খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
156

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৩৭
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে চার দেওয়ালের আবদ্ধ কক্ষ। কক্ষের মধ্যে জীর্ণশীর্ণ দেহটা নিয়ে মিরাজুলের সামনে শুয়ে আছে আরিয়ান। মিরাজুল গম্ভীর দৃষ্টি মেলে আরিয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মনের একাংশে প্রতিশোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। মেহেভীন আরিয়ান আর রহমানের নামে নারী নির্যাতনের মামলা করেছে। সে খবর কর্ণকুহরে আসতেই পালিয়েছে সে। শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। তবুও প্রতিশোধের নেশা মস্তিষ্ককে নাড়া দিচ্ছে। রহমানের হাত ভেঙে গিয়েছে। সে পুলিশ হেফাজতে আছে। মিরাজুল নিজেই আরিয়ানকে পালাতে সাহায্য করেছে।

–পালালেন কেন? মিরাজুলের কথায় জ্বলে উঠল আরিয়ান। কর্ণ দিয়ে উত্তপ্ত হাওয়া বের হচ্ছে। হিম শীতের মধ্যেও ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা তৈরি হয়েছে। আরিয়ান রাগান্বিত হয়ে বলল,

–শা’লী পুলিশ কেস করে দিয়েছে। পুলিশ আমায় খুঁজছে আমি না পালালে শা’লী’কে কি মারতে পারব! তোমার মেহেভীনের ওপরে এত কিসের রাগ ক্ষতি করতে চাও কেন?

–আমার মেহেভীনের প্রতি কোনো রাগ নেই। আমি মেহেভীনকে ভালোবাসি। হাজারটা বসন্ত আমি মেহেভীনের সাথে পার করতে চাই। কিন্তু আমার সুখানুভূতিতে মুনতাসিম বিষাদ ঢেলে দিয়েছে। আমি মুনতাসিমকে মা’র’তে চাইছি। আমার অধরযুগলের দিকে তাকিয়ে দেখো এখনো ক্ষত রয়ে গিয়েছে। এই ক্ষতের দিকে যতবার দৃষ্টিপাত করি মন মস্তিষ্ক নাড়া দিয়ে বলে মুনতাসিমকে নিঃস্ব করে দে। আমি বহু কষ্ট মেহেভীনের গৃহ পর্যন্ত এসেছি। তোমার জন্য শুধু মাত্র মেহেভীনকে তুলতে পারলাম না। মিরাজুলের বাক্য গুলো কর্ণপাত হতেই আষাঢ়ের আঁধার আরিয়ানের মুখশ্রীতে ঘনিয়ে এল। সে নেতিয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল,

–মেহেভীনের সাথে আমার বিয়ে হবার কথা ছিল। কিন্তু আমাকে মেহেভীনের মায়ের পছন্দ না। মেহেভীনও আমাকে পছন্দ করে না। সেজন্য আমাকে সে বিয়ে করেনি। শুনেছি মন্ত্রী সাহেব মেহেভীনকে ভিষণ ভালোবাসে। মেহেভীনের মনের অন্তরালে মন্ত্রী সাহেবের জন্য সুপ্ত অনুভূতি কাজ করে। তুমি ভেবেছো এত ভালো কিছু রেখে আমাদের মতো পঁচা আলুর দিকে নজর দিবে মেহেভীন!

–পঁচা আলু আপনি হতে পারেন আমি না। যে ভাবেই হোক মেহেভীনকে আমার চাই। মেহেভীন আমার না হলে মেহেভীনকে ধরনীর বুক থেকে মুছে দিব।

–তাহলে তোমাকে একটা সুখবর দেই। মেহেভীনের বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে মন্ত্রী সাহেবের সাথে, মা এখনই মেসেজ করে জানালো। এবার বলো দু’জনকে পৃথিবী থেকে সরাতে আমাকে সাহায্য করবে কি না?

–যদি ধরা পড়ে যাই?

–তাহলে বিয়ের দিনটাই আমরা বেছে নেই। সেদিন এতএত মানুষের কোলাহল থাকবে। চারদিকে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন হবে। বাহারী রঙের মানুষের আনাগোনা হবে। এত এত মানুষের ভিড়ে কে তাদের মা’র’ল সেটার হদিস কেউ খুঁজে পাবে না। মিরাজুল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। যার জন্য মন গহীনে একটা সময় সুপ্ত অনুভূতি কাজ করেছিল। নিয়তির বিরুদ্ধে গিয়ে তাকেই মা’র’তে হবে।

–আপনি এই কয়টা দিন সুস্থ হয়ে নিন। আমি প্রস্তুতি নেই অনেক শ্রম দিতে হবে। কথা গুলো বলেই মিরাজুল কক্ষ ত্যাগ করল।

ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই বিষন্ন মন নিয়ে মুনতাসিম কক্ষ প্রবেশ করল। কক্ষে প্রবেশ করে বাবা উপস্থিত টের পেয়েও আগের ন্যায় নিজের কর্মে ব্যস্ত থাকলো। রিয়াদ চৌধুরী কিছু বলতে যাবে তখনই মুনতাসিম ফ্রেশ হতে চলে গেল। মুনতাসিম ফ্রেশ হয়ে আসতেই রিয়াদ চৌধুরী এক বিবাদিনীর বিষাদ মাখা মুখশ্রী মুনতাসিমের সামনে উপস্থাপন করল। মুনতাসিম আগের ন্যায় গম্ভীর মুখশ্রী করে বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। প্রেয়সীর এমন মলিনতায় ছোঁয়া মুখখানা ভেতরে অস্থিরতার ঝড় তুলে দিয়েছে। মুনতাসিম নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল।

–কিছু দেখতে পাচ্ছ?

–হ্যাঁ পাচ্ছি মেয়েটা ভিষণ অসুস্থ!

–আর কিছু দেখতে পাচ্ছ না?

–সুন্দর ফুলের পাপড়ি যদি পোকা খেয়ে ফেলে, তাহলে মানুষের দৃষ্টি আগে সেই পোকা খাওয়া পাপড়িতে গিয়ে পড়ে। ফুলের সৌন্দর্য ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য পোকা খাওয়া পাপড়িটা ছেঁটে দেওয়া উচিৎ। তবেই ফুলের আসল সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে।

–খুশি হওনি?

–আমার খুশির সাথে কি যায় আসে?

–রাগ করে আছ?

–আমার রাগ আছে?

–ধরনীর বুকে সবচেয়ে বড় মিথ্যা কথা মুনতাসিমের রাগ নেই! বিয়ে ঠিক করে এসেছি। আমি তো ভিষণ খারাপ বাবা। তাই ছেলের ছোট বেলার ইচ্ছেটা পূর্ণ করে আসলাম। কারো অনেক শখ ছিল মায়ের নাক ফুল দিয়ে লাল টুকটুকে বউ নিয়ে আসবে। কেউ সেটা ভুলে যেতে পারে কিন্তু তার মা ভুলে যায়নি। তার মা আমার কাছে ছেলের বউয়ের আমানত রেখে গিয়ে ছিল। এত গুলো বছরে সেই জিনিসটার সংস্পর্শে কাউকে আসতে দেইনি। যে জিনিসটার আসল মালিক সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিয়ে আসলাম। আগামী সপ্তাহে বিয়ে ঠিক করে এসেছি।

–দয়া দেখানোর দরকার ছিল না।

–আমি তোমায় পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম। তোমার ভালোবাসা ঠিক কতটা গভীর।

–তার জন্য মেয়ের প্রয়োজন ছিল না। সেই পথেই হাঁটলেন মাঝখানে কিছুটা জল ঘোলাটে করলেন।

–মেহেভীনের বাবা বাসায় নেই। সেজন্য তার সাথে কথা বলতে পারিনি। তোমার কাছে নাম্বার থাকলে দিও তো আমি কথা বলব। কথা গুলো বলেই রিয়াদ চৌধুরী কক্ষ ত্যাগ করছিলেন। তখনই মুনতাসিম ধীর কণ্ঠে ডাকল, আব্বা। রিয়াদ চৌধুরী থমকালেন। উৎসুক দৃষ্টিতে ছেলের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে।

–আপনাকে বিশ্বাস করে একটা কথা বলব। আপনি যদি বিশ্বাসের মর্যাদা রাখেন। তবেই বলব কথা না দিলে বলব না।

–তোমার বিষয়ে আমি কতটা সিরিয়াস তুমি জানো না। তুমি যতটুকু জানো তার থেকে-ও অনেক বেশি আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার ক্ষতি হবে তুমি আঘাত পাবে এমন কাজ করার আগে আমার মৃ’ত্যু হোক।

–বাজে কথা বলা বন্ধ করুন। কথাটা আপনার আর আমার মধ্যেই থাকে যেন। আর সবকিছু জানার পরে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার দায়িত্ব আপনার। রিয়াদ চৌধুরী চিন্তিত হলেন। তার ভেতরে দারুণ অস্থিরতা কাজ করছে। মুনতাসিম আগে কখনো তাকে এমন কথা বলেনি। তবে কি ভয়ংকর কিছুর সম্মুখীন হতে চলেছে? রিয়াদ চৌধুরী ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে।

–মেহেভীনের বাবা বেঁচে নেই আব্বা। মেহেভীনের বাবা খু’ন হয়েছে। আমাদের বিয়ের আগ পর্যন্ত কথা গুলো নিজের মধ্যে রাখবেন। মেহেভীনের মা আমার থেকে কিছু আড়াল করতে চান না। তাই সমস্ত সত্যি কথা আমাকে বলেছে। আপনি সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে আনন্দ করতে ভালোবাসেন। হয়তো প্রচন্ড রকমের বাড়াবাড়ি করতেন। তাই আপনাকে বলতে বাধ্য হলাম আন্টির সামনে এসব কথা বলে আমটিকে বিব্রত করার করবেন না। মেহেভীনকে ভালোবাসার চেষ্টা করবেন। তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ব্যক্তিটি হব আমি। রিয়াদ চৌধুরী বিস্ময় নয়নে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিমের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরানো। অদ্ভুত ভাবে আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে।

–মেহেভীন অসুস্থ জানলে কিভাবে?

–সব জানি আমি গিয়েছিলাম। আন্টি বললেন রাত করে দু’টো মেয়ে মানুষ বাসায় থাকে। মানুষজন দেখলে বদনাম রটাবে। তাদের মানসন্মানের কথা চিন্তা করে চলে এসেছি। প্রাপ্তির শশুর আর ভাই মিলে দু’জনকে মেরেছে। কথা গুলো কর্ণকুহরে আসতেই কলিজা কেঁপে উঠল রিয়াদ চৌধুরীর। বাক্য গুলো আজ শব্দ হারিয়েছে। অনুভূতিরা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। ভেতরে ভেতরে ভিষণ অনুশোচনা কাজ করছে। এই সময়ে কেন মুনতাসিমকে দূরে সরতে বলল। ছেলেটা তার আল্লাহর তৈরি শ্রেষ্ঠ নেয়ামত সবাইকে কিভাবে মিলেমিশে ভালোবাসতে হয়। সেটা তার ছেলের থেকে শেখা উচিৎ।

–আপনি যে বিয়ের কথা পাকা করে এসেছেন। এটা জানেন তো মেয়ে টার চাকরিটা আর নেই। বিয়ের পরে শোনার থেকে বিয়ের আগেই শোনা ভালো। বিয়ের পরে যেন মেয়ে টাকে কখনো কোনো কড়া বাক্যের সম্মুখীন হতে না হয়। আপনাকে আমি ভিষণ সন্মান করি। আমার মনে হলো কথা গুলো আপনাকে জানানো প্রয়োজন। বিয়ের পরে আপনার তরফ থেকে মেহেভীনের প্রতি অসম্মান আসলে, আমি সেটা সহ্য করতে পারব না। তাই মনের কথা কোনো কিছু থাকলে সরাসরি বলে দিন।

–আমার মেহেভীনের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। তবে সে তোমায় কষ্ট দিয়েছে। সেজন্য মনের গহীনে রাগ ছিল। কিন্তু যখন দেখলাম আমার ছেলের অধিকাংশ পরিবর্তনের কারণ মেয়েটা। তখন আমার ভুল ধারণা ভাঙলো। আমার ছেলের সুখের উর্ধে গিয়ে কিছুই হবে না। তোমার মতো করে মেয়েটাকে আগলে রাখতে পারব কি না জানি না। তবে তোমাকে সাহায্য করব যেন মেয়ে টাকে প্রয়োজনের থেকে একটু বেশিই আগলে রাখা যায়। কথা গুলো বলেই কক্ষ ত্যাগ করল রিয়াদ চৌধুরী। ভেতরটা ছিন্ন ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে তবুও যেন আরিয়ানের দেখা মিলছে না। যে হাতে মেহেভীনকে প্রহার করেছে। সে হাত দু’টো সে আগে কা’ট’বে তবেই রক্তাক্ত হৃদয়টা শুকাতে শুরু করবে। তাইয়ান মস্তক নুইয়ে বলল,

–এলাকার কোথাও নেই আরিয়ান। সিসি ক্যামেরাতে দেখা গিয়েছে মিরাজুল ভাই আরিয়ানকে নিয়ে পালিয়েছে। যেদিকে গিয়েছে সেদিকের এলাকা গুলোতেও খোঁজা নেওয়া হয়েছে পাওয়া যায়নি। তাইয়ানের কথায় মুনতাসিমের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এল। ক্রোধে চোয়াল শক্ত করে ফেলল। মস্তিষ্ক টগবগ করে উঠল। মিরাজুলের প্রতি ক্রোধের মাত্রা দ্বিগুন ভাবে প্রকোপ পেল। মুনতাসিমে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

–আমি একটা ঠিকানা দিচ্ছি তোমাকে সেখানে খোঁজ করো। তাইয়ান ঠিকানা নিয়ে কক্ষ ত্যাগ করল। মুনতাসিম আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের ক্রোধ সংবরন করার চেষ্টা করছে। কিছু স্নিগ্ধ অনুভূতির মধ্যে তিক্ত অনুভূতি এসে অনুভূতি নাম টাকেই বিষাক্ত করে তুলেছে। সেই বি’ষ বাতাসের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে মনটাকে ভিষণ পীড়া দিচ্ছে।

প্রভাতের আলো ফুটে গিয়েছে। গাছের মগডালে বসে পাখিরা সুর তুলতে ব্যস্ত। রোদের সোনালী আলোয় কুয়াশা বিলীন হতে শুরু করেছে। সময় স্রোতের ন্যায় ছুটে চলেছে। জীবন বদলায়, বাদলায় জীবনের গতিবেগ বদলায় না শুধু কিছু মানুষ মন। নির্ঘুম রজনী কাটিয়ে মেহেভীনদের বাসায় এসেছে মুনতাসিম। রাইমা বেগমকে বেশ সুস্থ দেখাচ্ছে। মুনতাসিমকে দেখে রাইমা বেগম মিষ্টি হেসে বললেন,

–তুমি এসেছ? কালকে রাস্তা থেকে চলে যেতে বললাম রাগ করোনি তো আবার। আসলে কালকে এতবড় ঘটনা হয়ে গিয়েছে। আশেপাশের মানুষ কেমন নজরে দেখছিল। আমি চাইনি আমাদের নিয়ে কেউ কোনো বাজে কথা বলুক।

–আমাকে এতটা কৈফিয়ত দিতে হবে না। ভালো-মন্দ বোঝার বুদ্ধি বিবেক দু’টোই আমার আছে। আপনার শরীর এখন কেমন আছে?

–আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছে। তুমি কালকে যে নার্সকে রেখে গিয়েছিলে মেয়েটা ভিষণ মিষ্টি। ডক্টর এসে কি যে ঔষধ দিয়ে গেল সকালে উঠে দেখি মস্তকের ব্যথা হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। কিন্তু অদ্ভুত দু’টো ডক্টরের ঔষধ খেলাম। কিন্তু পার্থক্য কতটা আলাদা! মুনতাসিম হালকা হাসলো কিছু বলল না।

–তুমি এখন মেহেভীনের সাথে দেখা করতে পারো। তুমি মেহেভীনের কক্ষে গিয়ে বসো। আমি রান্না ঘর থেকে আসছি। মুনতাসিম কোনো বাক্য উচ্চারন না করেই মেহেভীনের কক্ষের সামনে আসলো। মেহেভীন বিছানায় শুয়ে ফোনে স্ক্রোল করলছিল।

–আসব? মুনতাসিমকে দেখে মেহেভীন ফোন রেখে উঠে বসলো। রাগান্বিত হয়ে বলল,

–দয়া দেখাতে এসেছেন? আপনাকে কে বলেছিল আমাদের নার্স লাগবে? আপনি কেন কাল আমাদের বাসায় নার্স নিয়ে এসেছিলেন?

–এই প্রশ্নের উত্তর আমি সেদিন দিব। যেদিন আমি অসুস্থ হব আপনি ডক্টর ডাকবেন। অনুভূতি তো বলে প্রকাশ করা যায় না। তবে অনুভূতি পরিস্থিতি দিয়ে অনুভব করানো যায়।

–আপনি ভেতরে এসে বসুন। মা দেখলে আমাকে কথা শোনাবে।

–তার দরকার নেই দেখতে এসেছিলাম। এই যে দেখলাম এখন চলে যাব।

–চলে যাবেন কেন?

–যাব না বলছেন?

–একটা মেয়ে যখন রাগ করে বলবে কথা বলবেন না। তখন বুঝতে হবে এখন মেয়েটার সাথে জোর করে কথা বলতে হবে। একটা মেয়ে যখন বলবে আমার কারো ভালোবাসার প্রয়োজন নেই। তখন বুঝবেন মেয়েটাকে প্রয়োজনের থেকে একটু বেশিই ভালোবাসা দিতে হবে।

–থেকে ভালোবাসতে বলছেন?

–অদ্ভুত মানুষ তো আপনি!

–আপনার চিন্তা ভাবনা গুলো অদ্ভুত। তাই আমাকেও আপনার কাছে অদ্ভুত লাগছে।

–আপনার বাবাকে বলুন বিয়েটা ভেঙে দিতে।

–আপনার মাকে বলুন আপনাকে তুলে আ’ছা’র দিতে।

–আপনি ঝগড়া করতে এসেছেন?

–আমার মতো মানুষ ঝগড়া করতে পারে?

–আমি আপনাকে বিয়ে করব না।

–করবেন না সমস্যা কি সারাজীবন দেবদাস হয়ে থাকবেন।

–আমি অন্য কাউকে বিয়ে করব।

–তাহলে আমার হাতে খু’ন হওয়া প্রথম নারীটি আপনিই হবেন। আমি নিজেও বিয়ে করব না। আপনাকেও বিয়ে করতে দিব না। আর বিয়ে করতে মন চাইলে আমাকেই করতে হবে।

–স্যার আপনি দাঁড়িয়ে না থেকে কক্ষে এসে বসুন। আপনার সাথে আমার কয়টা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। সেগুলো শুনে আমাকে বাধিত করুন। মুনতাসিম বিলম্ব করল না গম্ভীর মুখশ্রী করে বসলো। মেহেভীন শান্ত কণ্ঠে বলল,

–আপনার বাবাকে বিয়েটা পেছাতে বলুন। আমার একটু সময়ের প্রয়োজন। আপনি তো সবকিছুই জানেন। সবকিছু জানার পরে-ও মায়ের সাথে তাল কেন মেলাচ্ছেন?

–বাচ্চাদের পড়াশোনার দেরি হয়ে যাচ্ছে তাই। মেহেভীন হতভম্ব হয়ে গেল। মুহুর্তের মধ্যে মেজাজ উত্তপ্ত হয়ে গেল। সে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। আর মানুষটা তাকে নিয়ে মজা লুটছে! মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই কিছু বাক্য কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাল।

“আমারে হারাইতে দিয়েন না ম্যাডাম। আমার মতো মায়া করে কেউ আপানারে চাইবে না। কথা গুলোর মধ্যে কত-শত আকুলতা দেখতে পেল মেহেভীন। মায়ায় জড়ানো কণ্ঠস্বর মেহেভীনের ভেতরে নাড়া দিয়ে উঠল। মেহেভীনের আঁখিযুগল মুনতাসিমের দিকে স্থির হয়ে আছে। কতদিন পরে মুনতাসিম তাকে আদুরে মাখা কণ্ঠে ম্যাডাম বলে ডাকলো!

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৩৮
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

উত্তপ্ত মেজাজ টগবগে মস্তিষ্ক রাগান্বিত চেহারার সামনে ঘৃণিত মুখশ্রী দেখে সমস্ত শরীর জ্বলে উঠল। ক্রোধের চোয়াল শক্ত হয়ে এল মুনতাসিমের। পিনপতন নিরবতা ভেঙে, সে সামনে থাকা নিকৃষ্ট মানুষটার দু’গাল চেপে ধরে হুংকার ছেড়ে বলল,

–তোর সাহস কি করে হয় আমার গার্ডদের খু’ন করার! তোকে আমার জ্যা’ন্ত পুঁ’তে ফেলতে ইচ্ছে করছে। শুধু মাত্র আব্বার জন্য তোর মতো জা’নো’য়া’র’কে বাঁচিয়ে রেখেছি। এতদিন আমাকে খু’ন করতে চেয়েছিস সবকিছু জানেও চুপ থেকেছি৷ কিন্তু এখন তুই মেহেভীনের দিকে নজর দিয়েছিস। আমি তোকে শেষ বারের মতো সাবধান করছি। মেহেভীনের ছায়ার পাশেও যেন তোর ছায়া না দেখি। যদি আমার কথার অবাধ্য হয়েছিস। আল্লাহর কসম করে বলছি তোকে খু’ন করতে দু’বার ভাবব না। মুনতাসিমের কথায় দাউদাউ করে জ্বলে উঠল ব্যক্তিটি। একদলা থুতু মুনতাসিমের মুখে ফেলতে যাবে। তখনই মুনতাসিম তার মুখটা মাটির দিকে বাঁকিয়ে ধরলো। থুতু গুলো গিয়ে ব্যক্তিটির পায়ে ওপরে পড়লো। প্রতিশোধের নেশা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে দ্বিগুন ভাবে প্রকোপ হচ্ছে। কাল বৈশাখী ঝড়ের ন্যায় নিজের শক্তি প্রয়োগ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বরাবরের ন্যায় সে ব্যর্থ হচ্ছে, সে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–তুই আমার ভালোবাসার মানুষের থেকে আমাকে আলাদা করেছিস। আমি তোকে তোর ভালোবাসার মানুষের সাথে সুখ থাকতে দিব। আমি যেভাবে না পাওয়ার দহনে পুড়ছি তোকেও সেভাবে পোড়াব। তবেই আমার শান্তি মিলবে। যখন তুই হারাবি তখন বুঝবি হারানোর যন্ত্রনা ঠিক কতটা। আমার প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোকে অভিশাপ দিতেই থাকবে। তুই কোনোদিন সুখী হতে পারবি না।

–আমি যদি অন্যায় করে থাকি, তাহলে আমার বিধাতা আমাকে শাস্তি দিবেন। আমার বিধাতা যদি আমায় দুঃখ দিয়ে খুশি হন। তার খুশিতেই আমার খুশি তোর মতো জা’নো’য়া’রে’র কথা আমার ভাগ্য পরিবর্তন হবে না। আমি তোর মতো কাপুরষ নই যে একজনকে ভালোবেসে আরেকজনকে ব্যাবহার করব। তারপর ব্যবহার শেষে ছুঁড়ে ফেলে দিব। তুই তো বাবা নামের কলঙ্ক তোর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। তুই যেমন নষ্ট পুরুষ তেমনই নিকৃষ্ট বাবা। তুই বাবা শব্দ টাকেও কলঙ্কিত করে দিয়েছিস। তোর আসল চেহারা সবার সামনে প্রকাশ পেলে সবাই তোকে ইট-পাথর নিক্ষেপ করে মা’র’বে। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিস না। যেদিন আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাবে। সেদিন আব্বা ও তোকে বাঁচাতে পারব না।

–কাপুরুষের মতো আমাকে ধরে রেখেছিস কেন? তোর বুকে সৎ সাহস থাকলে আমাকে ছেড়ে দিয়ে দেখা। ব্যক্তিটির কথায় মুনতাসিম তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল ফ্লোরে। ব্যক্তিটি ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে অদ্ভুত ভাবে হাসতে লাগলো। আঁখিযুগল দিয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে। ভেতর টা হাহাকারে ভরে গিয়েছে। সমস্ত শরীর জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। সে উঠে দাঁড়াল রক্তিম আঁখিযুগল গুলো স্থির হয়ে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিম রাগান্বিত হয়ে বলল,

–কি করবি কর? মুনতাসিমের কথায় ব্যক্তিটির মুখশ্রীতে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল। সে মলিনতার ছোঁয়ায় মাখা কণ্ঠে বলল,

–তোকে পোড়ালে শান্তি পাব না। যাকে পোড়ালে তোকে রক্তাক্ত করে দিতে পারব। আমি তাকেই পোড়াব পেয়েও হারানোর যন্ত্রনা কতটা সেটা তোকে প্রতিটি মুহুর্তে অনুভব করাব। মৃত মানুষ হারানোর চেয়ে জীবিত মানুষ হারানোর যন্ত্রনা কতটা পোড়ায় যেটা তোকে উপলব্ধি করাব। তোদের বিয়ের দিন কবুল বলার পর, মেহেভীন তোর গৃহ পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারল না। তার আগেই মেহেভীন শরীর টা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় কালো পিচ ঢালাই করা পথে লুটিয়ে পড়ে থাকলো। তখন তোর অনুভূতি কেমন হবে?ভয়ংকর ভাবে মুনতাসিমের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। ললাটে চিন্তার ভাজ পড়লো। মুনতাসিম শান্ত দৃষ্টিতে ব্যক্তিটির দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিমের শান্ত দৃষ্টি ব্যক্তিটিকে আরো উত্তপ্ত করে দিল।

–আমাকে নষ্ট বলেছিস না। এই নষ্টামি যদি তোর মেহেভীনের সাথে করি। কথা গুলো বলার সাথে সাথে ব্যক্তিটির গ’লা ছু’টি দিয়ে কে’টে দিল মুনতাসিম। এতক্ষণ ধরে ছু’টি আসার জন্য অপেক্ষা করছিল সে। গলায় আঘাত পেতেই গ’লা মুরগীর মতো ছটফট করতে লাগলো ব্যক্তিটি। মুনতাসিম তার পাশে বসে দারুন হেসে বলল,

–আপনার যাত্রা শুভ হোক মুনতাসিম কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী। এরপর থেকে কোনো কিছু বলার আগে ভেবেচিন্তে বলবেন। আপনি আমার বাবার ভালোবাসার মানুষ তাই মৃত্যুর আগে একটু সন্মান করে দিলাম। প্রসঙ্গ যখন মুনতাসিমের ভালোবাসা মানুষ। তখন মুনতাসিম ভয়ংকর রকমের পাষাণ। আমার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে কেউ কিছু বললে আমি অমানুষ হয়ে উঠি। আর একটা অমানুষ কি কি করতে পারে। সেই সম্পর্কে তোকে ধারণা দিতে হবে না। আমাকে উত্তপ্ত করার উপহার তোকে দিয়ে গেলাম। উত্তপ্ততা বেশি প্রকোপ হতে দিস না। তাহলে মাটির ওপরে না থেকে মাটির নিচে থাকবি। ব্যক্তিটি কিছু বলতে চাইল হাত বাড়িয়ে মুনতাসিমকে স্পর্শ করতে চাইল। কিন্তু তার শক্তি ধরা ছোঁয়ার বাহিরে গেল গেল। চারদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে। আঁখিযুগল ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। হৃদয়স্পন্দনের গতিবেগ কমতে শুরু করেছে। অশ্রুসিক্ত আঁখিযুগল বন্ধ হয়ে গেল। নিথর দেহটা মাটিতে পড়ে থাকলো। তাইয়ান গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–এভাবে থাকলে উনি মারা যাবেন স্যার। আমাদের দ্রুত উনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। আপনার বাবা জানলে গভীর ভাবে আহত হবেন। আপনি এতটা নিষ্ঠুর হইয়েন স্যার। আপনার এমন পাষাণ রুপই না আবার মেহেভীন ম্যাডামকে আপনার বাবার চোখে বি’ষ বানিয়ে দেয়।

–তোমাকে এসব নিয়ে এত ভাবতে হবে না তাইয়ান। আমি এখন কি করব না করব সেটা তোমার থেকে অনুমতি নিয়ে করতে হবে!

–স্যরি স্যার।

–আমি এতটাও গুরুতর ভাবে আঘাত করেনি। সাময়িক ভাবে জ্ঞান হারিয়েছে। ডক্টর ডেকে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করো। বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ না হওয়া অবধি তাকে চেয়ারের সাথে শক্ত করে বেঁধে রাখবে। বেশি বাড়াবাড়ি করার চেষ্টা করলে উল্টা করে ঝুলিয়ে রাখবে। আর একে কে সাহায্য করছে খুঁজে বের করো। সে যদি একবার আমার হাতে পড়েছে জীবিত বাঁচতে পারবে না। মুনতাসিমের কথা গুলো কর্ণকুহরে আসতেই তাইয়ানের অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। সুপ্ত অনুভূতি গুলো বিষাদের কালো মেঘে ঢাকা পড়ে গেল। তাইয়ানের সমস্ত মুখশ্রীতের আঁধার ঘনিয়ে এল। তা মুনতাসিমের দৃষ্টি এড়ালো না। মুনতাসিমের তাইয়ানের দৃষ্টির আড়ালেই রহস্যময় হাসিতে মেতে উঠল। সে দেখত চায় তাইয়ান কতদিন লুকোচুরির খেলা খেলতে পারে। তাইয়ান দোটানায় প্রতিটি মুহুর্ত পুড়তে পুড়তে কয়লা হয়ে যাচ্ছে। তাইয়ানের অসহায় মাখা মুখশ্রী মুনতাসিমকে শান্তি দেয়। সে দেখতে চায় তাইয়ানের ভালোবাসা তার প্রতি কতটা প্রখর। সে কতদিন দু’দিক এভাবে সামলাতে পারে। কথা গুলো ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মুনতাসিম।

রাইমা বেগম কক্ষে এসেই ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন। সমস্ত মুখশ্রীতে রক্তিম বর্ন ছড়িয়ে পড়েছে। হাসোজ্জল মুখশ্রী টা মুহুর্তের মধ্যে ক্রোধে ছেয়ে গিয়েছে। মেহেভীন বিস্ময় নয়নে মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মায়ের ক্রোধের কারন সে খুঁজে পাচ্ছে না। ভ্রু যুগল কুঁচকে মায়ের রক্তিম মুখশ্রী পর্যবেক্ষণ করছে। মায়ের নিরবতা মেহেভীনকে ভিষণ বিরক্ত করে তুলেছে। নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারল না মেহেভীন। বিরক্তি মাখা কণ্ঠে বলল,

–কি হয়েছে, আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?

–মুনতাসিমকে তুই কি বলেছিস? যে এতটা তাড়াহুড়ো করে চলে গেল কেন?

–আমি তাকে কিছুই বলিনি। তার একটা ফোন আসলো আর সে চলে গেল।

–মিথ্যা কথা বলছিস?

–তুমি ভালো করেই জানো মা। আমি মিথ্যা কথা বলি না। তোমার বিশ্বাস না হলে তুমি তাকে ফোন দিয়ে বলো। আমি তার সাথে কোনো রুপ বাজে আচরণ করেছি কি না।

–মুনতাসিম তোকে কি বলে গেল?

–আমি তাকে কয়টা দিন বিয়ে পেছাতে বললাম। সে আমাকে বলল সেটা সম্ভব নয়। আমাদের আড়ালে কিছু গোপন তিক্ততা আছে। সেগুলো সামনে আসলে পরিস্থিতি ভয়ংকর রুপ নিবে। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির সাথে আমি একা লড়াই করতে পারব না। আমি নাকি সামনে বড় ধরনের ধাক্কা খাব। সেই ধাক্কা খেয়ে যেন পড়ে না যাই সেজন্য সে আমার শক্তি হয়ে আমার পেছনে দাঁড়াতে চায়।

–আমার ছেলে টাকে ভিষণ ভালো লাগে। কি সুন্দর করে কথা বলে কেউ তার সাথে পাঁচ মিনিট ভালো করে কথা বললে, তার কথার মাথায় মায়ায় আঁটকে যাবে।

–তুমি আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য এত তাড়াহুড়ো কেন করছ আম্মু? কোনোভাবে আব্বুকে তুমি খু’ন করোনি তো আম্মু? রাইমা বেগম বিস্ময় নয়নে মেয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মায়ের চোখের ভাষা উপলব্ধি করতে পেরে মেহেভীন মস্তক নুইয়ে নিল। রাইমা বেগম কণ্ঠে গম্ভীরতা এনে বলল,

–আমি তোর মা তোর ক্লায়েন্ট না। বিয়ে ঠিক হবার পর থেকে তুই আমাকে একটার পর একটা জেরা করেই যাচ্ছিস। একজন মা তার সন্তানের কখনো খারাপ চাইবে না। আমিও তার ব্যতিক্রম নয়। যেদিন আমি থাকব না সেদিন বুঝতে পারবি মা কি জিনিস ছিল।

–আমি তোমাকে আঘাত করতে চাইনি মা।

–তুই মুনতাসিমকে খানিকটা অবহেলা আর অনেকটা অসম্মান দিয়েছিস। বিয়ের পরে এমন কোনো কাজ করিস না। যে ব্যবহারের জন্য আমাদের শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে স্বামীকে সন্মান করার চেষ্টা করবি। একটা মেয়ের পৃথিবীতে সবচেয়ে আপন কে জানিস? তার স্বামী! অবাক হচ্ছিস অবাক হবার কিছু নেই। তুই জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে পারবি। তোর জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যতগুলো মানুষ আসবে। তারা সবাই একটা সময়ের পরে জীবন থেকে চলে যাবে। কিন্তু স্বামী মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোর সাথে থেকে যাবে। সেই স্বামীকে দুঃখ দেওয়ার মতো দুঃসাহস আর করিস না মেহেভীন। মুনতাসিমের মতো ছেলে সবার ভাগ্যে জুটে না। আমি যতদূর চিনেছি মুনতাসিম খাঁটি সোনা। অনেক সময় মানুষের দেখায় ভুল থাকে। যদি কখনো মুনতাসিম পরিবর্তন হয়ে যায়। তোকে প্রতিনিয়ত আঘাত করতেই থাকে। তখন যদি আমি পৃথিবীতে না থাকি, তবে তুই কেয়ামতের আগ পর্যন্ত আমাকে অভিশাপ করতেই থাকবি। একজন সন্তানের দোয়া আল্লাহ তায়ালা দ্রুত কবুল করে নেন। তোকে বিয়ে করতে আমি বাধ্য করছি। হঠাৎ করে যদি তোর জীবনটা নষ্ট হয়ে যায়। তাহলে তার দায় সম্পূর্ণ আমার। তুই যতটুকু দুঃখ পাবি তার থেকে দ্বিগুন দুঃখ পাবার যোগ্য হব আমি। তোর বদদোয়ায় শাস্তির মাত্রা প্রকোপ পাবে। আমি জানিনা মৃত্যুর পরবর্তী জীবন কেমন হবে। তবে জীবনে যে পাপ গুলো করেছি। আমার জন্য অধিকতর ভয়াবহ হবে। আর যদি মনে করিস মা আমাকে সবচেয়ে ভালো কিছু দিয়ে গিয়েছে। তাহলে আমার জন্য দোয়া করিস। তোর দোয়ায় অন্তত কিছুটা হলে-ও শান্তি পাব। জীবনের এপর্যায়ে এসে মনে হবে মা আমার জন্য ভালো করেছে। নয়তো বা মনে হবে মা আমার জন্য খারাপ করেছে। যার সমাধান একটাই হবে বদদোয়া নয়তো বা ভালোবাসার দোয়া। তোর জীবনের সিদ্ধান্ত নিয়ে তোকে সামনের দিকে এগিয়ে দিলাম। ভবিষ্যতে খারাপ কিছু হলে কি করবি সেটার সমাধান ও বলে গেলাম। তোমার জীবন সুন্দর ও সুখময় হোক। মায়ের কথায় বাকরূদ্ধ হয়ে গেল মেহভীন। শব্দরা ভেতর থেকে না আসার পণ করেছে। অনুভূতিরা জোট বেঁধে পালিয়েছে। এই কথা গুলোর উত্তর দেওয়ার ভাষা জানা নেই মেহেভীনের। সে নিশ্চুপ রইল। রাইমা বেগম খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে উঠতে যাচ্ছিল। তখনই মেহেভীনের নজরে পরিচিত মানুষের মুখশ্রী ভেসে উঠল। মেহেভীন খপ করে মায়ের হাত থেকে খবরের কাগজটা কেঁড়ে দিল। তা দেখে রাইমা বেগম কিছুটা আঁতকে উঠল। মেহেভীন গভীর মনোযোগ দিয়ে লেখা গুলো পড়তে শুরু করল। লেখাগুলো পড়ার সময় মেহেভীনের শিরা-উপশিরা কেঁপে কেঁপে উঠছে। হাত-পা শীতল হয়ে আসছে। মনের অজান্তেই মানুষটার জন্য ভেতরটা হাহাকার করে উঠছে। অনুভূতিরা আজ শূন্য হয়ে গিয়েছে। আহত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ছবিটির দিকে দৃষ্টিপাত করে রাখালো মেহেভীন।

–মাহতাব আংকেল খু’ন হয়েছে! তার মতো সহজ সরল লোককে কে মারলো?

–কে সে? তুই কি তাকে চিনিস?

–আমি চিনব না আংকেল খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আমাকে অনেকটা ভালোবাসা দিয়েছে। এই মানুষটার সম্পূর্ণ জীবন মানুষের প্রতারণা আর অবহেলা পেতে পেতে শেষ হয়ে গিয়েছে। আমার না ভিষণ কষ্ট হচ্ছে আম্মু মানুষ এতটা খারাপ কিভাবে হয়!

–তার পরিবার কেস করেনি?

–আংকেল তো বিয়ে করেনি। শুনেছি আংকেল একটা মেয়েকে ভালোবাসতো। কিন্তু আতংকেলের বেস্ট ফ্রেন্ড আংকেলের ভালোবাসার মানুষকে কলঙ্কিত করে বিয়ে করেছে। আংকেল মেয়েটাকে এতটাই ভালোবাসতো যে আর দ্বিতীয় বিয়ে করেনি। আংকেলের কাছে তার ভালোবাসার মানুষটা ছাড়া নাকি সব নারী বিষাক্ত লাগে।

–তারপর সেই মেয়ে তোর আংকেলের কাছে ফিরতে চায়নি?

–চেয়েছিল কিন্তু আংকেল গ্রহণ করেনি। আংকেলের বেস্ট ফ্রেন্ড তার ভালোবাসার মানুষকে ঘুমিয়ে ঔষধ খাইয়ে ছিল ।তারপর সেই মেয়ের সাথে রাত্রী যাপন করে। পরের দিন সকাল বেলা পরিকল্পনা মাফিক সেই মেয়ের ঘর থেকে আংকেলের বেস্ট ফ্রেন্ড বের হয়। সমস্ত এলাকাবাসী তাদের দিকে জু’তা ছুড়ে মারে। আশ্রাব্য ভাষায় গা’লা’গা’লি করতে থাকে এলাকায় মিটিং বসে, সেখানে সিদ্ধান্ত হয়। তাদের দু’জনকে বিয়ে দেওয়া হবে। মেয়েটা নাকি সকলের পা জড়িয়ে ধরে কান্না করেছিল। সে এসব বিষয়ে কিছুই জানতো না সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। কিন্তু এলাকাবাসী তার কথা শুনেনি জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়।

–তারপর কি হলো?

–বিয়ের পরে মেয়েটা আংকেলের কাছে ফিরে এসেছিল। কিন্তু আংকেল তাকে ফিরিয়ে দেয়। তাকে বলে মানুষের জীবনে বিয়ে একবারই হয়। এমনিতেই মানুষ তাকে কটু কথা শোনাতে দ্বিধাবোধ করছে না। বিয়ের পরে সংসার ছাড়লে লোকে তাকে বাঁচতে দিবে না। একটা সুস্থ পরিবেশে তার সাথে সংসার করতে দিবে না। বিধাতা তার সাথে হয়তো তার জোড়া লিখেনি তাই তাদের মিলন হলো না। আংকেলের শেষ কথা ছিল, তুমি ভালো থেকো সুস্নিগ্ধা। ভালোবাসলেই যে পেতে হবে এর কোনো মানে নেই। ভালোবাসার মানুষের ভালো দেখেও ভালো থাকা যায়। আমার বন্ধু তোমাকে ভিষণ ভালোবাসে। সে তোমাকে অনেক ভালো রাখবে। সে তোমাকে ভালোবাসে বলেই এত ছলনা করল। আমি তাকে কোনোদিন ক্ষমা করব না। তবে তোমার খারাপ আমি চাইব না। পৃথিবীর সমস্ত সুখ তোমার হোক মায়াময়ী। তোমার ঐ সুখের মধ্যে আমি শান্তিতে বসবাস করব। যেদিন তোমার জীবনে সুখ ফুরাবে। তোমার জীবনে দুঃখের আবির্ভাব ঘটবে। তোমার হারানোর সুখের সাথে সাথে আমিও বিলীন হয়ে যাব। যে সংসার তৈরি হয়ে গিয়েছে। সে সংসার তুমি নষ্ট করো না। আমি পরপারে তোমার জন্য অপেক্ষা করব। এই জনমে পাইনি তো কি হয়েছে। মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে তোমাকে আমার করে নেওয়ার জন্য বিধাতার কাছে আর্জি করব। এতটুকু বলেই আংকেল চলে যায়। তারপর আর দু’জনের দেখা মেলেনি। জীবন কি অদ্ভুত তাই না মা একজন বিয়ের করে সংসার করছে। আর একজন তাকে না পাওয়ার বিরহে আস্ত একটা জীবন গোটা একা কাটিয়ে দিল।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৩৯
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

সুখানুভূতিকে ঢেকে নিয়েছে বিষাদের কালো মেঘের দল। একটু টুকরো সুখকে দুঃখ তার চাদরে মুড়িয়ে নিয়েছে। আনন্দিত হৃদয়ের ভেতর থেকে আনন্দ শুষে নিয়ে একরাশ তিক্ততা বিরাজ করছে। মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ পরিবেশটা মুহুর্তের মাঝে কালো মেঘের ন্যায় আঁধারে রুপ নিল। চারদিকে নিস্তব্ধতার মেলা বসেছে। অনুভূতিরা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। শব্দ গুলো আজ ছন্দ হারিয়েছে। কিছু তিক্ত সত্য বুকের ভেতরটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। ভেতরটা যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে প্রতিটি মুহুর্তে ম’র’ছে। মনের শহরের অলিতে-গলিতে হাহাকার ছড়িয়ে পড়েছে। পিনপতন নিরবতা ভেঙে রাইমা বেগম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,

–তোর আংকেলের সাথে তো ভিষণ খারাপ হয়েছে। একটা সত্যি কথা কি জানিস মেহেভীন? ভালো মানুষের সাথেই সব সময় খারাপ হয়। আর ভালো মানুষ গুলোও বেশিদিন বাঁচে না। বাক্য গুলো কর্ণপাত হতেই মেহেভীনের মুখশ্রীতে মলিনতার ছায়া দেখা গেল। বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠল। আজকাল ভেতরটা ভিষণ খালি খালি লাগে। বাবার শূন্যতায় ভেতরটা জ্বলে পুড়ে দগ্ধ হয়ে যায়।

–তাহলে আমার বাবাও কি ভালো মানুষ ছিল মা?

–হয়তো ছিল, কে জানে শেষ বয়সে এসে এমন হয়ে গেল কেন? সে না বদলালে আমরা জীবনে আরো কয়টা সুন্দর বসন্ত পার করতে পারতাম। এসব কথা ভেবে নিজেকে দুর্বল করে তুলিস না। এই কয়টা দিন নিজের যত্ন নিবি না হলে পরের ঘরে গেলে সবাই বলবে, আমরা মেয়েকে ঠিকমতো খেতে দেইনি। কথা গুলো বলেই রাইমা বেগম স্থান ত্যাগ করল। মেহেভীন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার কাছে চলে গেল। এক ফালি রৌদ্রের আলো এসে মেহেভীনের মুখশ্রীতে আঁচড়ে পড়লো। মেহেভীন পরম আবেশে আঁখিযুগল বন্ধ করে রাখল। সমস্ত মুগ্ধতা যেন মেহেভীনের মুখশ্রীতে এসে ধরা দিয়েছে। মনে পড়ে গেল সেই খোলা জানালার দক্ষিণের কথা, পাশে দৃষ্টিপাত করতেই হতাশ হলো মেহেভীন। কিন্তু সুন্দর স্মৃতি মুখশ্রীর সামনে ভেসে উঠল। কত-শত স্নিগ্ধ অনুভূতির সাক্ষী সেই বাড়ির জানালাটা। সেই জানালা পাশ থেকেই দেখা মিলেছিল একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মানুষের। যার আগা থেকে মাথা পর্যন্ত দুষ্টিতে ভরা। যার প্রধান কাজই ছিল তাকে বিরক্ত করা। সেই মুহুর্ত গুলো যেন চোখের পলকে হাওয়ার সাথে মিলিয়ে গেল। প্রতিদিন প্রভাতের আলো ফুটতেই দেখা হবে না, খোলা জানালার দক্ষিণের পাশে অবস্থান করা মানুষটা এসেছে কি না। চন্দ্রা আলোকিত রজনীতে মানুষটার সাথে সুখানুভূতি আদান-প্রদান করা হবে না। মানুষটার অপেক্ষায় চাতক পাখি ন্যায় প্রতীক্ষা করতে হবে না৷ কথা গুলো ভাবতেই তিক্ত অনুভূতি এসে মনে হানা দিল।

জাফর ইকবাল সুন্দরী রমনীর বুকে আস্তরণে শয়িত ছিলেন। তার সুন্দর মুহুর্ত বিষাদ করে দিয়ে কবাটে কেউ কড়া নাড়ে। জাফর ইকবালের মুখশ্রীতে বিরক্তির ছাপ ফুঠে উঠল। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। সে কড়া ভাবে গৃহের প্রতিটি মানুষের কর্ণ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। তার ব্যক্তিগত মুহুর্তে কেউ যেন তাকে বাধাগ্রস্ত না করে। গায়ে বস্ত্র পরিধান করে কবাট খুলে দিতেই পরিচিত মুখশ্রী ভেসে উঠল। সে অধরের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল,

–সায়ান যে, কি তথ্য নিয়ে এসেছ তুমি?

–আপনার জন্য একটা গরম খবর আছে স্যার। সেজন্য আপনার অন্তরঙ্গ মুহুর্তে বাঁধা প্রদান করতে বাধ্য হলাম। আমার ভুল ত্রুটি মার্জনা করবেন। মন্ত্রী সাহেব বিয়ে করছেন আমাদের হাতে একটা দারুন সুযোগ এসেছে। এই সুযোগটা যদি লুফে নিতে না পারি। তাহলে সারাজীবন আমাদের মুনতাসিমের পেছনে পড়ে থাকতে হবে। বিয়ের অনুষ্ঠানে শতশত মানুষ থাকবে। এত এত মানুষের মধ্যে যদি মুনতাসিমের সমস্ত কায়া ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেওয়া যায়। কারো বাবার ক্ষমতা হবে না আমাদের ধরার। সায়ানের কথায় জাফর ইকবালের বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠল। সে হাসোজ্জল মুখশ্রী করে বলল,

–মানুষের দুর্বলতা তৈরি হতে দেওয়ার জন্য আমাদের সময় নেওয়া উচিৎ। শক্ত মানুষকে এত সহজে ভাঙা যাবে না। আমাদের মেইন পয়েন্ট ধরে দুর্বল জায়গায় আঘাত করতে হবে। যেন ভাঙলে এমন ভাবে ভাঙে কায়ার সমস্ত হাড়গুলো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়। সেই ভাঙা কায়া নিয়ে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন করার ক্ষমতা সারাজীবনের জন্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। প্রেম মানুষকে বাঁচতে শেখায় আবার প্রেমই মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর করে। অতিরিক্ত ভালোবাসার পরে ,মানুষটা হুট করে জীবন থেকে মর্মান্তিক ভাবে হারিয়ে গেলে বিপরীতে পক্ষের মানুষটা আঘাত ছাড়াই রক্তাক্ত হয়ে যায়। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি ক্ষয় হয়ে যায়। সবার প্রিয় মুনতাসিম আরো একটু গভীর প্রেমে মজুক। সুযোগ বুঝে আমরাও তার প্রেয়সীকে লুটে নিব। মুনতাসিম এমনিতেই ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। কথা গুলো কর্ণপাত হতেই সায়ান মৃদু হেসে চলে গেল। জাফর ইকবাল গানের সুর তুলতে তুলতে আস্তরনে এসে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে মেতে উঠলেন।

চারদিক সুখ সুখ অনুভূতিতে মেতে উঠেছে। মুনতাসিম আর মেহেভীনের বিয়ের বার্তা পুরো এলাকায় ছড়িয়ে গিয়েছে। সবাই মেহেভীনকে দেখতে আসছে। মেহেভীনের ভিষণ বিরক্ত লাগছে। একই এলাকার মানুষ ছোট থেকেই দেখে আসছে। সেই মানুষকে নতুন করে দেখার কি আছে? নাকি তার রুপ নতুন করে রুপ বদল করেছে। যার জন্য সবাই তাকে দলে দলে দেখতে আসছে। মেহেভীনের বাবার খোঁজ পড়লে সবাইকে জানানো হয়েছে। মেহেভীনের নানি ভিষণ অসুস্থ সেজন্য তাকে সেখানে থাকতে হচ্ছে, বিয়ের দিন এসে উপস্থিত হবেন। সবাই বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে। কারন ফরিদ রহমান এর আগেও বহু বার মেহেভীনের নানা-নানির দেখা শোনা করেছে। গৃহ ভর্তি মেহমান গিজগিজ করছে। কালকে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে হবে। সমস্ত গৃহে ফুল আর মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। মেহেভীন আর মুনতাসিমের মতো নতুন ভাবে সেজেছে দু’টো গৃহ। রিয়াদ চৌধুরী ছেলের বিয়ের কোনো ত্রুটি রাখেনি। রাজকীয় ভাবে বিয়ের আয়োজন করেছেন। চৌধুরী গৃহের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই মুগ্ধতা এসে আঁখিযুগলে ধরা দিচ্ছে। যে কেউ দেখলে বলবে, কোনো এক রাজ্যের রাজার বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। রাজপ্রাসাদের ন্যায় গৃহটা রঙবেরঙের ফুল আলো দিয়ে সেজে উঠেছে। তার সৌন্দর্য দিয়ে মানুষের হৃদয়কে আকৃষ্ট করতে বাধ্য করছে। বিবাহের দু’দিন আগেই এত মানুষের আনাগোনা এত এত কোলাহল! বিয়ের দিন কি অবস্থা হবে? গোলাপ আর রজনীগন্ধার সুবাস সবাইকে মাতাল করে তুলছে। চারিদিকে কাজের তোরজোর চলছে। মেহেভীন নিজের কক্ষে বসেছিল। একদল মহিলা তাকে ঘিরে রেখেছে। ভালোমন্দ আলোচনা করছে। সে মন্ত্রীর বউ হবে এটা তাদের কাছে বিশাল ব্যাপার। সবার এত বাড়াবাড়ি মেহেভীনের মেজাজ উত্তপ্ত করে দিচ্ছে। সে একটু নির্জন স্থান খোঁজয় ব্যস্ত তবে আজ নির্জনতা পথ হারিয়েছে। কিছুতেই সে মেহেভীনের সামনে ধরা দিচ্ছে না। তখনই মুঠোফোনটা জানান দেয়। সে কারো বার্তা নিয়ে এসেছে। ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো মুনতাসিম মেসেজ করেছে।

–কি করছেন ম্যাডাম?

–আপাতত একটু নির্জন জায়গায় খুঁজছি। এত কোলাহল এত মানুষজন মস্তকে ব্যথা তুলে দিয়েছে।

–আমি আসব? আমি আসলেই নির্জনতা চলে আসবে।

–তার আগে বলুন, সেদিন ভূতের মতো গায়েব হয়ে গেলেন আর খোঁজ নিলেন না কেন? সেদিন কোথায় গিয়ে গিলেন?

–কারো মধ্যে বউ বউ ভাব পাচ্ছি।

–কেন বউ হবার মতো ভাব আমার নেই?

–এত সুন্দর একটা মেয়ে! আপনি কেন সব সময় রেগে রেগে কথা বলবেন? আপনি সব সময় হেসে হেসে কথা বলবেন। আপনার মুখশ্রীতে ক্রোধ মানায় না ম্যাডাম। আপনি হাসলে আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে।

–ফ্লাট করছেন আমার সাথে?

–না বউকে বোঝাচ্ছি। তাকে হাসলে ভিষণ সুন্দর লাগে, তার মুখের এক টুকরো হাসি আমার অশান্ত হৃদয়ের প্রশান্তির হাওয়া। মুনতাসিমের কথায় অদ্ভুত ভাবে মেহেভীনের সমস্ত কায়া কেঁপে উঠল। হৃদয়স্পন্দনের ক্রিয়া অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেল। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি! সেই অনুভূতির সাথে পরিচিত নয় মেহেভীন। নতুন এক অনুভূতির সন্ধান পেল মেহেভীন। সে কণ্ঠে স্নিগ্ধতা নিয়ে এসে বলল,

–আপনি ঘুমাবেন না? সকালে যখন আপনাকে হলুদ মাখাবে একটা ছবি দিয়েন। আমি দেখব আপনাকে কেমন দেখায়?

–ভালো না দেখালে বিয়ে করবেন না?

–আমি বলেছি সে কথা! আমি কি আপনাকে দেখতে চাইতে পারি না।

–বহু আগেই চোখ দিয়ে আমার সর্বনাশ করে রেখেছেন। যতটুকু সন্মান আছে বাকিটুকু সর্বনাশ করার ধান্দা। মুনতাসিমের কথায় মনের অজান্তেই লজ্জা পেল মেহেভীন। সেটা প্রকাশ না করে রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আচ্ছা অসভ্য লোক তো আপনি! আপনার মেসেজেই রিপ্লাই-ই আর করব না। মেসেজটা পাঠিয়েই মুঠোফোনটা বালিশের নিচে রেখে দিল। মেহেভীনের কান্ড দেখে সবাই মিটমিট করে হাসছে। কেউ কেউ রসিকতা শুরু করে দিয়েছে। এত আনন্দ এত সুখ সইবে তো? কথা গুলো ভাবতেই মেহেভীনের বুকটা ভারি হয়ে আসলো। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ বসে থেকে সবাই কথা শুনতে লাগলো।

চারিদিকে প্রভাতের আলো ফুটতে গিয়েছে। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজকের দিনটা একটু অন্য রকম। রজনীর শেষ প্রহর থেকে রান্নার কার্যক্রম শুরু হয়ে গিয়েছে। রান্নার টুংটাং ধ্বনি কর্ণকুহরে এসে বাড়ি খাচ্ছে। বাচ্চারা হৈ হুল্লোড় করছে খেলাধূলা করে সমস্ত গৃহ মাতিয়ে রেখেছে। আগের তুলনায় দ্বিগুন মেহমান এসে বাড়ি ভরে গিয়েছে। মুনতাসিমকে শুভ্র লুঙ্গি আর সেন্ডো গেঞ্জি পরিধান করিয়ে কাঁধের ওপরে লাল গামছা পড়িয়ে ছাদে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হলুদের আয়োজন ছাদেই করা হয়েছে। নিচে করার মতো অবস্থা নেই। তাই রিয়াদ চৌধুরী ছাদ টাকেই বেছে নিয়েছে। মাশরাফি, শেহনাজ, তাহিয়া, রিনি, আরো কিছু বয়স্ক মহিলারা যাচ্ছে মুনতাসিমের সাথে। শেহনাজ গান গাইছে শেহনাজের সাথে সুর মেলাচ্ছে মাশরাফি। তাহিয়া চুপচাপ তাদের সঙ্গ দিচ্ছে। বৃদ্ধারা বলছে,

–আজকালকার পোলা মাইয়ারা গানের তালে তালে হলুদ লাগায়। আর আমাগো সময় কত আনন্দ কইরা গীত গাওয়া হইতো। সে-সব আজকাল উইঠা গেছে। তোরা গান বাজনা যা করার করবি। আমরা গীত গাইয়া আগে হলুদ লাগামু। তারপর বাচ্চারা হলুদ দিবি কি কইছি বুঝছোস তোরা? শেহনাজ একটা বৃদ্ধার গাল টেনে বলল,

–সমস্যা নেই দাদি যতরকমের গীত আছে সব গাইবে। তোমাদের হলুদ লাগনো শেষ হলে, আমরা নাচ গান করে হলুদ অনুষ্ঠান শুরু করব। মুনতাসিমকে ছাদে নিয়ে এসে বসানো হলো। বৃদ্ধারা গীত গাইছে আর হলুন দিচ্ছে অদ্ভুত ভাবে মুনতাসিমের ভিষণ লজ্জা লাগছে। সমস্ত মুখশ্রীতে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে। বৃদ্ধাদের পালা শেষ হলে সবাই আস্তে আস্তে হলুদ মাখিয়ে দিল। মুনতাসিমের সাথে সবাই হলুদ মাখায় মেতে উঠল। শেহনাজ আর মাশরাফি গানের তালে তালে নাচছে। তাদের সাথে একদল ছেলেমেয়ে এসে যোগদান করল।শীতের সকালের ঠান্ডা পানি কায়াতে পড়তেই সমস্ত কায়া কেঁপে উঠল। কলসি দিয়ে মুনতাসিমের মস্তকে পানি ঢালা হচ্ছে। হলুদের কাজ সম্পূর্ণ হলেই মুনতাসিম নিজে নেমে আসলো। কক্ষের এসে ভালোভাবে গোসল করে বস্ত্র পরিধান করে নিল। তার ছোঁয়ানো হলুদ নিয়ে সবাই মেহেভীনের গৃহের উদ্দেশ্য বের হবে। মেহেভীনকে হলুন শাড়ি পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সমস্ত কায়াতে তাজা সতেজ গাঁদা ফুলের অলঙ্কার বানিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই মেহেভীনকে দেখে দোয়া করে দিচ্ছে। রাইমা বেগম মেয়ের দিকে মুগ্ধ নয়নে দৃষ্টিপাত করে আছেন। তার মেয়েকে পরীর থেকে কোনো অংশে কম লাগছে না। মেয়ের হাতে কামড়ে দিতে ইচ্ছে করছে, যেন তার মেয়ের সৌন্দর্যে কারো নজর না লাগে। মেহেভীনকে হলুদের আয়োজনের মাঝখানে বসিয়ে দেওয়া হলো। সেখানে নানা রকমের মিষ্টি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। রঙবেরঙের ফল কে’টে সুন্দর সুন্দর ডিজাইন করে সাজিয়ে রেখেছে। সবাই আসছে মেহেভীনকে মিষ্টি খাইয়ে দিয়ে দোয়া করে টাকা দিয়ে চলে যাচ্ছে। মেহেভীন অসহায় দৃষ্টিতে মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। এতএত মানুষের আনাগোনা তবুও তার ভেতরটা খালি খালি লাগছে। ভিষণ করে বাবার করে মনে পড়ছে। বাবার কথা স্মরণ হতেই ভেতরটা ভিষণ জ্বালা পোড়া করছে। আঁখিযুগলের কার্ণিশে অশ্রুকণা এসে জমাট বাঁধল। এর মধ্যেই হৈচৈ শোনা গেল হলুদ এসে গিয়েছে। শেহনাজ এসেই মেহেভীনের পাশে বসলো। মেহেভীনের ডান হাত ধরে বলল,

–আমি ভাবির ডান হাতে মেহেদী দিয়ে দিব। তোরা কে বাম হাতে দিয়ে দিবি ঠিক কর। একদম আমাদের সাথে ঝামেলা করতে আসবি না। তাহলে ভাইকে বলে সবার অবস্থা খারাপ করে ফেলব। মুহুর্তের মধ্যে মেহেদী দেওয়া নিয়ে ঝামেলা বেঁধে গেল। হলুদ বড়দের হাতে দেওয়া হয়ে গিয়েছে। তাদের ঝামেলার মাঝেই একজন বলল,

–অবিবাহিত মেয়ে গুলো সইরা যাও। আমরা হলুদ দিয়া চইলা যাই। তারপর তোমরা সবাই মিইলা মেন্দি পড়াইয়া দিও। মহিলাটির কথায় কয়েকজন সরে গেল। মেহেভীনকে হলুদ পড়িয়ে দিয়ে সবাই সরে যেতেই সবাই মেহেভীনের হাত নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে গেল। অবশেষে চারজন মিলে ঠিক করল তারাই মেহেদী পড়াবে। শেহনাজ খুব সুন্দর করে মেহেদী পড়াতে পারে। সবাই মেহেভীনকে মেহেদী পড়িয়ে দিচ্ছে। মেহেভীন চুপচাপ বসে বসে দেখছে, মুখ দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারন করছে না। রাইমা বেগম মেয়েকে ভরসা দিতে একটু পর পর এসে দেখে যাচ্ছে। মেহেভীনের দু’হাতের মাঝখানে মুনতাসিমের নাম লিখে দেওয়া হয়েছে। মেহেদী পড়ানো শেষ করে, সবাই নিজদের মতো করে আড্ডায় মেতে উঠেছে। এত সুখ এত আনন্দ তবুও কোথাও জানি, মেহেভীনের ভেতরটা শূন্যতা অনুভব করছে। অদ্ভুত ভাবে আঁখিযুগল দিয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে। এমন অনুভূতি সে আগে কখনো অনুভব করেনি। তবে আজ কেনো তার এত কষ্ট হচ্ছে? প্রশ্নের গভীরে গিয়েও উত্তর পাইনি সে। মনের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে