খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
174

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৩১
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

সময় তার নিয়মে স্রোতের ন্যায় ভেসে চলে যাচ্ছে। নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে কিছু মানুষের হৃদয়। ভারাক্রান্ত মন ছন্নছাড়া মস্তিষ্ক নিয়ে কারো সাথে কথোপকথনে ব্যস্ত মুনতাসিম। তখনই দরজা জানান দেয় কেউ তাকে স্মরন করছে। বিরক্তিতে মুনতাসিমের মুখশ্রী কুঁচকে আসে। সে গম্ভীর কণ্ঠে ভেতরে আসার অনুমতি দিল। তাইয়ান কক্ষে এসে বিস্ময় কণ্ঠে বলল,

–আপনার সাথে দেখা করতে মেহেভীন ম্যাডামের আম্মু এসেছেন। দীর্ঘ এক ঘন্টা ধরে আপনার জন্য নিচে বসে অপেক্ষা করছেন। আপনি যদি একটু নিচে আসতেন। তাইয়ানের কথায় মুনতাসিমের মুখশ্রীতে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো। সে রাগান্বিত হয়ে বজ্রকণ্ঠে বলল,

–আমাকে এখন বলছ কেন? কথা গুলো বলেই মুনতাসিম হন্তদন্ত হয়ে কক্ষের বাহিরে চলে গেল। ড্রয়িং রুমে মেহেভীনের আম্মু বসে আছে। প্রাপ্তি এসে রাইমা বেগমের গা ঘেঁষে বসে আছে। প্রাপ্তির কর্মকাণ্ডে রাইমা বেগম ভিষণ বিরক্ত। তখনই মুনতাসিম নিচে আসে মুনতাসিমকে দেখে রাইমা বেগম সালাম দেয়। মুনতাসিম সালামের উত্তর নিয়ে নিজেও সালাম দিল। সে কুশল বিনিময় করে বলল,

–আপনি আমার কক্ষে এসে আপনার কথা গুলো বলতে পারেন আন্টি। এখানে বিরক্ত করার অনেক মানুষ আছে। আমার কাজে ব্যাঘাত ঘটানো মানুষ গুলোকে আমি একদম পছন্দ করি না। মুনতাসিমের কথায় প্রাপ্তির মুখশ্রী অপমানে থুবড়ে গেল। ক্রোধে চোয়াল শক্ত হয়ে এল তার। মুনতাসিমের কথার ওপরে কথা বলার সাহস নেই বিধায় দাঁতে দাঁত চেপে কথা গুলো সহ্য করল। সে কোনো কথা না বলে হনহন করে উঠে চলে গেল। মুনতাসিম তাইয়ানকে নাস্তা বানানোর কথা বলে রাইমা বেগম কে উপরে যাওয়ার জন্য আহবান জানাল। মুনতাসিম আগে আগে হাঁটছে আর রাইমা বেগম পেছনে পেছনে হাঁটছে। মুনতাসিম নিজের কক্ষে এসে সোফায় রাখা ল্যাপটপ টা গুছিয়ে রাখল। রাইমা বেগম দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,

–আমি কি ভেতরে আসতে পারি স্যার? রাইমা বেগমের কথায় মুনতাসিম লজ্জায় পড়ে গেল। সে দ্রুত উত্তর করল,

–আমি আপনার ছেলের মতো এভাবে স্যার সম্মোধন করে আমাকে ছোট করবেন না আন্টি।

–আপনি কত বড় মাপের মানুষ আপনাকে অসম্মান করে কথা বলার ক্ষমতা আমার আছে। আপনি আপনার বাসায় আমার প্রবেশ করতে দিয়েছেন। আপনার কক্ষে বসতে দিয়েছেন। এটাই তো আমার ভাগ্য ভালো জিনিসের কদর সবাই করে সে বড়ো হোক বা ছোট। রাইমা বেগমের কথায় মুগ্ধ হলো মুনতাসিম। মানুষটা মুহুর্তের মধ্যে যে কারো মন কেঁড়ে নিতে পারে তার কথার মুগ্ধতা দিয়ে, মুনতাসিম একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মনে মনে বলল, “আপনি ঠিকই আমার মূল্যটা বুঝলেন। কিন্তু আপনার মেয়ে বুঝল না। সে যদি আপনার মতো করে আমায় বুঝতো। তাহলে আমাদের জীবনটা আজ অন্য রকম সুন্দর হতো। কথা ভাবতেই বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। নিজেকে স্বাভাবিক করে কোমল কণ্ঠে রাইমা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–আপনি আমায় তুমি করে বলতে পারেন। আপনি আমার বড় হয়ে আমাকে আপনি বলে সম্মোধন করছেন। এতে আমার ভিষণ খারাপ লাগছে। মুনতাসিমের কথা গুলো কর্ণপাত হতেই রাইমা বেগম হালকা হাসলো। ছেলেটা ভিষণ সুন্দর ভাবে কথা বলতে জানে। কথার মধ্যে কত সুন্দর ভদ্রতা বিরাজ করে। রাইমা বেগম মস্তক নুইয়ে মাটির দিকে দৃষ্টি স্থীর করল। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলতে শুরু করল,

–আমি খবর নিয়ে জেনেছি। যে মেহেভীনের কেসটা নিয়ে তদন্ত করছে। সে আপনার বন্ধু হয় মূলত আপনিই তাকে রেফার করেছেন। আমি চাই আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত পৌঁছে যেতে আপনি নেহাল স্যারকে সাহায্য করুন। আপনার অনেক ক্ষমতা যে কাজটা আমরা একমাসে করব৷ সেই কাজটা আপনার এক ফোনে সাতদিনেও হতে পারে আবার একদিনেও হতে পারে। আপনি যদি আমার মেয়ের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করতেন। তাহলে আমি সারাজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। তার বিনিময়ে আপনি যা চাইবেন আমি আপনাকে সেটাই দিব কথা দিলাম। রাইমা বেগমের কথায় মুনতাসিম চমকে উঠল। রাইমা বেগম এত তথ্য পেল কোথায়! মুনতাসিম বিস্ময় নয়নে রাইমা বেগমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। রাইমা বেগমের শেষ কথাটা কর্ণকুহরে আসতেই মুনতাসিমের হৃদয়ে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেল। সে আগের ন্যায় নরম কণ্ঠে জবাব দিল,

–আপনি সত্যি কথা বলছেন? আমি যা চাইব আপনি আমায় সেটাই দিবেন!

–একবার চেয়ে দেখুন। বলুন আপনার কি চাই?

–সময় মতো চেয়ে নিব। ততক্ষণ আপনার অপেক্ষা করতে হবে।

–বেশ তবে তাই হবে। আমি আপনার চাওয়ার অপেক্ষায় থাকব।

–আপনি চিন্তা করবেন না। আমার দেহে নিঃশ্বাস থাকা অবস্থায় আমি মেহেভীনের শরীরে কলঙ্কের হাওয়া পর্যন্ত বইতে দিব না। আপনি গৃহে ফিরে যান নিশ্চিন্তে নিদ্রায় তলিয়ে যান। মেহেভীনের সব দায়িত্ব আমার তার সব চিন্তা আমি নিলাম। আমাকে একবার ভরসা করে দেখুন ঠকে গেলে পরবর্তীতে আমার মুখ আপনায় দেখাব না। মেহেভীনের সব দায়িত্ব আমার কথাটা মধুর মতো শোনাল রাইমা বেগমের কাছে। সে কত পুরুষকে দেখেছে কই আগে কোনো পুরুষ এভাবে মেহেভীনের দায়িত্ব নেয়নি। বরঞ্চ মেহেভীনের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে। তবে কি রাইমা বেগম ভয়ংকর রকমের ভালো কিছুর আভাস পাচ্ছে। একটা মানুষকে বাহির থেকে যেমনটা মনে হয়। তার সাথে কথা না বললে তার সাথে না মিশলে বোঝা যায় না মানুষটা আসলে কেমন। এর মাঝের তাইয়ান একটা গার্ডকে সাথে নিয়ে নাস্তা নিয়ে আসলো। রাইমা বেগম খাবে না কিছুই মুনতাসিমের জোড়াজুড়িতে হালকা কিছু আহার করলেন। রাইমা বেগম চলে যাচ্ছিলেন। তখনই মুনতাসিম আদুরে কণ্ঠে ডাকল,

–আজকে থেকে যান আন্টি দুপুর ভাত খেয়ে যাবেন। রাইমা বেগম মুনতাসিমকে যত দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে! এত বড় মাপের মানুষের মন এতটা সহজ সরল হতে পারে সেটা রাইমা বেগমের ধারনার বাহিরে ছিল। সে ভেবেছিল মুমতাসিম হয়তো তাকে কয়টা কড়া বাক্য শুনিয়ে বিদায় করে দিবে। সে কি জানত না মুনতাসিম মানেই মুগ্ধতা। মুনতাসিম প্রতিশোধে নয় ক্ষমায় বিশ্বাসী। সে ঘৃণায় নয় ভালোবাসায় পারদর্শী। একটা মানুষের কাছে যত আসা যায়। ততই মানুষটার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। রাইমা বেগমের মুনতাসিমের গাল স্পর্শ করে আদর করে দিতে ইচ্ছে করল। এত মিষ্টি একটা ছেলে নিশ্চই কোনো এক ভাগ্যবতী মায়ের গর্ভের সন্তান। যেমন তার ব্যবহার তেমন তার শিক্ষা। রাইমা বেগম মিষ্টি হেসে বিদায় জানিয়ে চলে গেল।

মুঠোফোনটা হাতে নিতেই দেখল, নেহাল পনেরো বার ফোন দিয়েছে। মুনতাসিম বিলম্ব করল না। দ্রুত ফোন ব্যাক করল। ওপর পাশ থেকে রাগান্বিত কণ্ঠ স্বর ভেসে এল। নেহাল চেচিয়ে বলল,

–এই শা’লা মন্ত্রী হয়েছিস বলে যা খুশি তাই করবি! গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছিলাম! কথা শেষ না করেই কল কাটলি কেন? কল কাটলি তো কাটলি একদম ভূতের মতো গায়েব হয়ে গেলি! আমাকে উলটা রাগ দেখাতে আসিস না। তুই মন্ত্রী হবার আগে আমার বন্ধু এটা ভুলে যাস না।

–তুই রাগ করিস না আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছিলাম। সেজন্য না বলে কল কেটে দিতে হয়েছে। তোকে কতবার বলেছি। বন্ধুত্বের মধ্যে একদম নিজেদের পেশা টানবি না। আমি আগে যেমন তোর কাছে সাধারণ মুনতাসিম ছিলাম। আজও তেমনই আছি। এবার কাজের কথায় আসা যাক।

–আমার মনে হয় মেহেভীনের অফিসের কেউ এতটা গভীর ষড়যন্ত্র করেনি। দুই তিনটা তথ্য পেয়েছি। কিন্তু সেগুলো সব মেহেভীনের বিপরীত পক্ষে, এগুলো দিয়ে মেহেভীনকে নির্দোষ প্রমাণ করা সম্ভব নয়। আমাদের আসল মাথা খুঁজে বের করতে হবে। আমি শুধু মাথার খোঁজটা পাই গোড়া পর্যন্ত পৌঁছে যেতে দুই সেকেন্ড সময় লাগবে না। মুনতাসিমের বিচক্ষণ মস্তিষ্ক নাড়া দিয়ে উঠল। ক্রোধে নিজেই নিজের হাত দেওয়ালে বা’ড়ি মা’র’ল। মুনতাসিম ভেবেছিল কাজটা হয়তো অফিসের মধ্যে হয়েছে। সেজন্য নেহালকে অফিসের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত তল্লাসি চালাতে বলেছে। এদিকে রুপার কথা তার মাথা থেকেই বের হয়ে গিয়েছিল। এতবড় ভুল তার দ্বারা কিভাবে হলো ভাবতেই রাগে ললাটের রগ ফুলে ফুলে উঠেছে। মুনতাসিম ঘন গাঢ় শ্বাস নিয়ে বলল,

–আমার থেকে তুই অভিজ্ঞ বেশি তোকে আমি আগা দেখিয়ে দিচ্ছি। তুই গোড়া পর্যন্ত অনায়াসে চলে যেতে পারবি। মেহেভীনের কাজের মেয়েটা রুপা তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হস্তান্তর কর। আশা করছি তার সবকিছু সামনে আসলে বড়ো বড়ো মুখ গুলো সামনে চলে আসবে।

–আর কারো কথা তুই জানিস?

–জুনায়েদ খান নামের এক লোকের সাথে দেড় বছর ধরে ঝামেলা চলছিল মেহেভীনের। তুই চাইলে তাকে-ও জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারিস। নেহালকে আর কিছু বলতে হলো না। নেহাল যথেষ্ট বুদ্ধিমান একটা ছেলে ছোট বেলায় থেকে সে বেশ মেধাবী। তাকে আঁটি ভেঙে শ্বাস দিতে হয় না। অল্প একটু বললেই সে খুব সহজে গভীরে চলে যেতে পারে।

দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে যাবার পরে আজ সেই কাঙ্খিত দিন চলে এসেছে। আজকে মেহেভীনের কেসের ফাইনাল রাই হবে। মেহেভীনের মা, মুনতাসিম, নেহাল, রুপা সবাই কোর্টে উপস্থিত। একটু পরেই জজ সাহেব কোর্টে উপস্থিত হতেই সবাই দাঁড়িয়ে সালাম দিল। জজ সাহেব আসার সাথে সাথেই মেহেভীনকে উপস্থিত করা হলো। নেহাল জজের কাছে একটা ফুটেজ প্রদান করল। যেখানে মেহেভীন ইউএনও সাহেবকে হুমকি দিচ্ছে। সেটা শুনে মেহেভীনের মস্তক নত হয়ে গেল। ফুটেজ টা দেখা হলে মেহেভীনকে বলা হলো,

–আপনার কি নিজের সম্পর্কে কিছু বলার আছে?

–এখানে আমার হুমকি দেওয়ার ফুটেজ টা শুধু দেখানো হয়েছে। কিন্তু ইউএনও সাহেব আমার যে অশালীন আরচণ করেছেন। সেই অংশটুকু কেনো কেটে দেওয়া হয়েছে? নেহাল মেহেভীনকে শান্ত কণ্ঠে বলল,

–আপনার নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য কোনো প্রমাণ আপনার কাছে আছে? মুহুর্তের মধ্যে মেহেভীনের চোখে মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। আঁখিযুগল রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। আঁখিযুগলে অশ্রু এসে চকচক করছে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে সেগুলো গড়িয়ে পড়লো। মেহেভীন মস্তক নুইয়ে ধীর কণ্ঠে জবাব দিল,

–না। তখনই নেহাল আরো কিছু ফুটেজ জজের কাছে প্রদান করল। সেগুলো দিয়ে নেহাল বলতে লাগলো।

–এখানে অনেক গুলো ফুটেজ আছে জজ সাহেব। আপনি একটা একটা করে দেখলে বুঝতে পারবেন। মেহেভীনের কাজের মেয়েটা কিভাবে দিনের পর দিন মেহেভীনের আড়ালে অনৈতিক কাজ করে গিয়েছে। সে বৈধ দলিলের মধ্যে অধৈর্য দলিল প্রবেশ করিয়ে কাগজ গুলো সাইন করিয়ে নিয়েছে। এভাবে তিনি মেহেভীনের বিভিন্ন ক্লায়েন্টের কাছে থেকে অবৈধ অর্থ দাবি করেন। শুধু তাই নয় জুনায়েদ খান নামক এক ক্লায়েন্টের কাছে থেকে সে পুরো এক কোটি টাকা অর্থ নিয়েছে। তারা মেহেভীনের আড়ালে মেহেভীনের বাসায় গোপন বৈঠক বসায়। আমাদের দেশের বেশিভাগ মানুষ নিজেদের বাসার কাজের লোককে একটু বেশি বিশ্বাস করে থাকে। মেহেভীনের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মেহেভীনের কাজের লোক অর্থাৎ রুপা মেহেভীনের সরলতার সুযোগ টাকে কাজে লাগিয়ে দিনের পর দিন তাকে ঠকিয়ে এসেছে। অবৈধ কাজের বিনিময়ে টাকা ঠিকি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই টাকা গুলো মেহেভীন পর্যন্ত কোনোদিন আসেইনি। মেহেভীন এসব টাকার বিষয়ে কিছুই জানে না। বলতে গেলে মেহেভীনকে জানতে দেওয়া হয়নি। মেহেভীনের সাথে ইউএনও সাহেবের ঝামেলা চলছিল। মূলত সমস্যাটা এখানে থেকেই তৈরি হয়। ইউএনও সাহেব মেহেভীনের সাথে দিনের পর দিন অশালীন আরচণ করছিলেন, আপত্তিকর প্রস্তাব প্রদান করছিলেন। মেহেভীন তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিবে বলায় তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে যান। আর মেহেভীনকে ভয় দেখান সে মেহেভীনকে পদত্যাগ করাতে বাধ্য করবেন। তারপরে তিনি জুনায়েদ খান আর রুপাকে কাজে লাগিয়ে এতদূর আসেন। ইউএনও সাহেবের বাসায় যেদিন মেহেভীন যায়। সেদিনের ফুটেজও আছে। তারা এতটুকু করেই ক্ষান্ত হননি মেহেভীনকে মারার বুদ্ধিও তারা করেছেন। রুপা মেয়েটা তাদের এত সাহায্য করল। তারা সেই মেয়েটার উপকারের কথা ভাবেনি। রুপাকেও মারার পরিকল্পনা তারা করেছে। বোকা মেয়েটা বুঝল না কে তার আপন কে তার পর! অর্থের লোভ মানুষকে ধংস করে দেয়। রুপা কেও ধংস করে দিয়েছে। রুপার জালিয়াতি করে টাকা নেওয়া ইউএনও সাহেবের অশালীন আরচণ ও কথা রুপার মেহেভীনকে মারতে বলার কথা সবকিছু এই ফুটেজের মধ্যে আছে। আপনি সবকিছু দেখুন আর আপনার মতামত জাহির করুন জজ সাহেব। হিম শীতের মাঝে-ও পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। জজ সাহেব একটা একটা করে ফুটেজ দেখতে লাগলো। এগুলো মেহেভীনের ড্রয়িং রুমের ফুটেজ যেখানে মাহতাব উদ্দিনের কাগজের মধ্যে রুপা জুনায়েদ খানের কাগজ গুলো ঢুকিয়ে দিচ্ছে। জুনায়েদ খানের বাসায় রুপাকে যেতে আসতে দেখা হয়েছে। জুনায়েদ খানকে হুমকি দিতে দেখা যাচ্ছে। ইউএনও সাহেবের বাসায় মেহেভীনকে খু’ন করতে ও গা’লি দিতে দেখা যাচ্ছে। ইউএনও সাহেবের অশালীন আরচণ ও প্রস্তাবের কথা শোনা যাচ্ছে। দিনের পর দিন এত এত টাকা রুপাকে নিতে দেখা যাচ্ছে। সবকিছু দেখে ঘৃণায় মেহেভীনের সমস্ত শরীর রি রি করে উঠল। মেহেভীন ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে রুপার দিকে দৃষ্টিপাত করল। রুপা ভয়ে জমে গিয়েছে। মুখশ্রী বেয়ে তরতর করে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। শক্তি গুলো যেন পালিয়েছে। পুরো শরীর অবশ হতে শুরু করেছে। পালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা সে হারিয়েছে। রুপার এক পাশে রাইমা বেগম অন্য পাশে মুনতাসিম। মুনতাসিমের অধরের কোণে স্নিগ্ধ হাসি বিরাজমান। রুপার পালিয়ে যাবার কোনো রাস্তাই খোলা নেই। সে মস্তক নুইয়ে কাঁপতে লাগলো।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৩২
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

চারিদিক সুখানুভূতিতে মেতে উঠেছে। মেহেভীনকে বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয়েছে। রাইমা বেগমের আঁখিযুগলে অশ্রুকণা এসে হানা দিয়েছে। যেকোনো সময় ভারী বর্ষণের ন্যায় জমিনে গড়িয়ে পড়বে। আস্তে আস্তে কোর্ট ফাঁকা হতে শুরু করল। পুলিশ এসে রুপাকে আটক করল। জুনায়েদ খান ও ইউএনও সাহেবকে ধরার কার্যক্রম শুরু হয়ে গিয়েছে। জুনায়েদ খানকে ধরা গেলে-ও ইউএনও সাহেবের খোঁজ মিলেনি। রুপাকে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছিল তখনই মেহেভীন রুপার সমানে গিয়ে উপস্থিত হয়। মেহেভীনকে দেখে রুপার মস্তক নুইয়ে যায়৷ তবুও নিজেকে বাঁচানোর বৃথা চেষ্টা করে বলল,

–আমি ছোট মানুষ অনেক বড় ভুল করে ফেলছি আপা। আমাকে আপনি বাঁচান। আমি আর কখনো এমন ভুল করব না। আপনি চাইলে আমাকে বাঁচাতে পারবেন। আমি জেলে যেতে চাইনা। আপনি না আমায় বলেছেন। আমি আপনার ছোট বোনের মতো বড় বোন হয়ে ছোট বোনের ভুলটা মাফ করা যায় না। আমি আপনার জীবন থেকে অনেক দূরে চলে যাব। তবুও আপনি আমায় জেলে যেতে দিয়েন না। রুপার কথায় মেহেভীনের মস্তক জ্বলে উঠল। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না৷ নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে রুপার গালে ক’ষে থা’প্প’ড় বসিয়ে দিল। রাগান্বিত হয়ে বলল,

–পায়ের জুতাকে কখনো মাথায় তুলতে নেই। আমি আপন ভেবে পায়ের জুতাকে মাথায় তুলেছিলাম। এতটুকু শাস্তি আমার প্রাপ্য ছিল। এবার তুই বুঝবি তোর অবস্থান টা ঠিক কোথায়। তুই পায়ের জুতা ছিলি তার সারাজীবন পায়ের জুতাই থাকবি। চাকরানী চাইলেই রাজরানী হতে পারে না। তুই অবৈধ অর্থ উপার্জন করে চাকরানী থেকে রাজরানী হতে চেয়েছিলি না। সৃষ্টিকর্তা ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। তাই তোকে তোর অবস্থান দেখিয়ে দিল। আমার তোকে খু’ন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। দুধকলা দিয়ে এতদিন ঘরে কাল সাপ পুষেছিলাম। কথা গুলো বলতে বলতে মেহেভীন নিয়ন্ত্রণ হারা হয়ে গেল। আচমকা রুপার গলা চেপে ধরলো। অদ্ভুত ভাবে মেহেভীনের শক্তি দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে। রুপা বাঁচার জন্য ছটফট করছে। দু’জন মহিলা পুলিশ মেহেভীনকে দূরে সরিয়ে দেয়। একজন মহিলা পুলিশ বলল,

–আইন নিজের হাতে তুলে নিবেন না ম্যাম। আমাদের কাজ আমাদের করতে দিন।

–এই মেয়ে যেন এতটুকু শাস্তি ও কম না পায়। আপনাদের সর্বোচ্চ শাস্তি যেন এই মেয়ে পায়। মেহেভীনের কথায় মহিলা পুলিশ দু’টো রুপা নিয়ে চলে গেল। রুপা ছাড়া পাবার জন্য ছটফট করছে। কিন্তু দু’জন মানুষের সাথে পেরে উঠছে না। পুরো কোর্ট ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। রাইমা বেগম, নেহাল আর মুনতাসিম রয়ে গিয়েছে। নেহাল হাসোজ্জল মুখশ্রী করে ভা উচ্চারন করতেই মুনতাসিম জোরে নেহালের পায়ের ওপরে পা রাখল। নেহাল ব্যথায় কুঁকড়িয়ে উঠল। নেহালের আর্তনাদ শুনে, মেহেভীনের দৃষ্টি নেহালের ওপরে পড়লো। মেহেভীন নেহালের কাছে এসে বলল,

–আমাকে নির্দোষ প্রমাণ করার আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি সারাজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।

–আমার কাজই এটা আমাকে ধন্যবাদ দিতে হবে না। যদি দিতে হয় তাহলে মুনতাসিমকে দিবেন৷ সে আমাদের অনেক সাহায্য করেছে৷ আমি আপনার কাছে থেকে বেশি কিছু চাই না৷ আমাকে আপনাদের বি..উচ্চারণ করতেই মুনতাসিমের দিকে নজর যায়। মুনতাসিম অগ্নি দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। মেহেভীন এখানে না থাকলে তাকে এতক্ষণে ধংস করে দিত মুনতাসিম। আঁখিযুগল দিয়ে তাকে শতবার ভষ্ম করে দিচ্ছে। নেহালের কণ্ঠনালিতে শব্দ গুলো এসে আঁটকে গেল। আমার কাজ আছে বলেই সে দ্রুত কোর্ট থেকে বেড়িয়ে গেল। মুনতাসিম চলে যাচ্ছিল। তখনই মেহেভীন ডাকলো।

–স্যার। মেহেভীনের ডাক উপেক্ষা করার ক্ষমতা তার কোনোদিনই ছিল না। আজ ও সে প্রেয়সীর ডাককে উপেক্ষা করতে পারল না৷ দৃষ্টি ঘুরালো পেছনের দিকে। মেহেভীন নরম কণ্ঠে বলল,

–আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ বিপদে পাশে থাকার জন্য।

–একজন বন্ধুর বিপদে পাশে দাঁড়ানোই প্রকৃত বন্ধুর কাজ। আমি কখনোই নির্দোষ ব্যক্তির শরীর কলঙ্ক লাগিয়ে আরামে বসে থাকতে পারি না। আমার শরীরে যদি কেউ কলঙ্ক লাগায় তাহলে আমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে জানি৷ ঠিক তেমনই আমার বন্ধুর শরীরে যদি কেউ মিথ্যা বোঝা চাপিয়ে দেয়। আমার যতটুকু সাধ্য আছে। সেটা প্রয়োগ করে তাকে সাহায্য করতেও জানি। ধন্যবাদ দিয়ে আমাকে ছোট করতে হবে না। ভালো থাকবেন আসছি। আমি কাজ ফেলে রেখে এসেছি আমাকে যেতে হবে। কথা গুলো বলেই মুনতাসিম বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল। মানুষটার অভিমান তার ভালোবাসার মতোই প্রখর। অভিমান ভাঙাতে যে প্রচুর কাঠ কয়লা পোড়াতে হবে। সেটা মেহেভীন গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারছে। রাইমা বেগম দিন পর দিন ছেলেটার প্রতি মুগ্ধতা বেড়েই চলেছে। মুনতাসিমের মাকে রাইমা বেগমের ভিষণ দেখতে ইচ্ছে করে। গর্ব করে বলতে ইচ্ছে করে, মানুষের মতো মানুষ করেছেন ছেলেটাকে। এমন সোনার টুকরো ছেলে কয়জনের হয়? কথা গুলো ভাবতে ভাবতে মেয়েকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্য রওনা হলেন। মেয়ের বাসায় দু’টো দিন থেকে চলে যাবে। ফরিদ রহমান একটি বারের জন্য মেয়ের খোঁজ নেয়নি। রাইমা বেগম বাসায় ফিরছে না। সেটা নিয়েও প্রচুর অশান্তি করেছে। বাবা কি আসলেই এমন হয়? ভাবতেই মেহেভীনের বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করল।

অভাগী যেদিকে যায় কপাল পুড়তে পুড়তে যায়। কথাটার সঠিক মর্ম আজ মেহেভীন উপলব্ধি করতে পারছে। এত কষ্ট সাধ্য সাধনা সবকিছু অসৎ এর কাছে এসে হেরে গেল। তাতে কি যায় আসে নিজের সন্মান নিয়ে ফিরতে পেরেছে সে। এটাই তার কাছে বিশাল কিছু। নিজের সন্মান বিক্রি করে তো আর কাজে থাকতে পারবে না। এই জন্যই বোধহয় মানুষ বলে সৎ পথে কষ্ট বেশি আর অসৎ পথে বন্ধু বেশি৷ মেহেভীন তার মায়ের কাছে ফোন দিল। ত্রিশ সেকেন্ডের মতো চুপ ছিল মেহেভীন। রাইমা বেগম অস্থির হয়ে বলল,

–আমার কিন্তু ভিষণ চিন্তা হচ্ছে তোর কি হয়েছে বলবি?

–মা আমার চাকরিটা চলে গিয়েছে।

–কেন কি হয়েছে?

–সেই ঘটনার পরে কিছু মানুষ আমার সাথে খুব অশালীন আরচণ করতে লাগছিল। যা আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। আমার নামে একে পর এক মামলা আসছিল। আমি কিছু নিয়ম ও ভঙ্গ করেছি মা৷ সেজন্য আমাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। মেহেভীনের কথায় রাইমা বেগম নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কারো কণ্ঠনালি দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারিত হচ্ছে না। রাইমা বেগম দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছেন। সে মেহেভীনকে খবর টা দিবে কি না৷ রাইমা বেগম স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

–আমি জানি তোর মনের অবস্থা ঠিক কতটা খারাপ। এটাও জানি তোর ভেতরে ছোটখাটো একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সমস্যা যেন আমাদের সমস্যায় ফেলতে না পারে। বরঞ্চ আমরা চেষ্টা করব সমস্যাকে সমস্যায় ফেলতে। আমি তোকে কি বোঝাতে চেয়েছি আশা করি বুঝতে পেরেছিস? আল্লাহ তায়ালা আমাদের মাঝে মাঝে দুঃখ-কষ্ট দিয়ে পরীক্ষা করেন৷ ধৈর্য হারা হোস না আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন।

–সব ভালো কেন আমার সাথেই করেন আম্মু। জীবনের পাপের বোঝা খুব বেশি হয়ে গিয়েছে। তাই তিনি এভাবে আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছেন।

–তুই রাগ করে এসব কথা বলছিস। আল্লাহ তায়ালা আমাদের থেকে যা কিছু কেঁড়ে নেন৷ তার থেকে দ্বিগুন ফিরিয়ে দেন৷ তুই নিরাশ হোস না তিনি যতটুকু কেঁড়ে নিয়েছেন। তার থেকে দ্বিগুন খুব তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দিবেন। মানুষের ওপরে ভরসা করলে নিরাশ হবি খালি হাতে ফিরে আসবি। কিন্তু আল্লাহ তায়ালাকে ভরসা করে দেখ তিনি তোকে নিরাশ ও করবে না৷ আবার খালি হাতেও ফিরিয়ে দিবেন না। পৃথিবীতে মানসিক শান্তির আরেক নাম মা। এই যে ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিল। অসহ্য যন্ত্রনায় শরীরটা ছটফট করছিল। মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে গিয়েছিল। চিন্তায় মস্তক থম মেরে গিয়েছিল। এত অশান্তির মধ্যে অজানা আনন্দ অনুভূত হচ্ছে মেহেভীনের। চিন্তিত মস্তক নিজেকে বোঝাতে আর মানাতে নেমে পড়েছে।

উত্তপ্ত মস্তিষ্ক টগবগে মেজাজ রাগান্বিত চেহারা রক্তিম আঁখিযুগল নিয়ে বাবার সামনে বসে আছে মুনতাসিম। মুনতাসিমের বাবা গম্ভীর মুখশ্রী করে ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা-ছেলের মধ্যে কিছু মুহুর্ত তর্কাতর্কি হয়েছে। পরিবেশ শীতল করতে দু’জনই নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। মুনতাসিমের বাবা শান্ত হয়ে কোমল কণ্ঠে বলল,

–তোমার বয়স তো আর কম হয়নি। আমি চাই তোমার বিয়ে দিতে তুমি আমার মতামতকে উপেক্ষা করতে পারো না। তুমি রীতিমতো আমার মতামতকে অসন্মান করছ মুনতাসিম।

–আমি আপনাকে কতবার বলব আব্বা। আমি বিয়ে করব না৷

–নিজের বয়সের দিকে নজর দিয়েছ! এই বয়সে বিয়ে করবে না। তাহলে কোন বয়সে বিয়ে করবে? আমার ও তো মন চায়। ছেলে-মেয়ে বিয়ে দিয়ে নাতি-নাতনীর মুখ দেখতে।

–এক ছেলেকে বিয়ে দিয়ে দেখলেন না নাতি-নাতনীদের মুখ। আবারও একটা লা’শ বের হয়ে যাবে চৌধুরী বাড়ি থেকে যদি আমার সাথে ছলনা করার চেষ্টা করছেন।

–সে আজ আমার থেকে বহুদূর। আমি তোমার জন্য আমার না হওয়া নাতি-নাতনীর মুখ দেখতে পারিনি। তাই তোমাকেই আমার না দেখা স্বপ্নটা পূর্ণ করে দিতে হবে। বাবার কথায় মুনতাসিম লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। নিজের বিয়ে নিয়ে বাবার সাথে কথা বলতে সে ভিষণ লজ্জা পায়। লজ্জা আর জড়তার কারনেই নিজের মনের কথা বাবার কাছে প্রকাশ করতে পারছে না। বাক্য গুলো যেন ছুটি নিয়েছে। যে মানুষটার একটা কথায় সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে যায়৷ আজ সেই মানুষটা কথা বলার শব্দ হারিয়েছে।

–আমি তোমাকে সাতদিন সময় দিলাম। তুমি সাত দিনের মধ্যে নিজের সিদ্ধান্ত জানাবে। আমি আমার বন্ধুর মেয়েকে আমাদের বাসায় নিমন্ত্রণ করেছি। সে চৌধুরী বাড়িতে আসবে। তুমি তার সাথে ঘুরবে ফিরবে মিশবে। তারপরে যদি তোমার তাকে ভালো লাগে তবে আমি সামনের দিকে আগাব বুঝেছ। মুহুর্তের মধ্যে মুনতাসিমের ভেতরটা জ্বলে উঠল। দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আছে। দাঁতে দাঁত চেপে বাবার কথা গুলো সহ্য করে নিল। বাবার মতামতকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার ক্ষমতা তার নেই। সে রাগান্বিত হয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। রিয়াদ চৌধুরী একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তার অজানা কারনে মেহেভীনকে পছন্দ নয়। দু’জনের দুরত্বের কথা জেনেই ছেলেকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে চায় সে। কিন্তু ছেলে তার নাছোড় বান্দা নিজের সিদ্ধান্তে অটুট থাকবে। মেহেভীনকে রাস্তা থেকে সরানোর জন্য একটা পথ অবলম্বন করবেন তিনি। সেই পথ যদি কাজে লেগে যায় তাহলে আলহামদুলিল্লাহ। আর না হলে মনের বিরুদ্ধেই ছেলের সুখ বেছে নিবে সে।

রাইমা বেগমের কণ্ঠ কেমন জানি শোনালো। মেহেভীন বুঝতে পারছে। তার মা তার থেকে কিছু আড়াল করার চেষ্টা করছে। মেহেভীন নিজের দুঃখ গুলো খুব যতনে মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখে বলল,

–তোমার কি হয়েছে আম্মু? আমাকে একদম মিথ্যা বলার চেষ্টা করবে না। আমার মা তো এত সহজে নিস্তেজ হয়ে যাওয়ার মতো মানুষই না। মেহেভীন কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে কথা টা ভাবতেই চমকে উঠল রাইমা বেগম।

–পরে শুনিস।

–আমি এখনই শুনব৷ রাইমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। সে সত্য টা দু’দিন পরে সবার সামনে চলে আসবে৷ সেটা দু’দিন আগে আসলে ক্ষতি কি? তাই মেহেভীনের মা দম নিলেন৷ কিছু সময়ের ব্যবধানে বলার জন্য প্রস্তুত হলেন। শব্দ গুলো যেন কণ্ঠনালিতে এসেও হারিয়ে যাচ্ছে। নিজের অশ্রু গুলো সংবরণ করে বলল,

–তোর বাবা খু’ন হয়েছে মেহেভীন। সাতদিন ধরে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না৷ আজকে খবর পেয়েছি তাকে খু’ন করে ছয় টু’ক’রো করা হয়েছে। একটা ভিডিও ক্লিপ তারা সংগ্রহ করতে পেরেছে। কিন্তু তোর বাবার খন্ড গুলো তারা এখনো উদ্ধার করতে পারেনি। উদ্ধার করার কার্যক্রম চলছে। কথা গুলো কর্ণকুহরে আসতেই মেহেভীনের মনে হলো কেউ তার শরীরের সমস্ত হার গুলো গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিয়েছে। এক মুহুর্তের জন্য তার রুহু কেঁপে উঠল। পুরো শরীর অবশ হয়ে আসতে শুরু করেছে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য গয়ে পড়েছে বুকের মধ্যে ভিষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মানুষটা যতই খারাপ হোক মানুষটা তার বাবা ছিল। যার হাত ধরে সে হাঁটতে শিখেছে। যার উষ্ণ ভালোবাসায় সে বড় হয়েছে। কিছু দিনের করা খারাপ ব্যবহারের কাছে কি সারাজীবনের ভালোবাসা বৃথা যেতে পারে! মেহেভীনের মনে হচ্ছে জীবনের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে সে। আর একটা ধাক্কা দিলে দেহ থেকে প্রাণ পাখিটা খাঁচা ফেলে উড়াল দিবে। এক ধাক্কায় ভেঙে পড়ার মতো মানুষ মেহেভীন নয়। বারবার ধাক্কা দিলে পাহাড় ও ভেঙে পড়ে সেখানে মেহেভীন একজন মানুষ মাত্র।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৩৩
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

প্রতিটি মুহুর্ত যেন বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। বাসতের সাথে তাল মিলিয়ে যেন বি’ষ উড়ে বেড়াচ্ছে। মেহেভীনের সমস্ত শরীর বিষাদে ছেয়ে গিয়েছে। ভেতর থেকে বুদ্ধি শূন্য হয়ে পড়েছে সে। মস্তিষ্ক না কাজ করার পণ করেছে। অশ্রুকণা গুলো যেন পালিয়েছে। কিছুতেই আঁখিযুগলের কোণে এসে ভির জমাচ্ছে না। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসছে। মেহেভীনকে নিস্তব্ধ হয়ে যেতে দেখে রাইমা বেগম মলিন কণ্ঠে বলল,

–এই জন্যই আমি তোকে বলতে চাইনি। কারন বাবা যতই খারাপ হোক না কেন একজন বাবা প্রতিটি মেয়ের দুর্বলতা। আমি যে ধাক্কা টা সহ্য করে নিয়েছি। তুই সেটা সহ্য করতে পারবি না৷

–আমি বাসায় আসছি মা।

–তোর বাবার নিখোঁজ হবার খবর পরিবারের লোক ছাড়া কেউ জানে না। তুই বাসায় এসে বিষয়টা ঘোলাটে করিস না৷ তোর চাকরি চলে গিয়েছে শুনলে মানুষ তোকে আর আমাকে ছিঁড়ে খাবে। এখনো সঠিক সময় আসেনি। সবাইকে সত্যিটা বলার তুই আর কয়টা দিন পরে আয়৷ বাবাহীন মেয়েটা জানে বাবা ছাড়া ধরনীর বুকে টিকে থাকা কতটা কঠিন। বাবাহীন প্রতিটি মেয়ে জানে তারা সমাজে কতটা অবহেলিত। যার বাবা নেই তার কেউ নেই। মানুষটা যতই খারাপ হোক মাথার ওপরে ছিল বিধায় কেউ মুখ দিয়ে কটু বাক্য উচ্চারন করতে পারেনি। তোর বাবার মৃত্যুর খবর পাঁচ কান হলে দেখবি সবাই তার খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছে।

–আমার এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না আম্মু। আমার পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে শরীরের শক্তি ক্ষয় হতে শুরু করেছে। তোমাকে এই অবস্থায় আমি কিছুতেই একা থাকতে দিব না। যতই রাত হোক না কেনো আমি আসছি। কথাগুলো বলেই কল কেটে দিল। রাইমা বেগম ক্রোধে দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিল৷ রহমান যদি আরিয়ানের সাথে মেহেভীনের বিয়ে চাপ দেয়। তখন সে কি করবে তার স্বামীও নেই। যে জোড় গলায় কথা বলবে। এখন তার গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধাবোধ করবে না। এই পরিবারের প্রতিটি মানুষের রগ তার চেনা আছে।

রজনীর আঁধার ধরনীকে গ্রাস করে ফেলছে। আজকে শেহনাজের বাসায় ফরিতে দেরি হয়ে গিয়েছে। আজকে ড্রাইভার কেও বাসায় ফিরে যেতে বলছে। জীবনে প্রথম গাড়ির জন্য মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে সে। ভেতরে ভেতরে ভিষণ ভয় কাজ করছে তার। কেন যে বোকামি করে ড্রাইভারকে বাসায় যেতে বলল। শেহনাজ একটা চায়ের দোকানের পাশে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে। সে একা থাকায় কেউ নিয়ে যেতে চাইছে না৷ তখনই কর্ণকুহরে কিছু অশালীন বাক্য এসে পৌঁছায়। বাক্য গুলো যত স্পষ্ট হচ্ছে শেহনাজের শরীর ততই ঘৃণায় রি রি করে উঠছে৷ তখনই শেহনাজের সামনে এসে তাইয়ান উপস্থিত হয়। তাইয়ানকে দেখে স্বস্থির নিঃশ্বাস ছাড়ে শেহনাজ। দ্রুত গাড়িতে উঠে বসলো সে। তাইয়ান গাড়ি চালানো শুরু করল।

–আপনি গাড়ি কেন বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন? স্যার অনেক রাগ করেছে। আমি আপনার ভার্সিটি থেকে খুঁজতে খুঁজতে এতদূর এসেছি। আপনাকে বাসায় নিয়ে না ফিরতে পারলে স্যার আমার গরদান নিয়ে নিতো।

–জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা আজকে আমি করেছি জানো। আমার বোঝা উচিৎ ছিল আমি একটা মেয়ে। আর একটা মেয়ের জন্য রজনীর আঁধার কতটা ভয়ংকর হতে পারে। সেটা আমি আজ উপলব্ধি করতে পারলাম। শেহনাজের কথার উত্তরে তাইয়ান আর কিছুই বলতে পারল না৷ সে নিরুত্তর রইল। শেহনাজ যেতেই চায়ের দোকান থেকে বের হয়ে আসলো শেহনাজের প্রিয়তম স্বাধীন। মুখশ্রীতে তার বিশ্রী হাসি বিদ্যমান। সে রফিককে উদ্দেশ্য করে বলল,

–শা’লি’কে আমরা কবে তুলছি। ভেতরটা দাউদাউ করে জ্বলছে। ওর তেজ না কমানো পর্যন্ত আমার ভেতরটা শীতল হবে না। শেয়াল কুকুরের মতো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাব ওকে। তবেই আমার ভেতরটা শান্ত হবে। স্বাধীনের বলা বাক্য গুলো কর্ণপাত হতেই রফিক বলল,

–কিছু পেতে হলে কিছু কষ্ট সহ্য করতে হয়। তার মনে জায়গা করে নিতে পেরেছিস। তাকে ছিঁড়ে ও খেতে পারবি। একটা মন্ত্রীর বোনকে তুলে নেওয়া কি এতটাই সহজ! শেহনাজকে কৌশলে তুলতে হবে। কথা গুলো বলেই স্বাধীনের কর্ণের কাছে এসে কিছু একটা বলল৷ স্বাধীনের মুখশ্রীতে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল।

রাইমা বেগমের সামনে বসে আছে মুনতাসিম। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে যাবার পরও মুনতাসিম কিছু বলছে না দেখে, রাইমা বেগম নিজেই বিরক্ত হয়ে বলল,

–আপনি আমায় কিছু বলতে চান স্যার? রাইমা বেগমের মুখে আপনি আর স্যার ডাকে নিভে গেল মুনতাসিম। সে অপ্রস্তুত হয়ে বলল,

–আমি আপনার ছেলের মতো। আপনি আমাকে স্যার না ডেকে তুমি বলে সম্মোধন করবেন। তাহলে আমি আপনার সাথে কথা বলতে সহজ হতে পারতাম। রাইমা বেগম বুঝলেন মুনতাসিমের অপ্রস্তুত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা। তিনি ও নিজেকে স্বাভাবিক করে মুনতাসিমকে অভয় দিয়ে বলল,

–আমি তোমার মায়ের মতো মায়ের কাছে এত কিসের হেলাফেলা! তুমি নিশ্চিন্তে তোমার মনের কথা আমায় জানাতে পারো।

–আমি মেহেভীনকে বিয়ে করতে চাই আন্টি। কথাগুলো বলেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল মুনতাসিম৷ হৃদস্পন্দনের ক্রিয়া তড়িৎ গতিতে ছুটে চলেছে। মনের গহীনে অস্থিরতা কাজ করছে। মুনতাসিম উৎসুক দৃষ্টিতে রাইমা বেগমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। রাইমা বেগমের মুখশ্রী আগের ন্যায় গম্ভীর হয়ে আছে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি মুনতাসিমের প্রস্তাবে বেশ চিন্তিত হয়েছেন। মুনতাসিমের ভেতরে অদ্ভুত ভাবে ভয় কাজ করছে। রাইমা বেগম যদি তাকে নাকচ করে দেয় কথা গুলো ভাবতেই মস্তিস্ক এলোমেলো হয়ে গেল।

–তোমার পরিবার জানে তুমি মেহেভীনকে বিয়ে করতে চাও। দেখো বাবা আমি তোমাকে পছন্দ করি না, এমন টা না।তোমাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। আমি খোলামেলা কথা বলতে পছন্দ করি। কিন্তু তোমার পরিবারের মতামত না থাকলে, আমি সামনের দিকে এগোতে পারব না। কারন তোমার পরিবার তোমাকে ছোট থেকে বড় করেছে। তোমাকে নিয়ে তাদেরও স্বপ্ন আছে। আমি কারো রঙিন স্বপ্ন ভেঙে আমার মেয়ের জীবন রঙিন ভাবে সাজাতে পারি না। তুমি তোমার পরিবারসহ আমার কাছে এসো। তখন না আমি ভেবে দেখব। আমি তোমাকে কড়া করে কথা গুলো বলতে বাধ্য হলাম। কারন এখানে আমার মেয়ের সারাজীবনের ব্যাপার জড়িয়ে আছে।

–আপনি রাজি হলে এখনই আমার পরিবারকে আসতে বলব। আমার খুশির জন্য কেউ রাজি না হোক। আমার বাবা রাজি হবে। নিজের সুখ বিক্রি করে হলে-ও আমার বাবা আমার জন্য সুখ কিনবে। বাবা ছাড়া দুনিয়ায় আপন বলতে আমার কেউ নেই। এই ধরনীর বুকে আমি বাবাকেই নিজের ধরনী মনে করি। আপনি অনুমতি দিলে আমার পরিবারকে আসতে বলব। রাইমা বেগম মুগ্ধ হয়ে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছেন। ছেলেটা এত ভালো কেনো? ছেলেটা এতটা ভালো না হলে-ও পারতো। ভালোবাসার মানুষ তো এমনই হওয়া উচিৎ। যেখানে অধিকারই থাকবে আলাদা যেটা মুনতাসিমের আঁখিযুগলে দেখেছে সে। রাইমা বেগম একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। মনস্থির করে নিলেন মেহেভীন আসলে মেহেভীনের সাথে কথা বলবে। জীবনে চলার পথে একটা শক্ত লা’ঠি’র ভিষণ প্রয়োজন আছে। রাইমা বেগম মুনতাসিমকে পরীক্ষা করার জন্য বলল,

–আমার মেয়ের কিন্তু চাকরি চলে গিয়েছে। তুমি আগে যে মেহেভীনকে দেখেছো। সে কিন্তু এখন আর আগের মতো নেই। তুমি আমার বেকার মেয়েকে মেনে নিতে পারবে তো? আমি অবাক হচ্ছি যে মেয়েটা তোমার সন্মান নষ্ট করল! তুমি কেন তাকেই বিয়ে করতে চাইছ?

–ভালোবাসা হচ্ছে স্নিগ্ধ পবিত্র জিনিস। প্রকৃত ভালোবাসায় না থাকে কোনো খাদ আর না থাকে প্রতিশোধের নেশা। ভালোবাসায় থাকে শুধু প্রিয় মানুষটাকে ভালোবাসার নেশা। আমি তো ঘৃণায় করতে শিখিনি আর না নিয়েছি প্রতিশোধ। আমি সবকিছুর বিনিময়ে ভালোবাসার মানুষটাকে একান্তই নিজের করে নিতে চেয়েছি। ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে হৃদয়ের ছোট্ট কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছি। যার মুখ দেখে আমার নিদ্রা ভাঙবে। যার মুখ দেখে আমি শান্তিতে নিদ্রা যেতে পারব। যার মুখের হাসি আমার মানসিক শান্তির কারন। আমার উথাল পাথাল করা হৃদয় যাকে দেখে শান্ত হয়ে যায়। সেই মানুষ টাকে আমি ভিষণ ভালোবাসি। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে কল্পনা করতেও আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। যাকে দুঃখ দিয়ে আমি নিজেই তার থেকে দ্বিগুন পুড়ি। তাকে আমি কিভাবে অবহেলা করব? শত্রুর সাথে লড়াই করা যায় আন্টি। কিন্তু ভালোবাসার মানুষের সাথে লড়াই করা যায় না। ভালোবাসার কাছে আমরা চরম ভাবে বেহায়া হয়ে যাই। আমরা বাহির থেকে নিজেদের যতই শক্ত প্রমাণ করার চেষ্টা করি না কেন? ভেতর থেকে আমরা কারো না কারো প্রতি গভীর ভাবে দুর্বল। একজন আত্মসম্মান সম্পূর্ণ মানুষ দিনশেষে কারো কাছে বেহায়া হয়ে যায়। চাইলেও তার সামনে শক্ত হওয়া যায় না। আর না করা যায় তার সাথে কঠিন ব্যবহার। আমাদের সমস্ত আত্মসম্মান শুষে নিয়ে চলে যায় আমাদের ভালোবাসার মানুষ গুলো। সেজন্য বোধহয় দিনশেষে আমরা বেহায়া উপাধি পেয়ে থাকি। আমি কি আপনাকে বোঝাতে পেরেছি। এতকিছুর পরে-ও কেন আমি মেহেভীনকে চাই। রাইমা বেগম যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। মনের শহরে আনন্দের মিছিল শুরু হয়ে গিয়েছে। অনুভূতিরা আনন্দে মেতে উঠেছে। অশ্রুশিক্ত নয়নে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। আল্লাহ তায়ালার কাছে শতবার শুকরিয়া আদায় করলেন। তার ললাটে ভালোবাসা জুটেনি তো কি হয়েছে। আল্লাহ তার মেয়ের ললাটে অফুরন্ত ভালোবাসা জুটিয়ে দিয়েছে। রাইমা বেগমের বুকটা প্রশান্তিতে ভরে যাচ্ছে। ভেতরে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠা আগুন টা মুহুর্তের মধ্যে নিভে গেল। এবার সে শান্তিতে পরকালে গমন করতে পারবেন। একজন মায়ের কাছে মেয়ের সুখ দেখার মতো শান্তি ধরনীর বুকে নেই।

–আমি তোমার সাথে মেহেভীনের বিয়ে দিব। কিন্তু মেহেভীনের বাবা মা’রা গিয়েছে। মেহেভীনের বাবার লা’শ খোঁজার তদন্ত চলছে। তাকে না পাওয়া পর্যন্ত কিভাবে মেহেভীনের বিয়ে দেই বলো? রাইমা বেগমের কথায় চমকে উঠল মুনতাসিম! সে বিস্ময় কণ্ঠে বলল,

–আংকেল কবে মা’রা গেল আন্টি? আপনি আমাকে জানাননি কেন? আমি আপনাকে আমার সর্বোচ্চ দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করব। আংকেলের তদন্তে কোন থানার পুলিশ আছে। আপনি আমাকে নাম বলুন। আমি ব্যাপারটা দ্রুত সমাধান করার চেষ্টা করছি।

–মেহেভীনের বাবাকে খু’ন করা হয়েছে। আমি চাই মেহেভীনের বাবা শাস্তি পাক। সে আমার মেয়েকে রক্তাক্ত করেছে। আমার মেয়ে কলঙ্ক না করে-ও সে আমার মেয়েকে কলঙ্কিত নারী বলে উপাধি দিয়েছে। নিজের মেয়ে বলে অস্বীকার করেছে। আমি চাই তার এতটুকু শাস্তি হোক। এবার মুনতাসিমের মস্তিস্ক নাড়া দিয়ে উঠল। বিচক্ষণ মস্তিষ্ক ভয়ংকর কিছুর আভাস পাচ্ছে। মেয়ে মানুষের মন তো কুসুমের ন্যায় কোমল হয়। তবে রাইমা বেগম কেন তার বিপরীত চিত্র! একটা নারী যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে। তা রাইমা বেগমকে না দেখলে উপলব্ধি করা যাবে না। এতটা পাষাণ মনের নারী কিভাবে হতে পারে? মুনতাসিমের মস্তক ঝনঝন করে উঠল। ভেতরটা আপন জন হারানোর পূর্বাভাস দিয়ে যাচ্ছে। এই ঝড়ের সাথে না আবার মেহেভীন ভেসে চলে যায়। সে নিঃস্ব হয়ে পড়বে। তার এক একটা দিন বেঁচে থাকা হবে মৃত্যুর সমান। সবকিছু সামনের আসার আগেই মেহেভীনকে নিজের আয়ত্ত করে নিতে হবে। মনের গোপন কুঠুরিতে ভালোবাসার চাদর দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। যেন কোনো বিপদ তার প্রেয়সীকে স্পর্শ করতে না পারে। এই প্রথম মুনতাসিম ভয় পাচ্ছে প্রিয়জন হারানোর ভয়। ভেতরটা হাহাকার করে উঠছে। রাইমা বেগম মুনতাসিমের দিকে শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। সেই শীতল চাহনি ভয়ংকর ভাবে মুনতাসিমের হৃদয় স্পর্শ করে গেল।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে