আমার ভীনদেশী এক তারা পর্ব-০১

0
1002

#Raiha_Zubair_Ripte
#আমার_ভীনদেশী_এক_তারা
#সূচনা_পর্ব

দীর্ঘ ছয়টি বছর পর আবার পা রাখলাম সেই চিরচেনা শহরে। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে সামনে তাকাতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটাকে দেখতে পেয়ে পুরোনো অতীতটা আবার মনে পড়ে গেলে। বুকের বা পাশটায় চিনচিন ব্যাথা অনুভূত হলো সেই সাথে ভালোবাসার মানুষ টাকে না পাওয়ার যন্ত্রণা টাও আরো প্রকোপ হলো। প্রিয় মানুষটিকে পেয়েও হারিয়ে ফেলার যন্ত্রনাটা বোধয় পৃথিবীর সব চাইতে বেদনাদায়ক। এই সেই অল্পদিনেই প্রিয় হওয়া অপ্রিয় আলবার্টা শহর। ঠিক ছয়টি বছর আগে এমনই এক দিনে ভাঙা হৃদয় নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলাম নিজ জন্মভূমিতে। কথাটা ভাবতেই এনার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া নোনাজল টুকু সন্তপর্ণে মুছে ল্যাগেজ টা হাতে নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ টাকে পাশ কাটিয়ে আরাভের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আরাভ এনার চাচা তো ভাই। আরাভ এগিয়ে এসে এনার ল্যাগেজ টা হাতে নিয়ে বলে,,,

” তোমার আসতে অসুবিধা হয় নি তো এনা?

এনা একবার আড় চোখে আরাভের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি মাটিতে নিবন্ধ করে বলে,,

” না ভাইয়া এর আগেও তো একবার এসেছি থেকেছি কতগুলো বছর এই শহরে। আসতে কোনো অসুবিধে হয় নি।

” পিটার চল তাহলে যাওয়া যাক।

পিটার এতোক্ষণ ধরে এনার পানে চেয়েছিল। কতো গুলো বছর পর আজ এনাকে দেখতে পেলো। মূহুর্তটা থেমে গিয়েছিলো। একটা ঘোরে চলে গেছিলো পিটার। পিটার ভাবতে পারে নি এনা সত্যি সত্যি আবার ফিরবে দ্বিতীয় বার এই শহরে। মেয়েটার চোখ মুখে আগের ছয় বছরের সেই লাবণ্যতা নেই। আগের থেকেও শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালো দাগ। আরাভের কথায় পিটারের ভ্রু দুটি বিরক্তিতে কুঁচকে গেলো। আরাভের এখনই কেনো যাওয়ার কথা বলতে হবে?আরেকটু পরে বললেও তো পারতো। ভাগ্যিস আজ আরাভের গাড়িটা মাঝ রাস্তায় নষ্ট হয়েছিলো ভাগ্যক্রমে আমি ও যাচ্ছিলাম সেই রাস্তা দিয়ে তাই তো আজ এতো গুলো বছর পর ভালোবাসার মানুষ টাকে একনজর দেখতে পেলাম। এনার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আরাভের দিকে তাকিয়ে বলে,,

” হুমম তোরা গাড়িতে গিয়ে বস।

এনা আর আরাভ গাড়িতে গিয়ে উঠে বসে। এনা একটিবার পেছনে ফিরে তাকালে হয়তো দেখতে পারতো অশ্রু ভরা দুটি চোখ তার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেই দৃষ্টিতে ছিলো ভালোবাসার মানুষটাকে না পাওয়ার অসংখ্যাত বেদনা।

এনা গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে এক ধ্যানে। পুরো আকাশ টা কালো মেঘে ঢাকা। রাস্তায় লোকগুলো ছুটে যাচ্ছে বাড়ির পানে। বাতাস বইছে সাথে রাস্তার ধুলোবালি গুলো বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে উড়ছে। শীতল ঠান্ডা বাতাস সেই বাতাস গুলো এসে এনার মুখমন্ডলে উপচে পড়ছে। অবাধ্য চুল গুলো বারংবার সামনে এসে বিরক্ত করছে। লুকিং গ্লাসে পিটার বারবার আড় চোখে সেটা দেখছে।

গাড়িটা হঠাৎ কানাডার আলবার্টা শহরের ব্যান্ফ ন্যাশনাল পার্কের সামনে দিয়ে যেতেই এনার বুকটা ধক করে উঠলো। অজান্তেই চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল দু ফোটা অশ্রু। এই সেই পার্ক প্রিয় মানুষটার সাথে প্রথম সাক্ষাৎকার স্থান। আড় চোখে একবার সামনে গাড়ি ড্রাইভ করতে তাকা পিটারের দিকে তাকাতেই তাদের চোখাচোখি হয়। পিটার ও তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। এনা নিজের চোখ সরিয়ে নেয়। আরাভ দু একটা কথা জিজ্ঞেস করছে এনাকে আর এনা হ্যাঁ না হুমম বলে উত্তর দিচ্ছে। পিটারের সামনে থাকতে তার অনেকটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। শুধু সময় গুনছে কখন বাসায় পৌঁছাবে সে আর এই মানুষটার দৃষ্টির অগোচর হবে।

দীর্ঘ তিনঘণ্টা পর গাড়ি এসে থামলো দু তোলা একটি ডুপলেক্সের সামনে। এনা তড়িঘড়ি করে সবার আগে গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে। আর একটু গাড়ির মধ্যে থাকলে হয়তো দম বন্ধ করে ম’রেই যেত। মানুষটার দৃষ্টিতে বারবার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। আদৌও কি আমি সত্যিই অপরাধী!

আরাভ এনাকে এভাবে নেমে যেতে দেখে মৃদু হেসে উঠে। পিটারের দিকে তাকিয়ে বলে,,

” বাসার ভেতর চল।

পিটার সদর দরজার দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করে বলে,,

” না এখন আর যাবো না। তুই বাসায় যা আরাভ।

আরাভা এনার ল্যাগেজ টা নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে একবার পিটারের দিকে তাকিয়ে বাসার ভেতর ঢুকে পড়ে।

এনার ভেতরে ঢুকতেই তার চাচি রত্না বেগম ছুটে আসে। এনার মুখে কপালে অসংখ্য চুমুতে ভরে দেয়। গালে হাত দিয়ে ছলছল নয়নে শুধায়,,,

” নিজ দেশে গিয়ে ভুলে গেছিলি এই চাচি টাকে। একটাবার ও ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নিলি না। খুব পর করে দিয়েছিলি।

এনা রত্না বেগম কে জড়িয়ে ধরে।

” সরি চাচি।

রত্না বেগম এনাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে বলে,,

” হয়েছে হয়েছে আর সরি বলতে হবে না যাও ফ্রেশ হয়ে আসো তারপর দেখছি তোমায়।

আরাভ ল্যাগেজ টা বাড়ির কাজের লোকের কাছে দিয়ে এনার ঘরে পাঠিয়ে দেয়। এনা সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে আসে। রুমে ঢুকে বেশ অবাক হয় সেই আগের মতোই তার রুম টা গোছানো রয়েছে। তার চাচি এই রুমটা ঠিক সময় করে গুছিয়ে রেখেছে। কথাটা ভাবতেই মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে। এই চাচি টা তাকে পা’গলের মতো ভালোবাসে। নিজের তো মেয়ে নেই। দুটো ছেলেই শুধু।

এনা ল্যাগেজ থেকে ব্লু কালারের টপস বের করে ওয়াশরুমে চলে যায় গোসল করতে। ওয়াশরুম থেকে গোসল সেরে দেখে আকাশের বুক চিঁড়ে ঝোড়ো বৃষ্টি নামা শুরু করেছে। থেকে থেকে বিদ্যুৎ ও চমকে উঠছে সেই সাথে আছে তো বাতাসের তীব্রতা। এনা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বেলকনিতে এসে সামনে তাকাতেই বুকটা দুমড়ে মুচড়ে উঠলো এনার। গলাটা ধরে আসলো শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিলো। দু হাত দিয়ে মুখ চেপে দৌড়ে রুমে চলে আসে। মানুষ টা এমন করছে কেনো? তাকে দেখলে যে আমার কষ্ট টা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। কেনো দেখা হলো আবার তার সাথে আমার। আমি তো আজও তার মায়া থেকে বেড়িয়ে আসতে পারি নি। সে তো দিব্যি বউ সন্তান নিয়ে সুখে আছে তাহলে কেনো? কথাটা বলেই দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কান্না করতে থাকে এনা।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে