চুপিসারে ভালবাসি
–পর্বঃ২
সাদিয়া আফরিন নিশি
__________________
মালিহা আহমেদের ফোনটা বেজে উঠল। মালিহা আহমেদ কিচেনে ব্যস্ত থাকায় ফোন রিসিভ করতে গেল সোহা। তার বড় মামি অর্থাৎ নীলের মা ফোন করেছে। এই কলটা তো আসারই ছিল। তার ছেলের এমন হুটহাুট পাগলামোতে অলওয়েজ দিশেহারা থাকে সবাই। একদম ছন্নছাড়া, নাছোড়বান্দা,একরোখা টাইপ বজ্জাত ছেলে বলেই আখ্যায়িত করে সোহা নীলকে। ফোন রিসিভ করে সোহা প্রথমেই মিষ্টি করে সালাম দিল। সোহার মামি সালামের উত্তর দিয়ে উদ্বীগ্ন কন্ঠে বললেন,
“আম্মা, নীল কী তোমাদের বাড়িতে গেছে নাকি? এই ঝড়,বৃষ্টির মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে গেল।এত করে বললাম পরিবেশ ঠিক হলে তারপর বের হ বাসা থেকে কিন্তু সে তো কোনো কথাই শুনল না। গাড়িটাও নিল না বাইক নিয়ে ভিজতে ভিজতে চলে গেল।”
সোহা হতাশার নিশ্বাস ফেলে বলল,
“হ্যাঁ বড় মামনি, তোমার ওই একরোখা বজ্জাত ছেলে আমাদের বাড়িতেই এসেছে। ইতিমধ্যে তোমার ননদ তার আপ্যায়নের জন্য কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে। তুমি নিশ্চিন্তে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে পড়। তাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। আর তার সঙ্গে সঙ্গে তার গ্যাং-রাও এখানেই আছে। সো সকলকে বলে দিও তাদের নিয়ে টেনশন না করতে।”
নীলের মায়ের মুখে প্রশান্তির হাসি। যেটা চোখে না দেখলেও সোহা ঠিকই অনুভব করতে পারল। সেও মুচকি হাসল। অতঃপর ওপাশ থেকে যোগাযোগ বিচ্ছেদের আওয়াজ শোনা গেল।
____
“যা তো সোহা এই গরম দুধটা নীলকে দিয়ে আয়।”
মালিহা আহমেদ দুধের গ্লাস দিতে দিতে বললেন। সোহার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। সে ভীত কন্ঠে বলল,
“এসব কী বলছ তুমি আম্মা? তোমার ভাইপো চেয়েছে কফি তুমি দিয়েছ দুধ। তারওপর আবার আমাকে পাঠাতে চাইছ তাকে দুধ খাওয়াতে। দেখা যাচ্ছে তোমার ভাইপো শেষমেশ এক গ্লাস দুধের মধ্যে আমাকে ভিজিয়ে কামড়ে কামড়ে খেয়ে নিল। তখন কিন্তু আমার খুব লাগবে মা।”
শেষ উক্তিটি সোহা শয়তানির ভঙ্গিতে বলল। সোহার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সূর্য বলল,
“ও কুপ্পী সুয়োরানী কিন্তু ঠিকই বলেছে। এরপর দেখবে তোমার মেয়ে আছে কিন্তু তার হাড্ডি নেই নয়তো তোমার মেয়ের হাড্ডি আছে কিন্তু তোমার মেয়ে নেই।এখন যেটা ভালো বোঝ করো।”
সোহা মায়ের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মালিহা আহমেদ সেদিকে তোয়াক্কা না করে বিরক্তির সুরে বললেন,
“আহ তোরা থামবি। আমার নীল মোটেই অমন ছেলে নয়। আমি দিয়েছি শুনলে এক লাফে খেয়ে নেবে। সোহা তুই তাড়াতাড়ি যা তো দুধটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো। আমার আবার ওদিকে অনেক কাজ আছে।”
মালিহা আহমেদ চলে যেতেই সোহা অসহায় দৃষ্টিতে ভাইদের দিকে তাকালো। জিসান আর ইশান তাকে অভয় দিয়ে বলল,
“যাহ বোন কিচ্ছু হবে না। ভাই কিছুই বলবে না।”
কিন্তু সূর্য তাকে আরও ভয় দেখানোর জন্য বলে,” হ্যাঁ হ্যাঁ যাও যাও পড়ে বুঝবে মজা কাকে বলে।”
সোহা সূর্যকে মুখ ভেংচি কেটে চলে গেল।
____
বেলকনিতে বসে নিকোটিনের স্বাদ নিতে ব্যস্ত নীল। এ বাড়িতে আসলেই তার মনে আলাদা প্রশান্তি মিলে। কোথাও একটা এটা ভেবে শান্তি পায় যে এ বাড়ির কোনো এক কোণে তার গোলাপরানি আছে। খুব কাছেই আছে। তখন বুক ভরে শ্বাস নেয় সে। ভীষণ খুশি লাগে মন থেকে। সুমিষ্ট কন্ঠস্বর কানে বাজতেই বুকটা ধক করে ওঠে নীলের। পেছন থেকে কেউ আমতা আমতা কন্ঠে বলছে,
“নীলাদ্রি দা তোমার দ দদ দুধ।”
এই নীলাদ্রি নামে শুধু সোহাই তাকে ডাকে। অন্যকেউ এই নামে ডাকার সাহস পায় না। অন্য কেউ এই নামে ডাকলে সে ভীষণ রেগে যায়। সোহার বলা কথাটি মস্তিষ্কের নিউরনে পৌছতেই ভ্রু কুঁচকে আসে নীলের। সে কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে পেছন ফিরে তাকায়। সোহার হাতে দুধের গ্লাস দেখে অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“এটা কেন? আমি তো কফি চেয়েছিলাম।”
সোহার রিনরিনে কন্ঠ,
“আম্মা পাঠিয়েছে। বলেছে এটাই তোমার শরীরের জন্য বেশি বেটার।”
নীল কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। কিছু একটা ভেবে অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল সোহার দিকে। সোহার অস্বস্তি হচ্ছে ভীষণ সেই সাথে ভয়ও। সে চুপচাপ দুধের গ্লাসটা টেবিলে রেখে কেটে পড়তে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই কেউ তার এক হাত খপ করে ধরে বসে। থমকে দাড়াল সোহা। এক অদ্ভুত শিহরণ কাজ করছে তার পুরো শরীর জুড়ে। সে যেন নড়তে ভুলে গেছে। স্ট্যাচু হয়ে দাড়িয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। হঠাৎই হাতের স্পর্শ আরও শক্ত হলো। কেউ তাকে এক টানে নিজের সংস্পর্শে নিয়ে গেল। সোহা কাঁপছে অবিরাম। এই কাঁপুনির কারণ তার অজানা। সহাসয় নিজের কাছাকাছি সে যায় না। কিশোরী হওয়ার পর এই বোধহয় প্রথম নীল তাকে টাচ করল।
হাতের বাঁধন আলগা হলো ধীরে ধীরে।সোহার হাত ছেড়ে দিয়ে নীল তার দু কাঁধে নিজের দু হাত রাখল। আলতো স্বরে বলল,
“এভাবে কাঁপছিস কেন?আমি কী তোকে কিছু বলেছি?”
সোহা এখনো চুপ। চেয়েও কিছু বলতে পারছে না। সব কথা দলা পাকিয়ে কন্ঠনালীতে আটকে আছে। সোহা এবার হাসফাস করছে এখান থেকে মুক্তি নিয়ে জন্য। কিন্তু আমরা যেটা চাই সবসময় কী সেটা হয়? সোহাকে নীল ছেড়ে দিল ঠিকই কিন্তু পুরোপুরি নয়। সে সোহাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য পাশে ঘুরে দাড়াল। অতঃপর একটা অনাকাঙ্খিত বায়না জুড়ে দিল।বেলকনি থেকে ঘরের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে সে সোহাকে বলল,
“দুধ টা খেতে পারি তবে এক শর্তে।”
সোহা ততক্ষণে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। নীলের কথা শুনে চটজলদি বলে ফেলল,
“কী, কী শর্ত?”
নীল খাটের ওপর আরাম করে বসতে বসতে বলল,
“এই দুধটা তোর আমাকে খাইয়ে দিতে হবে নয়তো আমি খাব না।”
নীলের কথা শুনে সোহার চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম। সে ঈশৎ জোরে চিৎকার দিয়ে বলে,
“কিহহহ, আমি। এটা কী করে সম্ভব? আমি কখনো কাউকে খাইয়ে দেইনি। বরং আমাকেই সবাই খাইয়ে দেয়। তোমার মতো এত বড় একটা ছেলেকে আমি কী করে খাইয়ে দিব? ঢং না করে নিজের টা নিজেই খেয়ে নাও তো বাপু।”
“আচ্ছা বেশ৷ তারমানে তুই দিবি না। তবে ঠিক আছে নিয়ে যা ওই দুধ। তোর আম্মাকে গিয়ে বল আমার কোনো দরকার নেই এই দুধের।”
সোহা পড়ল মহা বিপদে। এই দুধ ফিরিয়ে নিয়ে গেলে তার আম্মা নির্ঘাত তাকেই বেশি কথা শুনিয়ে দেবে। ভাইপো বলতে অজ্ঞান কিনা। সোহা নীলকে মিনতি করে বলল,
“প্লিজ খেয়ে নাও না নীলাদ্রি দা। দেখো এটা ফিরিয়ে নিয়ে গেলে মা আমাকেই বকবে। প্লিজ খেয়ে নাও।”
নীলের এক কথা। সে কিছুতেই নিজ হাতে দুধটা খাবে না। সে গো মে’রে বসে থাকল। শেষমেশ উপায়ন্তর না পেয়ে অসহায় সোহা বাধ্য হলো নীলকে দুধটা খায়িয়ে দিতে। সোহা দুধের গ্লাসটা মুখে ধরতেই নীল খুব দ্রুত খেয়ে নেয়। বেশিক্ষণ ওয়েট করতে হয়না সোহাকে। খাওয়া শেষে নীল সোহাকে বলল,
“তোর কাজ শেষ। এখন তুই যেতে পারিস। আমি একটু ঘুমবো।”
সোহা কেমন জানি উশখুশ করছে। হয়তো কিছু একটা বলতে চাইছে। নীল সোহার হাবভাব বুঝতে পেরে বলল,
“কী হয়েছে কিছু বলবি?”
সোহা আমতা আমতা করে বলল,
“ওই, আসলে, ওভাবে বৃষ্টিতে ভেজার কী খুব বেশি প্রয়োজন ছিল? এখন যদি জ্বর আসে তখন কী হবে?”
“কী আর হবে। তুই বসে বসে সেবা করবি আমার।”
সোহা মুখে ভেংচি কেটে বলল,
“ইশ শখ কতো। বয়েই গেছে আমার আপনার সেবা করতে।”
“তাই বুঝি? বাই দি ওয়ে, তুই কী করে জানলি যে আমি বৃষ্টিতে ভিজে এসেছি? নিশ্চয়ই ফুপি বলেছে?”
“নাহ আম্মা বলেনি। আমি তখন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছিলাম। ঠিক সেসময়ই তোমাকে আসতে দেখি। আসতে যখন হতোই তখন গাড়ি নিয়ে আসতে পারতে তো। তাহলে অন্তত এতটা ভিজতে হতো না।”
“তা অবশ্য ঠিক কিন্তু অতো সময় ছিল না আমার হাতে তখন।”
“কেন কেন কী এমন ক্ষতি হতো একটু লেট হলে? তবু শরীর টাতে তো কোনো আঁচ আসত না।”
নীল কিছুক্ষণ চেয়ে রইল সোহার পানে। অতঃপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“কী হতো সেটা তুই বুঝবি না।”
নীলের গম্ভীর কণ্ঠ নাড়া দিয়ে গেল সোহার অন্তর। কেমন জানি মোচড় দিয়ে উঠল অন্তঃস্থল। সোহা আর কোনো দিরুক্তি করল না। ছোট্ট করে শুধু বলল,
“আমি তাহলে এখন যাই। পড়তে বসতে হবে।”
নীল শেষ বারের মতো বলল,
“শোন আরেকটা কথা…”
সোহা পেছন ঘুরল।
“বড় হচ্ছিস তো নিজেকে সামলাতে শিখ। কোনো ছেলেদের আশেপাশে ঘেঁষবি না। কাউকো তোর গায়ে টাচ করতে দিবি না।বুঝলি।সবসময় নিজেকে আগলে রাখবি।”
সোহার কৌতুহলী প্রশ্ন,
“কই আমি তো কারো কাছে যাই না। তবে এ কথা কেন বলছো?”
“সূর্যের সঙ্গে এত ঢলাঢলি কীসের তোর? সে আবার তোর হাতও ধরল। সবসময় ছেলেদের থেকে এক হাত দুরে থাকবি।”
“তাতে কী হয়েছে। সূর্য ভাই তো আমার ভাই। আমরা সবসময় এমন মজা করি। আর সে আমার ভাই হয়ে আমার হাত ধরতেই পারে। এতে দোষের কী? তুমিও তো একটু আগে আমার হাত ধরেছিলে কই তখনও তো আমি কিছু বলিনি।”
নীলের গাম্ভীর্যপূর্ণ উত্তর,
“সূর্য আর আমি কী এক?”
সোহা তব্ধ মে’রে গেল। সত্যিই তো সূর্য আর নীল কী এক? অবশ্যই এক। তারা দু’জনেই তো সোহার কাজিন। তবে সূর্য যখন হাত ধরে তখন তো সোহার মনে কোনো শিহরণ জাগে না। তবে নীল ধরলেই কেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়? উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল সোহা। সোহা যেতেই নীল মনে মনে আওড়ালো,
“কবে বুঝবি তুই গোলাপরানি এ মনের দহন?”
চলবে,