ওয়ারদূন আসরার পর্ব-২৪

0
1216

#ওয়ারদূন_আসরার
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব – ২৪ ||

সহকারীর ছদ্মবেশ ধরা অবয়কটি একটা গভীর জঙ্গলের গোরস্তানে আসলো। সেখানের কিছুটা দূরেই একটা ছোট টিনের ভাঙ্গা ঘর। চোখের পলকে সহকারী সেখানে গেলো। ভেতরে গরম লোহার শিকল পরা আসল সহকারী আধমরা হয়ে পড়ে আছে। নকল সহকারী একটা শয়তানি হাসি দিয়ে এক মানুষ রূপ ধারণ করলো। এতোটাই নিষ্পাপ তার চেহারা কেউ বলবে না এটা তার আসল চেহারা নয়। ওয়ারদূন আসরারই এইসব করছে আর তার সবকিছুর পেছনে আছে জাইফ। জাইফই সব ওয়ারদূন আসরারকে দিয়ে করাচ্ছে। ওয়ারদূন আসরার সহকারীর পাশে এক হাটু গেড়ে বসে মুখে টু টু শব্দ করে অসহায় ভঙ্গিতে বলছে,”ইশশরে বেচারা কি কষ্টই না হচ্ছে তোর তাইনা। আমি জানিস তোকে এভাবে কষ্ট দিতে চাইনি কিন্তু কি করবো বল তোদের মতো শয়তানের সাথে ইকটু আকটু যে দুই নাম্বারি করতেই হয়। সে যাইহোক তোকে যে এখনো মেরে ফেলিনি সেটা তোর ভাগ্য বুঝেছিস? আরও কিছুদিন এইভাবে বন্দি থাক তোর বাকি কাজ না হয় আমি করে দিবো।

বলেই হাসতে লাগে। এভাবেই কিছুদিন ওয়ারদূন আসরার সহকারী সেজে নানান কুবুদ্ধি দিয়েছে সর্দারকে। ওয়ারদূন আসরারের বুদ্ধি, যুক্তি এবং অভিনয় এতোটাই নিখুঁত যে সর্দার নিজেও তার খুঁত ধরতে অক্ষম। জাইফ দূর থেকে সবটা পরিচালনা করছে আর হাসছে। জাইফের বাবা মা আতংকিত হয়ে সেদিন জাইফের সাথে যোগাযোগ করেছে,”পুত্র এসব কি ইফ্রিত সর্দার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এখন আমরা কি করবো?”

– আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন আর সবটা আমার উপর ছেড়ে দিন।

– কিন্তু তুমি কি করবে পুত্র?

– আব্বুজান আমার উপর ভরসা রাখুন। আল্লাহ আমাকে উত্তম পরিকল্পনা দিয়েছেন আমি তার যথাযথভাবে পালন করবো আপনারা আপাতত যুদ্ধের জন্য তৈরি হন। এই যুদ্ধই হবে জীবনে দেখা সবচেয়ে ভয়ানক যুদ্ধ।

জাইফ যতোই দুশ্চিন্তা করতে বারণ করুক না কেন বাদশাহ সুলায়মান এবং তার স্ত্রী হাজেরার চিন্তা এক বিন্দু পরিমাণও কমছে না। একটা যুদ্ধ মানে কতোগুলো প্রজা সৈন্যের প্রাণ সংকটে থাকা তাদের নিহত হওয়া আরও কতো কি। কিন্তু জাইফের মনে কি চলছে সেটা একমাত্র জাইফ-ই ভালো জানে।

প্রায় ৭দিন পর ইফ্রিত সর্দার নিজের বিরাট সৈন্যদল নিয়ে মারিত রাজ্যে আক্রমণ চালায়। সেদিন আকাশ ছিলো মেঘলা বাইরে অনেক ঝড় হচ্ছে দেখে যীনাত ঘরেই বসে আছে। হঠাৎ লাইট চলে যায় আর পুরো রুম ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে যায়। যীনাত প্রথম ভয় পেলেও আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়। হঠাৎ যীনাত কারো কন্ঠসর শুনতে পেলো সাথে সাথে ভয়ে শিউরে উঠলো। জাইফ বলে,”ভয় পেয়ো না এটা আমি তোমার জাইফ।”

– আ… আপনি? আপনি কোথায় আর লাইট চলে কেন গেলো?

– আমি বন্ধ করেছি তাই আর আমি এখন অদৃশ্য হয়ে আছি আমক্র রাজ্যে ঘোর বিপদ আমাকে সেখানে যেতে হবে।

– মামানে? আপনি একা কেন আমিও আপনার সাথে যাবো। আমি এখানে থাকবো না।

– না যীনাত পাগলামি করো না। তুমি কি চাও না যে তোমার পরিবার এভাবে ধ্বংস করেছে তার কঠিন শাস্তি হোক? যে বাবা মায়ের থেকে এক সন্তানকে এতো বছর ধরে আলাদা রেখেছে চাওনা তার কঠিন সাজা হোক?

যীনাত চুপসে যায় আর মাথা নিচু করে ফেলে। তারপর মৃদ্যু সুরে বলে,”হ্যাঁ চাই মনে প্রাণে চাই!”

– হুম আমি তোমার থেকে ঠিক এই উত্তরটাই আশা করেছিলাম এখন আমি যা যা বলি মন দিয়ে শুনো।

– হ্যাঁ বলুন আপনি।(মনোযোগী হয়ে)

– আমি যাওয়ার পরও এখানে এমন লাইট থাকবে না। যতোক্ষণে না আমি যুদ্ধের ময়দানে যাচ্ছি আর ফিরে আসছি ততোক্ষণে তুমি এই ঘরে নানান ধরণের অস্তিত্ব পাবা। অনেক অবয়ক তোমায় বিভিন্ন ভাবে ভয় দেখানোর চেষ্টা করবে কিন্তু তুমি একদম ভয় পাবে না আল্লাহর উপর ভরসা রেখো। আর হ্যাঁ অয়বকগুলো আমার গলার সরের মাধ্যমেও তোমাকে তাদের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করবে কিন্তু সাবধান যীনাত ভুলেও তাদের ডাকে একদম সাড়া দিবে না এতে অনেক বড় বিপদ হবে। আমি যখন আসবো তখনই এই ঘরের আলো জ্বলবে এবং তোমায় একটা কথা বলবো যেটা ****** বুঝতে পেরেছো তো? আর হ্যাঁ তোমার এই পরিস্থিতিতে নূরা’স কোনোভাবেই তোমায় সাহায্য করতে আসবে না সবটাই তোমার বুদ্ধিমত্তার উপর নির্ভর করছে কারণ লড়াইটা তোমার একার।

যীনাত মাথা নাড়ায়। জাইফ অদৃশ্য ভাবেই যীনাতকে জড়িয়ে ধরে এবং তার শীতল দুটি ঠোঁট যীনাতের কপালে ছুঁয়ে চলে যায় জীবন-মরণের লড়াইয়ে। জাইফ যাওয়ার পরপরই রুমটা কেমন ঠান্ডা হতে থাকে আর পরিবেশ অস্বাভাবিক হয়ে উঠে। রুমটা এতোই ঠান্ডা যে যীনাত শীতে শিউরে শিউরে উঠছে। হঠাৎ ধুরুম-ধারুম কিছু শব্দ পাচ্ছে যীনাত। আবার এক মেয়ের আর্তনাদ কানে ভেসে আসে যীনাতের কানে, কি ভয়ংকর কান্না কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম৷ যীনাত সবকিছু থেকে নিজেকে সামলে রাখছে আর জাইফের আসার অপেক্ষা করে যাচ্ছে এবং আল্লাহর দরবারে দোয়া করছে যেনো খুব শীঘ্রই তাদের বিপদমুক্ত করে। মেয়েটা কেঁদে চিৎকার করে বলে,”যীনায়ায়ায়ায়ায়াত আমায় বাচাও আমি অনেক বড় বিপদে আছি বাচাও আমাকে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।”

যীনাত সেই মেয়ে কন্ঠটি শুনেও না শুনার ভান ধরে থাকে আর মনে মনে যতো দোয়াদুরূদ আছে পড়তে থাকে। এমন সব লোমহর্ষক শব্দ এবং কন্ঠ শুনছে যীনাত ভয়ে অন্ধকার ঘরটাতে চোখ বুলিয়ে দোয়া পড়ছে। হঠাৎ জাইফের কন্ঠ যীনাত শুনতে পেলো। যীনাত যেনো খুশি হয়ে গিয়েও আবার চুপ মেরে গেলো কারণ হঠাৎই তার জাইফের বলা কথা গুলো মনে পড়ে যায়। যীনাত মনে মনে ভাবছে,”খচ্চর ভূতসমাজ! তোরা আমাকে কি ভয় দেখাবি হ্যাঁ? এর আগেও এমন অনেক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি আর তোরা আসছোস আমাকে ভয় দেখাতে। একেকটাকে যদি চোখের ইশারায় নাচাতে পারতাম তাহলে কলিজা টা ঠান্ডা হতো।”

যীনাতের ভাবা অনুযায়ী আচমকা রুমে ডিস্কো লাইট জ্বলে উঠে। লাইটে বিভিন্ন কালার নিয়ে গোলগোল ঘুরছে একদম পার্টি লাইটের মতো। আর যীনাতের সামনে অনেকগুলো কুৎসিত চেহারার অবয়ক যেভাবে পারছে সেভাবেই নেচে চলেছে। যীনাত হ্যাবলার মতো শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। যীনাত যেদিকে তাকাচ্ছে সেদিকে গিয়ে অবয়কগুলো ধুমসে নাচছে গান বা মিউজিকের শব্দ ছাড়াই। এসবের মাঝে যীনাত ফিক করে হেসে দিলো। ইতিহাসে এই প্রথম সে এমন ভূত মানে জ্বীনদের নাচতে দেখলো।

দুইদিন পর,,

– জাইফ তোরে আমি ছাড়বো না আমার লোক তোর বউকে এতোক্ষণে মেরে হয়তো রক্তও পান করে ফেলেছে হু হা হা!!

জাইফ হেসে বলে,”তোর লোক মারবে আমার বউকে ভাবলি কি করে? দেখ গিয়ে আমার বউ কেমন ভাবে তোর লোকদের নাকে দড়ি দিয়ে নাচাচ্ছে।”

সর্দার অবাক হয়ে জাইফের দিকে তাকায়। পরে জাইফের কথা বিশ্বাস না করে যীনাতের অবস্থা দেখতে সে নিজের চোখ বন্ধ করে ফেলে। চোখের সামনে নিজের লোকদের এভাবে নাচানাচি করে বিনোদন দিতে দেখে সর্দারের হেঁচকি আর কাশি দুটো একসাথেই উঠে গেলো। এদিক দিয়ে সর্দার প্রায় হেরে যাওয়ার পথে। ভেবেছিলো জাইফের দুর্বলতাকে নিজের গাতে মুঠিতে রেখে যীনাতের মাধ্যমেই রাজ্য জয় করবে কিন্তু তাও তো হলো না। যুদ্ধেও যে সে আর জিতবে মনে হয়না। সে প্রাণপনে শয়তানের কাছে প্রার্থনা করছে। জাইফ তখনই সর্দারের নাক বরাবর দেয় এক লাথি। লাথি খেয়ে সর্দার ছিটকে দূরে চলে যায় আর তাকে ওয়ারদূন আসরার এসে ধরে। ওয়ারদূন আসরার শয়তানি হাসি দিয়ে বলে,”এখন তুই আমার স্বীকার।”

সর্দার একটা শুকনো ঢোক গিললো। আজ আর তার রক্ষ্যে নেই। দারুণভাবে মারিন রাজ্যের জয় হলো। বাদশাহ দূর থেকে আকাশে জয়ের আভা স্পষ্ট দেখতএ পারছে। বাদশাহ খুশি খুশি হয়ে হাজেরাকে বলে,”হাজেরা দেখো দূর আকাশে! আমাদের জয় হয়েছে আমাদের পুত্র বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে আজ অনেক বড় বীরত্ব! আমাদের মাঝে আর কোনো বিপদ নেই, ভয় নেই, দুঃখ বেদনা নেই।”

স্বামীর দিকে তাকিয়ে আনন্দের হাসি হেসে মাথা নাড়ায় হাজেরা। আজ যে তাদের বিজয়ের দিন, সুখের উল্লাসের ছলকানি সকলের মাঝে বিরাজ করছে। জাইফ যুদ্ধের ময়দান থেকে নিজের দলবল এবং ওয়ারদূন আসরার কে নিয়ে রাজকীয় ঘোড়ায় প্রাসাদের দিকে যাচ্ছে। রাজ্যের বাচ্চারা মহিলা পুরুষরা তাদের রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে রাজপুত্রকে প্রাণভরে দেখছে আর বৃদ্ধরা তাকে দোয়া দিচ্ছে। জাইফ সকলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে হাত দিয়ে ইশারায় সালাম দিচ্ছে। অবশেষে তারা প্রাসাদে এসে পোঁছায়। সদর দরজায় আসতেই দু’পাশ থেকে দাসদাসীরা তাদের উপর ফুল ছড়িয়ে দিচ্ছে আর দূরে পুত্রের অপেক্ষায় রাজকীয় পোশাক পপরিহিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে বাদশাহ সুলায়মান এবং তার অর্ধাঙ্গিনী হাজেরা। জাইফ তাদের কাছে এগিয়ে মুচকু হেসে সালাম করলো। বাদশাহ জাইফকে জড়িয়ে ধরে বলে,”তুমি পেরেছো পুত্র তুমি পেরেছো আমরা সত্যি-ই তোমার জন্য গর্বিত পুত্র। এখন থেকে তোমাকে আর আমরা আলাদা থাকতে দেবো না।”

———————————

চলবে তো???

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে