# কাগজের নৌকা
# লেখা: সাজ্জাদ আলম বিন সাইফুল ইসলাম
# পর্ব: ০৩
.
.
.
একজন নারী একজন পুরুষ ছাড়া অসম্পূর্ণ। আমার মাও আব্বাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ ছিলো। আব্বা নাই তাই হয়তো মা বাবুল চাচাকে খুঁজে নিয়েছে। আমাকে হয়তো তাদের এ অবৈধ সম্পর্ক মেনে নিতে হবে।
.
বাড়িতে এখন আমাদের খাবারের কোনো অভাব নাই। নাস্তা, ভালো ভালো তরকারি লেগেই আছে। কিন্তু এসব খাবার আমার গলা দিয়ে নামতে চায় না। কিন্তু কী আর করার! মাকে বুঝ দেয়ার জন্য এসব আমাকে খেতে হয়। প্রকৃতপক্ষে এসব খাবার খেলে আমার বমি পায়, ভীষণ বমি। অবৈধ রোজগারের খাবার বলে কথা।
মা আগে বাড়ি বাড়ি কাজ করতে যেত। আমি স্টেশনে যা পেতাম তাই করে কিছু কমাতাম। দুজনের আয়ে দুবেলা ভর্তা-ভাত অন্তত খেতাম। তাতেই শান্তি ছিল, তৃপ্তি ছিল। এখন সেই তৃপ্তিটা পাই না। আমার রোজগার এখন মালাকে দিয়ে দেই। দাদী সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকে। অসুস্থ। সুস্থ থাকাতে মানুষের বাসায় কাজ করে যা পেত তা দিয়ে তাদের দুজনের হয়ে যেত। মালা আমার থেকেও ছোট, খুব বেশি পরিশ্রম করতে পারে না। তাই আমার রোজগারটা ওকে দেই। অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাবুল মিয়ার আনা খাবারগুলো কোনোমতে পেটে ঢুকাই। এই লোকটাকে একসময় আল্লাহর দূত ভেবেছিলাম, কিন্তু এখন একে দুনিয়ার সবথেকে বাজে মানুষ মনে হয়। কারও শরীর ভোগের বিনিময়ে খাবার দিচ্ছে হারামজাদাটা। না জানি কতজনের সাথে এরকম চক্কর চলে তার। আমার মায়ের তাতে মাথাব্যথা নেই। নিজের শরীর বিক্রি করে টাকা পাচ্ছে, খাবার পাচ্ছে, সেটাই বা কম কীসে। সবচেয়ে বড় কথা নিজের শারীরিক সম্পর্কের চাহিদা নিবারণ হচ্ছে। প্রাপ্তবয়স্কদের তো এই চাহিদা নাকি থাকতে হয়, নাহলে নারীত্ব বা পুরুষত্বহীন বলা হয়। আমি এখন চুপ থাকতে শিখে গেছি। মা চলছে তার নিয়মে। আমি সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করে চলছি। চোখ থাকতেও অন্ধ যাকে বলে।
.
আজকে মালার দেখা পেলাম না। ওর ঝু্ঁপড়িতেও গেলাম না।নানান কারণে মনটা আমার খারাপ। আগের মতো বাড়িতেও ঢুকি না। ঘরটা নাপাক মনে হয়। কিছু ভাংড়ি নিয়ে মহাজনের কাছে গেছি বিক্রি করতে। এমন সময় দেখি মালা ছুটে আসছে।
‘কী রে মালা, এমন কইরা ছুটতাছোস ক্যান?’
মালা হাসফাস করতে করতে বলে উঠলো,
‘দাদী, দাদী নড়ে না আপন।’
‘কী কস! আমি অবাক হয়ে গেলাম
‘হ। তুই চল একবার। ডাক্তারের কাছে নিতে হইব।’
মহাজনের কাছে টাকাটা নিয়ে মালার সাথে দৌড় দিলাম। ঝুঁপড়ির ভেতর ঢুকে দেখলাম দাদী শুয়ে আছে। কোনো সাড়া শব্দ নেই। আমি ডাকলাম,
‘দাদী? ও দাদী? ওঠ, বেলা অনেক হইছে।’
দাদী কোনো কথা বলে না। নিরবে শুয়েই আছে। চোখের পাতাও পড়ে না। মালা ডুকরে কান্না শুরু করলো। আমি আবার ডাকলাম,
‘ওই বুড়ি, মালা কান্দে, দেখস না? ওঠ।’
দাদী নিশ্চুপ। মালার কান্না আরও বেড়ে গেল। দাদীর শরীরটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আমি মালাকে বললাম,
‘তুই থাক আমি ডাক্তার নিয়া আসি।’
বলেই ডাক্তারের কাছে ছুটলাম। স্টেশনের পাশে ডাক্তার সাহেবের চেম্বার। রুহুল মিয়া তার নাম। ভালো ডাক্তার। আমার সাথে তার সখ্যতা আছে।
‘ডাক্তারসাব, ডাক্তারসাব।’
রুগী দেখছিলেন ডাক্তারবাবু। আমাকে এমন দেখে তিনি বলে উঠলেন,
‘কী রে আপন, এমন হাঁপাচ্ছিস কেন?’
আমি একটা ঢোক গিলে বললাম,
‘মালার দাদী অসুস্থ। নড়ে না, শুনেও না। শরীরটা ঠান্ডা। আপনে চলেন ডাক্তারসাব। মালা কান্দে। মালার কান্দোন আমার সহ্য হয় না। আপনি যত টাকা ভিজিট চান দিমু নে। খালি অহনি চলেন।’
‘আরে এত কথা বলা লাগে আপন মিয়া? যাব তো। শুধু প্রেসক্রিপশনটা লিখে দিয়ে যাচ্ছি।’
‘আচ্ছা।’
ডাক্তারবাবু মালার ঝুঁপড়িতে ঢুকলো। কী কী যেন নড়েচড়ে দেখলো। তারমন বিষণ্ণমনে বললো,
‘বুড়ি আর বাঁইচা নাই রে আপন। মইরা গেছে।’
আমি ধপাস করে বসে পড়লাম। মালার কান্না আরও বেড়ে গেল। বুড়িটা শেষমেশ মরেই গেল। মালাটার কী হবে এবার!
মালা যে একা হয়ে গেল। আল্লাহ কী বুঝে না? এই ছোট্টছোট্ট মেয়েটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এবার!
মালা দাদীকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে। আমি উঠলাম। আমার ঝুঁপড়িতে ফিরতে হবে।
.
ঝুঁপড়ি বন্ধু। মনে হয় বাবুল মিয়া এসেছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ডাক দিলাম। না ডেকে কোনো উপায় নেই।
‘মা, ও মা।’
মা ভেতর থেকে জবাব দিলো,
‘আপন?’
‘হ্যাঁ মা।’
মা বাবুল মিয়াকে তখনেই বলে উঠলো,
‘আপনাকে আগেই বললাম আপন যে কোনো সময় চইলা আসবো। অহন না। শুনলেন না। অহন কী হইব? কী কইরা তারে মুখ দেখামু?’
বাবুল মিয়া মিনমিন করে বললো,
‘আমি কি জানতাম নাকি অসময়ে চলে আসবে?’
আমি আমার ডাক দিলাম,
‘মা ও মা।’
‘আইতাছি বাপ।’
আমি জানি দুজন সুখের সাগরে মহাব্যস্ত। আমি ঝুঁপড়িতে ঢুকলে হয়তো মা ভীষণ লজ্জায় পড়বে। আমি তার সন্তান হয়ে কি সেটা হতে দিতে পারি? মা লজ্জা পেলে আমিও পাব। মায়ের কালি লাগানো মুখটা আমি দেখতে পারব না। তাই বাইরে থেকে বললাম,
‘দরজা খোলার দরকার নাই মা। মালার দাদী মইরা গেছে। একটু তাড়াতাড়ি আসবি? মালা খুব কান্দে।’
মা কাপড় ঠিক করে বাইরে বের হলো। বাবুল মিয়া ভেতরেই আছে। মায়ের চুলগুলো এলোমেলো। আমি মাথা নামালাম।
‘কী কস বাজান? জেঠাইমা মইরা গেছে?’
‘হ মা। দাদী আর নাই।’
‘তুই ঠিক কইতাছোস?’
‘হ মা। ডাক্তারসাবও দেখছে। বলে দাদী মইরা গেছে।’
‘হায় আল্লাহ! এ কী সর্বনাশ হইলো।’
‘মা তুই আয়, আমি যাইতাছি। মালা কান্দে, কেমনে সমালামু ওরে।’
‘যা বাপ, আমি আইতাছি।’
আমি ছুটলাম মালার ঝুঁপড়ির দিকে। লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। মালা হাউমাউ করে কাঁদছে। আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আল্লাহ কী এমন করে দিলো যে, মালা কাঁদলে আমার বুকে লাগে।
কয়েকজন মানুষ বুড়ির সৎকার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমি মালার পাশে বসে আছি।
.
মালার দাদীর সৎকার শেষ করে ঝুঁপড়িতে ফিরেছি। মা মালাকে নিয়ে এসেছে। সেই তখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছে মেয়েটা। আমার সহ্য হচ্ছে না। মা ওকে চুলোর পাড়ে বসিয়ে রান্না করছে আর বুঝাচ্ছে,
‘দেখ মা, মানুষ সারাজীবন বাঁচে না। সবাই আল্লাহর কাছে ফিরা যাব। কেউ একদিন আগে আর কেউ একদিন পরে। জেঠাইমা অসুস্থ ছিল অনেকদিন, এত কষ্টের চাইতে আল্লাহর কাছে চলে যাওয়া ভালো না?’
মালা মাথা নিচু করে বসে মায়ের কথা শুনছে। আমি ভাবছি অন্য কথা। মা হয়তো আজকে বুঝতে পেরেছে আমি তার অবৈধ সম্পর্ক ধরে ফেলেছি। কিন্তু আমি বুঝেও না বুঝার ভান করেছি। মা শেষপর্যন্ত কী বুঝেছে আমি সেটা জানি না। আর আমার জানার আগ্রহও না। আমি শুধু এতটুকু বুঝেছি, আমি বাবুল চাচাকে ঝুঁপড়ির ভেতর দেখলে মা লজ্জায় মরেই যেত। কী দরকার এত বাড়াবাড়ি করার।
.
রাত গভীর হতে শুরু করেছে। মালাকে তার ঝুঁপড়িতে রেখে এসেছি। নাহলে ঝু্ঁপড়িটা ফাঁকা থাকে যে। তারপরও তাকে বলে দিয়েছি কোনো কারণে যদি ভয় পায় তাহলে যেন আমাদের ডাকে।
মা একপাশে আর আমি একপাশে শুয়ে আছি। মা বলে উঠল,
‘বাপ, কাছে আয়। মাথায় হাত বুলাই দেই।’
‘না মা, ভাল্লাগে না।’
‘কী হইছে বাজান?’
‘জানি না।’
‘আমায় বল। মাকে বল।’
‘মা বললাম তো, তুই ঘুমা।’
মা আমাকে কাছে টানার চেষ্টা করল। আমি বললাম,
‘এত কাছে টানিস না মা। ঘেন্না লাগে।’
আমার কথা শুনে মা হাতটা দ্রুত সরিয়ে নিলো। মনে হচ্ছে হাইভোল্টেজ শক খেয়েছে। শক খাওয়ারই কথা। আজ যে আমি স্পষ্ট বলে দিলাম তাকে।
‘ঘেন্না লাগে? ক্যান বাপ?’
মা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে। আমি বলি,
‘জানি না মা। তোর সারা শরীরে এহন নাপাক লেগে থাকে। যতই লাক্স সাবান দিস না ক্যান, কীভাবে মুছবি, বল মা?’
মা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। তারপর বললো,
‘সবাই যদি সবকিছু বুঝত বাপ, তাহলে তো হতোই।’
আমি মেকি হাসলাম। মনে মনে ভাবলাম, হয়তো তাই।
(চলবে)