ক্যাকটাস? পর্ব ০২

0
3885

ক্যাকটাস?
পর্ব ০২
Writer Tanishq Sheikh

আত্মসম্মানের গলা টিপে এ বাড়ির মাটি কামড়ে পড়ে আছি। কোথায় যাব? সব পথ বন্ধ আমার সামনে। ঘরকুনো মেয়েছিলাম। বাইরের দুনিয়ার শঠতা বুঝতে পারি নি। কীভাবে একলা চলতে হয় সেটাও জানি না।যদি জানতাম তবে পালিয়ে যেতাম। দূর বহদূর। একটু একটু করে সাহস সঞ্চার করছি। মনে আশা বেঁধে রেখেছি একদিন এই অত্যাচারের নাগপাশের শিকল ভেঙে পালিয়ে যাব। কোনোদিন ফিরে আসব না এ পথে আর। জ্বরে কাঁপছে শরীর। অত্যাধিক ব্যথা নিয়ে কুলিয়ে উঠছে না দেহটা বুঝি। এলোমেলো ভাবনা চিন্তা মনে রান্নাঘরে বসে কুটনা কুটছিলাম। শ্বাশুড়ি বাঁজ খাই গলায় চেঁচিয়ে বললেন,

” নবাবের বেটি, বলি এতো ধীরে ধীরে কুটলে রান্না কী কাল করবি?”

আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জরিনা খালা বলে উঠলেন,

” বুজি বউয়ের তো শরীলডা ভালা না। গতরডা জ্বরে কাঁপতাচে। ডাকতর দেহান না ক্যান?”

জরিনা খালার কথায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো শ্বাশুড়ি,
” ডাক্তার দেখাব? এই ফকিন্নির জন্য মানসম্মান সব গেছে আমার স্বামী আর পোলার। ছেলেধরা ছোট জাত। আমার পোলাডার মাথা খারাপ করে দিছে। নয়ত কী এমন পঁচা শামুকে পা কাটে আমার সাত রাজার ধন? জ্বর কেন কলেরা হয়ে মরুক এই অপয়া, অলক্ষুণে।”

শ্বাশুড়ির গালাগাল এ’কদিনে উঠতে বসতে শুনে শুনে গা সহা আমার। নির্বিকার কাঁপা শরীরে করলা কুঁচি করছিলাম। করলার শক্ত বিচি বটিতে চাপ দিতেই অসাবধানতা বশত আঙুল কেটে হাঁ। জরিনা খালা জোর করে সরিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু পারলো না। শ্বাশুড়ি রাজ্যের কটু কথায় কান ভারী করে তুললো তার। খালা আমার মতো হয়তো অসহায় নয় কিংবা ভীতু নয়। তাইতো মুখ ঝামটা মেরে হনহন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। তার এহেন দুঃসাহসে শ্বাশুড়ির চিৎকার, চেঁচামেচির মাত্রা বাড়ল আরও। জরিনা খালার যাওয়ার পথে তাকিয়ে ধমকি দিল তার বাড়িতে জরিনার কোনো জায়গা নেই আর। সে যেন এ মুখো না হয়। শ্বাশুড়ি কিংবা জরিনা খালা দু’জনই জানে তাদের রাগ বরাবরের মতোই ক্ষণস্থায়ী। দু’জনের প্রয়োজন দু’জনকে। জরিনা খালার দুর্ব্যবহারের পুরোটা দায় তিনি আমার উপর দিলেন। আমার চৌদ্দগুষ্ঠির জীবিত মৃত কাওকে বাদ রাখলেন না। জাত গুষ্টি নিয়ে তার মুখের ভাষা শুনে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। নিজের উপর হওয়া অত্যাচার হজম করি কিন্তু বাপ,মা ভাই তাদের কী দোষ? আমার বাবা,মা কিংবা আত্মীয় হওয়াই বুঝি দোষী তারা।

জরিনা খালা চলে যাওয়ায় কাজ বেশি বাড়ল আমার। তপ্ত শরীরে, ঘোলাটে দৃষ্টিতে ধীরে ধীরে তিন চার পদের তরকারী রান্না করে টেবিলে সাজিয়ে রাখলাম। রান্নাঘর ধুয়ে মুছে চলে এলাম ঘরে। শরীরটা বুঝি আর কুলোচ্ছে না এবার। না চাইতেও ফ্লোরে শুয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলো আহনাফের চড়া গলার শব্দে। ঢুলুঢুলু দুর্বল চোখের পাতা মেলে অসহায়ের মতো চেয়ে রইলাম তার দিকে। আমার করুন অবস্থা দেখে হয়তো করুনা হলো আহনাফের। দৃষ্টি শান্ত করে নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,

” জ্বর কী বেশি বেড়েছে? ”

ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালাম। অপ্রত্যাশিতভাবে এগিয়ে এলো সে। হাঁটু ভর দিয়ে বসল সম্মুখে। ভয়ে জড়সড় হয়ে রইলাম আমি। আমাক অবাক করে কপালে হাত রাখল আহনাফ। কপালে ভাঁজ ফেলে আহনাফ ধমকের সুরে বললো,

” গায়ে জ্বর পুষে কী প্রমাণ করতে চাস?”

চমকে উঠলাম আমি৷ ভীরু নয়নে তার দিকে তাকিয়ে বুঝালাম সে যা ভাবছে তা নয়। যে আমার বাহ্যিক ব্যথা বোঝে না সেকি আমার অব্যক্ত ভাষা বুঝবে? আহনাফ বুঝল না। একপ্রকার রেগে বললো,

” তোর মতলব বুঝি না ভেবেছিস? এসব অসহায়ত্বের ভাঁড়ামি করে মন গলাতে চাস সেকি আমি বুঝি না? তোর এসব সস্তা নাটকে আহনাফ ভুলবে না।”

আহনাফের কথাগুলো শরবিদ্ধ হলো আমার হৃদয়ে। দাঁত কামড়ে অশ্রু সংবরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। সব চেষ্টাই বৃথা আমার।

আহনাফ দুটো ওষুধের পাতা আমার দিকে ছুঁড়ে ফেলে বললো,

” সময় মতো খেয়ে নিস। রাতের মধ্যে জ্বর যেন কম দেখি। কথা কী কানে গেছে তোর?”

তার উঁচু গলার আওয়াজে কেঁপে উঠলাম আমি। নত মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম। আমার গলার স্বর আমিই আজকাল শুনি না। আহনাফও হয়তো শোনে নি। মাথা নাড়ানোতেই আশ্বস্ত হয়ে বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে।

সেই জ্বর সেদিন তো সারলো, তবে ভেতরে ভেতরে ঘাপটি মেরে রইল। সময়, সুযোগে সেও জেগে ওঠে আমাকে নাজেহাল করতে।

এ বাড়ি এসেছি একমাস পার হয়েছে আমার। কম সময় হলেও এ বাড়ির বৈরী পরিবেশ ও মানুষগুলোর রূঢ় ব্যবহারে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি। বলে রাখি, আমাদের মহল্লা তেমন অভিজাত নয়৷ মেইন টাউন থেকে অনেকটা ভেতরে হওয়ায় গ্রামীন ভাব আছে। আমার শ্বশুরবাড়ি অর্থাৎ আহনাফরা হলো স্থানীয়। তাদের বাড়িটিও পুরোনো ধাঁচের দ্বিতল বাড়ি। চারপার্শ্বে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। মাঝখানে টাইলসের গোল উঠোন। সদর দরজা ডিঙিয়ে সম্মুখ ভাগেই পড়ে টাইলস বসানো ঝকঝকে উঠোন। সেটা পেরিয়ে সামনে এলেই বাড়ির গ্রিলবেষ্টিত বারান্দা,তারপর বসার ঘর। বসার ঘরের তিনকোনে তিনটে রুম। কোনের দেয়াল ঘেঁষে এঁকেবেকে দোতলায় উঠে গেছে সিঁড়ি। আহনাফের রুমটা দোতলায়। পাশে আরও তিনটে রুম আছে। তবে উপরে আহনাফ এবং আমি একাই থাকি৷ আমার শ্বাশুড়ির হাঁটুতে ব্যথা। তিনি সিঁড়ি চড়তে পারেন না। নিচতলার দখিনের রুম তাদের। ভাবছেন এতোবড় বাড়ি আর আমরা মাত্র চারটে প্রাণী? জি না! এ বাড়িতে লেকলস্করের অভাব নেই। আহনাফদের মাছের খামার, কাঁচা বাজারের আড়ত আছে। আহনাফের বাবা স্থানীয় লিডার। কর্মচারী কিংবা দলের লোকের আনাগোনা প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে নিয়মিতই হয় এ’বাড়ি। প্রতিদিন কমপক্ষে দশজন লোকের রান্নার আয়োজন করতে হয় আমাদের। আমাদের বলতে আমি, জরিনা খালা আর হাবুর মা’কে। দিনের অর্ধেকভাগ কেটে যায় রান্না, ধোঁয়া মোছাতেই। বাকি সময়টুকু ঘর পরিষ্কার এবং আমার জন্য নির্ধারিত কাজ শ্বাশুড়ির পা টিপে দেওয়া। আহনাফ তো স্বামী! তার অধিকারবোধে যা প্রাপ্য তাই সে পায়। এভাবেই কাটছে আমার দিন। নিজের নিয়তিকে ধিক্কার দেওয়ার অবসর আমার এখন আর নেই। রাতে যেটুকু ফুরসৎ পাই তখন দেহ জাগতে নারাজ। এক ঘুমে ভোর। তারপর একই নিয়মে,একই কাজ।

রাতের রান্নার জোগারজান্তি করছিলাম আমি আর জরিনা খালা। হাবুর মা দুপুরের পরে আর থাকে না। বারান্দার শেষ মাথায় টালির ছাউনি দেওয়া পাকা রান্নাঘর। গুদাম ঘর থেকে চাল আনতে যাচ্ছিলাম আমি। পথিমধ্যে পিছু ডাকল শ্বাশুড়ি মা। তার গলার স্বর এসেছি অব্দি মাতৃকোমল পায়নি৷ তবে এর বিপরীত হয় ছেলের সামনে। তখন তিনি ভেজা বিড়ালের মতো কুঁই কুঁই করে কথা বলেন আর স্বামীর সাথে আহ্লাদিত স্বরে। ফর্সা সুন্দর গালটা এখনও ঝলমল করে আমার শ্বাশুড়ির। যৌবনে তিনি যে অপরূপা সুন্দরী ছিলেন তা তার দেহের গড়ন দেখলে যে কেউ বুঝবে। সারাটা দিন পান চিবান তিনি। দেখতে বেশ লাগে তবে ব্যবহারে সেই বেশটা বিলীন হয়। মধ্যমা আঙ্গুলের মাথা থেকে একচিলতে চুন দাঁতে লাগিয়ে মুখে রাখা পান চিবিয়ে বললেন,

” চাউল দুই সের বেশি দিস৷ আমার ভাতিজা আসছে চট্টগ্রাম থেকে। ফ্রিজ থেকে গরুর গোশত, মুরগি আর গতকাল খামার থেকে যে কাতলা মাছটা ধরছে ওটাও বের কর। গরুর রেজালা, মুরগিরে ঝাল কইরা কষাবি সাথে আলু, পটল দিয়া কাতলা ঝোল করবি।
সোনা আব্বা আমার এই গুলো খুব পছন্দ করে। শোন মাস্টরের মাইয়্যা রান্না যেন ভালো হয়। ব্যারিস্টারি পাশ করে আসছে আমার সোনা আব্বা। কতো নাম ডাক ওর। খাওয়া যদি ভালো না হয় তোরে বটি দিয়ে কুটি কুটি করে খামারে ফেলে দেব। যা সামনে থেকে।”

চুপচাপ চলে এলাম গুদাম ঘরে। চাল নিতে নিতে শুনলাম বাইরে কাকে যেন ভাতিজার গুণকীর্তন শুনাচ্ছে। আমি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলাম। ব্যঙ্গ করে বিড়বিড় করলাম,

” এক গাছের ফল সব একই হয়। এতো গুণকীর্তন করছে আসলে তো হবে ঐ আহনাফের মতোই। হাজার হোক মামাতো,ফুফাত ভাই ভাই।”

সব রেডি করে রান্নার কাজে হাত দিলাম। জরিনা খালা এগিয়ে গুছিয়ে দিল। রান্না শেষ করে হাঁফ ছাড়লাম দু’জন। বর্ষার মৌসুম অথচ তিনদিন ধরে বৃষ্টির দেখা নেই। ভ্যাপসা গরমে ঘন্টার পর ঘন্টা চুলার সামনে বসে থেকে প্রাণ ওষ্ঠাগত। শাড়ির আঁচল টেনে মুখ, গলা মুছে চুলা বন্ধ করলাম। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম আকাশে। তারার দেখা নাই সেখানে, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। বৃষ্টি কী তবে ঝড়বে আজ? একটা ক্ষীণ আশা জাগলো মনে।

” নে এইটুকু খেয়ে নে। সারাটা দিন তো খেটেই মরছিস। শরীরের যে হাড্ডি গোনা যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল আছে?”

একটা প্লেটে একটুকরো বড় কাতলার পিস, তিনচার টুকরো গরুর গোশত, আর ভাত একসাথে করে প্লেটটা তুলে ধরল আমার দিকে জরিনা খালা। আমি ভয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে বললাম,

” তোমার মাথা খারাপ হয়েছে খালা? মা দেখলে কুন্তি পোড়া দেবে সারা শরীরে। আমাকে চোর বানাতে চাও তুমি?”

” মোর জ্বালা! চোর বানাইতে চামু কেন? কেউ দেখব না। তরতরি খাইয়া ল তো। ধর!”

” আমি খাব না খালা। তুমি খাও তোমার খিদে পেলে।” পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্যত হতেই খালা হাত চেঁপে ধরে। ধমক দিয়ে বসিয়ে কোলের মধ্যে খাবার সমেত প্লেটটা রেখে বলে,

” এতো ভয় পাস কেন লো ছেরি? ভয়ে ভয়েই তো মরবি তুই। যারা পাপ করল তারা তো সিনা টান করে ঘোরে আর তুই ভয়ে মরস। খাইয়া দাইয়া গায়ে কাটা জন্মা। সেই কাটার বিষ বিন্দাইয়া মারবি এক একটারে। তাইলে না তোর জনম সার্থক! কথা না কইয়া চুপচাপ খা। আমি পাহারা দিতাছি। কেউ আইলে কমুনে।”

” খালা সত্যি আমার খিদে নেই।” কাচুমাচু করে বললাম আমি।

” আবার নাকে কান্দোস? বেশি কথা কইবি তো চোপার মধ্যে দিমু একটা। তোর কষ্ট এই অমানুষ গুলার চোখে না পড়ুক, আমার চোখে তো পড়ে। আন্ধা না সব দেখি আমি। চুপচাপ খা। ”

জরিনা খালার চোখ বড় বড় করে ধমকানিতে গলা শুকিয়ে গেল আমার। জরিনা খালার মাথায় একটু দোষ আছে সবাই জানে। আমার শ্বাশুড়িও তার রাগকে ভয় পান। রাগলে নাকি বোধবুদ্ধি থাকে না তার। সুতরাং তার রাগকে উপেক্ষা করা আমার সাহসের বাইরে। একদিকে শ্বাশুড়ির ভয় অপর দিকে সম্মুখে চোখ রাঙিয়ে দাঁড়ানো জরিনা খালা। এক গাল ভাত মুখে পুড়তে ভয়ের শেষ রইল না আমার। ভয়ে ভয়ে নাকে মুখে সবটা দ্রুত শেষ করতে হলো খালার তাড়ায়। হাত ধুয়ে পানিটুকু মুখে দিতেই বাইরে আহনাফের চিৎকার শুনে নাকে উঠে গেল পানি। খালা ছুটে বেরিয়ে গেলেন বাইরে। কাশতে কাশতে আমিও রান্নাঘরের দরজার পাশে দাঁড়ালাম। আহনাফ মা! মা! বলে বাড়ি মাথায় তুলে নিয়েছে। ছেলের কর্কশ আওয়াজে আহনাফের মা মেনি বিড়ালের মতো মুখটা একটুখানি করে ছেলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। আহনাফের রাগ সম্পর্কে আমি ভালোমতোই জ্ঞান রাখি। এমনি সময় মানুষ মনে হলেও রেগে গেলে হিংস্র হায়েনায় রূপ নেয় সে। মায়ের চুপসানো মুখের তোয়াক্কা না করে সামনে রাখা টুলটা আছড়ে ভাঙ্গলো। সাথে আরও যা পেল সবই ভেঙে তছনছ করে। গোঙাতে গোঙাতে হুঙ্কার ছেড়ে বলে,

” কোন সাহসে তোর ভাইয়ের ছেলেকে আসতে বলেছিস এখানে তুই? কুত্তার বাচ্চা, তোর এতো স্পর্ধা কী করে হয়? এখনি মোবাইল করে না করে দে রাফসান কে। কর মোবাইল! ”

আহনাফের মা কাঁদো কাঁদো স্বরে ছেলেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। যা এতোদিন পারেন নি তা আজ কী করে পারবেন তিনি? আহনাফ মায়ের এগিয়ে আসা হাতটা মুচড়ে ধরে চিৎকার করে,

” তোর ঐ ভাইয়ের ছেলে আমাকে কী করেছিল মনে নেই? সব জেনেও কেন আসতে বললি তুই? আমাকে মারতে চাস? তাহলে বল এখনই মরে ধুয়ে সাফ হচ্ছি।”

টেবিলে রাখা ফল কাটা ছুরি নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে হাতের শিরা বরাবর টান মারে সে। গল গল করে রক্ত পড়ছে। আহনাফের মার বোধহয় মাথা ঘুরে গেছে। আল্লাহ গো বলে চিৎকার দিয়ে বসে পড়লেন তিনি। আমি ভয়ে একচুল নড়লাম না৷ তবে উদ্বিগ্ন হচ্ছি মনে মনে। সে সময় বাড়িতে উপস্থিত আড়তে কাজ করা দু’জন ছেলে ছুটে গেলে আহনাফ লাথি মেরে সরিয়ে দেয় তাদের। রাগে ফোসফোস করছে সে। ঘটনাক্রমে তখনই এসে হাজির হলেন আমার শ্বশুর রইস চৌধুরী। সদর দরজায় স্বামীর গলার আওয়াজ পেয়ে আমার শ্বাশুড়ি সর্বশক্তি ব্যয়ে আর্তচিৎকার করে উঠলেন। শ্বশুর বেচারা বোধকরি মোবাইলে কথা বলছিলেন। স্ত্রীর এহেন কান্নার সাথে তিনি পূর্বপরিচিত। তাইতো মোবাইল ফেলেই লুঙ্গি হাঁটু সমান তুলে ছুটে এলেন স্ত্রী, পুত্রের সম্মুখে। ছেলের রক্তারক্তি অবস্থা দেখে দুহাতে জাপটে ধরে বসার ঘরে নিয়ে গেলেন। এসি ফুল স্প্রিডে ছেড়ে দুয়া,দুরুদ পড়ে ফুঁ দিতে লাগলেন তিনি। আমার শ্বশুর পালোয়ান গোছের লোক। শ্যাম বর্ণ, দীর্ঘ দেহ তার। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে ষাট ছুঁই ছুঁই অথচ মনে হয় লড়াইয়ে নামলে একাই একহাতে দশটাকে ফেলে দেবেন। এলাকার মানুষ তাকে সমীহ কম ভয় বেশি পায়। আহনাফ হয়েছে অবিকল বাবার মতো। মায়ের সাথে দৈহিক কিংবা মানসিক তেমন মিল পাওয়া যায় না তার। তবে মা ছেলে দু’জনই কটু ভাষী। এখানেই যা মিল!

সবাই উঠোনে দাঁড়িয়ে বাপ ছেলেকে দেখছে।
আমি রান্না ঘর ছেড়ে ভীরু পদে এগিয়ে গেলাম। শ্বাশুড়ি মাকে পাখা দিয়ে বাতাস করতে বললো জরিনা খালা। আমি দ্রুত পদে পাখা নিয়ে এসে বাতাস করতে লাগলাম। জরিনা খালা তেল পানি মিশিয়ে শ্বশুর মশাইয়ের হাতে দিলেন। কাটা হাতে এন্টিসেপটিক লাগিয়ে,ছেলের মাথায় তেল পানি দিয়ে আব্বা! আব্বা করছেন আহনাফের বাবা। কান্নার জল ক্ষণে ক্ষনে মুছে ছেলেকে শান্ত করার সকল উপায় কাজে লাগালেন তিনি। ফলস্বরূপ আহনাফ কিছুটা শান্ত হলো। অনুযোগের সুরে তার আব্বাকে সব বলছে সে। ছেলের পক্ষ নিয়ে আমার শ্বশুর মশাই তার বউকে গালাগাল দিলেন। তাতে যেন আরও বেশি কাঁদলেন আহনাফের মা। কী ভাবছেন গালগাল খেয়ে কাঁদছেন তিনি? আরে না! ছেলেকে বোঝাচ্ছেন তিনিই দোষী। তার গালাগাল খাওয়াই উচিত। তাদের এই ছেলে ভোলানো বকাবকি, কান্নাকাটিতে আহনাফ অবশেষে শান্ত হলো। এরমধ্যে আমি দু’গ্লাস ঠান্ডা শরবত পাঠানোর আদেশ দ্রুত পালন করে পাঠিয়ে দিলাম। ছেলের ভাব ভঙ্গি পর্যবেক্ষণ শেষে রইস চৌধুরী নরম সুরে বললেন,

” রাগ করে না বাপ আমার। রাফসান যা করেছিল ভুলে যাও। হাজার হোক মামাতো ভাই তো তোমার।”

” না আব্বা! তুমি বুঝতাছ না ব্যাপার টা। সামান্য একটা দোষে ঘাড় ধরে থানায় নিয়ে গেছিল আর এখন যদি শোনে,,,” আহনাফের কন্ঠস্বর কাঁপে। রইস চৌধুরীর ছেলের ভয় বুঝতে পেরে গম্ভীর হয়ে যান

কে বলবে এই বাঘ বিড়াল হয়ে গেছে কারও আগমনের ভয়ে। আহনাফ ঢোক গিলে বাবার মুখের দিকে উদ্বিগ্ন চোখে তাকায়৷ রইস চৌধুরী এতোক্ষনে ছেলের ভয় দূর করতে মুচকি হাসলেন। আহনাফ কটমট করে তাকায় বাবার পানে। রইস চৌধুরী ছেলের কাঁধে সজোরে চাপ দিয়ে বলেন,

” ব্যাটা এতো সামান্য ব্যাপারে ঘাবড়ে গেলি? কার পোলা তুই? এই রইস চৌধুরীর পোলা। বাঘ হইয়া থাকবি, তা না করে রাফসানকে ভয় পাচ্ছিস? পাগল!”

” আব্বা তুমি বুঝতাছ না! বাঘও কিন্তু বিপদ দেখলে পিছায় পড়ে। রাফসান আমার জন্য সেই বিপদ। ঘাবড়াব না বলছ তুমি। যখন,,” আহনাফের কথা থামিয়ে দিল রইস চৌধুরী। সবাইকে আড়চোখে লক্ষ্য করে চাপা স্বরে বললো,

” চুপ কর। রাফসান আর বিপদ! এমন কিছুই হবে না। রাফসান এখানে আসছে আমার প্রয়োজনে। যে’কদিন থাকবে তোর আর ঐ ছেমরির বিষয় গোপন থাকবে। তুইও দূরে দূরে থাকবি ওর থেকে এ’কদিন। বাকিটা আমি সামলে নেব।”

” কিন্তু আব্বা!” আহনাফ বিরক্তি প্রকাশ করে চুপ হয়ে যায়। তার ইচ্ছা হচ্ছে না রাফসান! রাফসান! করতে। এই নামটাকে যতোটা অপছন্দ, এই নামের মানুষটাকে তার চেয়ে কয়েকগুন বেশি অপছন্দ তার। ছেলের অব্যক্ত মনোকষ্ট রইস চৌধুরী বুঝে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ছেলের কাটা হাতে ব্যান্ডেজের শেষ গিট দিয়ে বললেন,

” তুমিই আমার একমাত্র সন্তান আহনাফ। তোমার দিকে কোনো বিপদ আসলে আগে আমি আর তোমার মা তার মুখোমুখি হব। তোমার কিছুই হবে না বাপ। ভয়ে ভয়ে নয়, আমোদে, প্রমোদে বাঁচো। রাফসান তো চিরজীবন আর থাকতে আসছে না। দুশ্চিন্তা কর না বাপ। যাও ঘরে যাও।”

আহনাফ মনে মনে স্বস্তি অনুভব করে। এতোক্ষনে আঁধারে নিমজ্জিত তার চেহারায় রৌদ্রজ্জ্বল চিলিক দেয়। আগের মতো তেজ ফুটে ওঠে তার মুখমণ্ডলে। বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে গালে চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়ায় সে।

আমাকে অদূরে দাঁড়াতে দেখে নাম ধরে ডাকে আহনাফ। তারপর সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে যায়। আমি ঘোমটা টেনে শ্বশুরের সম্মুখ দিয়ে তার পিছু পিছু উপরে উঠছি। আকাশে গুড়ুম গুড়ুম বাজ পড়ছে। বিদ্যুতের ঝলকানিতে বাইরের ঘুটঘুটে অন্ধকার আলোকিত হচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ। মনে হচ্ছে প্রচন্ড বৃষ্টি হবে আজ রাতে। সকল রুক্ষতা, তপ্ততা ছাপিয়ে ঝর ঝর ঝরবে পৃথিবীর বুকে। সেই বৃষ্টির পরশে শ্রান্ত,স্নিগ্ধ হবে ধরা।

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে