#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_০৯
#নুর_নবী_হাসান_অধির
সময় কখনও কারো জন্য অপেক্ষা করে না। ভাটা শুরু হয়েছে। পানির পরিমাণ কমে গেছে৷ কৃষকরা জমিতে ধান রোপণে ব্যস্ত৷ গবাদিপশুর জাতীয় খাবার ঘাসের পরিমাণ কমে গেছে। মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুও পুষ্টিহীনতায় ভোগছে৷ আয়েশা বেগম ক্লাস শেষ করে আইয়ুব আলীর বাড়িতে পা রাখেন৷ এখানে পা রাখা মানে ঝড়ের পূর্বাভাস। আইয়ুব আলীর অর্থবিত্তের অভাব নেই৷ গ্রামে প্রচুর জমিজমা। গাজীপুরের বোর্ড বাজারে গার্মেন্টস আছে৷ তাছাড়া শহরে কিছু দোকান আছে৷ সে দোকানগুলো পঞ্চায়েত মশাই দেখাশোনা করেন৷
আয়েশা বেগম চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন,
“আপনি কি ভিক্ষুক হয়ে গেছেন? এখনও অন্যের জমি, গরু দখল করতে মন বাঁধা দেয় না৷”
আইয়ুব আলী কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারল না৷ বোকার মতো আয়েশা বেগমের দিকে তাকিয়ে রইল৷ আয়েশা বেগম পুনরায় বলতে শুরু করেন,
“কি হলো কথা বলেন না কেন? এতো টাকা পয়সা থাকতেও অন্যের গরু কেঁড়ে নেওয়ার মানে কি? আপনার তো লজ্জা থাকা দরকার৷ আপনি গ্রামের প্রধান৷ আপনার আদর্শে সবাই জেগে উঠবে৷ কিন্তু আপনি গ্রামের চোরে পরিণত হচ্ছেন।”
আয়েশা বেগমের কথা শুনে আইয়ুব আলীর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়৷ রাগী চোখ মুখ লাল হয়ে যায়৷ আইয়ুব আলী আগে যা করেছে এখন তা করে না৷ কারোর গরু ছাগল লোড করে নিয়ে আসে না৷ গরিবের উপর জোর ঝুলুম করে৷ বিপদে ফেলে মোটা অঙ্কের সুধ নেওয়া উনার কাজ৷ কঠিন গলায় বললেন,
“আপনি না জেনে অনেক কথা বলেছেন৷ অনেক সহ্য করেছি আপনার কথা৷ আপনার কাছে কি প্রমাণ আছে? আমি অন্যের গরু নিয়ে আসছি।”
“কেন আপনি জানেন না? আপনার ছেলে আরিফ আশিকুরের গরু নিয়ে আসে নি৷ সেদিন তার স্ত্রী খোদেজা বানু আমাকে বলল৷ না বললে তো জানতাই না৷”
আইয়ুব আলী উচ্চ স্বরে আরিফকে ডাক দেন৷ আরিফ দ্রুত গতিতে বাবার সামনে হাজির হয়৷ আয়েশা বেগমকে দেখে মুখ চুপসে যায়৷ চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। আরিফ ভীত গলায় বলল,
“কিছু বলবেন বাবা?”
আরিফের গায়ে কষিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে বলল,
আশিকুরের গরু কে নিয়ে আসছে? আমি গরু নিয়ে আসতে বলছিলাম৷ আমার নাম বলে গরু নিয়ে আসছোস কেন?”
আয়েশা বেগম বুঝতে পারে আইয়ুব এসবের কিছু জানে না৷ আরিফ উনার অগোচরে অনেক কাজ করে৷ সেদিন আয়েশা বেগমকে খুন করার কথা আইয়ুব আলী বলেনি৷ আরিফ নিজে থেকেই গেছিল৷ আরিফ গালে হাত দিয়ে বলল,
“আশিকুরের সাহস হয় কিভাবে আমার কাছ থেকে দুধের টাকা নেওয়া? বাজারে মানুষের সামনে কিছু বলতে পারিনি৷ হ্যাঁ আমি গরু নিয়ে বাজারে বিক্রি করে দিছি৷ দরকার পরলে আরও নিব৷ নিছি ভালো করছি৷”
আইয়ুব আলী কষিয়ে আরও একটা থাপ্পড় বসিয়ে বলল,
“এতো নিচ তুই৷ আমার নাম বলে বলে গ্রামের লোকদের সাথে খারাপ ব্যবহার৷ তোর মতো ছেলে থাকার চেয়ে না থাকা অনেক ভালো৷”
আরিফ ক্ষোভ নিয়ে আঙ্গুল তুলে বলল,
“আমি এই মহিলাকে খুন করে ফেলব৷ এই মহিলার জন্য আমি কিছু করতে পারি না৷ আমি এই মহিলাকে ছাড়ব না৷”
আইয়ুব আলী কিছু লাঠিয়াল বাহিনীকে চোখের ইশারায় আরিফকে নিয়ে যেতে বলেন৷ আইয়ুব আলী বুঝতে পারে তার ছেলে গ্রামে অনেক অন্যায় কাজ করছে৷ যার জন্য গ্রামে আইয়ুব আলীর আধিপত্য কমে যাচ্ছে৷ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে রেখে বলেন,
“আরিফ ছোট মানুষ৷ এই বয়সে রক্ত গরম থাকে৷ ন্যায় অন্যায় বোধ হারিয়ে ফেলে৷ আরিফ ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে৷ তাকে আমি বুঝিয়ে সৎ পথে নিয়ে আসব৷ আরিফের গ্রামের মানুষের আর অত্যাচার করবে না৷”
“শাসনটা অনেক আগে করার দরকার ছিল৷ বাবা হিসেবে সব দিকে নজর রাখা দরকার ছিল৷ শুধু এগুলো তার কাজ নয়৷ আরও খারাপ কাজ করে৷ সবদিকে নজর দিবেন৷ আসিফ খারাপ কাজ করত যার ফলে আসিফকে হারিয়েছেন৷ আরিফকে হারাতে না চাইলে সঠিক পথে নিয়ে আসেন।”
চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বলল,
“সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়৷ আপনি নিজে সবকিছু জেনেও কাউকে কিছু বলেন নি৷ আমি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না৷ সবার খরব রাখি৷ মোল্লা সাহেব সামনে এমপি দাঁড়াবেন৷ নিজের মর্যাদা টিকিয়ে রাখেন৷”
আয়েশা বেগম চলে যেতে নিলেই আইয়ুব আলী বলেন,
“আসিফকে কে হত্যা করেছে আপনি জানেন?”
আয়েশা বেগম মুচকি হেঁসে জবাব দিলেন,
“সবার আগে খরব আমার কাছে পৌঁছায়৷ আসিফ একজন মেয়েকে ধর্ষণ করার ফলে প্রাণ হারিয়েছে৷ শুধু সে নয়৷ তারা তিনজন মিলে সম্মান হানি করেছিল। পৃথিবীতে তিনজনের মাঝে কেউ নেই৷ কিন্তু ধর্ষিত মেয়েটা আজও বেঁচে আছে৷”
আয়েশা বেগমের চোখে জল চলে আসল৷ মনে মনে বলেন,
“হ্যাঁ পারুল আমার মনের মাঝে বেঁচে আছে৷ আমি যতদিন জীবিত থাকব আমার সোনার টুকরো মেয়েটাও জীবিত থাকবে৷
__________
পারী এসাইনমেন্ট করছিল৷ এমন সময় রুমে আশালতা আসেন৷ পরীকে পড়ার টেবিলে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন৷ মনের মাঝে রাগ বাসা বেঁধে নিল৷ কিছুতেই পরীর পড়া মেনে নিতে পারল না৷ রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠল,
“নবাবজাদি তুই এখানে বসে থাকলে রান্না করে করবে কে? তোর মা এসে রান্না করে দিবে৷”
পারী দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ আমার মা রান্না করবে৷ আমার আদরের ছোট মা রান্না করবে৷ মা রান্নাটা করে নাও৷ সাথে আমার রুমটাও পরিষ্কার করে দিও। মেয়ের কষ্ট একমাত্র মায়েরাই বুঝে৷”
পরীর কথায় আশালতার মাথা গরম হয়ে যায়৷ এমনি সতিনের মেয়ে দু’বেলা চোখের সামনে থাকলে রাগে শরীর জ্বলে যায়৷ তার কথা আরও রাগ হচ্ছে৷ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে পরীর এসাইনমেন্ট টেনে ছিঁড়ে ফেলে৷ পরীর গায়ে হাত তুলতে নিলে পরী হাত ধরে ফেলে। পরী নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না৷ অনেক সহ্য করেছে এই মহিলাকে৷ পরী কষিয়ে কয়েকটি থাপ্পড় বসিয়ে দিল৷ হুংকার দিয়ে বলল,
“পরীকে রাগিও দিও না৷ খুন করে ফেলব সোজা৷ আজকেরটা সামান্য নমুনা৷ আমার সাথে লাগতে আসলে আরও খারাপ কিছু করতে পারি। গ্রামের মেয়ে ভেবে ভুল করবে না৷ রাগ উঠলে বড় বলে ছেড়ে দিব না৷”
তাদের চেঁচামেচি শুনে পলক হোসাইন এবং বাড়ির কাজের লোক আসতে নিলেই পরী তড়িঘড়ি করে আশালতার হাত নিজের গলায় নিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল,
“আম্মাগো আমাকে ছেড়ে দেন৷ আমি আপনার পায়ে পড়ি৷ আমি আর এই বাড়িতে থাকব না৷ মায়ের কাছে চলে যাব৷ আল্লাহর দোহাই লাগে আমাকে ছেড়ে দেন৷”
বাড়ির সকলে ইতিমধ্যে চলে এসেছে৷ এমন দৃশ্য দেখে পলক হোসাইন মেয়েকে ছাড়িয়ে নিয়ে আশালতার গালে কষিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে বলল,
“ছি! তুমি এতো নিচ। পরী তোমার নিজের মেয়ে নয় বলে তাকে মেরে ফেলতেও একবার ভাবলে না৷ শিক্ষিত মানুষের এমন নিষ্ঠুর রুপ দেখিনি৷ পরী আমাকে আগেই বলেছিল তুমি তাকে দিয়ে বাসার সকল কাজ করাও৷ কাজে ভুল হলে গায়ে হাত তুল৷ বিশ্বাস করতাম না৷ আজ চোখের সামনে যা দেখলাম৷”
আশালতা কান্না করতে করতে বলল,
“বিশ্বাস কর, আমি এসব কিছু করিনি৷ পরী সব বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কথা বলেছে৷ আমি পরীকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি৷”
পলক হোসাইন রাগী গলায় বলল,
“আমরা নিজের চোখে দেখলাম৷ একটু দেরি করলে হয়তো পরীর লাশ এখানে পাওয়া যেত৷”
দূরে দাঁড়িয়ে পরী কান্না করছে৷ পলক হোসাইন এক হাত দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করছে৷ আশালতা রাগী গলায় বলল,
“আমি এই মেয়েকে দেখে নিব৷ এই মেয়ে কিভাবে বেঁচে থাকে আমিও দেখব৷ আমি নিজ হাতে খুন করব৷”
একে একে সবাই রুম থেকে চলে যায়৷ পলক হোসাইন চলে যাওয়ার আগে বলল,
“ভয় নেই৷ তোমার কোন ক্ষতি কেউ করতে পারবে না৷ তোমার ছোট মাকে আমি বুঝিয়ে সব ঠিক করে দিব৷”
পরী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল৷ পলক হোসাইন রুম থেকে চলে গেলে পরীর রুমের দরজা লাগিয়ে চোখের জল মুছল৷ বিশ্ব জয়ের হাসি দিয়ে মনে মনে বলল,
“পরীকে ভালোবাসা দিলে সব কাজ করে দিত৷ মায়ের মতো ভালোবাসত৷ আগলে রাখত৷ যারা ভালোবাসার যোগ্য নয় পরী তাদের সাথে এমনই করবে৷”
____
সমাপ্তির বাসা ধানমন্ডি। প্রতিদিন গাড়ি করে আসা যাওয়া। ড্রাইভারের দরকারে গাড়ি নিয়ে কোথাও গেছে৷ অবশ্য সমাপ্তিকে বলে গেছে৷ বিশ মিনিটের মাঝে চলে আসবে৷ সমাপ্তি যাইনি বলে হুকু তার সঙ্গ দিয়েছে৷ একপ্রকার ধরে বেঁধে আটকিয়ে রেখেছে পরীকে৷ খোলা মাঠের নিচে বসে আছে তিনজন। কুহু চশমা ঠিক করতে করতে বলল,
“ছোঁয়া থাকলে খুব ভালো হতো৷ আমরা চারজন কথা বলতে পারতাম৷ ভালো লাগত অনেক৷”
কুহুর বার বার চশমায় হাত দেওয়া সমাপ্তি কিছুতেই মেনে নিতে পারে না৷ বিরক্তির সাথে বলে উঠল,
“কুহু আর কেউ কি চশমা পড়ে না৷ তুই একাই চশমা পড়োস৷ বার বার চশমায় হাত দেওয়ার মানে কি? নাকি মানুষকে দেখাস তোর চশমা আছে৷”
কুহু অভিমানী কন্ঠে বলল,
আমার চশমা নিয়ে কোন কথা বলবি না৷ হ্যাঁ আমি দেখাই আমার চশমা আছে৷ দরকার পড়লে তুইও দেখা৷”
পরী বিরক্ত স্বরে বলল,
থামাবি তোদের ঝগড়া। মন চাচ্ছে ধাক্কা দিয়ে দুটোকেই বুড়িগঙ্গায় ফেলে আসি৷”
কুহু ন্যাকা স্বরে বলল,
“সমাপ্তিকে ফেলে আয়৷ সে আমার পিছনে সব সময় লেগে থাকে৷ আমি যা করি তার কাছে সবই ভুল৷”
সমাপ্তি পরীর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“তোর সৎ মা তোর সাথে এতো খারাপ ব্যবহার করে তুই কিছু বলস না৷”
“আমি এখন আর বসে নেই৷ আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করলে আমিও খারাপ ব্যবহার করি৷ প্রথম দিকে গ্রামের মেয়ে ভেবে অনেক অত্যাচার করেছে৷ সময়ের সাথে অত্যাচার বাড়ছিল৷ প্রতিবাদ করায় এখন একটু কম৷”
“তোর বাবা কিছু বলে না৷ তোর সাথে এতো খারাপ ব্যবহার করে৷”
“আমি বাবার জন্য বসে থাকিনা৷ বাবাকে এক সময় অনেক ভালোবাসতাম৷ এখন ভালোবাসা মন থেকে উঠে গেছে৷ আর্দশ বাবা হয়ে উঠতে পারেনি৷”
পরী দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“সমাপ্তির গাড়ি চলে এসেছে৷ এখন সবাই বাড়িতে যাহ৷ আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে কাল আবার দেখা হবে৷”
চলবে….