এক শহর প্রেম পর্ব-০৯

0
1462

#এক_শহর_প্রেম💓
লেখনীতেঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৯
গম্ভীর পরিবেশের ইতি ঘটিয়ে ভিপি আশিক বললেন,
–তোমার বড়ো বোনের সাথে যা ঘটেছে তা যে তোমার ছোটো বোনের সাথেও ঘটবে এটার কোনো ভিত্তি নেই। তারপরেও তুমি বলবে, সাবধানতা অবলম্বন করতে সমস্যা কী? তাইতো? তোমার কনসার্ন আমি বুঝি। ভিপি অনেকটা রা*জ*নী*তিতে যুক্ত হওয়ার প্রথম ধাপ। তুমি ফার্স্ট ইয়ার থেকেই এসবে জড়িয়ে অনেক এক্টিভিটিতে ছিলে তাই তোমার উপর অনেকের ভরসা আছে আবার ক্ষোভও আছে। তোমাকে জুনিয়ররা বেশি ভরসা করে। আহনাফ যে যোগ্য না তা কিন্তু না। আহনাফ সবটা সামলাতে অবশ্যই পারবে কিন্তু তোমার উপর যাদের ক্ষোভ আছে তারা তোমাকে ক্ষমতাহীন দেখে আরও ফুলে-ফেঁপে উঠবে। তখন তারা যে তোমার ফ্যামিলি ফ্রেন্ডসদের ক্ষ*তি করবে না তার গ্যারান্টি কিন্তু তুমি দিতে পারবে না। আমার সাথে সাগরেরও যোগাযোগ হয়। সে কেমন প্রকৃতির তা আমি জানি। স্টুডেন্টরা তাকে চায় না কিন্তু সে কার্যসাধন করতে পারবে যেকোনো মূল্যে। আমিও যে সম্পূর্ণ ভালো তাও কিন্তু না। খারাপ ভালো সবার মধ্যেই আছে। সাগর ভিপি হোক এটা টিচররাও চান না। এখন কী করা যায় বলো?

মারসাদ টেবিলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে থাকে। পুরোনো সব তার স্মৃতিতে ভাসছে। আহনাফ মারসাদের পিঠে হাত রাখে। আহনাফ মারসাদের ভাবনা বুঝতে পারে। মারসাদের বোনের সাথে কী হয়েছিল….

ফ্ল্যাশব্যাক ——-★

মারসাদের বড়োবোন মিলি। যে কী-না মারসাদের চার বছরের বড়ো। মারসাদ ওর বোনকে আপিলি বলে মিলি নামের শেষ অক্ষরটা সাথে যুক্ত করে। মিলি ছিল খুব শান্তশিষ্ট স্বভাবের। খুবই মিষ্টি একটা মেয়ে ছিল। মারসাদ কেবল তার বড়োবোনের সাথেই চঞ্চল ছিল তার কারণ হলো মিলি ও মারসাদের মায়ের মৃ*ত্যুর পর সাত বছরের বাচ্চা মিলি তার তিন বছরের ছোটো ভাইকে চোখের আড়াল করতেই চাইতো না।

মারসাদের মা মীরার চাচাতো বোন মনিকা, মারসাদের বাবা আরসাদকে ভালোবাসতেন কলেজ লাইফ থেকে। কিন্তু তিনি জানতেন না তার কাজিন বড়োবোন মীরার সাথে তার কিশোরী বয়সের ভালোবাসার মানুষটার প্রণয় চলছিল। মীরা ও আরসাদ অনার্স কম্পিলিট করে তাদের পরিবারকে জানিয়েছিলেন তাদের প্রণয়ের কথা। দুইজন ক্লাসমেট ও বেষ্টফ্রেন্ড। দুজনের ব্রাইট ফিউচার। দুই পরিবারের মধ্যেও ভালো সম্পর্ক। মেনে নিয়েছিল মীরা ও আরসাদকে। মনিকা তখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়তেন। যৌথ পরিবার বসবাস তাদের। মনিকা নিজের ভালোবাসার অকাল মৃত্যুর একমাত্র সাক্ষী ছিল। মীরা ও মনিকা দুইজনেই তাদের পরিবারের সবার কাছে নিজেদের ভালোবাসার কথা অপ্রকাশিত রেখেছিল।

মীরা ও আরসাদের বিয়ের দুই বছর পর মিলির জন্ম। মীরার ফার্স্ট প্রেগনেন্সিতেও কিছু কম্পিলিকেশন ছিল তারপর মারসাদের সময় সেটা আরও বৃদ্ধি পায়। মারসাদের জন্মের পর মীরা প্রায়ই অসুস্থ থাকতো। মীরার জরায়ুতে খুবই খারাপ আকারে ক্যান্সার ধরা পরেছিল তাও সাথে কিডনি ও ইউরিনারি ইনফেকশন। মীরা একদিন তার বাবার বাড়িতে গিয়ে মনিকার স্টাডি টেবিলের ড্রয়ারে একটা ডায়েরি পেয়েছিল যা মনিকা সবসময় আড়াল রাখতো। সেদিন মীরার হঠাৎ ব্যাথা শুরু হওয়াতে মনিকার টেবিলের ড্রয়ার থেকে পেইনকি*লার মেডিসিন নেওয়ার জন্য এসেছিল তখন ডায়েরিটা দেখেছিল। মনিকার মাস্টার্স শেষ করে বছর গড়িয়ে গিয়েছিল কিন্তু সে বিয়ে করতে আগ্রহী ছিল না। মীরা কারণ জানার জন্য ডায়েরিটা নিজের কাছে রেখেছিল। মীরা মনিকার ব্যাপারে জানার পর খুব কস্ট পেয়েছিল। নিজের ক্ষুদ্র জীবন যে কারও জন্য আশীর্বাদ হতে পারে ভেবেই সে নিজে জীবিত থাকা অবস্থায়ই আরসাদের সাথে মনিকার বিয়ে দিয়েছিল অনেকটা আরসাদকে জোরপূর্বক। আরসাদ কোনো অবস্থায় দ্বিতীয় বিয়ে করতে রাজি ছিল না কিন্তু মীরার জেদ ও ওয়াদার কারণে বাধ্য হয়েছিল। মীরা তার স্বামী ও সন্তানদের কথা চিন্তা করে বিয়েটা করিয়েছিল। সে ভেবেছিল মনিকা তার চাচাতো বোন, নিশ্চয়ই সে তার বোনের এই সেক্রিফাইজের মূল্য দিবে। মীরা যদি জোর না করতো তবে আরসাদ কখনওই মীরার মুত্যুর পরেও দ্বিতীয় বিয়ে করতেন না। কিন্তু মনিকা বদলে যেতে শুরু করেছিল বিয়ের ছয় মাস পেরিয়ে যাবার পর থেকেই। আরসাদ মনিকার কাছে যেতেন না বলতে গেলে। মীরা জোর করে পাঠালে তখন যেতেন কিন্তু মনিকাকে নিজের কাছে ঘেষতে দিতেন না। মীরাকে যে সে খুব ভালোবাসে। মীরা তখন অনেকটা অসুস্থ কিন্তু মনিকা তার সাথে প্রায়ই রুড ব্যাবহার করতেন। কারণে অকারনে মীরাকে পিঞ্চ করতেন। মীরা তাও আরসাদকে জানতে দিতেন না। মনিকার সাথে আরসাদের বিয়ের এক বছরের মা*থায় মীরার মৃ*ত্যু হয়।

আরসাদ মীরার মৃ*ত্যুর পর খুব ভেঙে পরেছিল সে নিজেকে সময় দিতে সিঙ্গাপুর চলে গিয়েছিল। তখন আরসাদের কোনো খোঁজ খবর পাওয়া যেতো না। মনিকার তখন থেকে আরও বদল ঘটে। মারসাদ ও মিলির কোনো কেয়ার তিনি করতেন না। ওদের দাদী ওদের দেখাশোনা করতেন। আরসাদ ছয় মাস পর দেশে ফিরে এসব দেখে মনিকাকে অনেক কিছু বলেছিল ও তাদের মাঝে অনেক ঝামেলাও হয়েছিল। আরসাদ মীরার শেষ সময়ের ডায়েরিটা নিয়ে সিঙ্গাপুর গিয়েছিল। ডায়েরি থেকে সবটা জানতে পেরেছিল মনিকার ব্যাবহার মীরার প্রতি। তাই তিনি চাইছিলেন মনিকা একা থেকে নিজেকে শোধরাক। মনিকাকে আরসাদ বিয়ের আগেও মানা করেছিল যাতে মীরার প্রস্তাবে রাজি না হয় কিন্তু মনিকা সেটা মানেন নি কারণ তখন মনিকা আরসাদকে নিজের করে পাওয়ার চেতনায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।

মারসাদের দাদী তার ছেলেকে ডেকে মনিকার সাথে সম্পর্ক ভালো করতে বলার পর আরসাদও ভাবলেন তাই করবেন কারণ আরসাদ চান না মনিকা মিলি ও মারসাদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করুক। মনিকা তখন দিন দিন বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছিলো। আরসাদের নরম ব্যাবহারে মনিকাও কিছুটা নরম স্বভাবের হচ্ছিলো কিন্তু মাহির জন্মের পর থেকে মনিকা আবারও বদলে গিয়েছিলেন। মারসাদ ও মিলিকে সে ট*র্চার না করলেও আদরও করতেন না। মাহি মারসাদের পাঁচ বছরের ছোটো। মারসাদ ও মিলি দুজনেই মাহিকে খুব ভালোবাসে কিন্তু তাও মনিকার কাছে মারসাদ ও মিলি মাহির মতো আদরের ছিল না।

সময়ের পরিক্রমায় ওরা বড়ো হয়। মিলির অনার্স শেষ হওয়ার পর অনেক বিয়ের প্রস্তাব আসতো। ওই সময় মিলির বাবা সিটিকর্পোরেশনে কাউন্সিলর পদে জয়ী হয়েছিল। মারসাদ তখন ভার্সিটিতে প্রথম বর্ষে। মিলির বাবার কাছে একজন এক ছেলের কথা বলার পর তিনি ছেলের স্টাডি ব্যাকগ্রাউন্ড অনেক ভালো ও কিছু খোঁজখবর নিয়ে ভালোই জানতে পারেন। শেষমেশ খুব জলদি মিলির বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বিয়ের কয়েকমাসের মধ্যে ওই ছেলে নিজের আসল রূপে দেখাতে শুরু করে মিলিকে। সেই ছেলে মিলির বাবার অপোজিট পার্টির একজনের দুঃসম্পর্কিত আত্মীয় হয় এবং বিয়েটা তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য করিয়েছিল। মিলিকে টর্চার করতো ও বলতো যেনো ওর বাবাকে পদত্যাগ করতে বলে। আর প্রায়ই টাকার জন্য পাঠাতো। টাকা দিলে কিছুদিন শান্ত থাকতো। মিলির বাবা ট*র্চারের ব্যাপারে জানতেন না। তিনি নিজের মেয়েকে চাইলে সবই দিতেন কিন্তু মাহির মা মিলির টাকা নেওয়া পছন্দ করতেন না। মিলিকে তিনি একদিন ডেকে খুব কড়া করে নিষেধ করে দিয়েছিলেন টাকা নিতে। মিলি কাউকেই ট*র্চারের বিষয়ে বলতে পারতো না কারণ মিলি তখন প্রেগনেন্ট ছিল আর মিলির স্বামী মিলির আদরের ভাই মারসাদের ক্ষতি করার হুমকি দিতো। সে বুঝাতে চেষ্টা করতো তার স্বামীকে কিন্তু মিলির সব প্রচেষ্টা বৃথা। মিলির বাচ্চা ডেলিভারির সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও শরীর অনেক দুর্বল থাকার কারণে বাচ্চাসহ মিলির মৃ*ত্যু হয়েছিল।

মিলির না বলা সকল কথা মিলি নিজস্ব ডায়েরিতে লিখে রাখতো। ডায়েরিটা মিলি তার বাবার বাড়িতে আলমারির একদম নিচে এক কোনে রেখেছিল। মিলি মৃ*ত্যুর আগে মারসাদের হাত ধরে বলেছিল,

“সাবধানে থাকবি ভাই। অনেক কিছু বলার ছিল তোকে কিন্তু আমার হাতে সময় নেই। ওই লোকগুলো মানুষ না। একেকটা প*শু!”

মারসাদ সেদিন চিৎকার করে কেঁদেছিল। নিজের মায়ের মৃ*ত্যুর পর বড়োবোন ও দাদীই তাকে মায়ের ভালোবাসা দিয়েছিল। মারসাদ মিলিকে চিরনিদ্রায় ক*বরে শায়িত করে সেদিনই মিলির রুমের সবকিছু তন্নতন্ন করে ডায়েরিটা পায়। সেখানে মিলির বিয়ের পর থেকে আট মাসের সময়ের অনেক কিছু লিখা ছিল। মারসাদ সারারাত ডায়েরিটা পড়ার পর পরেরদিনই ডায়েরিটা সবার সামনে রেখে তাচ্ছিল্য স্বরে বলেছিল,

–পর সত্যি আপন হয় না। যেমনটা মিসেস মনিকা খানও হননি। আপনাকে আমার মা নিজের কস্ট তোয়াক্কা না করে নিজের স্বামীর ভাগ দিয়েছিলেন কিন্তু আপনি আমার মাকেই মূল্য দিলেন না। থাকুন আপনি আপনার সাম্রাজ্যে। আমার বোন যে আপনায় আপন ভেবে মা মনে করে কিছু শেয়ার করবে সেটারও অবস্থা রাখেন নি নিজের মানসিকতার পরিচয় দিয়ে। সুখে থাকুন আপনি। আর মিস্টার আরসাদ খান, নিজের শত্রুর কাছেই মেয়েকে বিয়ে দিলেন! আমার বোনের ব্যাপারে বড্ড তাড়াহুড়ো করে ফেলেছিলেন আপনি। অবশ্য আপনার স্ত্রীরই তো বড্ড তাড়া ছিল আমার বোনকে তাড়ানোর। ভালো থাকবেন আপনারা।

মারসাদ সেদিন তার দাদী, বাবা ও মাহি কারও কাকুতিমিনতি কানে তোলে নি। সে বেরিয়ে এসেছিল সেই বাড়ি থেকে। মারসাদের মায়ের নামে যা ছিল সেগুলো তিনি তার দুই ছেলে-মেয়ের নামে মৃ*ত্যুর আগে লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন। মারসাদ নিজের প্রয়োজনে সেগুলোই ব্যাবহার করে।

ফ্ল্যাশব্যাক এন্ড—-★

চলবে ইন শা আল্লাহ্,
ভুল ত্রুটি মার্জনীয়। কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে