আলো-আঁধার পর্ব-৩৯

0
877

#আলো-আঁধার🖤
#লেখিকা:সালসাবিল সারা

৩৯.
রাণীর রুমের দরজায় ঠকঠক করে কড়া নাড়লো হায়া।তার হাতে একটা খাম লক্ষণীয়।এই মাত্রই তূর্যয়ের ঠিক করা গার্ডের প্রধান এই খামটা তাকে ধরিয়ে দিলো। গার্ডের প্রধান হায়াকে জানালো, এই খামটা তূর্যয়ের ডার্ক হাউজে এসেছিল।কিন্তু তারা সেখানে না থাকায় সেখানকার গার্ড খামটি এইখানে পাঠিয়েছে।গার্ড খাম হাতে পেয়ে তূর্যয়কে ফোন দিলে,তূর্যয় উনাকে বলেছিলো,খাম শুধুমাত্র হায়া বা রাণীর হাতেই দিতে।তাই গার্ডের প্রধান, হায়াকে ডেকে খামটা তার হাতে দিয়েছে।আর সেই খাম নিয়ে রাণীর কাছে এসেছে হায়া।তবে রাণী এখনো দরজা খুলেনি।হায়া তার সরু ভ্রু একটু কুঁচকে নিলো।সে পুনরায় দরজায় খটখট করে কড়া নাড়লো।দরজা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে খামের দিকে তাকাতেই হায়া দেখলো,খামের উপরে তূর্যয়ের নামের পাশাপাশি “ওয়েস্টার্ন হাসপাতালের” নাম লেখা।হায়া মনে মনে ভাবছে,এটা কার রিপোর্ট হতে পারে।পরক্ষণে তার মনে এলো,এটা রাণীর রিপোর্ট হতে পারে।কারণ,
সেই দিন রাণীর জ্বরের মাঝেও ডাক্তার রাণীর রক্তের স্যাম্পল নিয়ে গিয়েছিল।হায়ার মনে অজানা ভয় জেঁকে ধরল। সে মনে মনে প্রার্থনা করছে,
–“এটা যদি রাণী ভাবীর রিপোর্ট হয়,তাহলে যেনো ভালো আসে রিপোর্ট।”
হায়ার চিন্তা বাড়ছে রাণীর দরজা না খোলার জন্যে।হায়া আবারও দরজায় কড়া নাড়লো। এর কয়েক সেকেন্ড পর ভেতর থেকে রাণীর কথা শুনতে পেলো হায়া,
–“কে?”
–“ভাবী আমি,হায়া।”
হায়া নিঃশ্বাস ফেলে উত্তর দিল রাণীকে।রাণীর কণ্ঠ শুনে যেনো হায়া নিজের প্রাণ ফিরে পেয়েছে।রাণী হায়ার জবাব পেয়ে দরজা খুলে দিলো।হায়া রুমের ভেতরে আসতেই, রাণী পুনরায় দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।রাণীর মাথায় তাওয়াল পেঁচানো আর গায়ে অল্প অল্প পানির আভাস দেখে হায়া বুঝলো রাণী বাথরুমে ছিলো এতক্ষণ।হায়া নিজের হাতের খাম রাণীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
–“এই নিন।প্রধান গার্ড দিয়েছে।”
রাণী খাম হাতে নিতে নিতে প্রশ্ন করলো,
–“কি এটা?”
–“কিজানি?বড় স্যারের নাম লেখা।”
রাণী হাসপাতালের নাম দেখে একটু ঘাবড়ে গেলো।খামের উপর তূর্যয়ের নাম সাথে হাসপাতালের নাম দেখা যাচ্ছে।রাণীর মাথা যেনো হঠাৎ ঘুরে উঠলো।রাণী পড়ে যেতে নিলে হায়া রাণীকে ধরে ফেলে দ্রুত।রাণীর অস্থির লাগছে এই খাম দেখে।রাণী মনের ভাবনা,
–“তূর্যয়ের কিছু হলো না তো!”
হায়া রাণীকে বসিয়ে দিলো খাটের উপর।মাথার চুল থেকে ভেজা তাওয়াল সরিয়ে দিয়ে হায়া সেটা ব্যালকনিতে রেখে আসলো।রাণীর গায়ে হালকা ভারী একটা চাদর মুড়িয়ে দিয়ে হায়া রাণীকে বললো,
–“কি হয়েছে ভাবী?”
রাণীর যেনো অস্থিরতা কমলো না।সে বিছানার চাদর খামচে বসে রইলো। কাঁপা গলায় সে হায়াকে অনুরোধ করলো,
–“খামটা তুমি খুলে দেখবে,প্লিজ?”
রুমের ঠান্ডা কমানোর জন্যে হায়া রুমে থাকা হিটার চালু করে রাণীর পাশে বসে তার কাঁধে হাত রেখে আশ্বাস দিয়ে বললো,
–“ভাবী,আপনি এমন করছেন কেন?আচ্ছা আমি দেখছি।”
হায়া রাণী থেকে খাম নিয়ে সেটা খুললো।এখন একটা অন্যরকম রিপোর্ট দেখতে পাচ্ছে হায়া,যেটা এখন ভাঁজ করা অবস্থায় আছে।হায়া রিপোর্ট খুলতেই প্রথমে রোগীর নামে চোখ বুলিয়ে নিলো।রোগীর নামে রাণীর নাম লেখা।হায়া বিস্ময়ের সুরে রাণীকে বললো,
–“আরে ভাবী,এটা তো আপনার রিপোর্ট!এই যে রোগীর নামের স্থানে আপনার নাম লেখা।বড় স্যারকে চিনে বিধায়,খামের উপর উনারই নাম লেখা ছিলো।কিন্তু,রিপোর্ট আপনারই।সেদিন আপনার জ্বর ছিলো,
তখন একজন মহিলা ডাক্তার এসেছিল বলেছিলাম না আপনাকে?উনি অনেক্ষণ আপনার চেকাপ করেছিলেন।আপনি তো অজ্ঞান ছিলেন।আমি প্রথমে রুমে বন্ধী থাকলেও,বড় স্যারের নির্দেশে সারাক্ষণ সেই ডাক্তার আর আপনার সাথেই ছিলাম।সেই পরীক্ষা নিরীক্ষার রিপোর্ট হয়তো এসেছে।”
হায়ার কথায় রাণীর অস্থিরতা কমে লাগলো।তূর্যয় তো তাকে বলেছিল তার রিপোর্ট আসতে পারে।অথচ রাণী ভুলেই বসেছে এই কথাটা।রাণী হায়া থেকে রিপোর্ট নিয়ে পড়তে লাগলো।অর্ধেক পড়েই জানতে পারলো,
এটা তারই প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট।রাণী ঘামতে শুরু করলো।মাঝ বরাবর চোখ যেতেই তার চোখের পলক থেমে গেলো।ইংরিজিতে গোটা অক্ষরে লেখা “পজেটিভ”। রাণীর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।চোখের পলক ফেলতেই রাণীর গাল বেয়ে পানি পড়তে শুরু করলো।হায়া চমকে উঠলো রাণীকে দেখে।রাণীর যেনো কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না তার এই রিপোর্ট দেখে।হায়া রাণী থেকে রিপোর্ট নিয়ে যাচাই করতে লাগলো।অনেকক্ষণ দেখে হায়া অনেক কষ্ট বুঝতে পারলো,এটা রাণীর প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট।হায়া খুশিতে নাচতে শুরু করলো।কিন্তু,রাণীর মন ছেয়ে আছে সংশয়ে।সামনে অনেক বিপদের আন্দাজ করতে পারছে রাণী।তার উপর নিজের সাথে অন্য এক প্রাণ জড়িয়ে আছে, তাহলে বিপদের মাত্রাটা যেনো হাজারগুণ বাড়লো এখন।রাণীর নিজের জন্যে চিন্তা হচ্ছে না।চিন্তা করছিলো শুধু তূর্যয়ের জন্যে।কিন্তু,এখন তার অনাগত সন্তানের কথাটা ভাবতেই রাণীর মনটা সংশয়ে ভরে গেলো।রাণীর খুব কান্না পাচ্ছে।কেমন যেনো একটা কষ্ট অনুভব করছে সে। মা হওয়ার সুখটা পৃথিবীর সব মেয়ের জন্য চরম সুখ। রাণীর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম না। কিন্তু,তার মনে একটাই সংশয় ঘুরছে,এই বাচ্চাকে সে দুনিয়ার আলো দেখাতে পারবে কিনা!কারণ,সামনে তাদের জন্যে সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটা অপেক্ষা করছে।শান্তি মহলে এসেছে তারা চারদিন হলো।এখনো কিছুর খবর জোগাড় করতে পারল না সে।রাণী জানেনা,এখন তাদের শেষটা কেমন হবে।তূর্যয় রাণীর এই অবস্থার কথা জানলে এক মুহূর্তও এই বাড়িতে রাখবে না।এমনটা হলে সত্যের কাছাকাছি যেতে অনেক দেরী হয়ে যাবে।বারংবার,রাণীর আর এই আলো আঁধারের খেলা ভালো লাগছে না।তাই সে মনে মনে অন্য পরিকল্পনা করছে।পেটের উপর হাত রাখতেই রাণী নিচের ঠোঁট চেপে চোখ বন্ধ করলো।মুহূর্তেই মনে হলো,তার দুনিয়াটা একেবারে আঁধার।অজানা চাপা দুঃখে রাণীর সকল কষ্ট চোখের পানি হয়ে রাণীর গালে উপচে পড়ছে। এমতাবস্থায় হায়া তব্দা বনে গেল। সে দ্রুত রাণীর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো,
–“ভাবী?কি হয়েছে আপনার? আমাদের ঘরে ছোট্ট একটা বাবু আসতে চলেছে,আর আপনি কান্না করছেন?”
রাণী দুইহাতে নিজের চোখ মুছলো।কিন্তু আবারও চোখের অবাধ্য পানি এসে তার গাল জোড়াকে ভিজিয়ে দিচ্ছে।রাণী চোখ বুঁজে হায়াকে বলে উঠলো,
–“তোমার বড় স্যারকে এই খবরটা জানাবে না।আমিও জানাবো না,যতদিন না এইখানের ঝামেলা মিটছে।আমি আজ থেকে ওদের সাথে একেবারে চিপকে থাকবো।যেনো দ্রুত এইখানের রহস্য উদঘাটন করে, চলে যেতে পারি এইখান থেকে।”
রাণীর কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিলো হায়া।রাণীর এমন কথা হায়ার পছন্দ হয়নি।সে গোমড়া মুখে রাণীকে জবাব দিলো,
–“নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছেন,ভাবী। বড় স্যার পরে জানলে কিন্তু লংকা কান্ড বাঁধিয়ে দিবে।তখন আর শেষ রক্ষে হবে না আপনার।”
রাণীর মাথায় এইসব কথা অনেক আগেই এসেছে।তূর্যয়ের রাগ,অভ্যাস সবই তো রাণীর অজানা নয়।তাও,রাণী নিজের মনের ফন্দিতে অটল।সে হায়াকে জবাব দিলো,
–“কিছু হবে না,হায়া।বাবুর কথা উনি জানলে আমাকে এইখানে এক মুহূর্ত থাকতে দিবেন না।আর আমি এইখানের রহস্য উন্মোচন না করে কোথাও যাচ্ছি না।”
–“আচ্ছা।আমি আপনার সাথে আছি।তবে,এর আগে একটা কাজ করতে হবে আপনার।”
রাণী আহত চোখে হায়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
–“কি?”
হায়া রাণীর মোবাইল তাকে ধরিয়ে দিয়ে রাণীকে হাসিমুখে বলল,
–“বড় স্যারকে তিনবার ফোন দিবেন আপনি।যদি একবারও না ধরে উনি,তাহলে বাবুর কথা এখন জানানোর দরকার নেই উনাকে।আর যদি ধরে, তাহলে আপনি এখনই বাবুর কথা জানিয়ে দিবেন উনাকে।”
রাণীর কাছে হায়ার এই চ্যালেঞ্জটা অদ্ভুত রকম ভালো লাগলো।রাণী ম্লান হয়ে মোবাইল হাতে নিলো।

অনেকবার তূর্যয়কে ফোন দিয়েও লাভ হয়নি।কারণ,
তূর্যয় ফোন তুলছে না।মনের চিন্তা দূর করতে সে হ্যারিকেও ফোন দিয়েছে।হ্যারি নিজেও ফোন ধরছে না। এতে রাণী বুঝে গেলো তূর্যয় আর হ্যারি দুইজনই নিজেদের কাজে ব্যস্ত।তূর্যয় সর্বদা বাসা থেকে বের হওয়ার পূর্বে রাণীকে বলে যায়,হ্যারি বা তাকে ফোনে না পেলে সে যেনো ইকরামকে ফোন দেয়। এতে রাণীর সব খবর সে জেনে যাবে।কিন্তু আজ ইকরামের কাছে ফোন দিয়ে কাজ নেই রাণীর।তাই মোবাইল রেখে রাণী হায়ার দিকে তাকালো।হায়ার চ্যালেঞ্জটা কাজে দেয়নি।হায়া রাণীর পাশে বসে রাণীর মাথায় হাত রাখলো।রাণী হায়ার কাঁধে মাথা রেখে অশ্রু বিসর্জন করছে।রাণীর প্রেগন্যান্সির খবরটা গোপন রাখাটাই তাদের এখন মুখ্য কাজ।

চারদিকে প্রচুর শব্দ ভেসে আসছে।গোলাগুলির শব্দ সাথে মানুষের আর্তনাদের শব্দ,সবকিছু মিলে একটা চাঞ্চল্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।এরমধ্যে তূর্যয় তীক্ষ্ণ চোখজোড়া দিয়ে চারদিক পরখ করছে।তার এক হাতে পিস্তল ধরানো,অন্য হাতে হ্যারির কোমর আঁকড়ে ধরেছে সে।হ্যারির হাতে আঘাত পেয়েছে।কিছুক্ষণ পূর্বের লড়াইয়ে হ্যারির বাম হাত গুলিবিদ্ধ হয়েছে।হ্যারি আর তূর্যয় দুইজন নিজেদের গার্ড থেকে আলাদা হয়ে এইদিকে এগিয়ে এসেছে।তারা প্রধান শত্রুকে মারতে সক্ষম হলেও,আচমকা একটা বুলেট এসে আঘাত হানলো হ্যারির ডান হাতের বাহুতে।হ্যারি ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠছে বারবার।তূর্যয়ের দলের লোকেরা বিপক্ষ দলের সবাইকে বিনাশ করছে।তারই শব্দে মুখর হয়ে আছে এখানকার পরিবেশ।তূর্যয় আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতে নিজেদের গাড়ি দেখতে পেলো।হ্যারির চোখমুখ লাল হয়ে আছে।গাড়ির কাছে পৌঁছালে হ্যারিকে গাড়িতে বসিয়ে দিলো তূর্যয়।তার উদ্দেশ্য,
হ্যারির হাত থেকে বুলেট বের করা।তূর্যয় আর হ্যারি গাড়িতে উঠতেই গাড়ি চলতে আরম্ভ করলো।তূর্যয় নিজের গায়ের কোট খুলে শার্টের হাতা বটে নিচ্ছে।হ্যারি সিটে হেলান দিয়ে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে।তূর্যয়কে ফার্স্ট এইড বক্স হাতে নিতে দেখে হ্যারি জোরে শ্বাস টেনে তূর্যয়কে বললো,
–“বুলেট বের করবে?”
তূর্যয় ফার্স্ট এইড বক্স থেকে সরঞ্জাম বের করে থমথমে গলায় বললো,
–“হুঁ।”
–“আহ,ওকে।”
হ্যারি চোখ বন্ধ করলো।তূর্যয় হ্যারির কষ্টটা বুঝতে পারছে।এমন অনেক বুলেটের আঘাতের শিকার হয়েছে তূর্যয়।তবে হ্যারির মুখে এক প্রকার ভয় দেখতে পাচ্ছে সে।তাই হ্যারির শার্টের হাতাতে কাঁচি চালাতে চালাতে হ্যারিকে তূর্যয় প্রশ্ন করলো,
–“বয়স তো কম হয়নি,বিয়ে করছো না কেনো?তোমার বোন তো তোমার বিয়েতে অংশগ্রহণ করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে।”
হ্যারি চাপা হাসলো। সে এক চোখ খুলে উত্তর দিলো,
–“ব্রাইড কই?আমি সিঙ্গেল আছি। সিসকে বলো,
আমার জন্যে ব্রাইড খুঁজতে।”
তূর্যয় নিজের কাজ করতে করতে হ্যারিকে আবারও বললো,
–“কেনো,তোমার বোনের বান্ধুবী কই গেলো?তার সাথে না তোমার সম্পর্ক ছিলো?”
কথাটা বলে তূর্যয় আবারও নিজের কাজ করে যাচ্ছে।ব্যাথায় হ্যারি গাড়ির সিট শক্ত করে ধরে আছে। ফুঁস করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে হ্যারি তূর্যয়কে জবাব দিলো,
–“শি ইজ নো মোর।”
তূর্যয় ঠোঁট বাঁকা করলো।চরম হাসি পেয়েছে তার।এক পর্যায়ে তূর্যয় হেসে উঠলো শব্দ করে।হ্যারি এক চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো তূর্যয় হাসছে।তূর্যয়কে হাসতে হ্যারি খুবই কম দেখেছে।কিন্তু,যতবারই দেখেছে সে তূর্যয়কে হাসতে;ততোবারই হ্যারির মনটা খুশিতে ভরে উঠে।কারণ,তূর্যয়ের অতীত জীবনটাই যে ছিলো অনেক কষ্টের।যার দরুণ তূর্যয় হাসতেই ভুলে গিয়েছিলো।তূর্যয়ের হাসিটা যেনো হ্যারিকে খুব ভালো বোধ করায়।হ্যারি ভাবে,তার মতো এমন একটা অপরিচিত মানুষকে তূর্যয়ের মতো কয়জনই বা নিজের আপনের মতো করে যত্ন করে!হ্যারি এটাও জানে,রাণী তূর্যয়ের জীবনে আসার পর থেকেই তূর্যয়ের জীবনটা স্বাভাবিক হয়েছে।হ্যারি মাঝে মাঝে বেশ কষ্ট লাগতো,
তূর্যয় পরিবারহীন থাকায়।কিন্তু,এখন তূর্যয়ের দিকে তাকালেই হ্যারির মনটা ভরে উঠে প্রশান্তিতে।কেমন যেনো অন্যরকম একটা প্রশান্তি দেখতে পায় সে এখন তূর্যয়ের মুখে।আর এইসব কিছুর জন্যে সে রাণীকে ধন্যবাদ জানায়।হ্যারি নিজ মনে নানান কিছু ভেবে যাচ্ছে।হ্যারিকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তূর্যয় হ্যারিকে হেসে জবাব দিলো,
–“এমনভাবে তো তোমার সিসও আমার দিকে তাকিয়ে থাকে না।আর রাণীর বান্ধবী তো এখনো বেঁচে আছে,
তাহলে কি প্রেম শেষ তোমাদের?”
হ্যারি ব্যাথায় ছটফট করে বলে উঠলো,
–“ইয়াহ। শি ইজ ডেড ফর মি।মম বলেছে,এইবার হোমল্যান্ডে ফিরলে তার ফ্রেন্ডের মেয়ের সাথে আমাকে মিট করিয়ে দিবে।আমার জন্যে বিদেশিনী বেস্ট হবে। সো,বাংলাদেশী গার্ল আর সার্চ করছি না।অ্যান্ড ব্রো, ইউ আর এ ব্লেসিং ফর মি।তোমার মতো ব্রো কয়জনই বা পা…..য়!”
তূর্যয় আবারও হাসলো।বুলেট বের করেছে সে হ্যারির হাত থেকে।তাই শেষে হ্যারি এইভাবে চিল্লিয়ে উঠলো।তূর্যয় হ্যারির হাতে ব্যান্ডেজ করে দিলো বাকি কাজ শেষ করে।তূর্যয় হ্যারির কাঁধে হাত রেখে তাকে জবাব দিলো,
–“আমিও অনেক খুশি,তোমার মতো ভাই পেয়ে।”
হ্যারি তূর্যয়কে জড়িয়ে ধরতে নিলে তূর্যয় ভ্রু কুঁচকে নিলো।হাত দেখিয়ে সে হ্যারিকে বললো,
–“কি করছো? এখন জড়িয়ে ধরবে,একটু পর চুমু দিবে? ছি,হ্যারি!এইসব কাজ আমি শুধু তোমার বোনের সাথেই করি।”
হ্যারি জোর করে এক হাত জড়িয়ে ধরে তূর্যয়কে বলে উঠলো,
–“আই লাভ ইউ,ব্রো।অ্যান্ড এটা আমার ব্রো লাভ।অন্য লাভ না।”
তূর্যয় হ্যারির চুলে হাত নাড়িয়ে বললো,
–“জানি আমি।পরবর্তীতে খেয়াল রাখবে নিজের।এখন শান্তি মহলে যাবে আমার সাথে। হাত ঠিক না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই থাকবে।”
হ্যারি মাথা নাড়ালো,
–“নেভার। আই হেইট সাবিনা।বমি আসে আমার তাকে দেখলে।অ্যাপার্টমেন্টে কোনো নার্স রেখে দিবো,সে আমার টেইক কেয়ার করবে।”
তূর্যয় পকেট থেকে সিগারেট বের করে লাইটার জ্বালিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে সিগারেট নিজের ঠোঁটের মাঝে রেখে বললো,
–“তোমার সিস শুনলে দৌড় দিবে তোমাকে দেখার জন্যে।এমনিও তোমার বোনের শরীর ভালো যাচ্ছে না।আজকে রিপোর্ট এসেছে।সেটা দেখতে হবে।তাই,
সেখানেই চলো।”
হ্যারি আর কিছু বললো না।তূর্যয় নিজের মোবাইল বের করতেই দেখলো রাণীর কয়েকটা কল।সাথে সাথে তূর্যয় ফোন ব্যাক করলে রাণীকে,রাণী সঠিক কথাটি জানায়নি তাকে। রাণীর ব্যাপারটা তূর্যয় বুঝলো না।অতঃপর রাণীকে সে বাড়িতে আসছে বলে জানিয়ে, ফোন কেটে দিলো।

দূর থেকে আহমেদ চাদরে মুড়ানো রাণীকে দেখছে।আহমেদ এমন আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে,তাকে কেউ টাহর করতে পারে না।রাণীর লাল হয়ে থাকা চোখটা আহমেদের মনকে অশান্ত করে দিয়েছে।আশ্চর্য হলেও,রাণীকে দেখার পর, সেদিন থেকে আহমেদ একদিনও নেশা করেনি।তবে তার ঘরে মেয়ে ঠিকই এনেছে সে।রাণীর জন্যে জমানো চাওয়াটা অন্য মেয়ের মাঝেই খুঁজে বেড়িয়েছে সে।কিন্তু পরম সুখটা পায়নি সে।আহমেদের মনে অগাধ বিশ্বাস,সেই সুখ শুধুমাত্র রাণীর কাছেই পাবে।রাণীর মাথার উপর থেকে চাদরটা সরতেই আহমেদের ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠলো।আহমেদ আরেকটু সামনে গিয়ে তাকে দেখতে চাইলে,সেটা আর হয়ে উঠলো না হায়ার জন্যে।হায়া রাণীর সামনে দাঁড়িয়ে রইলো।রাগে গজগজ করতে করতে আহমেদ নিজের ঘরে এসে একজনকে ফোন লাগালো,
–“খুন করা লাগবে।”
–“কারে?”
অপর পাশের ব্যাক্তিটি।
–“তাশরীফ তূর্যয়কে।টাকা দিয়ে ভরিয়ে দিবো তোকে।”
–“বাবারে বাবা,মইরা যামু।লাগবো না আপনার টাকা।বড় স্যাররে মারার ক্ষমতা আমার নাই,আর না আছে কারো।রাইখা দেন ফোন।”
কথাটা বলে ব্যাক্তিটি নিজেই ফোন রেখে দিলো।আহমেদ জোরে নিচে ফেলে দিলো নিজের মোবাইল,
–“সমস্যা নেই। আমিই মারবো তোকে নিজ হাতে,তূর্যয়।এরপর সেই মোলায়েম দেহের অধিকারী রাণীকে আমার রাজ্যের রাণী করবো!”
আহমেদ বিশ্রীভাবে হাসতে লাগলো।সাবিনা আহমদের রুমে আসতে গিয়েও আহমেদের এইসব কথা শুনতে পেয়ে থেমে গেলো।রাণী আর তূর্যয়কে একসাথে মারতে হবে এটা ভাবতেই সাবিনার মন নেচে উঠলো।কিন্তু পরক্ষণে কিছু একটা ভেবে সে সিমিকে ফোন লাগালো।সাবিনার কাছে এখন আহমেদের চেয়ে সিমির পরিকল্পনা বেশি সুবিধার মনে হচ্ছে।কারণ,আহমেদের মন এখন রাণীর কাছে, নিজের কাছে নেই।
.
হ্যারিকে শান্তি মহলে নিয়ে আসা হয়েছে।রাণী অস্থির হয়ে আছে হ্যারির জন্যে।তূর্যয় কোথাও ব্যাথা পেয়েছে কিনা এই নিয়েই চিন্তার শেষ নেই রাণীর।তূর্যয়ের দিকে শান্ত চোখে তাকাতেই রাণীর মনটা নড়ে উঠলো।তূর্যয়ের অর্ধাংশই তো রাণীর কাছে বিদ্যমান এখন।অথচ রাণী নিরুপায়।চেয়েও সে তূর্যয়ের কাছে তাদের জীবনের সবচেয়ে খুশির সংবাদটা জানাতে পারছে না।তূর্যয়ের চোখে চোখ পড়তেই রাণী চোখ নামিয়ে নিলো।ব্যাপারটা তূর্যয়ের বেশ বিরক্ত লেগেছে।হ্যারি চোখ বুঁজে শুয়ে আছে।তাকে ঘুমন্ত মনে হচ্ছে।হায়া,রাণী আর তূর্যয়কে একা রেখে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে,তূর্যয় হায়াকে বলে উঠলো,
–“ডাক্তার আসলে,তাকে এই ঘরে নিয়ে আসবে।আবার নিচে ছেড়ে আসবে।”
হায়া মাথা নাড়িয়ে তূর্যয়কে জবাব দিলো,
–“জ্বী,বড় স্যার।”
হায়া রুমটা প্রস্থান করলো। রাণী তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে নিলে তূর্যয় রাণীর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো।রাণী তাল মিলিয়ে হাঁটতে চেষ্টা করছে তূর্যয়ের সাথে।রাণী নিজের পেটে হাত রেখে তূর্যয়কে বললো,
–“আস্তে হাঁটুন না।”
তূর্যয় থেমে গেলো।রাণীর দিকে এক নজর তাকিয়ে তূর্যয় রাণীকে কোলে তুলে নিলো।রাণী কিছু বলতে চেয়েও পারছে না বলতে।গলা ধরে আসছে রাণীর।বুকটাও কাঁপছে।রাণীর ভেতরে যে তূর্যয়ের অংশবিশেষ আছে,এটা রাণীর চিল্লিয়ে বলতে ইচ্ছা করছে তূর্যয়কে।রুমে এসে রাণীকে বিছানায় বসিয়ে দিলো তূর্যয়।রাণীর কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে রাণীকে সে জানালো,
–“আসছি আমি।এরপর মন ভরে দেখবো তোকে।তোর রিপোর্টটাও দেখে নিবো।”
কথাটা বলে তূর্যয় কাঁধের উপর থাকা ঝুলন্ত কোট ঠিক স্থানে রেখে শার্টের বোতামে হাত চালিয়ে শার্ট খুলে নিলো। রাণীর দিকে ভালোবাসার নজরে তাকিয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়ালো তূর্যয়।
রাণী বিধ্বস্ত হয়ে আছে। থম মেরে বসে সে আলমারির দিকে তাকালো।এইখানেই তো রাণী তার রিপোর্ট লুকিয়ে রেখেছে।রাণীর মাথায় নানান চিন্তা ঘুরঘুর করছে।সে ভাবছে,
–“অতি দ্রুত এমন একটা কান্ড বাঁধাবে আমি সাবিনা ভুটকি আর চিকনা হাসানের মাঝে;যেনো তারা উত্তেজনায় নিজের জোশে এসে হুঁশ হারিয়ে ফেলে আর সত্যিটা বলে দেয়।মাথায় তো অনেক চিন্তায় আসছে।একটা পরিকল্পনা আমার অটল করতে হবেই।”
এরপর রাণী নিজের পেটের উপর রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে আবারও বলতে লাগলো,
–“এরপর আমাদের ছোট্ট বাবুর কথা তার বাবাকে জানিয়ে দিবো।আচ্ছা তোমার বাবা তোমার কথা শুনলে কিভাবে অভিব্যক্তি দিবে?সে কি আমাকে এই খুশির খবর না দেওয়ার জন্যে বকবে নাকি খুশিতে আত্নহারা হয়ে আমদের দুইজনকেই তার সাথে মিশিয়ে নিবে?কিজানি কি করবেন!উনি তো দানব সন্ত্রাসী,
আল্লাহ্ জানেন উনি কি করবেন তোমার কথা শুনে।”
–“কার কথা শুনবো?”
তূর্যয়ের এমন কথায় রাণী চমকে উঠলো।ম্লান হাসার চেষ্টা করলো সে।তূর্যয় তাওয়াল রেখে হেলেদুলে হেঁটে রাণীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।রাণীর মুখমণ্ডলে এক আঙ্গুল দিয়ে বিচরণ করে তূর্যয় রাণীকে আবারও প্রশ্ন করলো,
–“মন খারাপ?কান্না করেছো?রিপোর্ট কোথায়? জান!”
রাণী মাথা নিচু করে তূর্যয়ের কপালে নিজের অধর জোড়া স্পর্শ করে আবারও সোজা হয়ে বসলো।রাণী আমতা আমতা করে বললে লাগলো,
–“স..সব ঠিক আছে।আমি কেনো কান্না করবো!ঘুম ছিলাম।আর রিপোর্ট একদম ঠিক আছে।নাহলে ডাক্তার আপনাকে নিজেই ফোন করতো।”
রাণীর কথায় তূর্যয় রাণীর হাত জোড়া নিয়ে নিজের বুকের উপর রাখলো,
–“ঠিকই তো।আমিও না বেশি দুশ্চিন্তা করছি তোমায় নিয়ে।সেদিনের জ্বরের পর থেকেই কেমন দূর্বল হয়ে আছো তুমি।আবার এই বাড়ি থেকেও নড়ছো না।”
রাণী বুঝছে,আর বেশিক্ষণ তূর্যয় রাণীর শরীর খারাপের কথায় প্যাঁচালে তাকে, সে নিজেই গড়গড় করে সত্যিটা বলে দিবে।তাই রাণী কথা ঘুরানোর জন্যে তূর্যয়কে বলে উঠলো,
–“আমি ঠিক আছি।আপনি নিজের চিন্তা করুন।ভিনদেশী ভাই হাতে ব্যাথা পেয়েছে।আপনার কিছু হয়নি তো?দেখি সোজা হয়ে বসুন আমার সামনে।আমি আপনাকে দেখবো।কি এক সন্ত্রাসীর পাল্লায় পড়েছি।এইসব মারামারি,কাটাকাটি আর কতো দেখবো?এই সন্ত্রাসী উঠে বসুন না।”
তূর্যয় উঠে বসলো।রাণীর সামনাসামনি বসে রাণীর ঘাড়ে দুইহাত পেঁচিয়ে নিয়ে সে মৃদু হেসে রাণীকে জবাব দিলো,
–“সারাজীবন দেখতে হবে।তোর সন্ত্রাসীর কাজই এটা।এই কাজের জন্যেই তোর সন্ত্রাসীকে সবাই ভয় পায়,সবাই এতো কদর করে তোর সন্ত্রাসীর।”
রাণী মুখ ভেংচি দিলো তূর্যয়কে। তা দেখে তূর্যয় রাণীর গাল চেপে ধরে তার সারা মুখশ্রীতে ঘন ঘন চুমু দিয়ে তাকে বলে উঠলো,
–“আবার ভেংচি কাট।”
রাণী মাথা নাড়লো “না” বলে।তূর্যয় রাণীর মাথা নাড়ানো দেখে নিজের মাথার চুল ঠিক করে রাণীকে বললো,
–“নাহ?”
–“হ্যাঁ।”
–“নাহ?”
তূর্যয়ের আবারও প্রশ্ন।রাণী এইবার বিরক্ত নিয়ে বললো,
–“স্প্যানিশ ভাষায় বলতে হবে?”
তূর্যয় এক টানে রাণীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তার দুইপাশে হাতে ভর দিয়ে তাকে বলে উঠলো,
–“আমার মুখের উপর কথা!সাহস তো দেখছি দিনদিন বাড়ছে।”
রাণী শুকনো ঢেঁকুর গিললো,
–“হ্যাঁ,বেড়েছে তো?কি করবেন…”
রাণী আর কিছু বলার পূর্বেই তূর্যয় রাণীর ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে বললো,
–“কি করবো?আচ্ছা,দেখাচ্ছি এখন।তূর্যয় কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী।”
কথাটা বলতে দেরী কিন্তু তূর্যয়ের রাণীর গলার ভাঁজে অধর জোড়া স্পর্শ করতে দেরী করেনি।

তূর্যয় ঘুমিয়ে আছে।বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে তূর্যয়ের মুখটা।এই অবেলায় সচরাচর তূর্যয় ঘুমায় না।
রাণীর “না” বলাতে সে রাণীকে কিছুই বলেনি।উল্টো তাকে পেঁচিয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো।রাণী তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে তার চুলে হাত বুলিয়ে ভাবতে লাগলো,
–“সরি,তূর্যয়।আমার আর আপনার বাবুর এখন একটু সময় লাগবে।খুব দ্রুতই আমি বাবুর এই সুখবর আপনাকে দিয়ে দিবো।কিন্তু,আমার ভয় করছে প্রচুর। এই সুখবর কি আদৌ আমি আপনাকে জানাতে পারবো?নাকি এই পার্থিব জীবনে আমাদের সুখের দিনগুলো আসার আগেই শেষ হয়ে যাবে?”
রাণী চোখ ভিজে এলো।অজানা আতঙ্কে রাণীর মনটা খাঁ খাঁ করছে।রাণীর আরেকটু এগিয়ে গিয়ে তূর্যয়ের বুকের গভীরতায় মিশে গেলো।রাণীর শরীরের উষ্ণতা পেয়ে তূর্যয় আষ্টেপিষ্টে আঁকড়ে ধরলো রাণীকে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে