#কে_বাঁশি_বাজায়_রে
#পর্ব_০৬
#নুর_নবী_হাসান_অধির
পরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিশন পরীক্ষা দেয়৷ মর্মান্তিক বিষয় হলো পরীর ঢাবিতে চান্স হয়নি৷ সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছার স্বপ্নটা ভেঙে যায় নিমিষেই৷ পরবর্তীতে পরীক্ষা দেওয়ার মন মানসিকতা হারিয়ে ফেলে৷ পরিশেষে পলক হোসাইনের নির্দেশ অনুযায়ী সরকারি তিতুমীর কলেজে পদার্থবিজ্ঞান ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়৷
আয়েশা বেগম মেয়ের জন্য এই প্রথম আরিয়ানের মায়ের বাড়িতে পা রাখেন৷ তাদের বাসা বনানী ৮ নং রোড়ে৷ আরিয়ান বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুলে লেখাপড়া করছে। বিশাল বাড়িতে এলাহী কান্ড৷ সেসব বিষয়ে কোন আগ্রহ নেই৷ আশালতাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“পরীকে দেখে রাখবে৷ সতিনের মেয়ে ভেবে দূরে ঠেলে দিও না৷ পরীর কষ্ট হলে সবথেকে বেশি কষ্ট আমি পাব৷”
আয়েশা বেগমের হাত ধরে বলল,
“পরী আমারও মেয়ে৷ তাকে নিয়ে আপনি কোন চিন্তা করবেন না৷ আমার ভালোবাসায় কোন কমতি থাকবে না৷ আপনাদের আমি মাথায় করে রাখব৷”
দৃষ্টি নন্দন কথাগুলো মন ছুঁয়ে গেল৷ মেয়েকে ছেড়ে যেতে যেন বুক ফেটে যাচ্ছে৷ মনোবেদনার সহিত বলল,
“আমি গ্রামে চলে যাব৷ এখানে থাকব না৷ আমার বদলি হয়নি৷ আমার চোখে অনেক স্বপ্ন। আনন্দপুর গ্রামটাকে শিক্ষার নগরী বানাব৷ ভালোবাসা দিয়ে সকলের মনে অন্ধকার দূর করব৷”
“গ্রামে কেউ নেই৷ আপনি কেন গ্রামে একা একা থাকবেন৷ আপনাকে গ্রামে যেতে দিব না৷”
আয়েশা বেগমের চোখের কোণা ভেজে উঠল৷ ভেজা গলায় বলেন,
“আমার পারুল সেখানে একা আছে৷ আমি এখানে কিভাবে থাকব? আমাকে ছাড়া ভয় পাবে তো৷”
_____________
আরিফ অনেক চেষ্টা করেছে আসিফের খুনীকে বের করার৷ ফলাফল সব সময় শূন্য হয়েছে৷ ইউসুফ, জুয়েল, শামীমের কোন খুঁজ পাওয়া যায়নি৷ তাদের মা বাবা জানিয়ে দিয়েছেন তারা কখনও বাড়িতে ফিরে নি৷ তবুও কথাগুলো বিশ্বাস হয়নি৷ সকলের বাড়িতেই গোপন পাহারা বসিয়েছিল৷ মোটকথা, ফলাফল শূন্য।
আয়েশা বেগম গ্রাম পঞ্চায়েতের সামনে বসে আছেন৷ সামনে চা, বিস্কুট রাখা৷ চা অবহেলায় ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে৷ ঠান্ডা চায়ের কাপে চুমু দিয়ে বলেন,
“পঞ্চায়েত মশাই আপনাকে একটা কাজ করে দিতে হবে৷ আপনার কথা গ্রামের সবাই শুনেন৷ আপনি বললে সবাই এক কথায় রাজি হবে৷”
গ্রাম পঞ্চায়েত মশাই নড়েচড়ে বসে বলল,
“কাজটা কি? সরাসরি কাজের কথা বলেন৷ আমি কাজ ছাড়া অন্য কোন কথা পাত্তা দেইনা৷”
“গ্রামের সকল ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর কথা বলবেন। কৃষকের ছেলেরা কি সারাজীবন কৃষকই থাকবে? আমি কৃষিকাজকে ছোট করছি না৷ অক্ষর জ্ঞান থাকলেও এসব কৃষকরা কৃষিকাজে অনেক উন্নতি করবে৷ সঠিক সময়ে সার প্রয়োগ করবে৷ ফসল ভালো হবে৷”
“কৃষকের ছেলেদের পড়তে হবে না৷ আর মেয়ে মানুষের কিসের লেখাপড়া? তারা ঘরের কাজ করবে৷ মেয়ে মানুষের কোন লেখাপড়া লাগবে না৷ আর দামাল ছেলেরা কৃষি কাজ না করলে কে করবে? তাদের গায়ে অনেক জোর৷ লাঙ্গল চাষে জোর লাগে৷ আমি ভাবতেছি আমাদের গ্রামের স্কুলটা ভেঙে দিব৷ কলেজটাও ভেঙে দিব৷ লেখাপড়ার নামে ছেলেরা খারাপ হয়ে যাচ্ছে৷ সারাদিন স্কুলে পড়ে থাকে৷”
আয়েশা বেগম জানতেন এমন উত্তরই আসবে৷ তিনি মুচকি হেসে বলেন,
“পঞ্চায়েত মশাই আমি জানতাম আপনি এমন কথায় বলবেন৷ আমি স্কুলে যাওয়ার পর এমন কথা শুনেছি৷ আপনি স্কুল ভেঙে দিবেন৷ তাই আপনার কাছে এসেছি৷”
“ঠিকই শুনেছো৷ আমার জমিতে আমি স্কুল রাখব না৷ লেখাপড়া করার কোন দরকার নেই৷ আমি সব স্যারদের চলে যেতে বলেছি৷”
ঠান্ডা চায়ের কাপে আরও একটা চুমু দিয়ে বলেন,
“ঠান্ডা চা একদম ভালো লাগছে না৷ তেমনই আপনাকে উপড়ে ফেলে দিতেও গ্রামের লোকজনের দুই মিনিট সময় লাগবে না৷ আপনার অত্যাচার অনেক সহ্য করেছে৷ স্কুলের জমি সরকারের৷ সে জমিতে হাত দিলে আপনার হাত কেটে ফেলব৷ নিরক্ষরতা দূর করার জন্য অনেক কিছু করতে পারি৷”
গ্রাম পঞ্চায়েত মশাই রাগী কন্ঠে বলল,
“এই মাস্টন্নি, আপনাকে খুন করে ফেলব৷ বস্তা ভরে নদীতে ফেলে দিব৷ কোন কাক পক্ষী টেরও পাবে না৷”
“আমি আমার চিন্তা কখনও করিনা৷ আমি ছাত্রদের পক্ষে। তাদের গায়ে যদি ফুলের টুকাও পড়ে আপনাকে গ্রাম পঞ্চায়েত হওয়ার স্বাদ মিটিয়ে দিব৷”
আয়েশা বেগম কথাগুলো বলে এক মুহুর্ত দেরি করলেন না৷ তিনি সোজা বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন৷ রাগে আরিফের চোখের মণির চারপাশ লালচে বর্ণ ধারণ করেছে৷ ক্ষোভ নিয়ে বলল,
“বাবা আপনি ওই মহিলাকে যেতে দিলেন কেন? আপনাকে হুমকি দেওয়ার সাহস হয় কিভাবে? আদেশ করেন, উনার জীবনের ইতি টানব।”
“ধৈর্য ধারণ কর৷ আয়েশা বেগমকে আমি দেখে নিব৷ অতি বাড় বেড়েছে৷ ভেঙে পড়ার দিন চলে এসেছে৷ উলি পোকা পাখা গজায় মরিবার কালে৷ উনার পাখা গজিয়েছে৷ পাখাগুলো কেটে দিতে হবে৷”
______
ক্লাস শেষে পরীর কিছু বান্ধবীর সাথে পরিচয় হয়৷ ১৬০ জন শিক্ষার্থীর মাঝে ছাত্রীর সংখ্যা ১৬ জন৷ সব সব জায়গায় মেয়েদেরকে পিছিয়ে রাখা হয়েছে। লেখাপড়া করার কোন সুযোগ দিচ্ছে না৷ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মেয়েদের কোন মূল্য নয়৷ বেগম রোকেয়ার বানী আজও সকলের কাছে পৌঁছানো হলো না৷ মেয়েদের শিক্ষার জন্য কত সংগ্রাম করেছে৷ বিশ্বাস আছে একদিন প্রতিটি ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়বে৷
ক্লাস শেষে বান্ধবীদের সাথে বিজ্ঞান ভবনের সামনে কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়৷ সকলের সাথে পরিচয় হয়৷ প্রথম দিনেই বন্ধুত্ব হয়ে যায় তিনজন মেয়ে এবং দুইজন ছেলের সাথে৷ সব থেকে প্রিয় মানুষে পরিণত হয় “সমাপ্তি” মানের মেয়েটা৷ বড়লোক বাবার মেয়ে হয়েও মনের মাঝে কোন অহংকার নেই৷ একসাথে অনেক সময় আড্ডা দিয়েছে৷ পরীর নামটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে৷ জীবন চলার পথে একজন বন্ধুর প্রয়োজন৷ যে বন্ধু বিপদে পাশে থাকবে৷ দিনশেষে আজাইরা কথাগুলো শেয়ার করা যাবে৷ পরী সবাইকে বিদায় জানিয়ে বাসায় চলে আসে৷ চিঠি লিখতে বসে মা আয়েশা বেগমের কাছে৷
প্রিয় মা,
আসসালামু আলাইকুম। আমার সালাম নিবে৷ কেমন আছো? আল্লাহর রহমতে আমি ভালো আছি৷ “মা” ছোট্ট একটি শব্দ। যার কোন বিশ্লেষণ হয়না৷ প্রতিটি মুহুর্তে তোমাকে মিস করি৷ দিন শেষ রাতের বেলায় তোমায় একাকিত্ব বোধ করি৷ রাত যত গভীর হয় তোমাকে তত মিস করি৷ ইচ্ছা করে তোমার কাছে ছুটে যেতে৷ দুই হাতে তোমায় জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছা তোমায় খুব ভালোবাসি৷ তোমায় ছেড়ে কোথাও যাব না৷
নিজের খেয়াল রাখবে৷ সঠিক সময়ে খাবার খাবে৷
ইতি
তোমার ছোট্ট মেয়ে
পরী
অল্পকথাগুলো লিখতেই পরীর চোখে জল চলে আসে৷ একমাত্র ভালোবাসার ছায়াকে ছেড়ে দূরে থাকার মতো কষ্ট কিছুই নেই৷ কাছে থাকলে কখনও সন্তানরা মা, বাবার কদর বুঝে না৷ একটু চোখের আড়াল হলে বুঝতে পারে মা বাবা ছাড়া পুরো পৃথিবী অন্ধকার।
____________
গভীর রাতে আরিফ তার দলবল নিয়ে আয়েশা বেগমের বাড়িতে হামলা করে৷ কিন্তু মনোবেদনার বিষয় আয়েশা বেগম বাড়িতে নেই৷ বাড়ির সদর দরজা হাঁক করে খোলা৷ বাসায় ঢুকে আয়েশা বেগমকে কোথাও পেল না৷ আরিফ রাগ নিয়ে বলল,
“এই মহিলা এতো রাতে কোথায় যেতে পারে? সে কি আমাদের ভয়ে পালিয়েছে? বুঝতে পেরেছে আরিফ কি জিনিস?”
পিছন থেকে একজন বলে উঠল,
“উনি মনে হয় ঢাকায় চলে গেছেন৷ পরী এখন ঢাকা থাকে৷ পরীর সাথে থাকবে এখন থেকে৷”
আরিফ উচ্চ হাসি দিয়ে বলল,
“কথা বলার সময় সব সময় সবার উপরে থাকে৷ কাজের বেলায় ভেজা বিড়ালের মতো লেজ গুটিয়ে পালায়।”
প্রকৃতির নিয়মেই প্রতিদিন ভোরের আলো ফুটে৷ সোনালী আলোয় মেঠো পথ ধরে আয়েশা বেগম স্কুলে পৌঁছাল৷ ক্লাস রুমের সকল দরজা জানালা কে জানি ভেঙে ফেলেছে৷ শিক্ষার্থীরা স্কুল মাঠে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ আয়েশা বেগম স্কুল গেইটে প্রবেশ করতেই সকল শিক্ষার্থী অভিযোগ শুরু করল৷ আয়েশা বেগম সবার উদ্দেশ্য বলেন,
“সভ্যতার শুরুতে পন্ডিতরা গাছের নিচে শিক্ষা দান দিতেন৷ সেখানে স্কুলের দরজা বিশেষ কিছু নয়৷ দরজা খুব তাড়াতাড়ি লাগানো হবে৷ তোমরা মন দিয়ে ক্লাস কর৷”
শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ ক্লাসে চলে যায়৷ আয়েশা বেগম ক্লাস শেষে গ্রাম পঞ্চায়েত মশাইয়ের বাড়িতে যান৷ আয়েশা বেগমকে দেখেই পঞ্চায়েত বলেন,
“আমি জানতাম আপনি আসবেন। কিন্তু ভরদুপুরে আসবেন জানা ছিল না৷ ভেবে ছিলাম সকালেই আসবেন৷”
অন্ধরমহলের দিকে হাঁক করে বলেন,
“কে আছিস? স্কুল শিক্ষিকাকে চা বিস্কুট দে।”
আয়েশা বেগম চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলেন,
“আপনি কাজটা খুব অন্যায় করেছেন৷ আপনার সাথে আমার কোন শত্রুতা ছিল না৷ আপনি সেই শত্রুতার সূত্রপাত করলেন৷ আপনার এতো ক্ষমতা আসিফের খুনীকে বের করতে পারলেন না৷ স্কুল একটা পবিত্র জিনিস৷ ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ জীবনের চাবিকাঠি। আপনি সেটা নিয়ে পড়ে আছেন৷
পঞ্চায়েত মশাই অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেন,
” আমার ছেলেকে খুন করে এই পৃথিবীতে কেউ বেঁচে থাকতে পারেনি৷ তার বন্ধুদের খুঁজ এখনও পাওয়া যাইনি৷ আমি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না৷”
আয়েশা বেগম মুচকি হেসে বলেন,
“আপনি সত্যিই খুবই বোকা৷ তাদেরকে কোনদিন খুঁজে পাননি৷ অনেক তো অত্যাচার করেছিলেন৷ তাদের তিনজনের খুঁজ একমাত্র আমি জানি৷ আমার সাথে মিথ্যা বলতে আসবেন না৷”
আয়েশা বেগমের কথায় গ্রাম পঞ্চায়েতের হিঁচকি উঠে৷ পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল,
“পানি খান। এমন অনেক অজানা তথ্য আমার কাছে আছে৷ যেমন আপনাকে না জানিয়ে আরিফ রাতে আমাকে হত্যা করতে গিয়েছিল৷ ভাগ্য আরিফের ভালো ছিল৷ নয়তো আরিফের লাশ পাওয়া যেত নদীর জলে৷ স্রোতে অন্য কোথাও নিয়েও যেতে পারত৷”
গ্রাম পঞ্চায়েত মশাই নড়েচড়ে বসলেন৷ এতোদিন আয়েশা বেগমকে সহজ মানুষ হিসেবে ধরে নিছিলেন৷ ভুলেই গেছিলেন তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা৷ জীবন বাজি রেখেছে যুদ্ধ করেছিলেন৷ ১৯৯৭ সালে বেগম রোকেয়া হলে থাকাকালীন ৮০% মেয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন৷ গ্রাম পঞ্চায়েত মশাই ক্ষোভ নিয়ে বলল,
“আপনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন সেজন্য আপনাকে ভয় পাব! আপনার ধারণা ভুল৷ স্কুল আপনার কাছ থেকে খুব দ্রুত কেঁড়ে নিচ্ছি৷”
“শুভকামনা রইল৷ আপনি কাজগুলো মনোযোগ সহকারে করবেন৷ আয়েশা বেগমের অগ্নি রুপ দেখতে পারবেন৷ কারণ আমার হারানোর কিছু নেই৷”
চলবে……