কোন কাননের ফুল গো তুমি পর্ব-২০

0
622

#কোন_কাননের_ফুল_গো_তুমি
#পর্ব_২০
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
মিতুলকে সাজানোর জন্য পার্লার থেকে লোক আনতে চেয়েছিল রূপকের পরিবার। কিন্তু রূপকের এক কথা, মিতুল ন্যাচারালভাবেই অনেক সুন্দর। ভারী মেক-আপের প্রয়োজন নেই একদম। যতটুকু দরকার বাড়িতে সাজলেই হবে। মিতুলও কোনো দ্বিমত করেনি। বরঞ্চ তার সেনসিটিভ স্কিনের দরুণ সে মেক-আপ করতে ভয়ই পায়। যেহেতু দুজনের একজনও পার্লারে আগ্রহী নয় তাই কেউ আর জোর করল না। এমনিতেও বিয়েটা তো ঘরোয়াভাবেই হচ্ছে।

মিতুল নিজের বিয়েতে নিজেই সাজল। আহামরি কিছুই না। সবসময় যেরকম সিম্পল সাজে সেটুকুই। শুধু বিয়ের শাড়ি আর গয়নার জন্য একটু গর্জিয়াছ লাগছে।

বিয়ে পড়ানো হচ্ছিল মিতুলদের বাড়িতে। কাজী যখন মিতুলকে কবুল বলতে বললেন, তখন অজানা এক অনুভূতি হচ্ছিল তার। সহসা কবুল শব্দটি তার কণ্ঠ থেকে বের হচ্ছিল না। এদিকে তার চারপাশে বসে থাকা বান্ধবী, ভাবি, টুম্পা সবাই ফিসফিস করে তাগাদা দিচ্ছিল। এক পর্যায়ে অনিক বলেই ফেলল,

“মেয়েদের কবুল বলতে এত সময় লাগে কেন?”

রিনভী কঠিন দৃষ্টিতে তাকাতেই অনিক চুপসে গেল। সাদামাটা বিয়ের আয়োজন হলেও এখানে তিশাও আমন্ত্রিত ছিল। সে মিটিমিটি হাসছিল দেখে অনিক জিজ্ঞেস করে,

“তুমি হাসছ কেন?”

“এমনিই।”

“এখানে তো হাসার মতো কোনো পরিস্থিতি হয়নি।”

“এখন কি আমার হাসাও বারণ?”

“উঁহু! তুমিও কি মিতুলের মতো এত সময় নেবে কবুল বলতে?”

“সেটা আমি এখনই কী করে বলব? বিয়ের সময় বলতে পারব। তখন তো…”

তিশার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই সবাই একত্রে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠল। মিতুল কবুল বলেছে। কেন জানে না, বিয়ে মিতুলের হলেও খুশি অনিকের লাগছে। তার এমন মনে হচ্ছে যে, তিশার সাথে আজ তারও বিয়ে হচ্ছে। বিয়েতে কি সত্যিই এতটা আনন্দ লাগে?

বিয়ে পড়ানো শেষ হলে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রাতেই মিতুলকে রূপকদের ফ্ল্যাটে নিয়ে এলো। যদিও দূরত্ব একদম নেই বললেই চলে তবুও বিদায়বেলা মিতুলসহ বাড়ির প্রত্যেকের কান্না বাঁধা মানছিল না। এইতো এইটুকু পথ। ইচ্ছে হলেই তারা গিয়ে তাদের মেয়েকে দেখে আসতে পারবে। আবার মিতুলও যখন খুশি চলে আসতে পারবে। তারপরও এত কষ্ট কেন হচ্ছে? বিয়ের পর বোধ হয় মেয়ে যতই কাছে থাকুক না কেন, তাকে দূরেই মনে হয়।

রাত প্রায় দেড়টা বেজে গেছে। ঘুমে দু’চোখ বুজে আসছে মিতুলের। শরীরে স্বস্তি নেই ভারী শাড়ি আর গয়নাগাটির জন্য। লজ্জায় মুখ ফুটে রূপককে সে কিছু বলতেও পারছে না। চুপ করে খাটের এক পাশে বসে আছে। রূপক যখন রুমে এসে দরজা লাগাল, মিতুলের জান তখন যায় যায় অবস্থা। মনে হচ্ছে তার আত্মা আর তার মাঝে নেই। এখনই ফুড়ুৎ করে বের হয়ে যাবে দেহ করে। এতটা ভয় কেন লাগছে তার রূপককে?

রূপক কাছে এসে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখে মিতুল জড়োসড়ো হয়ে বসে কাঁপছে। সে ভড়কে গিয়ে বলে,

“তুমি ঠিক আছো?”

মিতুল কথা বলবে তো দূরে থাক, চোখ মেলে তাকাতেও পারছে না। তার দৃষ্টি ফ্লোরের দিকে স্থির। রূপক এবার পাশে বসে মিতুলের হাত ধরল। এতে মিতুলের কাঁপাকাঁপি আরও বেড়ে যায়। রূপক বলে,

“তুমি কি ভয় পাচ্ছ আমাকে?”

মিতুল কোনো রকমভাবে বলল,

“সে…সেরকম কিছু নয়। একটু আনইজি আর নার্ভাস লাগছে।”

“ইজি হও। ভয়ের কিছু নেই।” বলে রূপক এক গ্লাস পানি এনে দিল।

পানিটুকু পান করে বড়ো করে দম নিল মিতুল। রূপক গ্লাস রেখে মিতুলের ঘোমটায় হাত রাখতেই মিতু্ল আঁতকে উঠে বলল,

“কী করছেন!”

রূপক হেসে ফেলে। হেসে হেসেই বলে,

“তুমি যা ভেবেছ, এখন সেসব করব না। তোমার চেঞ্জ করা দরকার তাই সাহায্য করছি।”

“সাহায্য করবেন মানে? শাড়ি, ঘোমটা আমি খুলতে পারব।”

মিতুলের এমন বোকা বোকা কথাতে রূপকের হাসির দমক আরও বেড়ে যায়। সে বলে,

“জানি। কিন্তু খোঁপায় যে কতগুলো ক্লিপ লাগিয়েছ, শাড়িতে না জানি কোথায় কোথায় সেফটিপিন লাগিয়েছ। এগুলো তো তুমি একা খু্লতে পারবে না।”

“আমি পারব। আপনি চেঞ্জ করে নিন।”

“তুমি এমন কেন করছ?”

মিতুল জড়োসড়ো হয়ে বলল,

“আমার আসলে লজ্জা লাগছে।”

রূপক মিতুলের দু’কাঁধে হাত রেখে ড্রেসিংটেবিলের সামনে এনে বসাল। ঘোমটা খুলতে খুলতে বলল,

“এত লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই এখন। বেশিদিন অবশ্য এই লজ্জা থাকবে না। নতুন নতুন তো। তাই এমন লাগছে। পরে তুমি নিজেই আমাকে চোখে হারাবে।”

মিতুল কোনো উত্তর দিল না। সে দৃষ্টি নত করে বসে আছে। অন্যদিকে মিতুলের গয়নাগাটি খুলতে খুলতে আয়নার মাঝে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে রূপক। সে যে কীভাবে নিজে কন্ট্রোল করে রেখেছে নিজেও জানে না। তার তো ইচ্ছে করছে মিতুলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফোলা ফোলা গালে অজস্র চুমু দিতে। অবশ্য সে এসব করল না। আগে মিতুলকে সহজ হতে দিতে হবে। মনের ভয় কাটাতে হবে। তাই সে তার ইচ্ছেকে মনের গোপন কুঠুরিতে রেখে বলল,

“শাড়ির সেফটিপিন তুমি খুলে নিও। আর তোমার ভাবি লাগেজে তোমার জামা-কাপড়, প্রয়োজনীয় সবকিছু দিয়ে দিয়েছে। বিয়ে হয়েছে বলেই যে শাড়ি পরতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তুমি যেই পোশাকে কমফোর্টেবল ফিল করবে সেটাই পরবে।”

মিতুল মাথা নাড়াল। রূপক পাঞ্জাবি খুলে একটা হাফ স্লিপ টি-শার্ট পরে রুমের বাইরে চলে গেল। মিতুল ভাবল শুধু শাড়ি বদলেই সে স্বস্তি পাবে না। গোসল করলেই ভালো লাগবে। তাই সে লাগেজ থেকে নীল রঙের একটা টি-শার্ট আর কালো রঙের প্লাজো নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে গোসল করে বেরিয়ে দেখে রূপক মিতুলের বিয়ের শাড়িটা কোনোরকম ভাঁজ করে চেয়ারের ওপর রাখছে।

মিতুলকে দেখেই রূপক কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুপ করে রইল। এরপর বলল,

“হুমায়ুন আহমেদ ঠিকই বলেছেন।”

“কী বলেছেন?”

“মেয়েদের মাথায় তোয়ালে পেঁচানো অবস্থায় সত্যিই অনেক সুন্দর লাগে।”

মিতুল লজ্জা পেয়ে গেল। রূপক তাকে খাটের ওপর বসিয়ে টেবিলের ওপর থেকে প্লেটটা নিল। সে তখন রুমের বাইরে খাবার আনতেই গেছিল। সে নিজে হাতে খাবার তুলে দিচ্ছিল মিতুলকে। মিতুল অবাক হয়ে বলে,

“একটু আগেই তো খেয়েছি।”

“আমি দেখেছি কতটুকু খেয়েছ। দুই লোকমা খাবারও ঠিকমতো খাওনি। এখন হা করো তো দেখি।”

“আমার ক্ষুধা নেই।”

“আমি হা করতে বলেছি।”

একই তো মিতুলের লজ্জার শেষ ছিল না। এখন আবার রূপকের হাতে খেতে হচ্ছে। লজ্জায় মনে হচ্ছে এবার সে ম-রে’ই যাবে। খাওয়া শেষ হলে রূপক প্লেট রেখে আসতে গেল। মিতুল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। সত্যি কি একটু বেশিই সুন্দর লাগছে আজ তাকে? সেই সময়ে রূপক রুমে চলে আসে। দরজা লক করে মিতুলের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

“কী এত দেখছ নিজেকে?”

মিতুল লজ্জা পেয়ে হেসে বলল,

“কিছু না।”

রূপক বলল,

“কমফোর্টেবল ফিল করো এজন্য যেকোনো পোশাক পরতে বলেছিলাম। তাই বলে তুমি টি-শার্ট পরবে?”

“কেন? ভালো লাগছে না?”

“তুমি যা-ই পরো না কেন, তোমাকে আমার সবসময়ই ভালো লাগবে। কিন্তু বিষয়টা তো ভালো লাগা, মন্দ লাগার নয়।”

“তাহলে?”

“এমনিই একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করেছি। তার ওপর এমন পোশাক পরেছ যে, আমি এখন আদর করব কেমনে সেটাই বুঝতেছি না।”

লজ্জায় ম-রি, ম-রি অবস্থা মিতুলের। তবুও সে কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

“আপনি খুব বাজে খুব। আর আমি মোটেও বাচ্চা নই।”

“তুমি বাচ্চাই। আমার বাচ্চা বউ। আজ বরং তুমিই আমাকে আদর করো।”

মিতুল রূপকের বুকে, বাহুতে মা-র-তে, মা-র-তে বলে,

“আপনি এত অসভ্য আর বাজে কেন?”

রূপক হাসতে হাসতে মিতুলের দুই হাত চেপে ধরে যেন মা-র-তে না পারে। এরপর সে হঠাৎ করেই মিতুলের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াল। এতক্ষণ মিতুলও হাসলেও, এবার তার হাসি বন্ধ হয়ে যায়। মনে হয় দম আটকে আছে। নিশ্বাসও নিতে পারছে না ঠিকমতো। রূপক ফিসফিস করে বলে,

“তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরি?”

মিতুল কিছু বলতে পারছে না। রূপক ফের বলে,

“প্লিজ!”

মিতুল মৃদুস্বরে বলে,

“হু।”

সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ শক্ত করে মিতুলকে জড়িয়ে ধরে রূপক। খোঁপা থেকে তোয়ালে খুলে মিতুলের ভেজা চুলে মুখ ডুবিয়ে দেয়। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে মিতুলের। সেই সময়েই কারেন্ট চলে যায়। এতে যেন মিতুলের ভয় আরও বেড়ে গেল। রূপক তাকে আশ্বস্ত করে বলল,

“আমি আছি তো!”

মিতুল ফিসফিস করে বলল,

“এজন্যই তো ভয়।”

রূপক হেসে বলে,

“হু? কী?”

মিতুলও হেসে ফেলে বলে,

“কিছু না।”

রূপক মিতুলকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিতেই আবার কারেন্ট চলে আসে। আবারও লজ্জায় রাঙা হয়ে যায় মিতুল। রূপক কাছে আসতেই সে বাঁধা দিয়ে বলে,

“লাইট অফ করেন প্লিজ!”

রূপক লাইট অফ করে ডিম লাইট অন রাখল। ডিম লাইটের মৃদু সবুজ আলোতে পুরো ঘরটা অন্যরকম সুন্দর লাগছে। তারচেয়েও বেশি সুন্দর লাগছে তার মিতুলকে। সে মিতুলের কাছে গিয়ে হাতে চুমু খেল। গালের সঙ্গে সঙ্গে গাল মিশিয়ে বলল,

“ভালোবাসি।”

দুজনের একসাথে রাত্রি যাপন, এই প্রথম এতটা কাছে আসা, রূপকের দেওয়া স্বর্গীয় আদর-ভালোবাসা সমস্তকিছু মিলিয়েই সুন্দর রাতটি কেটে যায়।

সকালে রূপকের ঘুম ভাঙল ভাবির ডাকাডাকিতে। ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে রূপক বুঝতে পারল, ওঠা তো দূরে থাক; সে তো ঘাড়টাই নাড়াতে পারছে না। সে দু’হাতে ভালো করে চোখ ডেলে তাকাতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। মিতুলের এক পা রূপকের গলার ওপর রাখা। মাথাটা দেয়ালের সাইডে। এক হাত নিজের পেটের ওপর এবং অন্য হাত বিছানায় ছড়িয়ে রেখে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। এরকম করেও কেউ ঘুমায়? রাতে তো ঘুমানোর সময় মেয়েটা রূপকের বুকেই ছিল। সরল কখন? সে তো টের পেল না একটুও। মিতুলের চুলগুলো খোলা অবস্থায় মুখের ওপর ছড়িয়ে আছে। টি-শার্ট পেটের ওপর থেকে অনেকখানি সরে গেছে। রূপক আস্তে করে মিতুলের পা সরাল। চুলগুলো মুখের ওপর থেকে সরিয়ে টি-শার্ট পেটের ওপর নামিয়ে দিল। মাথাটা ধরে বালিশে রাখার সময় মিতুল ঘুমের ঘোরেই আষ্টেপৃষ্ঠে রূপককে জড়িয়ে ধরল।

ভাবি তখনো বাইরে থেকে ডেকে যাচ্ছিল।

“কী ব্যাপার রূপক? উঠবে না? বেলা কয়টা বাজে খেয়াল আছে? ওঠো। নাস্তা করো আগে দুজনে।”

রূপকের মাথা তখন মিতুলের বুকের ওপর। মেয়েটা ঘুমের মাঝেই এমনভাবে ধরে রেখেছে যেন ছাড়লেই রূপক পালিয়ে যাবে। সে কোনো রকমভাবে উত্তর দিল,

“ভাবি, যাও আমরা আসছি।”

“জলদি।”

রূপক আর কিছু বলল না। মিতুলের বুকের ওপর মাথা রেখেই শুয়ে রইল। সেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আনমনে হেসে বলল,

“আমার বাচ্চা বউ।”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে