#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_০৭
#নুর_নবী_হাসান_অধির
চা নিয়ে উদাস মনে তাকিয়ে আছে৷ কিছুই ভালো লাগছে না৷ পরী ভাবতে পারেনি তার ছোট মা তার সাথে এমন ব্যবহার করবে। চিরকুট লিখে ছোট মায়ের কাছে যায়৷ আনন্দপুরে চিঠি পাঠানোর কথা বলায় আশালতা বলেন,
“গ্রামে চিঠি পাঠানোর কোন দরকার নেই৷ ঢাকায় দুইদিন না হতেই চিঠি পাঠানো শুরু করছো৷ আরও তো দিন পড়ে আছে৷ হাওয়ায় চিঠি যায় না৷ সাথে মোটা অঙ্কের টাকা লাগে৷”
পরী কিছু বলার আগেই আশালতা চিরকুট নিয়ে ছিঁড়ে ফেললেন৷ নিমিষেই মনটা ভেঙে গেল৷ বুকের গহীনে তীব্র ব্যথা শুরু হলো৷ অজান্তেই চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু কণা গড়িয়ে পড়ল। পরী চোখের জল মুছে নিজের রুমে চলে আসেন৷ রাতে খাওয়া হলো না আর৷ ঘুমটা নিশাচর পাখির মতো চলে গেল। মায়ের জন্য চিন্তা করতে করতে ভোর হয়ে গেছে৷
সমাপ্তির ডাকে পরীর ঘোর কাটে৷ সমাপ্তি আলতো করে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“কি হয়েছে তোর? চা তো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে৷ খাচ্ছিস না কেন? মন খারাপ!
পরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“খেতে ইচ্ছা করছে না৷ কিছু ভালো লাগছে না। এক সাথে এতো প্রশ্ন কেউ করে।
“তোর কি মন খারাপ? সকাল থেকে তোকে উদাসীন লাগছে৷”
“তেমন কিছু না৷ মা’কে ছাড়া কোনদিন থাকি নাই৷ আজ মাকে খুব মিস করছি৷ কাছে থাকতে মায়ের অভাব বুঝতে পারিনি। একটু চোখের আড়াল হতেই খুব মিস করছি৷”
সমাপ্তি পরীর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আমাদের জীবনটাই এমনই৷ কোন কিছুতেই মন আটকায় না৷ ভালো লাগে না কিছু৷ তোর মা বেঁচে আছেন৷ আর দেখ দুনিয়াতে আমার মা বেঁচে নেই৷ চিন্তা করিস না আন্টি আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন।”
সকলের চায়ের বিল তন্মায় দিয়ে দিল৷ তন্ময় পরীর পাশে দাঁড়াতেই হৃদয় কঠিন কন্ঠে বলল,
“তন্মায় নিজেকে সংযত রাখ৷ পাশে ভালোই মানিয়েছে৷ কিন্তু বেশি কিছু নয়৷”
হৃদয় কথাগুলো তন্ময়ের কানে কানে বলল৷ ছোঁয়া তাদের উদ্দেশ্যে বলল,
“তোরা ফিসফিস করে কি বলস? তোদের দেখে সন্দেহ হচ্ছে৷ আমাদের কাছ থেকে কিছু লুকাবি না৷”
হৃদয় মুচকি হেঁসে বলল,
“তেমন কিছু নয়৷ তোরা কি কোথাও ঘুরতে যাবি? একসাথে ঘুরতে গেলে ভালো লাগবে৷”
কুহু চশমা ঠিক করতে করতে বলল,
“তোরা কোথায় ঘুরতে যাবি? একসাথে কোথাও ঘুরতে গেলে সবার অনেক ভালো লাগবে৷ চল একসাথে ঘুরতে যায়৷”
পরী সকলের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“দোস্ত তোরা ঘুরতে যা৷ আমি কোথাও ঘুরতে যাব না৷ আমি দেরি করে বাসায় ফিরতে পারব না৷ ছোট মা বকা দিবেন৷ তিনি বলে দিয়েছেন ক্লাস শেষ হলেই সোজা বাড়ি ফিরতে৷”
সমাপ্তি আড় চোখে তাকিয়ে বলল,
“তোর মা বলে গ্রামে৷ তুই এখানে ছোট মা কোথা থেকে পেলি৷ তোর কথা কিছুই বুঝলাম না৷”
পরী মুচকি হেঁসে বলল,
“সময় হলে সব জানতে পারবি৷ এখন আমি আসি৷ তোরা সবাই মন খুলে ঘুরাঘুরি কর৷ আমি অন্যদিন তোদের সঙ্গ দিব৷”
_____________
আয়েশা বেগম আরিফকে স্কুলের মাঠে বড় আম গাছের সাথে বেঁধে রেখেছেন৷ এলাকার প্রতিটি মানুষের কানে পৌঁছে গেছে৷ কাজ কাম ফেলে সকলেই চলে এসেছে স্কুল মাঠে৷ পঞ্চায়েত মশাইয়ের ছেলেকে বেঁধে রেখেছেন৷ কি হবে? তা দেখার জন্য সকলেই অধীর আগ্রহে বসে আছেন৷ কানে কানে অনেক ফিসফিস কথা চলছে। গ্রাম পঞ্চায়েত মশাই এখনও আসেন নি৷ উনার জন্য অপেক্ষা করছেন সবাই৷ অবশেষে গ্রাম পঞ্চায়েত আইয়ুব আলীর দেখা মেনে৷ আইয়ুব আলী আসতেই সকলেই দাড়িয়ে যায়। হাত উঁচু করে বসতে বলে৷ আয়েশা বেগমের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাগী কন্ঠে বলল,
“আরিফকে ছেড়ে দেন৷ নয়তো আপনার লাশ পড়ে যাবে৷”
আয়েশা বেগম সকলের উদ্দেশ্যে বলেন,
“যে অন্যায় কাজ করবে তার শাস্তি চান কি আপনারা? আপনারা যদি অন্যায়ের শাস্তি না চান আমি আপনার মাঝে একজনকে মেরে ফেলব৷ কেউ শাস্তি চাইতে পারবেন না৷ কারণ আপনারা অন্যায়ের শাস্তি চাননা।”
সকলের মাঝে ভয় কাজ করে৷ কেননা আয়েশা বেগম যা বলেন তাই করেন৷ এখন কিছু না বললে হয়তো কাউকে সকলের সামনে মেরে ফেলবেন৷ অন্যদিকে আইয়ুব আলীর বিপক্ষে কথা বলাও বিপদজনক। সকলের মাঝখান থেকে একজন বলে উঠেন,
“হ্যা শাস্তি চাই।”
তার সাথে সকলে একজোট হয়ে বলল,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ৷ আমরা অন্যায়ের শাস্তি চাই৷ অপরাধীর শাস্তি চাই৷”
পঞ্চায়েত মশাইয়ের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ ধরা দিল৷ তিনি বুঝতে পারলেন গ্রামের মানুষদের উনার বিরুদ্ধে করে ফেলেছে৷ এখন কিছু বললে এর বিপরীত হবে৷ আয়েশা বেগম উচ্চ স্বরে বললেন,
“আপনারা কি জানতে চান আরিফের অন্যায়? আরিফ কি অন্যায় করেছে জানেন? কেন আমি আরিফকে বেঁধে রেখেছি।”
“হ্যাঁ জানতে চাই৷”
আয়েশা বেগম বলতে শুরু করেন,
“আরিফ শুধু একটা অন্যায় কাজ করে শান্ত হয়নি৷ একাধিক অন্যায় কাজ করেছে৷ তার আগে বলেন, আপনারা কি আপনাদের ছেলেদের কৃষক বানাতে চান? নাকি শিক্ষক, পুলিশ, ডাক্তার, ইন্জিনিয়ারিং বা প্রতিষ্ঠিত দেখতে চান৷”
“হ্যাঁ, আমরা আমাদের সন্তানদের ডাক্তার..পুলিশ বানাতে চাই৷”
“আপনাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ নষ্ট করেছে এই আরিফ। স্কুলের প্রতিটি দরজা ভেঙে ফেলেছে৷ আপনারা কি আরিফের বিচার নিজ হাতে করতে চান? সবাই যদি একজোট হোন৷ তাহলে কেউ আপনাদের ক্ষতি করতে পারবে না৷”
“হ্যাঁ হ্যাঁ আরিফকে আমাদের হাতে ছেঁড়ে দেন৷ আমরা তার শাস্তি দিব৷ স্কুল ভেঙে ফেলবে৷ আমরা সবাই তার হাত কেটে দিব৷ আমাদের হাতে তুলে দেন৷”
গ্রামের লোকজনের মনে যেন প্রতিশোধের আগুন হানা দিয়েছে। শত চেষ্টার পর একটা সুযোগ ধরা দিয়েছে তাদের হাতে। এই সুযোগ কিছুতেই হাত ছাড়া করবে না৷ ভীড়ের মাঝখান থেকে দুই একজন তো ঢিল ছুঁড়ে মেরেছে৷ পারলে ঢিল ছুঁড়ে মেরে ফেলবে। গ্রাম পঞ্চায়েত মশাই হাত তুলে বলেন,
“শান্ত হোন আপনারা৷ আরিফ যা করেছে তার জন্য আমি খুবই লজ্জিত। আমি স্কুলের দরজা জানালা সব ঠিক করে দিব৷ আর সবাইকে লেখাপড়া করতে উৎসাহিত করব৷ আরিফকে এবারের মতো ক্ষমা করে দেন৷”
গ্রাম পঞ্চায়েতের মূল শত্রু মোল্লা সাহেব বলেন,
“অন্যায়ের কোন ক্ষমা নেই৷ আপনারা যদি আরিফের হাত কেটে দেন তাহলেই আরিফের শাস্তি হবে৷ আপনারা কি চান?”
গ্রাম পঞ্চায়েত কোনঠাসায় পড়ে গেলেন৷ আয়েশা বেগম হাত উঁচু করে উচ্চ স্বরে বলেন,
“আরিফের অন্যায়ের কোন ক্ষমা হয়না৷ আমি আপনাদের ছেলেমেয়েদের পড়াই বলে আমাকে খুন করতেও চাইছিল৷ আমাকে মারার জন্য বাড়িতে গুন্ডা পাঠিয়েছিল৷”
গ্রামের লোকজন একসাথে শব্দ করে বলেন,
“আপনার কিছু হলে পঞ্চায়েত মশাইয়ের বাড়ি উড়িয়ে দিব৷ কাউকে বাঁচতে দিব না৷ আমরা আর অন্যায় অত্যাচার সহ্য করব না৷ আমরা অন্যায় সহ্য করেছি বলে আমাদের ছেলেমেয়েরাও সহ্য করবে৷ স্বৈরাচারী শাসন আর চলবে না৷”
আয়েশা বেগম পঞ্চায়েত মশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বিশ্ব জয়ের হাসি দিয়ে বলেন,
“কি পঞ্চায়েত মশাই! আমাকে মেরে ফেলবেন না৷ আপনি নাকি স্কুল ভেঙে দিবেন৷ স্কুল আমার প্রাণ। আপনি আমার জীবনে হাত দিয়েছেন৷ আমি বেঁচে থাকলে আপনার শাসন আর থাকবে না৷ যুদ্ধ করে সোনার বাংলা গড়ে তুলেছি৷ সেখানে শাসকের জায়গা নেই।”
পঞ্চায়েত মশাই হাত জোড় করে মিনতি স্বরে বলেন,
“আমার ছেলেকে বাঁচান। নয়তো বোকা গ্রামের আরিফকে লোকজন মেরে ফেলবে৷”
আয়েশা বেগম উঁচু স্বরে বলেন,
“পঞ্চায়েতের কথা বিবেচনা করে আরিফকে ক্ষমা করা যায়৷ যা ক্ষতি হয়েছে পঞ্চায়েত মশাই সব ঠিক করে দিবেন৷ আর স্কুলের সামনের জমিটা স্কুলের নামে লিখে দিবেন৷ সেখানে ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করতে পারবে৷”
_________
পরী বুঝতে পারে আশালতার উদ্দেশ্য। তিনি কিছুতেই পরীকে সহ্য করতে পারেন না৷ দিনদিন খোলস ছেড়ে বের হচ্ছেন৷ পরী সোফায় বসে বিটিভি দেখছিল৷ টিভি বন্ধ করে বলেন,
“বাড়িতে কাজ ফেলে টিভি দেখার শখ হয়েছে৷ অনেক টিভি দেখা হয়েছে৷ এখন বাড়ির কাজ কর৷ এখন তো আর ছোট নয়৷ অন্যের ঘাড়ে বসে বসে খেতে লজ্জা করবে না৷”
পরী মাথা নিচু করে বলল,
“ছোট মা, কি করব এখন? একটু আগে তো রান্না করেছি৷”
“কি করবে মানে? চোখ কি কানা হয়েছে৷ কিছুই দেখতে পাওনা৷ ফ্লোরে কত ময়লা হয়ে গেছে৷ হাঁটতে পায়ে বালি লাগছে৷ পানি দিয়ে ভালোভাবে ঠলে ঠলে পরিষ্কার কর৷”
পরী মাথা নাড়িয়ে কাজ করতে চলে যায়৷ বাড়িতে কাজ করেছে৷ কখনও কাজ করতে খারাপ লাগেনি৷ এখানে কাজ করতে খারাপ লাগার মূল কারণ হলো কথা বলার ধরণ৷ আশালতার কথা বলার ধরণ খুবই বাজে৷ ভালোবাসে একটুও কথা বলে না৷ যতটা পারেন বাজে ব্যবহার করেন৷ পরী বাবাকে এসব জানালে বাবা বলেন সবই মিথ্যা৷ যে বাবাকে সব সময় ভালো মানুষ মনে করেছেন৷ সত্যের পক্ষ থাকেন৷ আজ সেই বাবা কিছুই দেখেন না৷ পরী ঠিক করেছে হলে উঠবে৷ এখানে পড়ে থাকবে না৷ জ্ঞানীরা ঠিকই বলেছেন ‘আপন কখন পর হওয়া৷’ স্বার্থের জন্য মানুষ আপন হয়৷ পরীর চোখে জল টলমল করছে৷ মাকে খুব মিস করছে৷ কাছে পেলে জড়িয়ে ধরে কান্না করবে৷ পরী মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল, “এখান থেকে ঠিকই যাবে তবে আশলতার অহংকার ভেঙে৷”
চলবে…..
#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_০৮
#নুর_নবী_হাসান_অধির
আষাঢ়ের ঘনঘটায় ভারী বৃষ্টি হচ্ছে৷ বাহিরে যাওয়া যাচ্ছে না৷ ঝড়ো হাওয়ায় গাছের ঢাল পালা ভেঙে যাচ্ছে৷ বৃষ্টির জন্য পরী আজ ক্লাসে যাইনি৷ পরীকে বাড়িতে পেয়ে যেন আশালতা হাতে স্বর্গ পেল৷ রান্নাঘর থেকে ঢেকে বলল,
“বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে৷ খিচুড়ি রান্না কর৷ খিচুড়ি খারাপ রান্না করলে সবটায় তোমাকে খাওয়াব৷”
পরী মুখের উপর জবাব দিল,
“আমি রান্না করতে পারব না৷ আমি আপনার দাসী নয়৷ মহারানীর হুকুম পালন করতে পারব না৷”
পরীর কথায় আশালতা ক্ষেপে যান৷ পরীর গায়ে হাত তুলতে নিলে পরী হাত ধরে ফেলে৷ পরী অগ্নি মূর্তি ধারণ করে৷ চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট। রাগ ও প্রতিশোধের অনুষঙ্গ এখনই জ্বালিয়ে দিবে সবকিছু। পরী কঠিন গলায় জবাব দিল,
“আমার সাথে ভালো ব্যবহার করলে কাজ করে দিতে সমস্যা নেই৷ নিজের কাজ নিজে করতে কোন লজ্জার বিষয় নয়৷ আপনি আমাকে নিচু চোখে দেখেন৷ কাজ করতে বাধ্য করেন৷ দুই দিনে আমি আপনার ভিতরের রুপ দেখে নিয়েছি৷”
“এটা আমার বাসা৷ এখানে থাকতে আমার কথামতো চলতে হবে৷ নয়তো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব৷”
“হাত ঘাড় অব্দি পৌঁছাবে না৷ তার আগেই হাত কেটে দিব৷ আমাকে ভিতু নয়৷ আপনার অত্যাচার মেনে নিব৷”
“আমাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।”
“প্রিয় ছোট মা৷ আপনাকে হুমকি নয়৷ ভালোবেসে কথাগুলো বলে গেলাম৷ আমার অনেক কাজ আছে৷ আপনি খিচুড়ি ভালো করে রান্না করেন৷ আমার অনেক ক্ষুধা লাগছে৷”
পরী আশালতার কপালে আলতো করে ঠোঁট স্পর্শ করে চলে আসে৷ পরীকে আজ সহ্য হলো না৷ কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না৷ পরীর দেওয়া চুমুটা কাটা গায়ে নুনের ছিঁটার মতো লাগল৷ আশালতা রাগ ক্ষোভ নিয়ে কাজের মহিলা মর্জিনাকে খিচুড়ি রান্না করতে বলে রুমে চলে যায়৷
__________
টানা বৃষ্টিতে মানুষ বাহিরে বের হতে পারছে না৷ দিন দিন নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ পানি একটু বাড়তেই ফসলের ক্ষেতে উঠবে৷ ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে ফসলের ক্ষেতে পানি উঠতে সময় লাগবে না৷ ভারী বৃষ্টির জন্য স্কুল বন্ধ দেওয়া হয়েছে৷ আয়েশা বেগম বারান্দায় চৌকির উপর বসে বৃষ্টি দেখতে৷ হাতে নকশিকাঁথা৷ বৃষ্টির ছন্দে নকশিকাঁথা সেলাই করছে৷ একাকিত্ব ভালো লাগে না৷ পরী পারুল থাকলে বৃষ্টির মাঝে কত কাজ করত৷ নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরত৷ পরী কচু গাছ টেনে টেনে চিংড়ি মাছ ধরত৷ মেয়েটা ভীষণ পছন্দ করে চিংড়ি৷ ভাবতেই চোখ দু’টো ভিজে উঠল৷
বাঙালির নকশিকাঁথায় কত স্মৃতি জড়িয়ে থাকে! হাসি, কান্না, দুঃখ, উদাসীনতা, মন খারাপ আরও অনেক কথা লুকিয়ে থাকে প্রতিটি সেলাইয়ে। মাথায় কলাপাতা দিয়ে পাশের বাড়ি খোদেজা বানু আসেন খুস গল্পের জন্য৷ খোদেজা চৌকির এক কোণায় বসতে বসতে বলল,
“একটু পান দিবেন৷ আঙ্গোর ঘরে পান শেষ হইয়া গেছে৷ এহন আন্নের কাছে পাই খাইতে আইছি৷”
“ভালোই করেছেন৷ বসেন, আমি পান নিয়ে আসছি৷”
আয়েশা বেগম পান এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“আপনার ছেলে আনিস ঠিকমতো লেখাপড়া করে না৷ বাড়িতে পড়ার কথা বলেন না!”
পান মুখে দিতে দিতে বলল,
“আর কইয়েন না ভাবী! পোলাডারে নিয়ে চিন্তায় আছি৷ কথা হুনে না৷ আপনি স্কুলে একটু বকা দিবেন।”
“মা হলো বড় শিক্ষক৷ আপনি তাকে বুঝিয়ে পড়তে বসাবেন৷ বুঝিয়ে বললে সবই সম্ভব৷ আমি স্কুলে বলে দিব।”
“ঠিকই কইছেন ভাবী৷ পোলাডা খারাপ ছেলের পাল্লায় পড়ে এমন হয়েছে৷ প্রতিদিন রাইতে বেড়িয়ে পড়ে৷ রাইত বিয়াতে বাইরে থাকলে কেমনডা লাগে৷”
এরপর বাহিরে বের হলে বাড়িতে উঠতে দিবেন না৷ দরকার পড়লে এক বেলা খাবার দিবেন না৷ যখন কেউ জায়গা বা খাবার দিবে না তখন ঠিকই আপনার কাছে আসবে৷ ঠিকঠাক লেখাপড়া করবে, কথা শুনবে৷”
“কি যে কন না ভাবী! পোলা না খাইয়ে থাকলে আমি খাইতাম কি করে? রাতে ঘরে ঢুকতে না দিলে কই না কই থাকবে? চোর টোর ভেবে মানুষ পিটাবে৷”
“একবেলা খাবার না দিলে কিছুই হবে না৷ না খেয়ে থাকবে কেন? লেখাপড়ার বিষয়ে একটু কঠোর হোন৷ দেখবেন আপনার ছেলে ভবিষ্যৎ অনেক সুন্দর হবে৷”
“ভাবী আন্নেরে একটা কথা কইতে আইছি৷ গ্রাম পঞ্চায়েতের ছেলে আমাদের বড় গরুডা নিয়া গেছে৷ আন্নের ভাই গাভীটা কুরবানির জন্য রাখা হইছে৷ বাড়িতে গেছিলাম। না করে দিছে৷ আন্নে একটু কইলে গরুটা ফিরিয়ে দিবে৷”
“তাদের অত্যাচার দিনদিন বেড়েই চলেছে৷ এর সমাপ্তি আমাকে করতে হবে৷ আর বাড়তে দেওয়া যাবে না৷ তাদের শাসন শোষনে আর কতদিন আমরা চলব৷ আপনারা সবাই একত্রিত হয়ে মোকাবিলা করতে পারেন না৷”
“আমরা কি কইমু? কিছু কইলেই লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে সবাইকে পিটাই৷ সেজন্য কিছু কইতে পারি না। আমাদের জীবন তো সবার আগে৷”
“আমি বেঁচে থাকতে এমন কিছু হতে দিব না৷ আইয়ুব খান ছিল পাকিস্তানের একজন। এখন বাংলাদেশে দালাল আইয়ুব আলী।”
“ভাবী আরও একটা কথা হুনছেন৷ পঞ্চায়েতের ছেলে শ্যামল এসেছে বাড়িতে৷ ঝর্নার কাছ থেকে আরও একটা কথা হুনছি৷”
“কি কথা?”
“আসিফ পরীকে কেন বিয়ে করতে চাইছিল জানেন?”
আয়েশা বেগম ভুলেই গেছিল এ কথা৷ আজ মাথায় নতুন করে নাড়া দিল৷ চকিত দৃষ্টি মেলে তাকাল৷ বিষ্ময় কন্ঠে বলল,
“কেন? আপনি কি কিছু জানেন?”
“গ্রাম পঞ্চায়েতের ছোট ছেলে শ্যামল পরীকে ভালোবসত৷ আসিফও পরীকে ভালোবাসত৷ দু’ভাই পরীকে ভালোবাসত৷ শ্যামলের কথা কোন ভাবে আসিফ জেনে যায়৷ তারপর শ্যামলকে গ্রেরাম থেকে দূরে পাঠিয়ে দেয়। পরীকে দেখার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকত৷ আপনার ভয়ে আসিফ পরীকে কিছু কইতে পারে নি৷ শ্যামল চিঠি লিখলে আসিফ পাগল হয়ে যায়৷ তাই বিয়ের ব্যবস্থা করে৷ কিন্তু বিয়ের আগের দিন কি হলো? সবাই তো জানে৷”
শ্যামলের গায়ের রং উজ্জল শ্যাম বর্ণের৷ সেজন্য তার নাম রাখা হয় শ্যামল৷ দেখতে শুনতে খারাপ নয়৷ লেখাপড়ায় অনেক ভালো৷ বাকী দুই ভাইয়ের মতো নয়৷ গ্রামের লোকদের সাথে ভালো উঠা নামা ছিল৷
______________
কেটারের উল্টা দোলকের ল্যাব ক্লাস চলছে৷ পরীর হাতে থামা ঘড়ি৷ থামা ঘড়িতেও মন দিতে পারছে না৷ বার বার উত্তর দিতে ভুল করছে৷ একের পর এক দোল দিচ্ছে হৃদয়৷ হৃদয় দোলনের মাঝে বলে উঠল,
“তোকে ঠিক আগের মতো দেখাচ্ছে না৷ অনেকটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে তোর মাঝে। ঠিকমতো কথা বলস না৷ চোখের নিচে কালি জমা পড়েছে৷ নিজের খেয়াল রাখোস না৷”
“দোস্ত তুই কি মনোবিজ্ঞানী হলি নাকি? আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিস যে৷ মতলব কি?”
হৃদয় আমতা আমতা করে বলল,
“কিসের মতলব? তুই সব সময় এক লাইন বেশি বুঝতে পারিস”
“বেশি না৷ শোন আমার বইয়ের ভাজে চিরকুট কে রেখেছে জানিস?”
“আমি কি করে জানব? ক্লাস শেষে এসব নিয়ে আলোচনা হবে৷”
।
।
একে একে চিরকুট সবাই পড়ল৷ কুহু চশমা ঠিক নাকের ডাগায় নিয়ে বলল,
“দোস্ত, তোকে এতো সুন্দর করে প্রপোজ কে করেছে? সত্যি করে বল? তুই আমাদের কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছিস না।”
ছোঁয়া চিরকুট হাতে নিয়ে বলল,
“প্রিয়তমা আমি তোমায় প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলেছি। শয়নে স্বপনে, নয়নে শুধু তোমায় দেখি৷ আমি তোমাতেই আসক্ত। প্রথম দেখায় কাউকে ভালো লাগবে জানা ছিল না৷ তুমি আমার হৃদয়ের গহীন থেকে গহীনে রয়ে গেছো….।”
ছোঁয়া চিরকুটটা আর পড়তে পারল না৷ সমাপ্তি চিরকুট নিয়ে বলল,
“এখন মজা করার বিষয় নয়৷ আমরা ক্যাম্পাসে এসেছি দুই দুই চারদিন৷ কে হতে পারে? পরীর ক্ষতি করার জন্যও কেউ এমন করতে পারে৷ প্রথম দেখায় কাউকে এতোটা ভালো লাগে না৷ এগুলো সিনেমা থিয়েটারে হয়৷ বাস্তবতার সাথে কোনটায় মিল নেই৷”
কুহু চিন্তিত কন্ঠে বলল,
“দাদীমাদের মতো কথা বলা বন্ধ কর৷ আমাদের কেউ তেমন চিনে না৷ ক্ষতি করবে কে? অপরিচিত লোক কখনও ক্ষতি করে না৷ চেনা জানাশোনা লোক ক্ষতি করে৷”
সমাপ্তি বলল,
“তুই তাকে চিঠি লিখে আসতে বল৷ তারপর সবাই মিলে গণধোলাই দিব৷”
চলবে……