#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_১০
#নুর_নবী_হাসান_অধির
আশালতা কিছুতেই পরীর অপমান সহ্য করতে পারল না৷ তিনি পরীকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার জন্য সকল প্রকার প্রচেষ্টা করে৷ পলক হোসাইন কিছুতেই পরীকে বাসা থেকে বের করে দিবেন না। এগুলো পরী নিতে পারছে না৷ পরী সকলের সামনে বলল,
“আমাকে নিয়ে তোমাদের কোন চিন্তা করতে হবে না৷ আমি হলে উঠব৷ আমি কথা বলে রেখেছি৷”
পলক হোসাইন দুঃখভরা মন নিয়ে বলল,
“কেন তুই হলে থাকবি৷ হলে সব রকম সুবিধা নেই৷ হলের খাবার খেতে পারবি না৷ কেন জিত করছিস?”
আশালতার দিকে তাকিয়ে বলল,
“হলে যাই হোক মানসিক শান্তি আছে৷ যেখানে মানসিক শান্তি নেই সেখানে না থাকা অনেক ভালো৷ মানুষ মানসিক শান্তির জন্য সবকিছু করতে পারে৷ উনি কখন আমায় মেরে ফেলেন জানা নেই৷”
পলক হোসাইন রাগারাগি করে বাসা থেকে বের হয়ে যায়৷ আশালতা ভীষণ খুশী পরী তাদের সাথে থাকবে না৷ পরীও রাগ করে নিজের রুমে চলে যায়৷ আশালতা পরীর পিছন পিছন এসে বলে উঠল,
“তোর মায়ের কাছে চিঠি পাঠানোর ব্যবস্থা কর৷ টাকা পাঠাতে বল৷ এতোদিন যত অন্ন ধ্বংস করেছিস তার টাকা দিয়ে বাসা থেকে বের হবি৷”
পরীর মন খুব খারাপ ছিল৷ ভেবেছিল মায়ের মতো ভালোবাসা পাবে৷ বাবার আদর পাশে৷ ভাইয়ের সাথে হাসি খেলায় দুষ্টুমিতে দিন কেটে যাবে৷ সেখানে তার জীবন হয়ে উঠেছে নরক৷ আশালতার হীন কথায় পরীর ভীষণ রাগ হয়৷ পরী চোখের জল মুখে রুমের দরজা লাগিয়ে দিল৷ আশালতা ভয়ে ভয়ে ভীত গলায় বলল,
“রুমের দরজা লাগালি কেন? দরকা খুল বলছি৷”
“আমার আদরের ছোট মা। তোমাক সকল রকমের পাওয়া দিব। জ্ঞানীরা বলেছেন কখনও ঋণ রাখতে নেই৷”
আশালতা কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই পরী কষিয়ে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বলল,
“এটা আমার বাবাকে বিয়ে করার জন্য৷ নিজের হিংসাত্মক মেটানোর জন্য এই বিয়ে করেছিলেন৷ আপনার বিষয়ে আমি সব জেনে গেছি৷”
আশালতা বিছানায় ছিঁটকে পড়ে৷ রাগী ভাব নিয়ে উঠলে আরও একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল। পরীর চোখে মুখে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে৷ আশালতার মুখ চেপে ধরে বলল,
“আমার মাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য এই শাস্তি। বাবা সম্পর্কে খারাপ ধারণা মায়ের কাছে উপস্থাপনেরধ জন্য৷ মায়ের চিন্তা ধারণা অন্য দিকে ঘুরানোর জন্য। তোদের মতো কিছু মেয়ের জন্য বাংলাদেশের প্রতিটি মেয়ে আজ অবহেলিত। তাদের কোথাও কোন কদর নেই৷ তোদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই৷”
আশালতা ক্ষোভ নিয়ে কঠিন কন্ঠে জবাব দিল,
“পরী কাজটা কিন্তু ঠিক করছিস না৷ আমি কি করতে পারি এখনও জানিস না? তোকে গুন্ডা দিয়ে মেরে ফেলতে পারি৷ তোর সম্মানের বারোটা …”
আর কিছু বলার সুযোগ হলো না৷ তার আগেই পরী আরও একটা থাপ্পড় বসাল৷ ক্ষোভ নিয়ে বলল,
“এটা আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য। আমার মা জানতে পারলে তো কষ্ট পাবে জানো৷ কষ্টে নিজেকে বিলুপ্ত করেও দিতে পারে৷ পৃথিবীতে তোমার সবার আছে৷ আমার মা ছাড়া কেউ নেই৷”
ঘৃণার সাথে বলে উঠল,
“কাউকে হিংসা, ঘৃণা করলে তাকে খুন করে ফেল৷ তবুও তার কাছ থেকে ভালোবাসা কেঁড়ে নিবে না৷ ভালোবাসা ছাড়া মানুষটি প্রতিটি মুহুর্তে মা*রা যায়৷ বেঁচে থেকেও জীবন্ত লাশ।”
পরী হুট করেই আশালতার পা ধরে কেঁদে ফেলল। যে কন্ঠে ছিল সিংহের মতো গর্জন এখন সেই কন্ঠ ভেজা বিড়ালের রুপ ধারণা করেছে৷ পরী ভেজা গলায় বলল,
“ছোট মা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি৷ আমি কখনও তোমার সাথে এমন খারাপ ব্যবহার করতে চাইনি৷ তোমার কাছ থেকে সবকিছু কেঁড়ে নিলে কি করবে? তোমাকে এখানে থাকব বলে সব থেকে খুশী আমি ছিলাম৷ বাবার আদর পাব৷ তোমার সাথে হাসিখুশিতে ভরপুর আয়োজনের মাধ্যমে কেটে যাবে প্রতিটি মুহুর্ত৷ আরিয়ানের সাথে দুষ্টামিতে কাটবে জীবন। পারুল চলে যাওয়ার পর কাউকে আর খেলার সঙ্গী হিসাবে পাইনি৷ কেন করলে আমার সাথে?”
পরীর কান্না দেখে কিছু সময়ের জন্য আশালতার চোখে জল এসে পড়েছে। পরীরে পাশ কাটিয়ে রুম ত্যাগ করেন৷ পরী বিছানায় হেলান দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ কেন আমার কাছ থেকে সবকিছু কেঁড়ে নিচ্ছ? আমার মাকে দূরে সরিয়ে দিলে৷ আমি ঢাকার বুকে শ্বাস নিতে পারি না। আমার ধম বন্ধ হয়ে আসে৷ আমার মা কেন আমাকে স্বার্থ ছাড়া ভালোবাসে৷ মায়েরা কি স্বার্থ খুঁজে না? অথচও ছোট মা আমায় সহ্য করতে পারে না৷ ভালোবাসার কোন সংখ্যা উনার কাছে নেই৷”
পরীর চোখে আষাঢ়ের ঘনঘটা। বিষন্নতা মেঘ দু’চোখে বিরাজ করছে। ছায়া পতন ছন্দ হয়ে ঝরে যাচ্ছে অশ্রুকণা। এমন সময় প্রতিটি মেয়ে মায়ের কোল খুঁজে। মায়ের কোলে মাথা রেখে প্রতিটি অভিযোগ করতে চাই৷ মা নামক ছায়া যার কাছে নেই সেই বুঝে এই মুহুর্তের কথা৷
__________
চারিদিকে আসরের আযান দিচ্ছে৷ আয়েশা বেগম বাহিরের মাটির চূলায় রান্না করতে ব্যস্ত। বৃষ্টি বাদলের দিকে ঘরে রান্না করা হয়। বৃষ্টি ব্যতীত বাহিরে রান্না করা হয়৷ সেখানে খড়, গাছের শুকনাে পাতা বিশেষ প্রাধান্য পায়৷ আইয়ুব আলী এবং তার ছোট ছেলে শ্যামল উপস্থিত হয় আয়েশা বেগমের বাড়িতে৷ সেদিনের পর থেকে গ্রাম পঞ্চায়েত অনেকটা সর্তক হয়ে গেছেন৷ আরিফকে গাজীপুর পাঠিয়ে দিয়েছেন৷ নিজের গরুর পাল থেকে আশিকুরকে গরু দিয়েছেন। আয়েশা বেগম চূলার মুখ থেকে শুকনো পাতা সরিয়ে তাদের খোলা বারান্দায় চৌকির উপর বসতে দিলেন৷ আইয়ুব আলী বসতে বসতে বলল,
“আপনার কাছে একটা কাজে এসেছি৷ আমি জানি আপনি আমায় না করবেন না৷ আপনি গ্রামের প্রতিটি মানুষের জন্য ভাবেন৷ আশা করি আপনি আমার কথা মেনে নিবেন৷”
আয়েশা বেগম বুঝতে পারছে না কি বলবে? কখনও কোন আবদার নিয়ে আসেনি৷ মনটা কেমন জানি খচখচ করছে৷ সাথে কোন মানুষ নেই৷ মূলত আইয়ুব আলী কখনও একা চলাচল করেন না৷ তার সাথে সব সময় তার কাজের লোক থাকে৷ আজ শুধু তার ছেলে শ্যামল আছে৷ ভীতুকর কন্ঠে বলল,
“আপনি কি বলতে চান? আপনার কথা সত্যের পথে এবং ভালো উদ্দেশ্যের হলে আমি অবশ্যই মেনে নিব৷”
আইয়ুব আলী শ্যামলের দিকে এক তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন,
“অসময়ে আপনার বাড়িতে আসার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি৷ আমি এসেছিলাম একটা স্কুলের জন্য৷ গ্রামের ছেলেমেয়েরা পড়তে পারছে৷ কিন্তু যাদের একটু বয়স আছে তারা পড়া থেকে বঞ্চিত। কৃষকদের কোন শিক্ষা নেই৷ তারা ভালো মন্দ বুঝতে পারলেও শিক্ষার আলো তাদের মধ্যে নেই৷ একটা চিঠি আসলে সেটা অন্যের কাছে নিয়ে যায়। আমি কৃষক, কৃষাণী এবং মধ্য বয়স্কদের লেখাপড়া ব্যবস্থা করতে চাই৷ সেজন্য আপনার সাহায্য লাগবে৷”
আইয়ুব আলীর চিন্তা ধারণা এতোটা পরিবর্তন দেখে আয়েশা বেগম সত্যি খুব খুশী৷ আনন্দের সহিত জবাব দিলেন,
“অনেক সুন্দর কাজ৷ পৃথিবীর সবথেকে বেশি মহৎ কাজের মাঝে অন্যতম৷ আমি আপনার পাশে থাকব। আমি এ মহান কাজে শরীক হতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করব। গ্রামের সবাই লেখাপড়া করলে গ্রামটা অনেক উন্নতি হবে৷”
“সন্ধ্যার পর সবাই আমার বাড়িতে চলে আসবে৷ আপনি আর শ্যামল তাদের পড়াবেন৷ আপনার জন্য আরও একটা প্রস্তাব আছে৷ আমি মানতে না চাইলেও এটা করতে হবে৷ ধরে নেন আমি জোর করে চাপিয়ে দিলাম।”
বিষ্ময়কর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“কি করতে চান? যা জোর করে চাপিয়ে দিবেন৷”
“সন্ধ্যায় আসা যাওয়া আপনার সমস্যা হবে না৷ আমার লোক আপনাকে নিয়ে যাবে৷ আবার ক্লাস শেষে আপনাকে দিয়ে যাবে৷ আপনি একা থাকেন৷ পরী এখন আপনার সাথে নেই৷ সেজন্য আপনি প্রতিদিন রাতে আমার বাসায় খাবেন৷ আপনার কোন কথা আমি মানব না৷”
“কিন্তু পঞ্চায়েত মশাই আপনার বাসায় খাওয়াটা কেমন দেখায় না৷ একদিন দুইদিন ঠিক আছে৷ প্রতিদিন খাওয়া ঠিক হবে না৷”
“কোন কিন্তু নয়৷ আপনার জন্য আলাদা কোন রান্না হচ্ছে না৷ আমরা যা খাব আপনি তাই খাবেন৷ এমনি আপনি অনেক কষ্ট করেন৷ স্কুল থেকে এসে অনেক বাচ্চাকে পড়ান৷ তাদের কাছ থেকে কোন টাকা নেননা৷ সত্যি আপনার মন অনেক বড়৷ আবার আমার বাড়িতে যেতে হবে৷ আর কষ্ট করতে হবে না৷ পরী বাড়িতে থাকলে অন্য বিষয় ছিল৷”
আয়েশা বেগমের এতোদিনের পরিশ্রম যেন স্বার্থক হলো৷ আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া জানাল৷
চলবে……..।