আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ ২ পর্ব-২৩+২৪

0
235

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব২৩( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripti

শেষ সন্ধ্যায় ছাঁদে দাঁড়িয়ে রাস্তায় জ্বলতে থাকা কৃত্রিম আলোর ল্যাম্পপোস্ট দেখ চলছে চিত্রা। কানে রয়েছে মুঠোফোন। ফোনের ওপাশ থেকে পরপর দুটো জোরে নিশ্বাস ফেলার শব্দ শোনা গেলো। এতে একটুও বিচলিত হলো না চিত্রা। সে আগের ন্যায় ঐ ল্যাম্পপোস্ট টা দেখেই চললো। হঠাৎ আকাশে অসময়ে মেঘের ডাক শুনতেই চিত্রা দৃষ্টি সরায়। আশেপাশে তাকিয়ে আকাশ পানে তাকায়। আস্তে আস্তে চারপাশ থেকে বাতাস বইতে শুরু করলো। খুব গর্জে বৃষ্টি নামার সংকেত দিচ্ছে।
-“ ফোন কেটে দিব?
তুষার মুহুর্তে কথার পিঠে কথা বলতে পারলো না। সময় নিলো,কিয়ৎ ক্ষন চুপ থেকে বলল-
-“ ফোন কেটে দেওয়ার জন্য ফোন দিয়েছি?
-“ তাহলে কি কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছেন?
-“ হুমম।
-“ তাহলে কথা কোথায় মুখে? মৌনব্রত পালন করার ইচ্ছে হলে ফোন কেটে মৌনব্রত পালন করুন।
-“ কাল রেডি হয়ে থাকবেন আমি আসবো নিতে।
-“ কোথায় নিয়ে যাবেন?
-“ বিয়ের কেনাকাটা করতে। ভুলে গেছেন নাকি সামনে যে বিয়ে?
-“ ভুলতে দিলেন কই? সেই তো মনে করিয়েই দিলেন।
-“ রেগে আছেন মনে হচ্ছে?
-“ এতক্ষণ লাগলো এটা বুঝতে?
-“ না আগেই বুঝেছি সেজন্য নিশ্চুপ ছিলাম। হয়েছে টা কি, রেগে আছেন কেনো?

চিত্রা তপ্ত শ্বাস ফেললো। অভিযোগ সুরে বলল-
-“ সারাদিন ফোন দেন নি কেনো? ফোন কোথায় থাকে? ফোনের যথাযথ ব্যাবহার করতে জানেন না নাকি সময় হয় না আমাকে একটা ফোন দেওয়া কোনটা?

তুষার আগের ন্যায় থেকে জবাব দিলো-
-“ কথা বলার জন্য এই সময়টাই উপযুক্ত সেজন্য অন্য সময় ফোন দেওয়ার খুব একটা প্রয়োজন বোধ করছিলাম না। আকাশে তাকান দেখুন আকাশের রং পরিবর্তন হচ্ছে। কালো মেঘ গুলো জমাট বাঁধছে। চাঁদ টাও আড়াল হয়ে যাচ্ছে সেই মেঘে। আর দমকা ঠান্ডা হাওয়া গুলো শরীর কে মাতোয়ারা করে তুলছে সেই সাথে অনুভূতি গুলো কে সজাগ। বুঝলেন কিছু?

চিত্রা গায়ের ওড়না টা ভালো করে শরীরে জড়িয়ে বলে-
-“ হ্যাঁ বুঝলাম,মুশলধারায় বৃষ্টি নামবে হয়তো, এই বাতাস আমার সর্বাঙ্গ দেহে একমাত্র শীতের অনুভূতি কে মাতোয়ারা করছে খুব শীত লাগছে।
-“ রোমান্টিক পরিবেশ আর মুড টার এভাবে ১২ টা বাজাচ্ছেন কেনো।
-“ আপনি কোথায় এখন?
-“ বেলকনিতে।
-“ রুমে যান,কম্বলের তলে গিয়ে ঘুম দিন। আমারও ঘুম পাচ্ছে।
-“ আচ্ছা ঘুমান তাহলে।

কথাটা বলেই তুষার ফোন কে’টে দেয়। চিত্রা ভ্রু কুঁচকালো। ফোন টা মুখের সামনে এনে তাকিয়ে রইলো। বুঝতে পারলো না তুষার রেগে ফোন কাটলো নাকি স্বাভাবিক হয়েই।

-“ হবু স্বামীর সাথে কথা বলা শেষ?
চিত্রা ছাঁদ থেকে চলে যাওয়ার জন্য পেছন ঘুরতেই রিয়াদ কথাটা বলে উঠে। রিয়াদ তার মানে চুপিচুপি ছাঁদে এসো চিত্রার কথাগুলো শুনছিলো। অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে রিয়াদের পানে চেয়ে কিছু না বলে হনহন করে ছাঁদ থেকে নেমে চলে যায়। রিয়াদ চিত্রার যাওয়ার পানে তাকিয়ে হো হো করে হেঁসে উঠে।

চয়নিকা বেগম আর সিমি মিলে রান্না ঘরে রান্না করছে। চিত্রা বসার ঘরে ঢুকে সোফায় বসে। চোখ বন্ধ করতেই বুঝতে পারে সে একা নেই বসার ঘরে। তার আশেপাশে কেউ বসেছে। ফট করে চোখ মেলে তাকায়। রিয়াদ কে দেখে এবার রাগ সপ্ত আকাশে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে-
-“ আমি যেখানে থাকছি আপনিও সেখানে সেখানেই থাকছেন কেনো?
-“ আমার অস্তিত্ব জানাতে।
রিয়াদের গা-ছাড়া কথা শুনে চিত্রা নিজের রাগ কন্ট্রোল করে। এর সাথে রেগে কথা মানে একে জিতিয়ে দেওয়া যা চিত্রা করবে না। শান্ত করলো নিজেকে।
-“ শুনেছিলাম কুত্তার লেজ কখনও সোজা হয় না। ওমা আজ দেখি মানুষ সেই লেজা বেকা হওয়া কুত্তার মতো। হাউ ইন্টারেস্টিং!

মুহুর্তে রিয়াদের মুখের ভঙ্গিমা পাল্টে যায়।
-“ হোয়াট ডু ইউ মিন?
-“ নাথিং ব্রো,জাস্ট চিলল করুন আজকের রাত টা। বোনের বিয়ে খেতে এসেছেন,সারাদিন শুয়ে বসে এর ওর পেছন ঘুরাঘুরি বন্ধ করে কাল থেকে আমার বিয়ের যাবতীয় কাজ আছে সব হাতে হাতে সাহায্য করবেন।
-“ কেনো কাজের লোকের অভাব পড়েছে নাকি চেয়ারম্যান বাড়িতে?
-“ না তবে বেকার মানুষের আনাগোনা কি করে যেনো চেয়ারম্যান বাড়িতে বেড়ে যাচ্ছে।

চিত্রা চিন্তিত ভঙ্গিমায় কথাটা বলে। রিয়াদ বেশ বুঝলো কথাটা তাকেই মিন করা। তাই কথার প্রসঙ্গ টা বদলাতে হাক ছেড়ে সিমি কে ডেকে কফি চাইলো। চিত্রা সেটা দেখে হাসতে হাসতে রুমে চলে আসলো।

ছাঁদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হেঁসে হেঁসে ফোনে কথা বলছে তৃষ্ণা। ফোনের ওপাশে আছে তুর্য। আর ছাঁদে উল্টোপাশে কান খাঁড়া করে ফোন স্ক্রোল করছে রাফি। নামের ফোন টিপছে তার সব মস্তিষ্ক রয়েছে তৃষ্ণার পেছনে। তৃষ্ণা হাসি অসহ্য লাগছে রাফির কাছে। কিছু বলতে গেলেই শুধু বলে বসে “ আপনার সমস্যা কি? আমি যা ইচ্ছে তাই করবো।” অতঃপর রাফিকে চুপ থাকতে হয়। বলতেও পারছে না তার খারাপ লাগছে। এভাবে আর কতদিন চলবে কে জানে?
তৃষ্ণা কথা বলার পরপর আড়চোখে বারবার রাফিকে দেখছে। এই সুযোগ টা সে কোনো মতেই হাত ছাড়া করবে না। সুযোগের ব্যাবহার টা সে এবার ভালো করেই করে ছাড়বে। তুর্য ছেলেটা ভালোই। মজার ভিষণ যার জন্য কাজ খুব সহজেই হয়ে যাবে।

-“ তৃষ্ণা কাল ফ্রী আছো?
তৃষ্ণা রাফির থেকে দৃষ্টি সরায়। রাফিকে শুনিয়ে শুনিয়ে কিছুটা জোরে বলে-
-“ হ্যাঁ ফ্রী আছি কাল। কিন্তু কেনো?
ওপাশ থেকে কি বললো রাফি শুনতে পারলো না। তৃষ্ণা বলে উঠে-
-“ হ্যাঁ যাওয়াই যায়।
রাফি বুঝে গেলো তারা কোথাও যাওয়ার প্ল্যান করছে। মেজাজ বিগড়ে গেলো। তুর্য ছেলে টাকে শাসিয়ে আসতে হবে তৃষ্ণার থেকে যেনো দূরে থাকে। সে নিজেই এখনও তৃষ্ণা কে নিয়ে বাহিরে যায় নি সেখানে তুর্য এই সাহস দেখাচ্ছে। তৃষ্ণা আরো টুকটাক কথা বললো তুর্যর সাথে। দাঁতে দাঁত চেপে সেসব কথা রাফি সহ্য করলো। হঠাৎ আবহাওয়া পরিবর্তন হতেই তৃষ্ণা ফোন কেটে ছাঁদ থেকে নেমে যেতে নিলে রাফি পেছন থেকে ডেকে উঠে –
-“ এই ছোট প্যাকেট এদিকে আসো।
তৃষ্ণা মনে মনে হেঁসে মুখে গম্ভীর ভাব এনে রাফির দিকে এগিয়ে যায়।
-“ হ্যাঁ ভাইয়া বলুন।
-“ কাল কোথায় যাচ্ছ তুমি?
-“ এই তো ভাইয়া একটু ঘুরতে যাব।
-“ কোথায় যাবে সেটা জিজ্ঞেস করছি।
-“ সেটা তো ভাইয়া তুর্য জানে।
-“ তুর্য তোমার কি লাগে?
-“ কিছুই না।
-“ তাহলে কোন সাহসে তুমি ওর সাথে বাহিরে যেতে চাচ্ছো?
-“ উনি তো নিজে থেকেই বললো। আমি কি করে মুখের উপর না করে দেই বলুন তো?
-“ ফোন করে বলে দাও তুমি কাল ফ্রী নেই। আমার সাথে বের হবে।
-“ মিথ্যা বলবো?
-“ মিথ্যা কেনো বলবে? সত্যি ই বলবে।
-“ এটা তো সত্যি না।
-“ সত্যি না কেনো?
-“ আপনি তো আমায় শিখিয়ে দিচ্ছেন।
-“ না সত্যি বের হবে কাল আমার সাথে।
-“ কোথায় যাব?
-“ ঘুরতে।
-“ না আমি আপনার সাথে যাব না। তুর্যর সাথেই যাব ভাইয়া।
-“ আর একবার ভাইয়া ভাইয়া করলে ছাঁদ থেকে নিচে ফেলে দিব।
-“ বলবোই ভাইয়া।
-“ না বলবে না।
-“ আপনার ইচ্ছেতে নাকি? আমার যা মন চায় তাই ডাকবো।
-“ ওকে দ্যান তাহলে ছ্যাইয়া,জান বাবু শোনা,কলিজা বলে ডাকো।

তৃষ্ণা রাফির কথা শুনে নাক ছিটকালো।
-“ আপনি আমার জান,কলিজা,বাবু শোনা বা ছ্যাইয়া নন যে এসব বলে ডাকবো। আপনি তো আমার প্রিয় চাচার ছেলে প্রিয় ভাইয়া।
-“ চাচার ছেলে ভাই থেকে জান কলিজা বাবু শোনা, ছ্যাইয়া হতে বেশি সময় লাগে না।
-“ তাতে আমার কি?
-“ তোমারই তো সব শোনা।
তৃষ্ণা আড়চোখে তাকালো রাফির পানে। রাফির মুখে লেগে আছে দুষ্টু হাসি।
-“ আপনার ভাবসাব ভালো লাগছে না। কিসব বলছেন সকাল হলেই ভুলে যাবেন ভাইয়া।
-“ আর ভুলবো না জান।
-“ কি শোনা জান বলছেন ভাইয়া। মাথা ঠিক আছে?
-“ হ্যাঁ বাবু আমার মাথা একদম ঠিক ছিলো কিন্তু তোমাকে দেখে মাথা আউলে গেছে।
-“ লেবুর শরবত খান ভাইয়া। মাথা ঠিক হয়ে যাবে।
-“ তোমার হাতে শুধু লেবুর শরবত কেনো ডার্লিং করল্লার শরবত ও অমৃত ভেবে খেয়ে নিব।

তৃষ্ণা এবার আর দেরি করলো না হন্তদন্ত হয়ে ছাঁদ থেকে নেমে পড়লো। কিসব ডেকে সম্বোধন করছে। সকাল হলে নির্ঘাত ভুলে যাবে। রাফি তৃষ্ণার যাওয়ার পানে তাকিয়ে হোহো করে হেসে উঠে। বিরবির করে বলে-
-“ আমাকে ভালো থাকতেই দিলে না। ভাইয়া বলে বলে হৃদপিণ্ড টা ঝলসে দিলে এবার তোমার হৃদপিণ্ড টা ঝলসানোর বাকি।

———————–

শেষ রাতের দিকে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছিল। রাস্তা কিছুটা কাদায় কানা কানা হয়ে আছে। আকাশ এখনও মেঘলা। অধরা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে আরেক হাতে ছাতা নিয়ে হেঁটে চলছে। গন্তব্য তার ভার্সিটি। পড়নে আজ সাদা রঙের গোল জামা। রাস্তার কাদা নোংরা পানি ছিটকে তার পায়ের লেগে গেছে। যার দরুন সেলোয়ারের নিচের দিকটায় কাদা লাগে।

বিরক্তি তে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে অধরা। চারুকলা ভবনে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে কাদা ধুয়ে নেয়। এরপর চারুকলা ভবন থেকে বেরিয়ে একাউন্টিং ডিপার্টমেন্টে ঢুকে। ক্লাস শেষ করে বটতলা চলে যায়। আপাতত ভর্তা ভাত খাবে সে। বটতলা গিয়ে ভর্তা দিয়ে ভাত খায়। তারপর আবার সেই পদ্ম বিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আজ মনে বাসনা জেগেছে পদ্মবিল থেকে একটা পদ্ম তোলার। কিন্তু নাগালে পাওয়া অসম্ভব পদ্ম। তাই চুপচাপ বসে রইলো। আর তখনই হুড়মুড়িয়ে কাউকে পাশে বসতে দেখলো। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে তৃষ্ণা বসেছে।

হঠাৎ তৃষ্ণা কে দেখে আপনা-আপনি অধরার কপালে দু ভাজ পড়ে। অবাক হয়ে বলে-
-“ তুই এখানে কেনো?
তৃষ্ণা অধরার কাঁধে মাথা দিয়ে বলে-
-“ আজ তো বিয়ের শপিং করার কথা ভুলে গেছো? ভাইয়া গাড়ি নিয়ে এসেছে তোমাকে যেতে বললো।

অধরার বেলুমাল ভুলে গেছিলো আজ যে তুষার চিত্রার বিয়ের শপিং করার কথা। মন কিছুটা খারাপ হলেও সেটাকে পাত্তা দিলো না। এখন থেকেই তাকে বাস্তবতা মানতে হবে। কষ্ট পেলে নিজ ব্যাতিত অন্য কাউকে বুঝতে দেওয়া চলবে না।
অধরা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তৃষ্ণা ও বসা থেকে উঠে অধরার হাত ধরে হাঁটতে থাকে। মেন রোডে আসতেই দেখে তুষারের ব্লাক রঙের গাড়িটা। অধরা তৃষ্ণা এগিয়ে গেলো। ড্রাইভিং সিটে তুষার আর তার পাশে চিত্রা বসে আছে।চিত্রা অধরা কে দেখা মাত্রই মিষ্টি করে হেঁসে জিজ্ঞেস করলো-
-“ কেমন আছো আপু?
অধরা প্রতিত্তোরে চমৎকার হাসি উপহার দিয়ে বলে-
-“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো চিত্রা?
-“ আলহামদুলিল্লাহ আমিও ভালো আছি।
অধরা আর কিছু বললো না। তৃষ্ণা আর অধরা পেছনের সিটে বসে পড়লো। তুষার তৎক্ষনাৎ গাড়ি স্টার্ট দেয়। ওদের শপিং করিয়ে তারপর পার্টি অফিসে ছুটতে হবে। ইলেকশন যতো এগিয়ে আসছে ততই তুষারের এদিক ওদিক ছোটাছুটির মাত্রা বেড়ে গেছে। তুষার খুব একটা প্রয়োজন ছাড়া চিত্রার সাথে কথা বলছে না। এ নিয়ে চিত্রার মন প্রচুর খারাপ। কাল কি বেশি করে ফেলছে সে? চিত্রা কি খুব বেশি কিছু চেয়েছে তার কাছে? প্রিয় মানুষটার কাছ থেকে কি নিজের জন্য একটু গুরুত্ব চাওয়া অপরাধ? সবাই চায় তার প্রিয় মানুষ টা তাকে একটু পরপর ফোন করে খোঁজ খবর নিক। চিত্রা ও তো তাই চেয়েছে সে নিয়ে না হয় একটু অভিমানে বলেছে তাই বলে কথা বলবে না?
বসুন্ধরা শপিং মলের সামনে এসে গাড়ি থামায় তুষার। গাড়ি থেকে বের হয়ে ইশারায় চিত্রা কে নামতে বলে। চিত্রা চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে তুষারের পাশে দাঁড়ায়।
এদিকে তৃষ্ণা অধরা গাড়ি থেকে নেমে সামনে তাকাতেই দেখে রাফি আর রাতুল দাঁড়িয়ে আছে। রাফি তুষার কে দেখা মাত্র ই তুষারের কাছে এসে বলে-
-“ আসতে এতো দেরি করে কেউ ব্রো?
তুষার উত্তর দিলো না। চিত্রর ডান হাত নিজের বা হাত দ্বারা মুঠোবন্দি করে মলের ভেতর ঢুকে। রাতুল আঁড়চোখে অধরা কে দেখে নেয় একবার। মেয়েটার শরীরে আজ ও সাদা পোষাক দেখে অবিলম্বে একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে। মেয়েটার উচিত সাদা রং এর পরিবর্তে অন্য রং এর পোষাক ট্রাই করার।
রাতুল কে দেখে অধরা সৌজন্যমূলক হাসি উপহার দিয়ে ভদ্রতার খাতিরে জিজ্ঞেস করে-
-“ আসসালামু আলাইকুম কেমন আছেন?
রাতুল সালামে জবাব দেয়। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি বলে।
রাফি তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ তুমিও শপিং করবে নাকি জান?
তৃষ্ণা সরু চোখে তাকালো রাফির দিকে।
-“ কি শুরু করছেন কাল থেকে। কথায় কথায় এসব বলে ডাকছেন কেনো? বিরক্তিকর লাগছে এসব ডাক।
রাফি গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলে-
-“ আমার বেশ লাগছে এসব বলে ডাকতে শোনা।
-“ ছোট বোন হই আমি আপনার ভাইয়া।
-“ মায়ের পেটের তো না।
-“ আপনার চাচির পেটের তো।
-“ হুদাই বেহুদা লজিক দাঁড় করিয়ো না তো। চলো ভেতরে তোমাকে শপিং করিয়ে দেই।

তৃষ্ণা ভেঙচি কেটে বলে-
-“ এ্যাহ এমন ভাবে বলছেন মনে হচ্ছে আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড বা বউ।
-“ তুমি তো আমার জান।
তৃষ্ণা রাগান্বিত হলো।
-“ আর একবার জান জান করলে একদম জান টাই কেঁড়ে নিবো।
-“ আমি হাসতে হাসতে সেটাও দিয়ে দিব।
-“ অসহ্যকর।

কথাটা বলে তৃষ্ণা অধরার হাত ধরে মলের ভেতর ঢুকে পড়ে।
রাফি হাসতে হাসতে রাতুলের কাছে এসে বলে-
-“ ভাই চলো ভেতরে যাই।
রাতুল রাফির পিঠে ধপাস করে একটা কিল বসিয়ে বলে-
-“ ছোট বোনকে জালাচ্ছিস কেনো?
-“ ওর এটাই প্রাপ্য।
-“ কিছু চলছে নাকি দু’জনের মাঝে?
-“ সে-রকম ই কিছু একটা। চলো এবার আমার উপর গোয়েন্দাগিরি না করে।

তুষার চিত্রা কে নিয়ে লেহেঙ্গার দোকানে ঢুকে। দোকানদার তুষার কে দেখামাত্র ই সালাম দেয়। তুষার সালামের জবাব দেয়। দোকানদার কে বিয়ের জন্য টপ কালেকশনের লেহেঙ্গা দেখাতে বলে। দোকান দার তার দোকানে থাকা টপ কালেকশনের দশটা ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইনের লেহেঙ্গা দেখায়। চিত্রার চোখ আটকে যায় লেমন কালারের একটা লেহেঙ্গায়। বিয়েতে কেউ লেমন কালারের লেহেঙ্গা পড়ে আশ্চর্য! তুষার ইশারায় চয়েস করতে বললো। চিত্রা ভেবে পেলো না কোনটা নিবে।
-“ আপনি পছন্দ করে দিন।
তুষার বাক্য ব্যয় করলো না। লেমন কালারের লেহেঙ্গা টা তুলে প্যাক করে দিতে বললো। চিত্রা ফিসফিস করে তুষার কে বলল-
-“ বিয়েতে কেউ লেমন কালার পড়ে?
-“ ব্লাক পড়বে?
চিত্রা ভরকে গেলো। প্রতিত্তোরে কিছু বললো না। শাড়ির দোকানে গিয়ে গায়ে হলুদ আর বউ ভাত সহ বিয়ের পরে পড়ার জন্য শাড়ি কিনলো। সাথে কিছু সেলোয়ার-কামিজ। জুতার দোকানে গিয়ে জুতা কিনে গয়নার দোকানে ঢুকে। ডায়মন্ডের নিউ কালেশনের কয়েকটা গয়না সহ স্বর্নের গহনা কিনে।

পুরো টা সময় চিত্রা চুপ ছিলো। পুরো শপিং তুষার একাই করলো। চিত্রা হা হু না কিছুই বলে নি।

এদিকে রাতুল রাফি অধরা আর তৃষ্ণার সাথে। তৃষ্ণা একের পর এক ড্রেস লেহেঙ্গা দেখেই চলছে কিন্তু কোনটা রেখে কোনটা নিবে ভেবে পাচ্ছে না। রাফি তৃষ্ণার কানে ফিসফিস করে বলে-
-“ দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে যাবে শোনা কিন্তু একটাও সিলেক্ট করতে পারবে না। আর আমি তো সেটা হতে দিতে পারি না তাই না। বরং আমিই সিলেক্ট করে দেই।

কথাটা বলে রাফি কমলা রঙের একটা লেহেঙ্গা তুলে ধরে।
-“ এটা নিতে পারো মানবাে সুন্দর।
তৃষ্ণা লেহেঙ্গা টার দিকে তাকালো। সত্যি সুন্দর লেহেঙ্গা টা। তৃষ্ণার চুপচাপ কে সম্মতি ভেবে রাফি দোকানদার কে সেটা প্যাক করে দিতে বলে। তারপর তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ আর কি কি নিবে বলো?
-“ সবে তো একটা লেহেঙ্গা নিলাম। আর কত কিছু নেওয়ার বাকি, গায়ে হলুদ বউ ভাতের পোষাক কিনা লাগবে সাথে জুতা কসমেটিক, জুয়েলারি।
-“ আচ্ছা চলো।

রাফি তৃষ্ণা কে নিয়ে চলে যায়। এদিকে অধরাকে কোনো কিছু নিতে না দেখে রাতুল গলা ঝেড়ে বলে-
-“ আপনি কিছু নিবেন না?
অধরা এদিক ওদিল চেয়ে সব দেখছিলো আকস্মিক রাতুলের কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে-
-“ তেমন কিছুই পছন্দ হচ্ছে না।
-“ এতো এতো পোষাক লেহেঙ্গা শাড়ি তবুও আপনার পছন্দ হচ্ছে না?
-“ আসলে আমার এমন চাকচিক্য পোষাক পছন্দ না।

রাতুল দোকানদারের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে-
-“ ভাই সিম্পলের ভেতর কয়েকটা শাড়ির কালেকশন দেখান।
দোকানদার সিম্পলের ভেতর কয়েকটা শাড়ি বের করলো। রাতুল অধরার দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ এদিকে আসুন দেখুন কোনটা পছন্দ হয়।
অধরা এগিয়ে আসে। শাড়ি গুলো এক নজর দেখে। শাড়ি গুলোর মধ্যে থাকা কাতানের সাদা রঙের শাড়ি টার দিকে হাত বাড়াতেই রাতুল গম্ভীর কন্ঠে বলে-
-“ সাদা টা বাদে সিলেক্ট করুন।
অধরা হাত সরিয়ে আনে।
-“ সাদা টা বাদ কেনো?
-“ কারন আপনি এবার সাদা পড়তে পারবেন না। বিয়ে বাড়িতে কেউ সাদা রঙের পোষাক পড়ে?
-“ আমার সাদা রঙ পছন্দের।
-“ বিয়ে বাড়ির কয়েক টা দিন না হয় পছন্দ কে অপছন্দের তালিকায় রাখুন আর রঙিন কিছু সিলেক্ট করুন।
অধরা ঠোঁট কামড়ে পার্পল আর সবুজ কালারের শাড়ি সিলেক্ট করে। সেই সাথে রাতুল পাশ থেকে সিম্পলের মধ্যে হালকা টিয়া কালারে একটা লেহেঙ্গা আনে। তিনটে জিনিস প্যাক করতে বলে রাতুল।
অধরা লেহেঙ্গার দিকে তাকিয়ে বলে-
-” গার্লফ্রেন্ডের জন্য নিলেন ওটা?
রাতুল ঠোঁট চেপে হাসলো।
-“ না আপনার জন্য।

অধরা কিছু বলতে নিবে তার আগেই রাতুল বলে উঠলো-
-“ কোনো ওয়ার্ড যেনো বের না হয় মুখ দিয়ে। প্যাক করা শেষ পেমেন্ট ও করা শেষ সো আপনাকে নিতে হবে ওটা। বিয়ের দিন পড়বেন লেহেঙ্গা টা।

অধরা আর কিছু বললো না।

#চলবে?

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব২৪( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripti

-“ আপাতত এই প্যাক গুলো আপনার। আর বাকি গুলো বিয়ের পর পাবেন।

চিত্রা দের বাসার সামনে গাড়ি থামিয়ে চিত্রা কে সাতটা শপিং ব্যাগ দিয়ে কথাটা বলে তুষার। এই সাতটা শপিং ব্যাগে মূলত বিয়ে গায়ে হলুদের সহ আউট দুই তিনটে ড্রেস আর কসমেটিক আছে । চিত্রা শপিং ব্যাগ গুলো হাতে নেয়। তুষারের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে থেকে মিহি কন্ঠে বলে-
-“ ভেতরে আসবেন না?
তুষার গাড়িতে বসতে বাতে জবাব দেয় –
-“ না, আপনি ভেতরে গিয়ে রেস্ট নিন। টায়ার্ড ফিল হচ্ছে নিশ্চয়ই।
-“ রেগে আছেন আমার উপর?
-“ আপনার উপর রেগে থাকা যায় নাকি?
-“ তারমানে ছিলেন রেগে?
-“ না। বাসার ভেতরে যান,রাতে ফোন দিব।

তুষার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো। চিত্রা শপিং ব্যাগ গুলো নিয়ে বাসার ভেতর ঢুকে। সোফায় চয়নিকা বেগম, সিমি আর রিয়াদ বসে ছিল। চিত্রা কে দেখা মাত্র ই সিমি দৌড়ে চিত্রার কাছে আসে। ব্যাগ গুলোর দিকে তাকিয়ে উৎকন্ঠিত হয়ে বলে-
-“ দেখি দেখি আপু কি কি কিনলে।
চিত্রা ব্যাগ গুলো সিমির হাতে দিয়ে ক্লান্ত শরীর টা নিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিলো। চয়নিকা বেগম রান্না ঘর থেকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে চিত্রার মুখের সামনে ধরে ইশারায় খেতে বলে।

চিত্রার এই পানি টুকুই দরকার ছিলো। ঢকঢক করে গ্লাসের পানি টুকু খেয়ে সামনে থাকা ছোট্ট টেবিল টায় রাখতেই রিয়াদ বলে উঠে –
-“ আমাদের ও বলতে চিত্রা আমি আর সিমি ও যেতাম। আমাদের ও কিছু শপিং বাকি আছে।
চিত্রা পূনরায় সোফায় মাথা ঠেকিয়ে বলে-
-“ সবে তো আমার শপিং শেষ হলো। বাসার সবার এখনও বাকি। তাদের সাথে গিয়ে করবেন,প্যারা কিসের।

রিয়াদ আর কিছু বলল না। সিমি লেমন কালারের লেহেঙ্গা টা বের করে বলে-
-“ ওয়াও আপু লেহেঙ্গা টা দারুন তো। কে পছন্দ করছে তুমি নাকি ভাইয়া?
চিত্রা স্মিত হেঁসে বলে-
-“ সব তোর ভাইয়া কিনে দিছে। আমি তো শুধু নামেই তার সাথে গেছি।
-“ বাহ! ভাইয়ার চয়েস দারুন তো।
-“ দেখা শেষ হলে ব্যাগ গুলো আমার রুমে দিয়ে যাস।

কথাটা বলে চিত্রা নিজের রুমে চলে যায়।

গাড়ির সামের সিটে বসে আছে রাফি আর ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি চালাচ্ছে রাতুল। রাতুল গাড়ি আনায় চিত্রা আর তুষার কে তুষারের গাড়িতে একা পাঠিয়ে দেয়। গাড়ির আয়না টা দিয়ে রাতুল আড়চোখে বারবার অধরা কে দেখে চলছে। মেয়ে টা অন্যমনস্ক হয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। দমকা হাওয়া গুলো এসে চুলগুলো বারবার চোখ মুখে উপচে পড়ছে। এতে বেশ বিরক্ত অধরা,চোখ মুখ বারবার কুঁচকে আসছে। ক্লিপ বা কাকড়া থাকলে চুল গুলো কে এতক্ষণে বেঁধে ফেলতো।
কিন্তু হাত খোঁপা করতে চাচ্ছে না সে। হাত খোঁপা করলে আস্ত মহিলা মহিলা লাগবে তাকে। রাতুল নৈঃশব্দ্যে হাসলো। তারপর আবার মনোযোগ দিলো গাড়ি চালানো তে।

তৃষ্ণা ফোন টিপছে গাড়িতে বসে বসে। রাফি শুরু থেকেই লক্ষ করছে তৃষ্ণা ফোন টিপছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। বিষয় টা ভালো লাগছে না রাফির। রাতুল অধরা না থাকলে ফোন টা কেঁড়ে নিয়ে বাহিরে ফেলে দিত।

গাড়িটা এনে খাঁন ভিলার সামনে থামায় রাতুল। রাফি গাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। গাড়ির ডিঁকি থেকে শপিং ব্যাগ গুলো এক এক করে বের করে। তৃষ্ণা কে হাঁক ছেড়ে ডাক দিতেই তৃষ্ণা গাড়ি থেকে বের হয়ে রাফির সামনে দাঁড়ায়। রাফি ইশারায় ব্যাগ গুলো নিতে বলে। তৃষ্ণা ব্যাগ গুলো নিয়ে হাঁটা লাগায়। অধরা গাড়ি থেকে নামার আগেই রাতুল গাড়ি থেকে নামে। গাড়ির দরজা খুলে অধরা কে বের হতে সাহায্য করে। অধরা বের হয় গাড়ি থেকে। রাতুল গাড়ির দরজা টা লাগিয়ে অধরার সামনে দাঁড়ায়। বেশ গম্ভীর কন্ঠে বলে-
-“ বাহিরে বের হলে সব সময় চুল গুলো বেঁধে তারপর বের হবেন। আপনার এই খোলা চুল গুলো আপনি ব্যাতিত অন্য কাউকেও বিরক্ত করে খুব।

রাতুলের এহেন কথা শুনে অধরার কপালে আপনা-আপনি দু ভাজ পড়ে। রাতুল সেটা দেখে গাড়ির ভেতর থেকে একটা শপিং ব্যাগ এনে অধরার সামনে ধরে। ইশারায় নিতে বলে।
অধরা শপিং ব্যাগ টার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নাতীত দৃষ্টি নিয়ে ভ্রু উঁচু করে জিগ্যেস করে, কি?
-“ এটায় সেই সাদা শাড়ি টা আছে যেটা নিতে মানা করেছিলাম।
অধরা অবাকের পর শুধু অবাকই হচ্ছে। তখন তো বলল ঐ শাড়ি নিতে না। আর কিনলোই বা কখন? ব্যাগ টা হাতে না নিয়েই অধরা বলল-
-“ অনেক গুলো তো কিনলাম। এটা আবার কিনলেন কেনো? আর কখনই বা কিনলেন?
-“ সেটা জেনে কাজ কি? আপনার নজর বারবার শাড়ি টার দিকে যাচ্ছিল তাই কিনেছি। আপনি কিন্তু এটা বিয়ের মধ্যে পড়বেন না। যেদিন আপনার মন টা ভীষণ ভালো থাকবে। মনে হবে আজ আর দুঃখ কষ্ট রা আপনার নাগাল পাচ্ছে না সেদিন এই শাড়িতে নিজেকে সাজাবেন।

অধরা শাড়ি টা নিবে কি নিবে না সেই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে। রাতুল বুঝলো বিষয় টা। তাড়া দিয়ে বলল-
-“ মিস অধরা ব্যাগ টা ধরুন হাত ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে তো।

অধরা চট করে ব্যাগ টা নিজের হাতে নিলো। রাতুল মুচকি হেসে বলল-
-“ এবার বাসায় যান। এনজয় করতে থাকুন বিয়ে টা, আসি।
রাতুল গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ির বাহির জানালা দিয়ে একবার তাকালো। অধরা তার পানেই চেয়ে আছে। রাতুল গাড়ি স্টার্ট দিলো। গাড়িটা যতক্ষণ দৃষ্টি সীমার মধ্যে ছিলো ততক্ষণ অধরা পলকহীন ভাবে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে ছিলো। গাড়িটা যেই দৃষ্টি সীমার বাহিরে চলে গেলো ওমনি অধরার বুক টা ধক করে উঠলো। আচমকা বা হাত টা বুকের উপর চলে যায়। ঘনঘন শ্বাস ফেলে বাসার ভেতর ঢুকে পড়ে।

পার্টি অফিসে এসে বসে আছে তুষার। মাস দুয়েক পর ইলেকশন। এখন থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করছে তুষার। সামনে কতবড় দায়িত্ব, সেই সাথে আশেপাশে শত্রুর আনাগোনা বেড়েছে কয়েক ধাপ। প্রতিমুহূর্তে তাকে চিন্তায় থাকতে হয় সাথে সতর্ক। কখন না জানি কোন দিক দিয়ে আক্রমণ করে বসে। তুষার বাবা তামিম খাঁন, আর দাদা তরিকুল খাঁন তুষারের দু পাশে বসে আছে।

সামনের ওপর পাশে বসে আছে হালিম সরকার পাশে তার ছেলে হৃদয়। এখানে এসে শুনতে পারে তুষার এবার নির্বাচনে হালিম সরকারের পরিবর্তে তার ছেলে হৃদয় দাঁড়াবে।
বিষয় টা নিয়ে মোটেও মাথা ব্যাথা নেই তার। মনোনয়ন ফ্রম টা নিয়ে তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে আসে তুষার।

আহমেদ বাড়ি আর খাঁন বাড়ি পুরোদমে সাজানো হচ্ছে। কোথাও কোনো ফাঁক নেই। সিমি চয়নিকা বেগম, রিয়াদ গিয়েছিল শপিং এ তাদের জন্য কেনাকাটা করতে। সাহেল আহমেদ ব্যাস্ত থাকায় যেতে পারে নি। চয়নিকা বেগম নিজেই স্বামীর জন্য নিয়ে এসেছেন। পরশু গায়ে হলুদ,তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। গ্রাম থেকে চিত্রার খালা,মামা,মামি,নানি,ফুফু, এসেছেন। চিত্রার নানা নেই। মারা গেছেন বছর সাতেক আগে। চিত্রার ফুফাতো বোন নুপুর এসে চিত্রার সাথে গল্প করছে।

মেয়েটা এবার ক্লাস নাইনে পড়ে। দেখতে শুনতে ভীষণ কিউট। চিত্রা কথার ছলে বারবার নুপুরের গাল টেনে ধরে। আর প্রতিবারের মতো নুপুর গাল দুটো ফুলিয়ে বলে-
-“ আমার গাল টাকে তুমি ছিড়েই ফেলবে চিত্রা আপু। দেখো সফট্ তুলতুলে গাল টা শক্ত হয়ে গেছে।

চিত্রা খিলখিল করে হেসে উঠতো। কথার মাঝেই হঠাৎ চিত্রার মুঠোফোন টা বেজে উঠে। চিত্রা স্কিনে তাকিয়ে দেখে তুষার ফোন দিয়েছে। বাড়ি জুড়ে মানুষের গিজগিজ। তাই ফোন টা নিয়ে ছাঁদে ছুটলো,পেছন পেছন নুপুর ও আসলো। চিত্রা ফোন টা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভরাট কন্ঠে ভেসে আসলো-
-“ এতো সময় লাগে ফোনটা ধরতে?
-“ খুব বেশি কিন্তু সময় লাগে নি ফোন রিসিভ করতে।
চিত্রার মিহি কন্ঠে বলা কথাটা শুনে নিরবে ঠোঁট কামড়ে হাসলো তুষার।
-“ বলেছিলাম ফোন দিব,দিয়েছি।
-“ ফোন হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম সেজন্য।
-“ বড্ড অপেক্ষা করিয়েছি?
-“ বেশি না অল্প।
-“ এমন অল্প স্বল্প অপেক্ষা কিন্তু প্রায়ই করতে হতে পারে। তবে অপেক্ষারা দীর্ঘ হবে না। পারবেন না অপেক্ষা করতে এমন?

চিত্রার মুখ জুড়ে হাসির রেখা পাওয়া গেল।
-“ খুব পারবো।
-“ কথা দিচ্ছেন তো?
-“ হুমম।
-“ পরে কিন্তু অভিযোগ করতে পারবেন না।
-“ টুকটাক করবো। আমার অধিকার এটা।
-“ সেটাও ঠিক।
-“ রাত জাগবেন না,তাড়াতাড়ি ঘুমাবেন। কারন এরপর কিন্তু রাতে খুব একটা ঘুমানোর সুযোগ পাবেন না।

মুহূর্তে চিত্রার চোখ মুখ জুড়ে লজ্জারা হানা দিলো। গাল দুটো টকটকে টমেটোর মতো লাল হলো। বিরবির করে বলে উঠল-
-“ অসভ্য।
তুষার শুনে ফেললো।
-“ আমি সাধু পুরুষ নই, সত্যি টা আগেই বলে দিলাম। এতে যদি অসভ্যের ট্যাগ নিতে হয় সেটাও না হয় নিলাম।

চিত্রা আর কিছু বললো না। বেশ খানিকক্ষণ সময় নিশ্চুপ থেকে ফোন রাখছি বলে ফোনটা কেটে দিলো চিত্রা। নুপুর পুরে টা সময় চিত্রার দিকে চেয়ে ছিল।

তুষারদের দোতালা বাড়িটা সাদা মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো। বিয়ের গেটটা কি সুন্দর দেখাচ্ছে! অপূর্ব সাজবাতি!
ইশশ… চোখে চোখে ভীষণ বিঁধছে আলোগুলো? কেন যেনো মনে হচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট মরিচ বাতি বিদ্রুপ করে হাসছে অধরার দিকে চেয়ে।

খোলা ছাদে হলুদের স্টেজ। গাঁদা ফুলের গন্ধ বাতাসের সাথে মিশে একাকার। বাড়ির সবার কি একটা উত্তেজনা, আনন্দ। চারিদিকে রংমহলের খেলায় অধরার যেনো ফিকে এক রঙহীন। ভালবাসার মানুষের ভালো থাকাটাই তো সবচেয়ে প্রিয় হওয়া উচিত। আচ্ছা ভালোবাসলে কি সবাই এমন স্বার্থপর হয়ে যায়?
সাউন্ড স্পিকারের গানবাজনা হচ্ছে! প্রিয় মানুষটার অন্যের হয়ে যাওয়ার উৎসব!
অধরা নির্বিকারচিত্তে ছাঁদের এক পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে সব। মনে বইছে অশান্তির ঝড়। আর কয়েক টা প্রহর তারপর এই পুরুষ টি তার জন্য চিরকালের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।

কথায় আছে নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ জন্মায় বেশি। এই পুরুষ টা তার জন্য নিষিদ্ধ কথাটা মনে আসতেই ঠেলে কান্না পাচ্ছে অধরার।
আজ পড়নে তার পার্পল রাঙের সেই শাড়ি। যেটা সেদিন কেনা হলো। মুখে হালকা সাজ,শরীরে তাজা ফুলের গহনা। শরীরের পারফিউম আর তাজা ফুলের গন্ধে পাশে থাকা রাতুলকে বারংবার মাতোয়ারা করে তুলছে। কেউ যে তাকে মুগ্ধ দৃষ্টি তে দেখে চলছে সেদিকে অধরার ভ্রুক্ষেপ নেই। অধরা মনে তো না পাওয়ার যন্ত্রণা টার মাত্রা ভারি হচ্ছে।

তামিম খাঁন এখনও ছেলেকে স্টেজে দেখতে না পেয়ে রাফিকে ডাকেন। ডেকে তাড়াতাড়ি তুষারকে আসতে বলেন। ও বাড়িও তো যেতে হবে।

রাতুল অধরার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাফি সাথে নিচে নামলো।
তুষার নিজের রুমে বসে ল্যাপটপে কিছু একটা ঘেঁটে দেখছে। রাতুল ভেতরে এসে তুষার কে ল্যাপটপে ডুবে থাকতে দেখে তুষারের পিঠে কিল দিয়ে বলে-
-“ আজ তোর গায়ে হলুদ আর তুই এখনও ল্যাপটপে মুখ ডুবিয়ে বসে আছিস!
তুষার ল্যাপটপ বন্ধ করলো। বসা থেকে উঠে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে নিলো। তারপর রাতুলের দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ চল।
তুষারের ছাঁদে আসা মাত্রই অধরার বুক কেঁপে উঠলো। সাদা পাঞ্জাবি তে লোকটাকে কি সুন্দর লাগছে। তৃষ্ণা দৌড়ে গেলো ভাইয়ে কাছে। তুষারের হাত ধরে স্টেজের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল-
-“ উফ ভাইয়া আজকের দিনেও এতো লেট করে কেউ? ওদিকে যে চিত্রা তোমার জন্য অধীর হয়ে বসে আছে।

তুষার বিনিময়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। তানিয়া বেগম আর তামিম খাঁন এসে ছেলের গালে হলুদ ছোয়ালো। এরপর তরিকুল খাঁন ও তার স্ত্রী তাসলিমা খাঁন এসে তুষার কে হলুদ ছায়ালো। চিত্রা দের ও বাড়ি থেকে রিয়াদ সিমি নুপুর আর চিত্রার মামা,ফুফু এসেছে। রিয়াদ বারবার তুষারের দিকে তাকাচ্ছে। ছেলেটা রিয়াদের থেকে অত্যাধিক সুদর্শন এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। সিমি বারবার রিয়াদ কে বলে চলেছে-
-“ দেখো চিত্রা আপুর স্বামী টা কি হ্যান্ডসাম।
প্রতিত্তোরে রিয়াদ বিরক্তিকর চাহনি দিচ্ছে সিমি কে। নুপুর অধরার পাশে বসে আছে। সবাই হলুদ শাড়ি পড়েছে কেবল অধরাই পার্পল। চোখে চশমা থাকায় নুপুরে মনে হলো মেয়েটা শান্ত,গম্ভীর আর ভীষণ পড়ুয়া মেয়ে।
অধরা খেয়াল করলো নুপুর নামের মেয়েটা বারবার তার দিকে তাকাচ্ছে। অধরা এবার নুপুরের দিকে ঘুরে বসে বলে-
-“ এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে কেনো দেখছো?ভালো করে দেখো।
নুপুর ভরকে গেলো। চুরি করে ধরা পড়লে যেমন টা হয় ঠিক তেমন টাই। অধরা স্মিত হাসলো। মুহূর্তে পাশে কারো বসার অস্তিত্ব টের পেতেই দেখে রাতুল এসে আসেছে। মুখে হাতে তার হলুদ লেগে আছে। অধরার দিকে চেয়ে বলে-
-“ ভাইয়ে বিয়েতে কেউ এমন নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে? হলুদ লাগিয়ে আসুন।
অধরার মন আবার অশান্ত হয়ে গেলো। যতই মন কে শান্ত করতে চাচ্ছে হুটহাট এক একটা কান্ড তাকে সেটা মনে করিয়ে দিচ্ছে। তৃষ্ণা ও দৌড়ে আসলো অধরার হাত ধরে বলল-
-“ আপু আসো তুমিই বাকি আছো শুধু। তাড়াতাড়ি হলুদ লাগাও ছবি তুলবো।

অধরা যথই স্টেজের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো ততই নিঃশ্বাস টা যেনো বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো। এমন যন্ত্রণা কেনো হচ্ছে স্বাভাবিক হতে পারছে না কেনো? মনের উপর রাজত্ব চলে না তাই বলে কি মন বুঝতে পারছে না তার কষ্ট টা? এতোটা নির্দয় হয় কেনো মন?
কাঁপা কাঁপা পায়ে স্টেজে এগিয়ে গেলো। হলুদ টা হাতে ছোঁয়াতেই হৃদপিণ্ড টায় রক্তক্ষরণ হতে লাগলো। ইশ কি অসহ্য ব্যাথা। কাঁপা কাঁপা হাতে সেটা তুষারের গালে ছোঁয়াল। মনে মনে কয়েকবার উচ্চারণ করলে-
-“ অতঃপর শখের পুরুষ আজ থেকে আপনি আমার কাছে চিরকালের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে দাঁড়ালেন। আপনার আর আমার ভিন্ন রাস্তা ভিন্ন সংসার হবে। আপনাকে আর এ জীবনে পাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো।

আর এক সেকেন্ড ও দেরি করলো না হন্তদন্ত হয়ে নিজের রুমের দিকে ছুটে গেলো। এভাবে কি কষ্ট আটকে রাখা যায়?

যায় না,এখন তো সাউন্ড বক্সে গান বাজছে। রুমের ভেতর গলা ফেটে কান্না করলেও কেউ বুঝবে না। কান্না করে যদি একটু মনের কষ্ট টা হালকা হয়ে এই মরণব্যাধি যন্ত্রণা থেকে খানিকটা মুক্তি পাওয়া যায় তাহলে তাই সই।

#চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে