টেস্টটিউব  ১ম_পর্ব

0
2337

টেস্টটিউব
১ম_পর্ব

লিখা: Nilufar_Nijhum

আবির সাহেব আপনার স্ত্রী কখনো মা হতে পারবেনা। সেইক্ষেত্রে আমার মনে হয়, আপনাদের আর চেষ্টা না করাই ভাল।

ডাক্তারের এমন কথায় আমি চমকে উঠি! তারমানে নীলা আর কখনোই মা হতে পারবেনা! কিন্তু এটা আমি মেনে নিলেও ও তো মেনে নিতে পারবেনা! পরিবারের কথাতো বাদই দিলাম! তবুও ডাক্তারকে বলি,
– আচ্ছা, ডাক্তার কোনই কি ভরসা নেই?
– আসলে, পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যা দেখেছি তাতে আপনার স্ত্রীর জন্মগতভাবে ভ্যাজাইনাল লেন্থ অনেক বড়। তাই শুক্রাণু ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়ে জাইগোট উৎপন্ন হতে পারছে না। তবে আমি একটা উপায় বলে দিতে পারি। যদি আপনি সেই ব্যবস্থা নিতে চান?

– কি সেটা? বলুন? আমি যেকোন ব্যবস্থা গ্রহণে রাজি আছি।
– আপনারা ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (কৃত্রিম জন্মপদ্ধতি) এর জন্য ব্যবস্থা নিতে পারেন।
– এটা তো জটিল ব্যাপার, সেইক্ষেত্রে আমার স্ত্রীর মতামত নেয়ার প্রয়োজন আছে।
– হুম্ম তাতো অবশ্যই। নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করুন। তারপর যা ডিসিশন নেয়ার নেবেন।

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে ভাবছি, এই খবর জানলে নীলা কিভাবে রিয়্যাক্ট করবে? এতবড় ধাক্কাটা কি ও নিতে পারবে? ভাবতে ভাবতেই নীলার ফোন,
– কোথায় তুমি?
– এইতো আসছি। আর অল্পক্ষণ এর মধ্যেই চলে আসছি।

আচ্ছা বলে ও ফোন কেটে দেয়। কিন্তু ও যা জানতে চায় তার কি উত্তর দিবো!

ও জানে, আসার পথে ডাক্তারের চেম্বারে যাবো। অফিসে থাকাকালীন বারবার ফোন করে মনে করিয়ে দিয়েছে, ফেরার পথে যেন অবশ্যই ডাক্তারের চেম্বার হয়ে ফিরি।

বাসায় ঢুকতেই হাতের ব্যাগটা ওর হাতে ধরিয়ে দিতে ও জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকে- আমি কিছু বলছিনা দেখে, নিজেই বলে উঠে-

– কিগো, কিছু বলছো না যে? আজকে তো রিপোর্ট দেয়ার কথা ছিল? তুমি যাওনি?

– নাহ আজকে আসলে সময় পাইনি। দেখি কাল যাবো।

– আচ্ছা আবির, তুমি এমন কেন! আমার প্রতি তোমার কি কোন গুরুত্বই নেই! তুমিতো জানো সেদিন ডাক্তারের কাছ থেকে ফেরার পর থেকে আমি কতটা চিন্তাই আছি!

– আহ! এত অস্থির হচ্ছো কেন! আজ যেতে পারিনি- তো কি হইছে! আগামীকাল নিশ্চয় যাব, একদম ভুল হবে না দেখে নিও।

– ঠিক আছে মনে থাকে যেন।

– একদম না।

কিন্তু আজ যে আমি ডাক্তারের কাছ হয়েই ফিরছি, ওকে বলতে গিয়েও বলতে পারিনা।

চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে বললাম,
– খুব খুধা লেগেছো খেতে দাও।
– হু- দিচ্ছি।

বলেই ও চলে যায়। ভাবছি খবর টা ওকে কিভাবে দিবো! আর ওই বা এটা কিভাবে নিবে! কিছুই ভেবে পাচ্ছিনা। পাগলিটা এটা শুনে নিশ্চয় খুব কষ্ট পাবে। বাচ্চা নিয়ে ওর বরাবরি অনেক স্বপ্ন।

হঠাৎ নীলার ডাক-
– কই হাত মুখ ধুয়ে খেতে আসো। খাবার দেয়া হয়েছে টেবিলে।
– এইতো আসছি।

খেতে বসেছি, কিন্তু খাওয়াই মনযোগ নেই। খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছি দেখে, ও বলে উঠলো-
– তুমি কি কিছু নিয়ে খুব আপসেট?
– কই নাতো! কেন বলতো?
– মনে হলো! খাচ্ছো না ভালভাবে!
– ও কিছুনা। এমনি। তুমি শুধু শুধুই ভাবছো!তোমরা খেয়েছো?
– হু, কিন্তু তুমি একটা কথা বলতো, তুমি কি আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছো? ডাক্তার খারাপ কিছু বলেছে? নিশ্চয় আমার সমস্যা।
– বোকা বোকা কথা বলো নাতো! কিসব ভাবো আর বলো!

এই কথা শুনে নীলা, কি বুঝে, বুঝতে পারিনা। চুপ করে টেবিল থেকে উঠে যায়।

খাওয়া শেষ করে, ল্যাপটপ নিয়ে একটু বসেছি,
কিন্তু মাথায় কিছুই আসছেনা। ঘুরে ফিরে একটাই কথা কানে বাজছে, নীলা মা হতে পারবেনা! আবার এটা ওকে বলতেও পারছিনা। কিন্তু এইভাবে কতদিন! একদিন না একদিন তো জানবে!

এমন সময় আম্মা দরজায় এসে ডাক দেন-
– আবির ঘরে আছিস?
– হ্যাঁ, আম্মা এসো। কিছু বলবা?
– আজকে নাকি তোর ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ছিল? ডাক্তার কি রিপোর্ট দিলেন?
– আম্মা আজকে যাইনি। রিপোর্ট নিয়ে এসে তোমাকে জানাবো। অনেক রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়ো। ও ভাল কথা, তোমার সুগার টা কাল একবার মাপাতে হবে।
– সুগারের আর দোষ কি বল? এই বয়সে এত চিন্তা আর নিতে পারিনা।
– আম্মা তুমি শুধু শুধু কেন যে এত চিন্তা কর! যাও ঘুমাও। রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে।

আম্মা চলে গেলে নীলা চুপ করে বসে থাকে। বুঝতে পারি আম্মার কথায় কষ্ট পেয়েছে। ওর মন হালকা করতে বলি-
– নীলা,
– হুম।
– আচ্ছা, একটা কাজ করলে কেমন হয়?
– কি কাজ!
– তুমি মন খারাপ করবেনা তো?
– আগে বলো!
– যদি কোন কারণে আমাদের বেবি আসতে সমস্যা হয়, আমরা কিন্তু ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (কৃত্রিম জন্মপদ্ধতি) এর জন্য ব্যবস্থা নিতে পারি। যদি তুমি চাও, এমনটা যে হচ্ছেনা তা কিন্তু নয়, বিজ্ঞান এখন কত উন্নত বলতো!
– কি বলতে চাও! আমি মা হতে পারবো না তাইতো? তুমি আজ নিশ্চয় ডাক্তারের কাছে গেছিলে, কিন্তু আমাকে বলছো না!
– আচ্ছা পুরো কথাটা তো শুনবে?
– কি শুনবো! আমার যা বোঝার বুঝা হয়ে গেছে, প্লিজ তুমি সব খুলে বল। নইলে আমি নিজেই ডাক্তারের কাছে যাব।
– তার আগে বল, আমি যাই বলি তুমি শুনে কষ্ট পাবেনা?
– কষ্ট পাওয়ার মত হলে পাবো না! আর কি এমন কথা যে কষ্টের কথা বলছো? তারমানে, সবাই যা ভাবে সেটাই ঠিক? আমারই সমস্যা, তোমার সমস্যা নয়?
– আহা এত অস্থির হও কেন। সমস্যা যেখানে, সমাধান ও সেখানে। সুতরাং এত চিন্তার কিছু নেই।
– এতকিছুর পর ও বলছো চিন্তা করবো না!

ওর কথা শুনে চুপ হয়ে যাই! নীলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে। কিন্তু ওকে যে কিভাবে বুঝাবো বুঝতে পারিনা!

পরে শান্ত হলে বলি,
– নীলা,
– হুম্ম, বল!
– চিকিৎসা ব্যবস্থা এখন অনেক উন্নত, দরকারে আমরা অন্য কোন ডাক্তার দেখাবো, এদেশে না হলে বিদেশে যাব। এত ভেঙে পড়ার কিছু হয়নি! তুমি কেন এত ভেঙে পড়ছো?
– আবির, তুমিতো বুঝোনা, নানান জনে নানান কথা বলে, আমার কতটা কষ্ট হয় বলতে পারো? আমার কষ্ট টা কেউ বুঝেনা, আমারো তো ইচ্ছে হয় একটা ছোট্ট শিশুর মা ডাক শুনতে! আমার কি ইচ্ছে করেনা?
– কে বলেছে, তুমি মা হবেনা?
– তুমি যাই বলো না কেন,আমি বুঝে গেছি আমি কোনদিন মা হতে পারবো না। মা হওয়ার স্বাদ আমি আজীবন নিতে পারবো না! এতদিন তবুও আশায় বুক বেঁধে ছিলাম, এখন তো তাও আর রইলো না! আমি কি নিয়ে বাঁচবো!

নীলার এই কথায় আমি কোন উত্তর দিতে পারিনা। বাচ্চার জন্য ও পাগল প্রায়। বিয়ের পর থেকে এমন কিছু নাই যা ও করেনি। এই ডাক্তার, সেই ডাক্তার ছুটে বেড়িয়েছে। বাচ্চা নেওয়ার জন্য ওর চেষ্টার কোন শেষ নেই! যে যা বলে তাই শুনে! সে একজন শিক্ষিতা মেয়ে হয়েও কবিরাজি ঝাঁড়- ফু, তাবিজ-মাদুলি কোনটাই বাদ রাখেনি! বিয়ের শুরু থেকেই প্রায় বলতো-
– আবির আমার একটা ফুটফুটে মেয়ে হবে , দেখে নিও ও দেখতে ঠিক তোমার মত হবে।

আমি ওর পাগলামো দেখে হাসতাম। কিন্তু একদিনও ভাবিনি এটা ওর জীবনে দুঃস্বপ্ন হয়ে যাবে!

এরমধ্যে ডাক্তারের দেয়া রিপোর্ট এর ব্যাপারে সবাই জেনে গেছে। সবটা জানার পর কিছুদিন সবাই চুপ থাকলেও এখন অনেকে আড়ালে আবডালে বলাবলি করে, আমার কানে যে কম বেশি আসেনা তা নয়। সবার ওইসব কথা শুনে নীলা প্রচণ্ড কান্নাকাটি করে আর বলে-
– আবির, এখন সবাই বলছে, এরপর তুমিও বলবে, আমি বাচ্চা জন্মদানে অক্ষম। তারপর আমাকে করুনা করবে, আগের মত আর ভাল বাসবেনা তাইনা?

– কি সব উল্টাপাল্টা কথা বল হহু! এসব মাথায় নিয়ে শুধু ঘুরে বেড়াও তাইনা? পাগলি কোথাকার!
– এখন যতই শান্তনা দাও, আমি জানি একদিন তুমিও বিরক্ত হবে। করুনা দেখাবে।

ওকে মুখে যাই বলিনা কেন, ও এখন বুঝবেনা। বেশ বুঝতে পারছি, যত দিন যাচ্ছে, আত্মীয়স্বজনদের কটু কথায় ওর মনোবল ভেঙ্গে যাচ্ছে। কিন্তু আমি কি করবো, সমাজের বাইরে তো কেউ নই! ওকে তো চাইলেই সমাজের বাইরে নিয়ে গিয়ে রাখতে পারবোনা! মানুষ বললে তা আটকাবো কি করে!

এদিকে আম্মাও ইদানীং আফসোস করে একে ওকে শুনিয়ে বলেন- সব কপাল, নইলে কপালে এমন বউ জুটবে কেন! বংশ হয়তো নির্বংশই থাকবে। আমার একটামাত্র ছেলে, এখন যদি এই হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ বংশ বলতে কিছুই থাকবে না। শেষ বয়সে নাতী নাতনীর মুখ ও দেখে যেতে পারবো না!

বুঝতে পারছি, আম্মা এটা নিয়ে বেশ বিরক্ত কিন্তু নীলা কষ্ট পাবে ভেবে বলতে পারেন না। কারণ, আম্মা নীলাকে নিজের মেয়ের মত দেখেন।

আম্মা, বিয়ের দিন-ই সংসারের চাবি, নীলার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল- আজ থেকে এই সংসারের সমস্ত দায় দায়িত্ব তোমার। তুমি এসে গেছো, এখন আমার ছুটি। তোমার কাছে শুধু আমার একটাই চাওয়া, বছর ঘুরে, ঘর আলো করে যেন আমার নাতী-নাতনী আসে। আমি যেন ওদের সাথে শেষ বয়সে হাসতে খেলতে দুনিয়া থেকে যেতে পারি।

আম্মার এই কথা শুনে, আমি আর নীলা দুইজনেই লজ্জ্যা পাই।

কিন্তু আজ যখন সব আশা নিরাশায় পরিণত হচ্ছে, আম্মা ও একটু মনঃক্ষুণ্ণ।

এইসব দেখে শুনে নীলা কান্না করে, আর বলে-

– আচ্ছা আবির তুমিই বল, কোন মেয়ে কি ইচ্ছে করে কখনো সন্তানহীন থাকে? প্রতিটা মেয়েই তো বিয়ের পর প্রথম স্বপ্ন দেখে সে মা হবে। একজন মেয়ের জীবন তখনই পূর্ণতা পায়, যখন সে মা হয়। কিন্তু যদি শারীরিক কোন সমস্যায় বাচ্চা না হয়, তাতে তার কি করার থাকতে পারে? শারীরিক সমস্যা টা তো আর নিজের হাতে তৈরি নয়! বিভিন্ন কারণে একজন নারী সন্তান জন্মদানে অক্ষম হতে পারে। তাতে তার কতটুকু হাত থাকে বলতে পারো, আমার ব্যাপারে আমারই বা কতটুকু হাত আছে? আমি কি ইচ্ছে করে এমন করেছি? আল্লাহ যদি আমাকে অক্ষম করে দেন আমি কি করতে পারি! কিন্তু জানোতো সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, সমাজ কখনো সন্তান জন্মদানে অক্ষম নারীকে মেনে নিতে পারে না। আজ আমার জায়গায় তুমি হলে তারা কেউ কখনো বলত না, আমি যেন তোমাকে ছেড়ে আরেকজনকে বিয়ে করি। অথচ দেখো, আমি যেখানে যাই, আমাকে শুনতে হয়, আমি যেন তোমার বিয়ে দিয়ে দেই।

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই নীলা কাঁদতে থাকে। শেষে ওকে থামাতে বলি-

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে