এ শহর মেঘলা ভীষণ পর্ব – ১৩

0
1007

এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ১৩
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম

মিলি ঢাকায় চলে এসে আলাদা রুমে না গিয়ে তোহার সাথে রুম শেয়ার করে থাকে। দুজন মিলে খুনশুটি করে দিন পার করছিলো। সৌরভ মিলিকে চাকরীর জন্য বেশ কিছু বই কিনে দেয়। সেগুলোই প্রেক্টিস করতে থাকে সে। এদিকে তোহা নিয়মিত ক্লাসে মন দেয়। ক্লাস শেষে রাজিবের সাথে একটু ঘুরেফিরে তারপর ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে। সৌরভ অফিসে জয়েন করেছে। শুরু হয়েছে আবারো সেই ব্যস্ত জীবন। ব্যস্ততার মাঝে ছায়ার কেসটা চাপা পরে গেছে। সবাই নিজেদের মতো জীবন গুছিয়ে নিতে কর্মশীল। তবে দিন শেষে একটা সময় সৌরভ শুধু ছায়ার। সেই সময়টা ছায়ার জন্যই রাখা। ছায়ার কথা ভেবে ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি চলে আসা, ছায়ার কথা ভেবে মন খারাপ আবার ছায়ার কথা ভেবেই ঘুমিয়ে যাওয়া। এভাবেই কাটছে সময়। এর মাঝে মিলির ফাইনালের রেজাল্ট হয়ে যায়। একাউন্টিং থেকে ফার্স্ট ক্লাস আসে। জবের জন্যও সব প্রিপারেশন নিয়ে নেয়। তখন সৌরভ নিজেই মিলিকে তার ব্যাংকে জয়েন করতে বলে। মিলি যদিও এভাবে কারোর সুপারিশে ঢুকতে নারাজ হয়। তাই সে ইন্টারভিউ দিয়েই কাজটা নেয়। কিন্তু মিলি জানতে পারে না, সে না করার পরও তার জবটা সৌরভের কারণেই হয়েছে। সৌরভ চাচ্ছিলো না অন্য কোথাও জব করে মিলির জীবনেও কোন রিস্ক চলে আসুক। তাই আগে থেকেই যাতে মিলির জবটা হয়ে যায় সেজন্য সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলো সৌরভ।

মিলি অফিসে জয়েন করার পর সৌরভের সাথেই যাতায়াত শুরু করে। নিয়মিত অফিস করে এক সাথে বাসায় ফিরে তারা। মাঝে মাঝে তোহা আর মিলিকে নিয়ে বাহিরে ঘুরতে বের হয় সৌরভ। জীবনটা আবারো হাসিখুশি হয়ে উঠতে শুরু করে। সৌরভ ঠিক করে এবারে রাজিব আর তোহার বিয়েটা দিয়ে দিবে। তাই সে আর অপেক্ষা করে না। এ বিষয়ে একবার আমেনা বেগম আর আশরাফ আহমেদের সাথে কথা বলে নিতে চায় সে। যেহেতু তার নিজের বাবা মা বেঁচে নেই। উনাদেরকেই সৌরভ নিজের বাবা মায়ের জায়গাটা দিয়েছে। মোহনকে ফোন দিয়ে বলে দেয় সকলকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসতে। তোহার বিয়ের কথাও জানায় তাদের। এটাও বলে তারা আসলেই সব ঠিক করা হবে। সৌরভের এই এতো ভালোবাসা দেখলেই মোহন মুগ্ধ হয়। ছেলেটা তাদের সাথে কতটা গভীর ভাবে জড়িয়ে আছে ! তাই মোহনও দেরি করে না। সকলকে নিয়ে পরের দিনই চলে আসে ঢাকায়।

সন্ধ্যায় বাড়ির সকলে ড্রইং রুমে হাজির হয়। সৌরভ বিনয়ের সাথে বলে,
– ‘ আমার নিজের পরিবারের লোকজন বলতে আপনারাই। তাই আমার এখানে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমি আপনাদের জানানো সব থেকে জরুরি মনে করি। তোহার বিষয়ে তো আগেই বলেছিলাম। রাজিবের সাথে ওর বিয়েটা এবারে ঠিক করতে চাচ্ছি। তাই রাজিবের পরিবারের সাথে কথা বলার আগে আপনাদের সাথে আলোচনা করে নিতে চাচ্ছিলাম আমি। ‘

আমেনা বেগম অল্পতেই আবেগ প্রবণ হয়ে যান সৌরভের কথা শুনলে। এতো শ্রদ্ধা, ভালোবাসা মেয়ের জামাই থেকে ক’জনই বা পায়! তিনি আপ্লুত হয়ে বলেন,
– ‘ রাজিব অত্যন্ত ভালো ছেলে। ওরা দুজন দুজনকে যখন এতো পছন্দ করে তখন আর দেরি করা আসলেই ঠিক হবে না। তুমি রাজিবকে জানিয়ে দাও ওর পরিবারের সাথে কথা বলে বিয়ের দিন ক্ষণ ঠিক করতে। ‘

আমেনা বেগমের সাথে বাকিরাও একই মত পোষণ করে। সৌরভ বেশ খুশি। তার এক মাত্র বোনের বিয়ে হবে নিজের প্রাণ প্রিয় বন্ধুর সাথে। সে ফোন করে রাজিবকে বলে দেয় দুপক্ষ এক সাথে বসে একটা তারিখ ঠিক করা হবে।

রাজিবের পরিবার বলতে আছে শুধু তার মা। পরেরদিন রাজিব  তার মাকে নিয়ে সৌরভের বাসায় এসে বিয়ের তারিখ ঠিক করে যায়। যেহেতু রাজিবের আত্মীয়স্বজন বলতে তেমন কেউ নেই। সেই সাথে সৌরভেরও আলাদা করে বলার মতো কেউ নেই তাই বিয়েটা হবে অল্প কিছু পরিচিত লোকজনদের নিয়ে নিজের বাড়িতেই। বিয়ের তারিখ ঠিক হবার সাথে সাথেই সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মিলি, তোহা আর সুবর্ণা মিলে সারাদিন এদিক সেদিক শপিং করে বেড়ায়। তুহিন আর সৌরভ ডেকোরেশনের লোকজনদের সব দেখিয়ে দেয়া, মেহমানদের নিমন্ত্রণ কার্ড দেয়ার বিষয় গুলো দেখছে। তাছাড়া খাবারের আয়োজনের দিকটাও দেখতে হচ্ছে সৌরভকে।

বিয়ের যখন আর দুদিন বাকি তখনও সৌরভ অফিস থেকে ছুটি নেয়নি। সে অফিস শেষ করে তারপর অন্যান্য কাজে সময় দিচ্ছে। তবে এতে কোন সমস্যা হচ্ছে না। বাড়িতে এখন মিলি, মোহন, সুবর্ণা থাকায় তোহার মন সব সময় ফুরফুরে। আজ ওরা বের হয়েছিলো বিয়ের শাড়ি কিনতে। বাসায় ফিরতে রাত হয়। এসে জানতে পারে আমেনা বেগম মাথা ঘুরে পরে গিয়েছিলো। আশরাফ আহমেদ গিয়ে ছিলেন মাগরিবের নামাজ পড়তে। সে সময় সৌরভ বাসায় আসে। সৌরভ এসে দেখে আমেনা বেগম ড্রইং রুমে পরে আছে। রহিমা, আমেনা বেগমের মাথা কোলে নিয়ে বসে কাঁদছে। সে একা একটা কম বয়সি মহিলা হয়ে আমেনা বেগমের ভারী শরীর নিয়ে উঠে বসাতে পারেনি। সৌরভ শাশুড়ীকে এ অবস্থায় দেখে দ্রুত গিয়ে কোলে তুলে সোফায় শুইয়ে দেয়। তারপর ডাক্তার ডাকা হয়। ডাক্তার জানায় প্রেশার আপ ডাউনের কারণে এমন হয়েছে। তিনি অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করেন আর কিছু মেডিসিন লিখে দেন।  সৌরভ ডাক্তার যাবার পর ওষুধ আনিয়ে খাইয়ে দেয় আমেনা বেগমকে। তারপর নিজ হাতে রাতের খাবার খাইয়ে রুমে নিয়ে যায়।  আমেনা বেগম ঘুমিয়ে গেলে রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে যায় সৌরভ।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

রাত দশটার দিকে আশরাফ আহমেদ, তুহিন আর মিলিকে নিজের রুমে ডেকে নিয়ে আসেন। বাবার সাথে তার রুমে এসে দেখতে পায় তাদের মা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছেন। মিলি আর মোহন মায়ের পাশে গিয়ে বসে। মোহন বলে,
– ‘ এখন কেমন লাগছে মা ? ‘
আমেনা বেগম হালকা হেসে বলেন,
– ‘ ভালো আছি বাবা। ‘

আশরাফ আহমেদ স্ত্রীর পাশে একটা চেয়ার টেনে বসেন। আমেনা বেগম ছেলে মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলেন,
– ‘ আমি তোদের একটা কথা বলার জন্য ডেকেছি। ‘
– ‘ হ্যাঁ বলো। ‘ মোহন উৎসুক হয়ে জানতে চায়।
– ‘ আমি আর তোর বাবা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশা করি তোদের কোন আপত্তি থাকবে না। ‘

মোহন আর মিলি দুজনই ভ্রু উচিয়ে জানতে চায় কী সিদ্ধান্ত ? আমেনা বেগম নিজের মুখে একটা গাম্ভীর্য ভাব ফুটিয়ে শান্ত স্বরে গলার আওয়াজ নামিয়ে বলেন,
– ‘ মিলি বলেছিলো চাকরী করবে তারপর বিয়ে। তখন বোনকে তুই সাপোর্ট দিয়েছিলি মোহন। এখন সে নিজে ইনকাম করে। তার পড়াশুনা শেষ। এখন আমি তার বিয়ে দিতে চাই। আর আমি যার সাথে বিয়ে দিবো মিলির তাকেই বিয়ে করতে হবে। ‘

মায়ের কথায় মিলি আর মোহন দুজনই বেশ অবাক হয়। মোহন বুঝতে পারে তার মা নিশ্চয় পাত্র দেখে ফেলেছে। কারণ তিনি ছেলে ঠিক না করলে কখনোই এতো জোড় দিয়ে বলতেন না, তিনি যাকে বলবেন তাকেই মিলির বিয়ে করতে হবে। তাদের মা কিছু ঠিক করে ফেললে তখনই ছেলে মেয়েদের এভাবে বলেন।  মোহন তাই সরাসরি জানতে চায়,
– ‘ ছেলেটা কে মা ?’

আমেনা বেগম আগের মতোই মুখের ভারী রেশ নিয়ে বলেন,
– ‘ সৌরভ। আমি আর তোর বাবা চাই সৌরভের সাথেই মিলির বিয়ে হোক। ‘

মিলি চমকে যায়। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছুই বলে না। চুপচাপ শুনতে থাকে সে। মোহন অবাক হয়ে বলে,
– ‘ সৌরভ ! ‘
আমেনা বেগম চোখ পাঁকিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,
– ‘ হ্যাঁ সৌরভ। কেনো সৌরভের থেকে কোন ভালো ছেলে পাবি বলে তুই আশা করছিস ? আর পেলেও তো আমি দিবো না। সৌরভ কেমন ছেলে আমরা সকলে জানি। ছেলেটা আমাদের নিজের পরিবারের সাথে জড়িয়ে আছে। ছায়া চলে গেলেও সে আমাদের প্রতি কোন অবহেলা দেখায়নি। আমি চাই ঘরের ছেলেকে ঘরেই রেখে দিতে। ওকে তো আজ না হয় কাল বিয়ে করতেই হবে। সারাজীবন তো ছেলেটার নষ্ট হতে দিতে পারি না। তাই আমার মেয়ের সাথেই তার আবার বিয়ে দিবো। ‘

মোহন কিছু একটা ভেবে বললো,
– ‘ আমারও সৌরভকে পছন্দ মা। তোমরা ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছো। তবে সৌরভ কি রাজি হবে ? ‘
– ‘ সেটা আমি দেখবো। আমি বললে সৌরভ মানবেই। তবে তাড়াহুড়া নেই। সময় হলে দেখা যাবে। তোহার বিয়েটা আগে সম্পূর্ণ হোক। এখনই এসব কথা বাহিরে যাতে না যায়। বিশেষ করে তোর স্ত্রীর কানে তো নয়ই।’ মোহনকে ইঙ্গিত করে কথাটি বলেন আমেনা বেগম।

মোহন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে স্পষ্ট ভাবে বলে,
– ‘ মিলি কী চায় সেটাও দেখতে হবে। মিলির মতটাকে আমি সব সময় গুরুত্ব দিবো। কোন চাপ সৃষ্টি যাতে না হয় তার উপর। ‘

– ‘আমার কোন আপত্তি নেই ভাইয়া। ‘ মাথা নিচু করেই উত্তর দেয় মিলি। তারপর উঠে দ্রুত মায়ের রুম ছেড়ে চলে যায়।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে