ইলশেগুঁড়ি পর্ব-০১

0
7333

#ইলশেগুঁড়ি
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_০১

তিথি সিএনজিতে বসেই উঁকি দিলো ।তাঁর চোখের সামনে বিশাল কালো রঙের গেইট। গেইটা এতই বিশাল যে ভিতরের কিছু দেখাতো ভালোই বুঝাও যাচ্ছে না। গেইটের পাশেই বাগান বিলাস গাছ। অর্ধেক গেইট ই গোলাপী ফুলে ঢেকে আছে। তাঁর মধ্যে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। তিথির এতো ভালো লাগলো। সে খুব অল্পতেই মুগ্ধ হয়। এই মুগ্ধতা দেখে, তিথির মা প্রায়ই বলতো “এতো সহজে মুগ্ধ হতে নেই। এই সহজ জিনিসগুলোই পরে বড় কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তিথির অবশ্য তা মনে হয় না। তাঁর মনে হয় এই ছোট ছোট মুগ্ধতা গুলোই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। যখন মানুষের এই মুগ্ধ হওয়ার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। তখন বেঁচে থাকার ইচ্ছাও শেষ হয়ে যায়। তাঁর মায়েরও কি শেষ হয়ে গিয়েছিলো। কি জানি! তিথি জানে না। তবে তাঁর মা কোন কিছুতেই মুগ্ধ হতো না। তিথি কোন কিছু দেখে যখন বলতো, ” দেখ দেখ মা কতো সুন্দর”। তখন তাঁর মা বিরস মুখে বলতো, ” হুম সুন্দর “। এই সুন্দরের মধ্যে না থাকতো মুগ্ধতা, না থাকতো কোন আগ্রহ।

তিথি সিনজি থেকে নেমে দাঁড়ালো। এক এক করে নিজের ব্যাগ দুটো নামালো। ব্যাগ নামাতে গিয়ে সে নেয়ে ঘেমে একাকার । তাঁর তুলনায় তাঁর ব্যাগ অনেকটাই ভারি। তিথি সোজা হয়ে দাঁড়ালো। গেইট টার দিকে আবার তাঁকালো। তাঁর মা তাকে নিয়ে এই বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বেড়িয়ে গিয়েছিলো। আর সে এসেছে দুই দুইটা ব্যাগ নিয়ে। এতো বড় বাড়ি, এতো বড়লোক মানুষ। তবুও তাঁর মাকে চার বছরের সংসার জীবনে নেয়ার মতো কিছুই দিতে পারেনি।

তিথি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ফেলে ব্যাগগুলোকে টেনেটুনে গেইটের সাইডে আনলো। এখন বৃষ্টি ভালোই পড়ছে। ভিজে গেলে সর্বনাশ।
গেইটের সাইড দেওয়ালে একটা সাদা রঙের সুইচ। তিথি কয়েক বার টিপ দিলো। কোন শব্দ হলো কিনা সে বুঝতে পারলো না। তাঁর মিহি গলায় কতোক্ষণ ডাকাডাকি করলো। শেষ মেষ উপায় না পেয়ে ধরাম ধরাম করে গেইটে কয়েকটা বাড়িও মারলো। কোন হেলদোল নেই। তিথি তাঁর মার কাছে শুনেছে। গেইটের পরেই বিশাল লন। তাই তাঁর শব্দ বাড়ি পর্যন্ত যাবে না সে জানে। তবে দাড়োয়ান থাকার কথা। সে শুনছেনা কেন কে জানে। তিথি এক সাইডে দাঁড়ালো। গেইটের উপরে সিসি ক্যামেরা লাগানো । মনিটরে কেও না কেও তাঁকে অবশ্যই দেখবে। সে অপেক্ষা করতে লাগলো।

নোমান অনেক্ষণ ধরেই তিথিকে দেখছে। সে বের হয়েছে তিথি আসার একটু আগে। তাঁর একটা পার্সেল আসার কথা। সে না বের হলেও অবশ্য তাঁর কাছে পৌছে যেতো। তবে পার্সেল টা একটু ব্যাক্তিগত তাই সে নিজেই বের হয়েছে। বের হওয়ার একটু পরেই সিএনজিটা বাড়ির সামনে এসে থেমেছে। সে অবশ্য প্রথমে মাথা ঘামায় নি। দাদুর গ্রামের অনেক আত্মীয় – স্বজনই আছে। তাঁরা হঠাৎ হঠাৎ এসে হাজির হয়। কেও আসে ডাক্তার দেখাতে, কেও আসে ঢাকা শহর ঘুরতে, আবার কেও কেও আসে এমনি এমনি! বলে দাদুকে দেখতে এসেছে । একেকজন কে তো দাদু চিনতেও পারে না। তবুও তারা কিছুদিন মেহমানের মতো থাকে। বিস্ময়ভড়া চোখে তাঁদের ঘর বাড়ি, আসবাবপএ , জীবন যাএা দেখে। আর যাওয়ার সময় কিছু না কিছু তাঁদের পুটলিতে ভরে নিয়ে যায়। এতে অবশ্য কেওর কোন মাথা ব্যাথা নেই। শুধু হালিমা খালা কিছুদিন রাগে গজগজ করেন।

নোমান এবারও এরকমই ভেবেছিলো। তবে তাঁর ভাবনাকে ভুল করে দিয়ে উঁকি দিলো ছোট মোটো মুখের শ্যামলা বরণ একটা মেয়ে।যার মুখে দীর্ঘ জার্নির ক্লান্তির ছাপ, এলোমেলো মাথায় লম্বা বেণী। বয়স কতো হবে কে জানে। তবে তাঁর কাছে ছোটই মনে হলো। যে কিনা উঁকি দিয়েই থমকে গেছে। সাধারণ এক গুচ্ছ ফুল দেখে তাঁর চোখে মুখে মুগ্ধতা উপচে পড়ছে। আর সেই মুগ্ধতা ভরা চোখ,মুখ দেখে নোমান ও কিছুক্ষণের জন্য থমকে গিয়েছিলো।

নোমান আয়েশি ভঙিতে সিগারেটের ধোয়া ছাড়লো। সেই থমকে যাওয়া থেকেই সে এতোক্ষণ এই মেয়ের কান্ডকারখানা দেখছিলো। জামান ভাই ভিতরে কি করছে, কে জানে? বের হওয়ার সময়তো গেইটের পাশেই দেখেছিলো। বাথরুম টাথরুমেও যেতে পারে। তাঁর আবার নতুন নতুন ডায়াবেটিস ধরা পরেছে। সেই টেনশনে দরকার পরুক আর না পরুক সে থাকে দৌঁড়ের উপর । তা না হলে। গেট নিয়ে এই মেয়ে যে ঝাকাঝাকি করেছে। এতোক্ষণে তো জামাল ভাইয়ের লাঠি নিয়ে দৌঁড়ে আসার কথা। মেয়েটার অবশ্য ভাগ্য খারাপ। এসেই পড়েছে এক ঝুলাঝুলির মধ্যে। এরকম সচারচর হয় না। জামান ভাই খুবই নিষ্ঠ দাড়োয়ান। সে তাঁর চাকরি আর এই গেইটকে খুবই ভালোবাসে। এই গেইট নিয়ে কেও ঝাকাঝাকি করবে আর সে চুপচাপ বসে থাকবে এটা অসম্ভব।

নোমান এগিয়ে গেলো। মেয়েটিকে ঝুলাঝুলি থেকে বের করা দরকার। কেমন জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর মায়া লাগছে। এটা অবশ্য নতুন না। তাঁর সবার জন্যই মায়া লাগে। দাদুর ভাস্য মতে আমি হচ্ছি মায়ার সাগর। আমার শুধু মন না! হাত,পা,চোখ,নাক, মুখ সব কিছুই মায়ায় টইটুম্বুর।তাই এই বৃষ্টির মধ্যে তাঁদের বাড়ির সামনে একটা মেয়ে তাঁর পুটলি পাটলি নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে আর সে চুপচাপ তাঁকিয়ে দেখবে ।এটা কি হয়?
তাই সে এগিয়ে গেলো। এগিয়ে যেতে যেতেই তাঁর ভ্রু কুচকে গেলে। মেয়েটার আদল কেমন যেনো চেনা চেনা মনে হচ্ছে । এই চোখ, এই নাক, এই ঠোঁটের পাশে তিল। কোথায় দেখেছে সে?

তিথি ড্রইংরুমে স্বভাবিক ভাবেই বসে আছে।এতোক্ষণ যে মনে ভয় ছিলো তা এখন কেঁটে গেছে। তবে অস্বস্তি আছে। কারণ অনেক গুলো মানুষ গোল গোল চোখে তাঁর দিকে তাঁকিয়ে আছে।
সে পাশে তাঁকালো! তাঁকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি মুছলেন মরিয়ম বানু। যে কিনা সম্পর্কে তাঁর দাদু। আর কেওর পরিচয় অবশ্য এখনো সে জানে না। না জানার ই কথা। তাঁর মা যখন তাঁকে নিয়ে চলে যায়। তখন তাঁর বয়স ছিল চার বছর।

সে আশে পাশে তাঁকালো। তাকাতেই নোমান নামের ছেলেটার সাথে চোখাচোখি হলো। এই ছেলেটা তাঁর কি হয় সে এখনো বুঝতে পরছে না। যখন সে চুপচাপ গেইটের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো।তখন কোথা থেকে যেন এই ছেলে এসে হাজির। এক হাতে ছাতা আরেক হাতে সিগারেট। সে ভ্রু কুচকে তাঁর দিকে তাঁকিয়ে আছে। তিথির ভয়,অস্বস্তি দুটোই এক সাথে হতে লাগলো। সে কি করবে বুঝে উঠে পারলো না। এতো এতো বিপদে সেতো আগে কখনও পড়েনি। সব কিছু থেকে তাঁর মা আড়াল করে রাখতো। এই প্রথমই একা এভাবে চলা। বলতে গেলে সেভাবে একাও অবশ্য না । ঢাকা পর্যন্ত নুরুল কাকা এসেছেন।নুরুল কাকা হচ্ছেন মায়ের দূরস্পর্কের ভাই। আমাদের সব বিপদে আপদে তিনিই তো থাকতেন পাশে। সিনএনজিতেও তুলে দিয়েছেন। শুধু বাড়ি পর্যন্ত আসেন নি। কেন আসেন নি তিথি জানে না। সিনএনজিতে বসে যখন তিথি মলিন ভাবে তাঁকালো । তখন পরমস্নেহে নুরুল কাকা মাথায় হাত রেখে বিরসমুখে বললেন, ” ভয় নেই! সিএনজি তোকে একেবারে ঠিক জায়গাই নিয়ে যাবে। আর সেখানে গিয়ে শুধু তোর আর তোর মায়ের নাম বলবি। ব্যাস আর কিছু বলার বা করার দরকার নেই। এইটুকুই যথেষ্ট। বুঝেছিস?
তিথি শুধু মাথা ঝাকিয়েছে। কি আর বলবে। তাঁর ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। আর হয়েছেও তাই।

প্রথমে তিথি খুব দ্বিধাদ্বন্ধে ভুগেছে । এই ছেলে কি এই বাড়িরই কেও। এর কাছেই কি তাঁদের নাম বলবে। আবার যদি বাইরের কেও হয়। তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এসেছে। হলে হবে! নামই তো! নামতো নিয়ে আর বেঁচে খাবে না। চাঞ্চ নেইয়াই যায়। এমনিতেই চুপচাপ দাঁড়িয়েই আছে। কিছুতো করতেই হবে।তাছাড়া দেখতে তো ভদ্র টাইপই মনে হয়। তাই সে অনেক চিন্তা ভাবনা করে মুখ খুললো, অস্বস্তি ভরা গলায় বললো,”– আমি তিথি! তাইয়্যেবার মেয়ে তিথি।

সাথে সাথেই ছেলেটা অবাক হয়ে গেছে। মুখ হা হয়ে গেছে, হাত থেকে সিগারেটাও পড়ে গেছে।
তিথি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে, ড্যাবড্যাব করে তাঁকিয়ে রইলো। কি বা করবে সে। তবে ছেলেটা যে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছে। সে বুঝতে পারছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলেটা নড়ে উঠলে, কিছু না বলেই ঘুরে হন্তদন্ত হয়ে গেইটে জোড়ে জোড়ে কয়েকটা লাথি মারলো।আর তাঁর সাথে সাথেই গেইট খুলে গেলো। গেইট খুলতেই ছেলেটা এক প্রকার দৌঁড়ে ভিতরে চলে গেলো।
আর আমি হতম্বভ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম । মন মনে মনে বললো,”– কি হলো”?
শুধু আমি না! হতম্বভ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো আরো একজন। সে সম্ভবতো দাঁড়োয়ান। তাঁর হাতে মোটা একটা লাঠি। তাঁকে দেখে আমার প্রথম যে কথাটা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, তা হলো , –“” এই বাসায় কি এভাবেই গেইট খোলার নিয়ম, নাকি আজকে আমাকে দেখে স্পেশাল ট্রিক এপ্লাই করা হয়েছে।

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে