাতে তোমার মেয়েকে লাগবে আমার.. আমি….ʼʼ

দরজায় ধাক্কা পড়ল। দিলরুবা বেগম ফ্যাকাশে মুখে দরজার দিকে ফিরে তাকালেন। তার চেহারায় আতঙ্ক, অজানা আশঙ্কাজনক ভীতি! ক্রমেই ধাক্কা কঠিন হয়ে উঠছে দরজার ওপারে। ফারজাদ কিছু একটা আন্দাজ করল। হয়ত ধাক্কা দেওয়া মানুষটিকে এবং এমন ক্ষ্যাপা ধাক্কার কারণকে! ফুপুকে চোখে আশ্বাস দিয়ে ইশারা করল দরজা খুলে দিতে। দিলরুবা বেগমের পায়ে আড়ষ্টতা। ফারজাদ হতাশ শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। ফুপুর পেছন পেছন এগিয়ে এলো। দরজা খুলতেই ক্রোধে পাগলপারা হয়ে ভেতরে এলেন হাবিব সাহেব। পাগলের মতো ক্ষ্যাপা স্বরে চিৎকার করে উঠলেন, “তোর ভাইয়ের ছেলে, ওই হারামজাদা বিয়ে ভাঙছে…ʼʼ

নজরে এলো ফারজাদ। হুট করে থেমে গেলেন তিনি। কিংকর্তব্যবিমূঢ় চোখে তাকিয়ে রইলেন ক্ষণকাল। যেন নিজের প্রতিক্রিয়া ভুলে গেছেন তিনি। কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম চোখজোড়া, থমকানো দৃষ্টি, হতবুদ্ধি চেহারায় কয়েক মুহুর্ত চেয়ে থেকে হঠাৎ-ই যেন হশে এলেন তিনি। পাগলা জন্তুর মতো তেড়ে এলেন ফারজাদের দিকে। থাবা দিয়ে চেপে ধরলেন ফারজাদের কলারটা। অশ্রাব্য ভাষায় বকে উঠলেন ফারজাদকে, “শেষপর্যন্ত বিয়ে ভাঙছিস? আমার মান-ইজ্জত মাঠে মাঠে করে ছাড়ছিস হারাম**। বাজারে গেছি গায়ে হলুদের কেনাকাটায়, তখন কল আসছে–ওরা মেয়ে নিবে না,মেয়ের অন্যখানে সম্পর্ক। সম্পর্কে গোষ্ঠির**.. আমার মুখ কোথায়?ʼʼ

সশব্দে একটা থাপ্পড় পড়ল ফারজাদের গালে। ফারজাদ শান্ত ভঙ্গিমায় হাবিব সাহেবের হাতের মুঠো থেকে কলার ছড়ানোর চেষ্টা করল।

-“যা না তা বলে অপমান করার সুযোগ পাইছে লোক আমারে তোর আর ওই…

একথা বলেই তিনি ডাইনিং রুমের দরজার এক কোণে জুবুথুবু হয়ে, বিষণ্ন মুখে দাঁড়িয়ে থাকা দ্বিজার দিকে। ফারজাদ এসে দাঁড়াল সামনে। একটা ধাক্কা দিয়ে পিছিয়ে দিলো হাবিব সাহেবকে একটু। লম্বা ফারজাদের উচ্চতার খানিক নিচে পড়ে আছেন হাবিব সাহেব। প্রসস্থ, কাষ্ঠল বুকটা সামনে মেলে আছে ফারজাদের। হাবিব সাহেব ফুঁসছেন রাগে। ওকে পাশ কাটিয়ে মেয়ে দিকে এগোতে অগ্রসর হলেন তিনি। সামনে বাঁধা হলো ফারজাদ,

-“দুঃসাহস দেখাবেন না ফুপা। দ্বিজা মেয়ে আপনার। জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া, বা তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জীবনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করাকে যদি পিতৃত্ব মনে করেন, তাহলে আপনার মতো মূর্খ বাপকে আমি বলছি, মেয়ের বাপ হওয়ার যোগ্যতা আপনার নেই। মনে রাখা উচিত আপনার–সমাজের সম্মান জন্ম দেন নি আপনি, দিয়েছিলেন একটা মেয়ের জন্ম। যার ভরণ-পোষন, ভালো- মন্দ, তাকে খুশি রাখার দায়িত্ব, তার ইচ্ছের দাম, পিতৃ স্নেহের জেরে সবকিছুকে দূরে ঠেলে তার ভালো লাগার মূল্য সর্বোচ্চ দেওয়া। বাপের কাছে কীভাবে মেয়ের খুশির চেয়ে সমাজের সম্মান, মানুষের কথা আর নিজের ক্ষোভ আগে আসতে পারে–আমার মাথায় ঢোকে না।নিজেকে হুদাই সম্মানী ব্যাক্তি দাবী করবেন না। আপনি শুধুই একটা স্বার্থপর আর দাম্ভিক মূর্খ লোক, যার নিজের মেয়ের বিবর্ণ মুখের দিকে তাকালে সেই কান্নাভেজা মুখে মায়া না লেগে বরং সম্মান, মানুষের কথা আর পুরোনো আক্রোশ মাথায় আসে। মেয়ে রত্ন, যাকে গলায় মালা হিসেবে ঝুলিয়ে রাখতে হয়। জীবনে না থেকেছেন কাছে, না দিয়েছেন আদর, না কখনও পিতৃসুলভ হাতখানা মাথায় বুলিয়ে বলেছেন–দ্বিজা তুই কী চাস? শুধু বিদেশের মাটিতে পড়ে থেকে মাসে গাদা গাদা টাকা পাঠিয়ে ভরণ-পোষন করলে সন্তান পালন হয়ে যায় না। কামাইও বউ-বাচ্চা লালন করার জন্য করেছেন নাকি সন্দেহ আছে। উপার্জন তো শুধু জিদ বজায় রাখতে, আমার বাপের কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে করেছেন বলেই মনে হয়।আপনি বাপ কম, কসাই বেশি। সেই আপনার মতো কর্তব্যহীন আর কসাই বাপের অনুমতির পরোয়া করলে আজ আমি শালাও আপনার মতোই স্বার্থপর আর ব্যক্তিত্বহীনের পরিচয় দেব।ʼʼ

ফারজাদের গাঢ় ভারী, তেজদীপ্ত দৃঢ় কণ্ঠস্বরে দমে গেলেন যেন হাবিব সাহেব। শুধু শক্ত চোখে তাকিয়ে রইলেন ফারজাদের দিকে। তবে কিছু বললেন না আর। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, চলতে চলতে হঠাৎ-ই ব্রেক কষায় থেমে যেতে থাকা গাড়িটার মতো। যে ধীরে ধীরে থামছে। ফারজাদ দ্বিজার দিকে ফিরল। কাঁদছে মেয়েটা, তাকে কেন্দ্র করে কীসব পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। কেন গেছিল সে ভালোবাসতে।

-“দ্বিজা!ʼʼ–গলাটা অতি রাশভারী ফারজাদের।

দ্বিজা অস্তমিত চোখে তাকাল ফারজাদের দিকে। ফারজাদ একই স্বরে বলল, “তোর বার্থ সির্টিফিকেটটা বের করে আন।ʼʼ

দ্বিজা কৌতূহল ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, পরিস্থিতি বুঝে আসছে না তার। ফারজাদ নাক শিউরে রাগান্বিত স্বরে ধমকে উঠল,

-“শুনতে পাস নি কথা? যা, নিয়ে আয়।ʼʼ

শেষ বাক্যটুকুতে হুংকার দিয়ে উঠল ফারজাদ। তার শরীর মৃদু কাঁপছে। নাকের পাটা ফুলছে, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হয়ে পড়ছে। শক্ত সিনাটা ফুলে উঠছে, আবার নামছে। ঘরটা পুরো নিস্তব্ধ। সেখানে শুধু ফারজাদের ভারী শ্বাসের উঠা-নামার শব্দটাই প্রকট হয়ে কানে লাগছে।

চলবে..

#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মর্তুজা

২২.

রাত সাড়ে আটটা। রাস্তার ধারে ল্যাম্পপোস্ট থেকে অল্প দূরে দাঁড়িয়ে আছে ফারজাদ দ্বিজার ডান হাতটা চেপে ধরে। হাতটা ধরেছিল সে বাড়ি থেকে দ্বিজাকে নিয়ে বেড়িয়ে আসার সময়। এখন অবধি ছাড়ে নি। দ্বিজার খুব অস্বস্তি হচ্ছে আবার অদ্ভুত অনূভূতিও হচ্ছে। এই যে লোকটা হাতটা এমন করে ধরে দাঁড়িয়ে ফোন কানে ধরে আছে। দেখে মনে হচ্ছে–কোনো বাচ্চা মেয়ের দায়িত্বে আছে সে। হাতটা ছাড়লেই দুর্ঘটনা ঘটবে খুব বড়। ছাড়া যাবে না।

-“ইরফান ভাই!ʼʼ

-“কী ব্যাপার!ʼʼ

-“দ্বিজাকে বের করে এনেছি বাড়ি থেকে। এখন বলুন কী করব?ʼʼ–খুব উত্তেজিত লাগল ফারজাদের কণ্ঠস্বর।

-“বের করে এনেছেন? এখন কোথায় আছেন আপনারা?ʼʼ

-“মোড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছি।ʼʼ

ইরফান হাসল, “তাহলে শেষমেষ রিস্ক নিয়েই নিলেন?ʼʼ

ফারজাদ জবাব দিলো না। ইরফান বলল, “আমাদের এখানে চলে আসুন। এরপর দেখছি কী করা যায়।ʼʼ

-“না। কোথাও আসাআসি করতে চাইছি না। বিয়ের সাক্ষী লাগবে, আপনি আর লাবন্য আসুন। আমি আর্জেন্ট ঢাকা ফিরব।ʼʼ

-“বিয়ে?ʼʼ

ইরফান প্রশ্ন করল যেন একটু অবাক হয়েই। একে তো বলছে বের করে এনেছে, আবার ইমিডিয়েট বিয়ের কথা বলছে? একটু অপ্রত্যাশিত ছিল ফারজাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা। কণ্ঠ শুনে টের পাওয়া যাচ্ছে সে খুব উত্তেজিত মেজাজে আছে। ইরফান বলল, “এখনই?ʼʼ

-“তো কখন? আগে কয়দিন লিভ-ইন টুগেদার কোরে তারপর নাকি? কুমিল্লা থেকে বিয়ে করে এরপর ঢাকার বাসে উঠব।ʼʼ

-“আহ রে! আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন? আচ্ছা, আমরা আসছি। ওখানেই থাকুন আপনারা।ʼʼ

-“কাজী অফিসে চলে যাচ্ছি, সেখানে আসুন।ʼʼ

কল কাটল ফারজাদ। দ্বিজা কেমন করে যেন চেয়ে আছে ফারজাদের দিকে। সে আশ্চর্যজনক ভাবে লক্ষ করল, সে ফারজাদের চেয়ে উচ্চতায় বেশ ভালোই ছোটো। এভাবে তো কখনও খেয়াল করা হয়নি, আসলে কাধে কাধ মিলিয়ে দাড়ানোই বা হয়েছিল কবে? দ্বিজার বিশ্বাস হতে চায় না মুহুর্তটা। সে বারবার জাগতে চাইছে স্বপ্ন ছেড়ে। এই স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুম ভাঙলে যে তীব্র হাহাকারটা ঘিরে ধরবে সেই কষ্টটা সে পেতে চায়না। তাকে নাকি ফারজাদ এনেছে বিয়ে করার জন্য! ফারজাদ ওকে ধরে নিয়ে হেঁটে রাস্তাটা পার হলো। দ্বিজা উপলব্ধি করল–এখনও ঘুম ভাঙল না। তাহলে কি সে জাগ্রতই! আশ্চর্য! এই লোক হাত ছাড়ছে না কেন? এসব সহ্য হচ্ছে না দ্বিজার হুট করেই। এতদিন এত এত দূরত্ব, অবহেলার পর সল্প সময়ের ব্যবধানে এমন পাল্টে খাওয়া আচরণ মানতে পারছে না সে।

ঘন্টাখানেকের মধ্যে সব ঠিকঠাক করে প্রস্তুত করা হলো। লাবন্য তাকিয়ে দেখছে ফারজাদ-দ্বিজাকে। অবাক করা বিষয় হলো–তার খারাপ লাগছে না। তার কষ্ট হচ্ছে না একটুও। বরং ইরফানের পাশে দাঁড়িয়ে ওদের বিয়ে দেখার ব্যাপারটা ভেতর ভেতর ওকে খুব পুলকিত করছে। কাজী সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “পালিয়ে বিয়ে?ʼʼ

ফারজাদ বলল, “পালিয়ে বলতে লুকিয়ে? উহু, সকলকে জানিয়ে, তবে সম্মতির বিরুদ্ধে। তাই আর কাজীকে বাড়িতে ডাকা হয়নি, আমরাই চলে এসেছি কাজী অফিসে। নিন, নিজের কার্যক্রম শুরু করুন।ʼʼ

এরকম কাটকাট শক্ত জবাব শুনে কাজী সাহেব একটু কেমন করে যেন তাকালেন ফারজাদের দিকে। দ্বিজা বসে আছে একটা চেয়ারে। কপাল অবধি ওড়না টানা। মাথাটা নুইয়ে বসে আছে। লাবন্য গিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে মাথায় স্নেহের হাত বুলালো। দ্বিজা তাকাল না চোখ তুলে। তার কেন জানি ছুটে পালাতে ইচ্ছে করছে। তবে সে পালাচ্ছে না। কীসের এক অদম্য সূতোর টানে সে উঠে পালাতে পারছে না। তবে তার খুশি কেন লাগছে না? সে তো চেয়েছিল এমনই কিছু! তাহলে আজ তার খুশিতে কান্না কেন আসছে না, বরং বরফের মতো জমে গেছে অনুভূতিগুলো। নড়ছে না, চড়ছে না, শীতল, গম্ভীর হয়ে গেছে।

ফারজাদ ফোন কানে নিয়ে কাউকে কল করছে। কয়েক মুহুর্ত পর বলে উঠল, “আপনার মেয়েকে বিয়ে করছি। সম্মতি না দিলেন, দোয়া করবেন। আর সাক্ষীও থেকে যান। জরুরী নয় সব বিয়েই বাপ-মা সাথে থেকে দেবে। ফুপুকে জানিয়ে দেবেন।ʼʼ

উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এরকম ঘটনা হয়ত প্রথমবার দেখছে তারা। একে একে ফারজাদ আব্বু, আম্মাকে কল করে দোয়া চাইল। চাইল না সম্মতি। বিয়েটা যেন তার কাছে জিদ হয়ে উঠেছে। যেন লোকে যত অসম্মতি জানাবে, তত আগ্রহের সাথে সে দ্বিজাকে নিজের করে ছাড়বে। যেমন এই কথা মাথায় রেখেই আজ হাবিব সাহেবের সামনে থেকে দ্বিজাকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে।

দ্বিজা কবুল বলতে দেরী করল। বেশ অনেকক্ষণই দেরী করল। তবে কাঁদল না মেয়েটা। পাথরের মতো শক্ত লাগছে মুখের ভঙ্গি। ওদের বিদায় দেবার সময় লাবন্য দ্বিজাকে জড়িয়ে ধরে নতুন জীবনে চলাচলের জন্য শুভেচ্ছা জানাল। দোয়া দিলো ছোটো বোনটাকে। বোনটা আজ নতুন জীবনে পা রাখল সব নিয়ম ভেঙে। জানা নেই–আগামী জীবন কেমন হবে! ইরফানের থেকে ফারজাদ কিছু টাকা চেয়ে নিলো। ইরফান আর লাবন্য দাঁড়িয়ে রইল দুজন।

কাজী অফিস থেকে বেরিয়ে ফারজাদ দ্বিজাকে নিয়ে বাস্ট্যান্ডে এসে পৌঁছাল। আগামীকালের দুটো টিকেট কেটে রেখেছে সে। সেগুলো আসলেই গচ্চা গেল। তবে সে ঠিকই কাউকে নিয়েই ঢাকা ফিরছে! দুটো টিকেট কেটে নিয়ে কাউন্টারের ভেতরে চেয়ারে গিয়ে বসল দ্বিজাকে নিয়ে। হাত শুন্য দুজনের। শুধু শরীরটাকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে দুজন। ফারজাদের কাছে সামান্য টাকা আর মোবাইল ছাড়া তেমন কিছু নেই। দ্বিজার শরীরে পরিহিত পোশাকটা ছাড়া আর কিছু নেই। এভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার ছিল তার? তাও ফারজাদের সাথে? দ্বিজা শিউরে উঠল একটু। অদ্ভুত এক শিহরণে ছেয়ে গেল ভেতরটায় তার। মাথার দু-পাশ চেপে ধরে ঝুঁকে বসে আছে ফারজাদ। দ্বিজা কিছু বলতে চেয়েও পারল না। কেমন আটকে আসছে ভেতরে। এই লোকটা তার স্বামী! চমকে উঠল সে। দ্রুত নজর ফিরিয়ে জোরে শ্বাস ফেলল। সে নিজেও অস্থির, তবে নিজেরটা ছাপিয়ে বুঝতে পারছে পাশে বসে থাকা মানুষটা তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি অস্থির। তাহলে কি ফারজাদ খুশি না বিয়েতে? না হওয়ারই কথা। তাহলে হুট করে এমন একটা কাজ কিছু সময়ের মধ্যে কেন করে ফেলল? এটাও কি কর্তব্য নাকি জিদ!

হাসতে মন চাইল দ্বিজার নিজের ওপর। সে যার কাছেই থাকে, বোঝা হয়েই। আজ বাপের ঘাঁড় থেকে নেমে ফারজাদের ঘাঁড়ে চাপল। ফারজাদ উঠে গেল। কিছুক্ষণ পর পানির বোতল কিনে নিয়ে এসে বসে ঢকঢক করে প্রায় সবটুকু পানিই খেয়ে ফেলল। বাকি অল্প একটু দ্বিজার দিকে এগিয়ে দিয়ে নিতে ইশারা করল। চোখাচোখি হলো দুজনের। ফারজাদের চোখে চাপা উদ্বেগ, ক্লান্তি! তা দেখে ভালো লাগল না দ্বিজার। কী দরকার ছিল এসবের? দ্বিজা মানিয়ে নিতো ঠিক। নিজেকে অপরাধী মনে হলো খুব। তার জন্য সকলের শান্তি নষ্ট। সে আসলেই অপদার্থ! নিজেকে কষে একটা ধমক দিলো, এত ভাবছে কেন সে? অতিরিক্তই ভাবছে আজ। আগে তো কখনও একরম আকাশ-কুসুম চিন্তায় পড়েনি সে! একটু সময় নিয়ে ফারজাদকে জিজ্ঞেস করল,

-“কোথায় যাচ্ছি আমরা?ʼʼ

-“ঢাকা।ʼʼ

বলে একটু থেমে আবার বলল ফারজাদ, “চিন্তা করিস না। অন্তত এটুকু সামর্থ্য আছে আমার– তোকে তিনবেলা খাবার, থাকার একটা ঘর আর পরার কাপড় দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারব। যাই হোক, তবে তুই কোনো বেকারের সাথে যাচ্ছিস না। আমি ভালো না, এর কোনো সমাধান আপাতত নেই আমার কাছে। তবে আর বাকি দিকে কষ্ট না দেবার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে আমার।ʼʼ

দ্বিজার চোখ ভরে উঠল। সে দৃষ্টি নত করে নিলো। লোকটা সত্যিই খুব স্বার্থপর। সে কোনোদিন বুঝবে না দ্বিজাকে। খুব দায়িত্বজ্ঞানবান মনে করে নিজেকে? কচুর দায়িত্বজ্ঞান আছে। সে কি শুধু খাওয়া, থাকা আর কাপড়ের কাঙাল? আব্বু কি সেসব দিচ্ছিল না? তাহলে তার সাথে কেন চলে এলো সে এত কিছুর পরেও? কোনোদিনই বুঝবে না এই লোকটা তাকে। খুব ভুল হয়েছে তার, খুব। তার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। সে যাবে না ঢাকা এই লোকের সাথে। যে মন বোঝে না, কিছুই বোঝে না। তার সাথে কেন যাবে ও? আর তাকাল না ফারজাদের দিকে। মাথা নুইয়ে নখ খুঁটতে লাগল। রাত দশটার গাড়ি ওদের। সাড়ে নয়টা বাজে। ফারজাদ উঠে গেল। দ্বিজা হুড়মুড়িয়ে তাকাল সেদিকে। কোথায় যাচ্ছে লোকটা? সে এক মুহুর্তের জন্য নিজেকে অসহায়, চারদিকে অন্ধকার দেখেছে। এই তীব্র অভিমানের মাঝেও যেন সবটুকু ভরসা ওই গোমরামুখো লোকটার সঙ্গ। এত রাতে সে কখনও এরকম লোকালয়ে বসে থাকে নি একা। এভাবে ওকে বসিয়ে রেখে গেল কোথায় ফারজাদ? এই তার দায়িত্বজ্ঞান? হুহ! আল্লাহ পাক জানে এই মানুষের সাথে আগামী জীবনযাপন কেমন হতে চলেছে!

ফরজাদ এসে বসল। হাতে সিগারেট আর দিয়াশলাই। দ্বিজা আড়চোখে দেখল, সরাসরি তাকাল না। তার মাথা থেকে পড়ে যাওয়া ওড়নাটা আলগোছে তুলে ফারজাদ কপাল অবধি টেনে দেয়। চমকে উঠল দ্বিজা। সিগারেট জ্বালিয়ে টানতে লাগল ফারজাদ।

দ্বিজার রাগ হলো খুব। ইচ্ছে করল, চিৎকার করে বলতে,

‘আমি যাব না আপনার সাথে। আপনার মতো ইতর লোকের সাথে আমার জীবন কেমন কাটবে এই কিছুক্ষণে বেশ ধারণা হয়েছে। যাব না আমি ঢাকা। সিগারেট ফেলুন নয়ত, সিগারেটের আগুন দিয়েই পুড়িয়ে দেব আপনাকে। কত পড়িয়েছেন আপনি আমায়। হিসেব নেই তার, সেই আপনি যদি এমন আজ স্বামী হিসেবে পাশেই বসে থাকবেন। বাড়ি থেকে ধরে এনে বিয়েই করবেন, তাহলে আমার চোখে পানি ফিরিয়ে দিন, মূল্য চুকতা করুন সেই সব ছটফট করা রাতের। পারবেন? উহু, না। ঘেন্না করি আপনাকে, আপনার স্বভাব, চলাফেরা, পুরো আপনিটাকেই খুব অপছন্দের লাগছে আমার। সহ্য হচ্ছে না আপনাকে। খুব প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে হচ্ছে সেসব দিনের। যেসব দিন ধিকধিক কোরে জ্বলেছি আমি। আজ স্বামী হয়েছেন, সঙ্গে নিয়ে ঢাকা যাচ্ছেন? এর বিনিময় কত নিষ্ঠুরভাবে শোধ করেছি, তা অজানা আপনার। আপনি তো আমার হন নি, আমি কিনে নিয়েছি আমার অজস্র ফোঁটা বুক চিড়ে বেরোনো নোনাজলের বিনিময়ে। আজ আর ভালোবাসা জাগছে না আপনার ওপর, আজ আর কষ্ট হচ্ছে না আপনার জন্য। খুব ক্ষোভ উঠছে ভেতরে, ক্ষোভের তুফান বয়ে যাচ্ছে।ʼ

দশটা বেজে কয়েক মিনিট পর বাস ছাড়ল। রাস্তায় জ্যাম না থাকলে সাড়ে বারোটার মধ্যেই পৌঁছে যাবার সম্ভাবনা আছে শান্তিনগর। জ্যামে পড়লে রাত হবে একটু। দ্বিজা জানালার পাশে বসেছে। জানালা আটকানো, তার খুব হাঁসফাঁস লাগল। কয়েকবার চেষ্টা করে জানালা টেনেও খুলতে পারল না। চট করে ফারজাদ ওকে পেরিয়ে একটানে জানালাটা কিছুটা খুলে দিলো। যখন জানালা খুলতে এগিয়ে গেল ফারজাদ, দ্বিজার ছোট্ট শরীরটা একদম মুরগীর বাচ্চার মতোন ফারজাদের বুকের আড়ালে লেপ্টে ছিল। ফারজাদ সোজা হয়ে বসল। অথচ বুকের ধুকপুকানি কমল না দ্বিজার। নাহ! বারবার এভাবে চলতে থাকলে খুব শীঘ্রই হার্টফৈইলিওর ঘটে যাবে দ্বিজার। লোকটার কী বাজে আক্কেল! বিনা নোটিশে এত কাছে আসাটা কখনোই কোনো ভদ্রলোকের কর্ম হতে পারে না।

শন শন করে বাতাস ঢুকছে বাসের জানালা দিয়ে। গরমের মৌসুমেও ঠান্ডা লেগে যাওয়ার জোগাড়। নাকে-মুখে বাতাস ঢুকে যাচ্ছে। দ্বিজা জানালার ওপর কনুই রেখে তাতে থুতনি ঠেকিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে বাইরের অন্ধকারে ঢাকা প্রকৃতির দিকে। জীবনটা কেমন আসলে? স্রোত আর জীবনের মাঝে বিশেষ পার্থক্য নেই বোধহয়। এদের প্রবাহধারা অপরিকল্পিত। কখন কোন ঘটনা স্রোতের ন্যায় কোথায় গিয়ে মিলিয়ে যাবে, কোথায় বাঁক নেবে তা স্রোতেরও অজানা।

“জানালাটা চাপিয়ে দে আরও কিছুটা। বেশি বাতাস আসছে, ঠাণ্ডা লেগে যাবে। মুখ আর হাত ভেতরে আন।ʼʼ

দ্বিজার একটুও ইচ্ছে করল না ফারজাদের কথা শুনতে। সে বরং জিদ করে অবাধ্যের মতো ওভাবেই রইল। যেন শুনতেই পায়নি ফারজাদের কথা। হুট করে ফারজাদ একটানে দ্বিজার হাতটা ধরে ভেতরে টেনে এনে জানালাটা টেনে দিলো, সামান্য একটু খোলা রাখল। দ্বিজার কাধে নিজের মাথাটা রেখে অদ্ভুত গলায় বলল, “কপালটা টিপে দে। খুব টান ধরেছে মাথায়। আমি একটু ঘুমাব।ʼʼ

দ্বিজা আকস্মিক ঘটনায় হতবুদ্ধি হয়ে যায়। তার ধারণাও ছিল না, এরকম কিছু ঘটার আছে। তবে কেন জানি ফারজাদের কথাটা এড়িয়ে যাওয়ার সাহস হলো না। দ্বিধাগ্রস্থ হাতটা একসময় এনে রাখল সে ফারজাদের কপালে। কপালটা হালকা গরম। মৃদু হাতে কপাল চাপতে চাপতে অস্পষ্ট ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “জ্বর জ্বর লাগছে আপনার?ʼʼ

-“উহু!ʼʼ

কিছুক্ষণ পর ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল, “তোর চুলগুলো খুব জালাচ্ছে আমায়। চুল সামলে রাখ।ʼʼ

দ্বিজা ডানহাত দিয়ে অল্প খোলা জানালাটাও বন্ধ করে দিলো। জনলার ফাঁক দিয়ে আসা বাতাসে চুলগুলো খুব বেপরোয়াভাবে উড়ছিল।

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন]

#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মর্তুজা

২৩.

বাসের মধ্যে অন্ধকার। দ্বিজার কাধে ফারজাদের মাথা। ওরা এখন কোথায় আছে জানা নেই। কতক্ষণের মাঝে ঢাকা পৌঁছাবে তা-ও জানে না দ্বিজা। ফারজাদের শরীর থেকে একটা মিশ্র ম্যান পারফিউমের গন্ধ এসে নাকে লাগছে। সিটে বসে থেকে দ্বিজার দেহটা যেন মিলিয়ে যেতে চাইছে সিটের সঙ্গে। অবচেতন মস্তিষ্কে বিভিন্ন ভাবনারা উঁকিঝুঁকি মারছে। ফারজাদ নিশ্চুপ, অথচ দ্বিজার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ফারজাদ উঠে পরে পড়ল হঠাৎ-ই কাধ ছেড়ে। সজাগ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

-“কাদছিস কেন? কী হয়েছে?ʼʼ

দ্বিজা চমকে উঠল, “কাঁদছি? কই নাহ! কাঁদছি না।ʼʼ

-“বুক কাপছিল তোর। ফুপাচ্ছিস এখনও।ʼʼ

দ্বিজা আর উত্তর দিতে পারল না। এতক্ষণ বাস থেমে ছিল কোথাও। এবার চলতে শুরু করল। ফারজাদ আস্তে করে শরীরটা মেলে দিলো সিটে। ক্ষীণ স্বরে বলল,

-“চোখ মুছে ফেল। তুই এক জনমের দায়িত্ব আমার। তোকে কাঁদতে দেখলে নিজেকে বড়ো অপরাধী মনে হবে। জীবনে অপরাধবোধের বোঝটা এমনিতেই খুব বেশি ভারী আমার, সেখানে তোর চোখের পানির ভার যোগ করে আমার বয়ে নিয়ে বেড়ানোর ক্ষমতা কেড়ে নিস না।ʼʼ

একটু থামল ফারজাদ। আবার বলল, “কেন কাদছিস? ভয় লাগছে?ʼʼ

দ্বিজা একটু সময় নিলো উত্তর দিতে, “কীসের ভয়?ʼʼ

-“সেটা অনিশ্চিত। তবে আমার লাগছে ভয়।ʼʼ

কথাটা দ্বিজাকে শঙ্কিত করে তুলল তাৎক্ষণিক। কথাটা শুনতে একটুও স্বাভাবিক আর ভালো শোনায় নি।

রাত একটা বেজে কয়েক মিনিটে পৌঁছাল তারা গন্তব্যে। ফারজাদের ফ্লাটটা চার তলা একটা ভবনে। সে থাকে উপরের তলার একটা ফ্লাটে। তার ফ্লাটে তিনটা বেডরুম দুটো বাথরুম, একটা কিচেন আর সেসবের মাঝখানে ছোট্ট একটা ডাইনিং রুম আর ড্রয়িং রুমের জায়গা একত্রে রয়েছে। তবে আসবাব পত্র তেমন কিছুই নেই। ব্যাচেলরদের আবাস যেমন হয় আর কী! দ্বিজা চোখ ঘুরিয়ে দেখল চারদিকে। দুটো রুম পাশাপাশি। আর একটা কিচেন পার করে যেতে হয়। কিন্তু সেখানে বাইরে থেকে তালা দেয়া।

সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রুমে ঢুকল সে। রুমের হাল বেহাল হয়ে আছে। পেছনে ফারজাদ ঢুকল। গায়ের শার্ট খুলতে খুলতে বারান্দার দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে দিয়ে পেছন ফিরতেই দ্বিজার মুখোমুখি হলো সে। তখন তার শার্টের সবগুলো বোতাম খোলা শেষ। শার্টটা একটানে খুলে রাখল বিছানার ওপর। পেটানো শরীর! দ্বিজা মুখ লুকানোর জায়গা পায় না। দ্রুত কপালের চুল কানে গুজে অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়াল। ফারজাদের শরীরের এমনভাবে সজ্জিত পেশিগুলো দিয়ে, দ্বিজার চোখ পড়তেই নিদারুন অস্বস্তিতে দম গুলো আটকে এসে আবার দীর্ঘ হয়ে পড়ছে। হুট করে মাথায় এলো তার পরিচয় বদলেছে, সে এখন এই মুহুর্তে একজন এসবি অফিসারের বউ হিসেবে সেই অফিসারের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। পা-দুটো ভঙ্গুর হয়ে এলো। ফারজাদ বলল,

“ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? আমি তো আর মেয়ে মানুষ নই যে কাপড় বদলাতে অন্য রুমে যাব বা দরজা আটকাব। এখন এভাবে প্রায় প্রতিদিনই দেখতে হবে। ঘরটা গুছিয়ে নে।ʼʼ

দ্বিজার হুট করে মনে হলো, কী রে! লোকটা তো ব্যাপক লাগামহীন! অস্থিরকে আরও অস্থির করে তোলা কথাবার্তা বলা মানুষগুলো খুব অসহ্যকর হয়। এই যেমন এখন ফারজাদকে লাগছে একটা অসহ্যকর মানুষ। ফারজাদ তোয়ালে কাধে চড়িয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এলো। দ্বিজা বিছানাটা ঝেরে, এলোমেলো হয়ে থাকা কাপড় গুছিয়ে শেষে ঘরটা ঝাড়ু দিলো। এভাবে সে বহুদিন ফারজাদের ঘর গুছিয়েছ। সেসসব দিনের সেই সকল কাজ আর আজকের মধ্যে বিস্তর ফারাক। চুলগুলো হাত দিয়ে খোঁপা করে নিলো। জানালাগুলো খুলে দিলো। বিল্ডিংয়ে গরমকালে রাতের বেলা দম আটকে আসা পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এখন ঘরটা দেখতে একটু মানুষ বাসের উপযোগী লাগছে। দ্বিজা ভেবে পেল না দেখতে পরিপাটি এই মানুষটা এখানে এমন যাচ্ছে-তাই হয়ে বসবাস করে!

ফারজাদ ফ্রিজ খুলে দেখল–সপ্তাহখানেক আগের দুটো আপেল ছাড়া বিশেষ কিছু নেই সেখানে। এবার হুট করে ফারজাদের মনে হলো–এটাই বুঝি সংসার জীবনে পুরুষের দায়িত্বের গণ্ডা! সে একা হলে খেত না এখন, বারান্দায় দাড়িয়ে কয়েকটা সিগারেট টেনে এসে ধপ করে বিছানায় পড়ে টানটান হয়ে শুয়ে থাকত। রুমে গিয়ে দ্বিজাকে পেল না। বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। খুব সংকটময় লাগছে সময়টা ফারজাদের কাছে। সবকিছুর সহজ সমাধানদাতা দায়সারা ফারজাদ একটা শুকনো ঢোক গিলল। সে হাত ধরে সঙ্গে করে বের করে এনেছে মেয়েটাকে। পাশে গিয়ে দাঁড়াল দ্বিজার। খুব হাঁসফাঁস লাগছে, এ কী মুশকিল! ফারজাদ কথা বলতে পারছে না কেন? এরকম অসহায় লাগে নি তার জীবনে।

-“রান্না করতে পারিস তুই?ʼʼ

-“ঘরে কিছু নেই তেমন।ʼʼ

কথাটা ধাক্কা দিলো ফারজাদকে। শুনতে ঠিক এমন লাগল–যেন বহু বছরের অভিজ্ঞ এক গৃহিনী অভিযোগ করছে ঘরে রান্নার সরঞ্জাম নেই। কিন্তু দ্বিজা কী করে জানল? মেয়েরা বোধহয় জন্মগতই এক নিবিড় সুপ্ত ক্ষমতার অধিকারী হয় ঘর-সংসার সামলানোর। এই যে কিছুক্ষণ আগে এসেছে এই মেয়ে। ফ্লাটের রঙ বদলেছে, তার কথার ধরণ হুট করে বদলে বেশ কর্তব্যরত গৃহিনীর মতো শোনাচ্ছে। ফারজাদ বলল,

-“তুই থাক,আমি আসছি একটু। দরজা লাগিয়ে দিয়ে যা।ʼʼ

-“শুনুন!ʼʼ

ফারজাদ পেছন ফিরে তাকাল। দ্বিজা কণ্ঠস্বর গম্ভীর লাগল শুনতে, “এখন অনেক রাত হয়েছে। কোথায় কী আনতে যাবেন? লাগবে না কিছু। আমার ক্ষুধা লাগে নি। আপনি..ʼʼ

“চল আমার সঙ্গে। দেখি কিছু পাওয়া যায় কিনা!ʼʼ

-“রাত দুটোর বেশি বাজে। এই সময় কোথায়, কী পাওয়া যাবে?ʼʼ

-“এটা ঢাকার শহর।ʼʼ

-“হবে ঢাকার শহর। তবে রাতের প্রভাব থেকে মুক্ত নয় এই শহর।ʼʼ

ফারজাদ তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ দ্বিজার গুমোট মুখটার দিকে। তার মেজাজ বিগড়াচ্ছে। এমনিতেই ব্যাপারটা এত অস্বস্তিকর। তার ওপর এই মেয়ে এত ম্যাচিউরিটি দেখাবে কেন? কথাবার্তা শুনতে কেমন অদ্ভুত ভারী লাগছে। অথচ বেশি দিন হয়নি, কথা গুলিয়ে ফেলত মেয়েটা।

তাদের একসূত্রে বন্দি হয়ে যাওয়া প্রথম রাতটা কাটল অভুক্ত। মেয়েটার মুখে কোনো অভিযোগ নেই, তবে লেপ্টে আছে নীরবতা। পরনে সেই বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়কার সালোয়ার-কামিজটা। ফারজাদ বেশির ভাগ সময় বাইরে খেয়েছে। ফ্লাটের রান্নাঘরটা একদম অপ্রয়োজনীয় পড়ে থেকেছে। অথচ আজ মনে হলো ওই ঘরটাই সবচেয়ে হারাভরা রাখার ছিল তার। তার আত্মমর্যাদাবোধ নিষ্পেষিত হয়ে যাচ্ছে আজকের পরিস্থিতির বদৌলতে। নিজের মাথার চুলগুলো টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। এত বেপরোয়া, দায়সারা ফারজাদ আজ একটা মেয়ে ধৈর্য্যের কাছে নিজেকে কর্তব্যপরায়নহীন হিসেবে কী করে মেনে নেবে? এই মেয়েটা প্রথম থেকে তাকে জ্বালাচ্ছে। বারবার ভুল প্রমাণিত করে আসছে। নিজের কোনো ভাবনা এবং সূত্র দিয়েই মেলানো যায় না দ্বিজার হিসেব। সর্বক্ষেত্রে ফারজাদকে ওভার-টেক করে নিজেকে প্রমাণ করে চলেছে মেয়েটা! ফারজাদ প্যাকেটের শেষ সিগারেটটা ধরাল।

ত্রস্ত পায়ে একবার রুমে এলো। দ্বিজা চুপচাপ বসে আছে বিছানায় হাঁটু মুড়ে। বারান্দায় চলে এলো। আসলে সে কী চাইছে তা নিজের কাছেই স্পষ্টতর হচ্ছে না। নিজের প্রতি কি সে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে! আধপোড়া সিগারেটটা ক্ষিপ্ত হাতে ছুঁড়ে ফেলল কোথাও। রুমে এলো। বসল বিছানায়। দ্বিজা ওভাবেই বসে আছে। হাঁটু মুড়ে মুখটা হাঁটুতে রেখে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে পা দুটো, দৃষ্টি দেয়ালে।

“ঘুমাবি না?ʼʼ

মুখ তুলে চাইল দ্বিজা, “আপনি ঘুমাবেন না?ʼʼ

“আমার জন্য বসে আছিস?ʼʼ

দ্বিজা তাকাল ফারজাদের দিকে, দুপাশে মৃদু ঘাঁড় নাড়ল।

“তাহলে বসে আছিস কেন?ʼʼ

একটা অপরিকল্পিত অভাবনীয় কাজ করে বসল দ্বিজা। হুড়মুড়িয়ে ফারজাদকে জড়িয়ে ধরল। ফারজাদ একদম প্রস্তুত ছিল না ব্যাপারটার জন্য। সে একটু থমকে গেল, শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারাতে গিয়ে আবার সামলে নিলো নিজেকে। দ্বিজার শরীর কাঁপছে। ফারজাদের গলাটা জড়িয়ে ধরে আছে মেয়েটা। কান্নার তোড় বাড়ছে তার। একসময় কম্পমান, কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলল, “আমার ভালো লাগছে না, ফারজাদ।ʼʼ

কী হলো জানা নেই ফারজাদের। তার বুকটা আচমকা মোচড় মারল। কী যেন হচ্ছে আজ ক’দিন তার সাথে। আজ মনে হলো গাঢ়, ঘনীভূত এক কুণ্ডলি বুকের মাঝটায় ধাক্কাধাক্কি করছে, সজোরে ধাক্কাচ্ছে। ফারজাদকে ভাঙতে চাইছে, গুড়িয়ে ফেলতে চাইছে ফারজাদ নামক জীবন্মৃত প্রায় সত্তাটাকে। দ্বিজার কান্নার তোড়ে তার ছোট্ট দেহটা কেঁপে কেঁপে উঠছে যেমন ফারজাদের বুকে। ফারজাদের বুকটাও কাঁপল। সে জানে না তার কী করা উচিত এখন, কী করতে হবে তাকে। অবচেতনায় অথবা অচেতনায় দ্বিজাকে বুক থেকে তুলে ছোট্ট মুখটা দুহাতের আজলায় নিলো। মেয়েটা তার ঘরে এসে প্রথম রাত পার করছে খালি পেটে। আবার তার বুকে নিজেকে সঁপে কাঁদছে। ফারজাদকে ঋণী করতে চাইছে নাকি এই মেয়ে? এসব ফারজাদের কঠোর দেয়ালখানায় প্রতিনিয়ত আঘাত হানছে, তা বুঝছে না কেন মেয়েটা?

চোখে পানি মুছে দিলো ফারজাদ দ্বিজার। দ্বিজার নাক লাল হয়ে আছে। ঠোঁট দুটো থুতনির সাথে তাল মিলিয়ে কাঁপছে। ফারজাদ পাগলামী করে বসল। দ্বিজার গালে থাকা বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে দ্বিজার ঠোঁট ছুইয়ে হঠাৎ-ই ঠোঁট দিয়ে প্রায় কামড়ে ধরল দ্বিজার ঠোঁট। দ্বিজা মুহুর্তে বহুদিনের অসুস্থ, দুর্বল মানুষটার মতো নেতিয়ে পড়ল। হাত দিয়ে মুঠ করে চেপে ধরল ফারজাদের মাথার পেছনের চুলগুলো। ফারজাদ আজ এক তৃষ্ণার্ত পুরুষ। বহুদিন ভাঁটার আগুনে মাটি পুড়ে ইট হবার সেই ইটে পানি দিলে যেমন ইট শুধু পানি শুষতেই থাকে, ফারজাদকে আজ পোড়া ইটের ন্যায় লাগছে। দ্বিজার কান্নামখা ভাঙা ঠোঁটজোড়া অঝোরে ঝরতে থাকা শীতল জল!

মিনিট কয়েক কেটে যাওয়ার পর চট করে দ্বিজাকে ছেঁড়ে এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে পড়ল ফারজাদ। দ্বিজা এখনও বিস্ময় এবং অপ্রস্তুত ভাব কাটিয়ে উঠতে পারছে না। থেরে বসে রইল সে। ফারজাদ ভারী পা ফেলে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। সেদিকে তাকিয়ে রইল কেবল। ফারজাদকে দেখে মনে হচ্ছে–সে খুব বড়ো ভুল করে ফেলেছে উত্তেজনায়। সে অনুতপ্ত। এড়িয়ে যেতে চাইছে মুহুর্তটা। সে চায়নি এমন কিছু হোক। পাপ করে ফেলছে। অনুশোচনা হচ্ছে খুব!

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে