কোন কাননের ফুল গো তুমি পর্ব-০১

0
876

#কোন_কাননের_ফুল_গো_তুমি
#সূচনা_পর্ব
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া

“তোর ড্রেস কি একটাই রে মিতুল?”

মিতুল ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ওর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে রিয়াদ। ওর ক্লাসমেট। কখনো সেভাবে কথাবার্তা হয়নি। অথচ সরাসরি তুই সম্বোধন! সে কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলল,

“কেন? থাকবে না কেন?”

“থাকলে এরকম ময়লা জামা পরে এসেছিস কেন?”

মিতুল যারপরনাই অবাক হয়ে বলল,

“ময়লা জামা পরে এসেছি মানে! কোথায় ময়লা?”

“পেছনে তাকিয়ে দেখ।”

মিতুল পেছনে তাকিয়েই আঁৎকে উঠল। হায় সর্বনাশ! এত কাদা কখন ছিটল? সে অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,

“আমার এত শখের সাদা জামা!”

রিয়াদ মুখ টিপে হেসে বলে,

“সবাই তোকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। ক্লাসে গিয়ে বসে থাক যা।”

মিতুলের ভীষণ কান্না পাচ্ছে। সে আকাশপানে তাকাল। সূর্যের দাবদাহ প্রখরতা। গনগনে তপ্ত রোদ্দুর মাথার ওপর। এমন খরস্রোতা তপ্ত রোদ্দুরের মধ্যে সে কাদা পেল কোথায়? কেউ কি ইচ্ছে করে তার জামায় কাদা লাগিয়ে দিয়েছে? কিন্তু সেটাই বা কী করে সম্ভব! আবার হতেও পারে। শত্রুতা করার ইচ্ছে থাকলে অনেকভাবেই করা যায়। তবে প্রশ্ন এখানেও রয়ে যায়। নতুন কলেজ, নতুন পরিবেশ; সূচনাতেই তার শত্রু জুটল কোত্থেকে? সে আর কিছু ভাবতে পারছে না। লম্বা করে শ্বাস নিল। এখানে নবীনবরণ অনুষ্ঠান হচ্ছে অথচ সে কিনা ক্লাসে গিয়ে বসে থাকবে! এক মনে ভাবল সে বাড়িতেই চলে যাবে। কিন্তু এই অবস্থায় বাড়িতেই বা ফিরবে কী করে? কামিজের পেছনের অংশের অর্ধেক অংশই কাদায় মাখামাখি। কী বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে! সে ক্লাসে না গিয়ে কোলহলহীন একটি জায়গায় গিয়ে চুপ করে বসে রইল। সবাই কত আনন্দ করছে। অথচ সে কিনা এখানে ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে। এভাবে কতক্ষণই বা বসে থাকা যায়। তাই সে বিরক্ত হয়ে চলে যাবে বলে ঠিক করে। একটু এগিয়ে আবার পিছিয়ে আসে। ভীষণ আনইজি ফিল হচ্ছে। ওকে একা অফিস কক্ষের সামনে পায়চারি করতে দেখে একটা ছেলে এগিয়ে আসে। তার মুখে মাস্ক। সে মিতুলের উদ্দেশ্যে বলে,

“এনিথিং রং?”

মিতুল উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকাল। সবকিছুই এখন তার বিরক্ত লাগছে। সে বলল,

“না।”

ছেলেটি অনেকক্ষণ পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। যেন মিতুল তার কত বছরের চেনা! সে অস্পষ্টভাবে বলে ওঠে,

“মিতুল!”

মিতুল কিছুটা অবাক হয়ে বলল,

“আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?”

ছেলেটি এবার মুখের মাস্ক খুলে ফেলে। কিছুটা সময় লেগে যায় মিতুলের তাকে চিনতে। যখন চিনতে পারল তখনই তার বুকটা ধক্ করে ওঠে। পুরনো কিছু তিক্ত স্মৃতি চোখের দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে। অথচ সে আর কখনোই এই দৃশ্য এবং এই ঐ মানুষটার মুখোমুখি হতে চায়নি। বাস্তবে তো নয়-ই; এমনকি কল্পনাতেও নয়। তাহলে কেন এমন হলো? কেন এত বছর বাদে পূণরায় তার সহিত সাক্ষাৎ ঘটল? নওশাদ স্যার এখানে সে ভেবেই পাচ্ছে না।চিনতে পারার পর থেকেই মিতুলের চেহারার রং পালটে গেছে। অসস্তিতে গাঁট হয়ে যাচ্ছে সে। আর এক মুহূর্তও সে এখানে থাকবে না। যে যা ভাবে ভাবুক, তাকে নিয়ে হাসাহাসি করুক তবুও সে এই মুহূর্তেই স্থান ত্যাগ করবে। করেও তাই। কোনো রকম প্রত্যুত্তর না করেই সে হাঁটা শুরু করে। নওশাদ অনেকবার পেছন থেকে নাম ধরলে ডাকলেও সে ফিরে তাকায় না।

কলেজ গেইটের বাইরে এসে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছে মিতুল। ফাঁকা কোনো রিকশা নেই। পেছনের চায়ের দোকান থেকে কতগুলো ছেলের হাসাহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওদের কিছু কথোপকথনও কানে এসেছে মিতুলের। তাকে নিয়েই ওরা হাসি-তামাশা করছে। মিতুল শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে। মনেপ্রাণে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছে সে। তার পাশেই একটি ছেলে বাইক থামিয়ে দোকান থেকে কিছু কেনার জন্য এগিয়ে আসে। সাধারণত ছেলেটির কানেও ছেলেগুলোর কথা ভেসে আসে। সে মিতুলের দিকে তাকাল। আরক্তিম মুখখানা থমথমে হয়ে আছে। ছেলেটি এগিয়ে এসে বলল,

“গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন?”

মিতুল ছেলেটির মুখ দেখতে পাচ্ছে না। হেলমেট পরার কারণে ঐ স্বচ্ছ চোখ দুটোই শুধু সে দেখতে পায়। চোখের ভাষা কি সবাই পড়তে পারে? মিতুলও চেষ্টা করছে। তার চেষ্টায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে ছেলেটি বলল,

“কী হলো?”

মিতুল মৃদুস্বরে বলল,

“জি।”

“এখানে খালি রিকশা পাবেন না। সামনে এগিয়ে গিয়ে রিকশা নিতে হবে। বাইকে উঠুন। আমি নামিয়ে দিচ্ছি।”

“আপনার বাইকে উঠব কেন?” সন্দেহ প্রকাশ করে বলল মিতুল।

“সাহায্য নেওয়ার জন্য।” এরপর ছেলেটা পকেট থেকে আইডি কার্ড বের করে মিতুলকে দেখিয়ে বলল,

“আমি এই কলেজেরই ছাত্র। আমায় বিশ্বাস করতে পারেন।”

মিতুল একবার পেছনে ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে কী ভেবে যেন রাজি হয়ে গেল। সে বলল,

“ঠিক আছে।”

মিতুল ভেবেছিল ছেলেটি হয়তো তাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। কিন্তু এগিয়ে দিল রাস্তার মোড়ে, যেখান থেকে রিকশা পাওয়া যাবে। সে নেমে দাঁড়ালে ছেলেটি তার গায়ের শার্ট খুলল। যদিও শার্টের ভেতরে হোয়াইট টি-শার্ট আছে। শার্ট মিতুলকে দিয়ে বলল,

“এটা কোমরে বেঁধে নিন। আর একটু অপেক্ষা করুন। রিকশা এখানেই পাবেন।”

মিতুলের হাতে শার্ট ধরিয়ে দিয়েই ছেলেটি বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেল। একটা কিছু বলার সুযোগও দিল না। মিতুল কতক্ষণ তাকিয়ে রইল। এরপর যখন ফাঁকা রিকশা পেল তখন আর কাল বিলম্ব না করেই রিকশায় উঠে পড়ল। এই মুহূর্তে বাড়ি ফেরাটাই তার মুখ্য উদ্দেশ্য। অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে বাড়ি ফিরেই ব্যাগটা সজোরে সোফায় ছুঁড়ে ফেলল মিতুল। শব্দ শুনে রান্নাঘর থেকে মমতা বেগম বেরিয়ে এলেন। কণ্ঠস্বর উঁচু করে বললেন,

“হয়েছে কী?”

মিতুল চিৎকার করে বলল,

“আমি ঐ কলেজে পড়ব না।”

“কেন? নওশাদ আছে তাই?” পাশের রুম থেকে বেরিয়ে প্রশ্ন করলেন তৈয়ব রহমান।

বাবাকে দেখে মিতুল চুপসে যায়। মাথা নত করে ফেলে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে পড়ছে সে। কোনো রকমে সাহস সঞ্চয় করে বলে,

“সে ঐ কলেজে আছে জানার পরও তুমি আমাকে ঐখানে ভর্তি করিয়েছ?”

“হ্যাঁ। নওশাদ কোনো বাঘ-ভাল্লুক নয়। আর তুমিও কয়েদ থেকে পালানো কোনো আসামী নও যে দুজনে এক কলেজে থাকতে পারবে না। তাছাড়া তুমি স্টুডেন্ট আর সে টিচার। সত্যকে এড়িয়ে কেন যেতে চাও? বারংবার বলেছি সত্যের মোকাবেলা করতে।”

“কিন্তু আমি তার মুখোমুখি হতে চাই না বাবা।”

“হতে হবে। টাকা খরচ করে ভর্তি করিয়েছি। তোমার বাবার মুখ দেখেই তোমাকে কলেজে নিয়ে নেয়নি। সূতরাং, আগে কী হয়েছে না হয়েছে সেসব ভুলে যাও এবং পড়াশোনায় মনোযোগ দাও।”

বাড়িতে একমাত্র কর্তা তৈয়ব রহমান। তার কথাই শেষ কথা। তার একটা গর্জনই যথেষ্ট সবাইকে তার সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার জন্য। তবে এ কথাও সত্য, তিনি কখনোই না ভেবে-চিন্তে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন না। যার যেটা মঙ্গল তিনি তার জন্য সেই সিদ্ধান্তই নেন। বিশেষ করে তার একমাত্র মেয়ে মিতুলের বেলাতেই তার কঠোরতা বেশি প্রযোজ্য। একমাত্র মেয়ে বাড়িসহ বংশের সবারই আদরের মিতুল। পান থেকে চুন খসলেই সকলে উতলা হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত কোনো কিছুই কখনো ভালো কিছু বহন করে আনতে পারে না। মিতুলের বেলাতেও ঠিক তাই হয়েছিল। আর তাই বাকিদের থেকে নিজেকে একটু আলাদাভাবে মেয়ের সামনে উপস্থাপন করেন তিনি। তার রাগ, দম্ভ এবং কঠোরতার জন্য হলেও যেন মিতুল বিপথে না যায়, ভুল না করে এটাই তিনি চান। মেয়ের জন্য কলিজা পুড়লেও বাইরে তিনি কাঠিন্য বজায় রাখেন।

মিতুলও বুঝে গেছে তার জেদ এই বাড়িতে বর্তাবে না। বিশেষত বাবার কাছে তো নয়-ই। বাবার সিদ্ধান্তই শিরোধার্য। সেখানে কান্নাকাটি করা মানে সময় নষ্ট এবং নিজের ক্ষতি। তবে মন মানলেও তার মস্তিষ্ক বিষয়টা মানতে নারাজ। তার রাগ কমছে না। সে নিজের রুমে চলে গেল। পরনের জামাটা খুলে ফ্লোরে ফেলে ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ারের নিচে দাঁড়ায়। মমতা বেগম কিছুক্ষণ বাদেই নুডলসের বাটি নিয়ে আসেন মেয়ের রুমে। বিছানার ওপর শার্ট দেখে একটু ভ্রুঁ কুঁচকে তাকান। মিতুল তো শার্ট পরে না। শার্ট রেখে দৃষ্টি যায় নিচে পড়ে থাকা জামার দিকে। তিনি জামাটি হাতে তুলে নিতেই বিস্মিত হয়ে যান এত কাদা দেখে। তিনি ওয়াশরুমের দরজায় নক করে বলেন,

“মিতুল, জামায় এত কাদা ভরিয়েছিস কীভাবে? রাস্তায় গরুর মতো হাঁটিস নাকি?”

মিতুল ওয়াশরুমের দরজা সামান্য খুলে জোরে বলল,

“গরুর মতো হাঁটব কেন? গরু কি জামা পরে?”

“পশু গরু পরে না। মানুষ গরু পরে। তুই হচ্ছিস মানুষ গরু।”

মিতুলের মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। আধখোলা দরজাটি এবার সে শব্দ করে লাগাল। বিরক্ত হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল শাওয়ারের নিচে। এই বাড়িতে তার কোনো মান-সম্মানই নেই।

গোসল সেরে বেরিয়ে দেখে মা রুমে নেই। সে নুডুলসের নাটি নিয়ে ডাইনিং রুমে এসে বসল। বাবার রুমে উকি দিয়ে একবার দেখেছে আছে কিনা। নেই দেখে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। জোরে হাঁক ছেড়ে বলল,

“মা, ভাত খেতে দাও।”

“টেবিলে রাখা আছে। নিয়ে খেয়ে নে।” রান্নাঘর থেকে জবাব দিলেন মমতা বেগম।

সেই সময়ে বাড়ির কলিংবেলটা বেজে উঠল। মিতুল খাবার না নিয়ে আগে দরজা খুলতে গেল। পুঁইশাক হাতে নিয়ে এক সুন্দরমতো ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে লুঙ্গি এবং হাফ হাতার সাদা টি-শার্ট। এত সুন্দর ছেলে পুঁইশাক কেন বিক্রি করবে? মিতুলের ভীষণ মায়া হলো। সে মনে মনে স্বগতোক্তি করল,

“আহারে!”

কিন্তু মুখে বলল অন্য কিছু। ভ্রুঁ বেঁকিয়ে জানতে চাইল,

“কী চাই?”

ছেলেটি বোধ হয় মিতুলকে দেখে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেছে এমনভাবে বলল,

“ইয়ে মানে, আন্টি পুঁইশাক চেয়েছিল।”

“আপনার কি পুঁইশাকের ক্ষেত আছে?”

“জি না।”

“তাহলে কি কিনে বিক্রি করেন?”

ছেলেটি ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,

“আমি কোনো পুঁইশাক বিক্রেতা নই। আব্বুর কাছে আন্টি শাক চেয়েছিল তাই দিতে এসেছি।”

“ওহ সরি। আপনার বাবা বিক্রি করেন। বুঝতে পারিনি। আচ্ছা দাঁড়ান আমি টাকা নিয়ে আসছি মায়ের থেকে।”

মিতুল শাকগুলো নিয়ে মমতা বেগমের কাছে চলে গেল। টাকা চাইলে তিনি বললেন,

“টাকা দিয়ে করবি কী?”

“শাকের দাম দেবে না?”

“ওরা কি শাক বিক্রি করে নাকি। ছাদে লাগিয়েছিল। তুই ছেলেটাকে আবার উলটা-পালটা কথা বলিসনি তো? ও কিন্তু বাড়িওয়ালার ছেলে।”

মিতুল জিভ কাটল। যা বলার তা তো বলেই দিয়েছে সে। এখন গিয়ে কি তার সরি বলা উচিত। কিন্তু ফিরে গিয়ে ছেলেটিকে আর পাওয়া গেল না। এখন এই সুদর্শন পুঁইশাকওয়ালা যদি বাড়িওয়ালীর কাছে বিচার দেয় তবে? বাড়িওয়ালী যেই ডেঞ্জারাস মহিলা, নির্ঘাত শাস্তি হিসেবে পুঁইশাক গাছের সাথে তাকে বেঁধে রাখবে।
কী হবে না হবে ভেবেই তার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে