জানে জিগার পর্ব – ১

0
2019

#জানে জিগার
#হৃদয়ের আকাশে মেঘ রোদ বর্ষণ
#Part-01
#Writer-NOVA

এক থাপ্পড়ে যে কোন ছেলে অজ্ঞান হয়ে যায় তা বর্তমানে ফাইজার সাথে না ঘটলে, কখনোই জানতো না সে। বিশালদেহী এক ছেলেকে কোনরকম ধরে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগে নিজেই একে থাপ্পড় মেরে অজ্ঞান করেছে। কিন্তু ওর এখন নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না। ওর মতো চিকনা একটা মেয়ের থাপ্পড় খেয়ে ছেলেটা অজ্ঞান হয়ে গেল! কি রকম অদ্ভুত কথা! যদিও সর্বশক্তি লাগিয়ে থাপ্পড়টা মেরেছে তবুও ওর সন্দেহ আছে। কই যখন সর্বশক্তি দিয়ে তেলাপোকা মারতে যায় তখন তো তা মরে না। তাহলে এই ছেলে কেন অজ্ঞান হলো? যে কিনা একটা তেলাপোকা মারতে পারে না সে একটা থাপ্পড় মেরে একটা গাট্টাগোট্টা ছেলেকে অজ্ঞান করে দিলো।বিষয়টা আসলেই ভাববার মতো। ছেলেটাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না সে। এরকম হাতির মতো বডির ছেলেটার ভারে নুইয়ে পরছে ফাইজা। একটু পর সে নিশ্চয়ই এই ছেলের ভারে ঠাস করে রাস্তায় পরে যাবে। আর ওর ওপর ছেলেটা পরবে। তারপর সে গেলে চিলেচেপ্টা হয়ে যাবে।আশেপাশে তাকিয়ে কোন মানুষ দেখতে পেলো না সে। কি একটা বিপদে পরলো?এখন নিজের ওপর রাগ উঠছে ওর। কে বলেছিলো আগ বাড়িয়ে এত শক্তি দেখাতে? ফাইজা নিজের মনে বিরবির করে উঠলো,

—ধূর,অসহ্যকর। কেন যে এই ছেলেকে থাপ্পড় মারতে গেলাম। এখন নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। রাস্তায় কোন মানুষ নেই। আমি এখন কি করবো? ও আল্লাহ আমাকে সাহায্য করো। আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে তো তুমি তোমার কোন পেয়ারা বান্দাকে পাঠাও। তুমিই একমাত্র পারো আমাকে এই বিপদ থেকে বাঁচাতে। কি করবো এখন? ধ্যাত!

ফাইজা বিরক্তির সাথে বিরবির করে কথাগুলো বলে আশেপাশে তাকিয়ে দেখছে কোন মানুষ আসে কিনা।কিন্তু ফাইজা ভালো করেই জানে যে রাস্তায় বিকেলবেলায় কখনও মানুষের দেখা মিলে না।সেখানে এই রাত আটটা বাজে তো জীবনেও মানুষ পাওয়া যাবে না। বন্ধবী নিশার বাসায় গিয়েছিলো সে।দুইদিন পর এক্সাম। তাই নোট টুকতে। দুজন মিলে স্টাডি করতে করতে যে এতটা সময় হয়ে যাবে তা বুঝতে পারেনি। নিশা অনেকবার বলেছিলো ওকে থেকে যেতে। কিন্তু ফাইজা একপ্রকার জোর করেই একা চলে এসেছে। তাছাড়া ওর একা চলার অভ্যেস আছে।

শর্টকাটে যাওয়ার জন্য এই রাস্তায় এসেছিলো। কিন্তু সবসময় আমরা ভুলে যাই, যেটা আমরা তাড়াতাড়ি করতে যাই সেটাই উল্টো আরো দেরী হয়। এই রাস্তায় ঢুকতেই কোথা থেকে এই ছেলে এসে মাথা ধরে টলতে টলতে ওর গায়ের ওপর পরে যায়।আর ছেলেটার হাত লাগে ওর শরীরের আপত্তিকর জায়গায়। তাতেই ফাইজার রাগ উঠে। ব্যাস কষিয়ে একটা থাপ্পড় মেরে দেয়। সাথে সাথে ছেলেটা অজ্ঞান। তারপরের ঘটনা তো প্রথমেই উল্লেখ করে দিলাম।

বর্তমানে ফাইজা ছেলেটাকে আর ধরে রাখতে পারছে না। সারা শরীর অবশ হয়ে গেছে। ছেলেটা তার পুরো শরীরের ভার ফাইজার ওপর ছেড়ে দিয়ে মাথাটা ওর কাঁধে হেলিয়ে রেখেছে। আর ফাইজা তার কোমড় দুই হাতে পেচিয়ে শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

—আল্লাহ, এটা কি কোন মানুষের বডি নাকি স্টীলের বডি।যেমন শক্ত তেমনি ভার। আমার কাছে পানির বোতলও নেই। থাকলে ঝাপটা মেরে জ্ঞান ফিরিয়ে এই আপদ বিদেয় করতাম। আমার মাথা ঘুরছে। আমি আর একে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো না। ও আল্লাহ কই তুমি, আমাকে বাঁচাও।

কাঁদো কাঁদো ফেস করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর কাছে নিজের আর্জি জানালো সে।পেছন দিকে ঘাড়টা হালকা কাত করে দেখলো একটা বৈদ্যুতিক পিলার। অনেকটা কষ্ট করে ছেলেটাকে ধরে পেছনে পিছিয়ে পিলারের সাথে হেলান দিলো।এতে কিছুটা হলেও স্বস্তি মিললো তার। হঠাৎ ছেলেটা পরে যেতে নিলে মাথার পেছনে ধরে তাকে আটকিয়ে ফেললো ফাইজা। তখুনি ওর মনে হলো ওর হাত দুটো ভেজা। এক হাতে ছেলেটাকে ধরে আরেক হাত সামনে আনতেই আৎকে উঠলে সে।

—রক্ত!

পিলারের মাঝ বরাবরি টিমটিম আলোর একটা লাইট জ্বলছে। সেই আলোতে সে দেখতে পেলো তার হাতে রক্ত লেগে আছে। রক্ত দেখে বেশ ঘাবড়ে গেলো ফাইজা। আশেপাশে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। মাথাটা কচ্ছপের মতো করে পিলারের ওপর পাশে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো, সেখানে একটা বাইক উল্টে পরে আছে। এতক্ষণে পুরো বিষয়টা ক্লিয়ার হলো ফাইজার কাছে। ছেলেটা এক্সিডেন্ট করেছে। দ্রুত বাইক চালাতে গিয়ে বৈদ্যুতিক পিলারের সাথে ধাক্কা খেয়ে এক্সিডেন্ট করেছে ছেলেটি। যার কারণে মাথার পেছনে ভীষণ আঘাত পেয়েছে। এরপর যখন কোনমতে সেখান থেকে উঠে মাথা ধরে টলতে টলতে রাস্তায় চলতে লাগলো। তখুনি ফাইজার ওপর পরে যায়। তারপর ফাইজা এক থাপ্পড়ে বেচারাকে অজ্ঞান করে দিলো। ফাইজা বিষয়টা বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো। নয়তো তার মতো একটা পাতলী মেয়ের থাপ্পড়ে কোন ছেলে অজ্ঞান হয়ে যাবে, এটা সে
কিছুতেই মানতে পারছিলো না। যদি অজ্ঞান করতে পারতো তাহলে সবার আগে তার সো কল্ড বিএফ টাকে থাপ্পড় মেরে অজ্ঞান করে ফেলতো। আবারো বিরক্ত মাখা কন্ঠে ফাইজা বললো,

—ও আল্লাহ,আর কতক্ষণ এই লোহার বস্তাকে ধরে থাকবো? এবার তো আমাকে কোন পথ দেখাও।

ফাইজার আর্জি আল্লাহ এবার কবুল করে নিলো।ছেলেটার পকেটে থাকা মোবাইলটা শব্দ করে বেজে উঠলো। তাতেই যেনো ফাইজা আশার আলোর দেখলো। এতক্ষণ চিন্তায় চিন্তায় সে মোবাইলের কথা ভুলেই গিয়েছিল। মনে থাকলে তো কাউকে কল করে সাহায্য চাওয়া যেতো। খুব সাবধানে ছেলেটার পকেট থেকে মোবাইল বের করলো ফাইজা। ওর নড়াচড়ায় যাতে ছেলেটা পরে না যায় তাই এতো সাবধানতা।মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো স্ক্রিনে R2 শব্দ ভাসছে।সেদিকে খেয়াল না দিয়ে তড়িঘড়ি করে কলটা রিসিভ করলো ফাইজা। রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে ঝাঁঝালো কণ্ঠে একজন বলে উঠলো।

—- আকাশ, তোর আসতে আর কত দেরী হবে? তুই অলরেডি ১৫ মিনিট দেরী করে ফেলেছিস। আর কত দেরী করবি ইয়ার। একটা দিনও তাড়াতাড়ি কিছু করতে পারিস না। অপরদিকে সব এনাউন্সমেন্ট শুরু হয়ে গেছে। জলদী চলে আয়।

ফাইজা ইতস্ততভাবে বললো,
— হ্যালো কে বলছেন?

—- ইয়ার মজা করছিস এখন।এখন কি মজা করার সময়? তুই কোথায়……..(একটু থেমে কিছু একটা ভেবে) এক মিনিট কে আপনি?

🔥🔥🔥

ফাইজা কাঁপা কাঁপা গলায় কথাটা বলার পরেও রোদের হুশ ছিলো না। যখন তার মনে হলো আকাশের বদলে কলটা রিসিভ করেছে একটা মেয়ে তখন রোদের সম্বিত ফিরলো।

—- হ্যালো আপনি কে বলছেন? আকাশ কোথায়? আপনি আকাশের কল কেন রিসিভ করছেন? ওকে মোবাইল দিন।

—দেখুন আমার কথাটা শুনুন।

—– কি কথা শুনবো আপনার? ওকে মোবাইলটা দিন।আজকের দিনেও,ও কেন মেয়ে নিয়ে পরে আছে? ও কি জানে না ও সময়মতো এসে না পৌঁছালে কত বড় লস হয়ে যাবে? আপনি ওকে মোবাইলটা দিন। আজ ওর একদিন কি আমার একদিন।

— প্লিজ আপনি শান্ত হোন। আপনি যেমনটা ভাবছেন তেমন কিছুই না।

—- তেমন কিছু নয় তো কেমন কিছু। আজ ওকে পেলে একটা হাড্ডিও আস্ত রাখবো না।

—আমাকে কি পুরো কথাটা বলতে দিবেন। তখন থেকে কি শুরু করছেন? আপনার সাথে একটা মেয়ে কথা বলতে চাইছে আপনি তার কথা না শুনেই একের পর এক কথা শুনিয়েই যাচ্ছেন। প্লিজ লেট মি ফিনিস।

ফাইজা জোরে চিৎকার করেই কথাগুলো বলে উঠলো।ফাঁকা জায়গা থাকায় ওর কথাগুলো বারবার সামনের দেওয়ালে বারি খাচ্ছে। অপর পাশে থাকা ছেলেটা মানে রোদ চুপ হয়ে গেলো।শান্ত কন্ঠে বললো।

— জ্বি বলুন।

— আকাশ আপনার কি হয়?

—জানে জিগার।

ফাইজা বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করার ভঙ্গিতে বললো,
— জ্বি?

— আমার জানে জিগার দোস্ত।

— ওহ আচ্ছা। সে এক্সিডেন্ট করেছে। তার মাথার পেছন দিয়ে প্রচুর ব্লাড পরছে। প্লিজ আপনি যেখানেই থাকেন দ্রুত চলে আসেন। উনাকে হসপিটালে নিতে হবে। নয়তো অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। আমি মিনিট দশেক ধরে উনাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আর পারছি না।

ফাইজার কথা শুনে রোদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,

—হোয়াট? কি বলছেন আপনি? কি করে হলো? কখন হলো? ও কেমন আছে? আপনি এখন কোথায়? ঠিকানা দিন, আমরা এখুনি আসছি।

— প্লিজ শান্ত হোন। আমি ঠিকানা বলে দিচ্ছি। আপনি জলদী চলে আসুন।

ফাইজা ঠিকানা বলে দিলো।তবে রোদ ওকে কল কাটতে মানা করলো। রোদ যে ব্যস্ত হয়ে পরেছে তা ওর কন্ঠস্বর শুনেই বুঝে ফেলেছে ফাইজা। মিনিট দশের মধ্যেই দুটো ব্লাক কার ঘূর্ণিঝড়ের গতিতে এসে ফাইজার সামনে থামলো। এত জলদী চলে আসবে তা ফাইজা ভাবেনি। কার দুটো থামতেই দুটা ছেলে দৌড়ে ফাইজার সামনে এসে আকাশকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলো। চারজন মানুষ দুই গাড়ি নিয়ে কেন এসেছে তা বুঝলো না ফাইজা। একটা গাড়ি নিয়ে আসলেই তো হতো। তবে এসবে বেশি মাথা ঘামালো না সে। দুজন আকাশকে ধরাধরি করে গাড়িতে উঠালো।অবশেষে ফাইজা পুরোপুরি স্বস্তি পেলো।পিলারের সাথে হেলান দিয়ে বড় বড় নিশ্বাস টানলো।বেচারী হয়রান হয়ে গেছে। একটা ছেলে এগিয়ে এসে বললো।

—- হাই, আমি রোদ।আকাশের ফ্রেন্ড। একটু আগে আপনি আমার সাথেই কলে কথা বলেছেন।আপনাকে কি বলে ধন্যবাদ দিবো তার ভাষা আমার জানা নেই। তারপরেও বলবো অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনি না থাকলে হয়তো আজকে আকাশের বড় কোন ক্ষতি হয়ে যেতো।

—ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই। উনার জায়গায় অন্য কেউ হলেও আমি সেম কাজটা করতাম। যদি ধন্যবাদ দিতেই হয় তাহলে আল্লাহকে দিন। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে উনি আমাকে সঠিক সময় এখানে পাঠিয়েছে। এই নিন উনার মোবাইল। এত কথা না বলে উনাকে জলদী হসপিটালে ভর্তি করুন।

এতকিছুর মধ্যে ফাইজা শান্তপর্ণে থাপ্পড়ের কথাটা এড়িয়ে গেলো। যদিও এক্সিডেন্ট করেছে তারপরেও তো ওর থাপ্পড় খেয়ে আকাশ পুরোপুরি অজ্ঞান হয়েছে। সেই বিষয়টা এদের বললে ওর খবর নিয়ে ফেলবে।তাই ফাইজা খুব সাবধানে সেই বিষয়টা চেপে গেলো।

রোদ ফাইজার দিকে তাকিয়ে বললো,
—আপনাকে বাসায় পৌঁছে দেই চলুন।

— No thanks. আমি একা চলে যেতে পারবো।আমার রাতে একা চলার অভ্যেস আছে।

—আমাদের এতবড় উপকার করলেন। এতটুকু সাহায্য তো করতেই পারি।

— লাগবে না। মাত্র তিন মিনিট হাঁটলেই আমার বাসায় পৌঁছে যেতে পারবো।

রোদ কোন কথা বাড়ালো না। দুজন গাড়ি করে আকাশকে নিয়ে হসপিটালের দিকে চলে গেছে। এবার ফাইজা বুঝলো দুটো কার আনার লজিক। আরেকজন ছেলে মোবাইলে কারো সাথে কথা বলছে।
সম্ভবত আকাশকে হসপিটালে ভর্তি করা নিয়েই কথা বলছে। উচ্চস্বরে কথা বলায় তা ফাইজার কর্ণগোচর হয়েছে। সে ছেলেটাকে রোদ জিজ্ঞেস করলো।

— বর্ষণ সবকিছু কি কমপ্লিট? কোন হসপিটালে নিবে আকাশকে?

অপরপাশ থেকে বর্ষণ নামের ছেলেটা মোবাইল পকেটে রাখতে রাখতে বললো,

— আপতত আকাশকে গুলশানের ইউনাইটেড হসপিটালে ভর্তি করতে বলেছে। বাকিটা ওরা দুজন এসে সামলাবে। জলদী চল এখান থেকে যেতে হবে।

— আসছি মিস। সাবধানে যাবেন।

— নিশ্চয়ই, আল্লাহ হাফেজ।

হঠাৎ রোদের ব্লেজারে IS লেখা লোগো দেখে ফাইজার মনে হলো এটা কোথায় জানি দেখেছে।ততক্ষণে রোদ ও ফাইজা দুজনেই পেছন দিকে ঘুরে গেছে। দ্রুত পেছন ঘুরে ফাইজা বললো।

— আপনারা কি IS গ্যাংয়ের সাথে কানেক্টেড? না মানে আপনার ব্লেজারে যে তাদের লোগো আছে।শুধুমাত্র তো এই লোগো ঐ গ্যাংয়ের কাছেই আছে।

পেছন ঘুরতে ঘুরতে কথাগুলো বললো সে। কিন্তু পুরোপুরি পেছনে ঘুরেই ফাইজা অবাক হয়ে গেলো।
যেভাবে ঘূর্ণিঝড়ের গতিতে এসেছিলো সেভাবেই হাওয়া।

~~~~ ভালো একটা বন্ধু যতই ভুল করুক তাকে ভুলে যাবেন না। কারণ পানি যতই ময়লা হোক, আগুন নিভাতে সেই পানিই সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে