ডাকপিয়নের ছুটি নেই পর্ব-২৭+২৮+২৯

0
564

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব______২৭.

টেবিলে চারটা কফি রেখে গেলো ওয়েটার। ইশা ভ্রু কুঁচকে কফিগুলোর দিকে তাকালে, পাশ থেকে শ্রাবণ ওয়েটারকে ডেকে বলে উঠলো,

“এক্সকিউজ মি, আমরা তিনজন।;

“না, আরেকজন আছে। আমিই চারটা দিতে বলেছি।;

সামনে থেকে নিলাশা বলে উঠলো। ইশা এবার কফি রেখে নিলাশার দিকে সন্দিহানি দৃষ্টিতে তাকালো। এই মেয়ের মতিগতি ঠিক ধরতে পারছেনা ও। একটু আগে নিজেই ওদের কফি খাওয়ার জন্য রিকোয়েস্ট করেছে। আর এখন কফি খেতে এসে একটা বেশি কফি অর্ডার দিলো। করতে চাচ্ছে কি মেয়েটা?

“ও, ওকে আপনি যান।;

শ্রাবণ ওয়েটারকে পূণরায় যেতে বলে ইশার কফিটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজের কফিটা নিয়ে নিলো। নিলাশা আঁড়চোখে তাদের দু’জনকে নজরবন্দি করছে। আশেপাশে বেশ কোলাহল। নিলাশা ইশা আর শ্রাবণের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আশেপাশে তাকালো বারকয়েক। শ্রাবণ ওসবে আগ্রহ না দেখিয়ে নিজের কথা বলতে উদ্যোত হলো,

“সরি নিলাশা। আমার বাবার করা একটা ছোট্ট বোকামির জন্য আপনার লাইফে এতো বাজে একটা ইমপ্যাক্ট এলো। ভাবলে আমার সত্যিই ভীষণ খারাপ লাগছে।;

শ্রাবণ অত্যন্ত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন মানুষ। নিলাশা সেদিনই বুঝেছিলো। এবং সেই সাথে তার এই বিশ্বাসটুকুও হয়ে গিয়েছিলো যে, ইশানিকে শ্রাবণ ভ*য়ানক রকমের ভালোবাসে। ঠিক তার ইয়াসিরের মতো। তার ভাবতেই ভালো লাগে এই পৃথিবীতে শ্রাবণ এবং ইয়াসিররে মতো পাগল প্রেমিকগুলো আছে বলেই ভালোবাসার জিকির হয়। নয়তো কবেই বিলুপ্তি হয়ে যেতো ভালোবাসা নামের ফ্যান্টাসির।

“না, আপনি ভুল ভাবছেন শ্রাবণ। আপনার সাথে আমার বিয়েটা ভেঙে আপনি আমার কোনো ক্ষতি করেননি। বরং উপকার করেছেন!;

শ্রাবণ কফিতে চুমুক বসাতে গিয়েও থেমে গেলো নিলাশার কথা শুনে। ভ্রু জোড়া তার আপনাআপনিই কুঁচকে এলো।

“মানে?;

“আমি একজনকে ভালোবাসি।;

থেমকালো ইশা আর শ্রাবণ। দুজনে একসাথেই তাকালো নিলাশার পানে। পরক্ষণেই আবার দু’জন দু’জনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মুচকি হাসলো। ইশার ভারী হৃদয় মুহুর্তেই শীতল হয়ে গেলো। আর শ্রাবণের মাথায় অপরাধবোধের যে বোঝাটা ছিলো, সবটাই ক্রমশ হালকা হলো।

“এক্সকিউজ মি, ম্যে আই সিটেড?;

নিলাশার পেছন থেকে সচ্ছ গলায় ভেসে এলো কারোর ডাক। নিলাশা ফট করে পেছন মুড়ে তাকাতেই দৃশ্যমান হলো নজরকাড়া সৌন্দর্যের এক যুবককে। পরনের ফর্মাল ড্রেসআপ দেখে বোঝাই যাচ্ছে অফিসের জন্যই রেডি হয়ে বেরিয়েছে। মাঝপথে প্রেয়সীর ডাক পেয়ে হাজির হতে হলো।

নিলাশার হাস্যজ্বল মুখশ্রী দেখতে তাদের আর বুঝতে অসুবিধা হলোনা ইনিই তার কথিত প্রেমিক পুরুষ। ইয়াসির লম্বা করে হাসলো। নিলাশার পাশের চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে সেই হাসি আরও দীর্ঘ করে সম্মুখে তাকালো। ইশা আর শ্রাবণকে একনজর দেখে হাত বাড়ালো শ্রাবণের দিকে।

“ইয়াসির;

“শ্রাবণ;

“হাই, ইউ মাস্ট বি ইশানি রাইট?;

ইয়াসিরের প্রশ্নে স্মিত হেসে মাথা নাড়লো।

“জি, ইশানি।;

“ইউ গাইজ লুকিং লাইক আ পার্ফেক্ট কাপল আই সয়্যার। বস আমি তো রীতিমতো অবাক বনে গিয়েছিলাম, আমার সুন্দরী প্রেয়সীকে এই ফার্স্ট টাইম কেউ রিজেক্ট করলো উইথআউট এনি হেজিটেশন অর সামথিং লাইক দ্যাট। ক্যান ইউ ইমাজিন, এই মেয়েকে আমি রোজ কম করে হলেও পঞ্চাশ জনের কুনজর, ইভটিজিং থেকে সেইভ করে রাখি। সেখানে আপনি বস.. ইউ হ্যাভ টু এপ্রেশিয়েট ইওর লাক ইশানি।;

গড়গড় করে বলেই যাচ্ছে ইয়াসির। নিলাশা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ইশা লজ্জা মিশ্রিত হাসলো। জবাবে শ্রাবণ বলল,

“এতো সহজে হাত ছাড়বো বলে ভালোবাসিনি। সত্যি বলতে, যখন এই মেয়েটা চোখের সামনে থাকে, তখন যেন বাকি দুনিয়া ভুলে যাই আমি। ও আমার উপনেত্র। যতক্ষণ ও চোখের সামনে থাকে ততক্ষণই আমি শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারি, চারপাশ জুড়ে এক সচ্ছতা বিরাজ করতে থাকে। আর যেই না মাত্র ও চোখের আড়াল হয়, অমনি যেন দুনিয়া ঝাপ্সা লাগে।;

বলে থামলো শ্রাবণ। ইশার অক্ষিপট স্থীর হয়ে গেলো শ্রাবণের মন্ত্রমুগ্ধ বিশ্লেষণে। পাশ ফিরে মানুষটাকে এক পলক দেখার জন্য হৃদয়খানা আকুল হয়ে উঠলো যেন। ক্ষণেই পাশ ফিরে তাকালো শ্রাবণের পানে। এক মুহুর্ত বিলম্ব সইলোনা অন্তরের অন্তস্তলে। শ্রাবণ বিমুগ্ধ নয়নে পূর্বেই চেয়েছিলো ইশার স্নিগ্ধ মুখে। ইশা তাকাতে চোখের পলক ঝাপটালো সে।

“অসাধারণ ভাই। ভালোবাসার এতো সুন্দর সংজ্ঞা শুনে মন ভরে উঠলো।;

শ্রাবণ মৃদু হেসে মাথা দুলালো। অতঃপর টুকটাক কথায় কফি খেয়ে সময় ব্যয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো সবাই।

_________

গাড়িতে গাল ফুলিয়ে বসে আছে নামিরা। আরব ড্রাইভ করতে করতে বারবার পেছনের সীটে তাকাচ্ছে আঁড়চোখে। বাসা থেকে অনেক কাহিনি করে নামিরাকে বের করতে পারলেও আফিয়া বেগমের বাবার বাড়ি এসে মামলা ডিসমিস অর্থাৎ উল্টেপাল্টে গেলো। শ্রাবণের মামাতো ভাই আশফি এবং মামাতো বোন হৃদিমা। ওদের দু’জনকে নিয়ে বের হতে গিয়ে বিপত্তিটা বাঁধে। হৃদিমা এবার তানির সাথে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। আশফি আরবের বয়সি। একই ক্লাস। হৃদিমা ছোট থেকেই আরবের উপর ভীষণ ক্রাশ। সেকথা ওর ফুপি অর্থাৎ আফিয়া বেগমও জানেন। জেনে কিছু বলেননি অবশ্য। বলেছিলেন, বড় হ, তারপর দেখা যাবে।’ এখন তো সে অনেক বড় হয়েছে। সুতরাং এখনতো ফুপি ঠিকই দেখবে।

হৃদিমা আর আশফিকে পেছনের সীটে বসতে বললে, হৃদিমা জেদ ধরা গলায় জানায়, ‘ও সামনের সীটে বসবে।’ এ কথা শুনে অবশ্য নামিরার মুড এতোটাও বিগড়ে যায়নি যতটা বিগড়েছে এর পরের কান্ডটিতে। সামনের সীটে বসেও বাংলা সিনেমার নায়িকার মতো সীট বেল্ট না বেঁধে বারবার পরে যাচ্ছে। যা দেখে রীতিমতো বির-ক্ত হয়ে উঠলো নামিরা। অবশ্য আরব সেটা একদমই খেয়াল করেনি। একপর্যায়ে আরবের চোখে পড়লো বিষয়টা। সে তৎক্ষনাৎ বলে উঠলো,

“কি ব্যাপার হৃদিমা, সীট বেল্ট বাঁধছো না কেন?;

“ওও আরব ভাইয়া, আমি তো একদম ভুলেই গিয়েছিলাম। আহ্ এটা কি হলো!;

“কি হলো?;

“এটা তো বাঁধতে পারছিনা আমি। প্লিজ হেল্প মি আরব.. ভাইয়া?;

আরব গাড়ি থামালো। সাদা মনে হৃদিমার সীট বেল্টটা বেঁধে দিয়ে নিজের জায়গায় এসে বসতেই টেনে ধরলো হৃদিমা। ধন্যবাদ জানাতে ঝাঁপিয়ে পড়লো আরবের উপর। আহ্লাদে গদগদ হয়ে জড়িয়ে ধরলো আরবকে। ঘটনার আকস্মিকতায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো আরব। ওদিকে নামিরা রাগে এটম বোমে পরিনত হলো। যেকোনো সময় ঠুস করে ফেটে যেতে পারে।

গাড়ি থামালো শমসের সাহেবের সবথেকে কাছের বন্ধ ইকবাল সাহেবের বাসার সামনে। আরব গাড়ির সীট বেল্ট খুলে বের হতে নিলেই পাশ থেকে পূণরায় হাত টেনে ধরলো হৃদিমা। অসহায় তার চাহনি,

“সীট বেল্টটা খুলে দাও প্লিজ।;

“সীট বেল্ট খুলতেও পারোনা তুমি?;

“না।;

নামিরার মাথা গরম হয়ে উঠলো পূণরায়। সে আরবের পানে তীব্র ক্ষোভ নিয়ে তাকাতেই মুখ ঘুরিয়ে উপরে তাকালো আরব। অর্থাৎ আজকের জন্য বেঁচে যাওয়ার আর্জি করলো উপরওয়ালার কাছে।

“আশফি, ব্রো? ক্যান ইউ হেল্প ইওর সিস্টার?;

ভয় ভয় গলায় ঢোক গিলে আশফিকে ডেকে উঠলো আরব। ততক্ষণে নামিরা আর আশফি নেমে পড়েছে গাড়ি থেকে। আরবের ডাক পেয়ে আশফি এগিয়ে এলো। বলল,

“ইয়া, সিওর।;

আরব হৃদিমার থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে কোনো রকমের পগারপার হলো। নামিরা এপাশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরব এসে দাঁড়ালো ওর পেছনে। কথা বলার দুঃসাহস করতে পারছেনা। কে জানে কোন রিয়াকশন দুঃখ অপেক্ষা করছে তার কপালে।

“রেগে আছো?;

“যান না, যান? আপনার লুতুপুতু পুতুপুতু হৃদিমার গায়ে গিয়ে ঢলে পড়েন। আমার কাছে কি হ্যাঁ?;

নামিরার চড়া গলায় আঁতকে উঠে বুক চেপে ধরলো আরব। পরক্ষণেই বুকে থু থু দিয়ে অসহায় গলায় বলল,

“আ্ আমি কি করলাম বলো? ওই তো…;

“একদম কথা বলবেন না আমার সাথে!;

বলেই হনহনিয়ে চলে গেলো নামিরা। আরব ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে হা করে দম ছাড়লো। পরক্ষণেই আওড়ালো,

“এতো পুরোই এটম বোম হয়ে আছে।;

_______

আজকেই ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের টেস্ট এক্সামের ফিস জমা দেওয়ার লাস্ট ডেট ছিলো তানির। বাসা থেকে তাড়াহুড়ো করে এসে কোনোমতে শেষ মুহুর্তে কাজটা সম্পূর্ণ করতে পারলো। তবে সেই কাজও শেষ হলো ঘন্টাখানেক হবে। আজকে আরবের সাথে ওরও আত্মীয় স্বজনদের বাসায় যাওয়ার কথা ছিলো বিয়ের কার্ড দিতে। তবে এই কাজের জন্যই যেতে পারেনি। এখন মনে হচ্ছে এদিকে না এসে ওদিকে গেলে অনেক বেশি শান্তি লাগতো। একেতো মাথার উপর চড়া রোদ আর দ্বিতীয় এই দুপুর বেলা একটা রিক্সাও ওর চোখে পড়ছেনা। মনে হচ্ছে আজ সমস্ত রিকসাওয়ালারা এক হয়ে অবরোধ করছে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির সামনে। বিরক্তিতে আবোলতাবোল চিন্তায় মাথা ভরে উঠছে ওর। কাকে ফোন করবে এখন? বাবা-বাবাই কাজে ব্যস্ত। আরব, শ্রাবণ দুই ভাই-ই বাইরে আছে নিজেদের কাজ নিয়ে। কেউ নেই যে, ওকে এসে নিয়ে যাবে এখান থেকে।

একটা কালো গাড়ি তানিকে পাশ কাটিয়ে যেতে তানি জোরে জোরে হাত নাড়াতে লাগলো। সঙ্গে সাহায্যের জন্য বারবার ডাকছেও। গাড়ির ড্রাইভার তানিকে লক্ষ করে পেছনের সীটে বসা মালিককে বলল,

“মেয়েটা গাড়ি থামাতে বলছে ছোট সাহেব। মনে হচ্ছে বিপদে পড়েছে কোনো!;

গাড়ির মালিক সচ্ছ কাচ থেকে বাইরে দৃষ্টিপাত করলো। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখে অকারণেই তার সমান্তরাল ভ্রু জুগল বক্ররেখায় কুঁচকে গেলো।

“গাড়ি থামান।;

ড্রাইভার গাড়ি থামালো। গাড়িটাকে থামতে দেখতে একপ্রকার দৌড়ে এলো তানি। ড্রাইভার গাড়ির কাচ নামালে তানির অসহায় গলার স্বর শোনা গেলো,

“আঙ্কেল আমাকে একটু হেল্প করুন না প্লিজ। দেড়ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি রিক্সার জন্য। কোনো রিক্সা পাচ্ছিনা। মাঝেমাঝে দুই একটা প্রাইভেট কার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু হেল্পের জন্য কেউই দাঁড়াচ্ছে না।;

“কি হয়েছে মামনি? কোথায় যাবে তুমি।;

ড্রাইভারের অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে গেলো তানি। ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে বলল,

“তিন নাম্বার সেক্টরে যাবো। ওখানেই আমার বাসা।;

“ছোট সাহেব?;

“উঠে আসতে বলুন!;

“উঠে আসো মামনি। আমি তোমাকে নামিয়ে দিবো।;

তানি দৌড়ে গেলো ওপাশে। গাড়ির দরজা খুলে চটজলদি উঠে পড়লো কোনোরূপ সংকোচ ছাড়া। যেন এটা ওদেরই গাড়ি। পেছনের সীটে গাড়ির মালিকের পাশে বসলেও কোনো সংকোচ দেখা গেলোনা ওর মাঝে। উঠে বসে গাড়ির দরজা লাগিয়ে ড্রাইভারকে বলল,

“চলুন আঙ্কেল।;

“তুমি!;

তানি আপন মনে গুনগুন করতে করতে ব্যাগ থেকে ফোন বের করলো। শূন্যে দৃষ্টি ভাসিয়ে এয়ারপডের হদিস চালালো আন্দাজে। গান শুনতে শুনতে বাড়ি যাবে। ঠিক তখন পাশ থেকে একটা ক্ষোভ মিশ্রিত গলা শুনতে পেলো তানি। তড়িঘড়ি পাশ ফিরে তাকাতেই আঁতকে উঠলো লোকটাকে দেখে। ভয় জড়ানো গলায় বলল,

“আ্ আপনি এখানে কেন?;

________

বাড়ি ফিরে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ইশা। শরীরের অবস্থা আজ একটু বেশিই খারাপ বলে মনে হচ্ছে। নিজের রুমে যেতেও বেশ বেগ পেতে হলো ওকে। কোনোমতে নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ফোনটা বেজে উঠলো। শ্রাবণের কল। উফফ, এক ঘরে থেকে কেউ কল দেয়?

“হ্যাঁ বলো?;

“আমার রুমে আয়।;

“এখন আবার?; (ক্লান্ত স্বরে)

“কি হয়েছে, গলাটা এমন লাগছে কেন?;

“জানিনা। মনে হচ্ছে নাড়িভুড়ি সব জ্বলে যাচ্ছে।;

শ্রাবণের কলটা কেটে গেলো। ইশা আর তাকাতে পারলোনা ফোনের স্ক্রিনে। ফোনটা হাত থেকে ফেলে দু’হাতে পেট চেপে ধরলো। অবস্থা বেগতিক। ক্রমেই পেটে ভ*য়ানক ব্যাথার উপক্রম বাড়ছে।

“ইশা!;

দৌড়ে এলো শ্রাবণ। ইশা তখন তাকানোর অবস্থায় নেই। পেট চেপে ভাজ হয়ে রইলো।

“কি হলো হঠাৎ?;

“আ্ আমার পেট!;

তীব্র ব্যাথায় যেন নড়তে পারছেনা ইশা। গোঙাতে লাগলো। শ্রাবণ আতংকিত হয়ে বারবার তাকাতে লাগলো ওর পানে। হঠাৎ এমন হওয়ার তো কথা নয়। ডাক্তার তো বলেছিলেন অবস্থার উন্নতি ঘটবে আস্তে আস্তে। তবে এখনও কেন এমন ব্যাথা বা জ্বলা ভাব আসবে? কিছুই বুঝতে পারছেনা শ্রাবণ। ইশা গোঙাতে গোঙাতে হঠাৎ চিৎকার করতে লাগলো। ব্যাথা আর জ্বলা ভাবটা মাত্রাতিরিক্ত হচ্ছে। চিৎকার করতে করতে খামচে ধরছে পেট।

নীচ থেকে একগাদা মানুষ দোতলায় ছুটে এলো ইশার চিৎকার শুনে। আফিয়া বেগম, মরিয়ম বিবি, নুপুর বেগম সব হন্নে হ’য়ে ছুটে এলেন ইশার ঘরে। ইশাকে এভাবে ছটফট করতে দেখে সবার মাঝেই বিরাজ করলো আতংক। শ্রাবণ আর কোনো রিস্ক নিতে চাইলোনা। পাজা কোলে তুলে নিলো ইশাকে। অতঃপর দ্রুত ছুটলো হসপিটালে।

#চলবে

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_____২৮.

তানির আতংকে ঘেরা নেত্রদ্বয় মুহুর্তেই কুঞ্চিত হলো। ওর মনে পড়ছে সেদিনের ঘটনাটি। মিষ্টি পাগলি তানি খোরশেদ সাহেবদের বাড়ি গিয়েও মিষ্টি খেতে ছাড়েনি। এদিকে যে তার ভাই বিয়ে ভেঙে চলে গেছে সে খবর আর তার ছিলোনা।

প্রায় চারটা মিষ্টি একসাথে মুখে পুড়লো তানি। এখন না পারছে গিলতে না পারছে কথা বলতে। ঠিক তখনই এক অপরিচিত ছেলে পথ আঁটকে দাঁড়ায় তানির।

“হোয়াট দ্যা.. এক্সকিউজ মি? কে আপনি?;

তানি গোলগাল চোখ পাকিয়ে তাকায়। ওর দেখাদেখি ছেলেটাও চোখ জোড়া ডিম্বাকৃতির ন্যায় করে ফেলে। এটাকে বলে সঙ্গ দোষ। তানি মুখে কিছু বলতে পারেনা, তাই চোখ আর হাতের বোঝাতে চেষ্টা করে।

“আপনি কে?; (চোখের ইশারায়)

ছেলেটা আর কেউনা, নিলাশার ভাই আরাফ। নিলাশাকে সবার মাঝে বসিয়ে দিয়ে নিজের রুমে যাচ্ছিলো একটা কাজে। আর যাওয়ার পথেই দেখা হয় এই মেয়েটার সাথে। এভাবে পাগলের মতো করে মিষ্টি কে খায়?

আরাফ চোখ জোড়া কুঁচকে তাকায়। তানির প্রশ্ন সে বোঝেনি। তাই প্রশ্নবিদ্ধ মুখ করে এখনও চেয়ে আছে ওর পানে।

“কি এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? চোখ দিয়ে গিলে খাবেন নাকি?; (চোখ আর হাতের ইশারায়)

পূণরায় তানির চোখ আর হাতের ইশারায় করা প্রশ্ন আরাফের শান্ত স্বভাব গুরুগম্ভীর করে দিলো। আরাফ রাগান্বিত হয়ে তানির হাত চেপে ধরে বলল,

“এসো আমার সাথে!;

তানি ভড়কে গেলো আরাফের কান্ডে। সাথে ভীষণ রেগেও গেলো এই অপরিচিত ছেলেটা ওর হাত ধরে টানার জন্য। আরাফ ওকে টেনে নিয়ে বেসিনের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল,

“মুখে যা আছে ফেলে দাও। জলদি!;

তানির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আরাফকে এই মুহুর্তে ওর মানুষ বলেই মনে হচ্ছে না। এমন অমানুষ হয় কেউ?

তানির এভাবে তাকানো দেখে আরাফ বির-ক্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। অতঃপর আশেপাশে একবার তাকিয়ে যা ভাবলো সেটাই করলো। হঠাৎ তানির গাল চেপে ধরে মাথাটা নুইয়ে দিলো বেসিনের সামনে। আর এতোই জোরে ধরলো যে তানি মিষ্টি গুলো না পারছে গিলতে, আর না পারছে ফেলতে। তবে গেলার চেয়ে ফেলে দেওয়াটাই বেশি সহজ ছিলো। তাই বাধ্য হয়ে ফেলে দিলো মিষ্টি গুলো। তানি মিষ্টি গুলো ফেলতেই আরাফ ওকে ছেড়ে দেয়। রাগে তানির শ্যামবর্ণ চেহারা কালচে ভাব এনে দেয় ওর মুখে। আরাফকে এই মুহূর্তে গিলে খেয়ে নিলেও ওর এই রাগ পরবেনা। কিছুতেই না। মিষ্টি নিয়ে এতো অন্যায় তো ওর মাও ওর সাথে করেনা। কিন্তু এই অসভ্য ছেলেটা.. এরচেয়ে ভালো ওর অর্ধেক কলিজা দাবী করতো ছেলেটা। ও খুশি হয়ে সেটাও দিয়ে দিতো।

“পুরো কথা শুনতে না পারলে আমার এনজাইটি লেভেল তরতর করে বাড়তে থাকে! সরি ফর ডুয়িং দিস!;

তানি ফোঁস ফোঁস করছে রাগে। আরাফের ওসবে কোনো লেনদেন নেই। সে পূণরায় শান্ত প্রতিমায় রূপান্তরিত হয়ে নরম গলায় শুধালো,

“তুমি শ্রাবণ ভাইয়ের কাজিন?;

মাথার তারটা আর আস্ত নেই তানির। কথা নেই, বার্তা নেই ঠাসস করে একটা চড় মে*রে বসলো আরাফকে। এতোবড় ছেলের গায়ে সে হাত তুলবে, এটা পাঁচ মিনিট আগেও কল্পনা করেনি। চড় খেয়ে আরাফ স্তব্ধ হয়ে গেলো। কি বলবে বা কি করবে, কোনোটাই আর মাথায় ধরলোনা তার।

তানি হনহনিয়ে চলে গেলো। আরাফ স্রেফ গালে হাত চেপে শূন্য অনভূতি নিয়ে ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। ক্ষণেই তানি আবার ফিরে এলো। তানিকে রাগান্বিত অবস্থায় রণচণ্ডীর চেয়ে কম কিছু লাগছেনা। আরাফ ভড়কে গেলো ওর ফিরে আসা দেখে। তানি এসে তার সামনে দাঁড়াতেই এক পা পিছিয়ে গেলো সে। তানি বেসিনের দিকে তাকালো ফোঁস ফোঁস করে। ইচ্ছে করছে এই লোকটাকে মে/রে ফেলতে। কিন্তু যাদের বাসায় এসে মিষ্টি খেলো, তাদের বাসার কাউকে মে/রে ফেললে ব্যাপারটা জঘন্য হয়ে যাবে। কাল নিউজে হেডলাইন হবে, ‘আত্মীয়কে মিষ্টি খেতে না দেওয়ার অপরাধে খু*ন হলো এক যুবক!’ ছ্যা, বোকা বোকা হেডলাইন।

“তোদের মিষ্টি তোরা খা!;

কথাটা বলেই মুখ ঝামটি দিয়ে আবার চলে গেলো তানি। আরাফ চকিতে তাকিয়ে ফের এক পা পিছিয়ে গেলো। কেননা, সে এখনও বাকরূদ্ধ। এখনও স্তব্ধ, আতংকিত।

“আপনি আমাকে মিষ্টি খেতে দেননি তাই, আমি রাগ সামলাতে পারিনি। এতে আমার তো কোনো দোষ আমি দেখছিনা।;

প্রথমে ভয় পেলেও পুরো ঘটনাটি একবার ঝালাই করতে যেয়ে মনে হলো এখানে ওর ভয় পাওয়ার কোনো কারনই নেই।

আরাফ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে তানির অগোচরে গালে হাত ডললো। অর্থাৎ সেও ঘটনাটি পুনরায় ভাবতে গিয়ে চড় খাওয়ার একই অনুভূতি অনুভব করলো।

“অভদ্র মেয়ে!;

দাঁতে দাঁত চেপে আস্তে করে বলল আরাফ। তানি মুখ ভেঙচি দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো।

__________

“কোনো সিরিয়াস ইস্যুজ তো নয় ডক্টর?;

ইশার পালসরেট চেক করছেন ডক্টর। শ্রাবণ অস্থির গলায় ইশার অবস্থা জিজ্ঞেস করলে ডাক্তার গম্ভীর মুখে তাকান। কিছু না বলে শ্রাবণকে তার চেম্বারে আসতে বলে চলে যান। শ্রাবণ সময় ব্যায় না করে তার পিছুপিছু গিয়ে চেম্বারে ঢোকে। ডাক্তার সাহেব চেয়ার টেনে বসে খানিক বিরক্তি নিয়ে বলেন,

“ইশানি এখনও পুরোপুরি সুস্থ হয়নি শ্রাবণ। তোমরা একথা এতো জলদি কি করে ভুলে গেলে?;

শ্রাবণ অবাক হওয়ার প্রচেষ্টা চালালো। বাড়ির মানুষ গুলো ইশার অসুস্থতাকে অবজ্ঞা তো দূরে থাক এক মুহুর্তের জন্যও ভোলেনি। তাহলে ডাক্তারের এমন উক্তির মানে কি?

“ম্ মানে!;

“আমি তোমাকে স্পেশালি ডেকে নিয়ে বলেছিলাম ওর খাবারের রুটিনটা। ৬মাস প্রয়োজন নেই, এটলিস্ট ১মাস রুটিন ফলো করো। কিন্তু সেটাও তোমরা পারলেনা। হোয়াটএভার, ওর পেটে ঘা জাতীয় কিছু দেখা গিয়েছে। আমি ঔষধ দিচ্ছি। ঔষধ গুলো নিয়মিত করবে, সাথে পাতলা লিকুইড খাবার দিতে থাকবে।;

শ্রাবণের মাথায় ধরছেনা। যেখানে ওকে প্রতিদিনই স্যুপ বা এ জাতীয় লিকুইড খাবার দেয়া হচ্ছে সেখানে ডক্টরের এ কথার মানে কি! আজ সকালেও তো মা ওকে স্যুপ দিয়ে.. ভাবতে গিয়েও থামতে হলো শ্রাবণকে। মা আর ইশার কানে কানে কথা বলার দৃশ্যটা মনে আছে তার। আচ্ছা, তখন কি কোনোভাবে উল্টাপাল্টা খেয়েছে ও? হ্যাঁ! সে ঠিকই ভাবছে। সকালে তার সন্দিহান দৃষ্টি মোটেই ভুল ছিলোনা। সে ঠিকই সন্দেন করেছিলো।

ইশাকে ইনজেকশন দিয়ে ওর পেটের ব্যাথা কমাতে হয়েছিলো ডাক্তারকে। এখন ও মোটামুটি সুস্থ বোধ করছে। এতক্ষণ যাবত মা আর মামির সাথে কেবিনেই রয়েছে। শ্রাবণ ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গিয়েছে। কথা শেষ করে ফিরে এলেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হবে তারা।

দরজা ঠেলে কেবিনে ঢুকলো শ্রাবণ। বিছানায় অর্ধমৃ/ত চেহারা নিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে ইশা। পাশে মা আর মনি। ভেতরে ভেতরে তীব্র রাগ চেপে রেখেছে সে। আজকের সকালে ইশার খাবারটাই ওর জন্য পূণরায় ম*র*ন ব্যাধি তৈরি করেছে। এই মেয়েটা কি কখনও নিজের ভালো বুঝবেনা?

“ডাক্তার কি বললো রে বাবা?;

মরিয়ম বিবি উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলেন। শ্রাবণ হাতের প্রেসক্রিপশনটা নেড়েচেড়ে দেখছিলো। মনির প্রশ্নে নত মস্তিষ্কেই জবাব দিলো,

“ঔষধ দিলেন। বললেন ঠিক হয়ে যাবে।;

“সিরিয়াস কোনো সমস্যা হয়নি তো?;

উদগ্রীব গলা জিজ্ঞেস করলেন আফিয়া বেগমও। শ্রাবণ ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

“না মা। নাথিং সিরিয়াস।;

আত্মতৃপ্তি পেলেন তারা দু’জনেই। যেভাবে মেয়েটা ব্যাথায় চিৎকার করছিলো তাতে, সবাই ভেবেছিলো অস্বাভাবিক কিছু ঘটতে চলেছে।

“তোমরা ওকে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসো মা। আমি ঔষধ গুলো নিয়ে আসছি।;

এই বলে আবারও বেরিয়ে গেলো শ্রাবণ। ইশা তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো। শ্রাবণ একটা বারও ওর দিকে দেখলো না! কেন? আর তার মুখটাও কেমন অস্বাভাবিক লাগছে যেন। কি হয়েছে শ্রাবণের?

ইশাকে নিয়ে গাড়িতে বসালো আফিয়া বেগম। ওকে মাঝে বসিয়ে দুই মা দু’পাশে বসবেন। মরিয়ম বসার পূর্বেই আফিয়া বেগম উঠে এলেন। শ্রাবণকে দেখা গেলো সামনের ফার্মেসীতে। ঔষধ কিনছে। মরিয়ম বিবি আর না উঠে শ্রাবণের কাছে চলে গেলেন। ইশা সেদিকে স্থীর দৃষ্টি রেখে মামির উদ্দেশ্যে বলল,

“মামি, তোমার কি সবকিছু স্বাভাবিক লাগছে?;

“কেন রে?;

“শ্রাবণের ভাইয়ের মুখটা একটু অন্যরকম লাগছেনা?;

ইশার দৃষ্টি অনুসরণ করে আফিয়া বেগমও তাকালো ছেলের পানে। কিছু একটা ভেবে উনি মুচকি হাসলেন। ইশার দিকে তাকিয়ে ওর মাথায় হাত রেখে বললেন,

“মানুষ যখন ভালোবাসার কাছে অসহায় হয়ে পড়ে, তখন এমনই হয় জানিস তো! তুই তো দেখিসনি, তুই অসুস্থ হয়ে পড়ার সাথে সাথে কেমন পাগলের মতো করেছে আমার ছেলেটা। শুধু আজই নয়! সেদিন যখন তোকে মৃ*তপ্রায় অবস্থায় হসপিটালে নিয়ে এলো, পাগলের মতো চিৎকার করেছে হসপিটালের করিডোরে। আশেপাশের মানুষ গুলো কেমন ফ্যালফ্যাল করে দেখছিলো ওকে।;

ইশার মন অন্যদিকে ঘুরে গেলো মামির কথাগুলোয়। ওর নিজেকে ভীষণ লাকি মনে হয়। এই যে, শ্রাবণের মতো এমন একজন মানুষ পেয়েছে ওকে পাগলের মতো ভালোবাসার জন্য।

ঔষধের সাথে ইশার জন্য আলাদা করে কয়েকটা জুস কিনে আনলো শ্রাবণ। ক্লান্ত শরীরে এনার্জি দিবে একটু হলেও।

“মা, এগুলো ওকে দাও।;

মায়ের পাশেই ইশা বসে আছে। অথচ ইশার দিকে না তাকিয়েই মায়ের হাতে জুস গুলো ধরিয়ে দিয়ে ড্রাইভিং সীটে গিয়ে বসলো শ্রাবণ। ইশার পূণরায় কেমন সন্দেহ জাগলো শ্রাবণের আচরণে। না, মামির ধারনা ভুল। কেবল ওর অসুস্থতার জন্যই শ্রাবণের চোখমুখ এমন হয়নি। নিশ্চয়ই সবার অগোচরে কিছু ঘটেছে যেটা শ্রাবণ জানলেও আর কেউ জানেনা।

বাসায় পৌঁছাতে সন্ধ্যা হলো তাদের। বাসায় ফিরতেই সামনাসামনি পড়লেন হামজা সাহেব এবং তার বউ শাহনাজ বেগমের। অর্থাৎ ইশার বড় চাচা এবং বড় চাচী। সকাল থেকে বাইরে থাকার ক্লান্তি আবার বাসায় ফিরতেই ঘন্টা তিনিকের জন্য হসপিটালে এডমিট সব মিলিয়ে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে ইশাকে। চোখ জোড়া গর্ত খুঁড়ে ঢুকে পড়েছে তার ভেতরে। শুকনো শরীরটা কোনো কঙ্কালের চেয়ে কম লাগছেনা।

“ইশানি?;

শাহনাজ বেগমের গলা পেতেই চোখ জোড়া বড়বড় করে সম্মুখে তাকালো ইশা। চকিতে দেখছে শাহনাজ বেগমকে। আনন্দে নিজের অবস্থার কথা ভুলে দৌড়ে যেতে নিলে তিনি হাত উঠিয়ে ওকে থামতে বলেন। তারপর নিজেই একরকম ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেন।

“সোনা মা, লক্ষিমা আমার।

“মামনি। কত বছর পর তোমাকে দেখলাম।;

“হ্যাঁ রে, কত গুলো বছর!(কান্না জড়ানো গলায়) একি হাল করলি মা নিজের? এতো অযত্ন!;

সোজা হয়ে দাঁড়ালো ইশা। শাহনাজ বেগমের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল,

“তোমার মনে হয় এই মানুষগুলোর কাছে থেকে নিজের অযত্ন করার কোনো সুযোগ পাই আমি!;

“(হেসে) পাগলি আমার।;

“ভাবি, কেমন আছো তোমরা?;

মরিয়ম বিবি এগিয়ে এলো। শাহনাজ বেগম স্মিত হেসে জড়িয়ে ধরলেন মরিয়ম বিবিকে।

“তোদের ছাড়া আর কেমন থাকবো?;

ইশা ধীর পায়ে চলে গেলো হামজা সাহেবের দিকে। মায়ের কাছে শুনেছে বড্ড কড়া ধাঁচের মানুষ ছিলেন হামজা সাহেব। কিন্তু জাফর সাহেব অর্থাৎ ইশার বাবার মৃ/ত্যু/র পর একদমই ভেঙে পড়েন হামজা সাহেব। ভাইয়ের অকাল মৃ/ত্যু একদম ভেঙে দিয়েছিলেন মানুষটাকে। হামজা সাহেবকে প্রায় অনেকটাই জাফর সাহেবের মতো দেখতে। কোমল চাহনিতে মৃদু হাস্য মুখে খান সাহেবের সঙ্গে কথা বলছেন। ইশাকে লক্ষ করেননি একদম।

“চাচ্চু?;

পেছন থেকে কাঁপা কাঁপা গলায় ভেসে এলো কারোর ডাক। হামজা সাহেব কথা থামিয়ে দিয়ে পেছনে তাকালেন। ইশা চমকে উঠলো। এই তো সেই চোখ, সেই মুখ, সেই নাক। একদম বাবার মতো!

হামজা সাহেব দাঁড়িয়ে গেলেন। ইশার শরীর ভেঙে আসতে চাইলো। কোনো মতে সোফা ধরে দাঁড়াতে দৌড়ে এলো শ্রাবণ। পাশ থেকে আরও দুই জোড়া হাত ইশাকে ধরে ফেললো। এক হামজা সাহেব, দুই হিমাদ্র। হামজা সাহেবের ছেলে। শ্রাবণ আর নাগাল পেলোনা ইশার। তারাই ইশাকে ধরে বসালো সোফায়। হিমাদ্র ইশাকে পানি এগিয়ে দিলে ইশা এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ে। অর্থাৎ খাবেনা সে। হামজা সাহেব ইশার পাশে বসলে ইশা কিছু না বলে জড়িয়ে ধরে তাকে। ডুকরে কেঁদে উঠে সবার বুক কাঁপিয়ে অবুঝ মনেই হামজা সাহেবকে বাবা বলে ডেকে ওঠে।

সবাই স্তব্ধ হয়ে যায় ইশার ডাকে। ইশা কাঁদতে শুরু করেছে। ওর এই শারীরিক অবস্থায় এভাবে কাঁদাটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। শ্রাবণ ওকে কিছু বলতে নিলে হঠাৎ শোনা গেলো হিমাদ্রর বিষন্ন গলার স্বর,

“ইশুপাখি!;

থমকে গেলো শ্রাবণ। বুকের ভেতরটায় কেউ কুৎসিত ভাবে খামচে ধরলো যেন। দম ফুরিয়ে এলো তার। র*ক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে হিমাদ্রর এই ডাকে।

“কাঁদছিস কেন? আমরা সবাই তো আছি!;

পূণরায় যেন কেউ অ/স্ত্র চালালো শ্রাবণের বক্ষঃস্থলে। সে সহ্য করতে পারছেনা হিমাদ্রর কথাগুলো। এগুলো তো তার কথা, হিমাদ্র কেন বলছে?

“বাবাকে মনে পড়ছে?;

হিমাদ্রর একের পর এক বানীতে ইশার কান্না থামলোনা। হামজা সাহেবের বুকে পড়ে একই ভাবে চোখের জল বিসর্জন দিয়ে গেলো। হামজা সাহেব খুব করে বুঝালেন ইশাকে। কিন্তু তারপরও, বাবার স্মৃতি আজ বড্ড পীড়া দিচ্ছে ওকে। আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতো? শুধু এই একটা আক্ষেপেই বুকটা ফেটে যাচ্ছে ওর।

“কাঁদিস না। এই শ্রাবণ আছে তো তার ইশুপাখির জন্য? হু?;

গালে শ্রাবণের স্পর্শ পেতে কান্নার দমক কমে এলো ইশার। বাচ্চাদের ন্যায় ঠোঁট ফুলিয়ে চেয়ে আছে শ্রাবণের পানে। শ্রাবণ ওর পায়ের কাছে হাঁটু ভাজ করে বসলো। ফের দু’গাল উঁচিয়ে ধরে কোমল গলায় কথাটা বলতেই ইশা শান্ত হয়ে গেলো। সবাই দেখলো, আর হাসলোও মনে মনে। ভালোবাসার টান, ভালোবাসার জোর হয়তো একেই বলে।

“আরও কান্না পাচ্ছে? আরও কাঁদতে হবে?;

ইশা এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ে। শ্রাবণ মুচকি হাসে। ইশার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলে,

“কাঁদিস না প্লিজ, তুই কাঁদলে আমার বক্ষঃস্থলে তীব্র হাহাকার জমে যায়। তখন কিন্তু আমারও কান্না পায়।;

শ্রাবণের কথায় সবাই শব্দ করে হেসে উঠলো। তবে ইশা লজ্জায় অস্থির হয়ে উঠলো। একঘর লোকের সামনে ওর কান্না থামাতে মানুষটার এভাবে লজ্জা দিয়ে কথা বলতে হলো?

শ্রাবণ এসে ইশার কান্না থামাতে নিলে হিমাদ্রর ভেতরটা কেমন জ্ব*লেপুড়ে উঠলো। আজ যদি সব ঠিক থাকতো, তবে ইশা শ্রাবণের নয়, তার ঘরের বউ হতো।

#চলবে

#ডাকপিয়নের_ছুটি_নেই 🌼
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_______২৯.

সন্ধ্যা সাতটা। আজকের মতো কার্ড বিলি করা এখানেই শেষ। আরব গাড়ি ঘোরালো নামিরার বাড়ির পথে। একদমই ইচ্ছে করছেনা ওকে ছাড়তে, কিন্তু ওর মায়ের কথা ভেবে আবার সাহস করে বলতেও পারছেনা আজকে ওদের সাথেই যেতে।

“নামিরা আপু, তুমি ইশা আপুর বেস্ট ফ্রেন্ড তাইনা?;

হৃদিমাকে এবার পেছনের সীটে বসিয়েছে আরব। বাহানা দিয়েছে ওর সীটবেল্ট বাঁধতে না পারার ব্যাপারটা। ওটা হৃদিমা ইচ্ছেকৃত ভাবে করেছে যেন সাহায্যের খাতিরে আরবকে বারবার কাছ থেকে দেখতে পারে। নামিরা ঠিকই বুঝেছিলো। কিন্তু আরব প্রথমে এতো গভীরে ভাবতে পারেনি। হৃদিমাকে নিতান্তই সে তানির মতো ভাবে। সেখানে হৃদিমা এতোটা গভীরে ভেবে বসে আছে সেকথা আরবের ঘটে ঢুকতে বেশ সময় নিয়েছে।

“হ্যাঁ।; জবাব দিলো নামিরা।

“তোমার বয়ফ্রেন্ড নেই?;

হৃদিমার কৌতুহলী গলায় নামিরার রাগ আরও তরতর করে বাড়ছে। একবার ইচ্ছে করছে বলে দিতে, আমার বয়ফ্রেন্ড আমার পাশেই বসে আছে। কিন্তু বলতে পারছেনা। হৃদিমা শ্রাবণ ভাইয়ের মামাতো বোন। কোনোভাবে এই মুহুর্তে আরব আর ওর ব্যাপারটা সবার সামনে না আসাটাই ভালো। আনতে চায়না এমনটা নয়, কিন্তু কোনোভাবে এই মেয়েটার মাধ্যমে কেউ না জানুক সেটাই চায় নামিরা। তাই মনের কথাটা মনে রেখেই প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লো। নামিরার ভাবা ও দীর্ঘশ্বাসের মাঝের সময়টুকুও সবুর করলো না হৃদিমা। আরও একবার একই কথা জিজ্ঞেস করলো। যার ফলে নামিরা জোরপূর্বক হেসে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“না, নেই!;

আরব শকড হয়ে গেলো নামিরার এমন জবাবে। নাই মানে? তার নামটা না বলুক, কিন্তু বয়ফ্রেন্ড যে একেবারেই নেই সে কথা কেন বললো?

হৃদিমার মুখের ভঙ্গিমা সামনে থেকে ঠিক বুঝতে পারা গেলোনা। আবর নামিরার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে আছে। নামিরা সেদিকে তাকাচ্ছেও না। যেন, আরবের শকিং ফেস নিয়ে ওর কোনো মাথা ব্যাথাই নেই।

“কি বলো আপু? তুমি এতো সুন্দর একটা মেয়ে, তোমার বয়ফ্রেন্ড নেই! ভেরি স্যাড।;

নামিরার মেজাজ প্রথম থেকেই খারাপ। আর তার কারনটাও এই মেয়েটাই। আবার গরম মেজাজের উপর এই মেয়েটাই ঘি ঢালছে, এবার একটা চামাট মার্কা জবাব না দিলে একদমই চলবেনা।

“তোমার মতো বয়সে সময়টা পড়ালেখার পেছনে ব্যায় না করে যদি রূপচর্চায় দিতাম, তাহলে আজ নিশ্চয়ই আমার একটা বয়ফ্রেন্ড থাকতো। কি আরব ভাইয়া? ঠিক বলেছি না?;

হৃদিমার মুখটা বুঝি ফাটা বেলুনের ন্যায় চুপসে গেলো। আরব খুকখুক করে কেশে উঠলো। বিষম লেগেছে নির্ঘাত। পেছন থেকে হৃদিমা আঁতকে উঠলো।

“কি হলো, কি হলো? আরে আরব ভাইয়াকে পানি দাও! নামিরা আপু, কোথায় চেয়ে আছো। ডেস্ক থেকে পানিটা বের করে দাও!;

নামিরার শরীর জ্বলে উঠলো। হঠাৎ রাগান্বিত গলায় বেশ জোরেশোরেই বলে উঠলো নামিরা,

“গাড়ি থামান।;

আরব চমকে উঠে গাড়ি থামালো। আতংকিত গলায় শুধালো,

“ক্ কি হলো?;

“আমার বাসা এসে গেছে!;

আর কিছু বললো না নামিরা। গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। আরব পড়েছে মহাবিপদে। কিছু বলতেও পারছেনা, কিছু করতেও পারছেনা। নামিরা দ্রুত হেঁটে চলে যাচ্ছে বাসার দিকে।

“তোমরা ওয়েট করো, আমি আসছি।;

এই বলে আবরও বের হয়ে গেলো। নামিরা আর পেছন মুড়ে দেখলো না একবারও। আবর বলেছিলো কালও কার্ড দিতে যেতে হবে। যদি এই মেয়ে কালও ওদের সাথে যায়, তবে ম/রে গেলেও বের হবেনা।

“নামিরা, দাঁড়াও। প্লিজ দাঁড়াও।;

পেছন থেকে আরবের গলা পেলে নামিরা আরও জোরে জোরে হাঁটা ধরে। আরব হেঁটে পারেনা ওর সাথে। তাই পিছু আসতে আসতে নামিরার বাসায় পৌঁছে যায়।

আরবের মুখের উপর দরজাটা লাগাতে আরব বাইরে থেকে ঠেলে ধরে। নামিরা রাগ মিশ্রিত গলায় বলে,

“কি সমস্যা?;

“আমাকে একবার বায় না বলেই চলে এলে!;

“বায়। হয়েছে? এবার যান!;

“আ্ আমার কথাটা তো শোনো জান!;

“জাস্ট শাটআপ! ডোন্ট কল মি জান।;

“পাখি? প্ পাখি তো ডাকতে পারি?;

“কেন, আমি কি জঙ্গলে থাকি?;

তেতে উঠলো নামিরা। আরব অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো। আর কি বলবে? নামিরা যে সব কথাতেই রেগে যাচ্ছে।

“জান, প্লিজ..;

“নো! যান না আপনার ঐ ন্যাকা ষষ্ঠীর কাছে। আরব ভাইয়া, সীটবেল্টটা বেঁধে দাওনা, আরব ভাইয়া সীটবেল্টটা খুলে দাওনা!;(ব্যাঙ্গ করে)

আরব কপাল চাপড়ালো। সত্যিই ভীষণ রেগে গেছে নামিরা। যদিও রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে এসব ভেবে লাভ নেই। এখন এই রাগ কিভাবে পরবে, সেটা ভাবতে হবে। তাই সাহস করে দরজার ফাঁক থেকে হাত বাড়িয়ে নামিরার হাতটা ধরলো আরব। নামিরা বি-স্ফো*রিত দৃষ্টিতে তাকালো। এই চোখ দিয়েই ভ-স্ম করে দিবে আরবকে।

“কে এলো?;

ঘরের ভেতর থেকে নামিরার মায়ের গলা ভেসে উঠলো। যা শুনতে ভয়ে আপনাআপনিই আরবের হাত আলগা হয়ে এলো। কিন্তু তারপরও ছাড়লোনা। শক্ত করে ধরে রাখলো। ভেতর থেকে আবারও নামিরার মায়ের গলা,

“নামু এলি?;

গলাটা এবার কাছ থেকেই শোনা গেলো। অর্থাৎ তিনি এদিকেই আসছেন। নামিরার রাগ এবার আড়াল হলো। বরং ভয়টাই বেশি হানা দিচ্ছে মনের মাঝে। আরব এভাবে হাত ধরে আর তার মা এদিকেই আসছে!

“কি হচ্ছেটা কি? হাত ছাড়ুন। মা আসছে কিন্তু!;

“তোমার সাথে আমার কথা শেষ হয়নি। আমাকে ভেতরে আসতে দাও।;

“একদমই না। হাত ছাড়ুন!;( বিরক্তির গলায়)

“আরব নাকি রে?;

পূণরায় নামিরার মায়ের গলা ভেসে এলো। তবে এবার একদম কানের পাশ থেকে। নামিরা চমকে উঠলো। আরবও চমকালো, তবে নাছোড়বান্দার মতো এখনও শক্ত করে নামিরার হাতটা ধরে রইলো।

“হ্ হ্যাঁ মা! আ্ আরব! ম্ মানে আরব ভাইয়া। ভাইয়া ভেতরে আসুন না। কতবার করে বললাম।;

আরব নামিরার হাত ছেড়ে দিলো। যাক একটা ডোজে তো কাজ হলো। নামিরা পাশে সরে যেতে আরব ভেতরে ঢুকলো। নমিরার মা বেজায় খুশি হলেন আরবকে দেখে। নামিরাকে যেভাবে নিয়ে গেলো আবার সেভাবেই বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেলো। এমন ছেলে কোথায় মিলবে।

“আহারে, এক বেলাতেই চোখমুখ একদম শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। বসো বাবা বসো। আমি তোমার জন্য একটু কিছু খাবার নিয়ে আসি।;

“না মা, উনি বাইরে থেকে খেয়েছেন। এখন বাসায় যাবেন। তাড়া আছে নাকি! তাইনা?;(আরবের পানে তাকিয়ে)

“না না আন্টি। বিশেষ তাড়া নেই। আপনি আমাকে একটু পানি দিতে পারেন। গলাটা একদমই শুকিয়ে গেছে।; বলল আরব।

নামিরার মা পানি আনতে চলে গেলেন। নামিরা রাগি চোখে তাকালো আরবের পানে। আরব দাঁত কেলিয়ে হেসে এগিয়ে এলো নামিরার কাছে। নামিরা পেছনে সরে যেতে নিলে আরব ওর কোমর পেঁচিয়ে নিয়ে আসে কাছে। পরক্ষনেই একহাতে কান ধরে অসহায় গলায় বলে,

“আ’ইম রিয়েলি সরি।;

“ক্ কি করছেন, মা এসে পড়বে।;

“প্লিজ মাফ করে দাও?;

“হ্ হ্যাঁ মাফ করে দিয়েছি। ছাড়ুন এবার।;

আবর নামিরাকে ছাড়বে বলেও ছাড়লোনা। নামিরার মাথার পেছনে হাত দিয়ে তাকে আরও কাছে টেনে এনে গভীর স্পর্শ করলো নামিরার ওষ্ঠদ্বয়ে। নামিরা কেঁপে উঠলো শিহরণে। ওর রাগ, অভিমান এক নিমিষেই গলে জল হয়ে গেলো। আরব আরেকটু গভীর হতো যদিনা নামিরার মায়ের আসার শব্দ পেতো। সঙ্গে সঙ্গে নামিরাকে ছেড়ে দিয়ে ভদ্র শান্ত ছেলের মতো চুপটি করে সোফার উপর বসলো।

____________

হামজা সাহেবের সাথে রাত ১টা অব্দি আড্ডা দিয়েছে ইশা। কত মজার মজার গল্প করেছে তার সাথে। হামজা সাহেবও কম যাননা। ক্ষণে ক্ষণে ইশাকে হাসাতে হাসাতে অস্থির করে তুলেছেন। বাচ্চাদের ন্যায় খিলখিলিয়ে হেসেছে ইশা। কত আনন্দ এবং উপভোগ্যকর মুহুর্ত ছিলো। মাত্রই রুমে এলো মায়ের সঙ্গে। মরিয়ম বিবি ওকে শুয়ে দিয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে চলে গেলেন। মাথার কাছে জ্বলছে লাল রঙের একটা ড্রিম লাইট। লালচে আলোতে বারবার কেবল ইশার চোখ পড়ছে বিছানার পাশে ছোট্ট টি-টেবিলটার উপর। ওর ডাকবাক্সটি বারবার জ্বলে উঠছে যেন। ইশার মন লাফিয়ে উঠলো এই ভেবে যে, চিঠি এলো নাকি? ভাবতে দেরী হলেও হাত বাড়িয়ে ডাকবাক্সটি এনে কোলে চড়াতে দেরী নেই। ঠিক তখনই চেঁচাল টিয়াপাখিটা।

“ইশুপাখি চিঠি এসেছে, ইশুপাখি চিঠি এসেছে।;

ইশা আনন্দে হেসে উঠলো। চটজলদি ডাকবাক্সের তালা খুলেতেই একটা খাম বেরিয়ে এলো। বাবাহ, চিঠি পাঠানোর কি ঘটা। ভেবে লজ্জা মিশ্রিত হাসলো ইশা। ফের চিঠিটা তুলে ডাকবাক্সটি পুনরায় টি-টেবিলে রেখে চিঠিটা খুললো। ভেতরে ছোট্ট একটা চিরকুট। এতো বড় খাম অথচ এক রত্তি চিঠি। এটা ভারী অন্যায় হলো।

❝তুমি দেখনি আমার শুন্যতায় ডুবে থাকা হাহাকার❞

চিরকুটটা মেলে ধরতেই একলাইনের লেখাটি ভেসে উঠলো অক্ষিপটে। ইশার ভ্রু জুগল কুঁচকে গেলো। ভাবুক হয়ে চিরকুটটা উল্টে ধরতেই আরও এক লাইন লেখা চোখে পড়লো,

❝আজ যা হলো,তা যেন আর কখনও রিপিট না হয়, ইশুপাখি! নয়তো আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবেনা❞

ইশার বুকটা ধক করে উঠলো। শ্রাবণ এ কিসের কথা বলছে? কি হয়েছে আজ, কিসের ইঙ্গিত দিলো?

টুং করে বেজে ওঠে ফোনটা। বাসায় ফেরার পর থেকেই আর ইশাকে একা পায়নি শ্রাবণ। কতক্ষণ হামজা সাহেব, কতক্ষণ শাহনাজ বেগম তাদের কাছেই ঘুরেফিরে থেকেছে ও। তাই লজ্জার মাথা খেয়ে সেও আগ বাড়িয়ে ডেকে আনতে পারেনি। যার দরুণ ডাকবাক্সে চিঠি দিয়ে গেছে।

“ঘুমিয়েছিস?;

শ্রাবণের ম্যাসেজ, জ্বলজ্বল করছে ফোনের স্ক্রিনে। ইশা ফোনটা হাতে তুলে একটা ঢোক গিললো। এতক্ষণ আনন্দে নাচলেও এখন যে ভয়ে কথাও বলতে পারছেনা।

“না।;

টানা তিন মিনিট ভেবে তারপর রিপ্লাই করলো ইশা। ঠিক তখনই দরজায় টোকা পড়লো। চমকে উঠলো ইশা। ভয়াতুর দৃষ্টিতে সেদিকে তাকাতেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো শ্রাবণ। ইশার এবার মাথা ঘুরতে লাগলো। কি যে শনিটা নাচছে ওর কপালে, কে জানে।

শ্রাবণের হাতে একটা বাটি দেখা যাচ্ছে। ইশা সেদিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবার শ্রাবণের মুখ চেয়ে তাকালো। শ্রাবণের মুখভঙ্গিমা একদমই শান্ত। যেন কিছু হয়নি। ইশা অযথাই ঘাবড়ে যাচ্ছে।

“ক্ কি হয়েছে, কিছু বলবে?;

“তানিকে রসগোল্লা বানিয়ে দিয়েছি। ভাবলাম তোর জন্য নিয়ে আসি।;

“আহ্, মেয়েটা পারেও।;

নিজের অজান্তেই মৃদু হাসলো ইশা। শ্রাবণকে ভয় পাওয়ার কথা থাকলেও শ্রাবণের কেয়ারিংয়ের ব্যাপারটা দেখে এই মুহুর্তে ভুলে গেলো সব। শ্রাবণ হাতে ধরে রাখা বাটিটা এনে বিছানার উপর রাখলো। ইশা আস্তে আস্তে উঠে বসতে নিলে এগিয়ে এসে ধরে বসতে সাহায্য করলো শ্রাবণ। অতঃপর বাটিটা ইশার হাতে তুলে দিয়ে বলল,

“টেস্ট ইট।;

“(মুখে দিয়ে) তুমি এতো ভালো মিষ্টি বানাতে পারো?;

ইশা অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলে উঠলো কথাটা। শ্রাবণ মুচকি হাসলো। মাথা নেড়ে বলল,

“আরও অনেক কিছু পারি।;

“তাই?(আগ্রহী গলায়)

“হ্যাঁ।;

“আমাকে কবে টেস্ট করাচ্ছো তোমার হাতের রান্না?;

“বিয়ের পর। যখন তুই কনসিভ করবি!;

“অ্যা!;

“হু। কনসিভ করার আগ অব্দি আমি আমার বউয়ের হাতের রান্না খেতে চাই।;(ইশার নাক টেনে)

ইশার বিষম লাগলো শ্রাবণের কথায়। খুকখুক করে কেশে উঠলো হঠাৎ। কাশতে কাশতে আবার পরক্ষণেই হাত চাপলো মুখে। শ্রাবণ ওর কাশি দেখে শব্দ করে হেসে উঠলো। ফের মাথায় আর পিঠে হাত চাপড়াতে লাগলো।

“ব্ বিয়েই হতে পারলোনা, আর তুমি বাচ্চায় চলে গেলে।;

“কেন? আমার তো খুব ইচ্ছে বিয়ের পরপরই বেবি নেওয়ার। তোর ইচ্ছে নেই?;

“উফফ!(লজ্জা পেয়ে) আ্ আমরা তো অন্য টপিকেও কথা বলতে পারি নাকি?;

“না পারিনা। আমার এই টপিকেই কথা বলতে হবে।;

“নো প্লিজ!;

“কেন, লজ্জা পাচ্ছিস?;

“তুমি থামবে?;

“আচ্ছা আচ্ছা থামছি। তাহলে বেবি না, বেবির নাম নিয়ে কথা বলি?;

“শ্রাবণ ভাই!;

“দেখেছিস কি অবস্থা? আমাদের বিয়ের বাকি আর মাত্র চারদিন। আর তুই এখনও আমাকে ভাই ভাই লাগিয়ে রেখেছিস। সাপোজ, বিয়ের পরও তুই আমাকে ভাই ভাই করবি। আর এই ভাই ভাই করার মাঝেই আমাদের বাচ্চা হয়ে যাবে। দ্যেন? আমার বাচ্চা আমার বউয়ের এই ভাইকে মামু মামু বলে সারা ঘুরে বেড়াবে! ওহ গড। আমার তো ভেবেই সব উল্টেপাল্টে যাচ্ছে।;

কথাটা বলে দু’জন দু’জনের দিক বেশ কিছুক্ষণ চেয়েই কাটালো। ফের খানিক সময় যেতে দু’জনে একসাথেই ফিক করে হেসে দিলো। হাসতে হাসতে ইশা ঢলে পড়লো শ্রাবণের বুকে। শ্রাবণ দু’হাতে ঝাপটে ধরলো ইশাকে। দু’জনের হাসির শব্দ দরজা ডিঙিয়ে ঠকঠক করে কড়া নাড়ছে পাশের রুমে হিমাদ্রর বক্ষঃপিঞ্জরে। এতো সুন্দর মোহময়ী এক নব দম্পতির হাসির শব্দ অসহ্য লাগছে তার। ইচ্ছে করছে সব কিছু ভেঙে চুরমার করে দিতে। কতটা অসহায় সে ভালোবাসার কাছে। না পারছে কাছে নিতে না পারছে দূরে ঠেলে দিতে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে