এই ভালো এই খারাপ পর্ব-০১

0
662

#এই_ভালো_এই_খারাপ(১)
#Jannat_prema

নিজের বিয়ের স্টেজে এমন কিছু যেনো কল্পনাতীত ছিলো মেয়েটির। বর বেশে থাকা লোকটিকে দেখে অচিরে কপাল কুঁচকে গেলো। নিজের এক্স বয়ফ্রেন্ডকে বর বেশে মুচকি হেসে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিস্ময়ে হতবাক সে। মনে মনে একটা প্রশ্ন জাগলো তার, মানুষটা এতো বছর পর কেনো এলো? তাও এভাবে বর বেশে। কিন্তু তার বিয়ে তো আরেক জনের সাথে হওয়ার কথা। এ আবার কোথা থেকে আমদানি হলো। চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে ছেলেটির দিকে। এই বিয়ে সে কিছুতেই করবে না। করবে না মানে না! কনে কে এভাবে কবুল বলার মুহুর্তে দাড়িয়ে যেতে দেখে অবাক হলো সকলে৷ কেউ কেউ ছবি তুলতে গিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আবার কেউবা খেতে খেতে খাবার মুখে রেখেই অবাক হয়ে আছে৷ এতোক্ষণের পরিবেশটা কেমন অন্যরকম হয়ে গেলো। অনেকে কনেকে এভাবে আচমকা দাড়িয়ে যেতে দেখে কানাঘুষা করছে। মেয়েটির পাশ থেকে তার ছোট বোন সকাল ব’লে উঠলো,

” এভাবে দাড়িয়ে গেলি কেনো, আপু? ”

” এ বিয়ে আমি করবো না, সকাল! ”

ফিসফিস করে বোনের বলা কথাটা শুনে চমকে উঠলো সকাল। এমন চরম মুহুর্তে বোনের মুখ থেকে এমন কথা শুনে অবাক হওয়ারই কথা। মেয়েকে এভাবে দাড়িয়ে যেতে দেখে এগিয়ে আসলেন বাদল সাহেব। মেয়ের কাছ এসে আদুরে ভাবে মাথায় হাত রেখে বলে উঠলেন,

” কোনো সমস্যা, মা? এভাবে দাড়িয়ে গেলে যে? ”

নিজেকে শীতল করলো৷ বাবার দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বললো,

” উনার সাথে তো আমার বিয়ে হওয়ার কথা না বাবা! যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো তিনি তো এই লোকটা না। ”

বাদল সাহেব মেয়ের কথায় বর বেশে বসে থাকা ছেলেটির দিকে তাকালো। সকলের দৃষ্টি তাদের দিকে। মেয়েকে কি বলবে ভেবে মনে মনে আড়ষ্টতায় জড়িয়ে গেলো। মেয়েকে এ ব্যাপারে আগেই বলা উচিত ছিলো তার। সকাল বাবার চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে বোনকে বলে উঠলো,

” আসলে আপু উনার নাম, আ__”

” বাবা বলুক ব্যাপারটা! ”

সকাল চুপ হয়ে গেলো। দূর থেকে স্বামী ও দুই মেয়েকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে শ্রাবন্তী আক্তার এগিয়ে আসলেন। বড় মেয়ের উপর কিছুটা রেগে গিয়ে ব’লে উঠলেন,

” তোর কোনো আক্কেল নেই, ভোর! এভাবে ভরা বিয়ের মাঝে দাড়িয়ে কি বুঝাতে চাইছিস তুই? ”

অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালো ভোর। এতো বড় ঘটনা ঘটলো তার সাথে, আর সেখানে তার মা পরে আছে তার আক্কেল নিয়ে! বাদল সাহেব স্ত্রীর কথায় অসন্তুষ্ট হলেন। পাত্রপক্ষের থেকে কেউ কনেদের দিকে এগোতো নিলে তাকে আটকে দিলো ছেলেটি৷ ছেলের এমন আচরণে কৌতুহল নিয়ে তাকালো আফিল রহমান। বাবাকে ইশারায় কিছু একটা বললো। তিনি আর এগোলেন না সেদিকে। বাদল সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,

” এখানে একটু ঝামেলা হয়েছে মা।তোমার যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো, সেই ছেলেটা নাকি আজকে সকালে পালিয়ে গেছে। তাই মান সম্মানের কথা চিন্তা করে পাত্রের চাচাতো ভাইয়ের সাথে তোমার বিয়েটা দিচ্ছি৷ আমি ছেলেটার সাথে কথা বলে বুঝেছি খুব ভদ্র ছেলে। নাম আফিয়ান আবদ্ধ। তোমাকে আমার আগেই বলা উচিত ছিলো৷ আশা করি তুমি অমত করবে না।! অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। কিছু জানার থাকলে নাহয় আবদ্ধ তোমাকে সবটা বলে দিবে।”

বাবার কথায় ছলছল নয়নে তাকালো বর বেশে বসে থাকা আবদ্ধের দিকে৷ বেহায়া ছেলেটি তার দিকে বাঁকা হেসে তাকিয়ে আছে৷ বাবার কথায় মনে মনে তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো৷ বাবার থেকেও ভালো চিনে সে ছেলেটিকে। আফটার অল তার এক্স বলে কথা। ভোরের ইচ্ছে করলো চিৎকার করে বলতে, এই বিয়ে আমি করবো না,বাব! এমন চিটারের সাথে সে থাকতে রাজি নয়। কিন্তু সব কথা কি আর মুখ ফুটে বলা যায়। বাবার মান সম্মানের কথা ভেবে আবদ্ধর পাশে গিয়ে বসলো। ভোরকে নিজের পাশে বসতে দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসলো আবদ্ধ। পরিবেশ এখন আবার আগের মতো জমজমাট হয়ে উঠলো। কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করে দিলেন। সকলের অগোচরে ভোরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

” শুভ কামনা মিস ওপ্স মিসেস ইনায়াত হোসেন ভোর! ”

আবদ্ধর এমন কথায় ভোর দাঁতে দাঁতে চেপে আবদ্ধর হাতের উপর চিমটি কাটলো। হাতে ব্যাথা পেলেও চুপচাপ হজম করে গেলো আবদ্ধ৷ ভোর মাথাটা হালকা কাত করে আবদ্ধর মতো করে বলে উঠলো,

” তোকেও শুভ কামনা মিস্টার আফিয়ান আবদ্ধ!”

ভোরের কথায় ওর মুখের দিকে তাকালো আবদ্ধ। ভোর যেনো আগের থেকেও আরো সুন্দরী হয়ে উঠেছে। এই যে লাল শাড়িতে তাকে অপ্সরি থেকেও কম লাগছে না। এই দিনটার জন্য কত অপেক্ষা করেছে। তার ভোরকে বউ বেশে দেখবে। নিজের করে নিয়ে যাবে। এসবের জন্যই তো এতো বছর সে দূরে ছিলো। কাজির ডাক কানে যেতেই সম্বিৎ ফিরে। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে৷ সেই কখোন থেকে কাজি ডেকে যাচ্ছিলো কবুল বলতে। কিন্তু আবদ্ধ শুনলে তো৷ নিজের এহেন কাজে খানিকটা লজ্জা পেলো। মাথার পাগড়িটা ঠিক করে ভোরের দিকে তাকিয়ে কবুল বলে দিলো। আবদ্ধর এমন কাজে বিরক্ত হলো ভোর। সেই আবার আগের নাটকগুলো শুরু করলো। সকাল বোনের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,

” তোর জামাইটা কিন্তু হ্যাব্বি হ্যান্ডসামরে আপু৷ যে লোকটা পালিয়ে গেছে তার থেকেও সুন্দর। তোদের দুজনকে বেশ লাগছে দেখতে। ”

” আচ্ছা তাই? ”

বোনের কথায় খুশিতে গদগদ কণ্ঠে সকাল বলে উঠলো,

” হুম! হুম! ”

ভোর মুখে হাসি রেখে ব’লে উঠলো,

” তোর যখন এতই পছন্দ হয়েছে তাহলে বিয়েটা তুই করতে পারতি। ”

সকালের হাসি হাসি মুখটা চুপসে গেলো৷ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মুখ ভেংচিয়ে চলে গেলো অন্যদিকে।

.

এতোক্ষণ সকালের দিকে তাকিয়ে ছিলো আদিল৷ সকালকে স্টেজ থেকে নামতে দেখে হাটা ধরলো সকালের পিছু পিছু। মেয়েটাকে তার ভালো লেগেছে। মনে মনে ভাবলো বর্তমান গার্লফ্রেন্ডের সাথে কিভাবে ব্রেকআপ করবে। সকাল গিয়ে দাড়ালো তার কাজিনদের সাথে। ওদেরকে ছবি তুলতে দেখে নিজেও গেলো ছবি তুলতে। নাহলে আর সময় পাবেনা। একটু পরই আপুর বিদায়। বোনের বিদায়ে যে সে দঃখ পাচ্ছে তা না৷ আপুর সাথে তো সেও যাবে। বেশ আনন্দ লাগছে তার শুনেছে, দুলাভাইয়ের একটা বড় বোন আছে আর একটা ছোট ভাই। আচ্ছা উনার ভাইটা কত ছোট হবে?

” এহেম! এহেম! ”

কারো গলার আওয়াজ শুনে পিছনে তাকালো সে। সুন্দর দেখতে লম্বা চওড়া কালো সুট বুট পড়ে হাসি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে একটা ছেলে। সকাল আদিলের উপর থেকে নিচে একবার চোখ বুলালো। হাইটে তার থেকে অনেক লম্বা৷ সকালকে নিজের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনে মনে খুশিতে নেচে উঠলো। হয়ত মেয়েটা তার উপর ক্রাশ খেয়েছে৷ আদিল আরেকটু ভাব নিতে যাবে ঠিক সে সময় সকাল সামনের দিকে ঘুরে হাটা ধরলো৷ আদিল হা করে তাকিয়ে আছে সকালের যাওয়ার দিকে। মেয়েটা কি সুন্দর তাকে ইগনোর করে চলে গেলো। আদিল নিজেকে মিথ্যে স্বান্তনা দিয়ে ডেকে উঠলো,

” এই পিচ্চি শুনছো? ”

পিচ্চি ডাক শুনে দাড়িয়ে গেলো সকাল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কোনো পিচ্চি আছে নাকি! কাউকে না দেখে পিছনে তাকালো সেই সুন্দর দেখতে ছেলেটির দিকে। আদিল সকালকে তার দিকে ফিরতেই হাত নাড়িয়ে হাই জানালো। সকাল বুঝতে পারলো ছেলেটা তাকে পিচ্চি বলেছে। রাগ হলো সকালের। নাকের ডগা ফুলিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে এগিয়ে আসলো আদিলের দিকে। নিজের দিকে তর্জনি আঙ্গুল তাক করে বললো,

” আপনি কি আমাকে পিচ্চি বলে ডেকেছেন? ”

আদিল হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ালে সকাল এক অবাক কান্ড করে বসলো। পা উঁচিয়ে আদিলের চুল টেনে দিয়ে বলে উঠলো,

” আপনার বউ পিচ্চি, আপনার পোলাপান পিচ্চি৷ খারুস লোক! ”

এদিকে চোখ বড় বড় করে সকালের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে আদিল। পিচ্চি বলাতে যে কেউ এমন করবে সপ্নেও ভাবেনি। পরপরই হেসে উঠলো আদিল। মাথা চুলকে বলে উঠলো,

” তুমি আসলেই মিষ্টি একটা পিচ্চি! ”

.

শ্রাবন্তী আক্তার মেয়েকে জড়িয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। সকাল মায়ের পাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে চোখের পানি মুছছে। আবার কিছুক্ষণ পরপর নাক টানছে৷ আদিল সকালের লাল হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে আছে৷ সকালের কান্না দেখে বুকের ভিতর অদ্ভুত যন্ত্রণা টের পাচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে গিয়ে বলতে, পিচ্চি মানুষ এতো কাঁদতে নেই। বাদল সাহেব আবদ্ধর হাত ধরে চোখের পানি মুছে বলে উঠলেন,

” আমার মেয়েটাকে কষ্ট দিওনা বাবা। আমার অনেক আদরের মেয়ে৷ যদি কোনো ভুল করে তাহলে ওকে সঠিকটা শিখিয়ে দিও। নিজের মতো করে শিখিয়ে পড়িয়ে দিও। ”

আবদ্ধ মুচকি হেসে উনাকে একপাশে জড়িয়ে ধরে আশ্বাস দিলো। তার মেয়েকে সে সব সুখ দেওয়ার চেষ্টা করবে৷ আফিল রহমান এগিয়ে এসে বাদল সাহেবের হাত ধরে বললেন,

” খামোখা চিন্তা করছেন কেনো বেয়াই সাহেব। ভোর মাও আমার আরেকটা মেয়ে। এক বাবাকে ছেড়ে যাচ্ছে তো কি হয়েছে? আরেক বাবা তো আছেই। আপনি একদম চিন্তা মুক্ত থাকুন। ”

কান্নাকাটির পর্ব শেষ হলে ভোরকে অনেক কষ্টে গাড়িতে উঠালো আবদ্ধ। ভোরকে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পড়লো। ওরা বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করলো। আবদ্ধ ভোরের গা ঘেঁষে বসলো। কান্না করায় চোখ, মুখ, নাক লাল হয়ে আছে। এতেও আবদ্ধর কাছে ভোরকে কি আদুরে লাগছে। মেয়েটা এখনো আগের মতোই আছে। ভোরকে কান্না থামাতে বললো না। সে দেখতে চায় তার প্রাণ প্রেয়সীর কান্না। এতে বক্ষে চিন*চিনে ব্যাথা করলে করুক। সে নাহয় সহ্য করবে একটু। আবদ্ধকে এভাবে নিজের সাথে ঘেঁষে বসতে দেখে কান্না থামিয়ে কপাল কুঁচকে তাকালো। টিস্যু দিয়ে নাক মুছে কন্ঠে রাগ মিশিয়ে বললো,

” একদম আমার গায়ের সাথে লেগে বসবি না৷ দূরে যা বলছি। ”

আবদ্ধ যেনো ভাবলেশহীন ভাবে ভোরের গা ঘেঁষে বসে আছে। ভোরের কথায় পাত্তা না দিয়ে নিজে বলে উঠলো,

” আমি আমার বউয়ের গা ঘেঁষে বসেছি। তাতে তোর সমস্যা হওয়ার কথা না! ”

আবদ্ধর কথায় ভোর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলো,

” দেখ আ__”

” রাতে দেখাস। এখন এমন পরিস্থিতিতে দেখতে চাই না আমি। সামনে ড্রাইভার আছে। ”

চলবে!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে