একতরফা ভালোবাসা পর্ব-১৪

0
385

#একতরফা_ভালোবাসা
#পর্বঃ১৪
#লেখিকাঃদিশা_মনি

আহিল বাসের মধ্যে উঠে কোথাও প্রেয়াকে খুঁজে পায় না। এই বিষয়টি তাকে ভীষণ ভাবে হতাশ করে। সে হঠাৎ করে বলে ওঠে,
“তাহলে কি তুমি সত্যি আমায় ছেড়ে একেবারের জন্য চলে গেলে প্রেয়া? আর কি কখনো তোমার দেখা পাবো না?”

বাস ছাড়ার সময় হয়ে আসায় বিষন্ন ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়েই বাস থেকে নেমে পড়ল আহিল। সে এখন পুরোই হতাশায় ভুগছে। তবুও আশা ছাড়ল না আহিল। আজ সারাদিন বাস স্ট্যান্ডেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। তার একটাই উদ্দ্যেশ্য যে করেই হোক প্রেয়াকে খুঁজে বের করবেই। তার জন্য যা করতে হয় সে করবে। প্রয়োজনে আজ সারাদিন বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকবে।

★★★
প্রেয়াদের বাসটা আহিল বাসস্ট্যান্ডে উপস্থিত হওয়ার আগেই ছেড়ে দেয়। তাই আহিল প্রেয়ার আগাল পায়নি।

বাসের মধ্যে একদম জানালার পাশের সিটে বসে আছে প্রেয়া। জানালার কাচ ভেদ করে সে দেখে চলেছে বাইরের দৃশ্য। প্রেয়ার চোখের কোণে জমে আছে বিন্দু বিন্দু জলরাশি। আপন মানুষজন, চেনা শহর ছেড়ে সে আজ একজন নতুন গন্তব্যের দিকে পা বাড়াচ্ছে। সে জানে না তার ভবিষ্যত কি হবে। নিজের সামনের পদক্ষেপ নিয়েও সন্দিহান সে। তবুও আপাতত সে চাইছে জীবনের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া। সে জানে আপন মানুষজনকে ছেড়ে থাকাটা মোটেই সুখকর হবে না। বিশেষ করে তার প্রান্তির কথা খুব মনে পড়বে। তবুও প্রেয়া নিজেকে শক্ত রাখক। স্বগতোক্তি করে বলল,
“আমি একটা অপয়া মেয়ে। আমার পাশে থাকলে সবার বিপদ হতে পারে৷ তার থেকে ভালো আমি সবার থেকে দূরে চলে যাই। তাহলেই হয়তো সবাই ভালো থাকবে।”

এসবের মধ্যে আহিলের কথাও তার মনের মধ্যে আসে। আহিলের কথা মনে আসতেই প্রেয়া বলে ওঠে,
“আহিল ভাইও নিশ্চয়ই তার জীবনটা নতুন ভাবে সাজিয়ে নেবে। নতুন কাউকে হয়তো বিয়েও করে নেবে…যাইহোক সে সুখী হোক। এতে আমিও খুশি হবো। ভালো থাকুক ভালোবাসার মানুষগুলো। আমার একতরফা ভালোবাসার অনুভূতি আর আহিল ভাইয়ের দয়ার সংসারের থেকে বেটার হবে যেন সে কাউকে মন থেকে আপন করে নিতে পারে।”

★★★
তুষার আহিলকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করছে যেন সে বাস স্ট্যান্ড থেকে বাড়ি ফিরে যায়৷ কিন্তু আহিল কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। আহিল সমান তালে বলে যাচ্ছিল,
“আব্বু আমায় বলেছে প্রেয়াকে না নিয়ে যেন আমি বাড়িতে না ফিরি। আমি তাই করব। আমি যতক্ষণ না প্রেয়াকে খুঁজে পাচ্ছি ততক্ষণ বাড়িতে ফিরব না আর এটাই আমার প্রতিজ্ঞা।”

তুষার অনেক বুঝিয়েও কোন লাভ পায়না। সেও আজ সারাটা দিন কমলাপুর রেলস্টেশনে ছিল৷ কিন্তু প্রেয়াকে খুঁজেই পায়নি সেখানে। তুষার খুব ভালোই বুঝতে পেরেছে প্রেয়া হয়তো তাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। সে আহিলকেও এটা বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আহিল কোন কিছু মানতেই রাজি নয়। আহিলকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে তুষার হা হুতাশ করে বলে,
“জানি না এটা কেমন ভাগ্য৷ যেই গল্প শুরু হয়েছিল প্রেয়ার একতরফা ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে না জানি সেই গল্পের শেষটা কোথায় গিয়ে হয়!”

~~~৩ বছর পর,
অফিস থেকে নিজের ভাড়া বাসায় ফিরে এলো আহিল। এসেই বসে পড়লো সোফায়। অতঃপর প্রেয়ার ডায়েরিটা হাতে তুলে নিলো। প্রেয়া চলে যাওয়ার সময় এই ডায়েরিটা রেখে গিয়েছিল৷ গত ৩ বছর থেকে আহিল প্রতিদিন নিয়ম করে এই ডায়েরিটা পড়ে। এই ডায়েরির প্রত্যেকটা শব্দ, প্রত্যেকটা বাক্য তার মুখস্থ হয়ে গেছে। ডায়েরির পুরোটা জুড়েই তাকে নিয়ে প্রেয়ার সুপ্ত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আহিলের ভাবতেও ভালো লাগে যে কেউ একজন তাকে এত বেশি ভালো বেসেছিল৷ অথচ সে সেই ভালোবাসাটা উপলব্ধি করতে দেরি করে ফেলেছে। এজন্যই বোধহয় বলে সঠিক সময়ে মূল্য দিতে না জানলে হারিয়ে ফেলার পর আফসোস করা ছাড়া কিছু করার থাকে না। গত ৩ বছর ধরে আফসোস, দীর্ঘশ্বাস এগুলো নিয়েই চলে যাচ্ছে আহিলের জীবনটা। সে তার বাবাকে দেওয়া কথা রাখতে নিজের বাড়িতেও আর ফেরেনি৷ এখনো সে এই কথা নিয়েই বসে রেখেছে যে যতদিন না প্রেয়াকে খুঁজে পাবে ততক্ষণ সে নিজের বাড়িতে পা রাখবে না।

হঠাৎ করেই আহিলের ফোন বেজে উঠল। আহিল ফোনটা তুলে দেখল তার মা ফোন দিয়েছে। আহিল বিরক্তিতে মুখ দিয়ে “চ” জাতীয় শব্দ করে। কারণ এটা তার কাছে নতুন কিছু নয়৷ গত ৩ বছর থেকে প্রত্যেকটা দিনই রাহেলা বেগম প্রতিদিন এভাবে তাকে ফোন করেন। ফোনে অনেক কান্নাকাটি করেন, আহিলকে বাড়িতে ফিরতে বলেন। আহিলের প্রথম প্রথম কষ্ট হলেও পরবর্তীতে বিরক্তি জন্ম নেয়৷ তার উপর যখন একদিন রাহেলা বেগম নিজের মুখেই সব স্বীকার করেন তিনি প্রেয়ার সাথে কিরকম ব্যবহার করেছিলেন তখন থেকে আহিল নিজের মাকে যথা সম্ভব এড়িয়ে চলে। ভালো ভাবে কথাও বলে না। তবুও রাহেলা বেগম প্রতিদিন নিয়ম করে তাকে ফোন করেন। আহিল একটু সময় নিয়েই ফোনটা রিসিভ করল। সাথে সাথেই রাহেলা বেগম কাতর কন্ঠে বলে উঠলেন,
“ফোন ধরতে এত দেরি হলো কেন আহিল? তুই কি ব্যস্ত আছিস?”

“ব্যস্ত থাকলেও বা তোমার কি? তুমি তো সেই প্রতিদিনের মধ্যে একটু পরেই কান্নাকাটি করে ভাসিয়ে দেবে। আমাকে ফিরে যেতে বলবে তাই তো? তো শুরু করো তোমার নাটক।”

“আহিল!! আমার কান্নাকে তোর নাটক মনে হয়? একজন মায়ের মন তুই বুঝবি না। তুই আমার একমাত্র ছেলে। তোকে ঘিরেই যে আমার সব।”

“অথচ তোমার ছেলের জীবন তুমি নিজের হাতে নষ্ট করে দিয়েছ আম্মু।”

রাহেলা বেগমের অন্তরে গিয়ে লাগল কথাটা। তিনি জানেন আহিল ঠিক বলছে। নিজের ভুলের উপলব্ধি অনেক আগেই হয়েছে তাঁর। তিনি ভেবেছিলেন প্রেয়াকে দূর করতে পারলেই সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু তিনি যে নিজের অজান্তে নিজের ছেলের কত বড় ক্ষতি করেছেন সেটা বুঝতে পারেন নি। তাই তো এখন প্রতিনিয়ত তাকে গ্লানির অনলে জ্ব*লতে হচ্ছে। রাহেলা বেগম অসহায় স্বরে বলেন,
“আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। কিন্তু আমার অন্যায়ের শাস্তি তুই নিজেকে কেন দিচ্ছিস? ফিরে আয় আহিল। আমার কথা না ভাব তোর বাবার কথা ভাব। ওনার শরীর আজকাল ভালো যাচ্ছে না। বারবার তোকে দেখতে চাচ্ছেন। তোকে সেদিন ঐ কথাটা বলার জন্য উনি আজও আফসোস করেন জানিস?!”

আহিল কোন কিছুই বলে না। রাহেলা বেগম ফোনটা রেখে দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। এই পৃথিবীতে কিছু কিছু অন্যায়ের জন্য একটু ভয়াবহ শাস্তিই বোধহয় পেতে হয়। রাহেলা বেগম এখন সেটা উপলব্ধি করেছেন। প্রেয়ার সাথে তিনি যে অন্যায় করেছিলেন তার জন্য আজ তিনি নিজের ছেলের চোখে খারাপ হয়ে আছেন, তার ছেলে তার থেকে এত দূরে, স্বামীর থেকে অবহেলিত হন তিনি। এসব কিছু তার মনে পীড়ার জন্ম দিয়েছে। রাহেলা বেগম এখন চান নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও প্রেয়াকে ফিরিয়ে আনতে৷ তার ছেলের জীবনটা সুন্দরভাবে গুছিয়ে দিতে। কিন্তু এখন যে সেটা আর তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এই আত্মগ্লানি বয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে তাকে।

★★★
সিলেটের একটি বেসরকারি ভার্সিটির ক্যাম্পাসে নিজের কিছু ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে প্রেয়া। এই প্রেয়ার সাথে ৩ বছরের আগের প্রেয়ার অনেক অমিল। যদিও স্বভাবে আগের মতোই চাপা স্বভাবের রয়ে গেছে সে। কিন্তু চলনে বলনে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে সে অনেক আধুনিকমনা এবং স্বাধীনচেতা জীবন যাপন করছে। শরীর স্বাস্থ্যেরও উন্নতি হয়েছে। আগের থেকেও বেশি সুন্দরী হয়ে উঠেছে সে। অনেক ছেলে তার জন্য পাগল। কিন্তু সে এসবে পাত্তা দেয়না। প্রেয়া নিজেকে গড়ে তুলেছে একজন নারীবাদী হিসেবে। সে নারী অধিকার নিয়ে অনেক কথা বলে। তাদের গ্রুপের বাকি বান্ধবীরাও তার সমমনা। প্রেয়ার চিন্তাধারা এখন এমন মেয়েরা চাইলে একাই নিজের জীবন কা*টিয়ে দিতে পারে। তার জীবনে কোন পুরুষের প্রয়োজনীয়তা নেই। এই চিন্তাধারাই লালন করে চলেছে। বর্তমানেও এই বিষয় নিয়ে কথা বলছিল সে। এরইমধ্যে তাদের গ্রুপের মেঘলা নামের একটি মেয়ে বলে ওঠে,
“জানিস আমার ফ্যামিলি আমার বিয়ে ঠিক করেছে। ছেলে নাকি অনেক ভালো ফ্যামিলির। ইঞ্জিনিয়ার! আমার কি বিয়েটা করা উচিৎ?”

প্রেয়া সাথে সাথে বলে ওঠে,
“একদম না। তুই এখনই গিয়ে না করে দে। ছেলে যেমনই হোক সেটা কোন ফ্যাক্ট না। নিজে প্রতিষ্ঠিত না হয়ে বিয়ে করার প্রশ্নই ওঠে না। এমন হলে বিয়ের পর তোকে স্বামীর কথামতো চলতে হবে। তুই কেন কারো দয়ার উপর চলবি? তুই নিজে চাকরি করবি, নিজের টাকায় চলবি। ওমেন ইম্পাওয়ারম্যান্টে অংশ নিবি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে শোষিত হলে চলবে না।”

চলবে ইনশাআল্লাহ ❤️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে