ডাকপিয়নের ছুটি নেই পর্ব-০৬

0
589

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_____০৬

রাতে বৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে রাস্তাঘাট একদম স্যাঁতস্যাঁতে আর কর্দমাক্ত হয়ে আছে। শ্রাবণের বাইক নিয়ে মেইন রোডে উঠতে বেশ বেগ পেতে হলো। ইশা আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিলো মেইন রোডে। শ্রাবণের হুকুমে আগেই সে এসে পড়েছে এখানে। শ্রাবণ বাইক নিয়ে মেইন রোডে উঠলেও ইশা এখনও খাম্বার ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। হয়তো সে, পূণরায় শ্রাবণের হুকুমের অপেক্ষায় আছে।

“ল্যাম্পপোস্টের মতো নিজের জায়গা বুঝে দাঁড়িয়ে থাকবি, নাকি বাইকে উঠবি?;

শ্রাবণের এহেম বাণী কর্ণকুহরে প্রবেশ করলে, ইশা খানিকক্ষণ বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অতঃপর কিঞ্চিৎ বির*ক্ত পেশ করে এগিয়ে আসে বাইকের দিকে। মহা টেনশনে মাথার ভেতর দপদপ করতে লাগলো ওর! বাইকে ওঠা ওর জন্য ছোট খাটো একটা সুনামি। আগের দিন হলে, শ্রাবণ সযত্নে হাত ধরে তুলে দিতো বাইকের পেছনে, তবে আগের দিন আর নেই! এখন এই বিশ্বযু*দ্ধ ওর একারই করতে হবে।

“ব্ বলছিলাম যে, বাইকটা না নিলে হতোনা?;

“বাজার অব্দি হেঁটে যেতে পারলে যা! আমি তো বাইক নিয়েই যাবো!;

এই বলেই বাইক স্টার্ট দিলো শ্রাবণ। ইশার আকাশ-পাতাল এক করে রা*গ হচ্ছে। কোনো মানবিকতা নেই লোকটার মাঝে! ও কি আর সাধে বলবে বাইক না নেওয়ার কথা?

“দ্ দাঁড়াও! আমাকে ফেলে যেওনা। বাজার কি এখানে নাকি?;

শ্রাবণ হেলমেট পড়তে পড়তে বলল,

“এতো নাটক না করে উঠে বস! আমার হাতে মোটেও সময় নেই।;

“আবার কোথায় যেতে চাও!;

“বড় খালুকে আনতে যেতে হবে।;

“উনি আসলেন না কেন?;

বির*ক্ত হলো শ্রাবণ! ইশার পানে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে বলল,

“তোর সাথে এখন খেজুরে আলাপ করতে বসতে হবে নাকি!;

তব্দা খেলো ইশা। সে তো কেবল নিজের ভ*য়টা লুকাতে চাচ্ছিলো কথার মারপেঁচে। এই মানুষটা আর কি বুঝবে!

“উঠছি!;

নিজের ভ*য় কে জয় করতে হবে ইশা, এই বলে নিজের মনকে স্বান্তনা দিলো বেচারি। অতঃপর কাঁপা কাঁপা পা জোড়া এগিয়ে নিয়ে কোনো মতে উঠে বসলো শ্রাবণের পেছনে। বাইকের লুকিং গ্লাসে ইশার কার্যকলাপ দেখছিলো শ্রাবণ। ভ*য়ে মুখটা একদম কাচুমাচু হয়ে গেলো তার! বাইকে ওঠা নিয়ে এতো কিসের ভ*য় তার, কে জানে? গোটা একটা বছর শ্রাবণ তাকে বাইকেই তো ঘুরিয়েছে। এমনকি বাইক চালানোটাও ট্রেনিং দিয়েছিলো। ভীতুর ডিমটায় সব গুলে খেয়ে ফেলেছে।

“ধরে বস! পড়ে গেলো তো সবাইকে আবার আমাকেই কৈফিয়ত দিতে হবে! আর তুই খুব ভালো করে জানিস যে…;

“হ্ হ্যাঁ, জানি জানি! তুমি কাউকে কৈফিয়ত দিতে পছন্দ ক্ করো না! ত্ তাই বলে, আমাকে মে*রে ফেলার প্লান করোনা প্লিজ।;

ভ*য়ে জড়োসড়ো হয়ে গেলো ইশা। কোনো মতে পেছন থেকে শ্রাবণের কাঁধটা খামচে ধরে বসলো। কাঁপছে তার হস্তদ্বয়। টের পেলো শ্রাবণ। মনে মনে ভীষণ হাসছে সে। কিন্তু এভাবে বাইক চালানো সম্ভব নয়। তাই না চাইতেও ইশার হাতটা নিয়ে নিজের কোমর পেঁচিয়ে দিলো। ভীষণ অবাক হলো ইশা। বিস্ময়ের চোটে চোখ মুখ সব যেন অন্যরকম দেখালো। শ্রাবণ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

“ধরে বস! পরে গেলে এর দায় আমার কাঁধে তুলতে পারবোনা।;

ইশা কিছুই বলতে পারলোনা জবাবে। চুপচাপ কোনঠাসা হয়ে বসে রইলো পেছনে। শ্রাবণ ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাইক স্টার্ট দিলো।

বৃষ্টির কারনে বাজারের অবস্থা আরও ভ*য়াবহ। রাস্তাঘাটের অবস্থা যেমন তেমন হলেও বাজার যেন কর্দমাক্ত নদীতে পরিনত হলো। বাইক টেনে একদম ফুলের দোকানের সামনে থামালো শ্রাবণ। বাইক থামতেই নিজের জীবন নিয়ে নেমে পড়লো ইশা। বড়বড় দম ফেলে একবার ভ্রু কুঁচকে বাইকটার দিকে তাকিয়ে মনেমনে কয়েকখানা বকা ঝাড়লো। শ্রাবণ ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো। ওর মুখের রিয়াকশন দেখে অন্যদিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো শ্রাবণ। অতঃপর বাইকটা পাশে নিয়ে সেও নেমে পড়লো। ফুলের দোকানীর থেকে ভোরের সচ্ছ ফুলগুলো ঝুড়ি ভরে কিনে নিলো। হাজার দুয়েক টাকার ফুল কিনলো সব মিলিয়ে। যখন টাকা দিতে যাবে, ঠিক তখনই হাতে একটা বেলি ফুলের মালা পেঁচিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো ইশা। শ্রাবণের সামনে হাত নাচিয়ে আহ্লাদী গলায় বলল,

“সুন্দর না?;

শ্রাবণ গম্ভীর গলায় বলল,

“না। আর কোনো কাজ খুঁজে পাসনা? এগুলো নিয়ে বাসায় যাবি। রিক্সা করে দিচ্ছি।;

ইশার হাস্যজ্বল মুখখানা নিভে গেলো শ্রাবণের জবাবে। সে বিনাবাক্যে বেলি ফুলের মালাটা খুলে রেখে দিলো। শ্রাবণ কথাটা ওকে এভাবে বলতে চায়নি। অন্যমনস্ক থাকায়, বুঝতে পারেনি। তবে যেই মাত্র ইশা ফুলের মালাটা খুলে দিলো, ঠিক তখনই ভেতরে কেমন যেন হতে লাগলো তার। ইশার মন খারাপের আচ সে দূর থেকেও পাচ্ছে।

দোকানীকে টাকা শোধ করার সময় বারবার করে ইশার পানে দেখতে লাগলো শ্রাবণ। ইশা বিনাবাক্য ব্যয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। যা দেখতে বড্ড খারাপ লাগছে শ্রাবণের। আজ প্রথমবার তার নিজের উপরই ক্ষোভ বাড়তে লাগলো! কথাটা এভাবে না বললেও তো হতো!

রিক্সা ডেকে, ইশাকে রিক্সায় তুলে দিলো শ্রাবণ। যাওয়ার আগে একবার জিজ্ঞেস করতে চাইলো, ফুলের মালাটা ইশা নিবে কিনা! কিন্তু চেয়েও জিজ্ঞেস করতে পারলোনা । রিক্সা চলতে লাগলো। শ্রাবণ পেছন থেকে পলকহীন চেয়ে রইলো রিক্সা যতক্ষণ চোখের অলক্ষ্যে সরে না গেলো। রিক্সাটি আর দেখা গেলোনা খানিক বাদেই। বহুদূর চলে গেলো মাত্র কয়েক লহমার মধ্যে।

ইশা বাসায় পৌঁছে ফুল গুলো বড়মামাকে বুঝিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। এখন বাজে সকাল ৮টা। তিতির সবে ঘুম থেকে উঠলো। তুতুন আর তানিও উঠলো খানিক বাদে। ইশা ফ্রেশ হয়ে ধপাস করে শুয়ে পড়লো নিজের বিছানায়। আহা কি শান্তি। মনে হচ্ছে যেন অনন্ত কাল নিজের আরাম দায়ক বিছানা থেকে বঞ্চিত ছিলো সে। আজ আবারও ফিরে পেয়ছে তাকে! একটু জমিয়ে আরাম না নিলে যেন চলবেইনা।

জানালার কাচ ভেদ করে ফুুরফরে করে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে ঘরের ভেতর। চোখ বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাস টানলো ইশা। অনুভব করলো প্রকৃতির শান্ত স্পর্শ। যে স্পর্শ পেতেই হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে সোনালী অতীতে। ছোট বেলার কথা বড্ড মনে পরে, সেই সাথে মনে পরে হাসিখুশি সেই মানুষটাকে। যার মূখ্য কাজই ছিলো ইশার পেছনে লাগা, আর পুরো বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখা। কিন্তু আজ সে নিজেই চুপ। গম্ভীর এক মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে তারই করা কিছু ভুলের কারনে। সব তো ঠিকই ছিলো! তাহলে কেন করতে গেলো সে ওমন? কেন বুঝলোনা মানুষটাকে!

“আসবো?;

“কে?;

তুর্জ দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে! তুর্জকে দেখতে ক্ষণেই ভেতরটায় এক বির*ক্তির রেশ ছড়িয়ে গেলো। দোতলায় তার আসার কোনো দরকার খুঁজে পায়না ইশা! কাউকে দিয়ে ডাকিয়ে নিলেই তো সে চলে যায়।

চটজলদি শোয়া থেকে উঠে বসলো ইশা। তুর্জ অনুমতি পাওয়ার আর অপেক্ষা করলোনা। নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়লো।

“কখন এলেন?;

প্রশ্ন করলো ইশা। তুর্জ ইশাকে একবার চোখ ভরে দেখে মৃদু হেসে জবাব দিলো,

“মাত্রই। সারারাত ঘুমাওনি নাকি? চোখমুখ ফুলে আছে।;

তুর্জর এহেম প্রশ্নে ইশা চোখমুখ একবার মালিশ করে বলল,

“না। সেভাবে ঘুম হয়নি।;

“দেখেই বুঝেছি। এখন না হয় একটু ঘুমিয়ে নিতে। ঘুমের ঘাটতি থাকা কিন্তু শরীরের জন্য ক্ষতিকর।;

ইশা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো তুর্জর পানে। আজকে তুর্জর আচরণ যেন একটু অন্যরকম লাগছে। নিজের কাছেই ভিন্ন ঠেকলো তুর্জকে। ইশাকে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে এক ভ্রু নাচিয়ে শুধালো তুর্জ,

“এভাবে কি দেখছো? ভুল বললাম নাকি!;

“ন্ না। তেমন কিছু নয়। আঙ্কেল আন্টি এসেছেন?;

“না বাবা-মা দুপুরের দিকে আসবে। এখন আসতে না পারায় তোমার কাছে দুঃখ ভরে পাঠিয়েছে।;

স্মিত হাসলো ইশা। চোখ ঝাপটে বলল,

“দুঃখিত হতে হবেনা। ইট’স ওকে।;

স্মিত হাসলো ইশাও। তুর্জ হাতে একটা শপিং ব্যাগ ধরে রেখেছে। মাত্রই সেটা চোখে পড়লো ইশার। তবে ইশা প্রশ্ন করার আগেই তুর্জ সেটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

“এটা তোমার জন্য। মা পাঠিয়েছে। মা বলেছে, তার ছেলের হবু বউকে আজ এই ড্রেসটাতে দেখতে চায়।;

ইশার হাসি হাসি মুখখানা ধপ করে নিভে গেলো। সে বুঝতে পারলো তুর্জর হঠাৎ এই ভালো হওয়ার কারনটা। যখন তাদের এনগেজমেন্ট হয়, তখন তুর্জ ইশাকে একটা ড্রেস গিফ্ট করেছিলো। ইশা হাসি মুখেই সেই উপহার গ্রহণ করে, তবে কখনও খুলে দেখেনি। যেভাবে তুর্জর থেকে নিয়েছিলো, ঠিক সেভাবেই আলমারিতে তুলে রাখে সে। একদিন কথায় কথায় তুর্জ ভীষণ জেদ ধরে তার দেওয়া ড্রেসটা ইশাকে এখনই পড়তে হবে। মাঝরাত ছিলো। ইশা স্বাভাবিক ভাবেই তুর্জকে না করে দেয়, সাথে এও জানায় কখনও কোথাও বাইরে গেলে সে তার দেওয়া ড্রেসটা পড়বে। তবে, তুর্জ মানেনা। সে আরও জেদী হয়ে ওঠে। অবশেষে ইশা বাধ্য হয়েই রাজি হয়। তুর্জর মন রাখতে, সে তার গিফট করা ড্রেসটা পড়ে৷ কিন্তু পড়তে গিয়ে তার মনে হয়, তুর্জ তাকে সাধারণ বাঙালি মেয়েদের কোনো ড্রেস গিফ্ট করেনি। ড্রেসটা লম্বায় তার হাঁটুর সামান্য নীচে অব্দি, এবং সেই সাথে স্লিভলেস! পেছন থেকে, সামনে থেকেও কোথাও থেকে, কোনোভাবেই শালীন পোশাকের নাম দিতে পারলোনা এই ড্রেসটাকে। সবটা বুঝে ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে যায় ইশা! সঙ্গে সঙ্গেই কল দেয় তুর্জকে। তুর্জকে এক বুক আশা নিয়ে ইশার কলটা রিসিভ করতেই একগাদা কথা শুনিয়ে কলটা কেটে দেয় ইশা! তুর্জর সব আশায় এক বালতি জল পড়ায় সেও ভীষণ ক্ষিপ্র হয়, তবে ইশা তার হবু বউ হওয়াতে এক্ষনি এতো বাড়াবাড়ি করার সাহস পেলোনা। তারপর থেকে তুর্জর কোনো উপহারই আর নিতোনা ইশা। আজকেও যে নিবে, সেটাও নির্ভর করছে।

“কি হলো? ড্রেসটা তুমি নিবেনা?;

“না। আপনাকে আমি আগেও বলেছি, বিয়ের আগে আমাকে এসব উপহার দেওয়া বন্ধ করুন। ভালো লাগেনা আমার এসব!;

তুর্জর মুখটা কাচুমাচু হয়ে গেলো। হাত বাড়িয়ে ইশার হাতের উপর হাতটা রাখতেই হাতটা সরিয়ে নেয় ইশা। পূণরায় কিছু বলতে নিলে তুর্জ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,

“বাবা-মা পাঠিয়েছে। তুমি না পড়লে তারা খুব কষ্ট পাবে।;

“আপনার তাদেরকে বলা উচিৎ ছিলো!;

কাঠ কাঠ গলায় বলল ইশা। ওর দৃষ্টি অন্যকোথাও। সেই সুযোগে বির*ক্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো তুর্জ। নিজের রা*গটাকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণের রাখার চেষ্টা করে বলল,

“বাবা-মা অনেক হার্ট হবে ইশা, প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। আগে তোমার-আমার মাঝে ছোট্ট একটা ভুল বোঝাবুঝি ছিলো, সেটাতো আমি তাদেরকে এভাবে বলতে পারিনা। তাই না?;

ইশা যেন কথা বাড়াতে চাইলোনা তুর্জর সাথে। তুর্জর হাত থেকে শপিং ব্যাগটা নিয়ে বলল,

“আপনি হয়তো ব্রেকফাস্ট করে আসেননি। আসুন, ব্রেকফাস্ট করবেন।;

“তুমি পড়বে তো ড্রেসটা?;

ইশা শপিং ব্যাগটা আলমারিতে তুলে রাখতে রাখতে বলল,

“পড়বো। চলুন।;

“দ্যাটস লাইক আ গুড গার্ল।

ইশা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে চলে গেলো। তুর্জও গেলো তার পিছু পিছু।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে