তপ্ত সরোবরে পর্ব-০৬

0
422

#তপ্ত_সরোবরে
#তেজস্মিতা_মর্তূজা

৬.

দ্বিজা বাথরুমের শাওয়ার অন করে আয়নার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াল। চোখটা লাল হয়ে আছে। হয়ত কান্নাগুলো বাঁধ ভেঙে ছুটে বেরোতে না পেরে চোখের শিরায় র ক্ত হয়ে জমে আছে। বুকের ভেতরে জ্বলছে, থেকে থেকে মুচরে উঠছে বুকটা। কী নিষ্ঠুর অপমান, কী অবমাননায় পূর্ণ দাম দিলো ফারজাদ তার অনুভূতির। এবার হু হু কেঁদে উঠল দ্বিজা। এ কান্না থামবে না আর, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। দ্বিজা নিঃশব্দ চিৎকারে ফেটে পড়ে বন্ধ দরজার ভেতরে। সেই বুক ফাটা আত্মচিৎকার দেখার লোক নেই, থামানোর লোক নেই। কখন থামবে এই আর্তনাদ কে জানে!

ফারজাদ সন্ধ্যার দিকে তৈরী হয়েছে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রায়। ঢাকা থেকে কল এসেছিল, তাকে যেতে হবে। বাড়িসুদ্ধ সকলে প্রতিশ্রুতি নেয়—বিয়ের আগে ফিরে আসবে ফারজাদ বাড়িতে। ফারজাদ বলল, “আসব। আজ দুপুরেই কল এসেছিল ডিআইজি স্যারের। ট্রেনিং শুরু হবে খুব শীঘ্রই। ডেপুটি ইন্সপেক্টর আর্জেন্ট ডেকেছেন।ʼʼ

উঠোনে নামতেই দুর্ঘটনাক্রমে লাবন্য সামনে পড়ে গেল ফারজাদের। দুজনের কেউ-ই কাউকে গ্রাহ্য না করে বরং অপরিচিতর মতো পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আজকের পিকনিকের প্লান ক্যান্সেল হয়েছে। কারণটা দ্বিজা ও লাবন্য। তারা কেউ উপস্থিত না, দুজনেই রুমে আটকে আছে সারাদিন। তার ওপর ফারজাদ চলে যাচ্ছে–বলা তো যায় না, কোথায় কোন কাজে আটকে যাবে, ফিরতে পারবে না হয়ত বিয়েতে।


ঢাকা পৌঁছেই ফারজাদের যাওয়ার কথা ছিল রাজারবাগ। অথচ রাস্তায় জ্যামের কারণে রাত দশটা পেরিয়ে গেছে। শীতের রাত দশটা কম নয়, আর তাছাড়া ইচ্ছে করছে না এখন পুলিশ লাইনে যেতে। শান্তিনগর নিজের ফ্লাটে যায় ফারজাদ। মন-মেজাজ থমকে আছে। ফ্লাটে ঢুকে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। রুমে ফিরে এসে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে আবার বারান্দায় যায়। সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে মনে পড়ল—দিয়াশলাই বা লাইটার কিছুই আনেনি। মেজাজ চড়ল আরও, কিচেনে গিয়ে দিয়াশলাই এনে সিগারেট জ্বালায়। রাতের আকাশে চাঁদ নেই। কুয়াশায় ঢেকে আছে চারদিক। কিছুক্ষণ স্মোকিং করে রুমে চলে এলো। একটু ঘুম দরকার, শরীরের সাথে সাথে মানসিকভাবেও ফিট রাখা জরুরী নিজেকে।

সকালে ডেপুটি ইন্সপেক্টরের সম্মুখে ক্যান্ডিডেট হিসেবে দাঁড়াতে হলে ফিটনেসের বিকল্প নেই। এরকম ভোঁতা মুখ, বসে যাওয়া চোখ আর দুর্বল শরীরে প্রশাসন কর্মকর্তাকে মানায় না। ফারজাদ নিজেকে কড়া ধমক দেয়, আইন বিভাগের কর্মকর্তা হতে হলে নিজের মানসিক সুখ-দুঃখ, খারাপ-ভালো লাগা, কষ্ট-আঘাত—এক কথায় স্নায়ুকোষকে কেটে ফেলে দিতে হয়। ব্যক্তিগত বলতে কিছু রাখতে নেই। মেশিন তারা, কেবলমাত্র দেশের জনগনের নিরাপত্তা নিশ্চিকরণে এক একটা মেশিন হিসেবে ব্যবহৃত সক্রিয় থাকতে হয় দৈনিক চব্বিশঘন্টা।


রাত প্রায় বারোটা বাজছে। সকলে খাওয়া দাওয়া সেরে যে যার রুমে ঘুমোতে চলে গিয়েছে। দ্বিজা বসে আছে লাবন্যর রুমের বারান্দায়। সে আগে আগেই খেয়ে রুমে এসেছে। লাবন্য এসে দ্বিজাকে রুমে দেখতে না পেয়ে নিঃশব্দে বারান্দায় একবার উঁকি দিয়ে দেখল। গায়ে কেবল ওড়না জড়ানো, ঠান্ডা হাওয়ায় গরম কাপড় পরেই গা হিম হয়ে আসছে, অথচ মেয়েটা অনুভুতিহীন বসে আছে ঠান্ডার মধ্যে। লাবন্য রুমে ফিরে প্রথমে সোয়েটার নিলেও পরে সেটা রেখে একটা চাদর নিয়ে গিয়ে আস্তে করে জড়িয়ে দিলো দ্বিজার গায়ে। দ্বিজার মাঝে কোন বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে সজল চোখে চেয়ে আছে কুয়াশায় ঢাকা অন্ধকারের দিকে। লাবন্য বারান্দার গ্রিল ধরে দ্বিজার পাশে দাঁড়ায়। দ্বিজার চোখে বাধভাঙা পানি।

“অপমানে কাঁদছিস নাকি ভালোবাসায়?ʼʼ

লাবন্যর বলা কথাটা অদ্ভুত শোনায়। দ্বিজা চোখটা মুছে নিলো সন্তর্পণে। বলল, “কাঁদছি না।ʼʼ

লাবন্য কিঞ্চিৎ হাসল, “না কাঁদলে ভালো। আচ্ছা, দ্বিজা! তুই কবে পা পিছলেছিস বলতো? আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম, আমি না-হয় বোকা, অধম, পাগল। কিন্তু তুই তো কত চঞ্চল, তোর সঙ্গে কী করে এত বড়ো দুর্ঘটনা ঘটে গেল?ʼʼ

লাবন্যর কণ্ঠস্বর কেমন যেন শোনায়। মেয়েটা নিজেকে লুকানোর অদম্য ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে। বুকে ঝড় উঠেছে, তাণ্ডবপূর্ণ ঝড়, অবহেলায় হীন হয়ে প্রেমিকের দ্বার থেকে ফিরে আসার পর গুমোট কালো মেঘে বুক ছেয়ে আসা ঝড়। অথচ মেয়েটা অনড়, অটল, পর্বতের ন্যায় অবিচল। একেই বোধহয় পরিণত বলে, একেই বোধকরি বলে ম্যাচিউরিটি। দ্বিজা নিজেকে সামলে কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল, “কী বলতে চেয়েছিলি তুই?ʼʼ

লাবন্য তৎক্ষণাৎ জবাব দিলো না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে, আস্তে করে বলল, “ইরফান কল করেছিল। কাল দেখা করার কথা বলল। তাই ভেবেছিলাম ফারজাদ ভাইকে জানাব।ʼʼ

দ্বিজা কিছু বলল না আর। আস্তে করে উঠে বাথরুমে চলে যায়। লাবন্য তাকিয়ে দেখল দ্বিজাকে। মনে মনে হাসল একটু—মেয়েটার চোখ বাঁধা মানছে না, অথচ কারও সামনে ঝরাতেও চাইছে না সেই পানি। দ্বিজা চলে যেতেই লাবন্য গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। প্রকৃতি থেমে আছে যেন, জমে আছে ঘন কুয়াশার আস্তরণের মাঝে। সেই বরফ শীতল রাতের গুমোট পরিবেশে লাবন্যর চোখ বেয়ে উষ্ণ কয়েক ফোঁটা তরল গড়িয়ে পড়ল। উহু, এ আফসোস নয়, আর না মন ভাঙার কষ্টে ঝরছে। তার তো মন ভাঙেনি, কেবল ছোট্ট এক টুকরো আকাঙ্ক্ষাতে বাস্তবতার ছোঁয়া লেগেছে। আর বাস্তবতা নিষ্ঠুর, বাস্তবতা কঠোর, বাস্তবতা কেবল কেঁড়ে নিতে জানে, বাস্তবতা তা দেয়–যা মানুষের চাহিদার বিপরীতে রয়েছে। আজ লাবন্যর সঙ্গে সেটাই প্রকাশ্যভাবে ঘটে গেছে।

লাবন্যর বাবা আসলাম বরাবরই ভাতুরে লোক। আফছানা বেগম বিয়ে হয়ে এসে থেকেই আজাদ সাহেবের ঘাঁড়ে পড়েছেন। স্বামী খরচ বহন করতেন না, বরং দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে ছোট্ট মেয়ে ও বউকে বড়ো ভাইয়ের ঘাঁড়ে রেখে এদিক সেদিক উড়ে বেড়াতেন। আফছানা বেগম লাবন্যকে নিয়ে ভাসুরের কামাইয়েই দিন কাটাতে লাগলেন। যখন লিমন তার গর্ভে, আজাদ সাহেব লাবন্যকে নিজের কাছে রেখে আফছানা বেগমকে আসলামের কাছে পাঠালেন ঢাকা।

তখন থেকেই লাবন্য বড়ো চাচার কাছে মানুষ। ছোটো বেলা থেকে দেখছে ফারজাদকে। দ্বিজা মামার বাড়ি থাকার সুবাদে দুজনে একসাথে মানুষ হলো। ফারজাদ সন্ধ্যা হলেই পড়াতে বসাত ওদের দুজনকে। কখনও ফারজাদ গ্রামের কর্মঠ, দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন ছেলে, তো কখনও ভালো পড়ালেখা করে শিক্ষিত এক যোগ্য ছেলে, তো কখনও শহুরে সাহেবী বাবু। তবে যাই হোক আগে ফারজাদ এরকম নির্দয় ছিল না। কখনও বাড়ির কারও সাথে উল্লেখযোগ্য খারাপ আচরণ সে করেনি। সব মিলিয়ে লাবন্যর মনের এই নরম অনুভূতি জাগাটা খুব বেশি অস্বাভাবিক নয়। ফারজাদ চাচাতো ভাই হিসেবে সবদিকেই মোটামুটি ঠিকঠাক। আর তার ওপর বয়ঃসন্ধিকাল থেকে চোখের সামনে খুব কাছ থেকে দেখে দিন কেটেছে।

লাবন্য এটুকু ভেবে আরেকবার চোখটা মুছে নেয়। ফারজাদ জিজ্ঞেস করল, লোকে তার কোথায় আটকায়? লাবন্য জানে, ফারজাদের মাঝে আটকানোর মতো অনেক কিছু আছে। বিশেষ করে, তার দায়িত্বজ্ঞান। যেখানে অল্প কিছুটা ক্ষতির সম্ভাবনা আছে, সে কাজ ফারজাদ করবে না, নিজেকে খারাপ বানিয়ে হলেও করবেনা। লাবন্য অবুঝ না, সে তো সারাজীবনই মেনে নিয়েছে ফারজাদ কেবল তার একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল যা কখনও বাস্তবে রূপ নেওয়ার নয়। এত চেষ্টা করেছি নিজেকে লুকানোর, অথচ ওই জহুরী দৃষ্টি থেকে নিজের গোপন অনুভূতিকে বাঁচানোর সাধ্য হয়নি। নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করে লাবন্য–এই শেষ দীর্ঘশ্বাস সে ফেলবে ফারজাদ নামের ওই হৃদয়হীন পুরুষটার জন্য। তাকে নতুন জীবন শুরু করতে হবে। তার ভাগ্য তার দ্বারে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ছে, দ্বার খুলে ভাগ্যকে স্বাগত জানাতে হবে। এখানে পড়ে থাকলে তো চলবেনা।

রুমে চলে এলো। দ্বিজা যে বাথরুম থেকে কখন বিছানায় এসে শুয়েছে সে টেরই পায়নি। কম্বলের নিচে মুখ লুকিয়ে নিশ্চয়ই ফোঁপাচ্ছে! লাবন্য তো নিজেকে আবৃত করে ফেলবে কঠিন আবরণে, কিন্তু এই পাগলি মেয়েটা কবে বুঝবে বাস্তব জীবনটাকে। লাবন্য বাঁধা দিলো না দ্বিজাকে। এই চোখের পানি তো পরশ-পাথর। এর ছোঁয়া মানুষ পেলেই সে হয়ে যায় ব্যথাহীন। কাঁদতে কাঁদতে যেদিন এই কান্না থামবে, সেদিনের পর তাকে কাঁদানোর সাধ্যি আর কোন আঘাতের থাকবে না। আঘাতের তীব্র যন্ত্রণা মানুষকে ব্যথাহীন করে তোলে। এই মেয়ে এভাবে কিছুদিন কাঁদলে তবেই কিনা জীবনের টানপোড়েনকে হাতের মুঠোয় মুচরে সামনে এগোতে পারবে নির্দিধায়।

লাবন্য পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। তার কষ্ট লাগছে না, একটু জ্বলছে বুকের ভেতর, তবে চলবে সেটা। সে মেয়ে, সে মানুষ, সে প্রাপ্তমনষ্ক মেয়েমানুষ। তার কাছে ব্যথা যদি হার না মানে, তবে সে কিসের প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েমানুষ!


সকাল নয়টার দিকে ফারজাদ বেরিয়ে পড়ল রাজারবাগের উদ্দেশ্যে। ভেতরে ঢুকতেই কনস্টেবল ফারজাদকে নিয়ে যায় ডেপুটি ইন্সপেক্টর রাশেদুল হকের সম্মুখে। ফারজাদ গিয়েই সালাম দিলো, “আসসালামুআলাইকুম, স্যার!ʼʼ

রাশেদুল হক মাথা নেড়ে মনে মনে জবাব দিয়ে ফারজাদের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। হ্যান্ডশেক করতে করতে রাশেদুল হক একবার পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন ফারজাদকে। ছয়ফুটের কম হবে না ফারজাদ। বডি ফিটনেস ঠিকঠাক, টি শার্টের ওপর দিয়ে বক্ষপিঞ্জরের ওপরের কাষ্ঠল, কঠিন দেহটা ভেসে উঠছে যেন। তার ওপর পরনে তার গ্রে কালারের কার্গো প্যান্ট, ওপরে সাদা টিশার্ট, তার ওপরে কালো শার্ট। রোদচশমাটা খুলে হাতে নিয়েছে সম্মানের খাতিরে। এই ছেলেটাকে প্রথমবার দেখে যা মনে হয়েছিল আজও ঠিক সেই কমপ্লিমেন্টই দিলেন, “ফারজাদ, তোমার চাকরি তো হয়ে যাবে, আর তাতে এসবি অফিসার ফারজাদ কম, আর্মি মেজর ফারজাদ ইয়াজরান খান বেশি লাগবে।ʼʼ

ফারজাদ মুচকি হাসল, “আপনার কমপ্লিমেন্টটা নিন্দাজনক ছিল নাকি প্রশংসামূলক, আমি কনফিউজড, স্যার!ʼʼ

রাশেদুল হক সামান্য হেসে আবার তাৎক্ষণিক মুখটা গম্ভীর করে বললেন, “ওয়ার্ক আউট রুটিনটায় কোন গড়বড় কোরো না। ফিটনেস ধরে রাখাটা পুলিশের চাকরিতে অবশ্যই জরুরী। বিশেষ করে তোমার মতো জোয়ান অফিসারের জন্য। অন্তত ট্রেনিং শেষ হবার আগ অবধি কোন অনিয়ম নয়।ʼʼ

বলেই তিনি হেঁটে গিয়ে বসলেন অদূরে রাখা চেয়ারটাতে। ফারজাদ এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। রাশেদুল হক বললেন, “আগামীকাল তোমার সঙ্গে ডিআইজি স্যার দেখা করবেন। এবং অফিশিয়ালি তোমার গেট-আপ দেখে এবং সবকিছু বিবেচনা করা হবে আরেকবার। ভেবো না সিলেক্টেড হওয়ার পর আর অবজার্ভ করা হয় না। এবার পার্সোনালি কিছু বলি সেগুলো মন দিয়ে শোনো। যদিও আমি জানি তুমি কেমন। আসলে প্রথম তোমায় দেখেই মনে হয়েছিল, তুমি ব্যাটা সাচ্চা কসাই প্রকৃতির লোক। আর এরকম লোকেরাই সাধারণত এই লাইনে ভালো করতে পারে। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে তোমার মতো মানুষদের ফটোকপি করে অথবা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে চাষ করি। আর সবগুলোকে দেশের দূর্নীতি দমনের কাজে লাগিয়ে দেই। যারা সুষ্ঠুভাবে মেশিনের মতো দেশের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে কাজ করবে। যেসব ঝোল এসে ভর্তি হয় এই লাইনে, কী বলব? ʼʼ

এটুকু বলেই ইশারা করলেন ফারজাদকে লোহার চেয়ারে বসতে। ফারজাদ ঘাঁড় নেড়ে বোঝায়–এভাবেই ঠিক আছে। রাশেদুক হক বললেন, “আর বসো হে, ইয়াং ম্যান। একবার ডিউটিতে জয়েন করো, এ জীবনে আর বসার সুযোগ নাও হতে পারে।ʼʼ

পাশে দাঁড়ানো দুজন অফিসার ও কনস্টেবল মুখ চেপে হাসল একটু। এজন্য তাদের ডেপুটি স্যারকে ভালো লাগে। যেমন কর্তব্যপরায়ন কঠোর সুশৃঙ্খলা, তেমনই রসিকও। ফারজাদ বসলে তিনি বলতে শুরু করলেন,

“বুঝলে ইয়াং ম্যান! বস্তত, দেশের রক্ষী আমরা, দেশ যদি যোদ্ধা হয়, আমরা তার হাতে থাকা ঢাল। যদিও কথাটা আজ শুধু কথাই। এসব নীতি কেউ মানে না। তবে আসল নীতি তো এটাই, নিজেকে কোরবানী করে দেওয়া। আমাদের ব্যক্তিগত জীবন থাকতে নেই, শারীরিক ব্যাথা থাকতে নেই, অলসতা, ক্লান্তি, ঈদ, উৎসব, ছুটি জীবনের দাম—এসব আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। তুমি ভালো ঘর থেকে এসেছ, পরিবার পরিজন, প্রেমিকা, আত্মীয় এসব থাকবে। তবে জানো কী–তুমি যেখানে ঢুকতে যাচ্ছ, সেখানে ঢোকার আগে এসব বাইরে রেখে তারপর পা দিতে হয়? রাত-বিরাত কোন জঙ্গি দলের পেছনে দৌঁড়াবে, রাজনৈতিক অপরাধ দমন করতে গিয়ে গুলিতে বুক ফুটো করে রাস্তায় লুটিয়ে পড়বে, বন্যায় ভেসে যাওয়া মানুষকে উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেকে ভাসতে হবে, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে কোথায় কার হাতে ম রে গুম হয়ে যাবে, তার হদিস এ দুনিয়া আর পাবে না। খবর বেরোবে তূমি নিখোঁজ। এবার বলো তোমার কী পিছুটান থাকতে আছে? ঘরে বউয়ের প্রতি অগাধ মায়া, মায়ের আশীর্বাদে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা, সন্তানের জন্য খেলনা নিয়ে ঘরে ফেরার সুযোগ! এইসব কিছুই অনিশ্চিত, ঠিক তোমার এই রোবটিক জীবনটার মতো।ʼʼ

ফারজাদ মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়ে মূর্তির ন্যায় বসে শুনছে কথাগুলো। রাশেদুল হক আবার বলতে শুরু করলেন,

“কষ্ট, আঘাত, ব্যাথা, ক্লান্তি, মায়া, ব্যক্তিজীবন, মনের টানের আবেগ উত্তেজনা, অনুভূতি এসব থেকে মুক্ত আমরা। এমনই কিছু ওয়াদা পাঠ করানো হবে তোমাকে। পুরোটা কেউ পালন করে না। কেউ বিশ্বস্ত হয়ে কাজ করে না এটা ঠিক, তবে করা উচিত তো নাকি? করার চেষ্টা করা উচিত। তুমিও নিজেকে প্রস্তত করো কেবল একটা ইলেক্ট্রনিক মেশিন হিসেবে সরকারের হুকুমে পুতুলের মতো নাচতে। মানসিক ও শারীরিক দুভাবেই প্রস্তত করে তোলো।
মস্তিষ্কের কিছু অংশ ফেলে কিছু অংশ কাজে লাগাতে হবে এখন থেকে তোমাকে। যে অংশে আবেগ অনুভূতি, ঘুম, ক্লান্তি, ক্রোধ, ঘৃণা, ভালোবাসা কাজ করে—সেই অংশকে বাদ দিয়ে, যে অংশে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, চতুর নজর, আর সন্দেহকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার উপস্থিত জ্ঞান ডেলিভার হয় সেই অংশকে রেখে দিতে হবে। ত্যাগ, গোটাটাই ত্যাগ, পুলিশের চাকরি মানে গোটাটাই ত্যাগ, এছাড়া আর কিছু না।ʼʼ

চলবে..
[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে